Wednesday, March 02, 2022

আত্মহত্যার কারণ ও পরিণাম

 


আত্মহত্যার কারণ ও পরিণাম

এম এ রাজ্জাক হাওলাদার

সুচনা:

আত্মহত্যা মানে স্বেচ্ছায় বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিজের জীবনকে নিঃশ্বেস করে দেয়া। এটি একটি ব্যক্তিগত জটিল এবং আবেগগত সমস্যা। তবে আত্মহত্যাকে একটি মনস্তাত্বিক সামাজিক সমস্যা হিসেবে গণ্য করা হয়।

যে কোন অবৈধ হত্যা কান্ড গোটা মানব জাতির হত্যার শামিল। যারা বৈধ কারণ ছাড়া আল্লাহর কর্তৃক নিষিদ্ধ প্রাণকে হত্যা করে তারা মহাপাপী। যে একটা প্রাণকে বাঁচালো সে যেন গোটা মানবজাতিকে বাঁচালো। অন্যায় ভাবে কোন প্রাণীকে হত্যার পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়লা বলেন,

وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا

যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার ওপর ক্রুদ্ধ হন, অভিসম্পাত করেন এবং তার জন্য ভয়ংকর আযাব প্রস্তুত করে রেখেছেন। (সুরা নিসা-:৯৩)

আত্মহত্যার বিভিন্ন দিক:

# আত্মহত্যার কারণঃ

* আর্থিক অসচ্ছলতা।

* প্রাচুর্যের অপ্রতুলতা।

* কর্মক্ষেত্রে কঠোর প্রতিযোগিতা।

* কর্মক্ষেত্রে অত্যধিক চাপ।

* কর্মসংস্থানের অভাব বা নিম্নমানের কর্মসংস্থান।

* পারিবারিক অশান্তি।

* দাম্পত্য কলহ।

* বাবা মায়ের বিচ্ছেদ।

* নিঃসঙ্গতা।

* প্রেমে ব্যর্থতা।

* অর্থনৈতিক ক্ষতিগ্রস্থতা।

* ঋণের চাপ।

* সন্তানের উপর বাবা মায়ের মাত্রাতিরিক্ত শাসন।

* পরীক্ষায় খারাপ করা বা আশানুরূপ ফলাফল অর্জনে ব্যর্থতা।

* পারিবারিক অবহেলা।

* হতাশা।

আত্মহত্যার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিঃ

পৃথিবীর কোন ধর্মই আত্মহত্যাকে সমর্থন করে না। প্রত্যেক ধর্মই আত্মহত্যাকে একটি নিকৃষ্ট পাপের কাজ হিসেবে বিবেচনা করে।

বিভিন্ন ধর্মের আত্মহত্যার বর্ণনা:

* খ্রিষ্ট ধর্মঃ ক্যথলিক মতবাদের স্পষ্ট নির্দেশনা "তুমি নিজেকে হত্যা করো না"। খ্রিষ্ট ধর্ম মতে জীবন ইশ্বরের দেয়া একটি উপহার যা নষ্ট করার অধিকার কোন মানুষের নেই। আত্মহত্যা প্রাকৃতিক আদেশের বিরুদ্ধে স্বয়ং ইশ্বরের পরিকল্পনায় হস্তক্ষেপের শামিল।

* ইহুদি ধর্মঃ ইহুদি ধর্মে জীবনকে খুবই মূল্যবান মনে করা হয় এবং আত্মহত্যাকে ইশ্বরের ধর্মে হস্তক্ষেপের সমতুল্য জ্ঞান করা হয়।

* হিন্দু ধর্মে আত্মহত্যাকে খুবই ঘৃণা করা হয় এবং আত্মহত্যাকে অপরকে হত্যা করার সমান পাপ বলে মনে করা হয়।

* ইসলাম ধর্মঃ ইসলাম আত্মহত্যাকে হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এমন কি নিজের মৃত্যু কামনা করাকে পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا

"তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা করো না’’ (সুরা নিসা-৪:২৯)

এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন,

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا:" تَزَوَّجَنِي النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأَتَتْنِي أُمِّي فَأَدْخَلَتْنِي الدَّارَ، فَإِذَا نِسْوَةٌ مِنَ الأَنْصَارِ فِي البَيْتِ، فَقُلْنَ: عَلَى الخَيْرِ وَالبَرَكَةِ، وَعَلَى خَيْرِ طَائِرٍ "

তোমাদের কেউ দুঃখে দৈন্যে নিপতিত হওয়ার কারণে যেন মৃত্যু কামনা না করে।(সহীহ বুখারী-৫১৫৬)

# আত্মহত্যার পরিণামঃ

আত্মহত্যা মানে দুনিয়ার সামান্য কষ্ট থেকে নিষ্কৃতির অলীক ভাবনায় নিজেকে চিরস্থায়ী ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া। আখেরাতের চিরস্থায়ী ভয়াবহ শাস্তির তুলনায় দুনিয়ার সামান্য কষ্ট ক্লেশ কিছুই না। আত্মহত্যার ভয়াবহ পরিণামের কথা মনে রাখলে কেউ ই আত্মহত্যার মত জঘন্য পাপের দিকে নিজেকে ঠেলে দেবে না।

* আত্মহত্যাকারীর জন্য জান্নাত হারামঃ

জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত রাসুল (সাঃ) বলেন-

عَنِ الحَسَنِ، حَدَّثَنَا جُنْدَبُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، فِي هَذَا المَسْجِدِ، وَمَا نَسِينَا مُنْذُ حَدَّثَنَا، وَمَا نَخْشَى أَنْ يَكُونَ جُنْدُبٌ كَذَبَ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلّى الله [ص:171] عليه وسلم: " كَانَ فِيمَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ رَجُلٌ بِهِ جُرْحٌ، فَجَزِعَ، فَأَخَذَ سِكِّينًا فَحَزَّ بِهَا يَدَهُ، فَمَا رَقَأَ الدَّمُ حَتَّى مَاتَ، قَالَ اللَّهُ تَعَالَى: بَادَرَنِي عَبْدِي بِنَفْسِهِ، حَرَّمْتُ عَلَيْهِ الجَنَّةَ "

তোমাদের পূর্বর্তী যুগে একজন লোক আঘাত পেয়েছিল এবং সে কাতর হয়ে পড়েছিল। এরপর সে একটি ছুরি নিয়ে নিজের হাত কেটে ফেলল। ফলে তার রক্ত আর বন্ধ হলো না এবং তাতে সে মারা গেল। আল্লাহ বললেন, আমার বান্দাটি নিজের প্রাণ দেয়ার ব্যাপারে অগ্রণী ভুমিকা পালন করলো কাজেই আমি তার উপর জান্নাত হারাম করে দিলাম। (সহীহ বুখারী-৩৪৬৩)

* আত্মহত্যাকারীর শাস্তিঃ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবীজি বলেন-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «[ص:140] مَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ، فَهُوَ فِي نَارِ جَهَنَّمَ يَتَرَدَّى فِيهِ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا، وَمَنْ تَحَسَّى سُمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ، فَسُمُّهُ فِي يَدِهِ يَتَحَسَّاهُ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا، وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيدَةٍ، فَحَدِيدَتُهُ فِي يَدِهِ يَجَأُ بِهَا فِي بَطْنِهِ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا»

যে ব্যক্তি পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবে সে জাহান্নামের আগুনে পুঁড়বে এবং চিরদিন জাহান্নামের আগুনের মধ্যে অনুরূপ লাফিয়ে পড়তে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষ পানে আত্মহত্যা করবে সেই বিষ জাহান্নামে তার হাতে থাকবে এবং চিরকাল জাহান্নামের মধ্যে তা পান করতে থাকবে। (সহীহ বুখারী-৫৭৭৮)

وَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ (صـ) مَنْ قَتَلَ  نَفْسَــهُ  بِحَدِيْدَةٍ  فَحَدِيْدَتْــهُ فِىْ  يَدِهِ  يَتَوَجَّاهُ بِهَا فِىْ  نَارِ  جَهَنَّمَ  خَلِدًا مُخْلَدُا فِيْهَا اَبَدًا-(بخارى-مسلم )

হাদীসে আরো বর্ণিত হয়েছে অনুরূপভাবে লোহা, ছুরি, ফাঁস,বর্শা অর্থাৎ যা দিয়েই সে আত্মহত্যা করবে জাহান্নামে তা দিয়েই জাহান্নামে চিরকাল সে নিজেকে শাস্তি দিতে থাকবে।

* আত্মহত্যার লাঞ্চনা কবরস্থ হওয়ার আগ থেকেই শুরুঃ

আত্মহত্যা এমন একটি গর্হিত কাজ যে, এর প্রতি ধিক্কার জানিয়ে এবং অন্যদের সতর্ক করতে নবীজি আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়েন নি।

জাবির ইবনে সামুরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবীজির এক সাহাবী আহত হন। এটি তাকে প্রচন্ড যন্ত্রণা দেয়। তখন তিনি হামাগুড়ি একটি শিংয়ের দিকে এগিয়ে যান, যা তার তরবারীর মধ্যে ছিল। এরপর তিনি এর ফলা নেন এবং আত্মহত্যা করেন। এ কারণে নবীজি তাঁর জানাজা পড়ান নি। (তাবারানী-১৯২৩)

*আত্মহত্যা করা কবীরা গুনাহ:

আত্মহত্যাকারী কাফের হয়ে যায় না। তাই তার জানাজা পড়তে হবে। তবে এর প্রতি সামাজিক ঘৃণা প্রকাশ করতে সমাজের নেতৃস্থানীয়দের জানাজায় অংশ গ্রহণ না করাই বাঞ্চনীয়।

# আত্মহত্যা থেকে মুক্তির উপায়ঃ

* সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি।

* সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন বৃদ্ধি।

* মানসিক রোগ সনাক্তকরণ ও যথাযথ চিকিৎসা।

* কারো প্রতি বৈষম্য ও অবহেলা না করা।

* আল্লাহ ভীতি অর্জন করা।

* নিঃসঙ্গতা পরিহার করা।

* বিপর্যয়ে ধৈর্যধারণ করা।

* কারো মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা গেলে তার পাশে দাঁড়ানো এবং আত্মহত্যার প্রবণতা দূরীকরণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

 

# কি করে বুঝা যাবে কারো মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কাজ করছেঃ

* জীবন সম্পর্কে চরম হতাশা প্রকাশ করবে।

* একাকিত্ব পছন্দ করবে।

* পৃথিবীতে নিজের অনুপস্থিতির অনুভূতির কথা প্রকাশ করবে।

* তার অনুপস্থিতিতে তার উপর নির্ভরশীলদের দিকে খেয়াল রাখার কথা বলবে।

* নিজের প্রতি এবং পরিবারের প্রতি যত্ন কমিয়ে দেবে।

* নিজের দেনা পাওনার বিষয়ে বেশী বেশী আলাপ আলোচনা করবে।

এছাড়াও যারা আপনজন তারা আরো অনেক বৈপরিত্ব লক্ষ্য করবেন।

শেষকথা:

আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়। ব্যক্তি নিজে তার জীবনের মালিক নয়। আল্লাহর দেয়া জীবন নিঃশ্বেস করার কোন অধিকার তার নেই। আত্মহত্যার কুপ্রভাব নিজের পরিবারের উপর বিষাক্ত ছায়া বিস্তার করে।

 

No comments:

Post a Comment

razzakhowlader59@gmil.com