Monday, September 14, 2020


অন্তিম যাত্রা এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
প্রতীকী ছবি
ইকরা। সম্পর্কে ভাগিনা হলেও বয়সে বড় হওয়ায় মামা ডাকতাম। বেশ মজার মানুষ তিনি। কিন্তু আজ অবধি মামার সঙ্গে খুব বেশি চলাফেরা হয়নি। দেখা-সাক্ষাৎ হতো বছরে দু-একবার। তাই দেখা হবে শুনলেই নিজের মধ্যে কিছু হাসি জমিয়ে রাখতাম। এরপর কখন মজা করবে, আর কখন একটু পেটপুরে হেসে নিবো সেই অপেক্ষায় থাকতাম।
কয়েক বছর আগে মামার কিডনি দুটো নষ্ট হয়ে যায়। এরপর অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি মামাকে।
২০১৯ সালের পহেলা নভেম্বর শেষবারের মতো পৃথিবীটা ঝাপসা চোখে দেখেছিলো। এরপর চিরতরে চোখ দুটো বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে।
মামার ছোট ভাই আখিল; সেও বছরখানেক আগে কিডনি রোগে মারা গেছে। চোখের সামনে দুটো মানুষকে বেড়ে উঠতে আর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে দেখলাম।
মৃত্যুর দুদিন আগেই খবর এসেছিলো মামা মারা গেছে। ৩০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসহ নানা ব্যস্ততার কারণে চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয়নি। পরে শুনলাম; কে যেন বিদেশ থেকে রওনা দেওয়ায় তার জন্য জানাযা একটু দেরিতে পড়বে। সেই রাতে যখন 'জানাযা পড়তে পারিনি' ভেবে আফসোস হচ্ছিলো, ঠিক তখনি এ খবর পেলাম। পরদিন সকালে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পর বাড়ি থেকে ফোন দিয়ে জানালো-মামা মারা যায়নি। বেশ অবাক হলাম। পরে শুনলাম অ্যাম্বুলেন্সযোগে বাড়িতে মরদেহ আনার পথে সঙ্গে থাকা কেউ একজন বুঝতে পেরেছে ফুসফুস এখনো সচল। এরপর আবার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
যাই হোক,মনে কিছুটা স্বস্তি এলো। ভাবলাম বাড়ি যেহেতু যাচ্ছি হাসপাতালে গিয়ে একবার দেখে আসবো। ৩১ অক্টোবর রাতে মনে মনে সেই পরিকল্পনাই করছিলাম। কিন্তু রাত ১০টায় আবার খবর এলো- মামা এবার সত্যিই মারা গেছে। নিমিষেই ভেস্তে গেল সব পরিকল্পনা। ওদের বাড়ি থেকে জানালো, জানাযা তিন জায়গায় হবে।
পরদিন সকালে আমরা জানাযার উদ্দেশে রওনা দিলাম। প্রথম জানাযা তার নানার বাড়িতে হয়েছিলো। এরপর নোয়াখালীর মাইজদীতে দ্বিতীয় জানাযা হলো। সেখান থেকে মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্সটা সর্বশেষ গন্তব্য গ্রামের বাড়ি শরিফপুরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। আমিও সেই অ্যাম্বুলেন্সে ছিলাম। একেবারে মরদেহের পাশেই বসেছিলাম সেদিন।
শহর থেকে বেশ দূরেই ওদের গ্রামটা। আঁকাবাঁকা পথ ধরে প্রায় ঘন্টাখানেক অ্যাম্বুলেন্স চলছিলো। রাস্তার এবড়োথেবড়ো জায়গাগুলোতে গাড়ি বেশ জোরে ঝাঁকি দিচ্ছিলো। ঝাঁকিতে আমরা স্থির থাকতে পারছিলাম না। খেয়াল করে দেখলাম মরদেহটাও নিথর হয়ে গাড়ি যেদিকে দুলছে সেদিকেই ঝুঁকছে। সম্ভবত এত নিশ্চুপ হয়ে আগে কখনো বাড়ি যায়নি মামা। কারণ, বাড়ি যাওয়ার আমেজটাই তো অন্যরকম।
আজ কত অতিথি যাচ্ছে তাদের বাড়ি। কোথায় সবাইকে মাতিয়ে রাখবে, অথচ নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনো সাড়া শব্দ নেই। যে মেঠোপথে ছোটবেলা থেকে হাজারো স্মৃতি, সেই মেঠোপথটা আজ একবারের জন্য গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখতেও পারছে না। এসব ভাবতেই চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। মামার সঙ্গে করা সব দুষ্টুমিগুলো বারবার মনে পড়ছিলো। খুব নিরবে কাঁদছিলাম তখন। যে মানুষটা দেখা হলেই হাসাতো; আজ সেই মানুষটা কত অদ্ভুতভাবে কাঁদাচ্ছে।
সত্যিই! মানুষের ভালো দিকগুলো মৃত্যুর পর কাঁদায়। আর খারাপ দিকগুলোর জন্য মৃত্যুর পর হয়তো মৃত মানুষটা নিজেই কাঁদে। এই যে আমরা কাঁদছি, মৃত মানুষটা যেমন দেখছে না, তেমনি মৃত ব্যক্তির কান্না বা আনন্দটাও জীবিতরা হয়তো দেখতে পায় না।
২৫ বছর বয়সে জীবনের প্রদীপ এভাবে নিভে যাবে, কে জানতো! শুনেছিলাম শেষ কটা দিন বছরখানেক আগে মারা যাওয়া ছোট ভাই আখিলকে স্বপ্নে দেখতো মামা। আখিল নাকি স্বপ্নে এসে মামাকে ডাকতো ওর কাছে যাওয়ার জন্য। এত তাড়াতাড়ি ছোট ভাইয়ের কাছে চলে যাবে মামা- বোধহয় নিজেও জানতো না।
ইকরার জীবনের অধ্যায় এখানেই শেষ। শুধু পৃথিবীতে রয়ে গেছে তার কিছু স্মৃতি, ছুঁইছুঁই কিছু অপূরণীয় স্বপ্ন, কিছু বন্ধু, আত্মীয় আর কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী। এই তো বছরখানেক পর মৃত্যুর দিনক্ষণ সবকিছুই ভুলে যাবো আমরা। কিছুদিন ইকরা সবার আলাপচারিতার কেন্দ্রবিন্দু হবে। এরপর ধীরে ধীরে তার কথা ভুলতে থাকবো আমরা। হঠাৎ কোনো এক আলাপচারিতায় তার কথা আবারও মনে পড়বে। কিন্তু সেদিন আর স্মৃতিচারণ করে কেউ কেঁদে উঠবে না।--------



No comments:

Post a Comment

razzakhowlader59@gmil.com