Saturday, February 12, 2022

যৌতুক-প্রসঙ্গে ইসলামী দৃষ্টিকোণ

 


যৌতুক-প্রসঙ্গে ইসলামী দৃষ্টিকোণ

এম রাজ্জাক হাওলাদার


ভুমিকা:

যৌতুক বা পণ হল কন্যার বিবাহে পিতামাতার সম্পত্তির হস্তান্তর প্রক্রিয়া। যুধাতু থেকে নিষ্পন্ন যুতশব্দের অর্থ যুক্ত; বুৎপত্তিগত অর্থ হলো, পাত্র-পাত্রীর যুক্ত হওয়ার সময়ে অর্থাৎ বিয়ের সময় পাত্রীর জন্য যা কিছু মূল্যবান সামগ্রী দেয়া হয়, তা যৌতুক।-(সূত্র:হাবিবুর রহমান প্রণীত যার যা ধর্মপৃষ্ঠা ২৯৫)

যৌতুক সাধারণত কনে মূল্য ও স্ত্রীধন সংশ্লিষ্ট ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীত। যদিও কনে মূল্য বা কনে সেবা বর বা তার পরিবার কর্তৃক কনের পিতামাতার নিকট পরিশোধিত হয়, কিন্তু কনের পরিবার কর্তৃক বর বা তার পরিবারকে প্রদত্ত হস্তান্তরিত সম্পদ হল যৌতুক। অন্যভাবে, যৌতুক হল নববধূর নির্দিষ্ট সম্পত্তি যা বিয়ের সময় বরের মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণে থাকে।-(সুত্র:গুডি, জ্যাক (১৯৭৬)

সাধারণ অর্থে যৌতুক বলতে বিয়ের সময় বরকে কনের অভিভাবক কর্তৃক প্রদেয় অর্থ বা মূল্যবান সামগ্রীকে বুঝায়। এছাড়া বর কনের আত্মীয়, অভ্যাগত অতিথিরা সাধারনত স্বেচ্ছায় নবদম্পতিকে দিয়ে থাকেন যা তারা তাদের নতুন সংসারে সুবিধামত ব্যবহার করতে পারে। হিন্দু আইনে যৌতুককে নারীর সম্পত্তির উৎস বলা হয়এতে তার নিরঙ্কুশ অধিকার স্বীকৃত। হিন্দু সমাজে নারীরা পুরুষদের মতো একই ভাবে সম্পত্তির উত্তারিধকারী হতো না। তাই অনেক আগে থেকেই হিন্দু সমাজে নারীদেরকে বিয়ের সময়ে যৌতুক দেবার প্রচলন ছিল। কালক্রমে তা বিয়ের পণ হিসাবে আভির্ভূত হয় যা একসময় কনে পক্ষের জন্য এক কষ্টকর রীতি হয়ে দাঁড়ায়।-(সূত্র: কাজী এবাদুল হক (জানুয়ারি ২০০৩)"যৌতুক"। সিরাজুল ইসলাম)

১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধক আইন অনুসারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যদি কোন পক্ষ অপর পক্ষকে বিয়ের আগে-পরে-চলাকালীন যে কোন সময় যে কোন সম্পদ বা মূল্যবান জামানত হস্তান্তর করে বা করতে সম্মত হয় সেটাই যৌতুক বলে বিবেচ্য হবে।” (সূত্র: সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"২নভেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করাসংগ্রহের তারিখ ৪ জুন ২০১৫) 

সুতরাং বিয়ের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নন এমন কেউ ৫০০ টাকা বা তার চেয়ে কম মূল্যমানের কোন বস্তু উপহার হিসাবে কোন পক্ষকে দিলে তা যৌতুক হিসাবে বিবেচিত হবে না। তবে বিয়ের শর্ত হিসাবে এই সমপরিমান কোন কিছু আদান প্রদান করলে তা যৌতুক হিসাবে বিবেচিত হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুসারে বিয়ে স্থির থাকার শর্ত হিসাবে বা বিয়ের পণ হিসাবে প্রদত্ত অর্থ বা প্রদান করা হবে এই মর্মে কোন শর্ত যে কোন সম্পদকে যৌতুক হিসাবে বিবেচিত হবে। তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিয়ের ক্ষেত্রে বিয়ের মোহরানা যৌতুক হিসাবে বিবেচিত হবে না। প্রচলিত আইনে যৌতুক দেয়া বা নেয়া উভয়ই শাস্তীযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে এক থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল বা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হতে পারে। যৌতুক দাবী করার জন্যও একই সাজা হতে পারে। বাংলাদেশের সমাজে যৌতুকের জন্য নারীর প্রতি অসম্মান ও অত্যাচারের অনেক ঘটনা ঘটে। এমনকি যৌতুকের দাবীতে স্বামী বা তার আত্মীয় স্বজনদের দ্বারা অত্যাচারের পর হত্যাকান্ডের ঘটনাও বিঢ়ল নয়।

 

যৌতুক কি?

সাধারণ অর্থে যৌতুক বলতে বিয়ের সময় বরকে কনের অভিভাবক কর্তৃক প্রদেয় অর্থ বা মূল্যবান সামগ্রীকে বুঝায়। ... নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুসারে বিয়ে স্থির থাকার শর্ত হিসাবে বা বিয়ের পণ হিসাবে প্রদত্ত অর্থ বা প্রদান করা হবে এই মর্মে কোন শর্ত যে কোন সম্পদকে যৌতুক হিসাবে বিবেচিত হবে।

যৌতুকের ধারণা:

বিয়ে উপলক্ষে বরপক্ষ কনে পক্ষের কাছ থেকে বিয়ের আগেবিয়ের সময় কিংবা বিয়ের পরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে শর্ত আরোপ বা বিবাহের বিনিময় যে সমস্ত অর্থ সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ বা অন্য যা কিছু চাওয়া/আদায় করে তাকেই যৌতুক বলে।

 

যৌতুকের কুফল  ক্ষতিকর দিকসমুহ:

·         নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পায়

·         বহুবিবাহ  তালাক বৃদ্ধি পায়

·         কনে পক্ষের অর্থসম্পদ নষ্ট হয়

·         নির্যাতনের ফলে হত্যাত্মহত্যা  অপমৃত্যু বৃদ্ধি পায়

·         অর্থের অপচয় হয়

·         পারিবারিক সুখ শাস্তি বিনষ্ট হয়

·         লোভ বাড়ে

·         একটি পরিবার ধ্বংসের দিকে চলে যায়

·         স্ত্রীর মর্যাদা কমে যায়।

 

যৌতুক বন্ধ করার উপায়:

·         মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে

·         মেয়েদের আয় বৃদ্ধিমুলক কাজ করতে হবে

·         যৌতুক না নেয়ার জন্য ছেলে পক্ষকে আগ্রহী করে তুলতে হবে

·         যৌতুকের আইনগত দিক  শাস্তির কথা সবাইকে জানাতে হবে

·         ধর্মীয় দৃষ্টিকোনো থেকে যৌতুক হারাম তা প্রচার করতে হবে

·         পরিচিত পরিবারের ছেলে মেয়েদের মধ্যে যৌতুক ছাড়া বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে

·         সংগঠনের সদস্যদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

 

যৌতুকের আইনগত দিকসমুহ:

ক.যৌতুক নেয়া:     

দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

 যে নিবে বা যারা দিবে তাদের সবারই সাজা হবে এবং এই অপরাধ জামিন অযোগ্য  আপোষ অযোগ্য অপরাধ।

 

খ.যৌতুকের শাস্তি: যৌতুক নেয়ার জন্য শাস্তি হবে  থেকে  বছরের জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে     দন্ডিত হবে। যে ব্যক্তি যৌতুক নেয়ার ব্যপারে সহায়তা করবে তারও একই রকম শাস্তি হবে। এছাড়া যৌতুক গ্রহণ এর জন্য যদি কেউ উদ্বুদ্ধ করে বা প্ররোচিত করে সেই ব্যক্তি অপরাধী হবে এবং তারও শাস্তি হবে।

 

যৌতুকের জন্য নির্যাতন বা মৃত্যু ঘটলে তার শাস্তি:

যদি কোনো নারীর স্বামী বা স্বামীর কোনো ত্মী-স্বজন যৌতুকের কারণে-

মৃত্যু ঘটান তাহলে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড এবং আর্থিক জরিমানা

মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন তাহলে শাস্তি  হবে যাবজ্জীবন জেল এবং জরিমানা

আহত করেন তা হলে শাস্তি হবে যাবজ্জীবন জেল এবং জরিমানা

আহত করার চেষ্টা করেন তাহলে শাস্তি  হবে সর্বোচ্চ চৌদ্দ বৎসর কিন্তু সর্বন্মি  বছরের জেল এবং জরিমানা

সাধারণ জখম করার জন্য অনধিক  বৎসর কিন্তু কমপক্ষে  বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে এবং উভয় ক্ষেত্রেই উক্ত দন্ডের অতিরিক্ত অর্থ দন্ডেও দন্ডনীয় হবে।  সংক্রান্ত বিচার হবেনারী  শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে।

যৌতুক কারণ ও প্র‌তিকার

    পৃ‌থিবী এগি‌য়ে চল‌ছে ত‌ড়িৎ গ‌তি‌তে। প‌রিবর্ত‌নের দূরন্ত গ‌তিপ্রবা‌হে বদ‌লে যা‌চ্ছে প্রায় সব‌কিছুই। পালা বদ‌লের মঞ্চে অ‌নেক কিছুর হ‌চ্ছে রুপান্তর, হ‌চ্ছে আধু‌নিক‌ীকরণ। অত্যাধু‌নিক সভ্যতার হাত ধ‌রে আমা‌দের অগ্রযাত্রা অব্যাহত র‌য়ে‌ছে। আমরাও আমা‌দের ব্য‌ক্তিগত, পা‌রিবা‌রিক, সামা‌জিক ও রা‌ষ্টের অবা‌ঞ্ছিত প‌রি‌বেশ, প্রথা, প‌রি‌স্থি‌তি ও সমস্যার সমাধা‌নে য‌থোপোযু‌ক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ ক‌রে চ‌লে‌ছি। ‌কিন্তু অ‌নেক ক্ষে‌ত্রে যতটা প্রা‌প্তি যতটা অগ্রগ‌তি ঠিক কিছু কিছু ক্ষে‌ত্রে ততটা অপ্রা‌প্তি ততটা অবণতি যেন পাল্লা দি‌য়ে চল‌ছে। ক্ষুদ্র এই দেশ ব‌াংলা‌দেশ। পৃ‌থিবীর মান‌চি‌ত্রে বাংলা‌দেশ শব্দ‌টি লেখার জায়গা হয় না। তবুও বাংলা‌দেশ তার স্বকীয় বৈ‌শি‌ষ্ট্যে বি‌শ্বের দরবা‌রে আপন আসন গ্রহণ ক‌রে‌ছে। স‌ত্যিই এ প্রা‌প্তি গৌর‌বের এ প্রা‌প্তি সম্মা‌নের। লজ্জার ই‌তিহাসও যে নেই, তা‌তো নয়। তবুও আমরা আশাবাদী। তৃতীয় বি‌শ্বের দা‌রিদ্র্য পী‌ড়িত এ দেশ অজস্র সমস্যার ভা‌রে জর্জ‌রিত। আমরা যেন আমা‌দের সৃজনশীল ম‌নোভাব, আদর্শ মূল্য‌বোধ, ধর্মীয় চেতনা‌বোধ সব ধু‌লোয় লু‌ন্ঠিত কর‌ছি। হৃদ‌য়ের মহৎ প‌রিকল্পনাগু‌লো খোয়া‌তে ব‌সে‌ছি।

    সম‌য়ের পথ প‌রিক্রমায় দুষ্টক্ষ‌তের মতই বাসা বেঁ‌ধে‌ছে যৌতুক প্রথা আমা‌দের অন্ত‌রে ও সমা‌জে। আমা‌দের শরী‌রে যেমন অসংখ্য রো‌গের প্রাদুর্ভাব ঘ‌টে তেম‌নি আমা‌দের সমাজেও র‌য়ে‌ছে অজস্র রো‌গের বিস্তার ও বিচরণ। তার ম‌ধ্যে অন্যতম হ‌চ্ছে যৌতুক রোগ। সংক্রামক ব্যা‌ধির মতই যৌতুক রোগ বি‌ভিন্ন জা‌তি ও সমা‌জের র‌ন্দ্রে র‌ন্দ্রে প্র‌বেশ ক‌রে গোটা সমাজ ব্যবস্থা‌কে ভয়ংকর বিভী‌ষিকার দি‌কে ঠে‌লে দি‌চ্ছে। যৌতুক নামক প্রথা, রোগ, বাy বিষবৃক্ষ‌কে সমাজ থে‌কে সমূ‌লে উৎপাটন কর‌তে হ‌লে যৌতু‌কের কারণ, উৎপ‌ত্তি ও বিকাশ সম্ব‌ন্ধে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। যৌবন‌কে তুচ্ছ জ্ঞান করাই হ‌চ্ছে যৌতুক রোগ।‌

বি‌য়ের সময় কণ্যাপ‌ক্ষের অ‌ভিভাবক ই‌চ্ছে বা অ‌নিচ্ছায় পাত্র পক্ষ‌কে যে অর্থ সম্পদ, অলংকার, আসবাবপত্র দি‌য়ে থা‌কে তা‌কে যৌতুক ব‌লে। আর এ উপঢৌকণ প্রদা‌নের রেওয়াজ‌কে বলা হয় যৌতুক প্রথা।আবার দেখা যায়, পাত্র‌কে চাকুরীর নিশ্চয়তা দি‌য়ে কিংবা বি‌দে‌শে পাঠা‌নোর প্র‌তিশ্রু‌তি দি‌য়ে কণ্যা‌কে পাত্রস্থ করা হয়। সেটাও যৌতু‌কের আওতাভুক্ত। কখ‌নো দেখা যায় পাত্র‌কে প্র‌তি‌ষ্ঠিত হওয়ার উ‌দ্দে‌শ্যে কণ্যা প‌ক্ষের অ‌ভিভাবক পাত্র‌কে লেখাপড়া শেখা‌নোর যাবতীয় দা‌য়িত্ব গ্রহণ ক‌রেন বি‌নিম‌য়ে মে‌য়ে‌কে পা‌ত্রের নিকট বিবাহ বন্ধ‌নে আবদ্ধ করানবাস্ত‌বিক প‌ক্ষে সেটাও যৌতুক হি‌সে‌বে গণ্য হয়। কখ‌নো বা মে‌য়ের বাবা জামাই‌কে শ্বশুড় বাড়ী যাতাযা‌তের জন্য গাড়ী কি‌নে দেন অথবা মে‌য়ের সুখ শা‌ন্তি নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা বিধা‌নের জন্য বা‌ড়ি বা‌নি‌য়ে দেন সেটাও একরকম যৌতুক হি‌সে‌বে ধরা হয়।

যৌতুক প্রথা অ‌তি প্রাচীন প্রথা। তদানীন্তন হিন্দু সমা‌জে কণ্যা‌কে দশ/বার বছ‌রের ম‌ধ্যে পাত্রস্থ বা বি‌য়ে দি‌তে না পার‌লে পুরুষ নরকবাসী হ‌বেন ব‌লে ভয় দেখা‌নো হ‌তো। এমন কি সমাজ চ্যূত করার বি‌ধিও ছিল। হিন্দু সমা‌জে পিতা ও ভাতার সম্প‌দে ক‌ণের অ‌ধিকার নেই বিধায় সনাতন বা হিন্দু ধ‌র্মের বি‌ধি‌ বিধান থে‌কেই যৌতুক প্রথার প্রচলন হ‌য়ে প‌ড়ে। অর্থ ছাড়া জীবন অচল সত্য কিন্তু অ‌তি‌রিক্ত অর্থ‌লিপ্সা হ‌তেই যৌতু‌কের সৃ‌ষ্টি। যৌতু‌কের সূচনা হিন্দু সম্প্রদা‌য়ের ম‌ধ্যে সূত্রপাত হ‌লেও মুস‌লিম সমা‌জের শিরায় শিরায় আজ যৌতুক প্রথা স্থায়ী আসন দখল ক‌রে‌ছে। যৌতুক যেন অ‌ঘো‌ষিত বিধা‌নে প‌রিণত হ‌য়ে‌ছে।

         যৌতু‌কের নীল দংশ‌নে দং‌শিত হ‌চ্ছে নববধু। আগুন জ্বল‌ছে স্বামী গৃ‌হে। ভষ্ম হ‌চ্ছে সাজা‌নো গোছা‌নো ম‌নের ম‌তো সংসার। যৌতু‌কের কার‌ণে কত কুম‌ারী নারীর স্ব‌প্নের মে‌হে‌দি রঙ মু‌ছে গে‌ছে, কত অসহায় পিতা মে‌য়ে‌কে বি‌য়ে দি‌তে না পারার অক্ষমতায় আত্নহত্যা ক‌রে‌ছে অথবা মে‌য়ে পিতার অবস্থার কথা বি‌বেচনা ক‌রে আত্নহত্যা ক‌রে‌ছে তার স‌ঠিক কোন প‌রিসংখ্যান নেই ।প্র‌তি‌দিন প‌ত্রিকার পাতায় চোখ রাখ‌লে এর সত্যতা কতটুকু উপল‌দ্ধি করা যায়। মি‌ডিয়া কর্মী, সাংবা‌দিক, অনুসন্ধান কমী বি‌শেষজ্ঞ‌দের অগচ‌রেই থেকে যায় কত ঘটনা। যৌতুক যেন সভ্যতার ললা‌টে এঁ‌কে দি‌য়ে‌ছে কল‌ঙ্কের পদ‌চিহ্ন।
   নারী চিরকালই কোমলমনা, সুশীলা। নীর‌বে নিভৃ‌ত্যে সহ্য ক‌রে শ্বশুড় বাড়ীর অমান‌বিক নির্যাতন। অত্যাচার, অনাচার, উপহাস, অবজ্ঞা, অব‌হেলা যেন তা‌দের নিত্য জীবন যাপ‌নের সঙ্গী। শা‌রি‌রিক মান‌সিক যন্ত্রণা যেন তা‌দের অদৃ‌ষ্টের লিখন। ভাব‌লে অবাক হ‌য়ে যায়!! কি অসহায় আত্নসমর্পণ। মুখবু‌জে আঁচ‌লের আড়া‌লে স্রষ্টার দরবা‌রে কান্নার সান্ত্বনা বেঁ‌চে থাকার পা‌থেয়। প্র‌তিবা‌দের ভাষা যেন নারী রপ্ত কর‌তে শি‌খে‌নি।
কোম‌রে আঁচল পেঁ‌চি‌য়ে যে নারী প্র‌তিবাদ কর‌তে পা‌রে সে হয়ত কিছুটা অ‌ধিকার অর্জন কর‌তে সক্ষম হয়। কিন্তু যে বধু সহ্য ক‌রে সে হয় যৌতু‌কের ব‌লি। কখ‌নো দেখা যায় শারী‌রিক নির্যাত‌নে যখন কোন নারী মারা যায় সেটা‌কে আত্নহত্যার না‌মে চা‌লি‌য়ে দেওয়ার জন্য মু‌খে বিষ ঢে‌লে দেওয়া হয় অথবা সি‌লিং ফ্যা‌নের সা‌থে ঝু‌লি‌য়ে রাখা হয়। কখ‌নো বা লাশ‌টি পর্যন্ত গুম করা হয়। আশ্চর্য এই পুরুষ শা‌সিত সমা‌জে নারীর অবস্থান। নারী যেন এখা‌নে ভো‌গের সস্তা পণ্য, নগণ্য প্রাণী। তারা পুরু‌ষের স্বাধীনতার র‌শি‌তে বাঁধা, ই‌চ্ছে অ‌নি‌চ্ছের কারাগা‌রে বন্দী। তারা পুরু‌ষের খেলার পুতুল, সংসা‌রের স্বীকৃত দাসী।আমা‌দের দে‌শে এ যাবৎ যে সকল কুমারী নারী ও গৃহবধু আত্নহত্য‌া ক‌রে‌ছে তার শতকরা নব্বই ভাগই যৌতু‌কের কার‌ণে। যৌব‌নের মি‌স্টি মধুর বাতাস যখন একজন নারীর শরী‌রে স্পর্শ ক‌রে তখন হ‌তেই ফু‌লের মত সে মে‌য়ে‌টি বু‌কের সবুজ জ‌মি‌নে স্বামী সংসা‌রের র‌ঙিন স্বপ্ন বুন‌তে থা‌কে। কিন্তু ভা‌গ্যের নির্মম প‌রিহা‌সে স্বামীগৃ‌হে তা‌কে হ‌তে হয় দাসী, নির্যা‌তিতা নিপী‌ড়িতা গৃহবধু। চালা‌নো হয় অত্যাচা‌রের স্টীম রোলার। আল‌তা রাঙা আল‌তো পা‌য়ে, মে‌হেদী রাঙা কোমল হা‌তে প‌রি‌য়ে দেওয়া হয় দাসী‌ত্বের বেড়ী। স্বামী-স্ত্রী'র মধুর সম্পর্ক হ‌য়ে উ‌ঠে বেদনা বিধুর । নারীর ম‌নে নি‌র্মিত স্বপ্ন মিনার ভে‌ঙ্গে হয় খানখান। বাসর শয্যা হয় নির্যাতন শয্য। জীবন সংসার ফু‌লে ফু‌লে সমৃদ্ধ হওয়ার পূ‌র্বেই চ‌লে যে‌তে হয় অন্য জগতে। বু‌কের সমস্ত ভা‌লোবাসা উজাড় ক‌রে দি‌য়েও যখন একজন নারী চির আপন হ‌তে পা‌রে না সংসা‌রে তখন স্বামীর স্বর্গ সংসার হয় নরকযজ্ঞ।

নারীর অপ‌রিসীম অপ‌রি‌মেয় প্রেম, প্রী‌তি, ভা‌লোবাসা, স্নেহ-মায়া মমতা সব‌কিছুই যৌতুকের মত ভয়ংকর দান‌বের নিকট তুচ্ছ। যৌতুক প্রথার নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা ও নারী নিয়াতন আজকাল সর্বজন বি‌দিত। স্বামী বা‌ড়ির লোভী দানব‌দের লো‌ভের বা‌জেট যখন স্ত্রী তার বা‌পের বাড়ী হ‌তে অণু‌মোদন কর‌তে পা‌রে তাহ‌লে বউটা হয় খুব ভা‌লো, ঘ‌রের লক্ষ্মী। আর না পার‌লেই যত সমস্যা , যত বিপ‌ত্তি তখন বউট‌ি হয় খারাপ, অলক্ষ্মী। তার প্র‌তি‌টি কথায় লা‌গে তে‌তো, বি‌ষের ম‌তো। নিস্পাপ নারী চ‌রি‌ত্রের উপর লেপন কল‌ঙ্কের কাদা। শুরু হ‌য়ে যায় দৈ‌হিক ও মান‌সিক অকথ্য নির্যাতন নিপীড়ন। চ‌লে হত্যার চক্রান্ত, খু‌নের পাঁয়তারা। নির্যাতন নিপীড়‌নের নিত্য নতুন কৌশল উদ্ভা‌বিত হয়। কপা‌লে জো‌টে অবজ্ঞা, উপহাস আর অব‌হেলা। তিরস্কা‌রের তীক্ষ্ম ছোঁড়া তী‌রের আঘা‌তে ক্ষত‌বিক্ষত হয় বু‌কের পাঁজর। রক্তাত হয় হৃদ‌য়ের কোমল ভূ‌মি। আ‌র্শিবা‌দের পৃ‌থিবী হ‌য়ে উ‌ঠে অ‌ভিশা‌পের দ‌লিল।

স্ব‌প্নের আকা‌শে মেঘ জ‌মে, হয় বৃ‌ষ্টি। নি‌য়ে যায় সব ভা‌সি‌য়ে। ধী‌রে ধী‌রে ম‌ু‌ক্তির উপায় হি‌সে‌বে বে‌ছে নেয় আত্নহত্যা।যৌতুক প্রথার বিষ‌ ক্রিয়ায় সমা‌জে সৃ‌ষ্টি হ‌চ্ছে অ‌স্থিরতা, অশা‌ন্তি, ক্ষো‌ভের বারুদ। ঘট‌ছে সম্প‌র্কের অবণ‌তি। ঘৃণ্য যৌতুক প্রথা সমাজ রা‌ষ্টে বিশৃঙ্খলা সৃ‌ষ্টির পাশাপা‌শি সামা‌জিক কাঠা‌মো‌তে আঘাত কর‌ছে। সামা‌জিক ও রাষ্ট্রীয় প্র‌তিষ্ঠানগু‌লো‌কে ছিন্ন ভিন্ন ও ধ্বংস ক‌রে দি‌চ্ছে। র‌ক্তের বন্ধন ও সামা‌জিক সম্প‌র্কে ধর‌ছে ফাটল। নারীর মৌ‌লিক মান‌বিক অ‌ধিকার হ‌চ্ছে ক্ষুন্ন। এই যৌতুক প্রথাই হ‌চ্ছে নারী নির্যাত‌নের প্রথম ধাপ। এটা অত্যন্ত অমান‌বিক ও জঘন্য প্রকৃ‌তির সামা‌জিক নিয়ম।

একক কোন কার‌ণে যৌতুক প্রথার উদ্ভব ঘ‌টে‌নি। এর জন্য বহু‌বিধ কারণ‌কে দায়ী করা যায়। যেমনঃ-

১। আই‌নের চো‌খে নারী পুরুষ সমান মর্যদার অ‌ধিকারী হ‌লেও নারী‌কে নিম্ন সামা‌জিক মর্যাদার কার‌ণে সমা‌জে যৌতুক প্রথার বিস্তার ঘ‌টে‌ছে।

২। দা‌রিদ্রতার নিষ্ঠুর ছোবল হ‌তে মু‌ক্তির একটা মাধ্যম হি‌সে‌বে যৌতু‌কের বিকাশ ঘ‌টে‌ছে।

৩। অ‌তি‌রিক্ত সম্পদ লা‌ভের মান‌সিকতা হ‌তে যৌতু‌কের সূত্রপাত হ‌য়ে‌ছে।

৪। কণ্যার দৈ‌হিক খুঁত, অ‌ধিক বয়স, সৌন্দ‌র্য্যের বা রু‌পের অভাব প্রভৃ‌তি কার‌ণে কণ্যাপক্ষ যৌতুক দি‌য়ে বি‌য়ে‌তে রা‌জি হন।

৫। প্রকৃত শিক্ষার আ‌লো‌ক বিব‌র্জিত মান‌সিকতা যৌতু‌কের জন্য দায়ী।

৬। পা‌ত্রের বাবার ব্যবসা‌য়িক ম‌নোভাবও যৌতু‌কের প্রসা‌রে সহায়তা ক‌রে।

৭। কণ্যা সন্তা‌নের প্র‌তি পিতা মাতার অত্য‌ধিক স্নে‌হের কার‌ণে মে‌য়ের সু‌খের জন্য জামাই‌কে অর্থ সম্পদ প্রদান ক‌রে যৌতুক বৃ‌দ্ধি‌তে সহায়তা ক‌রে।

৮। কণ্যার চে‌য়ে বর বে‌শি উপযুক্ত হ‌লে মে‌য়ের অ‌ভিভাবক মোটা অং‌কের যৌতুক প্রদান ক‌রে মে‌য়ে‌কে পাত্রস্থ ক‌রে বিধায় যৌতু‌কের প্রসার ঘ‌টে।

এছাড়াও র‌য়ে‌ছে মেয়ে‌দের সামা‌জিক নিরভরতা- নিরভরতার অভাব, অ‌ভিজাত শ্রেণীভুক্ত হওয়ার বাসনা, সামা‌জিক নী‌তি, সামা‌জিক মূল্য‌বোধ, অনুকরণ প্রিয়তা, জামাই ক্র‌য়ের ম‌নোভাব, হিন্দু সমা‌জের নী‌তি ঐ‌তি‌য্যের বাড়াবা‌ড়ি ইত্যা‌দি ইত্যা‌দি।

পুঁইডাটার মতো লকল‌কি‌য়ে বে‌ড়ে উঠ‌ছে যৌতুক প্রথা এবং তা ছ‌ড়ি‌য়ে পড়‌ছে সমা‌জের সর্বস্ত‌রে। বিষাক্ত সা‌পের লালার মতই যৌতুক প্রথা দংশন কর‌ছে আমা‌দের সমাজকে আমা‌দের মূল্য‌বোধ‌কে। ধনী, গ‌রিব, উচ্চ‌বিত্ত, মধ্য‌বিত্ত, শি‌ক্ষিত-অ‌শি‌ক্ষিত কোন শাখা‌তেই এর কম‌তি নেই। শ্রেণী‌ভি‌ত্তিক যৌতু‌কের মূল্য নির্ধা‌রিত হয়। সামা‌জিক, নৈ‌তিক, মান‌বিক মূল্য‌বো‌ধের অবক্ষ‌য়ের এই যু‌গে যৌতুক প্রথা যে কলং‌কের অধ্যায় রচনা ক‌রে চ‌লে‌ছে, অদুর ভ‌বিষ্য‌তে এই প্রথার প্র‌তি‌রোধ কর‌তে না পার‌লে আমা‌দের স‌চেতন বি‌বে‌কের কবর রচনা কর‌তে হ‌বে। সৃ‌ষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হি‌সে‌বে আমা‌দের অহংকার করার অব‌শিষ্ট আর কিছুই থাক‌বে না। উপল‌দ্ধির এ সম‌য়ে নারী জা‌তির প্র‌তি অজস্র ভা‌লোবাসা, অকৃ‌ত্রিম শ্রদ্ধা ও অন্তহীন সম‌বেদনা জ্ঞাপন কর‌তে হ‌বে, ম‌নে রাখ‌তে হ‌বেঃ- যৌতুক অশা‌ন্তি ডে‌কে আ‌নে, স্বামী স্ত্রী'র মা‌ঝে ভা‌লোবাসার ঘাট‌তি আ‌নে, দাম্পত্য জীব‌নে কলহ আনয়ন ক‌রে।‌যৌতুক আর ভা‌লোবাসার মধুর মিলন একসা‌থে বাস কর‌তে পা‌রে না।

যৌতুক দেয়-‌নেয়া কোন ধ‌র্মের বিধান নয়, যৌতুক চাওয়া আর ভিক্ষা চাওয়ার মা‌ঝে কোন পার্থক্য নেই। আত্নার বন্ধ‌নে আত্নীয়তার সম্পর্ক তৈ‌রি হয়, যৌতু‌কের বি‌নিম‌য়ে নয়।‌ যৌতুক প‌রিবা‌রে ভাঙ্গ‌নের বাঁ‌শি বাজায়, যৌতু‌কের প‌রিণ‌তি কখ‌নো শুভ হয় না, যৌতুক কখ‌নো মান‌সিক সুখ শা‌ন্তি দি‌তে পা‌রেনা। যৌতুক চাওয়ার পূ‌র্বে ম‌নে রাখা উ‌চিত আপ‌নিও এক সময় মে‌য়ের পিতা হ‌বেন।

যৌতুক প্রথা সামা‌জিক কুসংস্কার ব্যতীত অন্য কিছুই নয়। ক্ষয়‌রো‌গের মতই যৌতুক প্রথা আমাদের‌কে মননশীল বি‌বেক বো‌ধের অকাল মৃত্যুর দি‌কে ঠে‌লে দেয়। যৌতুক আত্নমর্যদা‌কে ধূ‌লোয় মি‌শি‌য়ে দেয়। যৌতুক চাওয়া মা‌নে নি‌জের অক্ষমতার নির্লজ্জ ব‌হিঃপ্রকাশ। বিনাশ্র‌মে অ‌ন্যের সম্পদ পাওয়া গৌর‌বের নয় বরং লজ্জার ও ঘৃণার, অপমান ও অব‌হেলার, বঞ্চনার ও অবজ্ঞার। যৌতু‌কের বি‌নিম‌য়ে শুধু পাত্রই না, পা‌ত্রের প‌রিবার প্রত্যক্ষ প‌রোক্ষভা‌বে সবাই , পাত্রী ও পাত্রীর প‌রিবা‌রের নিকট বি‌ক্রি হ‌য়ে যায়। এর চে‌য়ে ঘৃণা, লজ্জিআর অপমা‌নের বিষয় খুব কমই আ‌ছে।

যৌতুক এক‌টি সামা‌জিক ব্যা‌ধি:

যৌতুক এক‌টি সামা‌জিক ব্যা‌ধি, এ‌টি মানবতা বি‌রোধী কুপ্রথা। এই স্বীকৃত মনুষ্য কুপ্রথা নির্মু‌লে মরা নিম্ন লি‌খিত ব্যবস্থা গ্রহণ কর‌তে পা‌রি।‌যেমনঃ-

ক। সরকারী ও বে-সরকারীভা‌বে সম‌ন্বিত উ‌দ্যোগ গ‌ড়ে তুল‌তে পা‌রি।

খ। ১৯৮০ সা‌লের যৌতুক বি‌রোধী আই‌নের প্র‌য়োগ ঘটা‌তে হ‌বে। প্র‌য়োজ‌নে নতুন ইন পাস ও বাস্তবায়ন কর‌তে হ‌বে।

গ। অ‌ভিভাবক‌দের স‌চেতন হ‌তে হ‌বে।

ঘ। শি‌ক্ষিত যুব সমাজ‌কে এগি‌য়েস‌তে হ‌বে।

ঙ। পেপার প‌ত্রিকায় যৌতুক বি‌রোধী প্র‌তি‌বেদন ছাপা‌তে হ‌বে।

চ। সমাজ থে‌কে অ‌শিক্ষা, কু‌শিক্ষা ও অজ্ঞনতা দূর ক‌রে শিক্ষার আ‌লো ছড়া‌তে হ‌বে।

ছ। অর্থ-সম্প‌দের প্র‌তি তীব্র লোভ প‌রিহার কর‌তে হ‌বে।

জ। পাঠ্যপুস্ত‌কে যৌতুক বিষয়ক প্রবন্ধ অন্তভুক্ত কর‌তে হ‌বে।

ঝ। মাদ্রাসা, মস‌জিদ তথা ধর্মীয় প্র‌তিষ্ঠান গু‌লো‌তে হুজুর ইমাম‌দের যৌতু‌কের কুফল তু‌লে ধর‌তে হ‌বে।

ঞ। ‌যৌতুক দেওয়া নেওয়া সামা‌জিক অপরাধ সেটা জনগণ‌কে অব‌হিত কর‌তে হ‌বে।

ট। হীন যৌতুক প্রথা ব‌ন্ধের জ‌ন্যে সভা-‌সে‌মিনার, কর‌তে হ‌বে।

ঠ। মান‌বিক মূল্য‌বোধ ও দৃ‌ষ্টি ভ‌ঙ্গির প‌রিবর্তন কর‌তে হ‌বে।

ড। নারী শিক্ষার প্রসার ও কর্মসংস্থা‌নের ব্যবস্থা কর‌তে হ‌বে।

ঢ। মি‌ডিয়া ও গণমাধ্য‌মের দা‌য়িত্ব স‌চেতনতা বাড়া‌তে হ‌বে।

ণ। সক‌লের সাহায্য স‌হযোগিতা র ঐ‌ক্যের একই প্লাটফর্ম তৈ‌রি কর‌তে হ‌বে।

এছাড়াও নারী‌দের‌কে ভোগ উপ‌ভো‌গের পণ্য কিংবা দাসী না ভে‌বে অর্ধাঙ্গনী ভাব‌তে হ‌বে, নারী পুরুষ সমমর্যদার অ‌ধিকারী মনে কর‌তে হ‌বে এবং যৌতুক দেব না যৌতুক নেব না এই মন মান‌সিকতা বাস্ত‌বে রুপান্ত‌রিত কর‌তে হ‌বে। লেখক, ক‌বি, সা‌হি‌ত্যিক‌দের যৌতুক বি‌রোধ‌ী লেখা প্রকাশ কর‌তে হ‌বে~ ইত্যা‌দি ইত্যা‌দি

মানু‌ষের ম‌ধ্যে যত‌দিন সামা‌জিক, নৈ‌তিক ও মান‌বিক মূল্য‌বোধ জাগ্রত হ‌বেনা তত‌দিন সমাজ থে‌কে যৌতু‌কের ম‌তো মহামারী রোগ‌কে নির্মূল করা সম্ভব হ‌বে না। সক‌লের সাহায্য, সহ‌যে‌া‌গিতা আর সহম‌র্মিতায় যৌতু‌কের ম‌তো সমাজ স্বীকৃত মহাজঘণ্য, ‌নি‌ন্দিত, অ‌ভিশপ্ত, দৈন্যদশা গ্রস্থ সমা‌জের কলংকময় অধ্যায়‌কে চিরত‌রে বিদূ‌রিত করা সম্ভব। ভিক্ষাবৃ‌ত্তি আর যৌতুক প্রথার ম‌ধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যৌতুক প্রথার অর্থ লালসার কা‌ছে তুচ্ছ ক‌রে দি‌য়ে‌ছে নারী ম‌নের স্বাভা‌বিক আ‌বেদন, প্রে‌মের পরম পাওয়া‌কে নস্যাৎ ক‌রে‌ছে তুচ্ছ বা‌নি‌জ্যিক লেন‌দেন ক‌রে। এই যৌতুক প্রথা সৃ‌ষ্টি কর‌ছে শত্রুতা, ভে‌ঙ্গে দি‌চ্ছে পা‌রি বা‌রিক স্নে‌হের বন্ধন, সৃ‌ষ্টি কর‌ছে সামা‌জিক অশা‌ন্তি, নি‌য়ে যা‌চ্ছে আদাল‌তে, দাঁড় করা‌চ্ছে কাঠগড়ায়। নববধূর বাসর শয্যা‌কে কর‌ছে এ‌লো‌মে‌লো, সৃ‌ষ্টি কর‌ছে নতুন নতুন ট্রা‌জেড‌ী, কলং‌কিত কর‌ছে সমাজ, দেশ ও জা‌তি‌কে। এই লজ্জাজনক এমন কি অপরাধ মূলক ঘৃণ্য নি‌ন্দিত যৌতুক প্রথার চির অবসান হোক এটাই আমা‌দের জাগ্রত বি‌বে‌কের একান্ত কামনা।

 যৌতুকের বহুমাত্রিক কুফল

বিয়ে মানুষের নীতি ও নৈতিকতা বৃদ্ধি করে। এর মাধ্যমে সন্তান জন্ম লাভ করে। ভবিষ্যৎ বংশধারা সুরক্ষা পায়। যদি এর সূচনা হয় লোভ, অশুচি ও অনৈতিকতার মাধ্যমে, অন্যায় উপার্জনের মধ্যমে, বিয়ের কোনো একপক্ষ বিশেষ করে কনেপক্ষকে বরপক্ষ দ্বারা শোষণের মাধ্যমে তাহলে এই ধরনের বিয়ের মধ্যে পবিত্রতা, পারস্পরিক বিশ্বাস, সহানুভূতি ও ভালোবাসা থাকে না। পবিত্রতা, পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসাহীন বিয়ের মাধ্যমে মিলন আর ব্যভিচারের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। বিয়ে ও বিয়েবহির্ভূত মিলনের মধ্যে তফাত শুধু সামাজিক বন্ধন, পবিত্রতা ও বিশ্বস্ততার। বিবাহবন্ধনের মিলনে পবিত্রতা ও বিশ্বস্ততা থাকে। আর বিয়েবহির্ভূত মিলনে তা থাকে না।

এ জন্যই ইসলাম বিয়েবহির্ভূত মিলন হারাম করে দিয়েছে। যৌতুকের বিয়ে পবিত্রতা ও বিশ্বস্ততা থাকে না। সুতরাং ব্যভিচার যদি নিষিদ্ধ হয়, হারাম হয়, অশুচি হয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়, সমাজে ঘৃণিত হয়, তাহলে যৌতুক কেন অশুচি হবে না, হারাম হবে না, সামাজিকভাবে ঘৃণিত হবে না? ব্যভিচারের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ যদি অপবিত্র হয়, ভালো কাজে ব্যয় করা নিষিদ্ধ হয়, তাহলে যৌতুকের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ কেন অপবিত্র হবে না, ভালো কাজে নিষিদ্ধ হবে না? মিশকাতুল মাসাবিহের একটি হাদিসের মর্মানুযায়ী ফেরত না দেওয়ার নিয়তে কোনো অর্থপ্রাপ্তির লোভে যে ব্যক্তি কোনো নারীকে বিয়ে করে সে একজন ব্যভিচারী।যৌতুকলোভীদের জন্য এর চেয়ে আর খারাপ কী উদাহরণ হতে পারে?

মানব বংশ রক্ষায় স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই সমান অবদান। বরং সন্তান লালন-পালনে মায়ের অবদান বেশি। সন্তান জন্মের ক্ষেত্র তৈরি হয় বিয়ে নামক একটি পবিত্র বন্ধনের মাধ্যমে। আর এই বন্ধনেরই যদি গোড়াপত্তন হয় একটি অন্যায্য অমানবিক শর্ত আরোপের মধ্য দিয়ে, তাহলে এ বন্ধন থেকে জন্ম নেওয়া সন্তান-সন্ততির ওপর যে এর খারাপ প্রভাব পড়বে তা অনস্বীকার্য। সামান্য অর্থের লোভে পড়ে যৌতুকলোভীরা আল্লাহ তাআলার দেওয়া একটি বিধানের কত ক্ষতি করেছেন। বিয়ে কোনো সওদা বা বাণিজ্য নয়। আর্থিক লাভ-ক্ষতির বিষয় নয়। এটি একটি পবিত্র বন্ধন। এ দ্বারা এক জোড়া মানব-মানবীর পরস্পরের অধিকার ও কর্তব্য স্থাপিত হয়। একজন আরেকজনের জন্য হালাল হয়। এটি কোনো আর্থিক বা বৈষয়িক জিনিস নয়। বেহেশতি নেয়ামত। এই বন্ধন প্রথম অনুষ্ঠিত হয় বেহেশতে প্রথম মানব-মানবী হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.)-এর মাধ্যে। আর এ বন্ধন ঘটিয়েছেন স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিন।

যৌতুক চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের চেয়েও খারাপচোর, ডাকাত ও ছিনতাইকারী যেমন অন্যের মাল জোর করে ছিনিয়ে আনে, যৌতুক গ্রহণকারীও তাই করে। স্বেচ্ছায় কেউ যৌতুক দেয় না। দায়ে পড়েই যৌতুক দেয়। সুতরাং চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো যৌতুক গ্রহণও হারাম। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُوا بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوا فَرِيقًا مِنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالْإِثْمِ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ

হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে গ্রাস করবে না। (সুরা বাকারা- : ১৮৮)

জন্মগতভাবে শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকে পুরুষ নারী অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। তাদের যেমন উৎপাদন ক্ষমতা বেশি, তেমনি নিজের ও স্ত্রীর নিরাপত্তা বিধানের ক্ষমতাও বেশি। তাই ইসলাম নারী অর্থাৎ স্ত্রী ও সন্তানের ভরণ-পোষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব নর তথা স্বামীর ওপর অর্পণ করেছে। আর এই কারণে মিরাস তথা উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রেও মেয়ের তুলনায় ছেলের ভাগ দ্বিগুণ করা হয়েছে। এই একই কারণে স্ত্রী ও সন্তানের ভরণ-পোষণের আর্থিক সামর্থ্য অর্জন না করা পর্যন্ত বিয়ে বিলম্বিত করতে ইসলাম পুরুষকে পরামর্শ দিয়েছে। এরূপ বলা হয়নি যে, আর্থিক সংগতি না থাকলে স্ত্রী বা স্ত্রীর অভিভাবক থেকে অর্থ নিয়ে বিয়ে করতে হবে। শারীরিক শক্তি অধিক উপার্জন ক্ষমতার কারণে যেখানে আল্লাহ নারীর ওপর নরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, সেখানে বিয়ের সময় নারীর কাছ থেকে নরের যৌতুক নামক অর্থ আদায় আল্লাহ প্রদত্ত নরের শ্রেষ্ঠত্বেরই অবমাননা। করআনের বাণী,

الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيًّا كَبِيرًا

পুরুষ স্ত্রীলোকের ওপর নেতৃত্ব পেয়েছে এই জন্য যে, পুরুষরাই পারে নারীকে বাইরের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা করতে। (সুরা নিসা- : ৩৪)

এই আক্রমণ শারীরিক হোক, নৈতিক হোক কিংবা আর্থিক। আর্থিক অসহায়ত্ব থেকে নারীকে রক্ষার জন্য যেখানে পুরুষকে নারীর নেতা বানানো হয়েছে, সেখানে পুরুষ কর্তৃক নারীর কাছ থেকে বিয়ের সময় যৌতুক আদায় পুরুষের জন্য সত্যি অবমাননাকর ও লজ্জাজনক কাজ। শারীরিকভাবে দুর্বল নারীর কাছ থেকে শারীরিকভাবে সবল পুরুষের কোনো সুবিধা আদায় পুরুষের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার পরিপন্থী। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের কুফরি বা অস্বীকার করার শামিল। এই ব্যাপারে মহান রাব্বুল আলামিনের ঘোষণা হচ্ছে,

وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ

তোমরা যদি আমার দেওয়া নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় কর, তাহলে তা আমি বাড়িয়ে দেব। আর যদি অস্বীকার কর, কৃতজ্ঞ হও, তাহলে জেনে রেখো আমার শাস্তি খুবই কঠিন। (সুরা ইবরাহিম-১৪ : ৭)

বিয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বীয় চরিত্রকে পরিচ্ছন্ন ও কলুষমুক্ত রাখা এবং মনের প্রশান্তি লাভ। যৌতুক নামক টাকা-পয়সার বাধ্যতামূলক লেনদেন বিয়ের পবিত্র উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করে দেয়। বিবাহের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতা, সহানুভূতি, দরদ ও সহযোগিতা সৃষ্টি হয়। আর বিয়েটাই যদি সম্পন্ন হয় যৌতুক নামক তিক্ততার মধ্য দিয়ে, তাহলে এই বিয়ে থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি সৃষ্টি হতে পারে না। অথচ মহান রাব্বুল আলামিন বলেছেন,

وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

আল্লাহর নির্দেশনাবলির মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনী, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। (সুরা রুম-৩০ : ২১)

উক্ত আয়াতে বিয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণিত রয়েছে। আর তা হচ্ছে বিয়ের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী পরম পরিতৃপ্তি ও গভীর প্রশান্তি লাভ। বিয়ে যদি আর্থিক লাভ-লোকসানের বস্তুতে পরিণত হয়, তখন এ ধরনের বিয়ে থেকে অর্থ পাওয়া গেলেও এ থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-প্রণয়, মায়া-মমতা, দরদ-সহানুভূতির সৃষ্টি হয় না। স্বামীর মধ্যে সব সময় একটি অপরাধবোধ কাজ করে। আর স্ত্রীর মধ্যে স্বামীর প্রতি একটি ঘৃণাবোধ কাজ করে।

যৌতুক একটি শয়তানি কাজ। এর দ্বারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, যেভাবেই বিচার করা হোক না কেন যৌতুক কারো জন্যই সুখকর নয়। এটি ধর্মীয়, অসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দিক থেকেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যৌতুক গ্রহণকারী সমাজ ও পরিবারের কাছে ঘৃণিত, স্ত্রীর কাছে নিন্দনীয় ও অপমানের, নীতি ও নৈতিকতাবিরোধী কাজ ও শৃঙ্খলা বিনষ্টকারী। নারী নির্যাতন, শ্রম শোষণ, পৌরুষের দিক থেকে দুর্বল মনের পরিচায়ক, ব্যক্তিত্বের দিক থেকে লজ্জাজনক। আইন করে এই বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটন সম্ভব কিনা তা বলতে না পারলেও এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের আলেমসমাজ যদি এর মূলোৎপাটনে সর্বান্তকরণে এগিয়ে আসেন, তাহলেই সম্ভব হবে জাহিলিয়াতের এই অভিশাপ থেকে মুসলিম নারীদের রক্ষা করা। এ দেশের আলেম-উলামা ও পীর-মাশায়েখরা অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন। যৌতুকের মাধ্যমে জাহিলিয়াতের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তা প্রতিরোধে তারা যথাযথভাবে এগিয়ে আসবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা। জন্ম, বিয়ে ও মৃত্যুতে তাদের উপস্থিতি অনিবার্য ও সমাজ সংগঠনের অবদান অনস্বীকার্যবিয়ের সময় যদি তারা তাদের এই ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্বটুকু হেকমতের সঙ্গে পালন করেন, তাহলে নারী নির্যাতন ও নারী অধিকার হরণকারী বিয়ের যৌতুকের অভিশাপ থেকে দেশ ও জাতি মুক্তি পাবে ইনশাআল্লাহ। 

নারী নিযার্তনের বড় হাতিয়ার যৌতুক

বতর্মান সময়ের সঙ্গে তালমিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ। দেশের সবকিছু সময়ের সঙ্গে পরিবতর্ন হলেও পরিবতর্ন হয়নি আমাদের মানবসমাজের মনমানসিকতা। আর আমাদের মনমানসিকতার পরিবতর্ন না হওয়ার কারণে আজ আমাদের নারীসমাজ বিভিন্নভাবে আমাদের দেশের প্রতিটি সমাজে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের সমাজে নারীসমাজ যৌতুকের কারণে সবচেয়ে বেশি নিযার্তনের শিকার হচ্ছে। যৌতুক একটি সামাজিক ক্যান্সার। এর বিষক্রিয়ায় আমাদের গোটা সমাজ আক্রান্ত। বতর্মানে যৌতুকপ্রথার ভয়াবহতা বাড়লেও এর প্রচলন প্রাচীনকাল থেকেই। নারীজীবনে এ প্রথা অভিশাপস্বরূপ। প্রতিনিয়ত অসংখ্য নারী অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হচ্ছে যৌতুকের কারণে। অসংখ্য নারীর সুখের সংসার ভেঙে যাচ্ছে যৌতুকের অভিশাপে। যৌতুকের করাল গ্রাসে নারীর সামাজিক ও মানবিক মযার্দা লাঞ্ছিত হচ্ছে।

যৌতুকপ্রথা কেবল নারীকে মযার্দাহীনই করে না বরং নারী জাতিকে সম্মানহানীর চড়ান্ত পযার্য়ে নিয়ে গেছে।. বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী যৌতুক দেয়া এবং যৌতুক নেয়া দুটোই অপরাধ? আর যৌতুকের কারণে কেউ আত্মহত্যা করলে প্ররোচনাকারীর শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিনিয়তই যৌতুকের বলি হচ্ছেন নারীরা। সারা দেশেই যৌতুকের কারণে নারী নিযার্তন, হত্যা, আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছেই। পারিবারিক সহিংসতার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে এই যৌতুক। যৌতুক প্রতিরোধে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন বলে অভিজ্ঞমহল মনে করছেন।

সম্প্রতি ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, যৌতুককে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালে ১৭৩ জন নারী খুন হয়েছেন। নিযার্তনের ঘটনা ঘটেছে ৩৬২টি। গত ৫ বছরে এ সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। হত্যার শিকার হয়েছেন ১ হাজার ১৫১ জন নারী। ১৪টি দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এসব তথ্য সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়েছে। খিলগঁাও থানার বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা শিল্পী আক্তার ওরফে নিপা (৩০) তার স্বামীর নাম মানিক গাজী। গত ১৩ বছর ধরে তাদের বিয়ে হয়। বতর্মানে তাদের সংসারে ৮ বছরের এক মেয়ে রয়েছে। যৌতুকের কারণে তাকে মারধর করা হতোএকপর্যায়ে তার শিশুসন্তানকেও উঁচু করে ফেলে দিত। আর তাকে তালাক দেয়ার হুমকি দিত। তাদের পরিবার ৩ বার মীমাংসা করেছেন। তার পরও তাকে ডিভোসর্ দেয়া হয়েছে। আর খিলগঁাও মেরাদিয়া এলাকার আনোয়ারা বেগম (৩৮)। তার স্বামীর নাম এনামুল হক। তিনি ২ সন্তানের জননী। তাকে যৌতুকের জন্য বিভিন্ন সময় মারধর করা হতো। অন্য এক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে। আর তার কাছে যৌতুকের দাবিতে তাকে মারধর করা হয়।

এ ছাড়া সুইটি আক্তার নামের এক গৃহবধূ জানান, তিনি এক শিশুসন্তানের মা। তার স্বামী ফজলে রাব্বী। গত ৪ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন যৌতুকের দাবিতে মারধর করে আসছে। শাশুড়ি তার গায়ে হাত তুলছেন। আর সুখী আক্তার (২৪) নামের এক গৃহবধূ শ্বশুরবাড়িতে ববর্র নিযার্তনের শিকার হয়েছেন। তাদের বিয়ের ১২ বছরের মাথায় যৌতুক না পেয়ে স্বামী ও তার স্বজনরা মিলে টেস্টার দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার ডান চোখটি একেবারে উপড়ে ফেলেন। আর বাঁ চোখেও ছিল মারাত্মক আঘাত। ঘটনাটি ২০১৫ সালে জিঞ্জিরা এলাকায়।

 আমাদের দেশে বতর্মানে দেখা যায়, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে যৌতুক নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। আর এই যৌতুক বিয়ের আগে থেকে শুরু হয়ে চলতে থাকে। যৌতুকের দাবি মেটাতে গিয়ে কনের পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে। আবার এ দাবি মেটাতে না পারলেই নেমে আসে শারীরিক ও মানসিক নিযার্তনের ঘটনা। যৌতুকের কারণে অনেক নারীকেই হত্যার শিকার হতে হচ্ছে। আবার মৃত্যুর হাত থেকে বঁাচলেও অনেকে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। গত ২০১৬ সালে বিয়ের ৫ বছর পর যৌতুক দিতে রাজি নন পাবনার শম্পা খাতুন (২৫)। এ কারণে বেঁচে থাকার অধিকারই হারিয়ে ফেলেন তিনি। যৌতুক না পেয়ে স্বামী ও তার স্বজনরা শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন শম্পাকে। নারীরা যৌতুকের কারণে নিযার্তনের শিকার হলেও সংসার করার জন্য আইনের আশ্রয় নেন না অনেক নারীই। পাশাপাশি, আইনি পরিবেশ নারীবান্ধব না হওয়ায় কম যাচ্ছেন। আর অপরাধীরা সব সময়ই প্রভাবশালী থাকে, তাদের বিরুদ্ধে বিচার হয় না। আসকের সূত্রমতে, ২০১৬ সালে যৌতুকের কারণে ১২৬ জন নারীর ওপর নিযার্তন চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়।

আর ১০৮ জন নিযার্তনের শিকার হয়েও বেঁচে আছেন, আর নিযার্তন সইতে না পেরে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন একজন, যৌতুকের মামলা হয়েছে মোট ৯৫টি এর আগের ২০১৫ সালে যৌতুকের কারণে ১৮৭ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছিল আর আত্মহত্যা করেন একজন এবং ১০১ জন নিযার্তনের শিকার হয়েও বেঁচে আছেন, একই কারণে ২০১৪ সালে ১৬৩ জন নারীকে নিযার্তন চালিয়ে হত্যা করা হয়, আত্মহত্যা করেন ১১ জন, নিযার্তন সইতে না পেরে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান একজন, ১২১ জন নিযার্তনের শিকার হয়েও বেঁচে আছেন, আর ২০১৪ সালে যৌতুকের মামলা হয় মোট ১৩৯টি, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দিতে যৌতুকের দাবিতে এক গৃহবধূকে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন আগুনে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগে থানা পুলিশ প্রথমে মামলা নেয়নি। পরে পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করার পর ঘটনাটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করে পুলিশ।

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার কেল্লাবাড়ী গ্রামের স্বপ্না বেগমের সঙ্গে (২৩) বালিয়াকান্দি উপজেলার মদনডাঙ্গী গ্রামের তোকেনের ছেলে এরশাদের (৩০) ছয় বছর বিয়ে হয়। স্বপ্নার স্বামী এক লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন। টাকা দিতে না পারায় গভীর রাতে স্বামী ও তার পরিবারের লোকজন স্বপ্নাকে মারধর করেন। একপর্যায়ে তারা স্বপ্নার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। তাকে প্রথমে বালিয়াকান্দি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভতির্ ও পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়া মাদারীপুরের কালকিনি পৌর এলাকার দক্ষিণ রাজদি গ্রামে তানিয়া বেগম (২৫) নামের এক গৃহবধূকে যৌতুকের দাবিতে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।

এই ঘটনায় মামলা হলে পুলিশ গত ১৫ জানুয়ারি (বুধবার) বিকালে রেজাউল মৃধাকে গ্রেপ্তার করে। ২০০৭ সালে কালকিনি উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের পশ্চিম বনগ্রামের আবুল কাশেম হাওলাদারের মেয়ে তানিয়া বেগমের সঙ্গে কালকিনি পৌর এলাকার দক্ষিণ রাজদি গ্রামের কালাম মৃধার ছেলে লিটন মৃধার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাদের দুটি সন্তানও হয়। বিয়ের সময় দুই লাখ টাকা যৌতুক নেয়। পরে আরও দুই লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে।

এই টাকার জন্য তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ওই গৃহবধূকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিযার্তন করে। তারই জেরে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তানিয়ার শরীরে আগুন লাগিয়ে হত্যার চেষ্টা করে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এসময় তার চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা এসে তাকে রক্ষা করেন। তা ছাড়া যশোরের কেশবপুরে যৌতুকের দাবিতে এক গৃহবধূকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে পাষÐ স্বামী। গত ১৮ জানুয়ারি দুপুরে উপজেলার কুশুলদিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার শিকার গৃহবধূ জেসমিন খাতুন (২২) ওই গ্রামের রবি মোড়লের স্ত্রী। মারাত্মক দগ্ধ অবস্থায় প্রথমে তাকে কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয় বলে জানা যায়। নারী নিযার্তন রোধ করতে হলে, বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হবে। আর সামাজিকভাবে জনসচেতনা বাড়াতে পারলেই যৌতুকের ঘটনা কমে যাবে। আর তাহলেই যৌতুকের কারণে নারী নিযার্তন ও হত্যাকান্ডের ঘটনা বন্ধ হতে পারে বলে দেশের বিজ্ঞমহল মনে করেন। যৌতুকের কুফল সম্পকের্ গণমানুষকে সচেতন করার জন্য দেশের গণমাধ্যমগুলোর ভমিকা বেশ কাযর্কর ও ফলপ্রসূ হতে পারে। জনমানুষকে যৌতুকবিরোধী আইন সম্পকের্ সচেতন করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সংবাদ, ফিচার, আলাদা সাময়িকী, নাটিকা, বক্তব্য, বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে। আন্তভুক্তিক যোগাযোগও ফলপ্রসূ ভমিকা পালন করতে পারে যেমন, মহিলা সমাবেশ, উঠান বৈঠক, কমর্শালা ইত্যাদির মাধ্যমে সচেতন করা। এ ছাড়া লোকমাধ্যম যেমন যাত্রাপালা এবং শোভাযাত্রা, পোস্টার ইত্যাদির মাধ্যমে যৌতুকবিরোধীর প্রচারণার মাধ্যমে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যৌতুকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে জোরদার করার মাধ্যমে যৌতুক নির্মূলের উপায় হিসেবে ভাবা যেতে পারে।

এগুলোর পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টিকে অন্তভুর্ক্ত করা যেতে পারে। পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে সচেতনতার বিষয়টি সবর্পর্যায়ে নিয়ে আসা দরকার। তবে উপায়টি শুধু যৌতুকের কুফল এবং আইন সম্পকের্ই জানানো নয়, নারীদের আত্মমযার্দা এবং ক্ষমতায়ন সম্পকের্ সচেতন হতে বলাটা বেশি জরুরি। সবোর্পরি সচেতনতা এবং মানসিকতার ইতিবাচক পরিবতর্ন যৌতুক নিমূর্ল করতে পারে। কিন্তু একদিনেই সবকিছু পরিবতর্ন হয়ে যাবে এমন নয়। দিনের পর দিন সচেতন করার নিরন্তর প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কাক্সিক্ষত সাফল্য লাভ করা যেতে পারে।

শেষকথা:

    আসুন আমরা সকলে যৌতুকের বিরুদ্ধে কথা বলি। যৌতুককে না বলি। যৌতুক দিবনা ও নিবনা এই অঙ্গিকার করি। ইসলামী সমাজ বিনির্মানে কাজ করি। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হউন। আমিন।

 

 

 

No comments:

Post a Comment

razzakhowlader59@gmil.com