Saturday, October 23, 2021

নবী(স.)-এর প্রতি ভালোবাসা

 


নবী(স.)-এর প্রতি ভালোবাসা

এম এ রাজ্জাক হাওলাদার

(১২ রবীউল আউয়াল উপলক্ষ্যে সীরাত সংখ্যা)


# রাসূল (স.)-কে ভালোবাসার মাপকাঠি:

১. তাঁকে ভালোবেসে অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ।

২.তাঁর সুন্নাত/কর্মকে/মিশন/তিনি যা ভালোবেসেছেন সেগুলোকে ভালোবাসা।

৩. তাঁর আদেশ নিষেধ হুবহু অনুসরণ করা।

# রাসূল (স.)-কে ভালোবাসার প্রতিদান:

১. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ

হে নবী আপনি বলুন, যদি আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসতে চাইলে আমার অনুসরণ কর তাহলে আল্লাহ তাআলা তোমাদের ভালোবাসবেন এবং গুনাহ সমূহ ক্ষমা করবেন (সূরা আলে ইমরান-৩/৩১)

২. হাদীসে এসেছে ثَلَاثٌ مَنْ كُنّ فِيهِ وَجَدَ بِهِنّ حَلَاوَةَ الْإِيمَانِ: مَنْ كَانَ اللهُ وَرَسُولُهُ أَحَبّ إِلَيْهِ مِمّا سِوَاهُمَا

অর্থাৎ, তিনটি গুণের অধিকারী ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করবে। তন্মধ্যে প্রথম হল, যার কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সবচেয়ে প্রিয় হবে। (বুখারী-১৬, ২১, ৬৯৪১ মুসলিম-৬৯; নাসায়ী-৪৯৮৭,৮৮,৮৯; ইবনে মাজা-৪০৩৩)

৩. রাসূল (স.)-কে ভালোবাসলে তাঁর সাথেই হাশর হবে, হাদীসে এসেছে,

 المَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبّ

যে ব্যক্তি যাকে ভালবাসে তার সাথেই তার হাশর হবে(বুখারী-৬১৬৮,৬৯,৭০ মুসলিম-৬৬১১, আবু দাউদ-৫১২৭, তিরমিজী-২৩৮৫,৮৬,৮৭,৩৫৩৫, ৩৬)

# সাহাবীদের ভালোবাসার হাজারো ঘটনার কিঞ্চিৎ বর্ণনা:

১.হযরত আবু বকর (রা:) মৃত্যুশয্যায় আয়েশা সিদ্দীকা (রা:) কে জিজ্ঞাসা করলেন,

فِي أَيِّ يَوْمٍ تُوُفِّيَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ؟ قَالَتْ: يَوْمَ الِاثْنَيْنِ، قَالَ: فَأَيّ يَوْمٍ هَذَا؟ قَالَتْ: يَوْمُ الِاثْنَيْنِ، قَالَ: أَرْجُو فِيمَا بَيْنِي وَبَيْنَ اللّيْلِ

নবীজি (সা) কোন্ দিন ইন্তেকাল করেছেন? আয়েশা রা. জানালেন, সোমবার। তিনি বললেন, আজ কী বার? জবাব দিলেন, সোমবার। তখন তিনি বললেন, হায় যদি আমার মৃত্যু রাতের আগেই হতো! (বুখারী-১৩৮৭)

আমার মৃত্যুও যেন হয় সে দিনে, যে দিনে আমার প্রেমাষ্পদ রাসূল (স.) মৃত্যু হয়েছিল।

২.আমর ইবনু আস রা. মৃত্যুশয্যায় বলেছেন,

وَمَا كَانَ أَحَدٌ أَحَبّ إِلَيّ مِنْ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، وَلَا أَجَلّ فِي عَيْنِي مِنْهُ، وَمَا كُنْتُ أُطِيقُ أَنْ أَمْلَأَ عَيْنَيّ مِنْهُ إِجْلَالًا لَهُ، وَلَوْ سُئِلْتُ أَنْ أَصِفَهُ مَا أَطَقْتُ؛ لِأَنِّي لَمْ أَكُنْ أَمْلَأُ عَيْنَيّ مِنْهُ

এ পৃথিবীতে আমার কাছে রাসূল (স.) এর চেয়ে অধিক প্রিয় ও মহান আর কেউ নেই। আমার হৃদয়ে তাঁর সম্মান ও মর্যাদার এ অবস্থা ছিল যে, আমি তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারতাম না। আমাকে যদি তাঁর দেহাবয়বের বর্ণনা দিতে বলা হয়, আমি পারব না। কারণ, আমি দুচোখ ভরে তাঁকে দেখতে পারিনি (মুসলিম, রিয়াদুস সালেহীন-৭১৬)

৩. জাবের (রা:) বলেন, উহুদ যুদ্ধের সময় রাতে আমার আব্বা আমাকে ডেকে বললেন,

مَا أُرَانِي إِلّا مَقْتُولًا فِي أَوّلِ مَنْ يُقْتَلُ مِنْ أَصْحَابِ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، وَإِنِّي لاَ أَتْرُكُ بَعْدِي أَعَزّ عَلَيّ مِنْكَ، غَيْرَ نَفْسِ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ

আমার প্রবল ধারণা, আমি নবী কারীম (স.) সঙ্গীদের মধ্যে আগেভাগেই শহীদ হবো। আর আমি তোমাকেই সবচেয়ে প্রিয় হিসেবে রেখে যাচ্ছি, তবে রাসূল (স.) ছাড়া (কারণ, তিনিই আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয়(বুখারী-১৩৫১)

৪. এ উহুদ যুদ্ধেরই ভয়াবহ মুহূর্তে আরেক সাহাবী হযরত আবু তালহা রা. নিজে ঢাল হয়ে রাসূল (স.) উপর আক্রমণ প্রতিহত করছিলেন। এক পর্যায়ে যখন নবীজী উঁকি দিয়ে দেখতে উদ্যত হলেন তখন আবু তালহা (রা:) বলে উঠলেন,

يَا نَبِيّ اللهِ، بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي، لاَ تُشْرِفْ يُصِيبُكَ سَهْمٌ مِنْ سِهَامِ القَوْمِ، نَحْرِي دُونَ نَحْرِكَ 

ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমার মা-বাবা আপনার জন্য কুরবান হোক! আপনি উঁকি দেবেন না; পাছে আপনার গায়ে কোনো তীর এসে লাগে। আমার বুক আপনার জন্য উৎসর্গিত (বুখারী-৩৮১১)

৫. আরেক নারী সাহাবীর ঘটনা তো আরও বিস্ময়কর। উহুদ যুদ্ধেরই ঘটনা। রাসূল (স.) বনূ দীনারের এক নারীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যার স্বামী ও ভাই উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। লোকেরা যখন তাকে সমবেদনা জানাতে গেল তখন তিনি জানতে চাইলেন, নবীজী কেমন আছেন?তারা বলল, ভালো আছেন আলহামদু লিল্লাহ। তাতেও তাঁর মন শান্ত হল না। বললেন,

أَرُونِيهِ حَتّى أَنْظُرَ إِلَيْهِ

তবুও আমি নিজে দেখতে চাই; আমাকে দেখাও। অতপর যখন তাকে দেখানো হল তিনি বললেন,

كُلّ مُصِيبَةٍ بَعْدَكَ جَلَلٌ

(আল্লাহ্ রাসূল, আপনি নিরাপদ আছেন!) আপনার (নিরাপত্তার) পরে সমস্ত বিপদ তুচ্ছ। (দালাইলুন নুবুওয়াহ, বায়হাকী-৩/৩০২; সীরাতে ইবনে হিশাম-২/৯৯)

৬. হযরত উমর (রা:) রাসূল (স.) এর পাশে কবরস্থ হবার আশা:

রাসূল (স.) এর প্রকৃত প্রেমিক ২য় খলীফা উমর (রা:) দুনিয়া ছেড়ে চিরতরে বিদায় নিচ্ছেন, এ সময় তার সবচেয়ে বড় আশা হচ্ছে রাসূল (স.) এর পাশে কবরস্থ হওয়া।

বুখারী এভাবে বর্ণনা করেছেন- আমর ইবনু মাইনুন কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উমর (রা:)-কে বলতে দেখেছি, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রা:) বলেন, তুমি মুমিন জননী আয়িশা (রা.) কাছে গিয়ে বলো উমার আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং (আমীরুল মুমিনীন বলবে না। কারণ আমি আজ মুমিনীনদের আমীর নই) বলো, তিনি নিজ সঙ্গীদ্বয়ের পাশে কবরস্থ হবার জন্য আপনার অনুমতি কামনা করেছেন।

আব্দুল্লাহ ইবনু উমার তার ওপর সালাম দিয়ে অনুমতি চেয়ে আয়িশাহর কাছে যান, (তখন তিনি বসে বসে কান্না করছিলেন। তিনি তাকে বলেন,‘উমার ইবনু খাত্তাব (রা) আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং তার সঙ্গীদ্বয়ের নিকট দাফন হবার জন্য অনুমতি চাচ্ছেন) প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, এ স্থানটি আমি নিজের জন্য রেখেছিলাম, কিন্তু আজ আমি তাকে নিজের ওপর অগ্রাধিকার দিচ্ছি। তিনি যখন ফিরে আসেন তখন বলা হয়, এতো আব্দুল্লাহ ইবনু উমার ফিরে এসেছেন। এরপর তিনি বলেন,(আমাকে ওঠাও এক ব্যক্তি তাকে নিজের ওপর হেলান দিয়ে বসান। এরপর বলেন,) তোমার কাছে কী (সংবাদ) আছে? তিনি বলেন, তিনি (আয়িশাহ) আপনার জন্য অনুমতি দিয়েছেন।(উমার আল-হামদুলিল্লাহ বলার পর বলেন) সে স্থানটির চেয়ে আমার কাছে আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আমি যখন মৃত্যু বরণ করব তখন আমার লাশ তার (আয়িশাহ্র) কাছে নিয়ে যাবে এবং পুনরায় অনুমতি চাইবে যদি অনুমতি দেন তাহলে আমাকে সেখানে দাফন করবে অথবা মুসলিমগণের কবরস্থানে দাফন করবে। (বুখারী-১৩৯২)

৭. হযরত উসমান (রা:) হুদায়বিয়ার সন্ধির দিনে জীবন বাজী রেখে মক্কায় প্রবেশ করলেন। শহীদ হবার রটনাও রটে যায়। অন্যান্য সাহাবীগণ মনে মনে ভাবলেন তিনি বড্ড ভাগ্য বান কাবা যিয়ারত করতে পারবেন। উসমান (রা:) কাফিররা প্রস্তাবও দিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন রাসূল (স.)-কে অবরুদ্ধ রেখে আমি কখনো কিছুতেই কাবা তাওয়াফ করতেই পারিনা। তাকে তখন বন্দী করা হলো। রটনা রটে যায় তাকে শহীদ করে দেয়া হয়েছে। (মুহাববতে রাসূল ৫৩- ৫৪, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

৮. হযরত আলী (রা:) এর ভালোবাস.

তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল রাসূল (স.)-এর সাথে আপনার মুহাব্বত কেমন ছিল? উত্তরে বলেন,

 كان رسول الله صلي الله عليه وسلم احب الينا من اموالنا و اولادنا و اباءنا و امهاتنا و من الماء البارد علي الظماء

তিনি আমাদের কাছে সব সম্পদ, সন্তান সন্ততি, পিতা মাতা, প্রচণ্ড পিপাসার সময়ে ঠান্ডা পানির চেয়ে অধিক প্রিয়

তাইতো জীবন বিপন্ন জেনেও রাসূল (স.) হিজরতের রাতে চাদর মুড়ি তাঁরই বিছানায় শুয়ে থাকলেন। (মুহব্বতে রাসূল-৫৪ ও অন্যান্য)

৯. উহুদ যুদ্ধে আবূ দুজানা রাসূল (সা.) এর জন্য নিজেকে ঢাল বানান। তিনি বুক পেতে দেন এবং তীর তার পিঠে বিঁধতে থাকে, এমন কী তাঁর পিঠে অসংখ্য তীর বিদ্ধ হয়। অন্য বর্ণনায় রয়েছে- এ অবস্থায় তিনি নড়াচড়াও করেননি। খালেস ভালোবাসা কাকে বলে। (আস সিরাতুন নাব্বীয়াহ,ইবনু হিশাম-৩/৩০,তারিখুল ইসলাম যাহাবী-১৭৪-১৭৫, মুহাব্বতে রাসূল (স.)-৫৮)

১০. রাসূল (স.)-এর মৃত্যু সংবাদ শুনে অন্ধ হয়ে গেলেন আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ:

রাসূল (স.)-এর মৃত্যু সংবাদ ছেলের মুখে শুনে শোকে কাতর হয়ে বলে উঠলেন

اللهم خذ بصري حتى لا أرى أحداً بعد رسول الله؟، فأخذ الله بصره

হে আল্লাহ আমার দু চোখ অন্ধ করে দাও, যাতে এ দু চোখে আমার প্রিয় রাসূল (স.) মারা যাবার পর কাউকে না দেখতে পাই, দুআ কবুল হয়ে গেল। দু চোখ অন্ধ হয়ে গেল (তাফসীরে কুরতুবী, islam web . net, মুহাব্বতে রাসূল-৫৫ পৃষ্ঠা)

# প্রিয় পাঠক একটু ভাবে দেখুনতো!

ভালোবাসা কাকে বলে? আর কিভাবে দুআ করলে তৎক্ষণাৎ কবূল হয়। মানুষের কাছে দু চোখের চেয়ে মূল্যবান আর কি থাকতে পারে বলুন! আর উনি সেই সাহাবী যিনি প্রথমে স্বপ্নে আযান শিখেছিলেন জিব্রাইলের কাছে থেকে। (সুবহান আল্লাহ)।

(লেখাটি ফরিদুজ্জামান ভাইয়ের ওয়াল থেকে নেওয়া)

 

No comments:

Post a Comment

razzakhowlader59@gmil.com