Thursday, February 17, 2022

ইসলামে-পর্দা ও সামাজিক শৃঙ্খলা

 


ইসলামে-পর্দা ও সামাজিক শৃঙ্খলা

এম এ রাজ্জাক হাওলাদার 

ভুমিকা:

    পর্দা (হিযাব) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে আবরণ বা অন্তরাল যাকে ইংরেজীতে বলে (Curtain) অথবা  cloak covering the whole body.  আর শরীয়তের পরিভাষায়, ইসলামের বিধান অনুযায়ী নারী-পুরুষ প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ ঢেকে রাখার নামই হিযাব বা পর্দা নারী-পুরুষ প্রত্যেকের জন্যই পর্দা করা ফরজ পর্দা সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুলআলামীন তাঁর মহাগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীমের এশরাদ করেছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوا وَتُسَلِّمُوا عَلَى أَهْلِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ

হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্য গৃহে প্রবেশ করো না, যে পর্যন্ত আলাপ-পরিচয় না কর এবং গৃহবাসীদেরকে সালাম না কর। এটাই তোমাদের জন্যে উত্তম, যাতে তোমরা স্মরণ রাখ।(সূরা নুর-২৪:২৭)

হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي زُرْعَةَ، عَنْ جَرِيرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، قَالَ: «سَأَلْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ نَظَرِ الْفُجَاءَةِ فَأَمَرَنِي أَنْ أَصْرِفَ بَصَرِي»

হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (.)-কে এই মর্মে প্রশ্ন করেছিলাম যে, হঠাৎ যদি কোন মহিলার উপর দৃষ্টি নিপতিত হয়, তাহলে কি করতে হবে? হুযুর (.) আমাকে নির্দেশ দিলেন যে, তুমি তোমার দৃষ্টিকে কালবিলম্ব না করে ফিরিয়ে নিবে (সহীহ মুসলিম-২১৫৯; শামেলা-৪৫)

পর্দা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান:

পর্দা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এটি মহান আল্লাহর একটি বিশেষ নির্দেশ। পবিত্র কুরআন মাজিদের বেশ কয়েকটি সূরায় পর্দাসংক্রান্ত বিধিবিধানের আলোচনা করা হয়েছে। পর্দার নিয়ে মহান আল্লাহ সব শ্রেণীর মুমিন নারী-পুরুষকে সম্বোধন করেছেন। মহানবী (স.)-কে আদেশ করেছেন তিনি যেন তাঁর স্ত্রী, কন্যা এবং মুমিন নারীদেরকে চাদর দিয়ে নিজেদেরকে আবৃত রাখার আদেশ প্রদান করেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا

হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলে দিন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আল-আহজাব-৩৩: ৫৯)

কিছু আয়াতে আল্লাহ উম্মুল মুমিনিনগণকেও সম্বোধন করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে,

يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا (32) وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا

হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তবে তোমরা পরপুরুষের সাথে কোমল আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। তোমরা নিজেদের গৃহে অবস্থান করবে। জাহেলি যুগের নারীদের ন্যায় সৌন্দর্য প্রদর্শন করবে না। নামাজ কায়েম করবে, জাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে। (সূরা আল-আহজাব-৩৩: ৩২-৩৩)

আবার কোনো কোনো আয়াতে মুমিন নারী-পুরুষদেরকেও সম্বোধন করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে,

يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ مَنْ يَأْتِ مِنْكُنَّ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ يُضَاعَفْ لَهَا الْعَذَابُ ضِعْفَيْنِ وَكَانَ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا (30)

وَمَنْ يَقْنُتْ مِنْكُنَّ لِلَّهِ وَرَسُولِهِ وَتَعْمَلْ صَالِحًا نُؤْتِهَا أَجْرَهَا مَرَّتَيْنِ وَأَعْتَدْنَا لَهَا رِزْقًا كَرِيمًا (31)

মুমিন পুরুষদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জা স্থানের হেফাজত করে। এটি তাদের জন্য পূত-পবিত্র পদ্ধতি। নিশ্চয় তারা যা কিছু করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। আর মুমিন নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জা স্থানের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক, অধিকারভুক্ত বাঁদি, যৌন কামনামুক্ত বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজসজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা আন-নূর-২৪ : ৩০-৩১)

পর্দার গুরুত্ব:

পর্দার গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী (সা:)- অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করেছেন। যেমন তিনি ইরশাদ করেছেন, দুই শ্রেণীর জাহান্নামি আমি এখনো দেখিনি। (কারণ তারা এখন নেই, ভবিষ্যতে আত্মপ্রকাশ করবে) এদের মধ্যে এক শ্রেণী হচ্ছে ওই সব মানুষ যাদের হাতে গরুর লেজের মতো চাবুক থাকবে, যা দিয়ে তারা মানুষকে প্রহার করবে। আর দ্বিতীয় শ্রেণী হচ্ছে ওই সব নারী, যারা হবে পোশাক পরিহিতা নগ্ন, যারা অন্যদের আকর্ষণকারিণী আকৃষ্টা; তাদের মাথার চুলের অবস্থা হবে উটের হেলানো কুঁজের মতো। এরা জান্নাতে যেতে পারবে না, এমনকি জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ তো এত এত দূর থেকে পাওয়া যাবে। (সহীহ মুসলিম)

অন্য হাদীসে রয়েছে,

اِنَّ النَّظْرَ سَهَمٌ مِنْ سِهَمِ اِبْلِسْسَ مَسْمُوْمُ مَنْ تَرَكَهَا مَخَافَتِىْ اَبْدَلْتُهُ  اِيْمَانًا يَجِدُ حَلاَوَتَهُ فِىْ قَلْبِهِ (ترمذى)

দৃষ্ট তো ইবলীসের বিষাক্ত তীরগুলোর মধ্যে একটি। যে ব্যক্তি আমাকে ভয় করে এ দৃষ্টি ত্যাগ করবে, তার বিনিময়ে আমি তাকে এমন ঈমান দেব, যার স্বাদ সে অন্তরে অনুভব করতে পারবে। (সুনানে তিরমিযী-; কুহাস-/৫০পৃ.)

মোটকথা, পবিত্র কুরআন হাদিসে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মুসলিম নারী পুরুষদের জন্য পর্দার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এটি শরিয়তের একটি ফরজ বিধান তথা অলঙ্ঘনীয় ইবাদত। ইসলামী শরিয়তের অনেক ইবাদতেরই কাজা, কাফফারা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কসর করার বিধান রয়েছে। যেমন মুসাফির অবস্থায় নামাজ, রোজা অসুস্থ অবস্থায় হজ প্রভৃতি। কিন্তু পর্দা এমন একটি ফরজ ইবাদত, যার কোনো কাজা বা কাফফারা হয় না।

কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, পবিত্র কুরআন সুন্নাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও মুসলিম সমাজ বিশেষ করে মুসলিম তরুণীরা পর্দার ব্যাপারে উদাসীনই থেকে যাচ্ছে। নানা কারণে মুসলিম তরুণীরা পর্দার ব্যাপারে উদাসীন হচ্ছে। এর মধ্যে একটি হলো পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের মুসলিম তরুণীরা এতটাই প্রভাবিত হয়ে পড়েছে যে, পবিত্র কুরআন সুন্নাহর বিধানও তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, পাশ্চাত্য সভ্যতা আজ সারা বিশ্বকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিকসহ সব ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের এই নেতৃত্ব অন্যান্য ভোগবাদী সমাজ সভ্যতার মতো আমাদের তরুণীদেরও আকৃষ্ট করেছে; যে কারণে ইসলামের নির্দেশনাকে পশ্চাৎমুখী আখ্যায়িত করে তারা আধুনিক সভ্যতার নামে ভিন্ন সভ্যতাকে লুফে নিয়েছে এবং পাশ্চাত্য পোশাক তাদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।

অথচ এখন পাশ্চাত্যে পারিবারিক সামাজিক শৃঙ্খলার বিপর্যয়ের কারণে তারা বৈবাহিক জীবনের চেয়ে হোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্লাব, বার নগ্নতার জীবনকে বেশি পছন্দ করছে। সেখানে অনেক শিশু জন্মগ্রহণ করছে এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করছে। আর যারা বেঁচে থাকছে তারা মাতা-পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে উটকো পরিবেশে বেড়ে উঠছে। পাশ্চাত্য সভ্যতা মানুষের জীবনধারাকে এমন একপর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে মানবতার ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এরূপ নিয়ন্ত্রণহীন, উচ্ছৃঙ্খল জীবনধারাকে মুসলিম তরুণীরা কী করে সানন্দে গ্রহণ করতে পারে?

পর্দাহীনতার কারণ:

মুসলিম তরুণীদের পর্দাহীনতার আরেকটি কারণ হচ্ছে, তাদের অনেকেই ইসলাম সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই রাখে না। অথচ ইসলামী শরিয়তের যথাযথ জ্ঞান থাকা মুসলিম নারী পুরুষের জন্য অতি জরুরি। পারিবারিক সামাজিক জীবনে আমরা আমাদের তরুণ-তরুণীদের এই শিক্ষা দিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছি। এমনকি ইসলামে যে পর্দার বিধান দেয়া হয়েছে, তা যে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ মর্যাদাকর জীবনকেই সমুন্নত রাখছে, নারীর জীবনকে সুরক্ষিত করে পবিত্রতার অবয়বে দাঁড় করাচ্ছে, এই সাধারণ বিষয়টুকুকে পর্যন্ত আমরা আমাদের মুসলিম তরুণীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছি।

তরুণীদের পর্দার প্রতি আগ্রহ হারানোর আরেকটি কারণ হলো, ইসলামের পর্দার বিধান সম্পর্কে বিভিন্ন অপপ্রচার। আমাদের দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যারা হরহামেশা বলে বেড়ান পর্দাপ্রথা নারীর অধিকার হরণ করে এবং প্রথা প্রগতির অন্তরায়। তারা মনে করে থাকেন ইভটিজিং নারীর উন্নয়ন প্রতিবন্ধকতার জন্য পর্দা দায়ী। অথচ যে সমাজে পর্দা প্রথার বিসর্জন দেয়া হয়েছে, সেখানে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তো দূরের কথা বরং সুমহান মর্যাদাকে নগ্নতা অশ্লীলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটি সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

সর্বশেষ কথা:

ইসলামী শরিয়ত নির্ধারিত পর্দার বিধান বিলুপ্ত করে পারিবারিক সামাজিক ব্যবস্থাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে নারীর মর্যাদাকে সমুন্নত করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। তাই আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা এবং পরকালে মুক্তির লক্ষ্যে পর্দার অনুশীলন করা। মহান আল্রাহ তায়ালা আমাদের সকলকে তাওফিক দান করুন। আমিন।



No comments:

Post a Comment

razzakhowlader59@gmil.com