Friday, April 22, 2022

ইতিকাফ ও সাদাকাতুল ফিতর

 


ইতিকাফ ও সাদাকাতুল ফিতর

এম এ রাজ্জাক হাওলাদার

ভূমিকাঃ

মুসলমানদের জন্য রমজান মাস হলো শ্রেষ্ঠ নেয়ামতের মাস। এই রমজান মাসের ফজিলতপুর্ন ইবাদতগুলোর মধ্যে অন্যতম ইবাদত হলো ইতিকাফ। নবী করিম (সা.) ইতিকাফের এত বেশি গুরুত্ব দিতেন যে কখনো তা ছুটে যেতে দিতেন না

মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন মসজিদে অবস্থান করা বা ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। রাসুলে কারিম (সাঃ) নিয়মিতভাবে প্রতি রমজান মাসের শেষ ১০ দিন মসজিদে ইতিকাফ করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামরাও ইতিকাফ করতেন।

দাকাতুল ফিতর বা ফিতরাহ ইসলামী শরীয়তে ওয়াজিব বিধান। দেশ, স্থান, কাল, পাত্র ও পরিস্থিতি ভেদে শরীয়তের মূল দৃষ্টিভঙ্গি সামনে রেখে গরীব মিসকিনের অধিক উপকার হয় সে বস্তু দিয়ে সাদাকা আদায় করা উচিৎ

ইতিকাফ কি?

এটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা, অবস্থান ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় জাগতিক কার্যকলাপ ও পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মসজিদ বা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান করা বা স্থির থাকাকে ইতিকাফ বলে।

রাসুল (সাঃ) নিজে ইতিকাফ করেছেন এবং সাহাবাদেরকেও উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন।তিনি বলেন, ‘মসজিদ মুত্তাকিদের ঘর। যে ব্যক্তি ইবাদতের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করবে আল্লাহ তার প্রতি শান্তি ও রহমত নাজিল করবেন এবং পুলসিরাত পার-পূর্বক বেহেশতে পৌঁছবার জিম্মাদার হবেন।

 

ইতিকাফের অর্থ:

ইতিকাফ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে অবস্থান করা, স্থির থাকা, কোন স্থানে আবদ্ধ হয়ে থাকা। পবিত্র করআনে ইতেকাফ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে এসেছে,

إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَا هَٰذِهِ التَّمَاثِيلُ الَّتِي أَنتُمْ لَهَا عَاكِفُونَ ﴿الأنبياء: ٥٢﴾

যখন তিনি (ইবরাহীম আঃ) তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে বললেন: এই মূর্তিগুলো কী, যাদের তোমরা পূজারী হয়ে বসে আছ? (সূরা আম্বিয়া-২১:৫২)

শরিয়াতের পরিভাষায় ইতিকাফের অর্থঃ  

ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায় রমজান মাসের শেষ ১০ দিন অথবা অন্য কোন দিন জাগতিক কাজ-কাম ও পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লার উদ্দেশ্যে ইবাদতের নিয়তে মসজিদে বা ঘরে নামাজের স্থানে অবস্থান করা ও স্থির থাকাকে ইতিকাফ বলে।

ইতিকাফের সময়:     

রমযানের ২০ তারিখ সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছু পূর্ব থেকে শুরু হয়ে ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায়। ইতিকাফকারী পুরুষ হলে ২০ রমযান সূর্যাস্তের পূর্বে মসজিদে পৌঁছাবে।আর মহিলা হলে বাসা-বাড়ি নির্ধারিত কক্ষে বসে যাবে।

রাসূল (সাঃ) এর আমল ছিল,

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، - زَوْجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -: «أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، كَانَ يَعْتَكِفُ العَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ، ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ» (بخارى-1896- مسلم-2651)

রত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন-নবী করিম (সাঃ) রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করতেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এ নিয়মই ছিল। এরপর তাঁর সহধর্মীনিগণও ইতিকাফ করতেন। (বুখারী-ই.ফা-১৮৯৬, মুসলিম-ই.ফা ২৬৫১)

অন্য হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «يَعْتَكِفُ فِي كُلِّ رَمَضَانٍ عَشَرَةَ أَيَّامٍ، فَلَمَّا كَانَ العَامُ الَّذِي قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ يَوْمًا» (بخارى-1913)

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্নিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সাঃ) প্রতি রমজানে শেষ দশ দিন ইতেকাফ করতেন। আর যে বছর তিনি ওফাত বরণ করলেন সে বছর বিশ দিন ইতেকাফ করেছিলেন। (বুখারী-ইফা-১৯১৩,আধু-১৯০১)

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا أَرَادَ أَنْ يَعْتَكِفَ صَلَّى الْفَجْرَ ثُمَّ دَخَلَ فِي مُعْتَكَفِهِ. رَوَاهُ مسلم-2652- أَبُو دَاوُدَ وَابْنُ مَاجَهْ

রত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন-রাসূল (সাঃ) যখন ইতেকাফের ইচ্ছা করতেন তখন ফজরের নামাজের পর ইতেকাফের স্থানে প্রবেশ করতেন।” (মুসলিম-ই.ফা;২৬৫২,ই.সে;২৬৫১)

 وَعَهِدْنَا إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ﴿البقرة: ١٢٥﴾

আমি ইবরাহীম (আ:) ও ইসমাঈল (আ:)-কে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, অবস্থানকারী ও রুকু সেজদাকারীদের জন্যে পবিত্র রাখ।(সূরা বাকরা-২:১২৫)

ইতিকাফের ফজিলত:

          একটি হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ فِي الْمُعْتَكِفِ «هُوَ يَعْكِفُ الذُّنُوبَ، وَيُجْرَى لَهُ مِنَ الْحَسَنَاتِ كَعَامِلِ الْحَسَنَاتِ كُلِّهَا»(ابن ماجة-1781) [حكم الألباني]ضعيف

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুল (সাঃ) ইতিকাফকারী সম্পর্কে এরশাদ করেন যে, ইতিকাফকারী গুনাহ সমূহ থেকে বেঁচে থাকে এবং তার জন্য ঠিক সেই ব্যক্তির মত নেকী সমূহ লেখা হয় যে (বাহিরে থেকে) নানা ধরনের অসংখ্য নেক আমল করে। (ইবনে মাজাহ-১৭৮১)

অন্য একটি হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنْ مَشَى فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ خَيْرًا لَهُ مِنَ اعْتِكَافِ عَشْرِ سِنِينَ، وَمَنِ اعْتَكَفَ يَوْمًا ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ جَعَلَ اللَّهُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ النَّارِ ثَلَاثَ خَنَادِقَ، كُلُّ خَنْدَقٍ أَبَعْدُ مِمَّا بَيْنَ الْخافِقَيْنِ»(بيهقى-3679-طبرانى-7326)

আরো একটি হাদীসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে খাঁটি অন্তরে একদিন ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তায়ালা দোযখকে তার থেকে তিন খন্দক দূরে সরিয়ে দেবেন। আসমান এবং জমিনের যে দূরত্ব, তার চেয়েও বেশী দূরত্বকে এক খন্দক বলা হয়। (বায়হাকী-৩৬৭৯,তাবারানী-৭৩২৬)

ইতিকাফরত অবস্থায় করণীয়:    

১.বেশী বেশী ইবাদাত বন্দেগী করা।

২.কুরআন তেলাওয়াত করা।

৩.নফল ইবাদত করা।

৪.যিকির আজকার করা, তাসবিহ পড়া।

৫.নফল সালাত আদায় করা

৬.সালাতুল হাযত ও সালাতুত তাসবিহ্‌ ইত্যাদি সালাত আদায় করা।

৭.সর্বক্ষণ নিজকে ইবাদতে মগ্ন রাখা।

৮.নিজের এবং সকল মুসলিম উম্মার কল্যাণ ও মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা।

ইতিকাফ অবস্থায় যেসকল কাজ নিষিদ্ধ:

عَن عَائِشَة رَضِي الله عَنْهَا قَالَتْ: السُّنَّةُ عَلَى الْمُعْتَكِفِ أَنْ لَا يَعُودَ مَرِيضًا وَلَا يَشْهَدُ جِنَازَةً وَلَا يَمَسُّ الْمَرْأَةَ وَلَا يُبَاشِرُهَا وَلَا يَخْرُجُ لِحَاجَةٍ إِلَّا لِمَا لابد مِنْهُ وَلَا اعْتِكَافَ إِلَّا بِصَوْمٍ وَلَا اعْتِكَافَ إِلَّا فِي مَسْجِدٍ جَامِعٍ.[حكم الألباني] : حسن صحيح(رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ-2473)

রত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন-ইতেকাফকারীর জন্য সুন্নাত হলো, কোন রোগীকে দেখতে মসজিদের বাহিরে যাবেনা, জানাযায় শরীক হবেনা, স্ত্রীর সাথে মেলা-মেশা করবেনা, মানবীয় প্রয়োজন ছাড়া মসজিদের বাহিরে যাবেনা, রোজা ও জামে মসজিদ ব্যতিত ইতেকাফ হবেনা।” (আবু দাউদ-২৪৭৩)

وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي المَسَاجِدِ، تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلاَ تَقْرَبُوهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ} (البقرة: 187)

আল্লাহ তায়ালা বলেন-আর যতক্ষণ তোমরা ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। এই হলো আল্লাহ্ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন আল্লাহ্ নিজের আয়াতসমূহ মানুষের জন্য, যাতে তারা বাঁচতে পারে।” (সূরা বাকরা-২:১৮৭)

১.ইতিকাফ অবস্থায় কোন দুনিয়াবী কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরূহ তাহরিমি। বাধ্য হয়ে করলে জায়েয হবে।

২.ইতিকাফ অবস্থায় চুপচাপ অবস্থায় বসে থাকা মাকরুহ তাহরিমি।

৩.মসজিদে বেচাকেনা করা, ঝগড়া করা, গীবত করা অথবা কোন বেহুদা কথা বলা মাকরুহ।

৪.কোন প্রকার প্রাকৃতিক ও শরয়ী প্রয়োজন ব্যতিরেকে মসজিদের বাইরে গিয়ে সেখানে থেকে আসলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ، قَالَ: اعْتَكَفَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْمَسْجِدِ، فَسَمِعَهُمْ يَجْهَرُونَ بِالْقِرَاءَةِ، فَكَشَفَ السِّتْرَ، وَقَالَ: «أَلَا إِنَّ كُلَّكُمْ مُنَاجٍ رَبَّهُ، فَلَا يُؤْذِيَنَّ بَعْضُكُمْ بَعْضًا، وَلَا يَرْفَعْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَعْضٍ فِي الْقِرَاءَةِ»، أَوْ قَالَ: «فِي الصَّلَاةِ»ابو داؤد-1332-صحيح

আবু সাইদ খুদুরী (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) ইতিকাফ করেছেন মসজিদে তখন তিনি ইতিকাফকারীদের মধ্যে উচ্চস্বরে করআন তেলাওয়াতের আওয়াজ শুনতে পেলেন।তিনি তাদেরকে থামালেন এবং বললেন, শুন! তোমরা প্রত্যেকে আল্লাহর কাছে মুক্তি চাইতে এসেছ, সুতরাং কেউ কাউকে কষ্ট দিওনা, তেলাওয়াতে কিংবা নফল নামাজের তেলাওয়াতে।” (আবু দাউদ-১৩৩২)

ইতিকাফের উপকারিতা:

ইতিকাফকারী এক সালাতের পর অন্য ওয়াক্ত সালাতের অপেক্ষায় থাকে, আর এ অপেক্ষার অনেক ফজিলত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় ফেরেশতারা তোমাদের একজনের জন্য দোয়া করতে থাকেন যতক্ষণ সে কথা না বলে, সালাতের স্থানে অবস্থান করে। তারা বলতে থাকে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করুন, যতক্ষণ তোমাদের কেউ সালাতের স্থানে থাকবে এবং সালাত তাকে আটকে রাখবে, তার পরিবারের কাছে যেতে সালাত ছাড়া আর কিছু বিরত রাখবে না, ফেরেশতারা তার জন্য এভাবে দোয়া করতে থাকবে।’ (সহীহ মুসলিম-৬০১১) 

ইতিকাফের প্রকারভেদ:

ইতিকাফ তিন প্রকার যথা:

১.সুন্নাত ইতিকাফঃ রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ। অর্থাৎ ২০ রমজানের সূর্য ডোবার আগ মুহূর্ত থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত মসজিদে ইতিকাফ করা। এ ধরনের ইতিকাফকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া বলা হয়। গ্রাম বা মহল্লাবাসীর পক্ষে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি এই ইতিকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে।

২.ওয়াজিব ইতিকাফঃ মানতের ইতিকাফ ওয়াজিব। যেমন কেউ বলল যে, আমার অমুক কাজ সমাধা হলে আমি এত দিন ইতিকাফ করব অথবা কোনো কাজের শর্ত উল্লেখ না করেই বলল, আমি এত দিন অবশ্যই ইতিকাফ করব। যত দিন শর্ত করা হবে তত দিন ইতিকাফ করা ওয়াজিব। ওয়াজিব ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। সুন্নাত ইতিকাফ ভঙ্গ করলে তা পালন করা ওয়াজিব হয়ে যায়।

৩.নফল ইতিকাফঃ সাধারণভাবে যেকোনো সময় ইতিকাফ করা নফল। এর নির্ধারিত কোন মেয়াদ নেই। অল্প সময়ের জন্যও ইতিকাফ করা যেতে পারে। সাওম পালন করা শর্ত নয়।


ইতিকাফের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ

রমজান মাসের শেষ দশ দিন ইতিকাফের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে লাইলাতুল কদরপ্রাপ্তির মাধ্যমে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভ। যে ব্যক্তি উক্ত দিনগুলোতে ইতিকাফ করবে, তিনি নিশ্চয়ই লাইলাতুল কদরের ফজিলত লাভ করবে।

আল্লামা হাফেজ ইবনে রজব (র:) বলেছেন, ইতিকাফের উদ্দেশ্য হল সৃষ্টির সাথে সাময়িকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক কায়েম করা। আল্লাহর সাথে পরিচয় যত দৃঢ় হবে, সম্পর্ক ও ভালোবাসা ততো গভীর হবে এবং তা বান্দাকে পুরোপুরি আল্লাহর কাছে নিয়ে যাবে।

ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থানঃ

ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান হলো বাইতুল্লাহ শরিফ। বাইতুল্লাহ শরিফের পর মসজিদে নববি। এরপর বাইতুল মাকদিস বা মুকাদ্দাস। তারপর জুমা আদায় করা হয় এমন মসজিদ। এরপর মহল্লার যে মসজিদে নামাজির সংখ্যা বেশি হয়, সে মসজিদে ইতিকাফে সওয়াব বেশি।

ইতিকাফের শর্তসমুহ:

১.মুসলমান হওয়া ২.পাগল না হওয়া      ৩.বালেগ হওয়া ৪.মসজিদে ইতিকাফ করা ৫.ইতিকাফের নিয়ত করা ৬.ইতিকাফকারী সর্বদা জানাবাত (বা মহিলা হলে হায়েজ নেফাস) থেকে পবিত্র থাকা৭.রোজা রাখা।

নারীদের ইতিকাফঃ

পুরুষদের ন্যায় নারীদের জন্য ইতিকাফ সুন্নত। কিন্তু তারা ঘরে ইতিকাফ করবে। ইতিকাফের জন্য ঘরের নির্দিষ্ট নামাজঘরকে ব্যবহার করা যেতে পারে। কারো নামাজের জন্য নির্দিষ্ট নামাজঘর না থাকলে নামাজের নির্দিষ্ট স্থানকে কাপড় দিয়ে ঘেরাও করে নেওয়া যেতে পারে।

রত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত,  তিনি বলেন,  রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষের দশকে ইতিকাফ করেছেন ইন্তেকাল পর্যন্ত। এরপর তাঁর স্ত্রীরা ইতিকাফ করেছেন।

সাদাকাতুল ফিতর

ফিতর-এর পরিচয়:

ফিতর বা ফাতূর বলা হয় সেই আহারকে যা দ্বারা রোযাদার রোযা ভঙ্গ করে। [আল মুজাম আল ওয়াসীত/৬৯৪]

ফিতরাকে শরীয়তে যাকাতুল ফিতর এবং সাদাকাতুল ফিতরবলা হয়েছে। অর্থাৎ ফিতরের যাকাত বা ফিতরের সদকা। আর যাকাতুল ফিতর বলা হয় ঐ জরুরী দানকে যা, রোযাদারেরা ঈদুল ফিতর উপলক্ষে অভাবীদের দিয়ে থাকে।[আল মুজাম আল ওয়াসীত/৬৯৪]

যেহেতু দীর্ঘ দিন রোযা অর্থাৎ পানাহার থেকে বিরত থাকার পর ইফতার বা আহার শুরু করা হয় সে কারণে এটাকে ফিতরের তথা আহারের যাকাত বলা হয়। [ফাতহুল বারী ৩/৪৬৩]

সাদাকাহ অর্থাৎ দান

ফিতর অর্থ বিরতি দেয়া, এক মাস রোজা রাখার পর রোজা ভাঙা। অতএব সাদাকাতুল ফিতর হলো দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে রোজা ভাঙা উপলক্ষে গরীব-মিসকিনকে যা দান করা হয়, তা-ই সাদাকাতুল ফিতর। সাদাকাহমানে দান এবং আল-ফিতরমানে রোজা ভেঙে পানাহারের বৈধতা। এক কথায় রোযা ভাঙ্গার সুযোগ পেয়ে পানাহারের বৈধতা প্রাপ্তির আনন্দে কিছু দান। ঈদুল ফিতরমানে পানাহারের বৈধতা দানের আনন্দে খুশি। (সূত্র: কাওয়াঈদুল ফিকহিয়াহ, মুগনী, রদ্দুল মুহতার ইত্যাদি)

পরিভাষায় সাদাকাতুল ফিতর মানে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের উপর ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদেকের সময় থেকে যে দানওয়াজিব হয়।

মূলত মাহে রমজানের রোজা পালনের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দার প্রতি যে অফুরন্ত নিয়ামত দান করেছেন, তার শোকর হিসেবে এবং রোজা পালনে ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ বিবেচনায় সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব করা হয়েছে। ওয়াকি ইবনুল জাররাহ (রা.) বলেন, ‘সিজদায়ে সাহু যেমন নামাজের ক্ষতিপূরণ, তেমনি সাদাকাতুল ফিতর রোজার ক্ষতিপূরণ

ফিতরার হুকুম বা বিধান

ফিতরা দেয়া বা আদায় করা ওয়াজিব। ফিতরা দেয়ার সামর্থ্য রাখে এরকম প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজের ও পরিবারের ঐ সমস্ত সদস্যদের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব, যাদের লালন-পালনের দায়িত্ব শরীয়ত কর্তৃক তার উপরে অর্পিত হয়েছে।” [আল মুগনী, ৪/৩০৭; বুখারী-১৫০৩]

সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব ঐ ব্যক্তির ওপর যার নিকট ঈদুল ফিতরের দিন সকাল বেলা তার প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও খাবার ব্যতীত নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে। নেসাব হলো সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা তার সম পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ। যদি স্বর্ণ ও রৌপ্য মূল্যমানে পার্থক্য হয়, তাহলে যেটির মূল্য ধরলে গরীব বেশি উপকৃত হয়, সেটির মূল্যমান ধরেই যাকাত, ফিতরা আদায় করতে হবেযার ওপর ফিতরা ওয়াজিব হবে, সে তার নিজের এবং তার পোষ্যদের পক্ষ হতে ফিতরা আদায় করবে।

ফিতরার পরিমাণ

সর্বাধিক মত হলো ফিতরার পরিমাণ এক ‘ছা’দলীল- আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক গোলাম, স্বাধীন, পুরুষ, মহিলা, ছোট-বড় সকল মুসলমানের ওপর এক ‘ছা’ খেজুর বা এক ‘ছা’ যব যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন এবং তা লোকেরা ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বেই আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী; সহীহ মুসলিম)

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা যাকাতুল ফিতর বের করে দিতাম এক ‘ছা’ খাদ্য আথবা এক ‘ছা’ যব আথবা এক ‘ছা’ খেজুর আথবা ‘ছা’ কিসমিস। (সহীহ বুখারী)

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ঈদুল ফিতরের দিনে এক ‘ছা’ খাদ্য বের করে দিতাম। তিনি বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল যব, কিসমিস, পনির এবং খেজুর। (সহীহ বুখারী)

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে এক ‘ছা’ খাদ্য অথবা এক ‘ছা’ খেজুর অথবা এক ‘ছা’ যব অথবা এক ‘ছা’ কিসমিস সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে আদায় করতাম। অত:পর যখন মুআবিয়া (রা.) মদীনায় আসলেন এবং গমের মওসুম শুরু হলো। তিনি বললেন, আমি মনে করি এটার এক মুদ উপরোক্ত মুদের দুই মুদের সমান হবে। (সহীহ বুখারী)

উল্লেখ্য, দুই মুদ এক ‘ছা’ সমপরিমাণ। অতএব এক মুদ অর্ধ ‘ছা’ সমপরিমাণ। আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করত এক ‘ছা’ যব অথবা খেজুর অথবা খোসাবিহীন যব অথবা কিসমিস। যখন ওমর (রা.) খলিফা হলেন এবং গমের উৎপাদন বেড়ে গেল, তখন তিনি অর্ধ ‘ছা’ গমকে উপরোল্লিখিত বস্তগুলোর এক ছা-এর স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণ করলেন। (-আবু দাউদ)

 সাসম্পর্কে বিশ্লেষণ

ফিতরার সম্বন্ধে আলোচনা হলেই একটি শব্দ উঠে আসে আর তা হল, সা। সা-এর পরিমাণ বর্তমান হিসাবে কত হবে- এ নিয়ে আলেমগণের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। সা হচ্ছে ওজন করার বা মাপার একটি পাত্র। যেমন গ্রামাঞ্চলে কাঠা দ্বারা ধান মাপা হয়। আধুনিক যুগে কিলোগ্রামের প্রচলন হওয়ায় সেই সার ওজন আরবেও বিলুপ্ত প্রায়। তবুও মক্কা মদীনায় ঈদের প্রাক্কালে ফিতরার চাল বিক্রয়কারীদের কাছে এই সাদেখা যায়। হানাফি আলেমগণ সা-এর হিসাব করেন ইরাকী হিসেবে, যার পরিমাণ বর্তমান হিসাবে হয় প্রায় সাড়ে ৩ কেজি। আবার অনেকে হিসাব করেন মদীনার সা হিসেবে, যার পরিমাণ কারো মতে ৯ কেজি ৯৪৮ গ্রাম, কারো মতে ২ কেজি ৬০০ গ্রাম, কারো মতে ২ কেজি ৩৫ গ্রাম-এভাবে বিভিন্ন মত রয়েছে। হাতের পার্থক্যের কারণে ও জিনিসের বিভিন্নতার কারণে ওজন কমবেশি হতে পারে।

সার ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরামদের বিভিন্ন মতের পর একটি সুন্দর, সহজ ও নির্ভরযোগ্য ওজন প্রমাণিত হয় যা, সর্বকাল ও সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তা হল: একজন সাধারণ শারীরিক গঠনের মানুষ অর্থাৎ অধিক লম্বা নয় এবং বেঁটেও নয়, এই রকম মানুষ তার দুই হাত একত্রে করলে যে অঞ্জলি গঠিত হয়, ঐরকম পূর্ণ চার অঞ্জলি সমান হচ্ছে এক সা। [ফাতাওয়া মাসায়েল/১৭২-১৭৩, সউদী ফাতাওয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি, ফতোয়া নং ৫৭৩৩ খন্ড ৯য় পৃ: ৩৬৫]

 

২০২২ সালের জন্য (ইফাবা)কর্তৃক সাদাকাতুল ফিতরের ঘোষিত হিসাব নিম্নের হারে।



অর্ধ সার ফিতরা প্রচলন

উপরে বর্ণিত প্রমাণগুলি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, নবী (স.)এক সা পরিমাণ ফিতরা জরুরী করেছেন। কিন্তু নবী করিম (স.)এবং চার খলীফার ইন্তেকালের পর যখন মুআবিয়া (রা.) ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা নির্বাচিত হন এবং ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদীনা হতে দামেস্ক স্থানান্তরিত হয়, তখন তারা গমের সাথে পরিচিতি লাভ করেন। সে সময় সিরিয়ার এই গমের মূল্য খেজুরের দ্বিগুণ ছিল। তাই খলীফা মুয়াবিয়া একদা হজ্জ বা উমরা করার সময় মদীনায় আসলে মিম্বরে বলেন- আমি অর্ধ সা গমকে এক সা খেজুরের সমতুল্য মনে করি। লোকেরা তার এই কথা মেনে নেয়। এরপর থেকে মুসলিম উম্মতের মধ্যে অর্ধ সা ফিতরার প্রচলন শুরু হয়। [সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: যাকাত, অনুচ্ছেদ: যাকাতুল ফিতর-২২৮১,৮২]

সাহাবী মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, ‘‘আমি মনে করি এই অর্ধ সা গম এক সা খেজুরের বরাবর।” [মুসলিম-২২৮১] তিনি কিন্তু বলেননি, যে এটা নবীজীর আমল বা তোমরা অর্ধ সা দাও।

 

ফিতরাহ কখন আদায় করতে হবে ?

ঈদুল ফিতরের দুইদিন আগ থেকে শুরু করে ঈদের সালাতের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। এর পূর্বে আদায় করলে সাদাকাতুল ফিতরের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। কেননা সাদাকাতুল ফিতরের উদ্দেশ্য হলো দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা, যাতে তারা ঈদের আনন্দে শরীক হতে পারে।

মহানবী (সা.) তা (সাদাকাতুল ফিতর) লোকেরা ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বেই আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম)

ইবনু আব্বাস (রা) সুত্রে বর্নিত, তিনি বলেন রাসুল (সা.) যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন অশ্লীল কথা ও খারাপ কাজ হতে রোযাকে পবিত্র করতে এবং মিসকিনদের খাদ্যের জন্যযে ব্যক্তি নামাযের পূর্বে তা আদায় করে সেটা কবুল সদকাহ গণ্য হবে, আর যে ব্যক্তি সালাতের পর তা আদায় করবে তা সাধারণ দান হিসেবে গৃহীত হবে। (আবু দাউদ, ১ম খন্ড, হা/১৬০৯; ইবনু মাজাহ, হা/১৮২৭)

নগদ অর্থ, টাকা পয়সা দিয়ে ফিতরা আদায় করা যাবে কি?

নগদ অর্থ দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে কিনা এনিয়ে আলেমগণের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও টাকা দ্বারা ‘‘ফিতরা’’ দেয়া সহীহ্ হাদীস ও ইমামগণের উক্তি দ্বারা প্রমাণিত।

প্রথম অভিমত:- ইমাম আবু হানিফা, আতা, হাসান বাসরী, ছুফয়ান সাওরী, ওমর বিন আব্দুল আজিজ, ও তার অনুসারীদের মতে, নগদ অর্থ দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করা বৈধ। কেননা সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের একটি অন্যতম লক্ষ্য হলো দরিদ্র মানুষকে ঈদের আনন্দে শরীক হওয়ার সুযোগ করে দেয়া।

দ্বিতীয় অভিমত:- ইমাম শাফেঈ, ইমাম মালেক, ইমাম আহমাদ (রহ.) মতে নগদ অর্থ দেয়া বৈধ হবে নয়। কেননা হাদীসে নগদ অর্থের কথা উল্লেখ নেই।

বর্তমানে বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে আমাদের দেশে কতিপয় উলামা প্রচার করে বেড়াচ্ছেন যে, ‘‘সহীহ বুখারীর মাঝে আছে ফিতরা দিতে হবে গম, খেজুর, কিসমিস, পনীর ইত্যাদি খাদ্য দ্রব্য দিয়ে। টাকা দিয়ে আদায় করলে আদায় হবে না!!’’ তাদের এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

* ইমাম আবু হানিফা মনে করেন, উপরে বর্ণিত পাঁচটি বিষয় হলো সকায়ে ফিতরের ক্ষেত্রে মানদন্ড। এর যে কোনো একটি দ্বারা যেমন আদায় করা যাবে, এর সমমূল্যের যে কোনো দ্রব্য দ্বারাও আদায় করা যাবে। এমনকি মুদ্রা দ্বারাও আদায় করা যাবে। অবশ্য আর তিন ইমামের অভিমত এই ছিল যে, মুদ্রা দ্বারা আদায় করা যাবে না, দ্রব্যের দ্বারাই আদায় করতে হবে। তবে তাদের অনুসারীরা পরবর্তীকালে ইমাম আবু হানিফার (রহ.) অভিমতকেই মেনে নিয়েছেন। এখন সবার দৃষ্টিতেই সমপরিমাণ মুদ্রা দ্বারা ফিতরা আদায় করলে আদায় হয়ে যাবে।(মাসিক মদিনা-২০১৩)

তবে হ্যাঁ, শরিয়তের নির্ধারিত মানদন্ড ঠিক রেখে যদি গরিবের উপকার করা যায় তাতে কোনো বাধা নেই; বরং সেটি উত্তম কর্ম বলে বিবেচিত হবে। তাই শুধু আধা সাগমের মূল্য পরিশোধ না করে এক সাখেজুরের মূল্যের সমপরিমাণ আদায় করতে বাধা নেই, যার বর্তমান বাজার দর প্রায় ১৪০০টাকা হবে। কিংবা এক সাকিসমিসের মূল্যের সমপরিমাণও আদায় করা যায়, যার বাজার দর ৪২০টাকা প্রায়। কিংবা ১সাপনিরের মূল্যের সমপরিমাণও আদায় করা যায়, যার বাজার দর ৭০০ টাকা প্রায়।

মোটকথা হলো সমাজের বিত্তশালীরা যদি খেজুরের মূল্যে সদকায়ে ফিতর আদায় করেন, মধ্যবিত্তরা যদি পনির ও কিসমিসের মূল্যে আদায় করেন আর নিম্নবিত্ত যাদের ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয় তারা যদি যব বা গমের মূল্যে আদায় করেন তাহলে গরিব লাভবান হবে এবং সম্পদের পর্যায় ভেদে এ অভ্যাস সমাজের মানুষের মাঝে গড়ে ওঠা উচিত। এজন্য আলেম-ওলামা ও মসজিদের ইমামরা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনতবে শরিয়ত স্বীকৃত কোনো বিষয়কে আইন করে রহিত করার অধিকার কারও নেই।

ইমাম বুখারী (রহ.), ইবনে আবী শায়বা (রহ.) ও বায়হাকি (রহ.) বলেন, টাকা দিয়ে ফিতরা দিলে আদায় হয়ে যাবে। নিম্নে কতিপয় দলীল দেখলে স্পষ্ট বুঝা যায় নগদ অর্থ, টাকা পয়সা দিয়ে ফিতরা আদায় করা বৈধ।

* ‘‘ফিতরা’’ টাকা দ্বারা আদায় করলেও আদায় হয়ে যাবে। তার দলীল-

* রাসূল (সা.) এর যুগে زَكَاةَالفِطْرِزكوة যাকাত ‘‘ফিতরা’’ ইত্যাদি টাকা দ্বারা আদায় করা হতো। তার কিছু প্রমাণ নিম্নে দেওয়া হলো:-

১.যখন রাসূলে কারীম (সা.) হযরত মুয়াজ (রা.)-কে ইয়ামেনে পাঠান, তখন তিনি সেখানে সদকাতুল ফিতর গম আদায় করার পরিবর্তে কাপড় আদায় করেছেন, তিনি বলেন, এটি আদায় করা তোমাদের জন্য সহজ। তাছাড়াও রাসূল (সা.) মহিলাদেরকে তাদের অলঙ্কার দিয়ে হলেও সাদকা আদায় করতে বলেছেন। (সহীহ বুখারী-২/১১৬)

২.সদাকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করা যাবে এটি ইমাম বুখারী (রহ.) এরও নিজস্ব অভিমত-তাই তিনি এ ব্যাপারে আলাদা অধ্যায় উল্লেখ করেছেন-

আল্লামা ইবনু রাশীদ (রহ.) বলেন, উক্ত মাসয়ালাটির মাঝে ইমাম বুখারী (রহ.) হানাফীদের সহমত পোষ করেছেন। (ফাতহুল বারী লি ইবনে হাজার-৩/৩১২)

হযরত যুহাইর (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবূ ইসহাক (রহ.) থেকে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন, আমি সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-কে এই অবস্থায় পেয়েছি যে, তারা রমজানে সাদাকায়ে ফিতর খাবারের বিনিময়ে টাকা দ্বারা আদায় করতেন। (ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮, হাদীস-১০৩৭১) এটির সনদ সম্পূর্ণ সহীহ

৪.হযরত হাসান বসরী (রহ.) বলেন, টাকা দ্বারা সাদাকায়ে ফিতর আদায় করার দ্বারা কোন সমস্যা নেই। (ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮, হাদীস-১০৩৭০)

৫.এ বিষয়ে হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহ.) এর চিঠি- ওয়াকি (রহ.) বলেন: আমাদের কাছে উমার ইবনে আব্দুল আযীযের চিঠি পাঠিয়েছেন যে, সাদকাতুল ফিতরের পরিমাণ হলো প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষ থেকে আধা সাগম বা তার মূল্য আধা দিরহাম। (ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮, হাদীস-১০৩৬৯)

৬.এছাড়াও বিখ্যাত ইমাম-ইমাম ইবনে আবী শায়বা তার রচিত কিতাব ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮পৃ. এর মাঝে এই ভাবে অনুচ্ছেদ স্থাপন করেন যে-অর্থাৎ সাদাকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার (বৈধতা) সম্পর্কে।

৭.ইমাম বায়হাকী (রহ.) তার রচিত কিতাব সুনানুল কুবরা-৪/১৮৯ এর মাঝে এই ভাবে অনুচ্ছেদ স্থাপন করেন যে,

 بَابُمَنْأَ جَازَ أَخْذَ الْقِيَمِفِي الزَّكَوَاتِ অথাৎ এই অনুচ্ছেদ হলো টাকা দ্বারা যাকাত আদায় করা অনুমোদিত।

ফিতর পাওয়ার হকদার ব্যক্তি:

সাদাকাতুল ফিতর পাওয়ার উপযুক্ত তারাই, যারা যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত। তবে সমাজের দরিদ্র-অনাথ এবং নিজের গরীব আত্মীয় ও প্রতিবেশীকে দেয়াটাই অধিক উত্তম। কেননা হাদীসে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, দরিদ্রের খাবারের ব্যবস্থা করা।অতএব সাদাকাতুল ফিতর একমাত্র দরিদ্র-অনাথকে দিয়ে ঈদের আনন্দে তাদের শামিল করবে এবং নিজের রোজাকে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে পরিচ্ছন্ন করবে-এটাই হবে সাদাকাতুল ফিতরের লক্ষ্য।

ইবনে আব্বাস (রা.)থেকে বর্নিত হাদিসে রাসুল (সা.) শুধু মাত্র ফকীর ও মিসকীনদের মধ্যে বন্টন করতে নির্দেশ দিয়েছেনসুতরাং ফকীর ও মিকিনরা শুধু মাত্র ফিতরা পাওয়ার অধিকারি।(আবু দাউদ/১৬০৯; ইবনু মাজাহ/১৮২৭)

ফিতরা যাদের দেয়া যাবে না

যাদেরকে ফিতরা দেয়া বৈধ নয়যেমন: ১.কোনো ধনী ব্যক্তিকে, ২.ইসলামের দুশমনকে, ৩.কাফিরকে, ৪.মুরতাদকে, ৫.ফাসিককে, ৬.ব্যভিচারী বা ব্যাভিচারিনীকে, ৭.রোজগার করার ক্ষমতা রাখে এমন ব্যক্তিকে, ৮.জিম্মি ব্যক্তিকে, ৯.নিজের স্বামীকে, ১০.নিজের স্ত্রীকে, ১১.নিজের পিতাকে এবং সন্তান সন্ততিকে, ১২.কুরাইশ বংশের হাশিম বংশধরদের, ১৩.মসজিদ নির্মানে বা জনকল্যাণ মুলক কাজে ফিতরা দেয়া যাবে না।(সূত্র:মাসিক মদিনা-২০১৯ মার্চ)

ফিতরার মাল এক জায়গায় জমা করা যায় কি না?

ইবনু উমার (রা.) হতে বর্নিত, ইদুল ফিতরের একদিন কিংবা দু‘দিন পুর্বে আদায়কারী বা একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তির নিকট তা জমা দিতেন। তিনি আরও বলেন, সাহাবীরা ঐ ব্যক্তির নিকট জমা দিতেন, সরাসরি ফকির মিসকীনদের দিতেন না। (বুখার-২০৫ পৃষ্টা; আবু দাউদ ১ম খন্ড ২২৭ পৃষ্ঠা) সুতরাং ফিতরার দ্রব্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে বন্টনের জন্য জমা করা যেতেই পারে

কি পরিমাণ সম্পদ থাকলে ফিতরা দেয়া ওয়াজিব হয়?

ঈদের দিন যদি কোন মুসলিম ব্যক্তি তার ও তার পরিবারের প্রয়োজনীয় খাবারের চেয়ে অতিরিক্ত আরো ২কেজি ৪০গ্রাম পরিমাণ নির্দিষ্ট খাবার মওজুদ থাকে তাহলে ঐ ব্যক্তি ও তার পরিবারবর্গের সকল সদস্যদের উপর ফিতরা প্রদান ওয়াজিব হয়ে যাবে।

ইবনু উমার (রা) হতে বর্নিত, রাসুল (স.)সাদাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন প্রত্যেক স্বাধীন বা গোলাম, পুরুষ কিংবা নারী নির্বিশেষে সকল মুসলিমের উপর মাথা পিছু এক সাখেজুর বা যব রমজানের ফিতরা আদায় করা।(বুখারী-১৫০৩; মুসলিম-৯৮৪)

তবে ইমাম আবু হানীফার (রা.) মতে ঈদের দিন যাকাতের নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে অর্থাৎ ঐদিন ভোরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত হিসেবে যার ঘরে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা এর সমপরিমাণ নগদ অর্থ থাকবে শুধু ঐ পরিবারের উপর ফিতরা দেয়া ওয়াজিব হবে।

এছাড়াও রাসুল (স.)-এর দুটি হাদীসের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। তা হলো:

১.রাসূল করিম (স.)বলেন, স্বাধীন, কৃতদাস, নারী, পুরুষ, ছোট-বড় প্রত্যেক মুসলিমের প্রতি রমাযানের সিয়ামের কারণে এক সা খেজুর বা এক সা যব ফিতরা হিসেবে ফরয করে দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

২.সহীহ মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদের একটি বিশুদ্ধ হাদীসে আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে,

كُلِّ نَفْسٍ مِنَ الْمُسْلِمِينَ حُرٍّ، أَوْ عَبْدٍ، أَوْ رَجُلٍ، أَوِ امْرَأَةٍ، صَغِيرٍ أَوْ كَبِيرٍ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ  عَدَىِ الْفِطْرِ وَاَجِبً »

প্রত্যেক স্বাধীন, পরাধীন, নারী, পুরুষ, ছোট- বড়, ফকীর-ধনী প্রত্যেকের উপর জনপ্রতি এক সা ২কেজি ৪০গ্রাম পরিমাণ খেজুর ফিতরা হিসেবে দান করা ওয়াজিব। (সহীহ মুসলিম-২২৮১)

 

আমাদের চিন্তা ভাবনার বিষয়:

বর্মান সময়ে অনেকে ফিতরার নিসাব নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছেন যে, সাড়ে সাত ভরি সোনা কিংবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা বা সমপরিমাণ অর্থ থাকলে ফিতরা ওয়াজিব, এমন দলিল কিন্তু হাদীসে পাওয়া যায় না। ফিতরা যেহেতু রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করার জন্য ফরয করা হয়েছে, সুতরাং এই ফিতরা ধনি-গরীব সকলকেই দিতে হবে। গরীবদেরও তো রোযায় ভুল হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো গরীব লোকেরা পাবে কোথায়? তার উত্তর হলো: তারা ধনীদের কাছ থেকে ফিতরা গ্রহণ করে আবার নিজের পক্ষ থেকে অন্যকে দিবে।(সূত্র:সহীহ মুসলিম-২২৮১)

 

উপসংহার:

সর্বোপরি, ইসলামে ইতিকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। ইতিকাফ ইমান বৃদ্ধির একটি মুখ্য সুযোগ। অন্য দিকে দাকাতুল ফিতর বা যাকাতুল ফিতর ইসলামী শরীয়তে ওয়াজিব বিধান। দেশ, স্থান, কাল, পাত্র ও পরিস্থিতি ভেদে শরীয়তের মূল দৃষ্টিভঙ্গি সামনে রেখে গরীব মিসকিনের অধিক উপকার হয়। উপকার হয় সে বস্তু দিয়ে ফিতরাহ আদায় করাই শরীয়তের মূল লক্ষ্য।

সুতরাং মহান আল্লাহ তায়ালাআমাদের সকল ইবাদত সমুহ কবুল কুরুন। আমীন!

 

No comments:

Post a Comment

razzakhowlader59@gmil.com