ইসলামী আদর্শে
পরিবার গঠনে করণীয়
এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
(১ম পর্ব)
সূচনা :
মানব সমাজের ভিত্তি পরিবার। স্বামী-স্ত্রীকে
কেন্দ্র করে যা শুরু হয়। আদম-হাওয়া (আঃ)-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রথম মানব পরিবার
গড়ে ওঠে। সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে আজও এ পরিবার প্রথা চালু আছে। সারা দিনের
কর্মক্লান্তি, বিভিন্ন কারণে মানব মনে
পাওয়া দুঃখ-বেদনায় যেখানে সবাই শান্তি খোঁজে সেটা হ’ল
পরিবার। যদি পরিবারে শান্তি-শৃংখলা থাকে তাহ’লে মানব জীবন সুখময় হয়।
পক্ষান্তরে পরিবারে কাঙ্ক্ষিত শান্তি না থাকলে জীবন হয়ে ওঠে বিতৃষ্ণ, বিষাদময়।
এজন্য দরকার একটি আদর্শ পরিবার। যা হবে মানুষের আরাম-আয়েশ ও সুখ-শান্তির আকর। তাই
শান্তি-সুখের ঠিকানা আদর্শ পরিবার গঠনে করণীয় সম্পর্কে এ নিবন্ধের অবতারণা।
পরিবার পরিচিতি :
স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা ও দাদা-দাদী নিয়ে গঠিত হয় পরিবার। পরিবারের সংজ্ঞায় Oxford ইংরেজী অভিধানে বলা হয়েছে, A group consisting of one or two parents
their children. ‘পরিবার হ’ল পিতা বা মাতা অথবা পিতা-মাতা উভয় ও তাদের সন্তান-সন্ততির সমষ্টি’।–(Oxford Advence Laerners English Dictionary, (New Yeork :
Oxford University press, 8th edn, 2010), p-551.)
পরিবারের সূচনাকাল
:
পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আঃ) ও প্রথম
মানবী হযরত হাওয়া (আঃ)-কে কেন্দ্র করে মানব জাতির প্রথম পরিবার গড়ে উঠেছিল
জান্নাতে। এই প্রথম পরিবারের সদস্য স্বামী ও স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ
বলেছিলেন,يَاآدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ
وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا
هَذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُوْنَا مِنَ الظَّالِمِيْنَ- ‘হে আদম! তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে অবস্থান কর এবং
সেখান থেকে যা চাও খুশীমনে খাও। কিন্তু তোমরা দু’জন
এই গাছটির নিকটে যেয়ো না। তাহ’লে তোমরা সীমালংঘনকারীদের
অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’। -(সূরা বাক্বারাহ-২/৩৫)
এই প্রথম পরিবার থেকে মানব জাতি বিশ্বময়
ছড়িয়ে পড়ে। এসম্পর্কে আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ
اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا
زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيْرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوْا اللهَ
الَّذِيْ تَسَاءَلُوْنَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ
رَقِيْبًا- ‘হে মানব জাতি! তোমরা
তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। যিনি তোমাদেরকে একজন মানুষ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার
থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ঐ দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও
নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর,
যাঁর
নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচ্ঞা করে থাক এবং আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কে সতর্ক হও।
নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর সদা সতর্ক তত্ত্বাবধায়ক’। -(সূরা নিসা-৪/১)
অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেন,يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَّأُنْثَى
وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوْبًا وَّقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا- ‘হে মানুষ! আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী
থেকে। তারপর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন বংশ ও গোত্রে, যাতে
তোমরা পরস্পরে পরিচিত হ’তে পার’।- (সূরা হুজুরাত-৪৯/১৩)
অনুরূপভাবে সকল নবী-রাসূলের ব্যক্তিগত জীবনে ও সময়কালে
পরিবার বিদ্যমান ছিল। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلاً
مِنْ قَبْلِكَ وَجَعَلْنَا لَهُمْ أَزْوَاجًا وَذُرِّيَّةً ‘তোমার
পূর্বেও আমরা অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি এবং তাদেরকে স্ত্রী ও সন্তানাদি দিয়েছি’। -(সূরা রা‘দ-১৩/৩৮) হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় পরিবারের জন্য দো‘আ
করেছিলেন,رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا
مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَكَ وَأَرِنَا
مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ- ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি আমাদেরকে আপনার
আজ্ঞাবহ করুন এবং আমাদের বংশধরগণের মধ্য হ’তেও আপনার অনুগত একটা দল
সৃষ্টি করুন। আর আপনি আমাদেরকে আমাদের হজ্জের নিয়ম-পদ্ধতি বাৎলে দিন এবং আমাদের
ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনি অধিক তওবা কবুলকারী ও দয়াময়’।- (সূরা বাক্বারাহ-২/১২৮)
পরিবারের গুরুত্ব ও
প্রয়োজনীয়তা :
পরিবার মানব সমাজের মূল ভিত্তি। পারিবারিক
জীবন ব্যতিরেকে মানব সভ্যতা কল্পনা করা যায় না। মানুষের অস্তিত্বের জন্য পারিবারিক
জীবন অপরিহার্য। সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা,
স্থিতিশীলতা, উন্নতি-অগ্রগতি
ইত্যাদি সুষ্ঠু পারিবারিক ব্যবস্থার উপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল। পারিবারিক জীবন
অশান্ত ও নড়বড়ে হ’লে,
তাতে
ভাঙ্গন ও বিপর্যয় দেখা দিলে সমাজ জীবনে নানা অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হ’তে
বাধ্য। তাই বলা যায়, পরিবারই হচ্ছে কল্যাণকর
সমাজের ভিত্তি। সুতরাং আদর্শ সমাজ গঠনের অপরিহার্য শর্ত আদর্শ পরিবার গঠন।
পরিবারের গুরুত্বের বিভিন্ন দিক নিম্নে উলেলখ করা হ’ল।-
১. মানব বংশ বৃদ্ধি
:
পরিবারের মাধ্যমে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
আল্লাহ বলেন,وَاللهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ
أَزْوَاجًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ بَنِيْنَ وَحَفَدَةً وَّرَزَقَكُمْ
مِنَ الطَّيِّبَاتِ- ‘আর আল্লাহ তোমাদের জন্য
তোমাদের মধ্য থেকেই জোড়া সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের জোড়া থেকে তোমাদের
পুত্র-পৌত্রাদি সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে পবিত্র বস্ত্তসমূহ হ’তে
রূযী দান করেছেন’।-(সূরা নাহল-১৬/৭২)
এভাবে রাসূলের উম্মতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আর উম্মতে
মুহাম্মাদীর সংখ্যাধিক্য পরকালে রাসূল (স.)-এর জন্য গর্বের বিষয় হবে। রাসূল (স.)
বলেন, تَزَوَّجُوْا الْوَدُوْدَ الْوَلُوْدَ فَإِنِّىْ
مُكَاثِرٌ بِكُمُ الأُمَمَ ‘তোমরা
অধিক
সোহাগিনী
ও
অধিক
সন্তানদায়িনী মহিলাকে বিবাহ কর। কারণ আমি ক্বিয়ামতের দিন তোমাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে
গর্ব করব’।–(আবুদাঊদ হা/২০৫০; মিশকাত হা/৩০৯১, সনদ
ছহীহ)
২. মানববংশ সংরক্ষণ
:
পরিবারের মাধ্যমে মানববংশ রক্ষা হয়। আল্লাহ
বলেন,وَهُوَ الَّذِيْ خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ بَشَرًا
فَجَعَلَهُ نَسَبًا وَصِهْرًا وَكَانَ رَبُّكَ قَدِيْرًا ‘তিনিই
মানুষকে পানি হ’তে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি তার বংশগত ও
বিবাহগত সম্পর্ক নির্ধারণ করেছেন। আর তোমার প্রতিপালক সর্বশক্তিমান’।- (সূরা ফুরক্বান-২৫/৫৪)
এ পরিবারের সদস্যদের মাঝে স্নেহ-মায়া-মমতা, সম্প্রীতি-সদ্ভাব
তৈরী হয়। তাদের পরস্পরের মধ্যে থাকে সুসম্পর্কের সুদৃঢ় সেতুবন্ধন। কারণ সেখানে
থাকে পিতামাতা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি, অনেক
ক্ষেত্রে দাদা-দাদী, পৌত্র-পৌত্রী ইত্যাদি
সম্পর্কের মানুষ। পরিবারে পিতামাতা সন্তানকে শৈশবে লালন-পালন করেন। তেমনি সন্তান
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর পিতামাতাকে দেখাশোনা করে। পৌত্ররাও দাদা-দাদীর সেবাযত্ন করে
থাকে। এভাবে একে অপরের মাধ্যমে মানব বংশ রক্ষা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হ’ল
এখন মানুষ বিভিন্ন অযুহাতে জন্মনিয়ন্ত্রণ ও জন্ম নিরোধ করছে। লাইগেশনের মাধ্যমে বা
অন্য কোন উপায়ে স্থায়ীভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ বা জন্ম নিরোধ করা হারাম। কেউবা ভ্রূণ
হত্যা করে। শারঈ কোন কারণ ব্যতীত
ভ্রূণ হত্যা মানবহত্যার শামিল। এসব থেকে বিরত থাকা অতীব যরূরী।
৩. শিক্ষা প্রদান :
পরিবার এক অনন্য শিক্ষাগার। এখানে পিতামাতা সন্তানকে
সুশিক্ষিত করে তোলে। পিতামাতার নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেই সন্তান সুনাগরিক হিসাবে
গড়ে ওঠে। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন,كُلُّ مَوْلُوْدٍ يُوْلَدُ
عَلَى الْفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ
يُمَجِّسَانِهِ- ‘প্রত্যেক সন্তানই ফিতরাতের
(ইসলাম) উপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী বা খৃষ্টান কিংবা
অগ্নিপূজক বানায়’।–(বুখারী
হা/১৩৬৫; মুসলিম হা/২৬৫৮; মিশকাত হা/৯০)
সুতরাং সৎ ও চরিত্রবান নাগরিক গড়ার প্রথম
ভিত্তি হচ্ছে পরিবার। শিশুরা আদর্শবান হয়ে গড়ে ওঠে পরিবার থেকে। তাই পারিবারে যে
শিশু সঠিকভাবে গড়ে ওঠে, সে বড় হয়েও সঠিক পথে অবিচল
থাকে। পক্ষান্তরে যে শিশু পরিবারে খারাপ শিক্ষা পায়, সে
বড় হয়েও খারাপ পথেই চলতে থাকে। এজন্য পিতা-মাতা সন্তানকে আল্লাহভীতি, পরকালীন
জবাবদিহিতা, মুসলমানদের
দায়িত্ব-কর্তব্য, আল্লাহর হক, বান্দার
হক, পারস্পরিক সহমর্মিতা শিখানোর চেষ্টা করবেন। এর পাশাপাশি
সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিবেন। যাতে তারা নিজেদের অভিভাবকহীন ভাবতে না পারে এবং
সঠিক তত্ত্বাবধায়নের অভাবে বখে না যায়। পাশাপাশি তাদের সার্বিক বিষয়ে খোঁজ-খবর
রাখবেন এবং তাদের সঙ্গী-সাথী ও বন্ধু-বান্ধবদের সম্পর্কেও নযর রাখবেন। যাতে অসৎ
সঙ্গে সর্বনাশ না হয়।
৪. শান্তি লাভ ও
পারিবারিক মহববত সৃষ্টি :
পরিবারেই মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে
এবং তাদের মধ্যে মহববত-ভালবাসা তৈরী হয়। আল্লাহ বলেন,وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجاً
لِتَسْكُنُوْا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِيْ
ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُوْنَ، ‘তাঁর
নিদর্শনের মধ্যে হ’ল এই যে,
তিনি
তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হ’তেই তোমাদের সঙ্গিনী
সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তার কাছে
শান্তি লাভ করতে পার আর তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।
এর মাঝে অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা চিন্তা করে’।- (সূরা রূম-৩০/২১)
পরিবারে মা-বাবা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি
একত্রে বসবাস করেন। একসাথে থাকার ফলে একে অপরের সুখে সুখী হয়, এক
অপরের দুঃখে দুঃখী ও সমব্যথী হয়। এভাবে পরিবারের সদস্যরা পরস্পরকে বিভিন্নভাবে
সাহায্য করে থাকে। পরিবারের এ বন্ধন আমাদের দেশে খুবই পরিচিত চিত্র। কিন্তু
দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, বর্তমানে
চিরচেনা এ পরিবার প্রথা বিলুপ্তির পথে। একে সামাজিক বিপর্যয় বললেও হয়তো অত্যুক্তি
হবে না। পারিবারিক বিপর্যয়রোধে অনেকেই সচেষ্ট। নানাবিধ কলাকৌশল প্রয়োগ করে
পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যাপৃত। অথচ মানব চিন্তা যতই শাণিত হোক, উন্নত
ও আধুনিক বলে দাবী করা হোক না কেন,
আল্লাহ
প্রদত্ত নির্ভুল জ্ঞানের সহায়তা ব্যতীত প্রকৃত সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই
পারিবারিক বিপর্যয়রোধে ইসলামের বিধান অনুসরণের বিকল্প নেই। এ পথেই রয়েছে সুষ্ঠু
সমাধান। ইসলাম আগে ব্যক্তি সংশোধনে গুরুত্বারোপ করেছে। কারণ ব্যক্তি ঠিক হ’লে
পরিবার ও সমাজ উভয়ই ঠিক হয়ে যায়। একটি বহুতল ভবন নির্মাণের পূর্বে যেমন ভিত্তি ঠিক
করতে হয়, তেমনি পূর্ণাঙ্গ সমাজ ও
রাষ্ট্র গঠন করতে হ’লে একটি আদর্শ পরিবার গঠন করতে হয়। কেননা
সমাজবিজ্ঞানী ও মুসলিম মনীষীগণের দৃষ্টিতে মানবসমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাথমিক ভিত্তি
হচ্ছে পরিবার।
সম্প্রতি আমাদের দেশের অনেক মানুষ পারিবারিক
বন্ধনের কথা ভুলতে বসেছে। আমাদের মানবিক মূল্যবোধ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। পরিবারের
প্রতি মানুষ বৈষ্যমূলক বিভিন্ন অন্যায়-আচরণ করছে। পরিবারের বড়দের সম্মান এবং
ছোটদের প্রতি স্নেহসুলভ আচরণ করা হচ্ছে না। অথচ রাসূল (স.) বলেন,مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيْرَنَا وَيَعْرِفْ حَقَّ كَبِيْرِنَا
فَلَيْسَ مِنَّا، ‘যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদেরকে স্নেহ করে না এবং
আমাদের বড়দের সম্মান বোঝে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়’।–(আবু দাউদ হা/৪৯৪৩; তিরমিযী হা/১৯১৯; ছহীহাহ
হা/২১৯৬)
ইসলামে পারস্পরিক সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে।
পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, ইসলামে
তার সবকিছু বিদ্যমান। সুতরাং সে বিধান মেনে চলার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত।
পারিবারিক জীবন যে শুধু দুনিয়াতেই কল্যাণ বয়ে আনে এবং এ
বন্ধন যে কেবল পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা নয়,
বরং
সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের জন্য এ বন্ধন জান্নাতেও বিদ্যমান থাকবে। মহান আল্লাহ বলেন,جَنَّاتُ عَدْنٍ يَدْخُلُوْنَهَا وَمَنْ صَلَحَ مِنْ آبَائِهِمْ
وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ وَالْمَلَائِكَةُ يَدْخُلُونَ عَلَيْهِمْ مِنْ
كُلِّ بَابٍ، ‘তা হ’ল স্থায়ী বসবাসের জান্নাত।
তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের সৎকর্মশীল বাপ-দাদা, স্বামী-স্ত্রী
ও সন্তান-সন্ততি। ফেরেশতারা তাদের কাছে আসবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে’।-(সূরা রা‘দ-১৩/২৩)
৫. জৈবিক চাহিদা
পূরণ ও লজ্জাস্থান হেফাযত :
পারিবারিক ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের স্বভাবসিদ্ধ জৈবিক
চাহিদা বৈধ পথে পূরণ করার সুযোগ হয়। ফলে লজ্জাস্থান হেফাযত করা যায়। রাসূল (স.)
বলেন,يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ
الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ ‘হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে বিবাহের
সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা উহা লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে এবং চক্ষুকে
অবনমিত রাখে’।–(বুখারী
হা/৫০৬৬; মুসলিম হা/১৪০০; মিশকাত হা/৩০৮০)
আর এই বৈধপন্থায় নারী-পুরুষের জৈবিক চাহিদা
পূরণের মাধ্যমে উভয়ে নৈতিক স্খলন থেকে বেঁচে যায়, পাপাচার
থেকে পরিত্রাণ পায় এবং ছওয়াব লাভ করে।
রাসূল (স.) বলেন,وَفِىْ بُضْعِ أَحَدِكُمْ
صَدَقَةٌ، قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ أَيَأْتِىْ أَحَدُنَا شَهْوَتَهُ
وَيَكُوْنُ لَهُ فِيْهَا أَجْرٌ قَالَ أَرَأَيْتُمْ لَوْ وَضَعَهَا فِىْ حَرَامٍ
أَكَانَ عَلَيْهِ فِيْهَا وِزْرٌ فَكَذَلِكَ إِذَا وَضَعَهَا فِىْ الْحَلاَلِ
كَانَ لَهُ أَجْرٌ، ‘তোমাদের কারো স্ত্রীর সাথে সহবাস করাও
ছাদাক্বাহ। ছাহাবীগণ আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের
কেউ যদি নিজের কামভাব চরিতার্থ করে তাতেও কি সে ছওয়াব পাবে? উত্তরে
রাসূলুল্লাহ (স.) বললেন, তোমাদের অভিমত কি যে, কোন
ব্যক্তি যদি হারাম উপায়ে কামভাব চরিতার্থ করে তাহ’লে
সে কি গুনাহগার হবে? ঠিক এভাবেই হালাল উপায়ে
(স্ত্রীর সাথে) কামভাব চরিতার্থকারী ছওয়াব পাবে’।–(মুসলিম হা/১০০৬; মিশকাত
হা/১৮৯৮)
৬. পারিবারিক জীবন
যাপন করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য :
মুমিন বান্দাদের অন্যতম গুণ সুন্দর পারিবারিক
জীবন যাপন। এজন্য তারা মহান আল্লাহর কাছে দো‘আ করে এই বলে,رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ
أَعْيُنٍ وَّاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِيْنَ إِمَامًا- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের স্ত্রীদের ও সন্তানদের
মাধ্যমে চক্ষুশীতলকারী বংশধারা দান কর এবং আমাদেরকে আল্লাহভীরুদের জন্য আদর্শ
বানাও’।-(সূরা ফুরক্বান-২৫/৭৪)
(চলবে—ফেইসবুকে
চোখরাখুন বাকী পর্ব আসবে)
ইসলামী আদর্শে
পরিবার গঠনে করণীয়
এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
(২য় পর্ব)
পারিবারিক জীবনের
সুফল :
পরিবারের সুফল অনেক মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাদান
ইত্যাদি। পরিবারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব শিশুকে সামাজিক করে গড়ে তোলা এবং ইসলামী
তাহযীব-তামাদ্দুন শিক্ষা দেওয়া। পরিবারের ধারা ও রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে শিশুর
মনোজগত তৈরী হয় এবং পরিবারে তার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। সুতরাং শিশুর সুষ্ঠু শিক্ষা
দিতে পরিবার বিশেষ ভূমিকা রাখে।
পরিবার একটি সার্বজনীন পদ্ধতি এবং সমাজ ও
রাষ্ট্রের আয়না। সারা বিশ্বে পরিবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভিত্তি হিসাবে
গণ্য হয়। পরিবার একজন মানুষের সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ। পরিবারের
সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সকলের দায়িত্ব। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও
স্নেহ-মায়া-মমতার বন্ধনে আবদ্ধ একেকটি পরিবার বহু হৃদয়ের সমষ্টি, যেখানে
আছে জীবনের প্রবাহ, আছে মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালবাসা, মিলেমিশে
থাকার প্রবল বাসনা, আছে নিরাপত্তা, সহনশীলতা
এবং পরস্পরকে গ্রহণ করার মানসিকতা। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে পারিবারিক বন্ধনের প্রভাব
বিস্তৃত।
বিশ্বের প্রতিটি দেশে ও জাতির নিকটে পরিবারের
গুরুত্ব অপরিসীম। মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণ,
সমমর্যাদার
নিশ্চয়তা এবং বৈষম্যহীন পরিবেশের মাধ্যমে সামাজিক অগ্রগতি সাধন ও জীবন মান উন্নয়নে
পরিবার সমাজের স্তম্ভ ও মৌলিক ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। পরিবার এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখান
থাকে ভবিষ্যত জীবনের পথ নির্দেশনা।
পারিবারিক বন্ধন থেকেই মানব বংশ সম্প্রসারিত
হয়েছে। যদি সকল মানুষ পরিবারে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে তবে সে পরিবার
সমাজে উত্তম ও আদর্শ পরিবার হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যেখানে বইতে থাকে শান্তির
ফল্গুধারা। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জীবন হবে সুখকর ও আনন্দময়।
স্মর্তব্য যে, ব্যক্তি
থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ এবং সমাজ
থেকে একটি দেশ বা রাষ্ট্র গঠিত হয়। তাই ব্যক্তি ভালো হ’লে
পরিবার ভালো হবে, পরিবার ভালো হ’লে
সমাজ ভাল হবে। আর সমাজ ভালো হ’লে দেশ বা রাষ্ট্র ভালো
চলবে। সমাজে এখনো বহু ভালো মানুষ আছেন,
যারা
প্রকৃতপক্ষেই চান যে, সমাজে ভালো মানুষই থাকুক, মানবরূপী
কোন দানব না থাকুক। ব্যক্তি সংশোধনের মাধ্যমে পরিবার ঠিক করে ঐসব মানবরূপী দানবদের
সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলা
এবং মযবূত করতে হবে পারস্পরিক সম্পর্কের সেতু বন্ধন। এক্ষেত্রে একে অন্যের প্রতি
স্নেহ-ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে সুন্দর
পরিবার গঠন ও পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা আমাদের জন্য একান্ত কর্তব্য।
পরিবার নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি শিশু
সুনাগরিক হয়ে গড়ে ওঠে। শিশুরা পরিবারে যে শিক্ষা পায় বড় হয়ে সে ঐ শিক্ষানুযায়ী
চলে। আর পরিবারে একই সঙ্গে মা-বাবা,
ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি
মিলেমিশে থাকে। একজনের সুখে অন্যজন আনন্দিত হয় এবং একজনের দুঃখে অন্যজন অশ্রু
ঝরায়। এ নিবিড় বন্ধন থাকে কেবল পরিবারের মধ্যে। ফলে সদস্যরা একে অন্যকে নানাভাবে
সাহায্য করে।
পরিবারের মূল চাবিকাঠি থাকে পিতা-মাতার
হাতেই। আর সকল পিতা-মাতাই চান তাদের সন্তান ভালো হোক, ভালোভাবে
চলুক এবং নিজের সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তুলুক। তাই সুন্দর একটি পরিবার গড়ে তুলতে
পিতামাতার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ পিতা-মাতার সাথে সন্তানদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়
ও চিরন্তন। সন্তানকে সুপথে চালিত করতে তাদেরকেই ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পরিবারের
সদস্যরা যখন আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন থাকবে; স্ত্রী
তার অধিকার পূর্ণভাবে লাভ করবে; স্বামী যখন স্ত্রীর নিকট
তার অধিকার পাবে, সন্তান পিতা-মাতার ঘনিষ্ঠ
সাহচর্য লাভ করবে ও তাদের অধিকার পাবে;
আত্মীয়-স্বজন
যখন পরস্পরের যথাযথ সম্মান-মর্যাদা পাবে,
তখন
কোন স্ত্রী অধিকারের দাবীতে প্রকাশ্য রাজপথে বের হবে না, কোন
স্বামী ভালোবাসা ও সুনদর জীবন-যাপনের প্রত্যাশায় অন্য নারীর প্রতি আসক্ত হবে না, কোন
সন্তানই পিতা-মাতার অবাধ্য হয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করবে না। বরং পরিবারে সবার
মাঝে সুসম্পর্কের কারণে আল্লাহর রহমত,
অনুগ্রহ-অনুকম্পা
বর্ষিত হ’তে থাকবে।
অপরদিকে ইসলাম নির্দেশিত পারিবারিক জীবন হ’ল
আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহ। মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত
পারিবারিক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হ’লে সমাজ থেকে পরকীয়া, লিভটুগেদার, মাদকাসক্তি, ইভটিজিং, এসিড
নিক্ষেপ, ধর্ষণ-অপহরণ, ধর্ষণ
পরবর্তী হত্যা ও প্রেমে ব্যর্থদের আত্মহত্যাসহ সকল প্রকার অপরাধ নির্মূল হবে।
জীবনের পড়ন্ত বেলায় বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিয়ে নীরবে অশ্রু ঝরাণোর মতো দুঃসহ জীবন-যাপন
বন্ধ হবে। তাই একটি সুন্দর ও আদর্শ পরিবার গঠনের লক্ষ্যে আল্লাহ ও রাসূল (স.)-এর
নির্দেশ মেনে চলা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য।
পরিবার না থাকার
ক্ষতিকর দিকসমূহ :
পরিবার মানুষের জন্য যেমন নিরাপদ আশ্রয়স্থল, তেমনি
মানসিক প্রশান্তি লাভের স্থান। মানবজীবনে পরিবার তাই এক গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। কিন্তু
পরিবার না থাকলে মানুষকে নানা ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হ’তে
হয়। তন্মধ্যে কয়েকটি দিক নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
ক. নিরাপত্তাহীন
হওয়া :
পরিবার মানুষের জন্য এক সুন্দর আশ্রয়।
পার্থিব জীবনে সংঘটিত বিভিন্ন বিপদাপদ,
অসুখ-বিসুখ, ব্যথা-বেদনা, দুঃখ-যাতনা
ইত্যাদির শিকার হয়ে মানুষ অনেক সময় দিশাহারা হয়ে যায়। এ সময় পরিবারের অন্যান্য
সদস্য তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। অসুখে সেবা করে,
বিপদে
সাহায্য করে, দুঃখ-কষ্টে সান্ত্বনা দেয়
এবং শোকে সমব্যথী হয়। কিন্তু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোন মানুষের জন্য এসব পাওয়ার
উপায় থাকে না। ফলে সে হয়ে পড়ে উদ্ভ্রান্ত। তার জীবনের নিরাপত্তা থাকে না। কখনও
কখনও সে কোথাও মরে পড়ে থাকলে তার খোঁজ-খবর নেওয়ার বা তাকে কাফন-দাফন করার মত লোকও
থাকে না।
খ. সহযোগিতা না
পাওয়া :
অর্থ মানব জীবনের এক আবশ্যিক বিষয়। রক্ত ছাড়া
যেমন মানুষ বাঁচে না অর্থ ছাড়া তেমনি জীবন চলে না। তাই বিভিন্ন সময়ে মানুষের
অর্থের প্রয়োজন হয়। পরিবারের লোকেরাই সেই প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসে। তাছাড়া জীবনের
সর্বক্ষেত্রে মানুষ কর্মক্ষম থাকে না। জীবনের সূচনাকালে যেমন সে অক্ষম ও
পরনির্ভরশীল থাকে, তেমনি জীবনের শেষ বেলায় সে
আবার অক্ষম ও পরনির্ভরশীল হয়ে যায়। এ সময়ে পরিবারভুক্ত মানুষ পরিবারের অন্যান্য
সদস্যদের সাহায্য পায়। তার সার্বিক প্রয়োজন পূরণে তারা এগিয়ে আসে। অথচ পরিবার থেকে
বিচ্ছিন্ন কোন মানুষের সাহায্যে তেমন কেউ এগিয়ে আসে না।
গ. বন্ধনহীন হওয়া :
একেকটি পরিবার মূলতঃ কতগুলো হৃদয়ের সমষ্টি, যেখানে
আছে জীবনের প্রবাহ, মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসা, যত্ন-আত্তি, সেবা-পরিচর্যা, নিরাপত্তা, মিলেমিশে
থাকার প্রবল আকাঙ্ক্ষা, সহনশীলতা এবং একে অন্যকে
গ্রহণ করার মানসিকতা। কিন্তু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোন মানুষ এসব সুযোগ-সুবিধা
পায় না।
উল্লেখ্য যে,
দেশ-কাল, সমাজ-পারিপার্শ্বিকতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, দায়িত্ব-কর্তব্য
ও রীতিনীতির কারণে পরিবারের রূপ ভিন্ন হয়। কালের বিবর্তনে পরিবর্তিত হচ্ছে
পরিবারের কাঠামো ও এর আকার-আয়তন। বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে গঠিত
হচ্ছে একক পরিবার। দেখা দিচ্ছে এক ধরনের বন্ধনহীনতা। যা কোন জ্ঞানী মানুষের কাম্য নয়।
ঘ. নৈতিক অবক্ষয় :
বর্তমান সমাজের অবক্ষয় ও সামাজিক ব্যাধি
উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে পরিবারকে কেন্দ্র করে অনেক সমস্যার সৃষ্টি
হচ্ছে। ঘরে ঘরে দাউ দাউ করে জ্বলছে অশান্তির আগুন। পরিবারগুলোর অশান্তির প্রভাব
পড়ছে সমাজে। ডিস, সিডি, ইন্টারনেট, মোবাইল, সাইবারক্যাফে
ইত্যাদির মাধ্যমে পর্ণোছবি দেখা, ব্লাক মেইলিং, ইভটিজিং
বাড়ছে মহামারীর ন্যায়। অশালীন পোশাক,
রূপচর্চা, ফ্যাশন, অবাধ
মেলামেশা, যত্রতত্র আড্ডা, প্রেমালাপ, মাদক, পরকীয়া, অবৈধ
যৌনাচার ও সন্ত্রাসের সয়লাব চলছে সমাজের সর্বত্র। এ সকল কাজে যে প্রচুর অর্থের
প্রয়োজন হয়, তা জোগাড় করতে গিয়ে
পরিবারের সাথে বাক-বিতন্ডা, মনোমালিন্য, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানী, কিডন্যাপ
ও খুন-খারাবী কিছুই বাদ যাচ্ছে না। এর নেতিবাচক পরিণতি হিসাবে পারিবারিক সহিংসতার
বিস্তৃতি ঘটছে। বস্ত্ততঃ এ ধরনের সামাজিক অস্থিরতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় পুরো
সমাজকে এক চরম ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
নানা অত্যাচারে অতিষ্ঠ অভিজাত পিতা-মাতা যেন
যিম্মী হয়ে আছেন তরুণ-যুবক সন্তান-সন্ততির কাছে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনও যেন
পিতামাতার মতই অসহায়। আর্থিক, নৈতিক, সামাজিক
ক্ষতির পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ছেন সংশ্লিষ্টরা। সমাজের অবক্ষয়ের
কারণে যুব সমাজের কল্যাণময় অবদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ
ও রাষ্ট্র সকলে। এজন্য পারিবারিক ব্যবস্থাকে সংস্কারে নযর দেয়া সকলের জন্য যরূরী।
বর্তমানে যে সকল পরিবার সন্তানের প্রতি
উদাসীন, সন্তানের প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন করেন না, তাদের
অধিকাংশের যুবক-তরুণ সন্তান-সন্ততি উচ্ছৃঙ্খল ও অনৈতিক জীবন যাপন করে, শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানসহ সমাজে নানা সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই ধনী ও
দরিদ্র শ্রেণী।
এদের মাঝে ধর্মীয় অনুশীলন, ইসলামী
মূল্যবোধ, ইসলামী সংস্কৃতির চর্চা, পারিবারিক
বোঝাপড়া, পারস্পরিক
দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ নেই বললেই চলে। ধনী শ্রেণী বৈধ-অবৈধ পন্থায় টাকা উপার্জন করে
এবং ভোগ-বিলাসেই মত্ত থাকে অধিকাংশ সময়। সন্তান চাইলেই তারা টাকা-পয়সা দিয়ে এবং
পোশাক-পরিচ্ছদ, দামি মোবাইল, গাড়ি
ইত্যাদি কিনে দিয়েই দায়মুক্ত হয়। অন্ধস্নেহে সন্তানের কোন ভুল-ত্রুটি অভিভাবকের
চোখে ধরা পড়ে না। বর্তমান সময়ের অভিভাবকগণ এসব ব্যাপারে আগের মত সিরিয়াস নন, তারা
কেবল অর্থের পিছনে ছুটছেন। সন্তানকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করাই তাদের একমাত্র বা
প্রধান লক্ষ্য। ধর্মকর্ম, নীতি-নৈতিকতা তাদের কাছে
গৌন হয়ে গেছে। সন্তান-সন্ততিকে সময় দেয়ার মত ফুরসত নেই, সন্তান-সন্ততিও
তাই কথা শুনছে না। ছোট-বড় সকলে তথাকথিত প্রগতি বা উন্নয়নের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়ায়
সমাজ ব্যবস্থা দ্রুত নষ্ট ও দূষিত হয়ে যাচ্ছে। অপর দিকে দরিদ্র শ্রেণীর সন্তানরা
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অশিক্ষা-কুশিক্ষা পেয়ে বেড়ে ওঠে। সন্তান একটু বড় হ’লেই
তারা অর্থ উপার্জনে লাগিয়ে দেয়। এই দুই শ্রেণী সাধারণত নিজেরাও ধর্মকর্ম করে না, সন্তানকে
খুব একটা শিক্ষা দেবারও প্রয়োজন অনুভব করে না। ফলে স্বাভাবিকভাবে এই শ্রেণীর
সন্তানদের মাঝে অপরাধ প্রবণতা বেশী থাকে।
বলা যায় যে, মধ্যবিত্ত
ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোই মোটামুটি সমাজের সজাগ ও সচেতন শ্রেণী। এসব পরিবারই
সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলার ভারসাম্য ধরে রাখে। এ সকল পরিবারের অভিভাবকগণ সন্তানদেরকে
লেখাপড়ার পাশাপাশি অত্যন্ত আন্তরিকতা ও যত্নের সাথে ধর্ম-কর্ম, আদব-কায়দা, ভদ্রতা-শালীনতা, দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ, নৈতিকতা
ইত্যাদি শিক্ষা দিয়ে থাকেন। সেজন্য এ অংশে সহজে ফাটল ধরে না। কিন্তু ফাটল সৃষ্টি হ’লে
তা হবে অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। তাই এ শ্রেণীসহ সমাজের সকল শ্রেণীর পরিবারে
নৈতিকতার মানোন্নয়নের মাধ্যমে অবক্ষয় রোধ করার চেষ্টা করতে হবে।
ঙ. সংসার বিরাগী
হওয়া
:
সংসার বিরাগী হওয়া বা বৈরাগ্য জীবন যাপন করার অনুমতি ইসলামে
নেই। আল্লাহ বলেন, وَرَهْبَانِيَّةً
ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ ‘আর
বৈরাগ্যবাদ- তা তারা নিজেরাই নতুনভাবে চালু করেছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়।
আমরা তাদের উপর এ বিধান অপরিহার্য করিনি’।- (সূরা হাদীদ-৫৭/২৭) আয়াতে খ্রীষ্টানদের বৈরাগ্যবাদের কথা বলা
হয়েছে। এসব থেকে ইসলাম মানুষকে সাবধান করেছে। হাদীছে এসেছে, সা‘আদ
ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) বলেন,رَدَّ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله
عليه وسلم عَلَى عُثْمَانَ بْنِ مَظْعُوْنٍ التَّبَتُّلَ، وَلَوْ أَذِنَ لَهُ
لاَخْتَصَيْنَا ‘রাসূল (স.) ওছমান ইবনু
মাযঊনকে নিঃসঙ্গ জীবন যাপনের অনুমতি দেননি। তাকে অনুমতি দিলে আমরা নির্বীর্য হয়ে
যেতাম’।–(বুখারী হা/৫০৭৩; মুসলিম, মিশকাত
হা/৩০৮১, ‘বিবাহ’ অধ্যায়)
আয়েশা (রাঃ) বলেন,أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم نَهَى عَنِ التَّبَتُّلِ ‘নিশ্চয়ই রাসূল (স.) নিঃসঙ্গ জীবন যাপনকে
নিষেধ করেছেন’।–(নাসাঈ
হা/৩২১৩; তিরমিযী হা/১০৮২; ইবনু মাজাহ হা/১৮৪৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৮৬৭)
সুতরাং পারিবারিক জীবন পরিহার করে
সংসারত্যাগী হওয়ার কোন সুযোগ ইসলামে নেই। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, বর্তমানে
এক শ্রেণীর লোক তাবলীগের নামে পরিবার-পরিজনকে ফেলে রেখে এক মাস, তিন
মাস, এক বছর বা জীবন চিল্লায় বের হয়। পরিবারের সাথে তাদের
যোগাযোগ এবং ক্ষেত্র বিশেষে খোঁজ-খবরও থাকে না। এভাবে দ্বীন প্রচার করা
নবী-রাসূলগণের পদ্ধতি নয়। এটা খ্রীষ্টানদের বৈরাগী ও হিন্দুদের সন্ন্যাসী হওয়ার
সাথে তুলনীয়। অতএব এসব পরিত্যাজ্য।
চ. উদ্দেশ্যহীন
জীবন :
পরিবার মানুষকে একটি স্থানে ও একটি লক্ষ্যে
চলতে সাহায্য করে। কখনও সে লক্ষ্যচ্যুত হ’লে পরিবারের অন্যান্য
সদস্যরা তাকে সঠিক পথে চলতে ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ফিরে আনতে তৎপর হয়। কিন্তু পরিবার
থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষের কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকে না। সে যা ইচ্ছা তাই
করে, যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে চলে যায়। পারিবারিক বন্ধনহীন এই জীবন
যেন হাল বিহিন নৌকার মত। সুতরাং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবনকে অশ্চিয়তার দিকে
ঠেলে দেওয়া কোন বিবেকবান মানুষের জন্য সমীচীন নয়।
(চলবে—ফেইসবুকে চোখরাখুন বাকী পর্ব আসবে)
ইসলামী আদর্শে
পরিবার গঠনে করণীয়
এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
(৩য় পর্ব)
পরিবারে
স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য :
স্বামী পরিবারের দায়িত্বশীল। তিনি পরিবারের সদস্যদের সাথে উত্তম
ব্যবহার করবেন। এটা তার দায়িত্ব। তিনি এ সম্পর্কে পরকালে জিজ্ঞাসিত হবেন। রাসূল (স.)
বলেন,إِنَّ اللهَ سَائِلٌ كُلَّ رَاعٍ عَمَّا اسْتَرْعَاهُ
أَحَفِظَ ذَلِكَ أَمْ ضَيَّعَهُ حَتّى يَسأَلَ الرَّجُلَ عَنْ أَهْلِ بَيْتِهِ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক দায়িত্বশীলকে তার
দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন যে,
সে
তা পালন করেছে, না করেনি? এমনকি
পুরুষকে তার পরিবার-পরিজন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন’।–(নাসাঈ, আস-সুনানুল
কুবরা, হা/৯১৭৪; ছহীহাহ হা/১৬৩৬; ছহীহুল
জামে‘ হা/১৭৭৪)
সেই সাথে স্বামীকে আদর্শ পরিবার গঠনের চেষ্টা
করতে হবে। এজন্য তাকে কিছু কাজ আবশ্যিকভাবে করতে হবে, যাতে
তার পরিবারের সদস্যরাও আদর্শ হিসাবে গড়ে ওঠে। স্বামীর করণীয়গুলিকে দু’ভাগে
ভাগ করা যায়। ১. বিবাহ পূর্ব করণীয় ২. বিবাহ পরবর্তী করণীয়। নিম্নে স্বামীর বিবাহ
পূর্ব করণীয়গুলি উল্লেখ করা হ’ল।-
১.
ঈমানদার ও উত্তম স্ত্রী নির্বাচন করা :
পরিবারের কল্যাণ ও শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য
ঈমানদার নারীকে বিবাহ করা যরূরী। মুমিনা সতি-সাধ্বী নারী স্বামীর সংসার, সন্তান-সন্ততি
ও অন্যান্য সদস্যদের প্রতি দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকে। সাথে সাথে দ্বীনী কাজে
সহায়তা করে। এজন্য মুমিনা নারীকে বিবাহ করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। যদি সে
কুৎসিৎ কালোও হয়। আল্লাহ বলেন,
وَلَا تَنْكِحُوا الْمُشْرِكَاتِ حَتَّى يُؤْمِنَّ
وَلَأَمَةٌ مُؤْمِنَةٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكَةٍ وَلَوْ أَعْجَبَتْكُمْ وَلَا
تُنْكِحُوْا الْمُشْرِكِيْنَ حَتَّى يُؤْمِنُوْا وَلَعَبْدٌ مُؤْمِنٌ خَيْرٌ مِنْ
مُشْرِكٍ وَلَوْ أَعْجَبَكُمْ أُولَئِكَ يَدْعُونَ إِلَى النَّارِ وَاللهُ يَدْعُو
إِلَى الْجَنَّةِ وَالْمَغْفِرَةِ بِإِذْنِهِ وَيُبَيِّنُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ
لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُوْنَ
‘আর তোমরা মুশরিক নারীদের
বিয়ে করো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে।
(মনে রেখ) মুমিন ক্রীতদাসী মুশরিক স্বাধীন নারীর চাইতে উত্তম। যদিও সে তোমাদের
বিমোহিত করে। আর তোমরা মুশরিক পুরুষদের বিয়ে করো না, যতক্ষণ
না তারা ঈমান আনে। (মনে রেখ) মুমিন ক্রীতদাস মুশরিক স্বাধীন পুরুষের চাইতে উত্তম।
যদিও সে তোমাদের বিমোহিত করে। ওরা জাহান্নামের দিকে আহবান করে। আর আল্লাহ স্বীয়
আদেশক্রমে জান্নাত ও ক্ষমার দিকে আহবান করেন। তিনি মানবজাতির জন্য স্বীয় আয়াত সমূহ
ব্যাখ্যা করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’।- (সূরা বাক্বারাহ-২/২২১))
নারীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে রাসূল (স.)
বলেন,تُنْكَحُ الْمَرْأَةُ لأَرْبَعٍ لِمَالِهَا
وَلِحَسَبِهَا وَجَمَالِهَا وَلِدِينِهَا، فَاظْفَرْ بِذَاتِ الدِّينِ تَرِبَتْ
يَدَاكَ، ‘নারীকে বিবাহ করা হয় চারটি কারণে (১) তার
সম্পদ (২) বংশ মর্যাদা (৩) সৌন্দর্য এবং (৪) তার দ্বীনদারির কারণে। এর মধ্যে তুমি
দ্বীনদারীকে অগ্রাধিকার দাও। নইলে তুমি কল্যাণ বঞ্চিত হবে’।–(বুখারী হা/৫০৯০; ‘বিবাহ’ অধ্যায়)
অন্যত্র রাসূল (স.) বলেন,إِذَا أَتَاكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ خُلُقَهُ وَدِينَهُ فَزَوِّجُوهُ
إِلاَّ تَفْعَلُوا تَكُنْ فِتْنَةٌ فِى الأَرْضِ وَفَسَادٌ عَرِيضٌ- ‘তোমাদের নিকট এমন কোন ব্যক্তি বিবাহের
প্রস্তাব নিয়ে এলে, যার চরিত্র ও ধার্মিকতা
সম্পর্কে তোমরা সন্তুষ্ট, তার সাথে (তোমাদের
মেয়েদের) বিবাহ দাও। তোমরা যদি তা না করো,
তাহ’লে
পৃথিবীতে বিপর্যয় ও ব্যাপক বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়বে’।–(তিরমিযী হা/১০৮৪; ইবনু
মাজাহ হা/১৯৬৭; ইরওয়া হা/১৮৬৮, ছহীহাহ হা/১০২২, সনদ
হাসান)
সুতরাং দ্বীনদার নারীকে বিবাহ করতে হবে।
আর মুমিনা উত্তম স্ত্রী পাওয়ার জন্য আগ্রহী
হওয়া ও আল্লাহর সাহায্য কামনা করা যরূরী। রাসূল (স.) বলেন, احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللهِ ‘তুমি তোমার জন্য উপকারী জিনিসের আকাঙ্ক্ষা কর
এবং আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর’।–(মুসলিম হা/২৬৬৪; ইবনু মাজাহ হা/৭৯;মিশকাত হা/৫২৯৮)
উত্তম
নারীর বৈশিষ্ট্য :
মুমিনা হওয়ার পরও নারীর মাঝে যেসব বৈশিষ্ট্য
থাকলে তাকে উত্তম স্ত্রী হিসাবে গণ্য হয়,
তন্মধ্যে
কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
ক. সতী-সাধ্বী, অনুগত ও লজ্জাস্থান হেফাযতকারিণী :
সেই উত্তম নারী যে সতী-সাধ্বী ও অনুগত এবং
স্বামীর অনুপস্থিতিতেও স্বীয় লজ্জাস্থান হেফাযতকারিণী। আল্লাহ বলেন, فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ
اللهُ ‘অতএব সতী-সাধ্বী স্ত্রীরা
হয় অনুগত এবং আল্লাহ যা হেফাযত করেছেন,
আড়ালেও
(সেই গুপ্তাঙ্গের) হেফাযত করে’।–(সূরা নিসা-৪/৩৪) আয়াতে বর্ণিত গুণাবলী দু’টি
ভাগে বিভক্ত। একটি হ’ল আল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্ট। অপরটি স্বামীর
সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্ট গুণ তথা সে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পুরাপুরি
মেনে চলে, তাঁর ইবাদত নিয়মিত আদায়
করে এবং দ্বীনের আবশ্যিক বিষয়গুলি পালনে অলসতা করে না। এসবই আল্লাহর অনুগত হওয়ার
পরিচায়ক। স্বামীর সাথে সম্পৃক্ত গুণ তথা স্বামীর উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিতে তার হক
আদায় করে এবং তার সন্তানাদি ও সম্পদ হেফাযত করে। আর নিজের লজ্জাস্থান হেফাযত করে।
রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন,إِذَا صلَّتِ الْمَرْأَةُ خَمْسَهَا، وَصَامَتْ شَهْرَهَا،
وَحَصَّنَتْ فَرْجَهَا، وَأَطَاعَتْ بَعْلَهَا، دَخَلَتْ مِنْ أَيِّ أَبْوابِ
الجَنَّةِ شَاءَتْ ‘নারী যখন পাঁচ ওয়াক্ত
ছালাত আদায় করবে, রামাযান মাসের ছিয়াম পালন
করবে, নিজের লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে, স্বামীর
আনুগত্য করবে তখন জান্নাতের যে কোন দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করবে’।–(ছহীহ ইবনে হিববান হা/৪১৬৩; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৯৩১, ২৪১১; মিশকাত
হা/৩২৫৪, সনদ ছহীহ)
নারীর লজ্জাস্থান হেফাযত করা তার সবচেয়ে
বড়গুণ। কারণ এর দ্বারা বিপর্যয়-বিশৃংখলার পথ বন্ধ হয়। আর এর অভাবে সংসারে
সর্বপ্রকার অনিষ্ট ও অকল্যাণ প্রবেশ করে এবং পাপাচারের পথ উন্মুক্ত হয়। সুতরাং
লজ্জাস্থানের হেফাযত নারীর কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য। তাই যে নারী তার নিজের কল্যাণ
কামনা করে সে যেন নিজের লজ্জাস্থান হেফাযত করে। আর আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর ইবাদতে
রত থাকে এবং স্বীয় কথা-কর্মের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য হাছিলের চেষ্টা করে। সেই
স্বামীর অনুগত থাকবে এবং নিজের লজ্জাস্থান হেফাযত করবে ও স্বামীর হক আদায়ে সদা
তৎপর থাকবে।
খ. দ্বীন
ও ঈমানের কাজে সহযোগী :
মুমিন নারী-পুরুষ পরস্পরের সহযোগী হবে। নেকীর
কাজে উৎসাহিত করবে এবং পাপের কাজে বাধা দিবে;
এটাই
হবে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি অন্যতম কর্তব্য। আল্লাহ বলেন,
وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ
أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيْعُوْنَ اللهَ
وَرَسُوْلَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُ إِنَّ اللهَ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ ‘আর মুমিন পুরুষ ও নারী পরস্পরের বন্ধু। তারা
সৎ কাজের আদেশ করে ও অসৎ কাজে নিষেধ করে। তারা ছালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে
এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এসব লোকের প্রতি আল্লাহ অবশ্যই অনুগ্রহ
বর্ষণ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান’।- (সূরা তওবা-৯/৭১) মুমিনা নারীকে শ্রেষ্ঠ সম্পদ অভিহিত করা
হয়েছে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ ثَوْبَانَ قَالَ لَمَّا نَزَلَتِ (الَّذِيْنَ
يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُوْنَهَا فِي سَبِيْلِ اللهِ
فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ) قَالَ كُنَّا مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه
وسلم فِى بَعْضِ أَسْفَارِهِ فَقَالَ بَعْضُ أَصْحَابِهِ أُنْزِلَ فِى الذَّهَبِ
وَالْفِضَّةِ مَا أُنْزِلَ. لَوْ عَلِمْنَا أَىُّ الْمَالِ خَيْرٌ فَنَتَّخِذَهُ
فَقَالَ أَفْضَلُهُ لِسَانٌ ذَاكِرٌ وَقَلْبٌ شَاكِرٌ وَزَوْجَةٌ مُؤْمِنَةٌ
تُعِينُهُ عَلَى إِيْمَانِهِ
ছাওবান (রাঃ) হ’তে
বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যারা সোনা ও রূপা জমা করে
রাখে এবং তা আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করে না তাদেরকে পীড়াদায়ক
আযাবের সুসংবাদ দাও’। -(সূরা তওবা-৯/৩৪), এ
আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময় আমরা নবী করীম (স.)-এর সাথে সফরে ছিলাম। কোন কোন ছাহাবী
বলেন, এ আয়াতটি সোনা ও রূপার সমালোচনায় অবতীর্ণ হয়েছে। কোন সম্পদ
উৎকৃষ্ট আমরা তা জানতে পারলে তা জমা করতাম। তখন রাসূলুল্লাহ (স.) বললেন, উৎকৃষ্ট
সম্পদ হ’ল (আল্লাহ তা‘আলার)
যিকরকারী জিহবা, কৃতজ্ঞ অন্তর ও ঈমানদার
স্ত্রী, যে স্বামীকে দ্বীনদারীর ব্যাপারে সহযোগিতা করে’।–(ইবনু মাজাহ হা/১৮৫৬; ছহীহাহ হা/২১৭৬)
অন্যত্র রাসূল (স.) বলেন,لِيَتَّخِذْ أَحَدُكُمْ قَلْبًا شَاكِرًا وَلِسَانًا ذَاكِرًا
وَزَوْجَةً مُؤْمِنَةً تُعِيْنُ أَحَدَكُمْ عَلَى أَمْرِ الآخِرَةِ ‘তোমাদের প্রত্যেকেই যেন অর্জন করে কৃতজ্ঞ
অন্তর, যিকরকারী জিহবা এবং আখেরাতের কাজে তাকে সহায়তাকারী ঈমানদার
স্ত্রী’।–(তিরমিযী হা/৩০৯৪; মিশকাত হা/২২৭৭, সনদ
ছহীহ)
গ.
প্রেম-ভালবাসা বিনিময়কারিণী :
স্বামী-স্ত্রীর সুসম্পর্ক বজায় থাকা পরিবারে
শান্তি বজায় থাকার অন্যতম শর্ত। এ সম্পর্ক অটুট রাখার জন্য স্ত্রীকে স্বামীর প্রতি
অতি প্রেমময়ী হওয়া যরূরী। এতে অন্য নারীর প্রতি স্বামীর মনে কখনো কোন আকর্ষণ
সৃষ্টি হয় না এবং তার বিপথগামী হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে না। আর এ ধরনের নারীর জন্যই
জান্নাত রয়েছে। রাসূল (স.) বলেন,
وَنِسَاؤُكُمْ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ الْوَدُوْدُ
الْعَؤُوْدُ عَلَى زَوْجِهَا، الَّتِي إِذَا غَضِبَ جَاءَتْ حَتَّى تَضَعَ يَدَهَا
فِيْ يَدِهِ، ثُمَّ تَقُولُ: لاَ أَذُوْقُ غَمْضًا حَتَّى تَرْضَى
‘তোমাদের জান্নাতী রমণীগণ
হচ্ছে যারা স্বামীর প্রতি প্রেমময়ী ও অধিক সন্তান প্রসবকারিণী। স্বামী ক্রদ্ধ হ’লে
সে এসে স্বামীর হাতে হাত রেখে বলে,
আপনি
আমার প্রতি সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আমি ঘুমাব না’।–(ছহীহুল জামে‘ হা/২৬০৪; ছহীহাহ হা/২৮৭)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, هذِهِ يَدِيْ فيْ يَدِكَ لاَ أَكْتَحِلُ بِغَمْضٍ حَتَّى تَرْضَى ‘এই আমার হাত আপনার হাতের মধ্যে রাখছি, আপনি
আমার প্রতি সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আমি চোখে মুদিত করব না’।–(ছহীহাহ হা/৩৩৮০; ছহীহ
আত-তারগীব হা/১৯৪১)
অর্থাৎ আমি ঘুমাব না, আরাম-আয়েশ
করব না।
ঘ. স্বামীকে
মুগ্ধকারিণী :
উত্তম স্ত্রীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’ল
নিজের প্রতি স্বামীকে আকর্ষিত করার চেষ্টা করা। সেটা কয়েকভাবে হতে পারে। নিজের
আকার-আকৃতিকে কেবল স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য সুন্দর করা। স্বামীর সামনে সুন্দর ও
পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করে সর্বদা স্বামীকে নিজের দিকে আকর্ষিত করার চেষ্টা করা।
সেই সাথে স্বামী যে ধরনের পোশাক পসন্দ করে সেগুলো পরিধান করা কেবল স্বামীর নযর
কাড়ার জন্য। আচার-ব্যবহারে সর্বদা খোশ মেজাযী ও হাসি-খুশী থাকা। কথা-বার্তার
ক্ষেত্রে সর্বদা মিষ্টি হাসিতে স্বামীর মন জয় করে নেওয়া। স্বামীর সেবায় নিজেকে
নিয়োজিত রাখা, তার অনুগত থাকা এবং তাঁর
নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করা। এক্ষেত্রে কোন প্রকার গর্ব, অহংকার, আত্মম্ভরিতা
প্রকাশ না করা। ঐসব বিষয়ে হাদীছে এসেছে,
রাসূল
(স.)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল,أَىُّ النِّسَاءِ خَيْرٌ قَالَ
الَّتِى تَسُرُّهُ إِذَا نَظَرَ وَتُطِيْعُهُ إِذَا أَمَرَ وَلاَ تُخَالِفُهُ فِى
نَفْسِهَا وَمَالِهَا بِمَا يَكْرَهُ. ‘কোন নারী উত্তম? তিনি
উত্তরে বললেন, যে স্বামীকে আনন্দিত করে
যখন সে (স্বামী) তার দিকে তাকায়; যখন সে নির্দেশ দেয়, তা
মান্য করে। তার নিজের ও স্বামীর সম্পদের ব্যাপারে স্বামীর অপসন্দনীয় কাজের
বিরোধিতা করে না’।–(নাসাই
হা/৩২৩১; মিশকাত
হা/৩২২৭; ছহীহাহ
হা/১৮৩৮)
অর্থাৎ নিজে স্বামীর অপসন্দনীয় কাজ করবে না
এবং স্বামীর বিনা অনুমতিতে তার সম্পদ খরচ করবে না।
অন্যত্র রাসূল (স.) বলেন,أَلاَ أُخْبِرُكَ بِخَيْرِ مَا يَكْنِزُ الْمَرْءُ الْمَرْأَةُ
الصَّالِحَةُ إِذَا نَظَرَ إِلَيْهَا سَرَّتْهُ وَإِذَا أَمَرَهَا أَطَاعَتْهُ
وَإِذَا غَابَ عَنْهَا حَفِظَتْهُ ‘আমি কি তোমাকে মানুষের
সর্বোত্তম সম্পদ সম্পর্কে অবহিত করব না?
তা
হ’ল, নেককার স্ত্রী। সে
(স্বামী) তার (স্ত্রীর) দিকে তাকালে স্ত্রী তাকে আনন্দ দেয়, তাকে
কোন নির্দেশ দিলে সে তা মেনে নেয় এবং সে যখন তার থেকে অনুপস্থিত থাকে, তখন
সে তার সতীত্ব ও তার সম্পদের হেফাযত করে’।–(আবুদাউদ হা/১৬৬৪; মিশকাত হা/১৭৮১; ছহীহুল জামে‘ হা/১৬৪৩)
উপরোক্ত আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, নারীর
সব কিছুই হবে স্বামীকে কেন্দ্র করে। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় হচ্ছে নারী স্বামীর
জন্য নিজেকে মোহনীয় ও সুসজ্জিত করে না। বরং সে নিজেকে সুশোভিত করে কেবল বাড়ির
বাইরে যাওয়ার জন্য বা কোন পার্টি ও উৎসবে অংশগ্রহণ কিংবা কোন বিশেষ কারো বাড়ীতে
আগমনের জন্য। পক্ষান্তরে স্বামীর কাছে যখন থাকে তখন অপরিস্কার-অপরিচ্ছন্ন কাপড়ে
থাকে, চুল থাকে এলোমেলো ও অপরিপাটি, শরীর
থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। এছাড়া আরো অন্যান্য খারাপ গুণ তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়।
সুতরাং স্বামী তার দিকে আকৃষ্ট হবে কিভাবে?
ঙ.
বিপদাপদে সান্ত্বনা দানকারিণী :
মানুষ বিভিন্ন বিপদাপদ ও অসুখ-বিসুখে অনেক
সময় মুষড়ে পড়ে। এসময় তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়োজন হয়। আদর্শ ও গুণবতী স্ত্রীর
অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’ল বিপদে স্বামীকে সান্ত্বনা দেওয়া ও ধৈর্য
ধারণে সাহায্য করা। রাসূল (স.) আরো বলেন,خَيْرُ نِسائِكُمُ الوَلُوْدُ
الوَدُوْدُ الْمُوَاسِيَةُ الْمُوَاتِيَةُ إذَا اتَّقَيْنَ الله ‘তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে উত্তম হ’ল
যারা প্রেমময়ী, অধিক সন্তান প্রসবকারিণী, সান্ত্বনাদানকারিণী
ও (স্বামীর) বাধ্যগত ও অনুগতা যখন তারা আল্লাহকে ভয় করে’।–(বায়হাক্বী, আস-সুনানুল
কুবরা; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৩৩০; ছহীহাহ হা/১৮৪৯)
এক্ষেত্রে প্রথম অহী নাযিলের প্রাক্কালে
উম্মুল মুমিনীন খাদীজা (রাঃ) কর্তৃক রাসূল (স.)-কে প্রদত্ত সান্ত্বনাবাণী
বিশেষভাবে স্মরণীয় ও অনুকরণীয়।–(বুখারী হা/৩; মুসলিম
হা/১৬০; মিশকাত হা/৫৮৪১)
অনুরূপভাবে উম্মে সুলাইম (রাঃ) কর্তৃক
তার স্বামীকে প্রদত্ত সান্ত্বনার ঘটনাটি স্মর্তব্য। ঘটনাটি হ’ল
এরূপ- তাদের একটি ছেলে মারা গেল। উম্মু সুলাইম পরিবারের সদস্যদের বললেন, আমি
না বলা পর্যন্ত তাকে সন্তান মৃত্যুর কথা কেউ বলবে না। আবু ত্বালহা আসলে তার সামনে
রাতের খাবার পেশ করলেন। তিনি পানাহার করলেন। এরপর সুসজ্জিত হয়ে নিজেকে স্বামীর
কাছে পেশ করলেন। স্বামী আবু ত্বালহা পরিতৃপ্ত হ’লে
তাকে এ বলে সান্ত্বতনা দেন যে, কোন সম্প্রদায় যদি কোন
দম্পতির নিকট একটি আমানত রাখে, অতঃপর তারা তাদের আমানত
ফেরৎ নিয়ে নেয়, তাহ’লে
আপনি সেটা কোন দৃষ্টিতে দেখবেন? তাদের নিষেধ করার কোন
অধিকার আপনার আছে কি? আবু ত্বালহা উত্তর দিলেন, না।
উম্মে সুলাইম বললেন, আপনার ছেলেকে সেই আমানত
গণ্য করুন। তাকে হারানো পুণ্য বিবেচনা করুন। এ ঘটনা অবহিত হয়ে রাসূল (স.) বলেন,بَارَكَ اللهُ لَكُمَا فِيْ غَابِرِ لَيْلَتِكُمَا. ‘আল্লাহ তা‘আলা
তোমাদের গত রাতের মিলনে বরকত দান করুন’। এরপর উম্মে সুলাইমের একটি পুত্র সন্তান
জন্মগ্রহণ করে।–(বুখারী হা/৫৪৭০; মুসলিম
হা/২১৪৪ (১০৭), ‘আবু ত্বালহার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ)
চ.
স্বামীর চাহিদা পূরণকারিণী :
গুণবতী স্ত্রী সদা স্বামীর সেবা-যত্ন ও তার
সার্বিক চাহিদা পূরণে নিয়োজিত থাকবে। রাসূল (স.) বলেন,إِذَا الرَّجُلُ دَعَا زَوْجَتَهُ لِحَاجَتِهِ فَلْتَأْتِهِ وَإِنْ
كَانَتْ عَلَى التَّنُّورِ ‘কোন লোক তার স্ত্রীকে নিজ
প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে ডাকলে সে যেন তার নিকট আসে যদিও সে চুলার উপর
রান্না-বান্নার কাজে ব্যস্ত থাকে’।–(তিরমিযী হা/১১৬০; মিশকাত
হা/৩২৫৭; ছহীহাহ হা/১২০২)
অন্য বর্ণনায় আছে,إِذَا دَعَا الرَّجُلُ امْرَأَتَهُ إِلَى فِرَاشِهِ فَلْتُجِبْ
وَإنْ كَانَتْ عَلَى ظَهْرِ قَتَبٍ ‘যখন স্বামী তার স্ত্রীকে
নিজ প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে ডাকে সে যেন তার ডাকে সাড়া দেয় যদিও সে উটের গদির
উপরে থাকে’।––(মুসনাদুল
বায্যার, ছহীহাহ হা/১২০৩)
ছ.
স্বামীর অধিকার পূরণে অগ্রগামী :
উত্তম নারী হচ্ছে যে স্বামীর অধিকার আদায়ে
কমতি করে না বরং তার খেদমতে সাধ্যমত চেষ্টা করে। উম্মুল হুছাইন বিন মিহছান তার
ফুফু থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি তার কোন প্রয়োজনে
রাসূল (স.)-এর দরবারে গমন করেন। তার প্রয়োজন শেষ হ’লে
রাসূল (স.) বললেন, তুমি কি বিবাহিতা? তিনি
বললেন, হ্যাঁ। রাসূল (স.) বললেন, তুমি
তার জন্য কেমন? তিনি বললেন, আমি
অক্ষম না হওয়া পর্যন্ত তার সেবা করি। রাসূল (স.) বললেন,انْظُرِىْ أَيْنَ أَنْتِ مِنْهُ فَإِنَّهُ جَنَّتُكِ وَنَارُكِ ‘লক্ষ্য কর, তার
থেকে তুমি কোথায়? কেননা সে তোমার জান্নাত ও
জাহান্নাম’।-–(মুসনাদ
আহমাদ, ছহীহুল জামে‘ হা/১৫০৯; ছহীহাহ হা/২৬১২)
জ. খরচের
ক্ষেত্রে স্বামীকে কষ্ট না দেওয়া :
জীবন যাত্রার মান সবার সমান নয়। অর্থনৈতিক
অবস্থার উপরে মানুষের জীবন যাত্রার মান নির্ভর করে। সুতরাং স্বামীকে ভরণ-পোষণের
ব্যাপারে কষ্টে নিপতিত করা আদর্শ নারীর বৈশিষ্ট্য নয়। বরং তার আয় বুঝে ব্যয় করার
চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে স্ত্রী কখনোই বিলাসী, অপব্যয়ী
ও সম্পদ বিনষ্টকারিনী হবে না। বরং মিতব্যয়ী হওয়া তার জন্য অবশ্য কর্তব্য। আল্লাহ
বলেন,وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ
يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا ‘তারা
যখন ব্যয় করে, তখন অপব্যয় করে না বা
কৃপণতা করে না। বরং তারা এতদুভয়ের মধ্যবর্তী অবস্থায় থাকে’। (সূরা ফুরক্বান-২৫/৬৭) রাসূল (স.) বলেন,كَانَتِ امْرَأَةٌ مِنْ بَنِى إِسْرَائِيلَ قَصِيرَةٌ تَمْشِى مَعَ
امْرَأَتَيْنِ طَوِيلَتَيْنِ فَاتَّخَذَتْ رِجْلَيْنِ مِنْ خَشَبٍ وَخَاتَمًا مِنْ
ذَهَبٍ مُغْلَقٍ مُطْبَقٍ ثُمَّ حَشَتْهُ مِسْكًا وَهُوَ أَطْيَبُ الطِّيبِ
فَمَرَّتْ بَيْنَ الْمَرْأَتَيْنِ فَلَمْ يَعْرِفُوهَا فَقَالَتْ بِيَدِهَا
هَكَذَا ‘বানী ইসরাঈলের এক খাটো
মহিলা দীর্ঘকায় দু’জন মহিলার সাথে চলাফেরা করত। অতঃপর কাঠের দু’টি
পা তৈরী করে নিল এবং সোনা দিয়ে একটি বড় আংটি প্রস্ত্তত করে তাতে মিশক ভরে দিল। তা
হ’ল সুগন্ধিগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম। পরে সে এই মহিলাদ্বয়ের
মধ্যে চলতে লাগল এবং লোকেরা তাকে চিনতে পারল না। তখন সে তার হাত দিয়ে এভাবে ঝাড়া
দিল’।-(মুসলিম হা/২২৫২)
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
إنَّ أَوَّلَ مَا هَلَكَ بَنَوُ إسْرائيلَ أنَّ
امرَأةَ الفْقِير كَانَتْ تُكَلّفُهُ مِنَ الثّيابِ أوْ الصّيَغِ أوْ قَالَ :
مِن الصّيغَةِ مَا تُكَلّفُ امْرَأةَ الغني، فَذَكَرَ امرأةً مِنْ بني إسْرَائِيلَ
كانتَ قَصِيرةً واتّخذّتْ رِجْلين مِنْ خشب، وَخَاتَماَ لَهُ غَلْقٌ وَطَبَقٌ،
وَحَشَتْهُ مسْكاً، وَخَرجَتْ بَيْنَ امْرَأتيْن طوَيلتَيْن، أوْ جسيمَتْيْن،
فَبَعَثُوْا إنساناً يَتْبَعُهمَ، فَعَرَفَ الطوِيلتَينِ، وَلَمْ يَعْرِفْ صَاحبةَ
الرِّجْلين مِنْ خَشَبٍ
‘বানী ইসরাঈলের প্রথমে যে
ধ্বংস হয় সে ছিল এক দরিদ্র মহিলা। সে পোষাকে বা অলংকারে বাড়াবাড়ি করত। অথবা তিনি
বলেন, অলংকারে। যেরূপ ধনীর স্ত্রী বাড়াবাড়ি করে। অতঃপর তিনি
উল্লেখ করেন যে, বানী ইসরাঈলের এক খাটো
মহিলা কাঠের দু’টি পা তৈরী করে নিল এবং সোনা দিয়ে একটি বড় আংটি
প্রস্ত্তত করে তাতে মিশক ভরে দিল। আর সে দীর্ঘকায় বা মোটা দুই মহিলার সাথে বের হ’ল।
লোকের তাদের পিছু নেওয়ার জন্য এক ব্যক্তিকে পাঠাল। সে দীর্ঘদেহী মহিলাদ্বয়কে চিনতে
পারল কিন্তু কাঠের পা ওয়ালাকে চিনতে পারল না’।––(আহমাদ, ছহীহাহ
হা/৫৯১)
ঝ. নে‘মতের
শুকরিয়া জ্ঞাপন করা :
আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতের
শুকরিয়া আদায় করা উত্তম নারীর বৈশিষ্ট্য। তদ্রূপ স্বামীর মাধ্যমে আল্লাহ তাকে যে
নে‘মত দান করেছেন তারও শুকরিয়া আদায় করে। রাসূল (স.) বলেন,لاَ يَشْكُرُ اللهَ مَنْ لاَ يَشْكُرُ النَّاسَ ‘যে ব্যক্তি মানুষের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না
সে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না’।-–(আবুদাউদ হা/৪৮১১; তিরমিযী
হা/১৯৫৪; মিশকাত হা/৩০২৫; ছহীহাহ হা/৪১৭)
অন্যত্র রাসূল (স.) বলেন,أُرِيْتُ النَّارَ فَإِذَا أَكْثَرُ أَهْلِهَا النِّسَاءُ
يَكْفُرْنَ. قِيلَ أَيَكْفُرْنَ بِاللهِ قَالَ يَكْفُرْنَ الْعَشِيرَ، وَيَكْفُرْنَ
الإِحْسَانَ، لَوْ أَحْسَنْتَ إِلَى إِحْدَاهُنَّ الدَّهْرَ ثُمَّ رَأَتْ مِنْكَ
شَيْئًا قَالَتْ مَا رَأَيْتُ مِنْكَ خَيْرًا قَطُّ ‘আমাকে
জাহান্নাম দেখানো হয়। (আমি দেখলাম),
তার
অধিবাসীদের অধিকাংশই নারী। (কারণ) তারা কুফরী করে। জিজ্ঞেস করা হ’ল, তারা
কি আল্লাহর সঙ্গে কুফরী করে? তিনি বললেন, তারা
স্বামীর অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ হয় এবং তার অনুগ্রহকে অস্বীকার করে। তুমি যদি দীর্ঘদিন
তাদের কারো প্রতি ইহসান করো, অতঃপর সে তোমার সামান্য
অবহেলা দেখতে পেলেই বলে ফেলে, আমি কখনও তোমার নিকট হ’তে
ভালো ব্যবহার পাইনি’।–(বুখারী
হা/২৯; মুসলিম হা/৯০)
আসমা বিনতু ইয়াযীদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী
করীম (স.) মসজিদের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন একদল মহিলা তথায় বসা ছিলেন। তিনি
হাতের ইশারায় তাদেরকে সালাম দেয়ার পর বলেন,
إِيَّاكُنَّ وَكُفْرَ
الْمُنَعَّمِيْنَ. فَقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَا كُفْرُ الْمُنَعَّمِيْنَ؟
قَالَ لَعَلَّ إِحْدَاكُنَّ تَطُولُ أَيْمَتُهَا مِنْ أَبَوَيْهَا ثُمَّ
يَرْزُقُهَا مِنْهُ وَوَلَداً فَتَغْضَبَ الْغَضْبَةَ فَتَكْفُرُ فَتَقُوْلُ مَا
رَأَيْتُ مِنْكَ خَيْراً قَطُّ. ‘তোমরা নে‘মতপ্রাপ্তদের
অকৃতজ্ঞতা থেকে সাবধান হও। রাবী বলেন,
আমি
বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! নে‘মতপ্রাপ্তদের অকৃতজ্ঞতা কি? তিনি
বললেন, হয়তো তোমাদের কোন নারী পিতা-মাতার নিকট দীর্ঘদিন থাকে।
অর্থাৎ দেরীতে বিবাহ হয়। অতঃপর আল্লাহ তাকে স্বামী ও তার সন্তান দান করেন। অতঃপর
সে অত্যন্ত রাগান্বিত হয় এবং নে‘মত অস্বীকার করে বলে, আমি
কখনো তার থেকে কোন ভালো ব্যবহার পাইনি’।-(আহমাদ, আদাবুল
মুফরাদ হা/১০৪৮; ছহীহাহ হা/৮২৩)
পরকালে এ ধরনের নারীর পরিণতি হবে ভয়াবহ।
রাসূল (স.) বলেন,لاَ يَنْظُرُ اللهُ إِلَى
امْرَأَةٍ لاَ تَشْكَرُ لِزَوْجِهَا وَهِيَ لاَ تَسْتَغْنِيْ عَنْهُ ‘আল্লাহ ঐ মহিলার দিকে তাকাবেন না যে তার
স্বামীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না এবং স্বামীকে ছাড়া তার চলে না’।–(হাকেম, ছহীহাহ হা/২৮৯;ছহীহ
আত-তারগীব হা/১৯৪৪)
ঞ.
স্বামীকে সম্মান করা ও তাকে কষ্ট না দেওয়া :
স্বামীকে যথাযথ সম্মান করা ও তাকে কষ্ট না
দেওয়া উত্তম নারীর বৈশিষ্ট্য। রাসূল (স.) বলেন,لَوْ كُنْتُ أُمِرَ أَحَدًا
أَنْ يَسْجُدَ لِأَحَدٍ لاَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا. ‘আমি যদি কোন ব্যক্তিকে কারো জন্য সিজদা করতে
আদেশ দিতাম, তবে স্ত্রীকেই তার
স্বামীকে সিজদা করার জন্য আদেশ করতাম’।–(আবুদাউদ হা/২১৪০; তিরমিযী
হা/১১৫৯; মিশকাত হা/৩২৫৫, ‘বিবাহ’ অধ্যায়)
কিন্তু অনেক মহিলা বিভিন্নভাবে স্বামীকে কষ্ট
দেয়। যা উচিত নয়। এর জন্য জান্নাতের হূররা তার জন্য বদদো‘আ
করে। রাসূল (স.) বলেন,لاَ تُؤْذِي امْرَأَةٌ
زَوْجَهَا فِي الدُّنْيَا إِلاَّ قَالَتْ زَوْجَتُهُ مِنَ الْحُوْرِ الْعِيْنِ لاَ
تُؤْذِيْهِ قَاتَلَكِ اللهُ فَإِنَّمَا هُوَ عِنْدَكِ دَخِيْلٌ يُوْشِكُ أَنْ
يُفَارِقَكِ إِلَيْنَا. ‘যখন কোন নারী তার স্বামীকে
দুনিয়াতে কষ্ট দেয়, তখন জান্নাতের হূরদের
মধ্যে যে তার স্ত্রী হবে সে বলে, (হে অভাগিনী!) তুমি তাকে
কষ্ট দিও না। আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন। তিনি তোমার কাছে আগন্তুক। অল্প দিনের
মধ্যেই তিনি তোমাকে ছেড়ে আমাদের কাছে চলে আসবেন’।–( তিরমিযী হা/১১৭৪; ইবনু
মাজাহ হা/২০১৪; মিশকাত হা/৩২৫৮)
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের কাছে
আল্লাহর হক হ’ল মানুষ কেবল তাঁর ইবাদত করবে ও তাঁর বিধান
মেনে চলবে। নারীর জন্য বিশেষ নির্দেশ হ’ল সে আল্লাহর হকের
পাশাপাশি স্বামীর হকও আদায় করবে। স্বামীর হক আদায় করলেই আল্লাহর হক আদায় হয়। রাসূল
(স.) বলেন,وَالَّذِيْ نَفْسُ مُحَمَّدٍ
بِيَدِهِ لاَ تُؤَدِّي الْمَرْأَةُ حَقَّ رَبِّهَا حَتَّى تُؤَدِّيَ حَقَّ
زَوْجِهَا وَلَوْ سَأَلَهَا نَفْسَهَا وَهِيَ عَلَى قَتَبٍ لَمْ تَمْنَعْهُ. ‘যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তাঁর কসম করে
বলছি, স্ত্রী ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর হক্ব আদায় করতে পারে না, যতক্ষণ
পর্যন্ত সে তার স্বামীর হক্ব আদায় না করবে। যদি স্বামী উটের গদির উপর থাকা অবস্থায়
স্ত্রীর সাথে সহবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করে,
তবুও
স্ত্রীকে সম্মতি প্রকাশ করতে হবে’।–(ইবনু মাজাহ হা/১৮৫৩; আদাবুয যিফাফ ২৮৪ পৃঃ, হাদীছ ছহীহ)
ট.
বাড়ীতে অবস্থান করা :
মহিলাদের কাজ হ’ল
বাড়ীতে। তাই বাড়ীর অভ্যন্তরে থাকাই তার জন্য আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন, وَقَرْنَ فِيْ بُيُوْتِكُنَّ وَلاَ تَبَرَّجْنَ
تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الأُولَى- ‘তোমরা স্বগৃহে অবস্থান কর, প্রাচীন
জাহেলী যুগের নারীদের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করো না।’
(সূরা
আহযাব-৩৩/৩৩) আর বাড়ীর বাইরে গেলে শয়তান তাকে বেপর্দা করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন
করে। রাসূল (স.) বলেছেন,الْمَرأَةُ عَوْرَةٌ فَإِذَا
خَرَجَتْ إِسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ. ‘নারী হচ্ছে গোপন বস্তু।
যখন সে বাড়ি থেকে বের হয়, তখন শয়তান তাকে (সৌন্দর্য
প্রকাশে) উদ্বুদ্ধ করে’।–(তিরমিযী, সনদ ছহীহ, মিশকাত
হা/৩১০৯)
ঠ.
স্বামীর গোপনীয় বিষয় ও উভয়ের মধ্যবর্তী বিশেষ কাজ প্রকাশ না করা :
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সংঘটিত কার্যাবলী গোপনীয়
বিষয়। তা প্রকাশ করা নির্লজ্জতা। আর একাজের জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে। রাসূল
(স.) বলেন,إِنَّ مِنْ أَشَرِّ النَّاسِ
عِنْدَ اللهِ مَنْزِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ الرَّجُلَ يُفْضِى إِلَى امْرَأَتِهِ
وَتُفْضِى إِلَيْهِ ثُمَّ يَنْشُرُ سِرَّهَا- ‘কিয়ামাতের দিন মহান আল্লাহর নিকট মর্যাদায় সর্বনিকৃষ্ট হবে
ঐ ব্যক্তি যে স্ত্রীর সাথে যৌন সম্ভোগ করে তার গোপনীয়তা প্রকাশ করে’।–(মুসলিম হা/১৪৩৭; মিশকাত
হা/৩১৯০)
অন্যত্র তিনি বলেন,
لَعَلَّ رَجُلاً يَقُولُ مَا يَفْعَلُ بِأَهْلِهِ
وَلَعَلَّ امْرَأَةً تُخْبِرُ بِمَا فَعَلَتْ مَعَ زَوْجِهَا. فَأَرَمَّ الْقَوْمُ
فَقُلْتُ إِى وَاللهِ يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّهُنَّ لَيَقُلْنَ وَإِنَّهُمْ
لَيَفْعَلُونَ. قَالَ فَلاَ تَفْعَلُوْا فَإِنَّمَا مِثْلُ ذَلِكَ مِثْلُ
الشَّيْطَانِ لَقِىَ شَيْطَانَةً فِى طَرِيقٍ فَغَشِيَهَا وَالنَّاسُ يَنْظُرُونَ
‘হয়তো পুরুষ তার স্ত্রীর
সাথে কৃত কর্মকান্ড প্রকাশ করে এবং স্ত্রীও স্বামীর সাথে সংঘটিত কর্ম প্রকাশ করে
দেয়। লোকেরা নীরব-নিশ্চুপ থাকল। আমি বললাম,
আল্লাহর
কসম! হে আল্লাহর রাসূল, নিশ্চয়ই নারী-পুরুষরা এসব
করে। তিনি বললেন, তোমরা এরূপ কর না। কেননা
এরূপ কর্ম হচ্ছে শয়তানের কর্মকান্ডের ন্যায়। যে শয়তান পুরুষ নারীকে রাস্তায় দেখে
জড়িয়ে ধরে আর মানুষ তা দেখতে থাকে’।–( আহমাদ, ইরওয়া
৭/৭৪; আদাবুয যিফাফ, পৃঃ ৭১, সনদ
হাসান)
ড.
সন্তানের প্রতি স্নেহশীলা :
সন্তানের প্রতি যত্নশীল ও স্নেহময়ী নারীকে
মহানবী (স.) উত্তম নারী হিসাবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন,نِسَاءُ قُرَيْشٍ خَيْرُ نِسَاءٍ رَكِبْنَ الإِبِلَ، أَحْنَاهُ
عَلَى طِفْلٍ، وَأَرْعَاهُ عَلَى زَوْجٍ فِى ذَاتِ يَدِهِ. ‘কুরাইশ বংশীয়া নারীরা উটে আরোহণকারী সকল নারীদের তুলনায়
উত্তম। এরা শিশু সন্তানের উপর অধিক স্নেহশীলা হয়ে থাকে আর স্বামীর সম্পদের প্রতি
খুব যত্নবান হয়ে থাকে।–(বুখারী
হা/৩৪৩৪, ৫০৮২, ৫৩৬৫; মুসলিম
৪৪/৪৯ হা/২৫২৭; মিশকাত হা/৩০৮৪)
ঢ.
লজ্জাশীলা :
লজ্জা ঈমানের অঙ্গ।–(বুখারী হা/২৪, ৬১১৮; মুসলিম
হা/৩৬; মিশকাত হা/৫০৭০) সুতরাং উত্তম নারীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লজ্জাশীলা
হওয়া। পক্ষান্তরে যার লজ্জা নেই সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে।–(বুখারী হা/৩৪৮৪, ৬১২০; মিশকাত
হা/৫০৭২)
এতদ্ব্যতীত মনে-প্রাণে স্বামীর উপদেশ শ্রবণ
করা ও মান্য করা, স্বামীর সাথে অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ
না করা ও উচ্চ শব্দে কথা না বলা, বরং কথাবার্তায় শালীনতা
বজায় রাখা, বাকবিতন্ডা না করা, স্বামীর
পিতামাতা ও ভাই-বোনদের প্রতি ইহসান করা ইত্যাদি উত্তম ও গুণবতী নারীদের
বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত।
[চলবে----------]
নিন্দিত
নারী :
মানুষকে আল্লাহ সম্মানিত করেছেন। (সূরা ইসরা-১৭/৭০) কিন্তু তাদের বিভিন্ন স্বভাব-প্রকৃতির কারণে
কেউ নন্দিত হয়, কেউ নিন্দিত হয়। আমাদের মা, বোন, স্ত্রী, কন্যারাও
তাদের কিছু অবাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যের কারণে সমাজে নিগৃহীত ও নিন্দিত হয়। পরিবার ও
সমাজে তাদের নিয়ে সৃষ্টি হয় নানা বিবাদ-বিসম্বাদ, ঘটে
যায় বহু বিপর্যয় ও অপ্রীতিকর ঘটনা। ঐসব নিন্দিত নারী থেকে রাসূল (স.) আল্লাহর কাছে
আশ্রয় প্রার্থনা করতেন এভাবে-
اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ جَارِ
السُّوْءِ، وَمِنْ زَوْجٍ تَشَيِّبَنِيْ قَبْلَ الْمَشِيْبِ، وَمِنْ وَلَدٍ
يَكُوْنُ عَلَيَّ رَبًّا، وَمِنْ مَالٍ يَكُوْنُ عَلَيَّ عَذَاباً، وَمِنْ
خَلِيْلٍ مَاكِرٍ عَيْنَهُ تَرَانِيْ، وَقَلْبُهُ يَرْعَانِيْ؛ إِنْ رَأَى
حَسَنَةً دَفَنَهَا، وَإِذَا رَأَى سَيِّئَةً أَذَاعَهَا
‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে
আশ্রয় প্রার্থনা করছি মন্দ প্রতিবেশী থেকে;
এমন
স্ত্রী থেকে যে বার্ধক্য আসার পূর্বেই আমাকে বৃদ্ধ করে দেয়; এমন
পুত্র সন্তান থেকে যে আমার মনিব স্বরূপ হয়ে যায়; এমন
সম্পদ থেকে যা আমার আযাবের কারণ হয় এবং এমন ধোঁকাবাজ বন্ধু থেকে যার চোখ আমাকে
দেখে আর তার অন্তর আমাকে পর্যবেক্ষণ করে। যদি সে ভাল কিছু দেখে, তাহ’লে
তা গোপন করে। আর মন্দ কিছু দেখলে তা প্রচার করে’।–(তাবারানী, ছহীহাহ
হা/৩১৩৭)
এখানে নিন্দনীয় নারীদের কিছু দোষ-ত্রুটি
উল্লেখ করা হ’ল-
ক.
স্বামীর অবাধ্যতা করা :
স্ত্রী স্বামীর অনুগত ও বাধ্যগত থাকবে এটাই
স্বাভাবিক। কিন্তু কোন কোন স্ত্রী স্বামীর কথা শুনতে চায় না। স্বামীকে বাধ্য করে
তার কথা মত চলতে। কখনো নিজের একরোখা মেজায ও গোঁড়ামির কারণে, কখনও
নিজের আর্থিক সচ্ছলতার কারণে, কখনও পিতামাতার
প্রভাব-প্রতিপত্তি ও অর্থনৈতিক সচ্ছল অবস্থার কারণে এরূপ হয়ে থাকে। যে কারণেই হোক
না কেন স্ত্রী স্বামীর অবাধ্য হ’লে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
রাসূল (স.) বলেন,اِثْنَانِ لاَ تُجَاوِزُ
صَلاَتُهُمَا رُءُوْسَهُمَا عَبْدٌ آبِقٌ مِنْ مَوَالِيْهِ حَتَّى يَرْجِعَ
وَامْرَأةٌ عَصَتْ زَوْجَهَا حَتَّى تَرْجِعَ- ‘দুই
ব্যক্তির ছালাত তাদের মাথা অতিক্রম করে না। ১. মনিবের নিকট থেকে পলাতক গোলাম
যতক্ষণ সে ফিরে না আসে। ২. ঐ মহিলা যে তার স্বামীর অবাধ্যতা করে, যতক্ষণ
সে তার আনুগত্যে ফিরে না আসে’।–(তাবারাণী, ছাগীর; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৮৮৮, ১৯৪৮; ছহীহাহ
হা/২৮৮) তবে এ আনুগত্য হবে শারঈ সীমারেখার মধ্যে।
কেননা স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোন আনুগত্য নেই।–(ছহীহুল জামে‘ হা/৭৫২০)
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর কথামত
চলতে গিয়ে বিভিন্ন পাপে জড়িয়ে পড়ে। শিরক-বিদ‘আতে লিপ্ত হয়। আল্লাহর
অসন্তুষ্টিমূলক বিভিন্ন কাজ করে বসে,
যা
আদৌ ঠিক নয়। এভাবে আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে মানুষের সন্তুষ্টি কামনা করার পরিণতি
ভয়াবহ। রাসূল (স.) বলেন,مَنِ الْتَمَسَ رِضَا اللهِ
بِسَخَطِ النَّاسِ كَفَاهُ اللهُ مُؤْنَةَ النَّاسِ وَمَنِ الْتَمَسَ رِضَا
النَّاسِ بِسَخَطِ اللهِ وَكَلَهُ اللهُ إِلَى النَّاسِ ‘যে
ব্যক্তি মানুষের অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, মানুষের
দুঃখ-কষ্ট থেকে বাঁচাতে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে
অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি কামনা করে,
আল্লাহ
তাকে মানুষের দায়িত্বে ছেড়ে দেন’।–(তিরমিযী হা/২৪১৪; ছহীহাহ
হা/২৩১১; ছহীহুহল জামে‘ হা/৬০৯৭)
খ.
স্বামীকে রাগান্বিত করা :
অনেক মহিলা স্বামীর অপসন্দনীয় কাজগুলি বেশী
বেশী করে স্বামীকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বা তাকে রাগান্বিত করার জন্য। স্বামী তার
প্রয়োজনীয় সবকিছু যথাযথভাবে প্রদান করলেও সে যেন খুশি হ’তেই
চায় না। কোন কিছুর বিনিময়েই ঐসব মহিলা তাদের বদঅভ্যাস ত্যাগ করে না। বরং স্বামীকে
রাগানো ও তাকে কষ্ট দেওয়াই যেন তার মূল কাজ। তার মাথায় যেন এ চিন্তাই সদা ঘুরপাক
খেতে থাকে যে, কোন কাজ করলে স্বামী রেগে
যাবে ও কষ্ট পাবে, সেটাই সে করে থাকে। এসব
নারীদের সম্পর্কে রাসূল (স.) বলেন,ثَلاَثَةٌ لاَ تُجَاوِزُ
صَلاَتُهُمْ آذَانَهُمُ الْعَبْدُ الآبِقُ حَتَّى يَرْجِعَ وَامْرَأَةٌ بَاتَتْ
وَزَوْجُهَا عَلَيْهَا سَاخِطٌ وَإِمَامُ قَوْمٍ وَهُمْ لَهُ كَارِهُوْنَ- ‘তিন ব্যক্তির ছালাত তাদের কান অতিক্রম করে
না। ১. পলায়নকারী গোলাম যতক্ষণ সে ফিরে না আসে। ২. এমন মহিলা, যে
রাত্রি যাপন করে অথচ তার স্বামী তার উপরে রাগান্বিত থাকে। ৩. ঐ ইমাম, জনগণ
যাকে অপসন্দ করে’।–(তিরমিযী
হা/৩৬০; মিশকাত হা/১১২২; ছহীহ আত-তারগীব হা/৪৮৭, সনদ হাসান)
গ. বিনা
কারণে স্বামীর কাছে তালাক চাওয়া :
কোন কোন মহিলা স্বামীর দুরবস্থার কারণে বা
পরপুরুষের প্রতি ঝুকে পড়ায় স্বামীর সাথে ঘর-সংসার করতে চায় না। ফলে সে স্বামীর
কাছে তালাক চায়। অথচ কেবল শারঈ কারণ ব্যতীত কোন মহিলা স্বামীর কাছে তালাক চাইতে
পারে না। এরপরেও কোন মহিলা বিনা কারণে তালাক চাইলে, সে
জান্নাত থেকে মাহরূম বা বঞ্চিত হবে। এ ধরনের মহিলাদের সম্পর্কে রাসূল (স.) বলেন,أَيُّمَا امْرَأَةٍ سَأَلَتْ زَوْجَهَا طَلاَقًا فِى غَيْرِ مَا
بَأْسٍ فَحَرَامٌ عَلَيْهَا رَائِحَةُ الْجَنَّةِ. ‘যে মহিলা বিনা কারণে তার স্বামীর নিকটে তালাক্ব চায়, তার
জন্য জান্নাতের সুগন্ধিও হারাম’।–(আবুদাউদ হা/২২২৬; তিরমিযী
হা/১১৮৭; ইবনু মাজাহ হা/২০৫৫; মিশকাত হা/৩২৭৯, সনদ
ছহীহ)
ঘ.
পর্দাপ্রথা পরিহার করা :
পর্দা ইসলামে ফরয। ছালাত-ছিয়াম পালন না করলে
যেমন আল্লাহর কাছে জওয়াবদিহি করতে হবে,
তেমনি
পর্দা পালন না করলেও আল্লাহর কাছে জওয়াবদিহি করতে হবে। কিন্তু বহু মহিলা পর্দা না
মেনে নিজের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে রাস্তা-ঘাটে চলাফেরা করে। ফলে তারা ধর্ষণ-অপহরণ
ও উত্যক্তকরণের শিকার হয়। এরপরও তারা পর্দা করে না। এদের সম্পর্কে রাসূল (স.) বলেন,
صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا
قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُوْنَ بِهَا النَّاسَ
وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيْلاَتٌ مَائِلاَتٌ رُءُوْسُهُنَّ
كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ لاَ يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلاَ يَجِدْنَ
رِيْحَهَا وَإِنَّ رِيْحَهَا لَيُوْجَدُ مِنْ مَسِيْرَةِ كَذَا وَكَذَا
‘দুই শ্রেণীর লোক
জাহান্নামী, যাদেরকে এখনও আমি দেখিনি।
১. এমন সম্প্রদায় যাদের হাতে গরু তাড়ানোর লাঠি থাকবে, যা
দ্বারা তারা মানুষকে প্রহার করবে। ২. নগ্ন পোষাক পরিধানকারী নারী, যারা
পুরুষদেরকে নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করবে এবং নিজেরাও পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট হবে।
তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধ বিশিষ্ট উটের ন্যায় হবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে
পারবে না। এমনকি তারা জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধি এত এত
দূর হ’তে পাওয়া যায়। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, এক
মাসের পথের দূরত্ব হ’তে পাওয়া যায়’।–(মুসলিম হা/২১২৮; মিশকত
হা/৩৫২৪)
এ হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তারা হচ্ছে ঐসব মহিলা যারা পর্দা করে না। বরং নিজেদের
সৌন্দর্য প্রদর্শন করে রাস্তা-ঘাটে চলাফেরা করে। তাদের পরিণতি সম্পর্কে অন্যত্র রাসূল (স.) বলেন,وَشَرُّ نِسَائِكُمُ
الْمُتَبَرِّجَاتُ الْمُتَخَيِّلاَتُ وَهُنَّ الْمُنَافِقَاتُ لاَ يَدْخُلُ
الْجَنَّةَ مِنْهُنَّ إِلاَّ مِثْلُ الْغُرَابِ الأَعْصَمِ- ‘তোমাদের নারীদের মধ্যে নিকৃষ্ট হ’ল
যারা পর্দাহীনা অহংকারিণী। আর তারা হ’ল মুনাফিক নারী। তাদের
মধ্য হ’তে কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না কেবল সাদা পা বিশিষ্ট কাকের
ন্যায় ব্যতীত’।–(বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হ/১৩৮৬০; ছহীহাহ হা/১৮৪৯)
অনেক মহিলা স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজের
সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়ায়। তাদের সম্পর্কে রাসূল (স.) বলেন,ثَلاَثَةٌ لاَ تَسْأَلْ عَنْهُمْ ... وَامْرَأَةٌ غَابَ عَنْهَا
زَوْجُهَا قَدْ كَفَاهَا مُؤْنَةَ الدُّنْيَا فَتَبَرَّجَتْ بَعْدَهُ، ‘(ধ্বংসে নিপতিত) তিন ব্যক্তি সম্পর্কে আমাকে
জিজ্ঞেস কর না।... আর ঐ নারী যার স্বামী অনুপস্থিত। কিন্তু সে (স্বামী) তার
দুনিয়াবী ভোগ্য সামগ্রী যথেষ্ট পরিমাণে প্রদান করে। অথচ সে (স্ত্রী) তার স্বামীর
পরে (অনুপস্থিতিতে) বেপর্দায় চলে’।–(আহমাদ, ছহীহাহ হা/৫৪২; ছহীহুল
জামে‘ হা/৩০৫৮)
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
‘ঐ
মহিলা, যে তার স্বামীর সাথে খেয়ানত করে।–(ছহীহ আত-তারগীব হা/১৮৮৭)
বর্তমানে আমাদের দেশের লোকেরা অন্যের বাড়ীতে
স্বাভাবিকভাবেই ঢুকে পড়ে। কোন অনুমতির তোয়াক্কা করে না। অথচ সে বাড়ীতে মহিলারা কোন
কোন সময় অপ্রস্ত্তত থাকে। অনেকে আবার অন্যের বাড়ীতে ঢুকে সে বাড়ীর মহিলাদের সাথে
নিঃসংকোচে কথাবার্তা বলেও খোশগল্প করতে থাকে। মহিলারাও তাদেরকে এসবের সুযোগ দেয়।
ইসলামে এসব নিষেধ। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ
آمَنُوْا لاَ تَدْخُلُوْا بُيُوْتًا غَيْرَ بُيُوْتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوْا
وَتُسَلِّمُوْا عَلَى أَهْلِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত
অন্যদের গৃহে প্রবেশ করো না। যতক্ষণ না তোমরা তাদের অনুমতি নাও এবং গৃহবাসীদের
প্রতি সালাম কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম। সম্ভবতঃ তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে (তা
মেনে চলার মাধ্যমে)। (সূরা নূর-২৪/২৭)
রাসূল (স.) বলেন,لاَ يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِإِمْرَأَةٍ إِلاَّ كَانَ ثَالِثُهُمَا
الشَّيْطانُ. ‘অবশ্যই কোন পুরুষ কোন
নারীর সাথে নির্জনে একত্রিত হ’লে তৃতীয় জন হবে শয়তান’।–(তিরমিযী, সনদ
ছহীহ, মিশকাত হা/১৩১৮)
মহিলাদের সাথে খোশগল্প নিষেধ করে আল্লাহ বলেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوْا
بُيُوْتَ النَّبِيِّ إِلَّا أَنْ يُؤْذَنَ لَكُمْ إِلَى طَعَامٍ غَيْرَ
نَاظِرِيْنَ إِنَاهُ وَلَكِنْ إِذَا دُعِيتُمْ فَادْخُلُوا فَإِذَا طَعِمْتُمْ
فَانْتَشِرُوْا وَلَا مُسْتَأْنِسِيْنَ لِحَدِيْثٍ
‘হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে
অনুমতি দেওয়া না হ’লে তোমরা আহার্য প্রস্ত্ততির জন্য অপেক্ষা না
করে ভোজনের জন্য নবী-গৃহে প্রবেশ কর না। তবে তোমাদেরকে আহবান করলে তোমরা প্রবেশ কর
এবং ভোজনশেষে তোমরা চলে যাও; তোমরা কথাবার্তায় মশগূল
হয়ে পড়ো না’। -(সূরা আহযাব-৩৩/৫৩) রাসূলের ব্যাপারে বলা হ’লেও
মুসলমানদের জন্য এ বিধান প্রযোজ্য।
আবার সমাজে দেবর-ভাবির, হাসি-তামাশা, অবাধ
চলাফেরা যেন সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। অথচ রাসূল (স.) এসব থেকে মানুষকে সাবধান
করেছেন। উক্ববা ইবনু আমের (রাঃ) বলেন,
রাসূল
(স.) বলেছেন,إِيَّاكُمْ وَالدُّخُولَ عَلَى
النِّسَاءِ فَقَالَ رَجُلٌ مِنْ الأَنْصَارِ يَا رَسُولَ اللهِ أَفَرَأَيْتَ
الْحَمْوَ، قَالَ الْحَمْوُ الْمَوْتُ. ‘তোমরা নারীদের নিকট প্রবেশ
করা থেকে সাবধান থাক। একজন আনছার ছাহাবী বললেন,
হে
আল্লাহর রাসূল! দেবর সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
তিনি
বললেন, ‘দেবর মৃত্যু সমতুল্য’।–(বুখারী হা/৫২৩২; মুসলিম
হা/২১৭২; মিশকাত হা/৩১০২ ‘বিবাহ’ অধ্যায়)
প্রকৃত
পর্দা : আমাদের দেশের মানুষ প্রকৃত
পর্দা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নয়। তারা মনে করে কেবল বোরক্বা পরে বাইরে গেলেই পর্দা
রক্ষা হয়ে যায় এবং বাড়ীর অভ্যন্তরে এর কোন প্রয়োজন নেই। অথচ সেটা প্রকৃত পর্দা নয়।
বরং পর্দা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ
أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ وَلَا يُبْدِيْنَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا
مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوْبِهِنَّ وَلَا
يُبْدِيْنَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُوْلَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ
بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُوْلَتِهِنَّ أَوْ
إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِيْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِيْ أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ
نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِيْنَ غَيْرِ أُولِي
الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِيْنَ لَمْ يَظْهَرُوْا عَلَى
عَوْرَاتِ النِّسَاءِ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِيْنَ
مِنْ زِيْنَتِهِنَّ وَتُوْبُوْا إِلَى اللهِ جَمِيْعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُوْنَ
لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ
‘আর তুমি মুমিন নারীদের বলে
দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান
হেফাযত করে।
আর
তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তবে যেটুকু স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ পায়
সেটুকু ব্যতীত। আর তারা যেন তাদের মাথার কাপড় স্বীয় বক্ষদেশের উপর রাখে। আর তারা
যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজ
পুত্র, স্বামীর পুত্র,
ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগিনীপুত্র, নিজেদের
বিশ্বস্ত নারী, অধিকারভুক্ত দাসী, কামনামুক্ত
পুরুষ এবং শিশু যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অবহিত নয়, তারা
ব্যতীত। আর তারা যেন এমনভাবে চলাফেরা না করে যাতে তাদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশিত
হয়। আর হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে ফিরে যাও যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে
পার’।- (সূরা নূর-২৪/৩১)
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়
বর্তমানে মহিলারা দেবর-ভাসুর, চাচাত, মামাতো, খালাতো, ফুফাত
ভাই, বেয়াই, বোনাই সবার সাথে খোশ-গল্প, হাসি-তামাশা, করে
থাকে। এগুলোকে তারা কিছু মনে করে না। অথচ এসব পর্দার পরিপন্থী। অন্যত্র আল্লাহ
বলেন,وَقَرْنَ فِيْ بُيُوْتِكُنَّ وَلاَ تَبَرَّجْنَ
تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى- ‘আর তোমরা স্বগৃহে অবস্থান
করবে এবং প্রাচীন যুগের মত নিজদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না’। (সূরা আহযাব-৩৩/৩৩) আল্লাহ এ আয়াতে মহিলাদের বাড়ীর মধ্যে থাকতে
নির্দেশ দিয়েছেন। প্রয়োজনে বাইরে যেতে হ’লে যথাযথ পর্দা পালন করেই
যেতে হবে।
আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِيْنَ
يُدْنِيْنَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلاَبِيبِهِنَّ- ‘হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ
ও মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলে দেও, তারা যেন নিজেদেরকে চাদর
দিয়ে আবৃত করে’। (সূরা আহযাব-৩৩/৫৯) এ নির্দেশ রাসূল (স.)-এর মাধ্যমে সকল মুমিন
নারীদেরকে দেওয়া হয়েছে।
পর্দার
পোষাক :
পোষাক-পরিচ্ছদ মানুষের লজ্জাস্থান আবৃত করার
জন্য আল্লাহ দান করেছেন। তিনি বলেন,يَا بَنِيْ آدَمَ قَدْ
أَنْزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِيْ سَوْآتِكُمْ وَرِيْشًا وَلِبَاسُ
التَّقْوَى ذَلِكَ خَيْرٌ ذَلِكَ مِنْ آيَاتِ اللهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُوْنَ- ‘হে আদম সন্তান! আমরা তোমাদের উপর পোষাক
অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান
আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি বেশভূষার উপকরণ সমূহ। তবে আল্লাহভীতির পোষাকই
সর্বোত্তম। এটি আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্যতম। যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’। (সূরা আ‘রাফ-৭/২৬)
বস্ত্তত শয়তান মানুষের দেহ থেকে তার আবরণ
খুলে নিয়ে মানুষকে নগ্ন-অর্ধনগ্ন করতে চায়,
যেমনভাবে
সে প্রথম মানব-মানবী আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর দেহ থেকে পোষাক খুলে নিয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,يَا بَنِي آدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ
كَمَا أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا
لِيُرِيَهُمَا سَوْآتِهِمَا إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا
تَرَوْنَهُمْ إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيَاطِيْنَ أَوْلِيَاءَ لِلَّذِيْنَ لَا
يُؤْمِنُوْنَ- ‘হে আদম সন্তান! শয়তান যেন
তোমাদেরকে বিভ্রান্ত না করে। যেমন সে তোমাদের আদি পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের
করেছিল। সে তাদের থেকে তাদের পোষাক খুলে নিয়েছিল যাতে সে তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান
দেখাতে পারে’। (সূরা আ‘রাফ-৭/২৭)
শয়তানের ঐ নীল নক্সা বাস্তবায়নে সে সদা তৎপর।
কিন্তু আদম সন্তান সেটা বুঝতে না পেরে এর বিপরীত কাজ করে। যেমন মহিলারা নিজেদের
সৌন্দর্য বিকাশের নামে পাতলা ও আঁটসাঁট পোষাক পরিধান করে বাইরে বের হয়। এতে তাদের
শরীরের বিশেষ অঙ্গ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়,
যা
ইসলামে নিষিদ্ধ। আসমা বিনতে আবী বকর (রাঃ) রাসূল (স.)-এর দরবারে প্রবেশ করলেন। আর
রাসূল (স.) তাকে লক্ষ্য করে বললেন,
إِنَّ الْمَرْأَةَ إِذَا
بَلَغَتْ الْمَحِيْضَ لَمْ تَصْلُحْ أَنْ يُرَى مِنْهَا شيء إِلاَّ هَذَا وَهَذَا
وَأَشَارَ إِلَى وَجْهِهِ وَكَفَّيْهِ- ‘যখন কোন নারী যৌবনে
পদার্পণ করে তখন তার জন্য এটা ওটা ছাড়া অন্য কিছু প্রকাশ করা বৈধ হবে না। তিনি
চেহারা ও দু’কব্জির দিকে ইঙ্গিত করলেন।–(আবুদাউদ হা/৪১০৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৮৪৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২১৫; মিশকাত হা/৪৩৭২)
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
دَخَلَتْ حَفْصَةُ بِنْتُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ عَلَى
عَائِشَةَ زَوْجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم وَعَلَى حَفْصَةَ خِمَارٌ
رَقِيقٌ فَشَقَّتْهُ عَائِشَةُ وَكَسَتْهَا خِمَارًا كَثِيفًا
‘হাফছা বিনতু আব্দির রহমান
নবী করীম (স.)-এর স্ত্রী আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট প্রবেশ করলেন, তখন
তার মাথায় একটা পাতলা ওড়না ছিল (অন্য
বর্ণনায় রয়েছে, যা থেকে তার ললাট দেখা
যাচ্ছিল)। আয়েশা (রাঃ) তার ওড়নাটি ছিড়ে ফেলে একটি মোটা ওড়না তাকে পরিয়ে দিলেন’।–(বায়হাকী, সুনানুল
কুবরা হা/৩০৮২; মুওয়াত্ত্বা মালেক
হা/১৪২০; মিশকাত হা/৪৩৭৫, সনদ ছহীহ)
অপর এক বর্ণনায় আছে, আয়েশা
(রাঃ) তার উপর থেকে পাতলা ওড়নাটি সরিয়ে দিয়ে বললেন, আল্লাহ
তা‘আলা সূরা নূরে যা নাযিল করেছেন তা কি তুমি জান না? অতঃপর
তিনি আরেকটি মোটা ওড়না তাকে পরিধান করালেন।–(জিলবাবুল মারআতিল মুসলিমা ১/১২৬; ত্বাবাকাতুল কুবরা ৮/৪৬, সনদ ছহীহ)
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) লোকদের ক্বাবাত্বী
কাপড় (মিসরীয় পাতলা সাদা কাপড়) পরতে দিয়ে বললেন,لاَ تُدَرِّعُهَا نِسَاؤَكُمْ فَقَالَ رَجُلٌ: يَا أَمِيْرَ
الْمُؤْمِنِيْنَ قَدْ أَلْبَسْتُهَا إِمْرَأْتِي فَأَقْبَلَتْ فِي الْبَيْتِ
وَأَدْبَرَتْ فَلَمْ أَرَهُ يَشِفُّ. فَقَالَ عُمَرُ: إِنْ لَمْ يَكُنْ يَشِفُّ
فَإِنَّهُ يَصِفُّ ‘এ কাপড়গুলো তোমাদের স্ত্রীদেরকে পরাবে না।
তখন একজন লোক বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! আমি
আমার স্ত্রীকে তা পরিয়েছিলাম। অতঃপর বাড়িতে সে আমার সামনে ঘোরাঘুরি করেছে। কিন্তু
তা এত পাতলা মনে হয়নি যার উপর থেকে ভিতর দেখা যায়। তখন ওমর (রাঃ) বললেন, যদি
তা অতি পাতলা নাও হয়, কিন্তু তা দেহের আকৃতি
প্রকাশ করবে’।–(বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩০৮০; ইবনু আবী শায়বা হা/২৫২৮৮; জিলবাবুল মারআতিল মুসলিমা ১/১২৮, সনদ ছহীহ)
অন্য বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন,لاَ تُلْبِسُوْا نِسَاءَكُمَ الْقَبَاطِيَّ، فَإِنَّهُ إِلاَّ
يَشِفَّ يَصِفُ- ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের
ক্বাবাত্বী কাপড় পরিধান করাবে না। কেননা যদিও সেটার উপর থেকে ভিতর প্রকাশ না পায়, কিন্তু
তা দেহের আকৃতি প্রকাশ করে’।–(ইবনু
আবী শায়বা হা/২৫২৮৯; মুছান্নাফ আব্দুর
রাযযাক হা/১২১৪২; ইবনুল আছীর, আন-নিহায়াতু ফি গারীবিল আছার ৪/১০; কানযুল উম্মাল হা/৪২০৩১, সনদ ছহীহ)
অরেকটি বর্ণনায় এসেছে,
أَنَّ الْمُنْذِرَ بْنَ الزُّبَيْرِ قَدِمَ مِنَ
الْعِرَاقِ فَأَرْسَلَ إِلَى أَسْمَاءَ بِنْتِ أَبِيْ بَكْرٍ بِكَسْوَةٍ مِنْ
ثِيَابِ مَرْوَيَّةٍ وَقُوهِيَّةٍ رِقاقٍ عِتَاقٍ بَعدَمَا كَفَّ بَصَرُهَا، قالَ:
فَلَمَسَتْها بِيَدِهَا، ثُمَّ قَالَتْ: أُفٍّ رَدُّوْا عَلَيْهِ كِسْوَتَهُ،
قَالَ: فَشَقَّ ذَلِكَ عَلَيْهِ وَقَالَ: يَا أُمَّه إِنَّهُ لاَ يَشِفُّ.
قَالَتْ: إِنَّهَا إِنْ لَمْ تَشِفُّ فَإِنَّهَا تَصِفُ
‘মুনযির ইবনু যুবায়ের ইরাক
থেকে ফিরে আসমা বিনতু আবী বকর (রাঃ)-এর নিকট কিছু পুরাতন পাতলা মারবীহ অকূহিয়াহ
কাপড় পাঠালেন। তখন তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। রাবী বলেন, তিনি
কাপড়গুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বললেন,
আফসোস!
তোমরা তার কাপড় ফেরৎ দাও। রাবী বলেন,
এটা
মুনযিরের কাছে পীড়াদায়ক হ’লে তিনি বললেন, হে
মা! এটা (শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রকাশ পাওয়ার মত) অতি পাতলা নয়। তখন তিনি বললেন, যদি
এটা অতি পাতলা নাও হয়, তবুও এটা শরীরের আকৃতি
প্রকাশ করে দেয়’।–(ত্বাবাকাতুল
কুবরা ৮/২৫২; ইউসুফ কান্ধালুবী, হায়াতুছ-ছাহাবা ৪/১০৩; ইবনু আসাকের,তারীখু
দিমাশ্ক ৬০/২৯০; জিলবাবুল মারআতিল
মুসলিমা ১/১২৭, ছহীহ)
উসামা ইবনু যায়েদ (রাঃ) হ’তে
বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَسَانِى رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم
قُبْطِيَّةً كَثِيْفَةً كَانَتْ مِمَّا أَهْدَاهَا دِحْيَةُ الْكَلْبِىُّ،
فَكَسَوْتُهَا امْرَأَتِىْ، فَقَالَ لِىْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم، مَا
لَكَ لَمْ تَلْبَسِ الْقُبْطِيَّةَ؟ قُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! كَسَوْتُهَا
امْرَأَتِى. فَقَالَ لِىْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: مُرْهَا
فَلْتَجْعَلْ تَحْتَهَا غِلاَلَةً، إِنِّىْ أَخَافُ أَنْ تَصِفَ حَجْمَ عِظَامِهَا
‘রাসূলুল্লাহ (স.) আমাকে
একটা গাঢ় ঘন কুবতী পোষাক পরিয়েছিলেন যেটা তাঁকে দেহিয়া কালবী উপহার দিয়েছিলেন।
অতঃপর আমি সেটা আমার স্ত্রীকে পরালাম। একদা রাসূল (স.) আমাকে বললেন, তোমার
কি হ’ল তুমি কুবতী পোষাকটি পরিধান করছ না? আমি
বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (স.)! আমি ওটা আমার স্ত্রীকে পরিধান
করিয়েছি। তখন রাসূল (স.) আমাকে বললেন,
‘তুমি
তাকে নির্দেশ দাও সে যেন তার নিচে গিলালাহ (সেমিজ) পরিধান করে। কেননা আমি তার
হাড়ের (দেহের) আকৃতি প্রকাশের আশংকা করছি’।–(আহমাদ হা/২১৮৩৪; মু‘জামুল কাবীর হা/৩৭৬; জিলবাব ১/১৩১, সনদ
হাসান)
অথচ আজকাল মহিলারা এমন পাতলা ও টাইট ফিটিং
পোষাক পরিধান করে যাতে তাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ সুস্পষ্টরূপে ফুটে ওঠে। মুমিন
নারীদের এ ধরনের পোষাক পরিধান করা থেকে বিরত থাকা অতি যরূরী।
সাজসজ্জা
করে ও সুগন্ধি মেখে বাইরে যাওয়া পর্দার পরিপন্থী :
বর্তমানে অনেক মহিলা কোথাও যাওয়ার প্রাক্কালে
সুসজ্জিত হয়ে এবং সুগন্ধি মেখে বের হয়। নিজ বাড়ীতে স্বামীর সামনে সাধারণ পোষাক
পরিধান করলেও অন্যত্র যায় সেজেগুজে। কড়া পারফিউম, চড়া
মেকাপ মেখে আর জিপসী টাইপের পোষাক পরে নিজেকে ডানাকাটা পরি সদৃশ সাজিয়ে পেটের ভাজ
ও শরীরের খাজ প্রদর্শন করে রাস্তায় হেলে-দুলে চলে। এদের না আছে লজ্জা-শরম, না
আছে পরকালের ভয়। জান্নাত এসব নারীদের জন্য নয়। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, سَيَكُوْنُ فِىْ آخِرِ أُمَّتِىْ نِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ
مُتَمَيِّلَاتٌ، لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ، وَلَا يَجِدْنَ رِيْحَهَا،
وَرِيْحُهَا تُوْجَدُ مِنْ مَسِيْرَةِ خَمْسِ مِائَةِ عَامٍ- ‘আমার উম্মতের শেষ সময়ে নারীরা নগ্ন-উলঙ্গ পোষাক পরিধান
করবে। তারা নিজেরা অন্যকে তাদের প্রতি আকর্ষণ করবে (নিজেরাও তাদের প্রতি আকর্ষিত
হবে)। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। যদিও এর
সুঘ্রাণ পঞ্চাশ হাযার বছর পথের দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়’।–(মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/৩৩৮৪; বায়হাকী, শু‘আবুল ঈমান হা/৭৮০০, সনদ ছহীহ)
অন্য বর্ণনায় রয়েছে,
‘তাদের
মাথা হবে হেলে দুলে পড়া দুর্ভাগা উটের কুজের ন্যায়। অবশ্যই তারা অভিশপ্ত’।–(মুসলিম হা/২১২৮; ছহীহাহ
হা/১৩২৬; মিশকাত হা/৩৫২৪, সনদ ছহীহ)
যারা সেন্ট, বডি
স্প্রে, আতর ইত্যাদি মেখে বাইরে যায়, এদের
সম্পর্কে রাসূল (স.) বলেন,أَيُّمَا امْرَأَةٍ
اسْتَعْطَرَتْ فَمَرَّتْ عَلَى قَوْمٍ لِيَجِدُوْا مِنْ رِيْحِهَا فَهِىَ
زَانِيَةٌ ‘যে নারী সুগন্ধি ব্যবহার
করল অতঃপর লোকদের পাশ দিয়ে এ উদ্দেশ্যে অতিক্রম করল যে, তারা
যেন তার সুঘ্রাণ পায়, তাহ’লে
সে ব্যভিচারী’।–(নাসাঈ
হা/৫১২৬; ছহীহুল জামে‘ হা/২৭০১)
মহিলারা ছালাত আদায় করার জন্য মসজিদে যাওয়ার
সময় তাদের জন্য সুগন্ধি মেখে যাওয়া নিষিদ্ধ। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,
أَنَّ امْرَأَةً مَرَّتْ بِهِ تَعْصِفُ رِيْحُهَا
فَقَالَ: يَا أَمَةَ الْجَبَّارِ الْمَسْجِدُ تُرِيْدِيْنَ؟ قَالَتْ: نَعَمْ.
قَالَ: وَلَهُ تَطَيَّبْتِ؟ قَالَتْ: نَعَمْ قَالَ فَارْجِعِى فَاغْتَسِلِىْ
فَإِنِّىْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ: مَا مِنِ
امْرَأَةٍ تَخْرُجُ إِلَى الْمَسْجِدِ تَعْصِفُ رِيْحُهَا فَيَقْبَلُ اللهُ
مِنْهَا صَلاَتَهَا حَتَّى تَرْجِعَ إِلَى بَيْتِهَا فَتَغْتَسِلَ
‘একজন মহিলা তাঁর পাশ দিয়ে
যাচ্ছিল এবং তার থেকে তীব্র সুগন্ধি বের হচ্ছিল। তখন আবু হুরায়রা (রাঃ) তাকে বললেন, হে
শক্তিধর আল্লাহর বান্দী! তুমি মসজিদে যাওয়ার ইচ্ছা করছ? সে
বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন,
তুমি
তার জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করেছ? সে বলল, হ্যাঁ।
তিনি বললেন, তুমি (বাড়িতে) ফিরে গিয়ে
গোসল কর। কেননা আমি রাসূল (স.)-কে বলতে শুনেছি,
‘যে
নারী মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হ’ল, আর
তার থেকে সুঘ্রাণ বের হ’তে থাকল,
আল্লাহ
তা‘আলা তার ছালাত কবুল করবেন না যতক্ষণ না সে বাড়িতে গিয়ে গোসল
করবে’।–(সুনানুল কুবরা
হা/৫১৫৮; আবু ইয়া‘লা হা/৬৩৮৫; জিলবাব
১/১২৭, সনদ ছহীহ)
অন্যত্র নবী করীম (স.) মহিলাদেরকে সুগন্ধি
মেখে মসজিদে যেতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,أَيَّتُكُنَّ خَرَجَتْ إِلَى
الْمَسْجِدِ، فَلاَ تَقْرَبَنَّ طِيْبًا- ‘তোমাদের মধ্যে যে মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হ’ল
সে যেন অবশ্যই সুগন্ধি ব্যবহার না করে’।–(নাসাঈ হা/৫১৩১; ছহীহুল
জামে‘ হা/৫০১; ছহীহাহ হা/১০৯৪)
ঙ.
অন্যের গৃহে স্বীয় বস্ত্র উন্মোচনকারিণী :
অনেক মহিলা আছে যারা স্বামীর প্রতি সন্তুষ্ট
থাকে না। অন্য পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তার কাছে যায়। পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। আর তার
দ্বারা নিজের মনোবাসনা পূর্ণ করে। তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন,أَيُّمَا امْرَأَةٍ نَزَعَتْ ثِيَابَهَا فِىْ غَيْرِ بَيْتِ
زَوْجِهَا هَتَكَتْ سِتْرَ مَا بَيْنَهَا وَبَيْنَ رَبِّهَا. ‘যে মহিলা স্বামীর গৃহ ব্যতীত অন্যের গৃহে পোশাক খোলে
(ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে), তাহ’লে
সে তার ও তার রবের মধ্যকার পর্দাকে ছিন্ন করে ফেলল’।–(মুসনাদ আহমাদ হা/২৬৬১১; ছহীহুল জামে‘ হা/২৭০৮; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৭১)
এমনকি স্বামীর গৃহ ব্যতীত অন্যের গৃহে রাত্রি
যাপন করাও নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন,أَلَا لَا يَبِيتَنَّ رَجُلٌ
عِنْدَ امْرَأَةٍ ثَيِّبٍ. إِلَّا أَنْ يَكُوْنَ نَاكِحًا أَوْ ذَا مَحْرَمٍ- ‘সাবধান! কোন পুরুষ যেন কখনও কোন অকুমারী
(গায়ের মাহরাম) নারীর সাথে রাত্রি যাপন না করে। তবে যদি সে বিবাহিত হয় (এবং তার
স্ত্রী সাথে থাকে) বা সে মাহরাম হয় তাহ’লে ভিন্ন কথা’।–( মুসলিম হা/২১৭১; ছহীহুল
জামে‘ হা/৭৫৯৯; ছহীহাহ হা/৩০৮৬)
চ.
অন্যকে স্বামীর বাড়ীতে প্রবেশের অনুমতি দানকারিণী :
নারী নিজে যেমন স্বামীর সম্পদ হেফাযত করবে
তেমনি নিজের ইয্যত-আব্রু রক্ষা করবে। সাথে সাথে সে স্বামীর অনুমতি ছাড়া অন্য কোন
পুরুষকে বাড়ীতে প্রবেশ করতে দিবে না। রাসূল (স.) বলেন,لاَ يَحِلُّ لِلْمَرْأَةِ أَنْ تَصُوْمَ وَزَوْجُهَا شَاهِدٌ
إِلَّا بِإِذْنِهِ، وَلاَ تَأْذَنَ فِيْ بَيْتِهِ إِلَّا بِإِذْنِهِ، وَمَا
أَنْفَقَتْ مِنْ نَفَقَةٍ عَنْ غَيْرِ أَمْرِهِ فَإِنَّهُ يُؤَدَّى إِلَيْهِ
شَطْرُهُ- ‘স্বামীর উপস্থিতিতে তার
অনুমতি ব্যতীত স্ত্রীর নফল ছিয়াম পালন করা বৈধ নয় এবং স্বামীর অনুমতি ব্যতীত
অন্যকে তার গৃহে প্রবেশ করতে দিবে না। যদি কোন স্ত্রী স্বামীর নির্দেশ ব্যতীত তার
কোন সম্পদ থেকে খরচ করে, তাহ’লে
স্বামী তার অর্ধেক ছওয়াব পাবে’।–(বুখারী হা/৫১৯৫; মুসলিম
হা/১০২৬; মিশকাত হা/২০৩১)
ছ.
ব্যভিচারিণী :
যেনা-ব্যভিচার এক জঘন্য ও ঘৃণিত পাপাচার। এতে
যারা লিপ্ত হয় তারা যেমন সমাজে নিগৃহীত হয়,
তেমনি
পরকালে তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি। মুমিন সাধারণত ব্যভিচারী মহিলাকে বিবাহ
করবে না। আল্লাহ বলেন,الزَّانِيْ لَا يَنْكِحُ
إِلَّا زَانِيَةً أَوْ مُشْرِكَةً وَالزَّانِيَةُ لَا يَنْكِحُهَا إِلَّا زَانٍ
أَوْ مُشْرِكٌ وَحُرِّمَ ذَلِكَ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ ‘ব্যভিচারী
পুরুষ বিয়ে করতে পারে না ব্যভিচারিণী বা মুশরিক নারীকে ব্যতীত। (অনুরূপভাবে)
ব্যভিচারিণী নারী বিয়ে করতে পারে না ব্যভিচারী বা মুশরিক পুরুষ ব্যতীত (যে
ব্যভিচারকে হারাম মনে করে না)। মুমিনদের উপর এটা হারাম করা হয়েছে’। (সূরা নূর-২৪/৩) সাধারণ মুমিনদের উপর উক্ত বিবাহ হারাম করা হয়েছে, যতক্ষণ
তারা তওবা না করে। ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন,
যদি
তওবা করে তাহ’লে উক্ত নারী বা পুরুষের সাথে সাধারণত মুমিন
পুরুষ বা নারীর সাথে বিবাহ সিদ্ধ হবে,
অন্যথা
বৈধ নয়।–(মুহাম্মাদ
জামালুদ্দীন আল-কাসেমী, মাহাসীনুত
তাবীল, ৭/৩২৪)
জ.
পুরুষের বেশ ধারণকারিণী :
নারী-পুরুষকে আল্লাহ তা‘আলা
আলাদা আকার-আকৃতি ও অবয়বে সৃষ্টি করেছেন। এটা আল্লাহর সৃষ্টি কৌশল। কিন্তু কোন কোন
মহিলা চুল ছোট করে এবং পুরুষের পোষাক পরিধান করে পুরুষের বেশ ধারণ করে। পরকালে
এদের পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
الْمُتَشَبِّهِيْنَ مِنْ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنْ
النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ ‘রাসূল (স.) সেসব মহিলাদের
উপর অভিশাপ করেছেন, যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে
এবং সে সকল পুরুষদের উপর অভিশাপ করেছেন,
যারা
মহিলাদের বেশ ধারণ করে’।–(বুখারী, মিশকাত হা/৪৪২৯)
অন্য
বর্ণনায় এসেছে, আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন,أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَعَنَ
الرَّجُلَ يَلْبَسُ لُبْسَةَ الْمَرْأَةِ وَالْمَرْأَةَ تَلْبَسُ لُبْسَةَ
الرَّجُلِ ‘রাসূল (স.) সেই পুরুষের
ওপর অভিশাপ করেছেন, যে মহিলার পোষাক পরিধান
করে এবং সে মহিলার উপর অভিশাপ করেছেন,
যে
পুরুষের পোষাক পরিধান করে’।–(আবূদাঊদ, মিশকাত হা/৪৪৬৯, হাদীছ
ছহীহ)
অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, ইবনু
আববাস (রাঃ) বলেন,أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَعَنَ الْمُخَنَّثِيْنَ مِنْ الرِّجَالِ وَالْمُتَرَجِّلاَتِ
مِنْ النِّسَاءِ. ‘নবী করীম (স.) হিজড়ার বেশ
ধারণকারী পুরুষের উপর অভিশাপ করেছেন এবং পুরুষের বেশ ধারণকারী নারীর উপর অভিশাপ
করেছেন’।–(বুখারী, মিশকাত হা/৪৪২৮)
আবূ মুলায়কা (রাঃ) বলেন, একদা
আয়েশা (রাঃ)-কে বলা হ’ল-إِنَّ امْرَأَةً تَلْبَسُ النَّعْلَ فَقَالَتْ لَعَنَ
رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّجُلَةَ مِنْ النِّسَاءِ- ‘একটি
মেয়ে পুরুষের জুতা পরে। তখন আয়েশা (রাঃ) বললেন,
রাসূল
(স.) পুরুষের বেশধারী নারীর প্রতি অভিশাপ করেছেন’।–(আবূদাঊদ, মিশকাত
হা/৪৪৭০, হাদীছ ছহীহ)
এধরনের মহিলা জান্নাতে যেতে পারবে না। রাসূল
(স.) বলেছেন,ثَلاَثَةٌ لاَ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ
الْعَاقُّ لِوَالِدَيْهِ وَالدَّيُّوْثُ وَرَّجُلَةَ النِّسَاء- ‘তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না (১)
পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান (২) বাড়ীতে বেহায়াপনার সুযোগ প্রদানকারী বা দাইয়ূছ (৩)
পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী’।–(নাসাঈ
হা/২৫৬২; ছহীহাহ হা/১৩৯৭)
ঝ.
পরচুলা ব্যবহারকারিণী ও উল্কিকারিণী :
এক শ্রেণীর মহিলা নিজের সৌন্দর্য বৃদ্ধির
নামে নিজ দেহে উল্কী করায় এবং নিজের অল্প চুলের সাথে নকল চুল বা পরচুলা ব্যবহার
করে, যাতে চুল বেশী ও লম্বা দেখা যায়। এ ধরনের কাজ ইসলামে
নিষিদ্ধ। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন,أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَعَنَ اللهُ الْوَاصِلَةَ وَالْمُسْتَوْصِلَةَ
وَالْوَاشِمَةَ وَالْمُسْتَوْشِمَةَ ‘নবী করীম (স.) বলেন, যে
নারী চুলে জোড়া লাগায় এবং অন্যদের দ্বারা লাগিয়ে নেয়, যে
নারী দেহে কিছু অংকন করে এবং অন্যের দ্বারা করিয়ে নেয় উভয়ের প্রতি আল্লাহ অভিশাপ
করেছেন’।–(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত
হা/৪৪৩০; ‘পোশাক’ অধ্যায়)
অন্য বর্ণনায় এসেছে,لَعَنَ اللهُ الْوَاشِمَاتِ وَالْمُسْتَوْشِمَاتِ
وَالْمُتَنَمِّصَاتِ وَالْمُتَفَلِّجَاتِ لِلْحُسْنِ الْمُغَيِّرَاتِ خَلْقَ اللهِ
تَعَالَى ‘আল্লাহ তা‘আলা
ঐসব নারীদের প্রতি অভিশাপ করেছেন, যারা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার
উদ্দেশ্যে দেহে উল্কি (সুচিবিদ্ধ করে চিত্র অংকন) করে বা অন্যের মাধ্যমে করিয়ে
নেয়। যারা ভ্রূ উপড়িয়ে চিকন করে, যারা দাঁত সমূহকে শানিত ও
সরু বানায়। কারণ তারা আল্লাহর স্বাভাবিক সৃষ্টির বিকৃতি ঘটায়’।–( বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৪৩১)
ঞ.
গান-বাজনায় অভ্যস্ত নারী :
কোন কোন নারী গান-বাজনায় আসক্ত। গান শুনে
নিজেও গুনগুন করে গাইতে থাকে। কেউবা গানের তালে নাচতে থাকে। গান-বাজনা না শুনে
তারা থাকতে পারে না। ইসলামের দৃষ্টিতে এসব নারী নিকৃষ্ট। এদের সম্পর্কে রাসূল (স.)
বলেন,لَيَكُوْنَنَّ مِنْ أُمَّتِيْ أَقْوَامٌ
يَسْتَحِلُّوْنَ الْحِرَ وَالْحَرِيْرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ ‘অবশ্যই আমার পরে এমন কিছু লোক আসবে যারা যেনা, রেশম, নেশাদার
দ্রব্য ও গান-বাজনা বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে’।[-(বুখারী হা/৫৫৯০)
অথচ আল্লাহ তা‘আলা
এগুলোকে হারাম করেছেন। রাসূল (স.) বলেছেন,إِنَّ اللهَ تَعَالَى حَرَّمَ
الْخَمْرَ وَالْمَيْسِرَ والكُوْبَةَ. ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা
মদ, জুয়া ও সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন’।–(বায়হাক্বী, মিশকাত
হা/৪৫০৩, হাদীছ ছহীহ)
[চলবে----------]
২.
অভিভাবকের অনুমতি :
বিবাহের ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি অতীব
যরূরী। বিশেষ করে মেয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি একান্তভাবে আবশ্যক। কারণ
অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিরেকে বিবাহ হয় না। নবী করীম (স.) বলেন, لاَ نِكَاحَ إِلاَّ بِوَلِىٍّ ‘অভিভাবক
ছাড়া কোন বিবাহ নেই’।–(আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে
মাজাহ, মিশকাত হা/৩১৩০, হাদীছ ছহীহ)
তিনি আরো বলেন,
أَيُّمَا امْرَأَةٍ نُكِحَتْ
بِغَيْرِ إِذْنِ وَلِيِّهَا فَنِكَاحُهَا بَاطِلٌ فَنِكَاحُهَا بَاطِلٌ
فَنِكَاحُهَا بَاطِلٌ فَإِنْ دَخَلَ بِهَا فَلَهَا الْمَهْرُ بِمَا اسْتَحَلَّ
مِنْ فَرْجِهَا فَإِنِ اشْتَجَرُوْا فَالسُّلْطَانُ وَلِىُّ مَنْ لاَ وَلِىَّ لَهُ- ‘যদি কোন নারী তার ওলীর অনুমতি ছাড়া বিবাহ করে, তবে
তার বিবাহ বাতিল, বাতিল, বাতিল। এইরূপ অবৈধ পন্থায় বিবাহিত নারীর সাথে সহবাস
করলে তাকে মোহর দিতে হবে। কারণ পুরুষ মোহরের বিনিময়ে তার লজ্জাস্থানকে ব্যবহার
করেছে। যদি ওলীগণ বিবাদ করেন, তবে যার ওলী নেই তার ওলী
দেশের শাসক’।–(আবু
দাউদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত
হা/৩১৩১)
সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্ব পিতামাতা বা
অভিভাবকের। সেই সাথে তাদেরকে সুশিক্ষা দান ও আদব-কায়েদা শিক্ষা দেওয়া পিতামাতা ও অভিভাবকের
দায়িত্ব। সন্তান প্রাপ্ত বয়স্ক হ’লে যথাযোগ্য স্থানে তাদের
বিবাহের ব্যবস্থা করা পিতামাতা বা অভিভাবকের অন্যতম দায়িত্ব। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শারঈ
অভিভাবক হ’ল পিতা,
দাদা, ভাই, চাচা
ইত্যাদি। তবে পিতার উপস্থিতিতে অন্য কেউ ওলী বা অভিভাবক হ’তে
পারবে না। আবার কোন মহিলাও কারো ওলী হ’তে পারে না।–(মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শরহুল মুমতে‘ আলা
যাদিল মুসতাকনি ১২/৭৩ পৃঃ)
রাসূল (স.) বলেন,لاَ تُزَوِّجُ الْمَرْأَةُ الْمَرْأَةَ وَلاَ تُزَوِّجُ
الْمَرْأَةُ نَفْسَهَا فَإِنَّ الزَّانِيَةَ هِىَ الَّتِى تُزَوِّجُ نَفْسَهَا- ‘কোন নারী কোন নারীর বিবাহ দিতে পারে না এবং
কোন নারী নিজে বিবাহ করতে পারে না। কোন নারী নিজেই বিবাহ করলে সে ব্যভিচারী বলে
গণ্য হবে’।–(ইবনু
মাজাহ হা/১৮৮২, মিশকাত হা/৩১৩৭, বুলূগুল মারাম হা/৯৮৬; হাদীছ ছহীহ)
৩.
পাত্র-পাত্রীর সম্মতি :
বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রী বা বর-কনে হ’ল
মূল। যারা সারা জীবন একসাথে ঘর-সংসার করবে। সেকারণ বিবাহের পূর্বে তাদের সম্মতি
থাকতে হবে। কোন অবস্থাতেই কোন ছেলে-মেয়ের অসম্মতিতে তাদেরকে বিবাহ করতে বাধ্য করা
উচিত নয়। আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ
آمَنُوْا لاَ يَحِلُّ لَكُمْ أَن تَرِثُوْا النِّسَاءَ كَرْهاً ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য বৈধ নয় যে, তোমরা
বলপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকারী হবে’। (সূরা নিসা-৪/১৯)
নবী করীম (স.) বলেছেন,لاَ تُنْكَحُ الأَيِّمُ حَتَّى تُسْتَأْمَرَ وَلاَ تُنْكَحُ
الْبِكْرُ حَتَّى تُسْتَأْذَنَ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَكَيْفَ إِذْنُهَا؟
قَالَ أَنْ تَسْكُتَ. ‘বিবাহিতা মেয়েকে তার
পরামর্শ ছাড়া বিবাহ দেয়া যাবে না এবং কুমারী মেয়েকে তার অনুমতি ছাড়া বিবাহ দেয়া
যাবে না। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, তার অনুমতি কিভাবে হবে? উত্তরে
তিনি বললেন, ‘চুপ থাকাই হচ্ছে তার
অনুমতি’।–(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত
হা/৩১২৬ ‘বিবাহতে অভিভাবক ও
মেয়ের অনুমতি’ অনুচ্ছেদ)
অন্য বর্ণনায় রয়েছে,وَالْبِكْرُ تُسْتَأْذَنُ فِىْ نَفْسِهَا وَإِذْنُهَا صُمَاتُهَا ‘যুবতী-কুমারী মেয়ের বিবাহের ব্যাপারে পিতাকে
তার অনুমতি নিতে হবে। আর তার অনুমতি হচ্ছে চুপ থাকা’।–(মুসলিম, মিশকাত
হা/৩১২৭)
বিবাহের প্রস্তাব শুনার পর কুমারী মেয়ে চুপ
থাকলে তার সম্মতি আছে বলে ধরে নিতে হবে। কিন্তু অকুমারী মহিলার ক্ষেত্রে সরাসরি
সম্মতি নিতে হবে। রাসূল (স.) বলেছেন,
‘অকুমারী
মেয়েরা নিজেদের ব্যাপারে ওলীর থেকে অধিক হকদার’।–(মুসলিম হা/১৪২১, তিরমিযী, নাসাঈ, বুলূগুল
মারাম হা/৯৮৫)
অন্য হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ
(স.) জনৈকা মহিলার সম্মতিবিহীন বিবাহকে প্রত্যাখ্যান করেন।–((বুখারী হা/৫১৩৮, মিশকাত
হা/৩১২৮)
এছাড়াও কোন মেয়েকে অভিভাবক তার অনুমতি ছাড়া
বিবাহ দিলে সে ইচ্ছা করলে বিবাহ বহাল রাখতে পারে, ইচ্ছা
করলে বিবাহ ভঙ্গ করতে পারে।–(বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসঈ, বুলূগুল
মারাম হা/৯৮৮)
৪. পাত্র-পাত্রীর সমতার দিকে লক্ষ্য
রাখা :
দ্বীনদারী, পরহেযগারিতা, বংশমর্যাদা
ও আর্থিক দিক সহ বিভিন্ন দিকে সমতার বিষয়টি লক্ষ্য রাখা যরূরী। বিশেষত দ্বীনদারীর
ক্ষেত্রে সমতা না থাকলে পরিবারে অশান্তি বিরাজ করে। এজন্য রাসূল (স.) বলেন,تَخَيَّرُوْا لِنُطَفِكُمْ وَانْكِحُوا الأَكْفَاءَ وَأَنْكِحُوْا
إِلَيْهِمْ- ‘তোমরা ভবিষ্যত বংশধরদের
স্বার্থে উত্তম মহিলা গ্রহণ করো এবং সমতা (কুফূ) বিবচেনায় বিবাহ করো, আর
বিবাহ দিতেও সমতার প্রতি লক্ষ্য রাখো’।–(ইবনু মাজাহ হা/১৯৬৮; ছহীহাহ হা/১০৬৭; ছহীহুল
জামে‘ হা/২৯২৮) তবে বিবাহে সমতা হবে কেবল
দ্বীনদারী ও চরিত্রের ক্ষেত্রে। যেমন আল্লামা নাছীরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন,ولكن يجب أن نعلم أن الكفاءة إنما هي في الدين والخلق فقط ‘তবে জানা আবশ্যক যে, সমতা
হচ্ছে কেবল দ্বীনদারী ও চরিত্রের ক্ষেত্রে’।–( সিলসিলা ছহীহাহ হা/১০৬৭-এর আলোচনা দ্র.)
৫. বিবাহের প্রস্তাব :
বর অথবা কনে যে কোন এক পক্ষ থেকে বিবাহের
প্রস্তাব আসতে পারে। ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, যখন
ওমর (রাঃ)-এর কন্যা হাফছাহ (রাঃ) খুনায়স ইবনু হুযাইফা সাহমীর মৃত্যুতে বিধবা হ’লেন, তিনি
রাসূলুল্লাহ (স.)-এর একজন ছাহাবী ছিলেন এবং মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন। ওমর (রাঃ) বলেন, আমি
ওছমান বিন আফফান (রাঃ)-এর কাছে গেলাম এবং হাফছাহকে বিবাহ করার জন্য প্রস্তাব
দিলাম। তখন তিনি বললেন, আমি এ ব্যাপারে
চিন্তা-ভাবনা করে দেখি। তারপর আমি কয়েক রাত অপেক্ষা করলাম। তিনি আমার সঙ্গে
সাক্ষাৎ করে বললেন, আমার কাছে এটা প্রকাশ
পেয়েছে যে, এখন আমি যেন তাকে বিবাহ না
করি। ওমর (রাঃ) বলেন, তারপর আমি আবুবকর (রাঃ)-এর
সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললাম, যদি আপনি চান তাহ’লে
আপনার সঙ্গে ওমরের কন্যা হাফছাহকে বিবাহ দেই। আবুবকর (রাঃ) নীরব থাকলেন, প্রতি-উত্তরে
আমাকে কিছুই বললেন না। এতে আমি ওছমান (রাঃ)-এর চেয়ে অধিক অসন্তুষ্ট হ’লাম।
এরপর আমি কয়েক রাত অপেক্ষা করলাম। তারপর রাসূল (স.) হাফছাহকে বিবাহের প্রস্তাব
পাঠালেন এবং আমি তাঁর সঙ্গে হাফছাহকে বিবাহ দিলাম’।–(বুখারী হা/৫১২২)
অন্য
এক হাদীছে এসেছে, আনাস (রাঃ) বলেন, একজন
মহিলা নবী করীম (স.)-এর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল (স.)! আমাকে কি আপনার প্রয়োজন আছে’?-(বুখারী হা/৫১২০)
বিবাহের প্রস্তাব দেয়ার পূর্বে লক্ষ্য রাখতে
হবে যে, এই মহিলাকে অন্য কেউ বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছে কি-না? কেউ
প্রস্তাব দিয়ে থাকলে নতুন করে প্রস্তাব দেয়া যাবে না। নবী করীম (স.)
(ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে) একজনে দর-দাম করলে অন্যকে দরদাম করতে নিষেধ করেছেন এবং
এক মুসলিম ভাইয়ের বিবাহের প্রস্তাবের উপর অন্য ভাইকে প্রস্তাব দিতে নিষেধ করেছেন, যতক্ষণ
না প্রথম প্রস্তাবক তার প্রস্তাব ফিরিয়ে নেয় বা তাকে অনুমতি দেয়’।–(বুখারী হা/৫১৪২, মুসলিম
হা/১৪১২,বুলূগুল মারাম
হা/৯৭৮)
অন্যত্র রাসূল (স.) বলেছেন,وَلاَ يَخْطُبُ الرَّجُلُ عَلَى خِطْبَةِ أَخِيْهِ، حَتَّى
يَنْكِحَ أَوْ يَتْرُكَ. ‘কোন ব্যক্তি যেন তার
ভাইয়ের প্রস্তাবের উপর প্রস্তাব না দেয়,
যতক্ষণ
না সে বিবাহ করে অথবা ছেড়ে দেয়’।–(বুখারী হা/৫১৪৪, মুসলিম, মিশকাত হা/৩১৪৪)
৬.
পাত্র-পাত্রী দর্শন :
বিবাহের পূর্বে পাত্র-পাত্রী উভয়ে একে অপরকে
দেখে নেওয়া উচিত। যাতে পরস্পরের মধ্যে মহববত তৈরী হয়। মুগীরা বিন শু‘বা
(রাঃ) বলেন, আমি জনৈক নারীকে বিবাহের
প্রস্তাব দিলাম। রাসূল (স.) আমাকে বললেন,هَلْ نَظَرْتَ إلَيْهَا؟
قُلْتُ لاَ، قَالَ فَانْظُرْ إلَيْهَا، فَإِنَّهُ أَحْرَى أَنْ يُؤْدَمَ
بَيْنَكُمَا. ‘তুমি কি তাকে দেখেছ? আমি
বললাম, না। তিনি বললেন,
তাকে
দেখে নাও। কেননা এতে তোমাদের উভয়ের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টি হবে’।–(তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত
হা/৩১০৭)
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একজন
লোক নবী করীম (স.)-এর নিকট এসে বলল যে,
সে
আনছারী একটি মেয়েকে বিবাহ করার ইচ্ছা করেছে। রাসূল (স.) বললেন,هَلْ نَظَرْتَ إِلَيْهَا فَإِنَّ فِىْ عُيُوْنِ الأَنْصَارِ
شَيْئًا- ‘তাকে কি দেখেছ? কেননা
আনছারদের চোখে দোষ থাকে’।–(মুসলিম, মিশকাত হা/৩০৯৮)
আমাদের সমাজে পাত্রী দর্শনের উদ্দেশ্যে
পাত্রের বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন মিলে ছোট-খাট একটি দল পাত্রীর বাড়ীতে যায়। তারা
পাত্রীকে সবার সামনে বসিয়ে মাথার কাপড় সরিয়ে,
দাঁত
বের করে, হাঁটিয়ে দেখে। এরপর সকলে
মিলে বিভিন্ন প্রশ্ন করে ছোট-বড় একটি ইন্টারভিউ নিয়ে ফেলে। কোন কোন ক্ষেত্রে
হাসি-ঠাট্টা করতেও ছাড়ে না। সমাজে পাত্রী দেখার এই প্রচলিত পদ্ধতি শরী‘আত
সম্মত নয়। বিবাহের পূর্বে পাত্র ব্যতীত অন্যদের এভাবে পাত্রী দেখা চোখের যেনার শামিল।
অনেক সময় পাত্র-পাত্রীর ধর্মীয় বিষয়কে না দেখে তার রূপ-লাবণ্য, বংশ
ও সম্পদ দেখেই বিবাহের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু প্রত্যেক মুসলিম পাত্রের
উচিত রূপ, বংশ ও সম্পদের চেয়ে
পাত্রীর দ্বীনদারীকে বেশী গুরুত্ব দেয়া। পরিপূর্ণ দ্বীনদারী পাওয়া গেলে অন্য গুণ কম
হ’লেও দ্বীনদার মহিলাকেই বিবাহ করা উচিত, তাহ’লে
দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ হবে।
অনেক সময় পাত্রী দেখার নাম করে ছেলে-মেয়ের
নির্জনে সময় কাটানো, পার্কে বসে আলাপ করা, হবু
বধূকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নবী করীম (স.) বলেন,لاَ يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ، وَلاَ تُسَافِرَنَّ امْرَأَةٌ
إِلاَّ وَمَعَهَا مَحْرَمٌ ‘কোন পুরুষ যেন অপর মহিলার
সঙ্গে নিভৃতে অবস্থান না করে, কোন স্ত্রীলোক যেন কোন
মাহরাম সঙ্গী ছাড়া সফর না করে’।–( বুখারী হা/৩০০৬)
অন্যত্র
তিনি বলেন, لاَ يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ
بِامْرَأَةٍ إِلاَّ كَانَ ثَالِثَهُمَا الشَّيْطَانُ ‘যখন
কোন পুরুষ-মহিলা নির্জনে একত্রিত হয়,
তখন
তৃতীয়জন হিসাবে সেখানে শয়তান উপস্থিত হয়’।–(তিরমিযী হা/১১৭১, ২১৬৫; ছহীহাহ হা/৪৩০; মিশকাত
হা/৩১১৮)
৭.
সুন্নাতী পদ্ধতিতে বিবাহ সম্পন্ন করা :
পরিবার ও পারিবারিক জীবনের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা
রয়েছে ইসলামে। বিবাহকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শরী‘আতসিদ্ধ
দাম্পত্য জীবনে জান্নাতের সুখ-শান্তির ছোয়া মেলে। তাই বিবাহ অনুষ্ঠান সুন্নাতী
তরীকায় হওয়া বাঞ্ছনীয়। বর্তমানে অধিকাংশ বিবাহ অনুষ্ঠানে গান-বাজনা, বেপর্দা, অশ্লীলতা, অপচয়, যৌতুক
ইত্যাদি শরী‘আত গর্হিত কর্ম দেখা যায়। এতে বিবাহ নামক
ইবাদতের ছওয়াব ও বরকত থেকে বঞ্চিত হয় বর-কনে ও সংশ্লিষ্ট সকলে। আর তাদের দাম্পত্য
জীবনে শুরু হয় ঝগড়া-বিবাদ, দ্বনদ্ব-কলহ ও অশান্তি। অথচ বিবাহের মাধ্যমে ঈমানের পূর্ণতা অর্জিত
হয়। রাসূল (স.) বলেন,مَنْ تَزَوَّجَ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ
نِصْفَ الإِيْمَانِ فَلْيَتَّقِ الله في النِّصْفِ الْبَاقِي ‘যে
ব্যক্তি বিবাহ করল, সে অর্ধেক ঈমান পূর্ণ করল।
অতএব বাকী অর্ধেকে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে’।–( মিশকাত হা/৩০৯৬; ছহীহুল
জামে‘ হা/৬১৪৮; ছহীহাহ হা/৬২৫)
বিবাহ
পড়ানোর শারঈ পদ্ধতি হ’ল প্রথমে একজন বিবাহের খুৎবা পাঠ করবেন।–(সাইয়েদ সাবেক, ফিকহুস
সুন্নাহ (বৈরূত : দারুল ফিকর, ২য়
প্রকাশ ১৯৯৮খ্রিঃ), ২/১৫৩)
এরপর মেয়ের পিতা বা অভিভাবক বরের সামনে মেয়ের
পরিচয় ও মোহরের পরিমাণ উল্লেখ করে বিবাহের প্রস্তাব পেশ করবেন। এসময় দু’জন
সাক্ষীও উপস্থিত থাকবেন। তখন বর সরবে ‘কবুল’ অথবা
‘আমি গ্রহণ করলাম’
বলবেন।
এরূপ তিনবার বলা উত্তম।–( বুখারী
হা/৯৫, মিশকাত হা/২০৮)
শুধু
বরকেই কবুল বলাতে হবে। কনের নিকট থেকে কনের অভিভাবক শুধু অনুমতি নিবেন। বর বোবা হ’লে
সাক্ষীদ্বয়ের উপস্থিতিতে ইশারা বা লেখার মাধ্যমেও বিবাহ সম্পন্ন হ’তে
পারে।–(শারহুল মুমতে‘ আলা
যাদিল মুসতাকনি ১২/৪৪ পৃঃ)
বিবাহের খুৎবা নিম্নরূপ-
إِنَّ الْحَمْدَ لِلَّهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِينُهُ
وَنَسْتَغْفِرُهُ وَنَعُوذُ بِاللهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ
أَعْمَالِنَا مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلاَ مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلاَ
هَادِىَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ
وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ- يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ
آمَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوْتُنَّ إِلاَّ وَأَنْتُم
مُّسْلِمُوْنَ (آل عمران، يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُواْ رَبَّكُمُ الَّذِيْ
خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا
رِجَالاً كَثِيْراً وَنِسَاء وَاتَّقُواْ اللهَ الَّذِيْ تَسَاءلُوْنَ بِهِ وَالأَرْحَامَ
إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيْباً (النساء، يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا
اتَّقُوا اللهَ وَقُوْلُوْا قَوْلاً سَدِيْداً، يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ
وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَقَدْ فَازَ
فَوْزاً عَظِيْماً (الأحزاب- [24]
অতঃপর বিবাহ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কথা বলবেন।
আমাদের সমাজে কবুল বলানোর জন্য কাযী বা যিনি
বিবাহ পড়াবেন তিনি বরের অনুমতি নিয়ে দু’জন সাক্ষীসহ কনের নিকট চলে
যান। কাযী গিয়ে বরের ঠিকানা ও মোহরের পরিমাণ উল্লেখ করে কনেকে কবুল বলতে বলেন।
কবুল বলার পর কাযী ছাহেব বরের নিকট ফিরে আসেন এবং মেয়ের ঠিকানা ও মোহরের পরিমাণ
উল্লেখ করে মেয়েকে গ্রহণ করার জন্য কবুল বলতে বলেন। তিন বার কবুল বলার পর বিবাহ
সম্পন্ন হয়। বিবাহ পড়ানোর এই পদ্ধতি সঠিক নয়।
৮. মোহর
প্রদান করা :
সামর্থ্য অনুযায়ী স্ত্রীকে মোহর প্রদান করা
প্রত্যেক স্বামীর উপরে ফরয। আল্লাহ বলেন,
وَآتُوا النِّسَاءَ
صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً ‘তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের
মোহরানা ফরয হিসাবে প্রদান কর’। (সূরা নিসা-৪/৪) তিনি আরো বলেন, فَآتُوْهُنَّ أُجُوْرَهُنَّ فَرِيْضَةً ‘তোমরা
স্ত্রীদের মোহরানা ফরয হিসাবে প্রদান কর’। (সূরা নিসা-৪/২৪)
রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন,أَحَقُّ الشُّرُوْطِ أَنْ تُوْفُوْا بِهِ مَا اسْتَحْلَلْتُمْ بِهِ
الْفُرُوْجَ- ‘(বিবাহে) সবচেয়ে বড় শর্ত
যেটা তোমরা পূর্ণ করবে, সেটা হ’ল
যা দ্বারা তোমরা লজ্জাস্থানকে হালাল কর’।–(বুখারী হা/৫১৫১; মুসলিম
হা/১৪১৮; মিশকাত হা/৩১৪৩) অর্থাৎ মোহর। মোহরানা কম হওয়ার প্রতি ইসলামে
উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। রাসূল (স.) বলেন,
خَيْرُ اَلصَّدَاقِ أَيْسَرُهُ উত্তম মোহর
হচ্ছে যা (পরিশোধ করা) সহজ’।–(বায়হাক্বী, ছহীহুল জামে‘ হা/৩২৭৯)
তিনি আরো বলেন,إِنَّ مِنْ يُمْنِ الْمَرْأَةِ تَيْسِيْرَ خِطْبَتِهَا
وَتَيْسِيْرَ صَدَاقِهَا وَتَيْسِيْرَ رَحِمِهَا- ‘নিশ্চয়ই
উত্তম মহিলা হ’ল যাকে প্রস্তাব দেওয়া সহজ, যার
মোহর আদায় করা সহজ ও যার গর্ভাশয় (সন্তান ধারণে) সহজ হয়’।–(মুসনাদে আহমাদ, ছহীহুল
জামে‘ হা/২২৩৫; ইরওয়া ৬/৩৫০ পৃঃ)
মূলত মোহর অধিক নির্ধারণের মধ্যে কোন কল্যাণ
নেই। ওমর (রাঃ) বলেন,
لاَ تُغَالُوْا صَدَاقَ النِّسَاءِ فَإِنَّهَا لَوْ
كَانَتْ مَكْرُمَةً فِى الدُّنْيَا أَوْ تَقْوًى عِنْدَ اللهِ كَانَ أَوْلاَكُمْ
وَأَحَقَّكُمْ بِهَا مُحَمَّدٌ صلى الله عليه وسلم مَا أَصْدَقَ امْرَأَةً مِنْ
نِسَائِهِ وَلاَ أُصْدِقَتِ امْرَأَةٌ مِنْ بَنَاتِهِ أَكْثَرَ مِنِ اثْنَتَىْ
عَشْرَةَ أُوقِيَّةً وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيُثَقِّلُ صَدَقَةَ امْرَأَتِهِ حَتَّى
يَكُونَ لَهَا عَدَاوَةٌ فِى نَفْسِهِ وَيَقُولُ قَدْ كَلِفْتُ إِلَيْكِ عَلَقَ
الْقِرْبَةِ أَوْ عَرَقَ الْقِرْبَةِ.
‘মহিলাদের মোহরের ব্যাপারে
তোমরা বাড়াবাড়ি করো না। কেননা তা যদি পার্থিব জীবনে সম্মান অথবা আল্লাহর কাছে
তাক্বওয়ার প্রতীক হ’ত,
তাহ’লে
তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (স.) এ ব্যাপারে অধিক যোগ্য ও অগ্রগণ্য
ছিলেন। তিনি তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদের মোহর বারো উকিয়ার বেশি ধার্য করেননি। কখনও
অধিক মোহর স্বামীর উপর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর মনে শত্রুতা
সৃষ্টি হয়। এমনকি সে বলতে থাকে, আমি তোমার জন্য পানির মশক
বহনে বাধ্য হয়েছি অথবা তোমার জন্য ঘর্মাক্ত হয়ে পড়েছি’।–(ইবনু মাজাহ হা/১৮৮৭; মিশকাত হা/৩২০৪; ছহীহাহ
হা/১৮৩৪)
যখন আলী (রাঃ) ফাতেমা (রাঃ)-কে বিবাহ করেন
তখন রাসূলুল্লাহ (স.) তাকে বললেন, তুমি ফাতেমাকে (মোহরানা
স্বরূপ) কিছু দাও। আলী (রাঃ) বললেন,
আমার
নিকট কিছু নেই। নবী করীম (স.) বললেন,
তোমার
হুতামী বর্মটি কোথায়’?-(আবু দাউদ হা/২১২৫, নাসাঈ হা/৩৩৭৫, বুলূগুল
মারাম হা/১০২৯)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, নবী
করীম (স.) এক ব্যক্তিকে বললেন, تَزَوَّجْ وَلَوْ بِخَاتَمٍ
مِنْ حَدِيْدٍ ‘তুমি বিবাহ কর, একটি
লোহার আংটির বিনিময়ে হ’লেও’।–(বুখারী হা/৫১৫০ ‘বিবাহ’ অধ্যায়)
কুরআন তেলাওয়াত শিক্ষাদানকে মোহর নির্ধারণ
করেও বিবাহ সম্পন্ন করা যায়। সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) হ’তে
বর্ণিত, জনৈকা মহিলা রাসূলুল্লাহ (স.)-এর কাছে এসে বলল, হে
আল্লাহর রাসূল (স.)! আমি আমার নিজেকে আপনার হাতে সমর্পণ করতে এসেছি। নবী করীম (স.)
তার দিকে তাকালেন এবং তার আপাদমস্তক লক্ষ্য করলেন। তারপর তিনি মাথা নিচু করলেন।
যখন মহিলাটি দেখল নবী করীম (স.) তার সম্পর্কে কোন ফায়ছালা দিচ্ছেন না, তখন
সে বসে পড়ল। এরপর নবী করীম (স.)-এর ছাহাবীদের মধ্যে একজন দাঁড়ালেন এবং বললেন, হে
আল্লাহর রাসূল (স.)! যদি আপনার বিবাহের প্রয়োজন না থাকে, তবে
আমার সঙ্গে এর বিবাহ দিয়ে দিন। রাসূল (স.) জিজ্ঞেস করলেন, তোমার
কাছে কিছু আছে কী? সে উত্তর দিল, না, আল্লাহর
কসম, হে আল্লাহর রাসূল (স.)! আমার কাছে কিছুই নেই। রাসূলুল্লাহ (স.)
বললেন, তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের কাছে গিয়ে দেখ, কিছু
পাও কি-না। তারপর লোকটি চলে গেল। ফিরে এসে বলল,
আল্লাহর
কসম! আমি কিছুই পাইনি। এরপর রাসূলুল্লাহ (স.) বললেন, আবার
দেখ, লোহার একটি আংটিও যদি পাও। তারপর লোকটি আবার চলে গেল। ফিরে
এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (স.)!
লোহার আংটিও পেলাম না। কিন্তু এই আমার লুঙ্গি (শুধু এটাই আছে)। সাহল (রাঃ) বলেন, তার
কাছে কোন চাদর ছিল না। লোকটি লুঙ্গির অর্ধেক মহিলাকে দিতে চাইল। তখন রাসূলুল্লাহ (স.)
বললেন, সে তোমার লুঙ্গি দিয়ে কি করবে? যদি
তুমি পরিধান কর, তাহ’লে
তার কোন কাজে আসবে না। আর সে যদি পরিধান করে,
তবে
তোমার কোন কাজে আসবে না। এরপর বেশ কিছুক্ষণ লোকটি নীরবে বসে থাকল। তারপর সে উঠে
দাঁড়াল ও নবী করীম (স.) তাকে যেতে দেখে ডেকে আনলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তোমার
কি পরিমাণ কুরআন মাজীদ মুখস্থ আছে?
সে
বলল, আমার অমুক অমুক সূরা মুখস্থ আছে এবং সে গণনা করল। নবী করীম
(স.) জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কী তোমার মুখস্থ আছে? সে
বলল, হ্যাঁ। নবী করীম (স.) বললেন, যে
পরিমাণ কুরআন তোমার মুখস্থ আছে তার বিনিময়ে এ মহিলাকে তোমার অধীনস্থ করে দিলাম’।–( বুখারী হা/৫০৮৭, ৫১২১, ৫১২৬, মুসলিম
হা/১৪২৫, বুলূগুল মারাম
হা/৯৭৯)
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হ’ল
আজকাল অনেকে বিবাহে মোহরানার মত ফরয কাজকে মর্যাদার বিষয় বা তালাক থেকে রক্ষার
জন্য নারীর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন। এজন্য ছেলের সামর্থ্যের দিকে খেয়াল না
করে মেয়েপক্ষ তাদের বংশমর্যাদা অনুযায়ী লক্ষ লক্ষ টাকা মোহর নির্ধারণ করেন। আবার
অনেকের ধারণা যে, বিবাহে মোহর বেশী ধার্য
করা থাকলে ছেলেপক্ষ মেয়েকে তালাক দিতে পারবে না কিংবা তালাক দিতে চাইলে প্রচুর
টাকা দিতে হবে। এই উভয় ধারণাই ইসলাম বিরোধী। রাসূল (স.)-এর যুগে লোকেরা এক মুষ্টি
খাদ্যের বিনিময়েও বিবাহ করতেন।–(ছহীহ আবুদাউদ হা/১৮৫৫) এছাড়া
কিছু না থাকায় কেবল কুরআন শিক্ষাদানের বিনিময়ে আল্লাহর রাসূল (স.) জনৈক ছাহাবীকে
বিবাহ দিয়েছে।–(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত
হা/৩২০২, ‘মোহর’ অনুচ্ছেদ)
যা
উপরোক্ত হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত।
উল্লেখ্য যে, কারণবশতঃ
মোহর বাকী রাখা যায়। তবে সেটা ঋণের অন্তর্ভুক্ত। তাই যত দ্রুত সম্ভব তা পরিশোধ
করা কর্তব্য। মোহর বাকী থাকলে সন্তান অবৈধ হবে একথা ঠিক নয়। কেননা বিবাহ শুদ্ধ
হওয়ার জন্য মোহর পরিশোধ করা শর্ত নয়। রাসূল (স.) একজন ব্যক্তিকে বললেন, অমুক
মহিলার সাথে তোমাকে বিবাহ দিব তুমি কি রাযী?
সে
বলল, হ্যাঁ। নবী করীম (স.) বললেন, অমুক
ব্যক্তির সাথে তোমাকে বিবাহ দিব তুমি কি রাযী?
মহিলা
বলল, হ্যাঁ। তিনি তাদের বিবাহ দিলেন। কিন্তু কোন মোহর নির্ধারণ
করলেন না এবং মহিলাকে কিছু দিলেন না। ঐ ব্যক্তি হোদায়বিয়ার ছাহাবী ছিলেন। পরে তিনি
খায়বরের গণীমতের অংশ পান। এ সময় তাঁর মৃত্যু উপস্থিত হ’লে
তিনি বলেন, স্ত্রীর জন্য আমার কোন
মোহর নির্ধারিত ছিল না। এক্ষণে আমি আমার খায়বরের প্রাপ্ত অংশ তাকে মোহর হিসাবে দান
করলাম। যার মূল্য ছিল এক লক্ষ দিরহাম’।–( আবূদাঊদ হা/২১১৭)
নবী করীম (স.) একদা মোহর বাকী রেখে এক
ব্যক্তির বিবাহ দেন এবং কুরআন শিক্ষাদানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তা আদায় করতে বলেন।–(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত
হা/৩২০২)
তবে মোহরানা পরিশোধ না করে মৃত্যুর সময়
স্ত্রীর নিকট থেকে তা মাফ করিয়ে নেওয়ার যে রীতি সমাজে চালু আছে, তা
চরম অন্যায় ও প্রতারণাপূর্ণ। এ থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে এবং হাতে অর্থ এলেই
সর্বাগ্রে স্ত্রীর মোহর পরিশোধ করতে হবে।
৯.
আড়ম্বর ও কুসংস্কার পরিত্যাগ করা :
(ক)
বিবাহের তারিখ নির্ধারণ : বছরের নির্দিষ্ট কোন মাস
বা দিনকে শুভ বা কল্যাণকর ধারণা করে সেই মাস বা দিনকে বিবাহের জন্য নির্ধারণ করা
অথবা কোন মাস বা দিনকে অশুভ বা অকল্যাণকর ভেবে সেই মাস বা দিনে ঐ মাস ও দিনে
বিবাহ-শাদী করা থেকে বিরত থাকা শরী‘আত বিরোধী। নির্দিষ্ট কোন
দিনে, কারো মৃত্যু বা জন্মদিনে বিবাহ করা যাবে না মনে করা গুনাহের
কাজ। আল্লাহর কাছে বছরের প্রতিটি দিনই সমান। মানুষ তার সুবিধা অনুযায়ী যে কোন দিন
নির্ধারণ করতে পারবে।
(খ) যৌতুক
আদান-প্রদান : অসচ্ছলতার দোহাই দিয়ে
কিংবা স্বাবলম্বী হওয়ার নাম করে মেয়ের পিতা বা অভিভাবকের নিকট থেকে যৌতুক গ্রহণ
করা হারাম। আল্লাহ বলেন, وَلَا تَأْكُلُوْا
أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ، ‘আর
তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের সম্পদ ভক্ষণ করো না’। (সূরা বাক্বারাহ-২/১৮৮; সূরা নিসা-৪/২৯)
কারো সক্ষমতা না থাকলে সক্ষম হওয়া পর্যন্ত
অপেক্ষা করা যরূরী। আল্লাহ বলেন,وَلْيَسْتَعْفِفِ الَّذِينَ
لاَ يَجِدُوْنَ نِكَاحًا حَتَّى يُغْنِيَهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ ‘যাদের বিয়ের সামর্থ্য নেই আল্লাহ তাদেরকে নিজ
অনুগ্রহে অভাবমুক্ত না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে’। (সূরা নূর-২৪/৩৩)
আর কেউ নিজের চারিত্রিক নিষ্কলুষতা বজায়
রাখার জন্য বিবাহ করার নিয়ত করলে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। রাসূল (স.) বলেন,ثَلاَثَةٌ حَقٌّ عَلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ عَوْنُهُمُ
الْمُكَاتَبُ الَّذِىْ يُرِيْدُ الأَدَاءَ وَالنَّاكِحُ الَّذِى يُرِيْدُ
الْعَفَافَ وَالْمُجَاهِدُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ ‘আল্লাহ
তা‘আলা তিন প্রকারের মানুষকে সাহায্য করা নিজের কর্তব্য হিসাবে
নির্ধারণ করেছেন। চুক্তিবদ্ধ গোলাম,
যে
চুক্তির অর্থ পরিশোধের ইচ্ছা করে; বিবাহে আগ্রহী লোক, যে
বিয়ের মাধ্যমে পবিত্র জীবন যাপন করতে চায় এবং আল্লাহর পথে জিহাদকারী’।–(নাসাঈ হা/৩১৬৬; তিরমিযী
হা/১৬৫৫; মিশকাত হা/৩০৮৯, সনদ হাসান)
অতএব যে কোন কারণেই হোক না কেন যৌতুক গ্রহণ
করা থেকে বিরত থাকা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য। অনুরূপভাবে যৌতুক প্রদান করা থেকেও
বিরত থাকতে হবে কেননা এতে পাপের কাজে সহযোগিতা করা হয়, যা
সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।–(সূরা মায়েদাহ-৫/২)
(গ) থুবড়া
ও ক্ষীর খাওয়ানো : বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে
বর ও কনেকে বিবাহের দু’তিন দিন পূর্বে নিজ নিজ বাড়ীতে নির্দিষ্ট
আসনে বসিয়ে রাতের প্রথমাংশে মাহরাম,
গায়রে
মাহরাম পুরুষ-নারী, যুবক-যুবতী সকলে মিষ্টি, ফল-মূল
ও পিঠা-পায়েস ইত্যাদি মুখে তুলে খাওয়ায়। সেই সাথে নব যুবতীরা গান গেয়ে টাকা-পয়সা
আদায় করে। এসব প্রথা শরী‘আত সম্মত নয়। বরং এর মাধ্যমে যুবক-যুবতীরা
অবাধ মেলামেশার সুযোগ পায়। আর পর্দাহীনভাবে চলাফেরা ও হাসি-ঠাট্টা থেকে
যুবক-যুবতীরা যেনার দিকে ধাবিত হয়।
(ঘ)
এঙ্গেজমেন্ট বা আংটি পরানো : আজকাল মুসলমানদের অধিকাংশ
বিবাহে আংটি পরানোর রীতি চালু আছে। আল্লামা নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) একে কাফেরদের
অন্ধ অনুকরণ বলে উল্লেখ করেছেন।–( আদাবুয
যিফাফ, মাসআলা নং ৩৮)
(ঙ) গায়ে
হলুদ : গায়ে হলুদের নামে আমাদের
সমাজে বিবাহের দু’একদিন পূর্বে বরকে কনের পক্ষের যুবতী নারীরা
এবং বরের ভাবী, চাচাতো বোন, ফুফাতো
বোন, মামাতো বোন,
খালাতো
বোনেরা মিলে হলুদ মাখায়। অনুরূপভাবে কনেকে বরের পক্ষের লোকেরা ও তার চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো
ভাইসহ অন্যান্য গায়ের মাহরাম পুরুষরা যেভাবে হলুদ মাখায় তা ইসলামী বিধানের
সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এছাড়া এই হলুদ মাখানোর জন্য উভয় বাড়ীতে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান
করা হয়। এসব শরী‘আত সম্মত নয়। তবে বর নিজে বা কোন পুরুষ ও মাহরাম
মহিলা যদি হলুদ মাখিয়ে দেয় তাতে কোন দোষ নেই। অনুরূপভাবে কনে নিজে বা মহিলারা
কিংবা কোন মাহরাম ব্যক্তি কনেকে শালীনভাবে হলুদ মাখিয়ে দিতে পারে। আনাস (রাঃ) বলেন,أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم رَأَى عَلَى عَبْدِ
الرَّحْمَنِ بْنِ عَوْفٍ أَثَرَ صُفْرَةٍ قَالَ مَا هَذَا. قَالَ إِنِّى
تَزَوَّجْتُ امْرَأَةً عَلَى وَزْنِ نَوَاةٍ مِنْ ذَهَبٍ. قَالَ بَارَكَ اللهُ
لَكَ، أَوْلِمْ وَلَوْ بِشَاةٍ. ‘নবী করীম (স.) আবদুর রহমান
ইবনু আওফ (রাঃ)-এর গায়ে হলুদ রঙের চিহ্ন দেখে বললেন, এটা
কিসের রঙ? তিনি বললেন, আমি
একটি মেয়েকে খেজুরের আuঁট পরিমাণ স্বর্ণের বিনিময়ে বিয়ে করেছি। নবী
করীম (স.) বললেন, আল্লাহ তা‘আলা
তোমার এ বিয়েতে বরকত দান করুন। তুমি একটি ছাগলের দ্বারা হ’লেও
ওয়ালীমার ব্যবস্থা কর’।–(বুখারী
৫০৭২, মুসলিম হা/১৪২৭, মিশকাত হা/৩২১০)
(চ) বিবাহ
অনুষ্ঠানে গান-বাদ্য বাজানো : বর্তমানে আমাদের সমাজের বিবাহ অনুষ্ঠানে বাংলা, হিন্দী, ইংরেজী
বিভিন্ন অশ্লীল গান-বাজনার আয়োজন করা হয়। আবার কোথাও কোথাও বাদ্যের তালে তালে
নাচের আয়োজন থাকে। বিবাহের কয়েক দিন পূর্ব থেকেই এই নাচ-গানের আসর চলে, যা
শেষ হয় বিবাহের কয়েকদিন পর। অথচ ইসলামে এই অশ্লীল গান ও বাদ্য-বাজনাকে হারাম করা
হয়েছে। রাসূল (স.) বলেছেন,لَيَكُوْنَنَّ مِنْ أُمَّتِىْ
أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّوْنَ الْحِرَ وَالْحَرِيْرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ ‘আমার উম্মতের মধ্যে অবশ্যই এমন কতগুলো দলের
সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশমী
কাপড়, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল জ্ঞান করবে’।–(বুখারী হা/৫৫৯০, মিশকাত
হা/৫৩৪৩) অন্যত্র রাসূল (স.) বলেন,إِنَّ اللهَ حَرَّمَ عَلَىَّ أَوْ حُرِّمَ الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ
وَالْكُوبَةُ ‘আল্লাহ আমার উপর হারাম
করেছেন অথবা হারাম করা হয়েছে মদ, জুয়া ও তবলা’।–(আবু দাউদ হা/৩৬৯৬, মিশকাত হা/৪৫০৩, হাদীছ
ছহীহ)
উল্লেখ্য,
বিবাহের
ঘোষণার জন্য দফ বা একমুখা ঢোল বাজানো বৈধ।–(আদাবুয যিফাফ, মাসআলাহ নং-৩৭।
(ছ) মহিলা
বরযাত্রী : মহিলাদের জন্য সাজসজ্জা
করে বেপর্দা অবস্থায় বের হওয়া সিদ্ধ নয়। কিন্তু বর্তমানে বিবাহের সময় মহিলারা
সাজগোজ করে পাতলা কাপড় পরিধান করে পর্দাহীনভাবে বরের সাথে কনের বাড়ীতে যায়।
অনুরূপভাবে কনের পক্ষের মহিলারাও বরের বাড়ীতে যায়। যাদের পরণে থাকে বিভিন্ন মিহি, পাতলা
পোষাকের বাহার, অঙ্গে শোভা পায় বাহারী
অলংকার আর গায়ে মাখা থাকে কড়া পারফিউম। কেউবা অর্ধনগ্ন পোষাক পরে বের হয়।
যাত্রাপথে গায়ের মাহরাম পুরুষের সাথে গাড়িতে একসাথে বসে, ঢলাঢলি, হাসি-তামাশা
করতে করতে যাতায়াত করে। এভাবে সৌন্দর্য প্রদর্শন করে, পর্দাহীনভাবে
ও গায়ের মাহরাম পুরুষের সাথে নারীদের কোথাও যাওয়া বৈধ নয়। মহিলাদেরকে যদি একান্তই
যেতে হয় তাহ’লে পর্দা মেনে শালীনভাবে যেতে হবে।
(জ)
সাজসজ্জা করা : বর্তমানে বিবাহ অনুষ্ঠানে
পাত্র-পাত্রীকে বিভিন্নভাবে সাজানোর প্রথা চালু আছে। বিউটি পারলারে নিয়ে গিয়ে
কনেকে সাজানো হয়। বিভিন্ন স্টাইল করে চুল কেটে,
মেকাপ
দিয়ে মুখমন্ডলসহ সর্বাঙ্গ সাজানো হয়। যাতে খরচ হয় হাযার হাযার টাকা। আর এই সাজ
নষ্টের আশংকায় অনেকে ছালাত পরিত্যাগ করে। এসব সাজসজ্জা নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি। তবে
স্বাভাবিক সাজসজ্জা দূষণীয় নয়। আবার বিবাহে বরকে স্বর্ণের আংটি, চেইন
উপহার দেওয়া হয়। অথচ পুরুষের জন্য স্বর্ণ ব্যবহার করা হারাম।–( নাসাঈ হা/৪০৫৭; আবু
দাঊদ হা/৪০৪৯; ইবনু মাজাহ হা/৩৫৯৫, সনদ ছহীহ)
এতদ্ব্যতীত নেইল পালিশ ব্যবহার, কপালে
টিপ দেওয়া, নখ বড় রাখা ইত্যাদি সবই
বিধর্মীদের আচরণ। এগুলি থেকে বিরত থাকতে হবে। রাসূল (স.) বলেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে
ব্যক্তি কোন জাতির অনুকরণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে’।–( আহমাদ, আবুদাউদ হা/৪০৩১, মিশকাত
হা/৪৩৪৭)
এতদ্ব্যতীত
আজকাল মহিলারা তাদের চোখের ভুরু উঠায়,
মাথায়
কৃত্রিম চুল লাগায় ও দাঁত সরু করে,
যা
শরী‘আত সম্মত নয়।
(ঝ) অপচয়
ও অপব্যয় করা : অপচয়-অপব্যয় ইসলাম সমর্থন
করে না। কিন্তু আজকাল অধিকাংশ বিবাহে অপচয় হ’তে দেখা যায়। যেমন বিবাহের দাওয়াতের জন্য দামী কার্ড
ছাপানো, শুধু বিবাহে ব্যবহারের জন্য বাহারী মূল্যবান পোষাক ক্রয় করা, পটকা-আতশবাজি
ফুটানো, বর-কনের বাড়ীতে বিবাহের আগে-পরে আলোকসজ্জা করা, রঙ
ছিটাছিটি, অপরিমিত খাদ্য-খাবারের
ব্যবস্থা করা, যার অধিকাংশই নষ্ট হয়
ইত্যাদি। অনেকে ঋণ করেও এসব করে থাকে। ইসলামে এসব অপচয় হারাম। আল্লাহ বলেন,وَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا وَلاَ تُسْرِفُوْا إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ
الْمُسْرِفِيْنَ- ‘আর তোমরা খাও ও পান কর, অপচয়
কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীকে পসন্দ করেন না’ (আ‘রাফ ৭/৩১)। পবিত্র কুরআনে অপচয়কারী শয়তানের ভাই বলে অভিহিত
করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الْمُبَذِّرِيْنَ
كَانُوْا إِخْوَانَ الشَّيَاطِيْنِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُوْرا-ً ‘নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান
স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ’। (বনী ইসরাঈল ১৭/২৭)
(ঞ)
আড়ম্বর পরিহার করা : বর্তমানে বিবাহ উপলক্ষে
বর-কনে উভয় পক্ষ প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিভিন্ন খরচ করে থাকে। স্ব স্ব মর্যাদা রক্ষা
করতে গিয়ে তারা এসব অনর্থক খরচ করে। উভয়পক্ষ নিজেদের বংশ গৌরব ও আভিজাত্য রক্ষা
করতে গিয়ে বিবাহ অনুষ্ঠানকে আড়ম্বরপূর্ণ করে তোলে। এটা এক দিকে লৌকিকতা ও অপরদিকে
তাক্বওয়া পরিপন্থী। বিবাহ যে একটি ইবাদত,
আড়ম্বর
ও অন্যান্য অনর্থক কর্মকান্ডের কারণে এই মূল বিষয়টি গৌন হয়ে যায়। তাই এসব পরিহার
করে মুসলমানদের বিবাহ অনুষ্ঠান শরী‘আত সম্মত পন্থায় সম্পন্ন
হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্যথা এসব বিবাহে আল্লাহর রহমত ও বরকত থাকে না। রাসূল (স.) বলেন, خَيْرُ النِّكَاحِ أَيْسَرُهُ ‘উত্তম
বিবাহ হচ্ছে যা সহজে সম্পন্ন হয়’।–(আবু দাউদ হা/২১১৭; ছহীহাহ হা/১৮৪২; ছহীহুল
জামে‘ হা/৩৩০০)
(ট) ফটো
সেশন ও ভিডিও রেকর্ডিং : আজকাল আমাদের সমাজে
বর্তমানে অধিকাংশ বিবাহ অনুষ্ঠানে স্থির ক্যামেরা ও ভিডিও ক্যামেরার মাধ্যমে
বর-কনে ও অন্যান্য অতিথিদের ছবি ধারণ করা হয়,
পরবর্তীতে
এসব অন্যকে দেখানোর জন্য কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। তাদের কাছে এসব স্মৃতি ও
ইতিহাসের সাক্ষী। ছবি উঠানোর জন্য ক্যামেরাম্যানের সর্বত্র অবাধ যাতায়াতের সুযোগ
থাকে।
তার
জন্য সাত খুন মাফ। আবার ছবি তোলার জন্য নারী-পুরুষ একত্রে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছবির
জন্য পোজ দেয়। নানা ভঙ্গিমায় নারীরা ছবি তোলে। অপরদিকে ভিডিও করা হয় গায়ে হলুদ
অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সবকিছু। এসব অনর্থক ও বিধর্মীদের অনুকরণ বৈ কিছুই নয়।
(ঠ)
অমুসলিমদের প্রথার অনুসরণ : বিবাহের অনুষ্ঠানে বাঁশের
কুলায় চন্দন, মেহেদি, হলুদ, কিছু
ধান-দূর্বা ঘাস, কিছু কলা, সিঁদুর
ও মাটির চাটি নিয়ে মাটির চাটিতে তৈল দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়। তারপর বর-কনের কপালে
তিনবার হলুদ মাখায়। এমনকি মূর্তিপূজার ন্যায় কুলাতে রাখা আগুন জ্বালানো, বর-কনের
মুখে আগুনের ধোঁয়া ও কুলা হেলিয়ে-দুলিয়ে বাতাস দেওয়া হয়। কোন কোন এলাকায় বর-কনেকে
গোসল করাতে নিয়ে যাওয়ার সময় মাথার উপরে বড় চাদরের চারকোণা চারজন ধরে নিয়ে যায়।
বিবাহ করতে যাওয়ার সময় বরকে পিঁড়িতে বসিয়ে বা সিল-পাটায় দাঁড় করিয়ে দুধ-ভাত
খাওয়ানো হয়। সম্মানের নামে বর-কনে মুরববীদের কদমবুসি করে। এছাড়া বিবাহের পর বর
দাঁড়িয়ে সবাইকে সালাম করে। এসব প্রথা ইসলামে নেই।
(ঠ)
বিবাহের বয়স নির্ধারণ : আমাদের দেশে পুরুষ-নারীর
বিবাহের জন্য বয়স নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এ বয়সের পূর্বে কেউ বিবাহ করতে পারবে
না, করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ আইন শরী‘আত
বিরোধী। ইসলাম প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক,
সক্ষম
ও সামর্থ্যবান নারী-পুরুষকে তাদের চারিত্রিক নিষ্কলুষতা বজায় রাখার জন্য বিবাহের
নির্দেশ দিয়েছে।–(বুখারী/৫০৬৫, মুসলিম/১৪০০, মিশকাত/৩০৮০
‘নিকাহ’ অধ্যায়, বুলূগুল
মারাম হা/৯৬৮।
এছাড়া নবী করীম (স.) যখন আয়েশা (রাঃ)-কে
বিবাহ করেন তখন তার বয়স ছিল ৬ বছর এবং তার সাথে যখন বাসর যাপন করেন তখন তার বয়স
হয়েছিল ৯ বছর। আর তিনি ৯ বছর নবী করীম (স.)-এর সঙ্গে জীবন কাটান।–(বুখারী হা/৫১৫৮ ‘বিবাহ’ অধ্যায়)
[চলবে-------]
২. বিবাহ
পরবর্তী কর্তব্য :
বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর কিছু করণীয় রয়েছে।
যার কিছু অন্য মানুষের জন্য এবং কিছু স্বামী-স্ত্রীর জন্য। এগুলি নিম্নে আলোচনা
করা হ’ল।-
ক. বিবাহ
শেষে দো‘আ পাঠ :
বিবাহ সুসম্পন্ন হওয়ার পর উপস্থিত সকলে
বর-কনের কল্যাণের জন্য এই দো‘আ পাঠ করবে- بَارَكَ اللهُ لَكَ وَبَارَكَ
عَلَيْكَ وَجَمَعَ بَيْنَكُمَا فِىْ خَيْرٍ ‘আল্লাহ
তোমার জন্য বরকত দিন, তোমার প্রতি বরকত নাযিল
করুন এবং তোমাদের উভয়কে কল্যাণে মিলিত করুন’।–(আবুদাউদ হা/২১৩০; তিরমিযী
হা/১০৯১; ইবনু মাজাহ হা/১৯০৫, মিশকাত হা/২৩৩২)
খ. বাসর
ঘর ও কনে সাজানো :
বিয়ের পর বর-কনেকে একত্রে থাকার জন্য বাসর
ঘরের ব্যবস্থা করা ও কনেকে সাজিয়ে সুন্দর করে বরের সামনে উপস্থিত করা সুন্নাত।–(বুখারী, ইবনু মাজাহ হা/১৮৭৬; ইরওয়া হা/১৮৩১)
উম্মু
সুলাইম (রাঃ) ছাফিয়া (রাঃ)-কে রাসূলের জন্য সাজিয়ে দেন।–(বুখারী হা/৩৭১; মুসলিম হা/১৩৬৫; নাসাঈ
হা/৩৩৮০)
আয়েশা
(রাঃ) বলেন, নবী করীম (স.) যখন আমাকে
বিবাহ করেন, তখন আমার বয়স ছিল ছয় বছর।
তারপর আমরা মদীনায় এলাম এবং বনু হারিছ গোত্রে অবস্থান করলাম। সেখানে আমি জ্বরে
আক্রান্ত হ’লাম। এতে আমার চুল পড়ে গেল। পরে যখন আমার মাথার সামনের চুল জমে উঠল, সে
সময় আমি একদিন আমার বান্ধবীদের সাথে দোলনায় খেলা করছিলাম। তখন আমার মাতা উম্মে
রূমান আমাকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকলেন। আমি তাঁর কাছে এলাম। আমি তার উদ্দেশ্য বুঝতে
পারিনি। তিনি আমার হাত ধরে ঘরের দরজায় এসে আমাকে দাঁড় করালেন। তখন আমি হাঁপাচ্ছিলাম। শেষে আমার
শ্বাস-প্রশ্বাস কিছুটা স্বাভাবিক হ’ল। এরপর তিনি কিছু পানি
নিলেন এবং তা দিয়ে আমার মুখমন্ডল ও মাথা মাসেহ করে দিলেন। তারপর আমাকে ঘরের ভিতর
প্রবেশ করালেন। সেখানে কয়েকজন আনছার মহিলা ছিলেন। তাঁরা বললেন, কল্যাণময়, বরকতময়
এবং সৌভাগ্যমন্ডিত হোক। আমাকে তাদের কাছে দিয়ে দিলেন। তাঁরা আমার অবস্থান ঠিক করে
দিলেন, তখন ছিল দ্বিপ্রহরের পূর্ব মুহূর্ত। হঠাৎ রাসূলুল্লাহ্ (স.)-কে
দেখে আমি হকচকিয়ে গেলাম। তাঁরা আমাকে তাঁর কাছে তুলে দিলেন। সে সময় আমি ছিলাম নয়
বছরের বালিকা।–(বুখারী
হা/৩৮৯৪, ৩৮৯৬; মুসলিম হা/১৪২২; নাসাঈ
হা/৩২৫৫-৫৮; আবূদাউদ হা/২১২১, ৪৯৩৩, ৪৯৩৫; ইরওয়া হা/১৮৩১)
গ. বিবাহের ঘোষণা দেওয়া :
বিবাহ হচ্ছে একটি প্রকাশ্য সামাজিক অনুষ্ঠান।
তাই বিয়ের অনুষ্ঠান সকলকে জানিয়ে দেওয়া উচিত। রাসূল (স.) বলেছেন, ‘তোমরা বিবাহের অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রচার কর’।–(ইবনু হিববান, ত্বাবারানী, ইরওয়া হা/১৯৯৩)
এজন্য
বিবাহের সময় ইসলামে দফ বা একমুখা ঢোল বাজানোকে জায়েয বলা হয়েছে। রুবাই বিনত
মুআবিবয ইবনু আফরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার
বাসর রাতের পরের দিন নবী করীম (স.) এলেন এবং আমার বিছানার ওপর বসলেন, যেমন
বর্তমানে তুমি আমার বিছানার ওপর বসে আছ। সে সময় আমাদের ছোট মেয়েরা দফ বাজাচ্ছিল
এবং বদরের যুদ্ধে শাহাদাতপ্রাপ্ত আমাদের বাপ-চাচাদের শোকগাঁথা গাচ্ছিল’।–(বুখারী হা/৫১৪৭ ‘বিয়ে
ও ওয়ালীমায় দফ বাজানো’ অনুচ্ছেদ)
ঘ. বাসর
রাতে স্ত্রীর সাথে সদয় ব্যবহার করা :
বাসর রাতে নববধূর নিকটে প্রবেশ করে তার সাথে
সদয় ও সম্প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। আসমা বিনতু ইয়াযীদ বিন সাকান বলেন, আমি
রাসূলুল্লাহ (স.)-এর জন্য আয়েশাকে তেল মাখিয়ে দিলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (স.)-এর
নিকটে আসলাম। তারপর তাকে খোলা অবস্থায় দেখার জন্য আহবান করলাম। তিনি এসে আয়েশার
পাশে বসলেন। তারপর দুধের একটি বাটি নিয়ে আসা হ’ল। তিনি পান করে আয়েশার
দিকে দিলেন। কিন্তু আয়েশা লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করলেন। আসমা বলেন, আমি
তাকে ধমকের সুরে বললাম, তুমি নবী করীম (স.)-এর হাত
থেকে গ্রহণ কর। আসমা বললেন, সে নিয়ে কিছুটা পান করল।
তখন নবী করীম (স.) তাকে বললেন, আমি কি তোমার বান্ধবীকে
দিব? আসমা বললেন,
আমি
বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (স.)! বরং তা আপনি নিন এবং পান করে আপনার
হাত থেকে আমাকে দিন। তিনি নিয়ে পান করে আমাকে দিলেন। তিনি বলেন, আমি
বসে পাত্রটি আমার জানুর উপরে রাখলাম। এরপর আমি পাত্রটি ঘুরাতে লাগলাম ও ঠোট দ্বারা
স্পর্শ করতে লাগলাম যেন নবী করীম (স.)-এর পান করার স্পর্শ পাই। অতঃপর নবী করীম (স.)
আমার সাথে উপস্থিত মহিলাদের লক্ষ্য করে বললেন,
তাদেরকে
দাও। তারা বললেন, আমরা তা (পান করার) ইচ্ছা
করি না। তখন নবী করীম (স.) বললেন, ‘তারা ক্ষুধা ও মিথ্যা জমা
করে না’।–(মুসনাদ আহমাদ
হা/২৭৬৩২; আদাবুয যিফাফ, পৃঃ ১৯)
ঙ.
স্ত্রীর মাথার অগ্রভাগে হাত রেখে দো‘আ করা :
বাসর রাতে বা তার পূর্বে স্বামী স্ত্রীর
মাথার সম্মুখভাগে হাত রেখে বরকতের দো‘আ করবে। নবী করীম (স.)
বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কোন মহিলাকে বিবাহ করবে অথবা চাকর ক্রয়
করবে, সে যেন তার কপালে হাত রেখে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ে
অতঃপর বলে,اَللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ
خَيْرَهَا وَخَيْرَ مَا جَبَلْتَهَا عَلَيْهِ وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا
وَشَرِّ مَا جَبَلْتَهَا عَلَيْهِ ‘হে
আল্লাহ! আমি আপনার নিকট তার মঙ্গল ও যে মঙ্গলের উপর তাকে সৃষ্টি করেছেন তা
প্রার্থনা করছি। আর তার অমঙ্গল ও যে অমঙ্গলের উপর তাকে সৃষ্টি করেছেন তা থেকে
আশ্রয় চাচ্ছি’।–(
আবুদাউদ হা/২১৬০; ইবনু মাজাহ হা/২২৫২; মিশকাত হা/২৪৪৬, সনদ
হাসান)
চ.
স্বামী-স্ত্রী একত্রে ছালাত আদায় করা :
বাসর রাতে স্বামী স্বীয় নববধূকে নিয়ে দু’রাক‘আত
ছালাত আদায় করবে। এটা মুস্তাহাব। শাকীক (রাঃ) বলেন, আবু
হারীয নামক এক ব্যক্তি এসে বলল, আমি একজন যুবতী কুমারী
মহিলাকে বিবাহ করেছি। আর আমি ভয় করছি যে,
সে
আমাকে অসন্তুষ্ট করবে। তারপর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ বলেন, নিশ্চয়ই
বন্ধুত্ব-ভালবাসা আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং রাগ-অসন্তুষ্টি শয়তানের পক্ষ থেকে। শয়তান
ইচ্ছা করছে যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য যা
বৈধ করেছেন তাতে সে তোমাদের নিকট ঘৃণা সৃষ্টি করবে। সুতরাং সে (তোমার স্ত্রী) যখন
তোমার কাছে আসবে তখন তাকে জামা‘আত সহকারে তোমার পিছনে দু’রাক‘আত
ছালাত পড়তে নির্দেশ দিবে।–( মুছান্নাফ
ইবনু আবী শায়বাহ; আলবানী, আদাবুয যিফাফ, মাসআলা
নং ৩)
আব্দুল্লাহ
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, স্ত্রী স্বামীর কাছে গেলে
স্বামী দাঁড়িয়ে যাবে এবং স্ত্রী তার পিছনে দাঁড়াবে। অতঃপর তারা একসঙ্গে দুই রাক‘আত
ছালাত আদায় করবে এবং বলবে, اَللّهُمَّ بَارِكْ لِىْ فِىْ
أَهْلِىْ وَبَارِكْ لَهُمْ فِىَّ، اَللّهُمَّ اجْمَعْ بَيْنَنَا مَا جَمَعْتَ
بِخَيْرٍ و فَرِّقْ بَيْنَنَا إِذَا فَرَّقْتَ إِلَى خَيْرٍ- ‘হে আল্লাহ! আপনি আমার জন্য আমার পরিবারে বরকত দিন এবং আমার
ভিতরেও বরকত দিন পরিবারের জন্য। হে আল্লাহ! আপনি তাদের
থেকে আমাকে রিযিক দিন আর আমার থেকে তাদেরকেও রিযিক দিন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের যতদিন একত্রে রাখেন
কল্যাণেই একত্রে রাখুন। আর আমাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিলে কল্যাণের পথেই বিচ্ছেদ
ঘটান’।–( তাবারানী, মু‘জামুল
কাবীর, হা/৮৯০০; মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/৭৫৪৭; সিলসিলাতুল আছার আছ-ছহীহাহ হা/৩৬১; আদাবুয যিফাফ, পৃঃ
২৪)
ছ. সহবাস সম্পর্কিত কিছু করণীয় :
সহবাসকালে কিছু করণীয় রয়েছে, যা
পালন করা প্রত্যেক নারী-পুরুষের জন্য কর্তব্য।
(১) সহবাসকালে দো‘আ পাঠ করা : সহবাসের সময় রাসূল (স.) নিম্নোক্ত দো‘আ
পাঠ করতে বলেছেন,بِسْمِ اللهِ اللَّهُمَّ
جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَجَنِّبِ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا- উচ্চারণ : ‘বিসমিল্লা-হি
আল্লা-হুম্মা জান্নিবনাশ শায়তা-না ও জান্নিবিশ শায়তানা মা রাযাকতানা’।
অর্থ:
‘আল্লাহর নামে শুরু করছি। হে আল্লাহ! আমাদেরকে শয়তানের
প্রভাব থেকে দূরে রাখুন এবং আমাদের যে সন্তান দান করবেন তাদেরকে শয়তানের প্রভাব
থেকে বাঁচিয়ে রাখুন’।–(
বুখারী হা/১৪১, ৩২৭১, ৫১৬৫; মুসলিম
হা/১৪৩৪; আহমাদ হা/১৯০৮, বুলূগুল মারাম হা/১০২০)
এ দো‘আ পাঠ করার পরে সহবাস করলে
আল্লাহ যদি ঐ স্বামী-স্ত্রীকে কোন সন্তান দান করেন, তাহ’লে
শয়তান সন্তানের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।–( বুখারী হা/১৪১, ৩২৭১; মুসলিম
হা/১৪৩৪; মিশকাত
হা/২৪১৬)
সহবাসের
ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীর সম্মুখভাগে যে দিক দিয়ে ইচ্ছা সহবাস করতে পারে। আল্লাহ
বলেন,نِسَاؤُكُمْ حَرْثٌ لَكُمْ فَأْتُوْا حَرْثَكُمْ
أَنَّى شِئْتُمْ ‘তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের
জন্য শস্যক্ষেত স্বরূপ। অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা আগমন কর’। (সূরা বাক্বারাহ-২/২২৩)
উম্মু সালামা (রাঃ) বলেন, মুহাজিরগণ
মদীনায় এসে আনছার মহিলাদের বিবাহ করলেন। মুহাজির মহিলারা চিৎ হয়ে শয়ন করত। কিন্তু
আনছার মহিলারা চিৎ হয়ে শয়ন করত না। একদা এক মুহাজির ব্যক্তি তার আনছার স্ত্রীকে
এরূপ করার ইচ্ছা করলে সে রাসূল (স.)-কে জিজ্ঞেস না করে তা করতে অস্বীকৃতি জানাল।
উম্মু সালামা (রাঃ) বলেন, সে মহিলা রাসূল (স.)-এর
নিকট আসল, কিন্তু তাঁকে জিজ্ঞেস করতে
লজ্জাবোধ করল। তাই উম্মু সালামা (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন। অতঃপরنِسَاؤُكُمْ حَرْثٌ لَكُمْ
فَأْتُوْا حَرْثَكُمْ أَنَّى شِئْتُمْ ‘তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের
জন্য শস্যক্ষেত স্বরূপ। অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা আগমন কর’। (সূরা বাক্বারাহ-২/২২৩) আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। রাসূল (স.) বললেন, না, শুধুমাত্র
একই রাস্তায় সহবাস করা যাবে’।–( আহমাদ, ইরওয়া
৭/৬১; আদাবুয যিফাফ পৃঃ
৩০)
অন্যত্র
রাসূল (স.) বলেন,ائْتِهَا مُقْبِلَةً، وَمُدْبِرَةً
إِذَا كَانَ ذَلِكَ فِي الْفَرْجِ- ‘তার নিকটে আস, সম্মুখ
ও পিছন উভয় দিক দিয়ে, যদি তা লজ্জাস্থান হয়’।–( ত্বাবারাণী, কাবীর, ইরওয়া
৭/৬২; আদাবুয যিফাফ, পৃঃ ২৭)
তিনি
আরো বলেন,أَقْبِلْ وَأَدْبِرْ وَاتَّقِ
الدُّبُرَ وَالْحِيْضَةَ. ‘সামনে কর, পিছনে
কর এবং পায়ুপথ ও ঋতুস্রাব থেকে বেঁচে থাক’।–( তিরমিযী হা/২৯৮০; মিশকাত হা/৩১৯১, সনদ
হাসান)
(২) নিষিদ্ধ স্থানে সহবাস না করা : স্ত্রীর পায়ুপথে সহবাস করা নিষিদ্ধ। রাসূল (স.)
বলেন,لاَ يَنْظُرُ اللهُ إِلَى رَجُلٍ يَأْتِي امْرأَتَهُ
فِيْ دُبُرِهَا- ‘আল্লাহ ঐ ব্যক্তির দিকে
তাকাবেন না যে তার স্ত্রীর পায়ুপথে সহবাস করে’।–( ইবনু মাজাহ হা/৬৩৯; মিশকাত হা/৩৫৮৫; সিলসিলা
ছহীহাহ হা/৩৩৭৮ আলোচনা দ্রঃ; ছহীহুল
জামে‘ হা/৭৮০২)
তিনি
আরো বলেন,إِنَّ اللهَ لاَ يَسْتَحْيِى
مِنَ الْحَقِّ. ثَلاَثَ مَرَّاتٍ، لاَ تَأْتُوا النِّسَاءَ فِى أَدْبَارِهِنَّ. ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ হকের ব্যাপারে লজ্জাবোধ করেন
না। কথাটি তিনি তিনবার বলেছেন। তোমরা মহিলাদের পায়ুপথে সহবাস কর না’।–( ইবনু মাজাহ হা/১৯২৪; মিশকাত হা/৩১৯২; ছহীহাহ
হা/৩৩৭৭)
মহিলাদের পায়ুপথ ব্যবহার করাকে হারাম করা
হয়েছে। রাসূল (স.) বলেন, إِتْيَانُ النِّسَاءِ فِىْ
أَدْبَارِهِنَّ حَرَامٌ ‘নারীদের পিছন দিয়ে সহবাস
করা হরাম’।–( নাসাঈ, সুনানুল
কুবরা, ছহীহাহ হা/৮৭৩; ছহীহুল জামে‘ হা/১২৬)
অন্যত্র
তিনি বলেন,إنَّ اللهَ يَنْهَاكُمْ أَنْ
تَأْتُوا النِّسَاءَ فِيْ أَدْبَارِهِنَّ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন তোমাদের স্ত্রীদের
পায়ুপথ ব্যবহার করতে’।–( ছহীহুল জামে‘ হা/১৯২১)
(৩) নিষিদ্ধ সময়ে সহবাস না করা : ঋতু অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সহবাস করা হারাম।
আল্লাহ বলেন,وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ
الْمَحِيْضِ قُلْ هُوَ أَذًى فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيْضِ وَلاَ
تَقْرَبُوْهُنَّ حَتَّى يَطْهُرْنَ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوْهُنَّ مِنْ حَيْثُ
أَمَرَكُمُ اللهُ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ التَّوَّابِيْنَ وَيُحِبُّ
الْمُتَطَهِّرِيْنَ- ‘আর লোকেরা তোমাকে প্রশ্ন
করছে মহিলাদের ঋতুস্রাব সম্পর্কে। তুমি বল,
ওটা
হ’ল কষ্টদায়ক বস্ত্ত। অতএব ঋতুকালে স্ত্রীসঙ্গ হ’তে
বিরত থাক। পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হয়ো না। অতঃপর যখন তারা ভালভাবে
পবিত্র হবে, তখন আল্লাহর নির্দেশ মতে
তোমরা তাদের নিকট গমন কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীদের ভালবাসেন ও পবিত্রতা
অর্জনকারীদের ভালবাসেন’। (সূরা বাক্বারাহ-২/২২২)
রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন,مَنْ أَتَى حَائِضًا أَوِ امْرَأَةً فِىْ دُبُرِهَا أَوْ كَاهِنًا
فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُوْلُ فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ- ‘যে ব্যক্তি কোন ঋতুবতী স্ত্রীর সাথে কিংবা
তার পায়ুপথে সঙ্গম করে অথবা গণকের কাছে যায় এবং তার কথা বিশ্বাস করে, সে
মুহাম্মাদ (স.)-এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অস্বীকার করল’।–( ইবনু মাজাহ হা/৬৩৯; তিরমিযী হা/১৩৫; মিশকাত
হা/৫৫১, হাদীছ ছহীহ)
উল্লেখ্য, ঋতুবতী
স্ত্রীর সাথে সহবাস ব্যতীত সবকিছু বৈধ। রাসূল (স.) বলেন,جَامِعُوْهُنَّ فِى الْبُيُوْتِ وَاصْنَعُوْا كُلَّ شَىْءٍ غَيْرَ
النِّكَاحِ- ‘তোমরা তাদের সাথে (তাদের
হায়েয অবস্থায়) একই ঘরে অবস্থান ও অন্যান্য কাজ করতে পার শুধু সহবাস ছাড়া’।– (আবুদাউদ হা/২৫৮, ২১৬৫, সনদ ছহীহ)
আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমাদের
কেউ হায়েয অবস্থায় থাকলে আল্লাহর রাসূল (স.) তার সাথে মিশামিশি করতে চাইলে তাকে
হায়েযে শক্তভাবে ইযার পরার নির্দেশ দিতেন। তারপর তার সাথে মিশামিশি করতেন’।–( বুখারী হা/৩০২; মুসলিম হা/২৯৩)
অন্য
বর্ণনায় আছে,أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله
عليه وسلم كَانَ إِذَا أَرَادَ مِنَ الْحَائِضِ شَيْئًا أَلْقَى عَلَى فَرْجِهَا
ثَوْبًا. ‘নবী করীম (স.) তাঁর ঋতুবতী
স্ত্রীর সাথে কিছু করতে চাইলে স্ত্রীর লজ্জাস্থানের উপর কাপড় রেখে তারপর করতেন’।–( আবুদাউদ হা/২৭২; ছহীহুল
জামে‘ হা/৪৬৬৩)
স্ত্রী
হায়েয থেকে পবিত্র হ’লে তার সাথে সহবাস করা বৈধ। আল্লাহ বলেন,فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوْهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللهُ
إِنَّ اللهَ يُحِبُّ التَّوَّابِيْنَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِيْنَ- ‘অতঃপর যখন তারা ভালভাবে পবিত্র হবে, তখন
আল্লাহর নির্দেশ মতে তোমরা তাদের নিকট গমন কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীদের ভালবাসেন
ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’। (সূরা বাক্বারাহ-২/২২২)
ঋতুকালে স্ত্রীর সাথে সহবাস করলে কাফফারা
দিতে হবে। নবী করীম (স.) এমন ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন,الَّذِيْ يَأْتِيْ امْرَأَتَهُ وَهِىَ حَائِضٌ قَالَ يَتَصَدَّقُ
بِدِيْنَارٍ أَوْ نِصْفِ دِيْنَارٍ- ‘যে ব্যক্তি ঋতুবতী স্ত্রীর
সাথে সহবাস করে, সে যেন এক অথবা অর্ধ দীনার
ছাদাকা করে’।–( আবুদাঊদ হা/২৬৪; মুসনাদে
আহমাদ হা/২১২১; সনদ ছহীহ)
উল্লেখ্য যে, ১
ভরি সমান ১১.৬৬ গ্রাম। হাদীছে বর্ণিত এক দীনার সমান ৪.২৫ গ্রাম স্বর্ণ। আর অর্ধ
দীনার সমান ২.১২৫ গ্রাম স্বর্ণ।
(৪)
সহবাসের পর ওযূ করা :
সহবাসের পরে ঘুমাতে ও পানাহার করতে চাইলে
কিংবা পুনরায় মিলিত হ’তে চাইলে মাঝে ওযূ করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ
(স.) বলেন,ثَلاَثَةٌ لاَ تَقْرَبُهُمُ
الْمَلاَئِكَةُ جِيْفَةُ الْكَافِرِ وَالْمُتَضَمِّخُ بِالْخَلُوْقِ وَالْجُنُبُ
إِلاَّ أَنْ يَتَوَضَّأ-َ ‘তিন ব্যক্তির কাছে ফেরেশতা
আসে না; কাফের ব্যক্তির লাশ,
জাফরান
ব্যবহারকারী এবং অপবিত্র ব্যক্তি যতক্ষণ না সে ওযূ করে’।–( আবুদাউদ হা/৪১৮০; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৭৩, সনদ হাসান)
আয়েশা (রাঃ) বলেন, كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا أَرَادَ أَنْ يَنَامَ
وَهْوَ جُنُبٌ، غَسَلَ فَرْجَهُ، وَتَوَضَّأَ لِلصَّلاَةِ. ‘নবী করীম (স.) যখন অপবিত্র অবস্থায় ঘুমাতে ইচ্ছা করতেন তখন
তিনি লজ্জাস্থান ধুয়ে ছালাতের ওযূর ন্যায় ওযূ করতেন’।–( বুখারী হা/২৮৮)
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর বলেন, ওমর
ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) আল্লাহর রাসূল (স.)-কে বললেন, যদি
রাতে কোন সময় তাঁর গোসল ফরয হয় (তখন কী করতে হবে?) রাসূলুল্লাহ (স.) তাঁকে বললেন, ওযূ
করবে, লজ্জাস্থান ধুয়ে নিবে তারপর ঘুমাবে।–( বুখারী হা/২৯০; মুসলিম হা/৩০৬; মিশকাত
হা/৪৫২)
অন্যত্র
তিনি বলেন,نَعَمْ لِيَتَوَضَّأْ ثُمَّ
لْيَنَمْ حَتَّى يَغْتَسِلَ إِذَا شَاءَ ‘হ্যাঁ
সে যেন ওযূ করে। অতঃপর সে যেন ঘুমায় এবং যখন চাইবে গোসল করবে’।–( মুসলিম হা/৩০৬; আদাবুয যিফাফ, পৃঃ
৪২।
তিনি আরো বলেন, نَعَمْ وَيَتَوَضَّأُ إِنْ شَاءَ ‘হ্যাঁ, যদি
সে চায় ওযূ করবে’।–( ইবনু হিববান হা/১২১৬; আদাবুয যিফাফ, পৃঃ
৪২। উপরোক্ত হাদীছ সমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, সহবাসের
পরে ওযূ করা আবশ্যিক নয় বরং সুন্নাত। যেমন আয়েশা (রাঃ) বলেন,كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَنَامُ وَهُوَ جُنُبٌ
مِنْ غَيْرِ أَنْ يَمَسَّ مَاءً. ‘রাসূলুল্লাহ কোনরূপ পানি
স্পর্শ না করেই নাপাক অবস্থায় ঘুমাতেন’।–( আবূদাঊদ হা/২৮৮; তিরমিযী হা/১১৮ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়; ইবনু
মাজাহ হা/৫৮৪ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, সনদ
ছহীহ)
উল্লেখ্য,
ওযূর
পরিবর্তে তায়াম্মুম করাও যায়। আয়েশা (রাঃ) বলেন,كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا أَجْنَبَ فَأَرَادَ
أَنْ يَنَامَ تَوَضَّأَ أو تَيَمَّمَ- ‘রাসূলুল্লাহ (স.) যখন
অপবিত্র হ’তেন এবং ঘুমানোর ইচ্ছা করতেন তখন ওযূ করতেন
বা তায়াম্মুম করতেন’।–( বায়হাক্বী, আস-সুনানুল
কুবরা, হা/৯৬৮; আদাবুয যিফাফ, পৃঃ
৪৫)
(৫) ঘুমের
পূর্বে অপবিত্রতার গোসল করা উত্তম :
নিম্নোক্ত হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, জানাবাতের
পরে গোসল করা উত্তম। আব্দুল্লাহ বিন কায়েস বলেন, আমি
আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, নবী করীম (স.) অপবিত্র
অবস্থায় কিরূপ করতেন? তিনি কি ঘুমের পূর্বে গোসল
করতেন, না গোসলের পূর্বে ঘুমাতেন? আয়েশা
(রাঃ) বলেন,كُلُّ ذَلِكَ قَدْ كَانَ
يَفْعَلُ رُبَّمَا اغْتَسَلَ فَنَامَ وَرُبَّمَا تَوَضَّأَ فَنَامَ. قُلْتُ
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى جَعَلَ فِى الأَمْرِ سَعَةً. ‘তিনি উভয়টি করতেন। কখনো গোসল করে ঘুমাতেন, আবার
কখনো ওযূ করে ঘুমাতেন। আমি বললাম, সমস্ত প্রশংসা একমাত্র
আল্লাহর যিনি কর্মে প্রশস্ততা দান করেছেন’।–(মুসলিম হা/৩০৭, ‘অপবিত্র
ব্যক্তির ঘুমানো জায়েয’ অনুচ্ছেদ; আবুদাউদ হা/১২৯১; তিরমিযী
হা/৪৪৯)
অন্য হাদীছে এসেছে,أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ طَافَ ذَاتَ
يَوْمٍ عَلَى نِسَائِهِ يَغْتَسِلُ عِنْدَ هَذِهِ وَعِنْدَ هَذِهِ فَقُلْتُ: يَا
رَسُولَ اللهِ أَلاَ تَجْعَلُهُ غُسْلاً وَاحِدًا؟ قَالَ: هَذَا أَزْكَى
وَأَطْهَرُ وَأَطْيَبُ.‘একদা নবী করীম (স.) তাঁর
স্ত্রীদের সাথে সহবাস করলেন। তিনি এর কাছে গোসল করলেন এবং ওর কাছেও গোসল করলেন।
রাবী বলেন, আমি তাঁকে বললাম, হে
আল্লাহর রাসূল! আপনি কি তাকে একটি গোসলে পরিণত করতে পারলেন না? তিনি
বললেন, এটা অধিকতর পরিচ্ছন্ন,
অতি
উত্তম ও সর্বাধিক পবিত্রতা’।–( আবূদাঊদ হা/২১৯; মিশকাত হা/৪৭০, সনদ
হাসান)
(৬) স্বামী-স্ত্রী এক সাথে
গোসল করা : স্বামী-স্ত্রীর একস্থানে
একত্রে গোসল করা বৈধ। আয়েশা (রাঃ) বলেন,كُنْتُ أَغْتَسِلُ أَنَا
وَرَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مِنْ إِنَاءٍ بَيْنِىْ وَبَيْنَهُ وَاحِدٍ
فَيُبَادِرُنِىْ حَتَّى أَقُولَ دَعْ لِىْ دَعْ لِىْ. قَالَتْ وَهُمَا جُنُبَانِ. ‘আমি ও আল্লাহর রাসূল (স.) উভয়েই একই পাত্র
থেকে গোসল করতে ছিলাম। এমনকি আমি বলতাম আমার জন্য রাখেন, আমার
জন্য রাখেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, উভয় অপবিত্র অবস্থায় ছিলেন’।–( মুসলিম হা/৩২১; মিশকাত হা/৪৪০)
বাসর
পরবর্তী সকালে করণীয় :
ওয়ালীমা
করা :
বাসর পরবর্তী সকালে বরের অন্যতম কর্তব্য হ’ল
ওয়ালীমা করা। এটা সুন্নাত। আলী (রাঃ) যখন ফাতিমা (রাঃ)-কে বিবাহের পয়গাম পাঠালেন, তখন
রাসূলুল্লাহ (স.) বললেন, ‘অবশ্যই নববধূর জন্য
ওয়ালীমা হ’তে হবে’।–( আহমাদ; আদাবুয যিফাফ, মাসআলা
নং ২৪) ওয়ালীমার মাধ্যমে বিবাহের
কথা সকলের মাঝে প্রচার হয়। আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন,مَا أَوْلَمَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم عَلَى شَىْءٍ مِنْ
نِسَائِهِ، مَا أَوْلَمَ عَلَى زَيْنَبَ أَوْلَمَ بِشَاةٍ- ‘রাসূল (স.) স্বীয় স্ত্রী যয়নাবের বিবাহে যেভাবে ওয়ালীমা
করেছিলেন, এরূপ ওয়ালীমা তিনি পরবর্তী
কোন স্ত্রীর বিবাহে করেননি। তাতে তিনি একটি বকরী দিয়ে ওয়ালীমা করেছেন’।–( বুখারী হা/৫১৬৮, মুসলিম হা/২৫৬৯, মিশকাত
হা/৩২১১)
আনাস
(রাঃ) বলেন, রাসূল (স.) যেদিন যয়নাব
(রাঃ)-এর সাথে বাসর রাত উদযাপন করলেন,
সেদিন
ওয়ালীমার ব্যবস্থা করলেন এবং মুসলিমদেরকে তৃপ্তি সহকারে রুটি ও গোশত খাওয়ালেন।
অতঃপর তিনি তাঁর স্ত্রীদের কাছে গেলেন এবং তাদের প্রতি সালাম করে তাদের জন্য দো‘আ
করলেন। আর তারাও তাঁকে সালাম করলেন এবং তাঁর জন্য দো‘আ
করলেন। রাসূল (স.) তাঁর বাসর রাতের সকালে এরূপ করতেন’।–( বুখারী হা/৫১৫৪)
ওয়ালীমা কয় দিন করা যাবে :
বাসর পরিবর্তী তিন দিন ওয়ালীমা করা যায়। আনাস
(রাঃ) বলেন,تَزَوَّجَ النَّبِيُّ صَلَّى
اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَفِيَّةَ وَجَعَلَ عِتْقَهَا صَدَاقَهَا، وَجَعَلَ
الْوَلِيمَةَ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ، ‘নবী করীম (স.) ছাফিয়া (রাঃ)-কে বিবাহ করলেন
এবং তার মুক্তিপণ তার মোহর নির্ধারণ করলেন,
তিন
দিন ওয়ালীমা খাওয়ালেন’।–( মুসনাদ আবু ইয়া‘লা, আদাবুয যিফাফ, পৃঃ
৭৪।
ওয়ালীমা সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় : (১) সমাজে ওয়ালীমার নামে বড়
লোকদের মিলন মেলা বসে, যেখানে বরের বা অভিভাবকদের
লক্ষ্য থাকে উপহারের দিকে। ঐসব অনুষ্ঠান থেকে দরিদ্র লোকজন বঞ্চিত হয়। অথচ
ওয়ালীমার দাওয়াতে উপহার আদান-প্রদান রাসূলের সুন্নাত নয়, বরং
সুন্নাত হ’ল সৎ ব্যক্তিগণকে দাওয়াত দেওয়া। তারা দাওয়াত
গ্রহণ করে ওয়ালীমাতে আসবেন ও নবদম্পতির মঙ্গলের জন্য দো‘আ
করবেন। বেছে বেছে কেবল বড় লোকদের ওয়ালীমায় দাওয়াত দেওয়া হলে ঐ খাদ্যকে রাসূল (স.)
নিকৃষ্ট বলেন,شَرُّ الطَّعَامِ طَعَامُ
الْوَلِيْمَةِ يُدْعَى لَهَا الأَغْنِيَاءُ، وَيُتْرَكُ الْفُقَرَاءُ، وَمَنْ
تَرَكَ الدَّعْوَةَ فَقَدْ عَصَى اللهَ وَرَسُوْلَهُ- ‘খাদ্যের মধ্যে নিকৃষ্ট খাবার ঐ ওয়ালীমার খাবার যাতে শুধু
ধনীদেরকে দাওয়াত দেয়া হয় এবং দরিদ্রদেরকে ত্যাগ করা হয়। আর ওয়ালীমার দাওয়াত যে
কবুল করল না, সে আল্লাহ ও তার রাসূলের
বিরোধিতা করল’।–( বুখারী হা/৫১৭৭, মুসলিম
হা/১৪৩২)
(২)
ওয়ালীমার দাওয়াত দিলে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য দাওয়াত কবুল করা ওয়াজিব।
রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন,إِذَا دُعِىَ أَحَدُكُمْ إِلَى
الْوَلِيْمَةِ فَلْيَأْتِهَا- ‘তোমাদের কাউকে ওয়ালীমার দাওয়াত
করা হ’লে সে যেন তাতে অংশগ্রহণ করে’।–( বুখারী হা/৫১৭৩, মুসলিম
হা/১৪২৯)
(৩) ওয়ালীমা অনুষ্ঠান
বাস্তবায়নের জন্য লোকেরা সাহায্য করতে পারে। আনাস (রাঃ)
নবী
করীম
(স.)-এর
স্ত্রী
ছাফিয়া (রাঃ)-এর ঘটনা সম্পর্কে বলেন, যখন
রাসূল রাস্তায় ছিলেন উম্মে সুলাইম ছাফিয়াকে তাঁর জন্য প্রস্ত্তত করলেন অর্থাৎ
সাজালেন এবং তাঁকে রাতে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। নবী করীম (স.) বাসর ঘরেই সকাল
করলেন। এরপর তিনি বললেন, যার কাছে যে খাবার আছে সে
যেন তা নিয়ে আসে। অপর বর্ণনায় আছে,
যার
কাছে অতরিক্ত খাবার আছে সে যেন তা আমাদের নিকটে নিয়ে আসে। আনাস (রাঃ) বলেন, তিনি
একটি দস্তরখান বিছালেন। তখন কেউ পণির নিলে আসল,
কেউ
খেজুর নিয়ে আসল, আবার কেউ ঘি নিয়ে আসল। সব
দিয়ে তারা হাইস (খাদ্য বিশেষ) তৈরী করলেন। তারা (আমন্ত্রিত লোকেরা) হাইস খেতে
লাগলেন এবং তাদের পাশের বৃষ্টির পানি হাউজ থেকে পান করতে লাগলেন। আর এটাই ছিল
রাসূলুল্লাহ (স.)-এর ওয়ালীমা।–(বুখারী হা/৩৭১; মুসলিম
হা/১৩৬৫; নাসাঈ হা/৩৩৮০) এ হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ওয়ালীমা
অনুষ্ঠানের জন্য কেউ সহযোগিতা করতে পারে। তবে ওয়ালীমা অনুষ্ঠানে মানুষকে দাওয়াত
দিয়ে সেখানে আমন্ত্রিত মেহমানদের নিকট থেকে উপহার-উপঢৌকন, টাকা-পয়সা
গ্রহণ করা সমীচীন নয়।
[চলবে-------]
বিবাহ
পরবর্তী কিছু কু-প্রথা :
১. বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর বরকে দাড় করিয়ে
সালাম দেওয়ানোর প্রথা রাসূল (স.) ও তাঁর ছাহাবীগণ থেকে প্রমাণিত নয়।
২. বর ও কনের মুরুববীদের কদমবুসি করা একটি
কু-প্রথা। কেবল বিয়ে নয় যে কোন সময় কদমবুসি করা রাসূল (স.) ও তাঁর ছাহাবীগণ থেকে
প্রমাণিত নয়। সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে হিন্দুয়ানী প্রণামকে প্রথা হিসাবে গ্রহণ
করা মুমিনদের জন্য কাম্য নয়।
৩. বরকে কনের আত্মীয়-স্বজনের সাথে পরিচয়
করিয়ে দেয়ার নাম করে মাহরাম ও গায়ের মাহরাম সকল মহিলাদের সাথে পর্দা বিহীন সরাসরি
পরিচয় করিয়ে দেয়া শরী‘আত বিরোধী কাজ।
৪. নববধূকে পুরুষ-মহিলা সকলে দেখা ও
উপহার-উপঢৌকন দেওয়া শরী‘আত সম্মত নয়।
৫. বরের সাথে প্রাপ্ত বয়স্কা শ্যালিকাদের ও
কনের ভাবীদের হাসি-তামাশা করা হারাম। তেমনি নববধূকে বরের বাড়ীতে নিয়ে আসার পর দেবরদের
ঠাট্টা-তামাশা ও নানা অশালীন আচরণও হারাম।
৬. সমাজে বিবাহোত্তর ওয়ালীমা না করে বিবাহের
অনেক দিন পরে এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে সন্তান জন্মের পরও বউ তুলে আনার রেওয়াজ দেখা
যায়। আর এ উপলক্ষে কনের পিতার বাড়ীতে আড়ম্বরপূর্ণ ভোজের অনুষ্ঠান করতে দেখা যায়।
এটা অপচয় ও বিদ‘আতী অনুষ্ঠান। শরী‘আতে
এরূপ অনুষ্ঠানের কোন নযীর পাওয়া যায় না।
স্ত্রীর
প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য :
১.
পরিবারে ইসলামী অনুশাসন বজায় রাখা :
পরিবার ও পারিবারিক জীবনে ইসলামী অনুশাসন না
থাকলে সদস্যদের মধ্যে প্রেম-ভালবাসা,
মায়া-মমতা
এগুলো কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। বরং দ্বন্দ্ব-কলহ, সন্দেহ-সংশয়, অমিল-অশান্তি
বাসা বেঁধে পারিবারিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে। বিশেষ করে বর্তমান স্যাটেলাইটের
যুগে অপসংস্কৃতির সয়লাবে আমাদের পারিবারিক জীবন হুমকির মুখে পতিত হয়েছে।
স্যাটেলাইটে প্রদর্শিত উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনা আমাদের পারিবারিক ও সমাজ জীবনকে
কলুষিত করে তুলছে। যেনা-ব্যভিচার, গুম-হত্যা, ছিনতাই-রাহাজানি, ধর্ষণ-অপহরণ
ইত্যাদি এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদেও এসেছে উলঙ্গপনার ছাপ। বয়ফ্রেন্ড ও গার্লফ্রেন্ড, লিভ
টুগেদার সংস্কৃতি এখন আমাদের দেশেও চালু হ’তে শুরু করেছে। এগুলো
বিজাতীয় কালচার। এর কারণে পরিবারে অশান্তি নেমে আসে। সেকারণ আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে
পরিবার থেকেই সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, সত্যবাদিতা, পরস্পরে
শ্রদ্ধাবোধ, আদব-কায়েদা ইত্যাদি শিক্ষা
দিতে হবে। সাত বছর বয়সে ছালাতের শিক্ষা,
দশ
বছর বয়সে ছালাত না পড়লে শাস্তি দেওয়া-(আবু দাউদ হা/৪৯৫; মিশকাত হা/৫৭২; ছহীহুল
জামে‘ হা/৫৮৬৮, সনদ ছহীহ)
কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা দেওয়া ইত্যাদির প্রতি
অধিক তাকীদ দিতে হবে।
পরিবারকে আদব বা শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার
জন্য রাসূল (স.) বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,وَلاَ تَرْفَعْ عَنْهُمْ عَصَاكَ أَدَباً- ‘তাদের থেকে তোমার শিষ্টাচারের লাঠিকে উঠিয়ে নিও না’।–( আহমাদ, মিশকাত
হা/৬১; ছহীহ আত-তারগীব
হা/৫৭০; ইওরয়া হা/২০২৬, সনদ ছহীহ)
২. হাসিমুখে থাকা ও উত্তম কথা বলা :
হাসিমুখে থাকা ছাদাক্বার অন্তর্ভুক্ত।–( তিরমিযী হা/১৯৭০; মিশকাত হা/১৯১০, সনদ
ছহীহ) তাই গোমড়ামুখে থাকা
সমীচীন নয়। আর উত্তম কথা বলাও ছাদাক্বা। এজন্য স্ত্রীর সাথে সর্বদা উত্তম কথা বলা
উচিত। এতে পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে। রাসূল (স.) বলেন,وَلاَ تَحْقِرَنَّ شَيْئًا مِنَ الْمَعْرُوْفِ وَأَنْ تُكَلِّمَ
أَخَاكَ وَأَنْتَ مُنْبَسِطٌ إِلَيْهِ وَجْهُكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنَ الْمَعْرُوْفِ- ‘ভালো কাজে অবজ্ঞা প্রদর্শন করো না। তোমার
ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে কথা বলা নিঃসন্দেহে ভালো কাজের অন্তর্ভুক্ত।–(আবু দাউদ হা/৪০৮৪; মিশকাত হা/১৯১৮, সনদ
ছহীহ) অন্যত্র তিনি বলেন,وَالْكَلِمَةُ الطَّيِّبَةُ
صَدَقَةٌ ‘উত্তম কথা ছাদাক্বা’।–(বুখারী হা/২৯৮৯; মুসলিম
হা/১০০৯; মিশকাত হা/১৮৯৬)
৩. উত্তম ব্যবহার করা :
উত্তম ব্যবহার দিয়ে অন্যকে জয় করা যায়, তার
হৃদয়ে আসন করে নেওয়া যায়। এমনকি শত্রুকেও বশে আনা যায়। আল্লাহ বলেন,وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي
هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ
حَمِيْمٌ- ‘আর ভাল ও মন্দ সমান হ’তে
পারে না। মন্দকে প্রতিহত কর তা দ্বারা যা উৎকৃষ্টতর, ফলে
তোমার ও যার মধ্যে শত্রুতা রয়েছে সে যেন হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু’। (সূরা হা-মীম সাজদাহ-৪১/৩৪)
তাই স্ত্রীর সাথে উত্তম ব্যবহার করতে হবে।
কেননা সে তার সকল স্বজন ছেড়ে কেবল স্বামীর কাছে আসে। আল্লাহ বলেন,وَعَاشِرُوْهُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ فَإِنْ كَرِهْتُمُوْهُنَّ
فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوْا شَيْئاً وَيَجْعَلَ اللهُ فِيْهِ خَيْراً كَثِيْراً- ‘তোমরা স্ত্রীদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস কর। যদি
তোমরা তাদের অপসন্দ কর, (তবে হ’তে
পারে) তোমরা এমন বস্ত্তকে অপসন্দ করছ,
যার
মধ্যে আল্লাহ প্রভুত কল্যাণ রেখেছেন’। (সূরা নিসা-৪/১৯)
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,طيِّبُوْا أَقْوَالَكُمْ لَهُنَّ، وحَسّنُوْا أَفْعَالَكُمْ
وَهَيْئَاتِكُمْ بِحَسَبِ قُدْرَتِكُمْ، كَمَا تُحِبُّ ذَلِكَ مِنْهَا، ‘তোমরা তাদের সাথে সুন্দর কথা বল। তাদের জন্য
সাধ্যমত তোমাদের আচার ও আকৃতিকে সুন্দর কর,
যেমন
তোমরা তাদের থেকে পসন্দ কর’।–(তাফসীর
ইবনে কাছীর, ২/২৪২পৃঃ)
স্ত্রীদের
সাথে উত্তম আচরণ ও ভাল ধারণা পোষণের জন্য রাসূল (স.) ছাহাবীদেরকে উপদেশ দিতেন।
তিনি বলেন,لاَ يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ
مُؤْمِنَةً إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِىَ مِنْهَا آخَرَ. ‘কোন মুমিন পুরুষ যেন কোন মুমিনা নারীকে শত্রু
না ভাবে। কারণ নারীর কোন আচরণ অপসন্দ হ’লে কোন আচরণ পসন্দ হবেই’।–( মুসলিম হা/১৪৬৯; মিশকাত হা/৩২৪০, ‘বিবাহ’ অধ্যায়)
তিনি আরো বলেন,هِيَ لَكَ عَلَى أَنْ تُحْسِنَ صُحْبَتَهَا ‘সে
তোমার নিকটে তোমার উত্তম সাহচর্য পাওয়ার অধিকারী’।–( তাবারানী, ছহীহাহ হা/১৬৬)
৪.
স্ত্রীর সাথে একান্তে বসা ও খোশগল্প করা :
অবসরে স্ত্রীর সাথে একান্তে বসে কিছু
গল্প-গুজব করা, তার মনের কথা জানা-বুঝা, তার
কোন চাহিদা থাকলে তা জেনে নিয়ে পূরণ করা স্বামীর জন্য যরূরী। আয়েশা (রাঃ) বলেন,أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ إِذَا صَلَّى {سُنَّةَ الْفَجْرِ}
فَإِنْ كُنْتُ مُسْتَيْقِظَةً حَدَّثَنِىْ وَإِلاَّ اضْطَجَعَ حَتَّى يُؤْذَنَ
بِالصَّلاَةِ. ‘নবী করীম (স.) যখন (ফজরের
সুন্নাত) ছালাত আদায় করতেন, তখন আমি জাগ্রত হ’লে
তিনি আমার সাথে কথা বলতেন। অন্যথা তিনি শয্যাগ্রহণ করতেন এবং ফজরের ছালাতের জন্য
মুওয়াযযিন না ডাকা পর্যন্ত শুয়ে থাকতেন’।–( বুখারী হা/১১৬১)
অন্যত্র তিনি বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا قَضَى
صَلاَتَهُ مِنْ آخِرِ اللَّيْلِ نَظَرَ فَإِنْ كُنْتُ مُسْتَيْقِظَةً حَدَّثَنِى
وَإِنْ كُنْتُ نَائِمَةً أَيْقَظَنِى وَصَلَّى الرَّكْعَتَيْنِ ثُمَّ اضْطَجَعَ
حَتَّى يَأْتِيَهُ الْمُؤَذِّنُ فَيُؤْذِنَهُ بِصَلاَةِ الصُّبْحِ فَيُصَلِّى
رَكْعَتَيْنِ خَفِيْفَتَيْنِ ثُمَّ يَخْرُجُ إِلَى الصَّلاَةِ
‘রাসূল (স.) যখন শেষ রাতে
ছালাত শেষ করতেন, তখন লক্ষ্য করতেন। আমি
জেগে থাকলে আমার সাথে কথা বলতেন। আর ঘুমিয়ে থাকলে আমাকে জাগাতেন এবং দু’রাক‘আত
ছালাত আদায় করে শুয়ে পড়তেন। অবশেষে মুওয়াযযিন এসে যখন ফজরের ছালাতের জন্য তাঁকে
ডাকতেন, তখন তিনি উঠে হালকা করে দু’রাক‘আত
ছালাত পড়ে ফরয ছালাতের জন্য বের হয়ে যেতেন’।–( আবু দাউদ হা/১২৬২; মিশকাত হা/১১৮৯, সনদ ছহীহ)
৫.
স্ত্রীর জন্য সুসজ্জিত ও সুবাসিত হওয়া :
স্বামীদের করণীয় হচ্ছে নিজেকে সর্বদা
পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি রাখা। কেননা অপরিচ্ছন্ন থাকা ও অপরিষ্কার পোশাক পরিধান করা
স্ত্রীরা পসন্দ করে না। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,إني أحب أن أتزيَّن لامرأتي،
كما أحب أن تتزيَّن لي؛ ‘আমি আমার স্ত্রীর জন্য
সুসজ্জিত হ’তে ঐরূপ পসন্দ করি যেভাবে আমার জন্য তার
সুসজ্জিত হওয়া পসন্দ করি’।–(তাফসীর
কুরতুবী, ৫/৯৭)
৬.
বাড়ীতে প্রবেশ করে স্ত্রীকে সালাম দেওয়া :
সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পরিক মহববত
বৃদ্ধি পায়। সেজন্য বাড়ী থেকে বের হ’তে ও বাড়ীতে প্রবেশকালে
বাড়ীর অধিবাসী বিশেষত স্ত্রীকে সালাম দিতে হবে। আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল
(স.) আমাকে বললেন,يَا بُنَىَّ إِذَا دَخَلْتَ
عَلَى أَهْلِكَ فَسَلِّمْ يَكُوْنُ بَرَكَةً عَلَيْكَ وَعَلَى أَهْلِ بَيْتِكَ، ‘হে বৎস! তুমি যখন তোমার পরিবার-পরিজনের নিকটে
যাও, তখন সালাম দিও। তাতে তোমার ও তোমার পরিবার-পরিজনের কল্যাণ
হবে’।–( তিরমিযী হা/২৬৯৮; ছহীহ
আত-তারগীব হা/১৬০৮; তারাজু‘আত হা/২৫৯; ইরওয়া
হা/২০৪১, সনদ হাসান)
তিনি আরো বলেন,ثَلاثَةٌ كُلُّهُمْ ضَامِنٌ عَلَى اللهِ إِنْ عَاشَ رُزِقَ
وَكُفِيَ وَإِنْ مَاتَ أَدْخَلَهُ اللهُ الْجَنَّةَ مَنْ دَخَلَ بَيْتَهُ
فَسَلَّمَ فَهُوَ ضَامِنٌ عَلَى اللهِ وَمَنْ خَرَجَ إِلَى الْمَسْجِدِ فَهُوَ
ضَامِنٌ عَلَى اللهِ وَمَنْ خَرَجَ فِيْ سَبِيْل الله فَهُوَ ضَامِن على الله. ‘তিন ব্যক্তি আল্লাহর যিম্মায় থাকে। যদি তারা
বেঁচে থাকে তাহ’লে রিযক প্রাপ্ত হয় এবং তা যথেষ্ট হয়। আর যদি মৃত্যুবরণ করে তাহ’লে
জান্নাতে প্রবেশ করে। যে ব্যক্তি বাড়ীতে প্রবেশ করে বাড়ীর লোকজনকে সালাম দেয়, সে
আল্লাহর যিম্মায়। যে ব্যক্তি মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হয়, সে
আল্লাহর
যিম্মায়। যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় বের হয়,
সে
আল্লাহর
যিম্মায়’।–( ছহীহ ইবুন হিববান, হা/৪৯৯; আবু
দাউদ হা/২৪৯৪; ছহীহ আত-তারগীব
হা/৩২১, সনদ ছহীহ)
৭.
স্ত্রীর পরিবারকে সম্মান করা :
স্ত্রীর পরিবারের লোকজনকে সম্মান করা স্বামীর
জন্য যরূরী কর্তব্য। কেননা এতে তার মধ্যে স্বামীর প্রতি মহববত-ভালবাসা, সম্প্রীতি-সদ্ভাব
বৃদ্ধি পায়। ফলে সে স্বামীর পরিবারের যাবতীয় কাজ যেমন সুচারুরূপে ও আন্তরিকতার
সাথে করে থাকে, তেমনি তাদের মাঝে
মনোমালিন্য ও ভুল বোঝাবুঝির পথ বন্ধ হ’তে সহায়তা করে।
৮.
স্ত্রী অসুস্থ হ’লে তার সেবা-শুশ্রূষা
করা :
স্ত্রী অসুস্থ বা রোগাক্রান্ত হ’লে
সাধ্যমত তার সেবা-শুশ্রূষা করা স্বামীর কর্তব্য। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, ওছমান
(রাঃ) বদর যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। কেননা তাঁর স্ত্রী আল্লাহর রাসূল (স.)-এর কন্যা
অসুস্থ ছিলেন। তখন নবী করীম (স.) তাঁকে বললেন,إِنَّ لَكَ أَجْرَ رَجُلٍ
مِمَّنْ شَهِدَ بَدْرًا وَسَهْمَهُ. ‘বদর যুদ্ধে যোগদানকারীর
সমপরিমাণ ছওয়াব ও (গনীমতের) অংশ তুমি পাবে’।–( বুখারী হা/৩১৩০, ৩৬৯৮)
আয়েশা (রাঃ) বলেন, নবী
করীম (স.) তাঁর কোন এক স্ত্রীর জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় চান, ডান
হাত তাঁর শরীরে বুলিয়ে দেন এবং বলেন,اللَّهُمَّ رَبَّ النَّاسِ
أَذْهِبِ الْبَاسَ، اشْفِهِ وَأَنْتَ الشَّافِى، لاَ شِفَاءَ إِلاَّ شِفَاؤُكَ،
شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا ‘হে আল্লাহ! মানুষের রব, রোগ
দূর করে দাও, তাকে আরোগ্য দান কর। তুমিই
আরোগ্য দানকারী। তোমার আরোগ্য ব্যতীত কোন আরোগ্য নেই। যা রোগকে ধোঁকা দেয় না’।–( বুখারী হা/৫৭৪৩; মুসিলম হা/২১৯১)
মানুষ অসুস্থ হ’লে
সে আপনজনের সান্নিধ্য ও সাহচর্য কামনা করে। তাই স্ত্রীর অসুস্থতায় সাধ্যমত তার
পাশে থাকা, তার সেবা করা এবং তার জন্য
দো‘আ করা স্বামীর জন্য করণীয়।
৯.
স্ত্রীকে সহযোগিতা করা :
স্ত্রীকে পারিবারিক কাজে সহযোগিতা করা
স্বামীর জন্য একান্ত করণীয়। বিশেষত সে অসুস্থ হ’লে
বা তার পক্ষে কোন কাজ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লে তাকে সাধ্যমত সহযোগিতা করা যরূরী। আয়েশা
(রাঃ) বলেন,كَانَ يَكُوْنُ فِىْ مِهْنَةِ
أَهْلِهِ تَعْنِى خِدْمَةَ أَهْلِهِ فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلاَةُ خَرَجَ إِلَى
الصَّلاَةِ ‘তিনি পরিবারের কাজ করতেন, যখন
ছালাতের সময় হ’ত তখন তিনি ছালাতের জন্য বের হয়ে যেতেন’।–( বুখারী হা/৬৭৬)
আয়েশা
(রাঃ) আরো বলেন,كَانَ بَشَراً مِنَ الْبَشَرِ
يَفْلِى ثَوْبَهُ وَيَحْلُبُ شَاتَهُ وَيَخْدُمُ نَفْسَهُ ‘তিনি
মানুষের মধ্যেকার একজন মানুষ ছিলেন। তিনি স্বীয় কাপড় সেলাই করতেন, বকরী
দোহন করতেন এবং নিজের কাজ নিজে করতেন’।–( আদাবুল মুফরাদ
হা/৫৪১; তিরমিযী হা/৩৪৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৯৯৬)
অন্যত্র
আয়েশা (রাঃ) বলেন,كَانَ يَخِيْطُ ثَوْبَهُ
وَيَخْصِفُ نَعْلَهُ وَيَعْمَلُ مَا يَعْمَلُ الرِّجَالُ فِىْ بُيُوْتِهِمْ. ‘তিনি নিজের কাপড় সেলাই করতেন, স্বীয়
জুতা ঠিক করতেন এবং এবং অন্যান্য পুরুষের ন্যায় বাড়ীর কাজ করতেন’।–( আহমাদ হা/২৪৩৮২; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৯৩৭)
১০.
স্ত্রীর ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেওয়া ও তার থেকে প্রাপ্ত কষ্টে ধৈর্য ধারণ করা
:
স্ত্রীদের সাথে ভাল আচরণ করা প্রত্যেক
স্বামীর জন্য করণীয়। তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেওয়া এবং তারা কষ্ট দিলে
তাতে ধৈর্য ধারণ করা কর্তব্য। রাসূল (স.) বলেন,لاََ يَفْرَكُ مُؤْمِنٌ
مُوْمِنَةً إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِىَ مِنْهَا آخَرَ. ‘কোন মুমিন পুরুষ যেন কোন মুমিনা নারীকে শত্রু
না ভাবে। কারণ নারীর কোন আচরণ অপসন্দ হ’লে কোন আচরণ পসন্দ হবেই’।–( মুসলিম হা/১৪৬৯; মিশকাত হা/৩২৪০, ‘বিবাহ’ অধ্যায়)
তিনি আরো বলেন,إِنَّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلْعٍ وَإِنَّكَ إِنْ تُرِدْ
إِقَامَةَ الضِّلْعِ تَكْسِرْهَا فَدَارِهَا تَعِشْ بِهَا- ‘নিশ্চয়ই মহিলাদের সৃষ্টি করা হয়েছে পাঁজরের হাড্ডি থেকে।
যদি তুমি তাকে সোজা করতে চাও তাহ’লে তাকে ভেঙ্গে ফেলবে।
সুতরাং তার সাথে উত্তম আচরণ কর ও তার সাথে বসবাস কর’।–( আহমাদ হা/২০১০৫; ছহীহুল জামে‘ হা/১৯৪৪; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৯২৬)
অন্যত্র তিনি বলেন,مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَإِذَا شَهِدَ
أَمْرًا فَلْيَتَكَلَّمْ بِخَيْرٍ أَوْ لِيَسْكُتْ وَاسْتَوْصُوْا بِالنِّسَاءِ
فَإِنَّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلَعٍ وَإِنَّ أَعْوَجَ شَىْءٍ فِى الضِّلَعِ
أَعْلاَهُ إِنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُهُ كَسَرْتَهُ وَإِنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ
أَعْوَجَ اسْتَوْصُوْا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে
যখন কোন বিষয় প্রত্যক্ষ করবে তখন যেন উত্তম কথা বলে অন্যথা চুপ থাকে। আর নারীদের
প্রতি সদুপদেশ প্রদান কর। কেননা পাঁজরের একটি হাড় দিয়ে নারী সৃজিত হয়েছে এবং
পাঁজরের সর্বাধিক বাঁকা হ’ল তার উপরের অংশ। তুমি তাকে সোজা করতে গেলে
তা ভেঙ্গে ফেলবে। আর তাকে স্বীয় অবস্থায় রাখলে তা সদা বাঁকা থেকে যাবে। সুতরাং
নারীদের প্রতি সদুপদেশ দান কর’।–( মুসলিম হা/১৪৬৮)
১১.
স্ত্রীর প্রতি উত্তম ধারণা রাখা :
অনেকে স্ত্রীকে অযথা সন্দেহ করে থাকে। ফলে
তাদের মাঝে মনোমালিন্য ও ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হয়। তাই সন্দেহ করা ঠিক নয়। আল্লাহ
বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا
مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয়ই কোন
কোন অনুমান পাপ’। (সূরা হুজুরাত-৪৯/১২)
রাসূল (স.) বলেন,إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ، فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيْثِ ‘তোমরা ধারণা করা থেকে বেঁচে থাক। কেননা ধারণা
করা অধিক মিথ্যা কথা’।–(বুখারী
হা/৫১৪৩, ৬০৬৪; মুসলিম হা/২৫৬৩; মিশকাত
হা/৫০২৮)
স্ত্রীদের প্রতি সুধারণা পোষণ করা মুমিনদের
জন্য অবশ্য করণীয়। যেমন আল্লাহ বলেন,لَوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوْهُ
ظَنَّ الْمُؤْمِنُوْنَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بِأَنْفُسِهِمْ خَيْرًا- ‘যখন তোমরা এরূপ অপবাদ শুনলে তখন মুমিন পুরুষ
ও নারীগণ কেন তাদের নিজেদের মানুষদের সম্পর্কে উত্তম ধারণা পোষণ করলে না’? (সূরা নূর-২৪/১২)
১২.
স্ত্রীর চাহিদা পূরণ করা :
স্বামীর উপরে কর্তব্য হচ্ছে স্ত্রীর সকল
চাহিদা পূরণ করা। রাসূল (স.) বলেন,فَإِنَّ لِجَسَدِكَ عَلَيْكَ
حَقًّا، وَإِنَّ لِعَيْنِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وَإِنَّ لِزَوْجِكَ عَلَيْكَ حَقًّا- ‘তোমার উপর তোমার শরীরের হক আছে; তোমার
উপর তোমার চোখের হক আছে এবং তোমার উপর তোমার স্ত্রীরও হক আছে’।–(বুখারী হা/১৯৭৫, ৫১৯৯; মিশকাত হা/২০৫৪)
আবুদ দারদার হাদীছে আছে,إِنَّ لِنَفْسِكَ عَلَيْكَ حَقًّا وَلِرَبِّكَ عَلَيْكَ حَقًّا
وَلِضَيْفِكَ عَلَيْكَ حَقًّا وَإِنَّ لأَهْلِكَ عَلَيْكَ حَقًّا فَأَعْطِ كُلَّ
ذِىْ حَقٍّ حَقَّهُ- ‘তোমার উপর তোমার দেহের হক
আছে এবং তোমার রবের হক আছে, মেহমানের হক আছে এবং তোমার
পরিবারের হক আছে। অতএব প্রত্যেক হাকদারকে তার হক প্রদান কর’।–( বুখারী হা/৬১৩৯; তিরমিযী হা/২৪১৩)
১৩.
স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করা ও তাকে গুরুত্ব দেওয়া :
স্বামী-স্ত্রী দু’জনের
মাধ্যমে একটি সুখী-সুন্দর পরিবার গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে কারো অবদান কম নয়। কাউকে খাটো
করে দেখার কোন সুযোগ নেই। কারণ স্বামী বাইরের কাজ করে আর স্ত্রী বাড়ীর ভিতরের কাজ
আঞ্জাম দিয়ে থাকে। তাই পরিবারের যে কোন কাজে তার সাথে পরামর্শ করা ও সঠিক হ’লে
সে পরামর্শ মূল্যায়ন করা উচিত। আল্লাহ বলেন,
وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ ‘আর যরূরী বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর’। (সূরা আলে ইমরান-৩/১৫৯) রাসূলুল্লাহ (স.) অহী নাযিলের পরে খাদীজা
(রাঃ)-এর সাথে পরামর্শ করেন-(বুখারী হা/৪৯৫৩; মুসলিম
হা/১৬০; মিশকাত হা/৫৮৪১ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়, ‘অহি-র
সূচনা’ অনুচ্ছেদ) এবং হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে
উম্মু সালামা (রাঃ)-এর পরামর্শ গ্রহণ করেন।–( বুখারী হা/২৭৩২)
১৪.
স্ত্রীকে দ্বীনী ইলম শিক্ষা দেওয়া :
স্বামীর অন্যতম কর্তব্য হচ্ছে স্বীয় স্ত্রীকে
দ্বীনী ইলম শিক্ষা দেওয়া। যার মাধ্যমে তাদের উভয়ের ইহকালীন ও পরকালীন জীবন সুন্দর ও
কল্যাণময় হবে। রাসূল (স.) মালেক বিন হুয়াইরিছ ও তার সাথীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ارْجِعُوْا إِلَى أَهْلِيْكُمْ فَأَقِيْمُوْا فِيْهِمْ
وَعَلِّمُوْهُمْ وَمُرُوْهُمْ- ‘তোমরা তোমাদের পরিবারের
নিকট ফিরে যাও এবং তাদের মধ্যে বসবাস কর। আর তাদেরকে (দ্বীন) শিক্ষা দাও এবং (সৎ
কাজের) নির্দেশ দাও’।–( বুখারী হা/৬৩১; মুসলিম
হা/৬৭৪)
সুতরাং স্ত্রীকে দ্বীনের মৌলিক বিষয়, ইসলাম
ও ঈমানের রুকনসমূহ, ইবাদতের বিভিন্ন
নিয়ম-পদ্ধতি ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়া যরূরী। নিজে শিক্ষা দিতে না পারলে যেখানে এসব শিক্ষা
দেওয়া হয় সেখানে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া বা যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া উচিত।
১৫.
স্ত্রীকে তার পরিবারের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া :
স্ত্রীকে তার পিতা-মাতা, ভাই-বোন
ও অন্যান্য নিকটাত্মীয়দের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া উচিত। আর এক্ষেত্রে প্রয়োজনে
নিজে সাথে নিয়ে যাওয়া বা মাহরাম ব্যক্তিকে সাথে দিয়ে পাঠাতে হবে। ইফকের ঘটনাকালে
আয়েশা (রাঃ) অসুস্থ হ’লে তিনি পিতার বাড়ীতে গমনের জন্য রাসূলের
কাছে অনুমতি চান। রাসূল (স.) তাকে অনুমতি দিলে তিনি পিতৃগৃহে চলে যান।- বুখারী হা/২৬৬১, ৪১৪১; মুসরিম
হা/২৭৭০; আহমাদ হা/২৫৬৬৪)
১৬. স্ত্রীকে
দ্বীনের ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া :
‘প্রত্যেক স্বামীর জন্য কর্তব্য হ’ল
স্বীয় স্ত্রীকে দ্বীনী কাজের নির্দেশ দেওয়া। যাতে তারা তা যথাসাধ্য পালন করে।
আল্লাহ বলেন, وَأْمُرْ أَهْلَكَ
بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا ‘আর তুমি তোমার পরিবারকে
ছালাতের আদেশ দাও এবং তুমি এর উপর অবিচল থাক’। (সূরা ত্ব-হা-২০/১৩২)
রাসূল (স.) স্বীয় স্ত্রীদেরকে দ্বীনের
ব্যাপারে তথা ইবাদতের নির্দেশ দিতেন। উম্মু সালামা (রাঃ) বলেন, এক
রাত্রে রাসূল (স.) ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় জাগ্রত হয়ে বললেন,سُبْحَانَ اللهِ مَاذَا أَنْزَلَ اللهُ مِنَ الْخَزَائِنِ وَمَاذَا
أُنْزِلَ مِنَ الْفِتَنِ، مَنْ يُوْقِظُ صَوَاحِبَ الْحُجُرَاتِ، يُرِيدُ
أَزْوَاجَهُ لِكَىْ يُصَلِّيْنَ، رُبَّ كَاسِيَةٍ فِى الدُّنْيَا، عَارِيَةٍ فِى
الآخِرَةِ- ‘সুবহানাল্লাহ, আল্লাহ
কতইনা ধনভান্ডার অবতীর্ণ করেছেন এবং কতইনা ফিৎনা নাযিল হয়েছে! কে আছে যে
হুজরাবাসিনীদেরকে জাগিয়ে দেবে? যেন তারা ছালাত আদায় করে।
এই বলে তিনি তাঁর স্ত্রীদেরকে উদ্দেশ্য করেছিলেন। তিনি আরো বললেন, দুনিয়ার
বহু বস্ত্র পরিহিতা পরকালে উলঙ্গ থাকবে’।–( বুখারী হা/৭০৬৯)
১৭.
বাড়ীতে ব্যতীত অন্যত্র স্ত্রীকে ছেড়ে না রাখা :
অনেকে স্ত্রীকে বিভিন্ন কারণে অন্যত্র রাখে।
কেউবা স্ত্রীর উপরে রাগ করে তাকে তার পিতার বাড়ীতে ফেলে রাখে। এটা উচিত নয়। বরং
তাকে শিক্ষার জন্য বিছানা পৃথক করে রাখার প্রয়োজন হ’লে
সেটা নিজ বাড়ীতেই হ’তে হবে। রাসূল (স.) বলেন, وَلاَ تَهْجُرْ إِلاَّ فِى الْبَيْتِ ‘আর
তাকে বাড়ীতে ছাড়া অন্যত্র ত্যাগ করবে না’।–( আবু দাউদ হা/২১৪২; মিশকাত হা/৩২৫৯, সনদ
হাসান ছহীহ) অর্থাৎ পৃথক রাখতে হ’লে ঘরের মধ্যেই রাখবে।
১৮.
স্ত্রীদের মাঝে ন্যায়বিচার করা :
কারো একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের সকলের সাথে
ন্যায় ও ইনসাফের সাথে আচরণ করা স্বামীর জন্য অতীব যরূরী। রাসূল (স.) বলেন,إِنَّ الْمُقْسِطِيْنَ عِنْدَ اللهِ عَلَى مَنَابِرَ مِنْ نُوْرٍ
عَنْ يَمِيْنِ الرَّحْمَنِ عَزَّ وَجَلَّ وَكِلْتَا يَدَيْهِ يَمِيْنٌ الَّذِيْنَ
يَعْدِلُوْنَ فِىْ حُكْمِهِمْ وَأَهْلِيْهِمْ وَمَا وَلُوْا ‘আল্লাহর নিকট যারা ন্যায়পরায়ণ তারা দয়াময়ের ডান পার্শ্বে
জ্যোতির মিম্বরের উপর অবস্থান করবে। আর তাঁর উভয় হস্তই ডান। (ঐ ন্যায়পরায়ণ তারা)
যারা তাদের বিচারে, পরিবারে এবং তার কর্তৃত্ব
ও নেতৃত্বাধীন ব্যক্তিবর্গের ব্যাপারে ন্যায়নিষ্ঠ’।–(মুসলিম হা/১৮২৭; নাসাঈ
হা/৫৩৭৯; মিশকাত হা/৩৬৯০)
তিনি আরো বলেন,إِذَا كَانَ عِنْدَ الرَّجُلِ امْرَأَتَانِ فَلَمْ يَعْدِلْ
بَيْنَهُمَا جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَشِقُّهُ سَاقِطٌ ‘যে
ব্যক্তির নিকট দু’জন স্ত্রী আছে সে যদি তাদের মধ্যে সমতা না
রাখে তবে ক্বিয়ামতের দিন সে লোক তার দেহের এক পার্শ্ব ভাঙ্গা অবস্থায় উপস্থিত হবে’।–( তিরমিযী হা/১১৪১; ইবনু মাজাহ হা/১৯৬৯; মিশকাত হা/৩২৩৬ সনদ ছহীহ)
রাসূল
(স.) আরো বলেন,مَنْ كَانَ لَهُ امْرَأَتَانِ
يَمِيْلُ لإِحْدَاهُمَا عَلَى الأُخْرَى جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَحَدُ
شِقَّيْهِ مَائِلٌ- ‘যার দু’জন
স্ত্রী আছে, আর সে তাদের একজনের চেয়ে
অপরজনের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ে, সে ক্বিয়ামতের দিন তার
(দেহের) এক পার্শ্ব পতিত অবস্থায় উপস্থিত হবে’।–( নাসাঈ হা/৩৯৪২; ইরওয়া হা/২০১৭, সনদ
ছহীহ)
১৯.
উপদেশ দেওয়া :
বিভিন্ন সময়ে স্ত্রীকে সদুপদেশ দেওয়া স্বামীর
অন্যতম কর্তব্য। বিশেষত তার কোন ভুল-ত্রুটি হ’লে তা সংশোধনের উপদেশ
দেওয়া যরূরী। বিদায় হজ্জের দিন রাসূল (স.) বলেন,اسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا فَإِنَّمَا هُنَّ عِنْدَكُمْ
عَوَانٍ. لَيْسَ تَمْلِكُونَ مِنْهُنَّ شَيْئًا غَيْرَ ذَلِكَ إِلاَّ أَنْ
يَأْتِيْنَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ- ‘স্ত্রীদের সাথে উত্তম
ব্যবহারের নছীহত গ্রহণ কর। কেননা তারা তোমাদের কাছে বন্দী। উত্তম আচরণ ছাড়া তাদের
উপর তোমাদের কোন অধিকার নেই। তবে যদি তারা প্রকাশ্য অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়’।–(তিরমিযী হা/১১৬৩, ৩০৮৭; ইবনু মাজাহ হা/১৮৫১; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৮৮০।
২০.
মারধর না করা :
স্ত্রীদের বিনা কারণে বা তুচ্ছ কোন ঘটনায়
মারধর করা উচিত নয়। বরং তার ত্রুটি বুঝিয়ে দিয়ে তাকে সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। আর
মারধর করা রাসূলের আদর্শ নয়। নবী করীম (স.) কখনো তাঁর স্ত্রীগণকে প্রহার করেননি।
আয়েশা (রাঃ) বলেন,مَا ضَرَبَ رَسُولُ اللهِ صلى
الله عليه وسلم شَيْئًا قَطُّ بِيَدِهِ وَلاَ امْرَأَةً وَلاَ خَادِمًا- ‘রাসূলুল্লাহ (স.) নিজ হাতে কোন কিছুকে প্রহার
করেননি। না তাঁর কোন স্ত্রীকে, না কোন খাদেমকে’।- মুসলিম হা/২৩২৮; ইবনু মাজাহ হা/১৯৮৪)
তিনি
স্ত্রীদের সাথে ভাল ব্যবহার করতে আদেশ দিয়েছেন এবং তাদেরকে অস্বাভাবাবিক প্রহার
করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,يَعْمِدُ أَحَدُكُمْ يَجْلِدُ
امْرَأَتَهُ جَلْدَ الْعَبْدِ، فَلَعَلَّهُ يُضَاجِعُهَا مِنْ آخِرِ يَوْمِهِ ‘তোমাদের মধ্যে এমন লোক আছে যে তার স্ত্রীকে
ক্রীতদাসের মত মারপিট করে। অতঃপর সম্ভবত ঐ দিন শেষেই সে আবার তার শয্যাসঙ্গী হয়’।–( বুখারী হা/৪৯৪২; মুসলিম হা/২৮৫৫; তিরমিযী
হা/৩৩৪৩; মিশকাত হা/২৬৭৬)
অন্যত্র
তিনি বলেন,لاَ يَجْلِدُ أَحَدُكُمْ
امْرَأَتَهُ جَلْدَ الْعَبْدِ ثُمَّ يُجَامِعُهَا فِي آخِرِ الْيَوْمِ- ‘তোমাদের কেউ যেন নিজের স্ত্রীকে দাসী-বাঁদীর
ন্যায় না পিটায়। অতঃপর দিন শেষে তার সাথে শয্যা গ্রহণ করে’।–(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩২৪২ ‘বিবাহ’ অধ্যায়)
তিনি
আরো বলেন, ‘যারা এভাবে স্ত্রীদেরকে
প্রহার করে তারা তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি নয়’।-(আবু দাউদ, হা/২১৪৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৩৬০; মিশকাত হা/৩২৬১, সনদ
ছহীহ)
[চলবে--------]
স্বামীর
নিকটে স্ত্রীর অধিকার :
স্বামীর কাছে স্ত্রীর কিছু হক বা অধিকার আছে, যেগুলি
আদায় করা স্বামীর জন্য অবশ্য কর্তব্য। এই অধিকারগুলি যথাযথভাবে প্রদান করলে
স্বামীর প্রতি স্ত্রী যেমন অনুগত হয় তেমনি তার প্রতি স্ত্রীর ভালবাসা-মহববত অটুট
থাকে। নিম্নে স্ত্রীর কিছু হক বা অধিকার উল্লেখ করা হ’ল।-
১. আশ্রয়
দান : স্ত্রীকে আশ্রয় দান করা
স্বামীর জন্য আবশ্যক। যেখানে স্ত্রী থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে ও নিরাপদ ভাবে
সেখানে তার আবাসনের ব্যবস্থা করা স্বামীর জন্য করণীয়। আল্লাহ বলেন, أَسْكِنُوْهُنَّ مِنْ حَيْثُ سَكَنْتُمْ مِنْ وُجْدِكُمْ وَلاَ
تُضَارُّوْهُنَّ لِتُضَيِّقُوْا عَلَيْهِنَّ- ‘তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যেখানে তোমরা বসবাস কর সেখানে
তাদেরকেও বাস করতে দিয়ো। তাদেরকে সঙ্কটে ফেলার জন্য কষ্ট দিয়ো না’। (সূরা তালাক্ব-৬৫/৬)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইদ্দত
পালনকালে স্ত্রীকে বাড়ী থেকে বের করে দেওয়া যাবে না। আল্লাহ বলেন,لاَ تُخْرِجُوْهُنَّ مِنْ بُيُوْتِهِنَّ وَلاَ يَخْرُجْنَ إِلاَّ
أَنْ يَأْتِيْنَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ- ‘তোমরা তাদেরকে তোমাদের বাড়ী-ঘর থেকে বের করে দিয়ো না এবং
তারাও বের হবে না। যদি না তারা কোন স্পষ্ট অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়’। (সূরা তালাক্ব-৬৫/১)
২.
ভরণ-পোষণ : স্ত্রীর ভরণ-পোষণের
সম্পূর্ণ দায়িত্ব স্বামীর। আল্লাহ বলেন,
لِيُنْفِقْ ذُوْ سَعَةٍ مِنْ
سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آَتَاهُ اللهُ لاَ
يُكَلِّفُ اللهُ نَفْساً إِلاَّ مَا آَتَاهَا سَيَجْعَلُ اللهُ بَعْدَ عُسْرٍ
يُسْراً- ‘সচ্ছল ব্যক্তি তার সচ্ছলতা
অনুসারে ব্যয় করবে। আর যার রিযক সীমিত করা হয়েছে, সে
ব্যয় করবে আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তাত্থেকে। আল্লাহ যাকে যতটা দিয়েছেন তার
অতিরিক্ত বোঝা তার উপর চাপান না। আল্লাহ কষ্টের পর সহজ করে দিবেন’। (সূরা তালাক্ব-৬৫/৭) তিনি আরো বলেন,وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ
بِالْمَعْرُوفِ ‘আর জন্মদাতা পিতার দায়িত্ব
হ’ল ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রসূতি মায়েদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা’। (সূরা বাক্বারাহ-২/২৩৩)
হাকীম ইবনু মু‘আবিয়াহ
আল-কুশাইরী থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত,
তিনি
বলেন, একদা আমি বললাম,
হে
আল্লাহর রাসূল!مَا حَقُّ زَوْجَةِ أَحَدِنَا عَلَيْهِ قَالَ أَنْ تُطْعِمَهَا
إِذَا طَعِمْتَ وَتَكْسُوَهَا إِذَا اكْتَسَيْتَ أَوِ اكْتَسَبْتَ وَلاَ تَضْرِبِ
الْوَجْهَ وَلاَ تُقَبِّحْ وَلاَ تَهْجُرْ إِلاَّ فِى الْبَيْتِ. ‘আমাদের
কারো উপর তার স্ত্রীর কি হক রয়েছে?
তিনি
বললেন, তুমি যখন আহার করবে তাকেও আহার করাবে। তুমি পোষাক পরিধান
করলে তাকেও পোষাক দিবে। তার মুখমন্ডলে মারবে না, তাকে
গালমন্দ করবে না। আর তাকে পৃথক রাখতে হ’লে ঘরের মধ্যেই রাখবে’।–(আবু দাউদ হা/২১৪২; মিশকাত
হা/৩২৫৯, সনদ ছহীহ)
তিনি আরো বলেন,إِذَا أَعْطَى اللهُ أَحَدَكُمْ خَيْرًا فَلْيَبْدَأْ بِنَفْسِهِ
وَأَهْلِ بَيْتِهِ- ‘তোমাদের কাউকে যখন আল্লাহ
কল্যাণ (সম্পদ) দান করেন তখন সে নিজের এবং তার পরিবারস্থ লোকজনকে দিয়ে (ব্যয়) শুরু
করবে’।–( মুসলিম হা/১৮২২; মিশকাত
হা/৩৩৪৩) কারো সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সে যদি তার
পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ করতে কৃপণতা করে তাহ’লে সে পাপী হবে। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন,كَفَى بِالْمَرْءِ إِثْمًا أَنْ يُضَيِّعَ مَنْ يَقُوْتُ، ‘কেউ পাপী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে
তার উপর নির্ভরশীলদের রিযিক্ব নষ্ট করে’।–( আবু দাউদ হা/১৬৯২; মিশকাত
হা/৩৩৪৬, সনদ ছহীহ)
অন্যত্র
তিনি আরো বলেন, كَفَى بِالْمَرْءِ إِثْمًا
أَنْ يَحْبِسَ عَمَّنْ يَمْلِكُ قُوْتَهُ ‘কোন
ব্যক্তির পাপের জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে,
যাদের
খোরপোষ তার দায়িত্ব সে তাদের খোরাকী আটকিয়ে রাখবে’।–( মুসলিম হা/৯৯৬; মিশকাত
হা/৩৩৪৬)
এ
ধরনের লোককে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, إِنَّ اللهَ سَائِلٌ كُلَّ رَاعٍ عَمَّا اسْتَرْعَاهُ أحَفِظَ
ذلِكَ أمْ ضَيَّعَهُ حَتّى يَسأَلَ الرَّجُلَ عنْ أهْلِ بَيْتِهِ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক দায়িত্বশীলকে তার
দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। সে তা সংরক্ষণ করেছে, না
তাতে অবহেলা করেছে? এমনকি পুরুষকে তার স্ত্রী
(পরিবার-পরিজন) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে’।–(নাসাঈ, আস-সুনানুল
কুবরা হা/৯১৭৪; ছহীহাহ হা/১৬৩৬; ছহীহুল জামে‘ হা/১৭৭৪)
পক্ষান্তরে
পরিবারের জন্য খরচকৃত অর্থের ফযীলত অনেক বেশী। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, أَفْضَلُ دِيْنَارٍ يُنْفِقُهُ الرَّجُلُ دِيْنَارٌ يُنْفِقُهُ
عَلَى عِيَالِهِ، ‘উত্তম হ’ল ঐ দীনার যা কোন ব্যক্তি
তার পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ করে’।–(মুসলিম
হা/৯৯৪; মিশকাত হা/১৯৩২)
অন্যত্র তিনি বলেন,ديْنَارٌ أَنْفَقْتَهُ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ،
دِينَارٌ فِي الْمَسَاكِيْنِ، وَدِيْنَارٌ فِيْ رَقَبَةٍ، وَدِيْنَارٌ فِيْ
أَهْلِكَ، أَعْظَمُهَا أَجْرًا الدِّيْنَارُ الَّذِيْ تُنْفِقُهُ عَلَى أَهْلِكَ، ‘এক দীনার যা তুমি আল্লাহর পথে খরচ কর। এক
দীনার দরিদ্রদের জন্য, এক দীনার গোলাম আযাদ করার
জন্য এবং এক দীনার তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য। এসবগুলির মধ্যে সর্বাধিক ছওয়াব
অর্জনকারী ঐ দীনার, যা তুমি তোমার পরিবারের
জন্য খরচ কর’।–( মুসনাদ হা/১০১৩২)
আর
পরিবারের জন্য খরচ করা অর্থ ছাদাক্বার অন্তর্ভুক্ত হবে। রাসূল (স.) বলেন,إِذَا أَنْفَقَ الرَّجُلُ عَلَى أَهْلِهِ يَحْتَسِبُهَا فَهُوَ
لَهُ صَدَقَةٌ. ‘কোন ব্যক্তি স্বীয়
পরিবার-পরিজনের জন্য পুণ্যের আশায় যখন ব্যয় করে তখন সেটা তার জন্য ছাদাক্বা হয়ে
যায়’।–( বুখারী হা/৫৫)
এমনকি কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে যে পানি পান
করায় তার জন্যও তার নেকী রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন,إِنَّ الرَّجُلَ إِذَا سَقَى امْرَأَتَهُ مِنَ الْمَاءِ أُجِرَ. ‘নিশ্চয়ই কোন ব্যক্তি যখন তার স্ত্রীকে পানি
পান করায় তখন সে তার বিনিময়ে ছওয়াব পায়’।–( মুসনাদ হা/১০১৩২; ছহীহ
আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১৯৬৩)
স্বামী
সাধ্যমত স্ত্রীকে পোষাক-পরিচ্ছদ দান করবে। রাসূল (স.) বলেন,وَحَقُّهُنَّ عَلَيْكُمْ أَنْ تُحْسِنُوْا إِلَيْهِنَّ فِىْ
كِسْوَتِهِنَّ وَطَعَامِهِنَّ ‘আর তোমাদের উপর তাদের
অধিকার এই যে, তোমরা (যথাসম্ভব) তাদের
পোষাক-পরিচছদ ও আহারের সুব্যবস্থা করবে’।–( তিরমিযী হা/১১৬৩, ৩০৮৭; ইবনু
মাজাহ হা/১৮৫১; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৮৮০)
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, সমাজে
এমন অনেক দায়িত্বহীন মানুষ আছে, যারা নিজ স্ত্রী ও
সন্তানকে ভাল ও মানসম্মত পোষাক কিনে দেয় না। অথচ নিজে মূল্যবান পোষাক পরিধান করে।
৩.
স্ত্রীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা : স্বামীর উপরে স্ত্রীর অন্যতম অধিকার হ’ল
তার নিরাপত্তার সুব্যবস্থা করা, যাতে তার জান-মাল, ইয্যত-আব্রু, মান-সম্ভ্রম
বজায় থাকে এবং সে ঐ পরিবেশে নিজেকে নিরাপদ মনে করে। সেই সাথে দ্বীনী যাবতীয়
কর্মকান্ড সুচারুরূপে পালন করতে পারে। অনুরূপভাবে তাকে সকল প্রকার ফিৎনা থেকে
রক্ষা করা। যেমন দুরাচারী মহিলাদের সাথে মেশার সুযোগ না দেওয়া, প্রেক্ষাগৃহে
না নিয়ে যাওয়া, বাদ্য-বাজনা সম্বলিত
অশ্লীল গান না শুনানো, তাকে বেপর্দা ও অর্ধ নগ্ন
হয়ে চলতে বাধ্য না করা, গায়ের মাহরাম পুরুষ
(দেবর-ভাসুর, বন্ধু-বান্ধব)-দের সাথে
মিশতে বাধ্য না করা। তদ্রূপ তাকে কোন চাকুরী করতে বাধ্য না করা, যাতে
সে পরপুরুষের সাথে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মিশতে বাধ্য হয়। আর এসবের মাধ্যমে নারীরা
পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে ও পাপাচারে লিপ্ত হয়। যার শেষ পরিণতি হচ্ছে বিচ্ছেদ।
৪.
স্ত্রীকে সন্দেহ না করা : স্ত্রীকে অযথা সন্দেহ করা
স্বামীর উচিত নয়। কারণ স্ত্রীকে সন্দেহ করলে দাম্পত্য জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। আর
সুখী-সুন্দর দাম্পত্য জীবনের জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়ের বিশ্বস্ততা, আমানতদারিতা, সততা-সত্যবাদিতা, আন্তরিকতা, অনাবিল
প্রেম, অকৃত্রিম ভালবাসা,
নম্রতা, সুস্মিত
ব্যবহার ও বাক্যালাপ, একে অপরের উপকার স্বীকার
করা ইত্যাদি গুণ উভয়ের মধ্যে থাকা প্রয়োজন। আর সন্দেহ এসব কিছুকে ধবংস করে ফেলে।
কারণ সন্দেহ এমন জিনিস যার সূক্ষ্মতম শিকড় একবার মনের গভীরে প্রোথিত হয়ে গেলে
যতক্ষণ না তাকে উপড়ে ফেলা হয়, ততক্ষণ সে প্রবল প্রতাপে
রাজত্ব করতে থাকে। এই সন্দেহ-সংশয়ের ফলে পরিবারে অশান্তি নেমে আসে। সংসার পরিণত হয়
এক প্রকার জাহান্নামে। এরূপ সংসার স্থায়ী হয় না।
এক্ষেত্রে মহান আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী
প্রত্যেক স্বামীর মনে রাখা উচিত। তিনি বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ
آمَنُوْا إِنَّ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَأَوْلاَدِكُمْ عَدُوًّا لَكُمْ
فَاحْذَرُوْهُمْ وَإِنْ تَعْفُوْا وَتَصْفَحُوْا وَتَغْفِرُوْا فَإِنَّ اللهَ
غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ- ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই
তোমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের (পার্থিব ও পারলৌকিক
বিষয়ের) শত্রু। অতএব তাদের ব্যাপারে তোমরা সতর্ক থেকো। অবশ্য (পাপ থেকে তওবা করলে
ও পার্থিব অন্যায়ে) তোমরা যদি তাদেরকে মার্জনা কর, তাদের
দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা কর এবং তাদেরকে ক্ষমা করে দাও তাহ’লে
জেনে রাখ যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম
দয়ালু’। (সূরা তাগাবুন-৬৪/১৪)
স্ত্রীর
দায়িত্ব ও কর্তব্য :
পরিবারে স্ত্রীর দায়িত্ব-কর্তব্যও কম নয়।
স্ত্রী একটি পরিবারের কর্ত্রী হয়ে থাকে। সে তার দায়িত্ব ভালভাবে পালন করলে পরিবার
ভাল চলে, সবাই সুখী হয়। কিন্তু
স্ত্রী তার দায়িত্বে অবহেলা করলে কিংবা দায়িত্ব পালনে অলসতা করলে পরিবারে
বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি মেনে আসে। তাই স্ত্রীকে দায়িত্ব সচেতন ও কর্তব্যপরায়ণ হওয়া
যরূরী। নিম্নে স্ত্রীর কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য উল্লেখ করা হ’ল।-
১.
ধৈর্যশীলা হওয়া : স্বামী প্রদত্ত কষ্ট ও তার
দুর্ব্যবহারে ধৈর্য ধারণ করা এবং একে ছওয়াবের কারণ মনে করা উচিত। তার পক্ষ থেকে
খারাপ আচরণ পেলেও তা সহ্য করা এবং তার শয্যা পরিত্যাগ না করা স্ত্রীর জন্য
কর্তব্য। নবী করীম (স.) বলেন,إِذَا دَعَا الرَّجُلُ
امْرَأَتَهُ إِلَى فِرَاشِهِ فَأَبَتْ، فَبَاتَ غَضْبَانَ عَلَيْهَا، لَعَنَتْهَا
الْمَلاَئِكَةُ حَتَّى تُصْبِحَ ‘কোন
লোক
যদি নিজ স্ত্রীকে বিছানায় আসতে ডাকে আর স্ত্রী অস্বীকার করে এবং সে ব্যক্তি
স্ত্রীর উপর কষ্ট নিয়ে রাত্রি যাপন করে,
তাহ’লে
ফেরেশতাগণ এরূপ স্ত্রীর উপর সকাল পর্যন্ত লা‘নত করতে থাকে’।–( বুখারী হা/৩২৩৭, ৫১৯৩; মুসলিম
হা/১৪৩৬; মিশকাত হা/৩২৪৬)
অন্যত্র
তিনি বলেন,إِذَا بَاتَتِ الْمَرْأَةُ
مُهَاجِرَةً فِرَاشَ زَوْجِهَا لَعَنَتْهَا الْمَلاَئِكَةُ حَتَّى تَرْجِعَ- ‘যদি কোন স্ত্রী তার স্বামীর শয্যা ছেড়ে
অন্যত্র রাত্রি যাপন করে তাহ’লে যতক্ষণ না সে তার
স্বামীর শয্যায় ফিরে আসে, ততক্ষণ ফেরেশতাগণ তার ওপর
লা‘নত বর্ষণ করতে থাকে’।–(বুখারী
হা/৫১৯৪; মুসলিম হা/১৪৩৬)
২. স্বামীর
পরিবারের উত্তম সংরক্ষক হওয়া : স্বামীর পরিবারের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা এবং তার
অনুপস্থিতিতে তার সম্পদের সংরক্ষণ করা স্ত্রীর কর্তব্য। আর জীবন যাত্রার ব্যয়
নির্বাহের ক্ষেত্রে অপচয় ও অপব্যয় না করা। যেমন আল্লাহ বলেন,وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيْرًا، إِنَّ الْمُبَذِّرِيْنَ كَانُوْا
إِخْوَانَ الشَّيَاطِيْنِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُوْرًا- ‘আর তুমি মোটেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই
অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ’। (সূরা বানী ইসরাঈল-১৭/২৬-২৭)
তিনি আরো বলেন, وَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا وَلَا تُسْرِفُوْا إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ
الْمُسْرِفِيْنَ ‘আর তোমরা খাও ও পান কর।
কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালবাসেন না’। (সূরা আ‘রাফ-৭/৩১)
পক্ষান্তরে স্বামীর সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি
সম্পর্কে স্ত্রীকে পরকালে জবাবদিহি করতে হবে। রাসূল (স.) বলেন,وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى أَهْلِ بَيْتِ زَوْجِهَا وَوَلَدِهِ
وَهِىَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ، ‘নারী তার স্বামীর পরিবার ও সন্তান-সন্ততির
উপর দায়িত্বশীল, সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত
হবে’।–( বুখারী হা/৭১৩৮; মুসলিম
হা/১৮২৯; মিশকাত হা/৩৬৮৫)
মূলতঃ স্ত্রী সংসারের কর্ত্রী। স্বামীর
ধন-সম্পদ ও সংসার তার রাজত্ব এবং এগুলো স্বামীর আমানত। তাই তার যথার্থ হেফাযত করা
এবং যথাস্থানে সঠিকভাবে তা ব্যয় করা স্ত্রীর অন্যতম প্রধান কর্তব্য। অন্যায়ভাবে
গোপনে ব্যয় করা ও
স্বামীর বিনা অনুমতিতে আত্মীয়-স্বজনকে উপহার-উপঢৌকন দেওয়া আমানতের খেয়ানত। এসব
কারণে অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। যা স্থায়ী হয়ে অনেক
ক্ষেত্রে বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়। অবশ্য স্বামী ব্যয়কুণ্ঠ বা কৃপণ হ’লে
এবং স্ত্রী ও সন্তানের প্রয়োজনীয় খরচ না দিলে,
স্ত্রী
গোপনে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই নিতে পারবে। এর বেশী নিলে তা অবৈধ হবে।–( ইরওয়াউল গালীল হা/২৬৪৬)
আর স্বামী দানশীল হ’লে
ও দানের জন্য সাধারণ অনুমতি থাকলে স্ত্রী যদি তার অনুপস্থিতিতে দান করে, তাহ’লে
উভয়েই সমান ছওয়াবের অধিকারী হবে।–( বুখারী, মুসলিম, আবু
দাঊদ, ছহীহ আত-তারগীব হা/৯২৬-৯৩০)
৩.
শ্বশুর-শাশুড়ীর প্রতি উত্তম ব্যবহার করা : স্ত্রীর অন্যতম কর্তব্য হ’ল
স্বামীকে সন্তুষ্ট করা। সেজন্য স্ত্রীর উচিত স্বামীর পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণ ও
তাদের সেবা করে স্বামীর সন্তুষ্টি অর্জন করা। সেই সাথে স্বামীকেও তার পিতা-মাতার
সন্তুষ্টি অর্জনে সাহায্য করা। অপরদিকে স্বামীর ভাইদের সাথে পর্দা বজায় রেখে নিজের
ইয্যত-আব্রু ও লজ্জাস্থান হেফাযতের চেষ্টা করা যরূরী। রাসূল (স.) বলেন,إِيَّاكُمْ وَالدُّخُولَ عَلَى النِّسَاءِ. فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ
الأَنْصَارِ يَا رَسُولَ اللهِ أَفَرَأَيْتَ الْحَمْوَ. قَالَ الْحَمْوُ الْمَوْتُ- ‘মহিলাদের নিকট একাকী যাওয়া থেকে বিরত থাক। এক
আনছার ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! দেবরের
ব্যাপারে কী হুকুম? তিনি বললেন, দেবর
হচ্ছে মৃত্যুতুল্য’।–( বুখারী হা/৫২৩২; মুসলিম
হা/২১৭২; মিশকাত হা/৩১০২) দেবর বলতে স্বামীর নিজের
ছোট ভাই (সহোদর বা সৎ), চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো
ভাইদের বুঝায়। সেই সাথে স্বামীর বড় ভাইয়ের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ থেকে বিরত থাকাও
যরূরী। অনুরূপভাবে স্ত্রী তার চাচাতো,
মামাতো, খালাতো, ফুফাতো
ভাইদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা থেকে বিরত থাকবে। কারণ এটা পর্দা রক্ষা ও লজ্জাস্থান
হেফাযতের জন্য অতীব যরূরী।
৪.
অন্যের সামনে নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ না করা : স্ত্রীর যাবতীয় সাজসজ্জা ও শোভা-সৌন্দর্য কেবল স্বামীর জন্য
হবে। অন্যের জন্য তার সৌন্দর্য প্রকাশ ও প্রদর্শন করা বৈধ নয়। আল্লাহ বলেন, وَلاَ يُبْدِيْنَ زِيْنَتَهُنَّ إِلاَّ لِبُعُوْلَتِهِنَّ ‘আর তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে
তাদের স্বামীর নিকটে ব্যতীত’। (সূরা নূর-২৪/৩১) রাসূল (স.)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল,أَىُّ النِّسَاءِ خَيْرٌ قَالَ الَّتِى تَسُرُّهُ إِذَا نَظَرَ. ‘কোন নারী উত্তম? তিনি
উত্তরে বললেন, যে স্বামীকে আনন্দিত করে
যখন সে (স্বামী) তার দিকে তাকায়’।–( নাসাঈ হা/৩২৩১; মিশকাত
হা/৩২২৭; ছহীহাহ হা/১৮৩৮)
সুতরাং
স্বামী ব্যতীত অন্য কারো জন্য অঙ্গসজ্জা করা ও তা প্রদর্শন করা বৈধ নয়। পক্ষান্তরে
এরূপ-লাবণ্য ও সাজসজ্জা অন্যের জন্য করা হ’লে সেটা তার অকল্যাণের
কারণ হবে। রাসূল (স.) বলেন,أَيُّمَا امْرَأَةٍ
اسْتَعْطَرَتْ فَمَرَّتْ عَلَى قَوْمٍ لِيَجِدُوْا مِنْ رِيْحِهَا فَهِىَ
زَانِيَةٌ- ‘যে নারী সুগন্ধি ব্যবহার
করল অতঃপর লোকদের পাশ দিয়ে এ উদ্দেশ্যে অতিক্রম করল যে, তারা
যেন তার সুঘ্রাণ পায়, তাহ’লে
সে ব্যভিচারী’।–( নাসাঈ হা/৫১২৬; ছহীহুল
জামে‘ হা/২৭০১)
আদর্শ নারীর সদা চিন্তা স্বামীর মনোতুষ্টি।
কারণ তার আনন্দেই স্ত্রীর সুখ। স্বামী সুখী না হ’লে
স্ত্রী নিজের সুখ কল্পনাই করতে পারে না। তাই স্বামীর প্রয়োজনের প্রতি সদা তীক্ষ্ণ
দৃষ্টি দেওয়া স্ত্রীর কর্তব্য। যেমন স্বামী বাইরে থেকে আসলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার
সামনে পানি, শরবত পেশ করা, তার
প্রয়োজনীয় জিনিস এগিয়ে দেওয়া, বৈদ্যুতিক পাখা না থাকলে
হাত পাখা দিয়ে বাতাস করা ইত্যাদি আদর্শ স্ত্রীর বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া স্বামী সালাম
দিয়ে যখন বাড়িতে প্রবেশ করে, তখন উত্তর দিয়ে হাসিমুখে
স্বামীকে সাদর সম্ভাষণ জানানো উচিত।
সাধারণত স্ত্রী স্বামীর জন্য সাজসজ্জা করে
ফুটন্ত গোলাপ সদৃশ হয়ে থাকবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়, সাজসজ্জা
ও বেশভূষায় স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। সৌন্দর্য ও সৌরভে ভরা গোলাপের দিকে এক পলক
তাকিয়ে যেমন মন-প্রাণ আকৃষ্ট হয়, স্বামীর মনও তার স্ত্রীর
দিকে তাকিয়ে তেমনি প্রফুল্ল হবে। স্ত্রীর মাঝে সৎগুণাবলী থাকলে এবং স্বামী-স্ত্রীর
মাঝে মধুর সম্পর্ক থাকলে, কোন নারী সংগঠন বা
নারীস্বাধীনতা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রয়োজনই হবে না।
উল্লেখ্য যে, যে
স্বামী তার স্ত্রীর প্রগাঢ় ভালোবাসা পায়,
বিপদে
সান্ত্বনা, কষ্টে সেবা-যত্ন পায়, রাগ-অনুরাগ
বা অভিমান করলে যার স্ত্রী তার অভিমান ভাঙ্গাতে ব্যাকুল থাকে সেইতো সৌভাগ্যবান।
পিতা-মাতার দো‘আ ও স্ত্রীর অকৃত্রিম প্রেমের বাহুবন্ধনেই তো
রয়েছে স্বামীর প্রকৃত পৌরুষ। এমন স্ত্রী না হ’লে পুরুষের জীবন বৃথা।
৫. লজ্জাস্থান
হেফাযত করা : স্ত্রীর অন্যতম কর্তব্য হ’ল
তার লজ্জাস্থান হেফাযত করা। অর্থাৎ ব্যভিচারের পথ পরিহার করা। আল্লাহ বলেন,فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ
اللهُ- ‘অতএব সতী-সাধ্বী স্ত্রীরা
হয় অনুগত এবং আল্লাহ যা হেফাযত করেছেন,
আড়ালেও
(সেই গুপ্তাঙ্গের) হেফাযত করে’। (সূরা নিসা-৪/৩৪) রাসূল (স.) বলেন, خَيْرُ النِّسَاءِ تَسُرُّكَ إِذَا أَبْصَرْتَ وَتُطِيْعُكَ إِذَا
أَمَرْتَ وَتَحْفَظُ غَيْبَتَكَ فِيْ نَفْسِهَا وَمَالِكَ ‘উত্তম
স্ত্রী সে যার দিকে তুমি তাকালে তোমাকে আনন্দিত করে, তুমি
নির্দেশ দিলে তা প্রতিপালন করে, তোমার অনুপিস্থিতিতে তার
নিজেকে ও তোমার সম্পদ হেফাযত করে’।–( ত্বাবারাণী, মু‘জামুল
কাবীর, ছহীহুল জামে‘ হা/৩২৯৯)
অন্যত্র রাসূল (স.) বলেন,أَلاَ أُخْبِرُكَ بِخَيْرِ مَا يَكْنِزُ الْمَرْءُ الْمَرْأَةُ
الصَّالِحَةُ إِذَا نَظَرَ إِلَيْهَا سَرَّتْهُ وَإِذَا أَمَرَهَا أَطَاعَتْهُ
وَإِذَا غَابَ عَنْهَا حَفِظَتْهُ ‘আমি কি তোমাকে মানুষের
সর্বোত্তম সম্পদ সম্পর্কে অবহিত করব না?
তা
হ’ল, নেককার স্ত্রী। সে
(স্বামী) তার (স্ত্রীর) দিকে তাকালে স্ত্রী তাকে আনন্দ দেয়, তাকে
কোন নির্দেশ দিলে সে তা মেনে নেয় এবং সে যখন তার থেকে অনুপস্থিত থাকে, তখন
সে তার সতীত্ব ও তার সম্পদের হেফাযত করে’।–(আবুদাউদ হা/১৬৬৪; মিশকাত হা/১৭৮১; ছহীহুল জামে‘ হা/১৬৪৩) এর সাথে নিম্নোক্ত কাজগুলি
করা যরূরী। ক. স্বামীর অনুপস্থিতিতে গায়ের মাহরাম পুরুষকে বাড়ীতে প্রবেশ করতে না দেওয়া।
খ. পরিবারের দেখা-সাক্ষাতের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মাঝে পর্দার ব্যবস্থা থাকা।
গ. পরিচারক ও গাড়ী চালকদের থেকে সাবধান থাকা। ঘ. হিজড়াদের বাড়ীতে প্রবেশ করতে না
দেওয়া। ঙ. পরপুরুষের সামনে পাতলা, মিহি কাপড় পরিহার করা। চ.
টেলিফোন ও মোবাইলের ক্ষতি থেকে সাবধান থাকা। ছ. বিধর্মীদের ধর্মীয় প্রতীক ও
দেব-দেবীর প্রতীক পরিহার করা। জ. সকল প্রকার প্রাণীর ছবি ও মূর্তি বাড়ীতে না রাখা।
ঝ. যাবতীয় নেশাদ্রব্য থেকে বাড়ীকে মুক্ত রাখা। ঞ. কোন কুকুর বাড়ীতে না রাখা। ট.
বাদ্যযন্ত্র ও অশ্লীল গান-বাজনা পরিহার করা। ঠ. বাড়ীর ভিতর-বাহির পরিচ্ছন্ন রাখা।–(মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আরবাঊনা
নছীহত লিইছলাহিল বুয়ূত, (রিয়াদ : মাজমূ‘আ
যাদ, ১ম প্রকাশ, ১৪৩৬হিঃ/২০১৫খৃঃ), পৃঃ
৮৯)
৬.
স্বামীর গৃহের কাজ করা : স্বামীর ঘর-বাড়ী
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিপাটি রাখা স্ত্রীর কর্তব্য। স্বামীর খেদমত
করা, সন্তান-সন্ততিদেরকে লালন-পালন করা ও তাদেরকে পরিচ্ছন্ন রাখা, তাদের
আদব-কায়েদা শিক্ষা দেওয়া এবং সভ্য করে গড়ে তোলাও স্ত্রীর দায়িত্ব। সংসারের কাজ
নিজের হাতে করা উত্তম। এতে তার স্বাস্থ্য ভালো ও সুস্থ থাকবে। একান্ত প্রয়োজন না হ’লে
গৃহপরিচারিকা না রাখা ভাল। মহিলা ছাহাবীগণ নিজ হাতে ক্ষেতেরও কাজ করতেন। একদা হযরত
ফাতেমা (রাঃ) কাজের অতিরিক্ত চাপ ও নিজের কষ্টের কথা পিতা মুহাম্মাদ (স.)-এর নিকট
উল্লেখ করে খাদেম চাইলে নবী করীম (স.) তাঁকে নিজ হাতে কাজ করতে নির্দেশ দিলেন এবং
অলসতা কাটিয়ে উঠার প্রতিষেধকও বলে দিলেন। তিনি বলেন, ‘যখন তোমরা শয়ন করবে তখন ৩৪ বার ‘আল্লা-হু
আকবার’ ৩৩ বার ‘সুবহা-নাল্লা-হ’ এবং
৩৩ বার ‘আলহামদুলিল্লা-হ’ পড়বে।
এটা তোমাদের জন্য খাদেম থেকেও উত্তম হবে’।–( মুসলিম হা/২৭২৭)
৭.
স্বামীর রাগের সময় স্ত্রী বিনম্র হওয়া : কখনও কোন কারণে স্বামী রাগান্বিত হ’লে
স্ত্রী নীরব থাকবে ও নম্রতা অবলম্বন করবে। যে আদর-সোহাগ করে, তার
শাসন করারও অধিকার আছে। আর এ শাসন স্ত্রীকে মাথা পেতে মেনে নিতে হয়। ভুল হ’লে
ক্ষমা চাইবে। স্বামী যেহেতু বয়সে ও মর্যাদায় বড়, সেহেতু
তার কাছে ক্ষমা চাওয়া অপমানের নয়; বরং এতে মান-সম্মান বৃদ্ধি
পায়। তাছাড়া অহংকার ও ঔদ্ধত্যের পরিণাম কখনও ভাল হয় না। সুতরাং স্বামীর রাগের
আগুনকে গর্ব-অহংকার ও ঔদ্ধত্যের ফুৎকারে প্রজ্বলিত না করে বিনয়ের পানি দিয়ে
নির্বাপিত করা উচিত। নবী করীম (স.) বলেন,وَنِسَاؤُكُمْ مِنْ أَهْلِ
الْجَنَّةِ الْوَدُوْدُ الْعَؤُوْدُ عَلَى زَوْجِهَا، الَّتِيْ إِذَا غَضِبَ
جَاءَتْ حَتَّى تَضَعَ يَدَهَا فِيْ يَدِهِ، ثُمَّ تَقُوْلُ: لاَ أَذُوْقُ غَمْضًا
حَتَّى تَرْضَى- ‘তোমাদের স্ত্রীরাও
জান্নাতী হবে; যে স্ত্রী অধিক প্রণয়িণী, সন্তানদাত্রী, ভুল
করে বার বার স্বামীর নিকট আত্মসমর্পণকারিণী,
যার
স্বামী রাগ করলে সে তার নিকট এসে তার হাতে হাত রেখে বলে, আপনি
রাযী (ঠান্ডা) না হওয়া পর্যন্ত আমি ঘুমাব না’।–( বায়হাক্বী, শু‘আবুল
ঈমান হা/৮৩৫৮; ছহীহাহ হা/২৮৭)
স্মর্তব্য যে, স্বামী-স্ত্রীর
মাঝে বিচ্ছেদ ঘটাতে শয়তান বড় তৎপর। সমুদ্রের উপর নিজ সিংহাসন পেতে মানুষকে বিভ্রান্ত
করতে তার বাহিনী পাঠিয়ে দেয়। সবচেয়ে যে বড় ফিৎনা সৃষ্টি করতে পারে সেই হয় তার অধিক
নৈকট্যপ্রাপ্ত। কে কি করেছে তার হিসাব নেয় ইবলীস। প্রত্যেকে এসে বলে, আমি
এটা করেছি, আমি ওটা করেছি। (চুরি, ব্যভিচার, হত্যা
প্রভৃতি সংঘটন করেছি)। কিন্তু ইবলীস বলে,
কিছুই
করনি! অতঃপর যখন একজন বলে, আমি স্বামী-স্ত্রীর মাঝে
রাগারাগি সৃষ্টি করে উভয়ের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ছেড়েছি। তখন শয়তান উঠে এসে তাকে
আলিঙ্গন করে বলে, হ্যাঁ, তুমিই
কাজের কাজ করেছ!-( মুসলিম
হা/২৮১৩; মিশকাত হা/৭১; ছহীহাহ
হা/৩২৬১)
সুতরাং রাগের সময় শয়তানকে সহায়তা ও তুষ্ট করা কোন মুসলিম দম্পতির কাজ নয়।
স্ত্রীর
নিকটে স্বামীর হক :
স্বামীর উপরে স্ত্রীর যেমন হক আছে, তেমনি
স্ত্রীর উপরেও স্বামীর হক আছে। স্ত্রী এসব হক বা অধিকার যথাযথভাবে আদায় করলে সংসার
সুখের হবে। তাদের মাঝে কখনো কোন অশান্তি বাসা বাঁধতে পারবে না। নিম্নে কয়েকটি হক
উল্লেখ করা হ’ল।-
১.
স্বামীর অপসন্দনীয় কাউকে বাড়ীতে প্রবেশ করতে না দেওয়া : স্বামী অপসন্দ করে এমন কোন লোককে বাড়ীতে বা
নিজের কাছে প্রবেশ করতে দেওয়া স্ত্রীর জন্য উচিত নয়। রাসূল (স.) বলেন,وَلَكُمْ عَلَيْهِنَّ أَنْ لاَ يُوْطِئْنَ فُرُشَكُمْ أَحَدًا تَكْرَهُوْنَهُ- ‘তাদের প্রতি তোমাদের অধিকার এই যে, তোমরা
যাদেরকে পসন্দ কর না তারা যেন সেসব লোককে দিয়ে তোমাদের বিছানা না মাড়ায়’।–( মুসলিম হা/১২১৮; ইবনু
মাজাহ হা/১৮৫১; মিশকাত হা/২৫৫৫)
অন্যত্র
তিনি বলেন, وَلاَ تَأْذَنَ فِى بَيْتِهِ
إِلاَّ بِإِذْنِهِ، ‘স্বামীর অনুমতি ব্যতীত অন্য কাউকে তার গৃহে
প্রবেশ করতে দেবে না’।–( বুখারী হা/৫১৯৫; মুসলিম
হা/১০২৬; মিশকাত হা/২০৩১)
২.
স্বামীর অনুমতি ব্যতীত নফল ছিয়াম না রাখা : স্বামী উপস্থিত থাকাবস্থায় তার অনুমতি ব্যতীত নফল ছিয়াম
রাখা স্ত্রীর জন্য বৈধ নয়। রাসূল (স.) বলেন,لاَ يَحِلُّ لِلْمَرْأَةِ أَنْ
تَصُومَ وَزَوْجُهَا شَاهِدٌ إِلاَّ بِإِذْنِهِ، ‘যখন
স্বামী উপস্থিত থাকবে, তখন স্বামীর অনুমতি ব্যতীত
মহিলার জন্য (নফল) ছিয়াম পালন করা বৈধ নয়’।–(বুখারী
হা/৫১৯৫; মুসলিম হা/১০২৬; মিশকাত
হা/২০৩১)
৩.
স্বামীর অনুমতি ব্যতীত বাড়ীর বাইরে না যাওয়া : নারীর কাজ বাড়ীর ভিতরে। তাই বাড়ীর অভ্যন্তরে
অবস্থান করা তার কর্তব্য। আল্লাহ বলেন,وَقَرْنَ فِيْ بُيُوْتِكُنَّ
وَلاَ تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى ‘আর
তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে। প্রাচীন জাহেলী যুগের ন্যায় সৌন্দর্য প্রদর্শন করে
বেড়িয়ো না’। (সূরা আহযাব-৩৩/৩৩) কোন যরূরী প্রয়োজনে তাকে বাড়ীর বাইরে যেতে হ’লে
স্বামীর অনুমতি নিয়ে যেতে হবে এবং শারঈ পর্দা বজায় রেখে যেতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তুমি মুমিন নারীদের বলে দাও, তারা
যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাযত করে। আর তারা যেন
তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তবে যেটুকু স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ পায় সেটুকু
ব্যতীত। আর তারা যেন তাদের মাথার কাপড় বক্ষদেশের উপর রাখে’। (সূরা নূর-২৪/৩১) রাসূল (স.) বলেন, إِنَّهُ قَدْ أُذِنَ لَكُنَّ أَنْ تَخْرُجْنَ لِحَاجَتِكُنَّ ‘আল্লাহ প্রয়োজনে তোমাদেরকে বাইরে যাবার
অনুমতি দিয়েছেন’।–(বুখারী
হা/৪৭৯৫; মুসলিম হা/২১৭০)
স্বামীর বিনা অনুমতিতে বাড়ীর বাইরে, পিতার
বাড়ী, বোনের বাড়ী,
মার্কেট
বা অন্য কোথাও না যাওয়া পতিভক্তির পরিচায়ক। এমনকি ছালাত আদায়ের জন্য মসজিদে গেলেও
স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। মায়ের কোল ছেড়ে বাইরে গেলে যেমন শিশু ঝড়-বৃষ্টি, শীত-গ্রীষ্ম
প্রভৃতি দুর্যোগে নিজেকে বিপদে ফেলে,
মুরগীর
কোল ছেড়ে বাচ্চারা দূরে গেলে যেমন বিভিন্ন হিংস্র প্রাণীর হামলার শিকার হয়, ঠিক
তেমনি নারীও স্বামীর নির্দেশ উপেক্ষা করে একাকী বাইরে গেলে নানাবিধ দুর্ঘটনার
শিকার হওয়ার আশংকা থাকে।
ধর্ম-কর্ম ও নৈতিকতাকে কবর দিয়ে অনেক
উচ্চশিক্ষিতা মহিলা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে মোটা অংকের টাকা উপার্জন করে।
স্বামীর তোয়াক্কা না করে পার্থিব সুখ ভোগ করা বস্ত্তবাদী ও পরকালে অবিশ্বাসীদের
বৈশিষ্ট্য। পক্ষান্তরে ধর্মীয় নির্দেশ পালন ও নীতি-নৈতিকতা বজায় রেখে পার্থিব
কর্তব্য পালন করা পরকালে বিশ্বাসী মুসলিম নারীর একমাত্র বৈশিষ্ট্য। কারণ মুসলমানের
মূল লক্ষ্য হ’ল পরকালীন মুক্তি। মুসলিম দু’দিনের
সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে পরকাল হারাতে রাযী নয়। সে চায় চিরস্থায়ী আবাস ও অনন্ত সুখের
ঠিকানা জান্নাত। এজন্যই নবী করীম (স.) দো‘আ করতেন,وَلاَ تَجْعَل الدُّنْيَا أَكْبَرَ هَمِّنَا وَلاَ مَبْلَغَ
عِلْمِنَا ‘দুনিয়াকে আমাদের বৃহত্তম
চিন্তার বিষয় ও আমাদের জ্ঞানের শেষ সীমা (মূল লক্ষ্য) করে দিও না’।–( তিরমিযী হা/৩৫০২; মিশকাত
হা/২৪৯২, সনদ হাসান)
৪. স্বামীকে সম্মান করা ও তার অনুগত থাকা : স্ত্রীর কাছে স্বামী অতি সম্মান ও মর্যাদার
পাত্র। তার সম্মানের কথা হাদীছে এভাবে উল্লিখিত হয়েছে,لَوْ كُنْتُ آمِرًا أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لِغَيْرِ اللهِ
لأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ
بِيَدِهِ لاَ تُؤَدِّى الْمَرْأَةُ حَقَّ رَبِّهَا حَتَّى تُؤَدِّىَ حَقَّ
زَوْجِهَا وَلَوْ سَأَلَهَا نَفْسَهَا وَهِىَ عَلَى قَتَبٍ لَمْ تَمْنَعْهُ- ‘যদি আমি কাউকে নির্দেশ দিতাম আল্লাহ ব্যতীত
অন্যকে সিজদা করার, তাহ’লে
স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করার জন্য। যাঁর হাতে মুহাম্মাদের
প্রাণ তাঁর কসম! কোন নারী তার প্রতিপালকের হক ততক্ষণ পর্যন্ত আদায় করতে পারবে না
যতক্ষণ না সে তার স্বামীর হক আদায় করেছে। সওয়ারীর পিঠে থাকলেও স্বামী যদি তার মিলন
চায়, তবে সে বাধা দিতে পারবে না’।–(ইবনু মাজাহ হা/১৮৫৩; ছহীহাহ
হা/১২০৩)
অন্যত্র তিনি বলেন,حَقُّ الزَّوْجِ عَلَى زَوْجَتِهِ، أَنْ لَوْ كَانَتْ قَرْحَةٌ
فَلَحَسَتْهَا مَا أَدَّتْ حَقَّهُ ‘স্ত্রীর কাছে স্বামীর এরূপ
হক আছে যে, স্ত্রী যদি স্বামীর দেহের
ঘা চেটেও থাকে তবুও সে তার যথার্থ হক আদায় করতে পারবে না’।–( ছহীহুল জামে‘ হা/৩১৪৮; আত-তালীকুল
হাসান, হা/৪১৫২)
তাই স্বামীর শরী‘আত
সম্মত সকল কাজে সহযোগিতা করা এবং তার বৈধ নির্দেশ মেনে নেওয়া স্ত্রীর জন্য আবশ্যক।
আল্লাহ বলেন,فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ
حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللهُ- ‘অতএব সতী-সাধ্বী স্ত্রীরা হয় অনুগত এবং আল্লাহ যা হেফাযত
করেছেন, আড়ালেও (সেই গুপ্তাঙ্গের) হেফাযত করে’ (নিসা ৪/৩৪)। আর স্বামীর আনুগত্যে অশেষ ছওয়াব রয়েছে। রাসূল (স.) বলেন,الْمَرْأَةُ إِذَا صَلَّتْ خَمْسَهَا وَصَامَتْ شَهْرَهَا
وَأَحْصَنَتْ فَرْجَهَا وَأَطَاعَتْ زَوْجَهَا فَلْتَدْخُلْ مِنْ أَيِّ أَبْوَابِ
الْجَنَّةِ شَاءَتْ- ‘মহিলা তার পাঁচ ওয়াক্তের
ছালাত আদায় করলে, রামাযানের ছিয়াম পালন করলে, লজ্জাস্থানের
হিফাযত করলে ও স্বামীর আনুগত্য করলে জান্নাতের যে কোন দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে
পারবে’।–( মিশকাত হা/৩২৫৪, সনদ
ছহীহ)
স্বামী-স্ত্রীর
যৌথ কর্তব্য :
স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য আলাদাভাবে ইতিপূর্বে
আলোচনা করা হয়েছে। এখানে স্বামী-স্ত্রীর কিছু যৌথ কর্তব্য আলোচনা করা হ’ল।
ক.
সন্তানদের সামনে ঝগড়া-বিবাদ না করা : দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোন সময় মনোমালিন্য হ’তে
পারে। এসব কোন কোন ক্ষেত্রে বাক-বিতন্ডার পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। কিন্তু ঝগড়া-ঝাটি ও
বাক-বিতন্ডা সন্তানদের সামনে করা বা তাদের সামনে অপ্রীতিকর কোন কিছু প্রকাশ করা
উচিত নয়। এতে সন্তানদের মনে একটা বিরূপ প্রভাব পড়ে। যা তাদের কোমল হৃদয়ে গভীর
ক্ষতের সৃষ্টি করে। কোন কোন সময় সন্তানরা বিপাকে পড়ে যায়। যেমন কখনও পিতা বলে, তুমি
তোমার মায়ের সাথে কথা বলবে না, আমার সাথে থাকবে। আবার মা
বলে, তুমি তোমার পিতার সাথে কথা বলবে না, আমার
কাছে থাকবে। আবার কখনও সন্তানরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কেউ
পিতার পক্ষে, কেউ মায়ের পক্ষে যায়। এতে
পরিবারে অশান্তি নেমে আসে। কাজেই স্বামী-স্ত্রী উভয়ই সন্তানদের সামনে ঝগড়া-বিবাদ
করা থেকে বিরত থাকবে এবং দু’জনের মাঝের অসন্তোষ ও
রাগ-অভিমান সন্তানরা যাতে বুঝতে না পারে সে চেষ্টা করা তাদের জন্য যরূরী।
খ. যার
দ্বীনদারী সন্তোষজনক নয় তাকে বাড়ীতে প্রবেশ করতে না দেওয়া : স্বামী-স্ত্রীর অন্যতম করণীয় হ’ল, যার
দ্বীনদারী সন্তোষজনক নয়, এমন নারী-পুরুষকে বাড়ীতে
প্রবেশ করতে না দেওয়া। যাতে তারা বাড়ীতে প্রবেশ করে কোন ফিৎনা সৃষ্টি করতে না
পারে। রাসূল (স.) বলেন, وَمَثَلُ جَلِيْسِ السُّوْءِ
كَمَثَلِ صَاحِبِ الْكِيْرِ إِنْ لَمْ يُصِبْكَ مِنْ سَوَادِهِ أَصَابَكَ مِنْ
دُخَانِهِ-ٍ ‘আর অসৎ লোকের সংসর্গ হ’ল
কামারের সদৃশ। যদিও কালি ও ময়লা না লাগে,
তবে
তার ধূয়া থেকে রক্ষা পাবে না’।–( আবু দাউদ হা/৪৮২৯; ছহীহুল
জামে‘ হা/৫৮৩৯)
অন্যত্র
তিনি বলেন,مَثَلُ الْجَلِيْسِ الصَّالِحِ
وَالسَّوْءِ كَحَامِلِ الْمِسْكِ وَنَافِخِ الْكِيْرِ، فَحَامِلُ الْمِسْكِ إِمَّا
أَنْ يُحْذِيَكَ، وَإِمَّا أَنْ تَبْتَاعَ مِنْهُ، وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ مِنْهُ
رِيْحًا طَيِّبَةً، وَنَافِخُ الْكِيْرِ إِمَّا أَنْ يُحْرِقَ ثِيَابَكَ، وَإِمَّا
أَنْ تَجِدَ رِيْحًا خَبِيْثَةً- ‘সৎসঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর
দৃষ্টান্ত হ’ল,
কস্ত্তরীওয়ালা
ও কামারের হাপরের ন্যায়। কস্ত্তরীওয়ালা হয়তো তোমাকে কিছু দান করবে কিংবা তার নিকট
হ’তে তুমি কিছু খরিদ করবে কিংবা তার নিকট হ’তে
তুমি সুবাস পাবে।
আর
কামারের হাপর হয়তো তোমার কাপড় পুড়িয়ে দিবে কিংবা তুমি তার নিকট হ’তে
দুর্গন্ধ পাবে’।–( বুখারী হা/৫৫৩৪; মুসলিম
হা/২৬২৮; মিশকাত হা/৫১১০)
অর্থাৎ দ্বীনহীন লোক বিভিন্ন ধরনের
ফেৎনা-ফাসাদ দ্বারা পরিবারে অশান্তির আগুন জ্বেলে দিবে। এমন অনেক ফাসাদ সৃষ্টিকারী
ও সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টিকারী আছে যে, বাড়ীতে যাদের যাতায়াতের
কারণে পরিবারের সদস্যদের মাঝে শত্রুতা,
স্বামী-স্ত্রীর
মাঝে মতপার্থক্য, বিভেদ-বিচ্ছেদ এবং পিতা ও
সন্তানদের মাঝে দুশমনী সৃষ্টি হয়। কখনো বাড়ীতে যাদু করা, চুরি-ডাকাতি
হওয়া ইত্যাকার ঘটনা ঘটে দ্বীনহীন নারী-পুরুষের বাড়ীতে যাতায়াতের ফলে। তাই
স্বামী-স্ত্রীকে এধরনের নারী-পুরুষকে বাড়ীতে প্রবেশ করা থেকে সতর্ক হ’তে
হবে। যদিও তারা প্রতিবেশী কিংবা বাহ্যিকভাবে বন্ধুও হয়। ফাসাদ সৃষ্টিকারী বলে জানা
গেলে এবং বাড়ীতে প্রবেশ করার অনুমতি চাইলে তাকে প্রবেশ করতে না দেয়াই কর্তব্য।
এক্ষেত্রে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। রাসূল (স.) বলেন,فَأَمَّا حَقُّكُمْ عَلَى نِسَائِكُمْ فَلاَ يُوْطِئْنَ فُرُشَكُمْ
مَنْ تَكْرَهُوْنَ وَلاَ يَأْذَنَّ فِىْ بُيُوْتِكُمُ لِمَنْ تَكْرَهُوْنَ- ‘তাদের প্রতি তোমাদের অধিকার এই যে, তোমরা
যাদেরকে পসন্দ কর না তারা যেন সেসব লোককে দিয়ে তোমাদের বিছানা পদদলিত না করায় এবং
যেসব লোককে অপসন্দ কর তাদেরকে বাড়ীতে প্রবেশের অনুমতি না দেয়’।–( তিরমিযী হা/১১৬৩; ইবনু
মাজাহ হা/১৮৫১; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৮৮০)
গ.
পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা : স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি স্নেহ-ভালবাসা বজায় রাখা পরিবারে
সম্প্রীতি-সদ্ভাব বৃদ্ধির অন্যতম উপায়। এজন্য রাসূল (স.) জাবের (রাঃ)-কে বলেন,فَهَلاَّ جَارِيَةً تُلاَعِبُهَا وَتُلاَعِبُكَ، وَتُضَاحِكُهَا
وَتُضَاحِكُكَ- ‘কুমারী (বিবাহ) করলে না
কেন? তুমি তার সাথে খেলতে,
সেও
তোমার সাথে খেলত। তুমি তাকে হাসাতে,
সেও
তোমাকে হাসাত’।–( বুখারী হা/৫৩৬৭; মুসলিম
হা/৭১৫)
অন্যত্র তিনি বলেন,كُلُّ شَيْءٍ لَيْسَ فِيهِ ذِكْرُ اللهِ فَهُوَ لَهْوٌ وَلَعِبٌ
إِلَّا أَرْبَعَ، مُلَاعَبَةُ الرَّجُلِ امْرَأَتَهُ، وَتَأْدِيبُ الرَّجُلِ
فَرَسَهُ، وَمَشْيُهُ بَيْنَ الْغَرَضَيْنِ، وَتَعْلِيمُ الرَّجُلِ السَّبَّاحَةَ- ‘যে বস্ত্ততে আল্লাহর যিকির উল্লেখ করা হয় না
তা একটি নিরর্থক ও কৌতুক। কিন্তু চারটি বস্ত্ত এমন রয়েছে, যা
তার অন্তর্ভুক্ত নয়- (১) পুরুষের স্বীয় স্ত্রীর সাথে খেলাধূলা করা (২) কারো ঘোড়াকে
প্রশিক্ষণ দেওয়া (৩) দু’টিলার মধ্যস্থল দিয়ে ঘোড়া দৌড়ানো (৪) কাউকে
সাঁতার শিক্ষা দেওয়া’।–( নাসাঈ, আস-সুনানুল
কুবরা, ছহীহুল জামে‘ হা/৪৫৩৪)
উপরোক্ত হাদীছদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রীর
সাথে হাসি-তামাশা করা ও মাঝে-মধ্যে বৈধ খেলাধূলা করায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে
ভালবাসা বৃদ্ধি পায়, পারস্পরিক সম্পর্কের
সেতুবন্ধন আরো সুদৃঢ় ও মযবূত হয়। পক্ষান্তরে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মহববত না থাকলে
সংসারে সুখ-শান্তি থাকে না; পরিবার পরিণত হয় অশান্তির
আকরে।
ঘ.
সন্তানদের স্নেহ করা : স্বামী-স্ত্রী উভয়ের উচিত
সন্তানদের আদর-স্নেহ করা। সর্বদা ধমক দেওয়া,
রাগারাগি
করা, শাসনের সুরে কথা বলা উচিত নয়। বরং সন্তানদের স্নেহ করা
আবশ্যক। হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে
বর্ণিত, আক্বরা‘ বিন হাবেস (রাঃ) দেখলেন যে, নবী
করীম (স.) হাসানকে চুম্বন করছেন। তখন তিনি বললেন, আমার
দশটি ছেলে, আমি তাদের কাউকে চুমা
দেইনি। তখন রাসূল (স.) বললেন, ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি দয়া
করে না, তাকে দয়া করা হয় না’।–( বুখারী হা/৫৯৯৭; মুসলিম
হা/২৩১৮)
ঙ.
নিন্দিত স্বভাব প্রতিহত করা : কোন ব্যক্তি ও পরিবার মিথ্যা বলা, গীবত-তোহমত, চোগলখুরী
করা ও অনুরূপ দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত নয়। এসব থেকে পরিবারের সদস্যদের বিরত রাখার
চেষ্টা করা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের কর্তব্য। আয়েশা (রাঃ) বলেন,مَا كَانَ خُلُقٌ أَبْغَضَ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه
وسلم مِنَ الْكَذِبِ وَلَقَدْ كَانَ الرَّجُلُ يُحَدِّثُ عِنْدَ النَّبِىِّ صلى
الله عليه وسلم بِالْكِذْبَةِ فَمَا يَزَالُ فِىْ نَفْسِهِ حَتَّى يَعْلَمَ
أَنَّهُ قَدْ أَحْدَثَ مِنْهَا تَوْبَةً. ‘মিথ্যা হ’তে অধিক ঘৃণিত চরিত্র
রাসূলুল্লাহ (স.)-এর নিকট আর কিছুই ছিল না। রাসূল (স.)-এর সামনে কেউ মিথ্যা বললে
তা অবিরত তার মনে থাকত, যে পর্যন্ত না তিনি জানতে
পারতেন যে, মিথ্যাবাদী তার মিথ্যা কথন
হ’তে তওবা করেছে’।–( তিরমিযী হা/১৯৭৩; ছহীহাহ
হা/২০৫২।
তিনি আরো বলেন,كَانَ إِذَا اطَّلعَ عَلَى أَحَدٍ مِّنْ أَهْلِ بَيْتِهِ كَذَبَ
كَذْبَةً لَمْ يَزَلْ مُعْرِضاً عَنْهُ حَتَّى يُحْدِثَ تَوْبَةً، ‘রাসূল (স.) পরিবারের কাউকে মিথ্যা বলতে শুনলে
তিনি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতেন, যতক্ষণ সে তওবা না করত’।–( ছহীহুল জামে‘ হা/৪৬৭৫)
অনেকের ধারণা যে মানুষকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনার
জন্য মারধরের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু উপরোক্ত দু’টি
হাদীছ প্রমাণ করে যে, মানুষ থেকে মুখ ফিরিয়ে
রাখা এবং তাদেরকে পরিত্যাগ করা প্রহারের চেয়েও কঠিন যন্ত্রণাদায়ক হয়। কোন কোন
ক্ষেত্রে এটা মারধরের চেয়ে অধিক ব্যথাতুর হয়। তাই মানুষকে সংশোধনের জন্য এ পদ্ধতি
অবলম্বন করা রাসূলের শিক্ষার অন্তর্গত।
চ.
সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করা : প্রযুক্তির উন্নয়নের যুগে সর্বত্র প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে।
তদ্রূপ মানুষের জীবনযাত্রায় এসেছে অনেক পরিবর্তন। পরিবারের আবশ্যকীয় কাজও অনেক সহজ
হয়েছে। স্ত্রীর দিকে খেয়াল করে স্বামীর সামর্থ্য অনুযায়ী পরিবারের ঐ প্রয়োজনীয়
জিনিসগুলি সংগ্রহ করে দেওয়া স্বামীর কর্তব্য। যাতে সংসারের কাজ-কর্মে স্ত্রীর কষ্ট
কিছুটা হ’লেও লাঘব হয়, কাজের
চাপ ও পরিশ্রম কমে এবং সময় বাঁচে। তবে খেয়াল করতে হবে এসব সংগ্রহ করতে যেন
স্বামীকে অসদুপায় অবলম্বন করতে না হয় কিংবা এসব যেন অপচয়ের কারণ না হয়।
ছ.
পরিবারের অসুস্থ সদস্যের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য দেওয়া : পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতি
বিশেষ লক্ষ্য রাখা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের কর্তব্য। আয়েশা (রাঃ) বলেন, كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا مَرِضَ
أَحَدٌ مِنْ أَهْلِهِ نَفَثَ عَلَيْهِ بِالْمُعَوِّذَاتِ، ‘রাসূলুল্লাহ
(স.)-এর পরিবারবর্গের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি মু‘আববিযাত
(সূরা ফালাক্ব ও নাস) পড়ে তাকে ফুঁক দিতেন’।–( মুসলিম হা/২১৯২)
তিনি আরো বলেন, রাসূলুল্লাহ
(স.)-এর পরিবারের লোকদের জ্বর হ’লে তিনি দুধ ও ময়দা সহযোগে
তরল পথ্য বানানোর নির্দেশ দিতেন। তা প্রস্ত্তত হ’লে
তিনি পরিবারের লোকদের নির্দেশ দিতেন এটা হ’তে রোগীকে পান করাতে। তিনি বলতেন,
এটা
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে শক্তি যোগায় এবং রোগীর মনের ক্লেশ ও দুঃখ দূর করে। যেমন
তোমাদের কোন মহিলা পানি দ্বারা তার মুখমন্ডলের ময়লা পরিষ্কার করে থাকে’।–( তিরমিযী হা/২০৩৯; ছহীহুল
জামে‘ হা/৪৬৪৬)
এছাড়া বিভিন্ন ক্ষতিকর মুহূর্ত ও অনিষ্টকর
জিনিস থেকে রাসূল (স.) উম্মতকে সাবধান করেছেন। তিনি বলেন,إِذَا اسْتَجْنَحَ {اللَّيْلُ} أَوْ كَانَ جُنْحُ اللَّيْلِ
فَكُفُّوْا صِبْيَانَكُمْ، فَإِنَّ الشَّيَاطِيْنَ تَنْتَشِرُ حِينَئِذٍ، فَإِذَا
ذَهَبَ سَاعَةٌ مِنَ الْعِشَاءِ فَحُلُّوْهُمْ وَأَغْلِقْ بَابَكَ، وَاذْكُرِ
اسْمَ اللهِ، وَأَطْفِئْ مِصْبَاحَكَ، وَاذْكُرِ اسْمَ اللهِ، وَأَوْكِ سِقَاءَكَ،
وَاذْكُرِ اسْمَ اللهِ، وَخَمِّرْ إِنَاءَكَ، وَاذْكُرِ اسْمَ اللهِ، وَلَوْ
تَعْرُضُ عَلَيْهِ شَيْئًا ‘যখন রাত শুরু হয় অথবা
(বলেছেন,) যখন রাতের অন্ধকার নেমে
আসে তখন তোমরা তোমাদের শিশুদেরকে ঘরে আটকে রাখবে। কারণ এ সময় শয়তানেরা ছড়িয়ে পড়ে।
অতঃপর যখন রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হবে তখন তাদের ছেড়ে দিতে পার আর তুমি তোমার
ঘরের দরজা বন্ধ করে দাও এবং আল্লাহর নাম স্মরণ কর (বিসমিল্লাহ বল)। তোমাদের ঘরের
বাতি নিভিয়ে দাও এবং বিসমিল্লাহ বল। তোমার পানি রাখার পাত্রের মুখ ঢেকে রাখ এবং
বিসমিল্লাহ বল। তোমার বাসনপত্র ঢেকে রাখ এবং বিসমিল্লাহ বল। সামান্য কিছু হ’লেও
তার ওপর দিয়ে রেখে দাও’।–( বুখারী হা/৩২৮০, ৩৩০৪; মুসলিম
হা/২০১২; মিশকাত হা/৪২৯৪)
এ হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, রাসূলুল্লাহ
(স.) পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিকর বিষয় থেকে রক্ষার জন্য সর্বদা তাদের সতর্ক করতেন।
উপসংহার
:
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, পরিবারে
ইসলামী অনুশাসন কায়েম করলে, স্বামী-স্ত্রী উভয়ে
স্ব-স্ব দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করলে এবং একে অপরের হক আদায় করলে পারিবারিক জীবনে
বইবে শান্তির মৃদু সমীরণ; পরিবার হবে সুখের আকর।
সম্প্রীতি-সদ্ভাব আর প্রীতির বন্ধনে সবাই থাকবে আবদ্ধ। এজন্য নারীস্বাধীনতা ও
নারীমুক্তির নামে আন্দোলন-সংগ্রাম,
সভা-সমাবেশ
ইত্যাদি করার কোন দরকার হবে না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে অনুরূপ পরিবার গঠনের তাওফীক
দিন-আমীন!
No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com