মসজিদে ‘আল-আকসা’ নির্মাণের ইতি কথা
-এম এ রাজ্জাক
হাওলাদার
মুসলমানদের প্রথম কিবলা মসজিদে আল-আকসা। অসংখ্য নবী ও রাসুলের পুণ্যভূমি এ মসজিদ। অত্যন্ত বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে এ মসজিদকে মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিষ্টান তিন ধর্মের অনুসারীরাই নিজেদের দাবি করে এবং তীর্থস্থান বলে দাবিও করে।
আল-আকসা মুসলমানদের প্রথম কিবলা। ছবি: সংগৃহীত
অসংখ্য নবী, রাসুল, সাহাবি, তাবেয়িদের পুণ্যভূমি মসজিদুল
আকসা। পবিত্র এ মসজিদ খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৯৫৭ সালে প্রথম নির্মাণ হয়।
খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ১০০৪ সালে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে
বিভিন্ন যুগে এর সংস্কার হতে থাকে। ঐতিহাসিক এ মসজিদটি ৩৫ একর জমির ওপর
নির্মিত। মসজিদের নির্মাণশৈলী মুসলিম ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে।
এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ: قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ: أَيُّ مَسْجِدٍ
وُضِعَ فِي الْأَرْضِ أَوَّلُ؟ قَالَ: «الْمَسْجِدُ الْحَرَامُ» قُلْتُ: ثُمَّ
أَيٌّ؟ قَالَ: «الْمَسْجِدُ الْأَقْصَى» قُلْتُ: كَمْ بَيْنَهُمَا؟ قَالَ:
«أَرْبَعُونَ سَنَةً، وَأَيْنَمَا أَدْرَكَتْكَ الصَّلَاةُ فَصَلِّ فَهُوَ
مَسْجِدٌ» وَفِي حَدِيثِ أَبِي كَامِلٍ «ثُمَّ حَيْثُمَا أَدْرَكَتْكَ الصَّلَاةُ
فَصَلِّهِ، فَإِنَّهُ مَسْجِدٌ»
বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু জর
গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, “আমি বললাম, হে আল্লাহর রসুল! পৃথিবীতে
নির্মিত প্রথম মসজিদ কোনটি?
প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
মসজিদুল হারাম। আমি পুনরায়
জিজ্ঞেস করলাম,
তারপর কোনটি? প্রতিউত্তরে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন,
তারপর হলো মসজিদুল আকসা। এরপর
আমি জানতে চাইলাম যে,
উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত বছরের? তিনি বললেন ৪০ বছরের ব্যবধান। (সহিহ বুখারী:৩১১৫,৩৩৬৬শামে; মুসলিম: ১০৫২ ইসে; শামেলা-৫২০)
মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল-আকসা সর্বপ্রথম ফেরেশতাদের
মাধ্যমে অথবা আদম (আ.)-এর কোন সন্তানের মাধ্যমে নির্মিত হয়। উপর্যুক্ত হাদিস থেকে
জানা যায়,
পবিত্র মসজিদ কাবা শরীফ
নির্মাণের চল্লিশ বছর পরে নির্মিত হয়। হজরত ইয়াকুব (আ.) কে মহান আল্লাহ
নির্দেশ দিলে তিনি তা পুনর্নির্মাণ করেন। তার প্রায় হাজার বছর পরে হজরত দাউদ (আ.)
পুনর্নির্মাণ শুরু করেন। হজরত দাউদ (আ.) নির্মাণ শেষ করতে পারেননি। তার ছেলে হজরত
সুলাইমান (আ.)-এর হাতে তার সংস্কার সমাপ্ত হয়।
হজরত সুলাইমান (আ.) ছিলেন একজন নবী। পৃথিবীর ইতিহাসে সেরা
প্রতাপশালী বাদশাহদের একজন। তার রাজত্বকাল ছিল প্রায় ৯৭০ থেকে ৯৩০
খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী। তিনি ছিলেন হজরত দাউদ (আ.)-এর ছেলে। হজরত
সুলাইমান (আ.) আল-আকসা ঘিরে জেরুজালেম নগরী প্রতিষ্ঠা করেন।
মহান আল্লাহ তাকে এমন নেয়ামত দিয়েছেন যা অন্য কোনো নবীকে
দেননি। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,
وَوَهَبْنَا لِدَاوُودَ سُلَيْمَانَ نِعْمَ الْعَبْدُ إِنَّهُ
أَوَّابٌ
“আমি দাউদের জন্য সুলাইমানকে
দান করেছিলাম,
সে কতই না উত্তম বান্দা।
অবশ্যই সে ছিল আমার প্রতি প্রত্যাবর্তনশীল।” (সুরা সদ-৩৮: ৩০)
মসজিদে আল-আকসা
নির্মাণে জিন জাতি:
মহান আল্লাহ জিনদের বশীভূত করার ক্ষমতা হজরত সুলাইমান (আ.)
কে দান করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,
وَلِسُلَيْمَانَ الرِّيحَ غُدُوُّهَا شَهْرٌ وَرَوَاحُهَا شَهْرٌ
وَأَسَلْنَا لَهُ عَيْنَ الْقِطْرِ وَمِنَ الْجِنِّ مَنْ يَعْمَلُ بَيْنَ يَدَيْهِ
بِإِذْنِ رَبِّهِ وَمَنْ يَزِغْ مِنْهُمْ عَنْ أَمْرِنَا نُذِقْهُ مِنْ عَذَابِ
السَّعِيرِ
“আর আমি সুলাইমানের অধীন
করেছিলাম বাতাস,
যা সকালে এক মাসের পথ ও বিকালে
এক মাসের পথ অতিক্রম করত। আমি তার জন্যে গলিত তামার এক ঝরনা প্রবাহিত করেছিলাম।
কতক জিন তার সামনে কাজ করত তার পালনকর্তার আদেশে। তাদের যে কেউ আমার আদেশ অমান্য
করবে,
আমি জ্বলন্ত অগ্নির-শাস্তি
আস্বাদন করাব। তারা সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউজসদৃশ বৃহদাকার পাত্র ও
চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত। হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতা সহকারে
তোমরা কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পসংখ্যকই কৃতজ্ঞ।” (সুরা সাবা-৩৪:১২)
জিনদের দিয়ে হজরত সুলাইমান (আ.) অনেক কাজ করাতেন। জিনেরা
সাগরে ডুব দিয়ে তলদেশ থেকে মূল্যবান মণি-মুক্তা, হীরা-জহরত তুলে আনত। ঈমানদার জিনেরা সাওয়াবের আশায় হজরত
সুলাইমান (আ.)-এর আনুগত্য করত। দুষ্ট জিনগুলো সুলাইমানের (আ.)-এর ভয়ে কাজ করত।
মহান আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে থাকায় এ দুষ্ট জিনরা হজরত সুলাইমান (আ.)-এর কোনো ক্ষতি
করতে পারত না। বরং সর্বদা তার নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুত থাকত। জিনদের মাধ্যমেই
আল-আকসা নির্মাণ ও সংস্কার করেন হজরত সুলাইমান (আ.)।
আল-আকসার মূল নির্মাণ কাজ পূর্ণ শেষ হওয়ার পূর্বেই হজরত
সুলাইমান (আ.)-এর শেষ সময় চলে আসে। অথচ এই কাজগুলো অবাধ্য জিনদের উপরে ন্যস্ত ছিল।
দুষ্ট জিনেরা হজরত সুলাইমান (আ.)-এর ভয়ে কাজ করত। যদি তারা মৃত্যু সংবাদ জানতে
পারে কাজ ফেলে পালিয়ে যাবে। তাই নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য মহান আল্লাহর
নির্দেশে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে হজরত সুলাইমান (আ.) কাচ নির্মিত মেহরাবে
প্রবেশ করেন। যাতে বাইরে থেকে ভেতরের সবকিছু দেখা যায়। তিনি বিধান অনুযায়ী ইবাদতের
উদ্দেশ্যে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে গেলেন। যেন রুহ বেরিয়ে যাবার পরেও লাঠিতে ভর দিয়ে
স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে।
নবী এক বছর লাঠিতে
দাড়িয়ে থাকেন:
মহান আল্লাহর নির্দেশে তার দেহ লাঠিতে ভর করে এক বছর
দাঁড়িয়ে থাকল। সুবহানাল্লাহ! দেহ পচেনি, পড়ে যায়নি। দুষ্ট জিনেরা ভয়ে কাছে যায়নি। ফলে তারা
হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে কাজ শেষ করে। এভাবে পূর্ণ কাজ শেষ হলে মহান আল্লাহর হুকুমে
কিছু উই পোকা খেয়ে লাঠি ভেঙ্গে দেয়। লাঠি ভেঙ্গে যাওয়ায় হজরত সুলাইমান
(আ.)-এর দেহ মাটিতে পড়ে যায়। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন,
فَلَمَّا قَضَيْنَا عَلَيْهِ الْمَوْتَ مَا دَلَّهُمْ عَلَى مَوْتِهِ
إِلَّا دَابَّةُ الْأَرْضِ تَأْكُلُ مِنْسَأَتَهُ فَلَمَّا خَرَّ تَبَيَّنَتِ
الْجِنُّ أَنْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ الْغَيْبَ مَا لَبِثُوا فِي الْعَذَابِ
الْمُهِينِ
“যখন আমি
সুলাইমানের মৃত্যু ঘটালাম,
তখন ঘুনপোকাই জিনদেরকে তার
মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করল। হজরত সুলাইমানের লাঠি খেয়ে যাচ্ছিল। অতঃপর যখন তিনি
মাটিতে পড়ে গেলেন,
তখন জিনেরা বুঝতে পারল যে, যদি তারা অদৃশ্য বিষয় জানতো, তাহলে তারা (মসজিদ নির্মাণের) এই হাড়ভাঙ্গা খাটুনির আজাবের
মধ্যে আবদ্ধ থাকতো না।”
(সুরা সাবা-৩৪ : ১৪)