Saturday, October 14, 2023

ইমামের দায়িত্ব কর্তব্য

 


ইমামের দায়িত্ব কর্তব্য

ধর্ম শিক্ষক-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার

ইমাম হচ্ছেন সমাজের সবচেয়ে সম্মানী ও মর্যাদাশালী ব্যক্তি। ইমাম শব্দটি কোরআনুল কারিমে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহূত হয়েছে। ইমাম অর্থ নেতাআল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা কুরআনুল কারিমে বলেছেন,

 وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا قَالَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ

“যখন ইবরাহিমকে তার রব কিছু বিষয়ে আনুগত্যের পরীক্ষা নিলেন, অতঃপর তিনি তা পুরোপুরি পূরণ করলেন, আল্লাহ বললেন, হে ইবরাহিম, আমি তোমাকে জাতির জন্য নেতা বানাতে চাই।” (সুরা বাকারা-:১২৪)

ইমাম অর্থ পথপ্রদর্শকবলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা বলেন,

وَمِنْ قَبْلِهِ كِتَابُ مُوسَى إِمَامًا وَرَحْمَةً  

“আর পূর্ববর্তী মুসার কিতাব যা ছিল পথপ্রদর্শক ও রহমত।”(সুরা হুদের-১১:১৭)

ইমাম এবং ইমামতি বিষয়টা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ইমামত দুই ধরনের হতে পারে, প্রথমত, ‘ইমামতে কুবরা’—বড় ইমামতি যা জনগণের সার্বিক কল্যাণে রাসূল (সা.)-এর প্রতিনিধি হিসেবে ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনাকে বোঝানো হয়ে থাকে। অবশ্য ইসলামি শরিয়ায় এর অনেক শর্ত রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ‘ইমামতে সুগরা’—ছোট ইমামতি নামাজের ইমামত ও মসজিদকেন্দ্রিক সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করা। আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) নবুওয়াতের মহান দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মদিনা রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন, তিনি নামাজের ইমামতিও করেছেন।

    ইসলামের দৃষ্টিতে ইমামতি কোনো পেশা নয়, বরং এটা হচ্ছে একটি মহান দায়িত্ব। ইমামের কাজের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে নবি করিম (সা.) ইমাম ও মুয়াজ্জিনের জন্য এই বলে দোয়া করেছেন, ‘ইমাম হচ্ছেন জিম্মাদার আর মুয়াজ্জিন হচ্ছেন আমানতদার। হে আল্লাহ! তুমি ইমামদের সঠিক পথ দেখাও আর মুয়াজ্জিনদের ক্ষমা করো।”(আবু দাউদ ও তিরমিযী)

এই হাদিসের প্রথম বাক্য হচ্ছে, ‘আল-ইমামু যামিনুন’- ইমাম জিম্মাদার; ইমাম দায়িত্বশীল হচ্ছেন মুসল্লিদের। তাদের নামাজ শুদ্ধ হলো কি না, তারা শুদ্ধ রূপে কোরআন পড়তে পারছেন কি না, তাদের আচার-আচরণ দুরস্ত হলো কি না, ইসলামের হুকুম আহকাম মেনে চলতে তারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন কি না, মূলত এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়াই ইমামের প্রধান দায়িত্ব। এছাড়া সমাজের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে মুসল্লিদের সম্পৃক্ত করে নেতৃত্ব দেওয়াও তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।

যেহেতু ইমামতি একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, তাই ইমামকে এ কাজের জন্য যেমন যোগ্য হতে হবে তেমনি তাকে মহত্ গুণের অধিকারীও হতে হবে। তাকে হতে হবে সত্ নিষ্ঠাবান তাকওয়াধারী আল্লাহওয়ালা আলেম। আমরা দেখে থাকি, সাধারণ মানুষ ইমামদের অনুসরণ করে থাকেন, তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে সে অনুযায়ী চলার চেষ্টা করেন। তাই ইমামগণ জনসাধারণকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান দানের পাশাপাশি তাদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করবেন। 

মানবসম্পদ উন্নয়নের বিভিন্ন দিক যেমন, প্রথমত, তাদের আত্মশুদ্ধির শিক্ষা দেওয়া, আত্মসমালোচনা করতে শেখানো, বেকারত্ব দূরীকরণে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রশিক্ষণ দেবেন। এতে করে সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূর হবে, মাদকাসক্তি দূর হবে, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ হবে, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল হবে। আর এসব কিছু তখনই সম্ভব হবে যদি একজন যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি ইমামতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ইমামকে নামাজের মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে। তিনি হাদিস ও ফেকাহের গ্রন্থসমূহ থেকে সলাত অধ্যায়টি খুব রপ্ত করে নেবেন। নামাজের মাসআলা-মাসায়েলের জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি ইসলামের সামগ্রিক বিধি-বিধান সম্পর্কেও তিনি যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী হবেন। আমল-আখলাকে দৃঢ়তা আনার জন্য প্রতিদিন কোরআন তেলাওয়াত, তাহাজ্জুদ ও অন্যান্য নফল নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়া একজন আদর্শ ইমামের বৈশিষ্ট্য। 

একজন যোগ্য ইমাম হতে হলে তাফসিরের কিতাব অধ্যয়নসহ ব্যক্তিগঠন বিষয়ক বই পুস্তক বেশি বেশি অধ্যয়ন করাও জরুরি। ইমামগণের বিশেষ দায়িত্ব হচ্ছে, জুমুআর খুতবায় সমকালীন বিষয়ে কোরআন হাদিসের আলোকে আলোচনা করা। মুসল্লিদের একটি নির্দিষ্ট সময়ে নামাজের মাসআলা-মাসায়েল শেখানো, বিশুদ্ধ কোরআন তেলাওয়াত শেখানো, নামাজের শুদ্ধ পদ্ধতি দেখানো, হালাল-হারাম সম্পর্কে অবহিত করাও ইমামের অন্যতম দায়িত্ব। ইমামের ভাষাগত দক্ষতা থাকতে হবে। কোরআন হাদিস ফেকাহ্ শাস্ত্রের জ্ঞানের পাশাপাশি মাতৃভাষায়ও ইমামকে দক্ষ হতে হবে। মাতৃভাষায় তিনি দক্ষ না হলে ইসলামি জীবনদর্শন সম্পর্কে মুসল্লিদেরকে স্পষ্ট করে বোঝাতে পারবেন না। ইসলামের বাণী সঠিকভাবে পৌঁছানোর জন্য আল্লাহ প্রত্যেক নবিকে তাদের স্বজাতির কাছে পাঠিয়েছিলেন। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, মাতৃভাষায় দক্ষ হওয়াও আলেম সমাজের কর্তব্য।

 

ইমাম অর্থ নেতা, আর নেতার অধিনে অধিনস্ত ব্যক্তিরা সামনের পথ চলে। নেতার আদেশ মান্য করা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ফরয। সুতরাং নেতা বা ইমামকে কমপক্ষে তার দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে জানতে হবে। নিম্নে ইমামের কতিপয় দায়িত্ব সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস তুলে ধরলাম।

.ইমামের চৌকোষ জ্ঞানের অধিকারি হতে হবে:

হাদীস দুটির ভাষায় এরকম এসেছে,

   عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمْ لِلنَّاسِ فَلْيُخَفِّفْ، فَإِنَّ مِنْهُمُ الضَّعِيفَ وَالسَّقِيمَ وَالْكَبِيرَ، وَإِذَا صَلَّى أَحَدُكُمْ لِنَفْسِهِ فَلْيُطَوِّلْ مَا شَاءَ ‏"‏‏.‏

হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ)থেকে বর্ণিত: আল্লাহ্‌র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “তোমাদের কেউ যখন লোকদের নিয়ে সালাত আদায় করে, তখন যেন সে সংক্ষেপ করে। কেননা, তাদের মাঝে দুর্বল, অসুস্থ ও বৃর্দ্ধ রয়েছে। আর কেউ যদি একাকী সালাত আদায় করে, তখন ইচ্ছামত দীর্ঘ করতে পারে।” (সহহ বুখারী-৭০৩)

.ইমামকে মুছল্লিদের কষ্ট বুঝে দায়িত্ব পালন করতে হবে:

 

 عَنْ أَبِي مَسْعُودٍ، قَالَ قَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي لأَتَأَخَّرُ عَنِ الصَّلاَةِ فِي الْفَجْرِ مِمَّا يُطِيلُ بِنَا فُلاَنٌ فِيهَا‏.‏ فَغَضِبَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَا رَأَيْتُهُ غَضِبَ فِي مَوْضِعٍ كَانَ أَشَدَّ غَضَبًا مِنْهُ يَوْمَئِذٍ ثُمَّ قَالَ ‏ "‏ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ مِنْكُمْ مُنَفِّرِينَ، فَمَنْ أَمَّ النَّاسَ فَلْيَتَجَوَّزْ، فَإِنَّ خَلْفَهُ الضَّعِيفَ وَالْكَبِيرَ وَذَا الْحَاجَةِ ‏"‏‏.‏

হযরত আবূ মাসউদ (রাঃ)থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, এক সাহাবী এসে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! অমুক ব্যক্তির জন্য আমি ফজরের সালাতে অনুপস্থিত থাকি। কেননা, তিনি আমাদের সালাত খুব দীর্ঘায়িত করেন।এ শুনে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাগান্বিত হলেন।আবূ মাসউদ (রাঃ) বলেন, নসীহাত করতে গিয়ে সে দিন তিনি যেমন রাগান্বিত হয়েছিলেন, সে দিনের মত রাগান্বিত হতে তাঁকে আর কোন দিন দেখিনি। অতঃপর তিনি বললেনঃ হে লোকেরা! তোমাদের মধ্যে বিতৃষ্ণা সৃষ্টিকারী রয়েছে। তোমাদের মধ্যে যে কেউ লোকদের ইমামাত করে, সে যেন সংক্ষেপ করে। কেননা, তার পিছনে দুর্বল, বৃদ্ধ ও হাজতওয়ালা লোকেরা রয়েছে।” (সহহ বুখারী-৭০৪)

ইসলামের দৃষ্টিতে ইমামতি একটি মহান দায়িত্ব। সুন্দর ও সম্মানজনক পদ। আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) নিজে ইমামতি করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম এই মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের পরবর্তী মুসলমানদের সর্বোত্তম পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ সমাজের ইমামতি করেছেন।

নবী করিম (সা.) ইমামের মর্যাদাকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সাথে সাথে এই মহান দায়িত্ব পালনে ইমামদের সতর্কও করেছেন। বিভিন্ন হাদিসে তাদের অনেক ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে।

ইমামের জন্য নবীজির (সা.) দোয়া : 

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মসজিদের ইমাম হলো মুসল্লিদের জন্য জিম্মাদার এবং মুয়াজ্জিন আমানাতদারস্বরূপ। হে আল্লাহ, তুমি ইমামদের সৎপথ প্রদর্শন কর এবং মুয়াজ্জিনদের ক্ষমা কর।’ (তিরমিজি-২০৭)

সঠিক সময়ে নামাজ পড়ানোর সওয়াব : 

উকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি সঠিক সময়ে লোকদের নিয়ে জামাতে নামাজ আদায় করছে, এজন্য সে (ইমাম) নিজে ও মুকতাদিগণও পরিপূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হবে।

অপরপক্ষে যদি কোনো সময় ইমাম সঠিক সময়ে নামাজ আদায় না করে তবে এজন্য সে দায়ী হবে কিন্তু মুকতাদিগণ পরিপূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হবে।’ (আবু দাউদ-৫৮০)

ইমাম মিশকের স্তূপের ওপর থাকবে : 

হাদিস শরিফে এসেছে, তিন ব্যক্তি মিশকের স্তূপের ওপর থাকবে।

হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, তিন ব্যক্তি কিয়ামতের দিন মিশকের কস্তুরির স্তূপের ওপর থাকবে-

১. যে ক্রীতদাস আল্লাহ ও তার প্রভুর হক ঠিকমতো আদায় করে।

২. যে ব্যক্তি কোনো কওমের ইমামতি করে আর তারা তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং

৩. “যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য প্রত্যেক দিন ও রাতে আজান দেয়।” (তিরমিজি-১৯৮৬)

কিয়ামতের দিন উল্লিখিত তিন শ্রেণির লোককে মিশকের স্তূপে আল্লাহ এ জন্য রাখবেন যে, এরা দুনিয়ার জীবনে নিজেদের কামনা-বাসনাকে পরিত্যাগ করে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসুলের (সা.) নির্দেশনাগুলোকে মাথা পেতে নিয়েছিল। এজন্য মহান আল্লাহ বিনিময়ে তাদের খোশবুর আকৃতিতে বিরাট প্রতিদান দেবেন যাতে অন্যান্য লোকদের ওপর তাদের মর্যাদা প্রমাণিত হয়।

নামাজ সংক্ষিপ্ত করা : 

ইমামের মূল দায়িত্ব হলো, নামাজ পড়ানো। এজন্য নামাজের যাবতীয় দিক খেয়াল রাখা একজন ইমামের জন্য অবশ্য কর্তব্য। তন্মধ্যে একটি হলো, জামাতের নামাজ সংক্ষিপ্ত করা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত- নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ লোকদের ইমামতি করলে সে যেন (নামাজ) সংক্ষেপ করে। কেননা তাদের মধ্যে ছোট বালক, দুর্বল ও অসুস্থ লোক থাকতে পারে। যখন সে একাকী নামাজ আদায় করে, তখন নিজ ইচ্ছামতো (দীর্ঘ করে) আদায় করতে পারে।’ (বুখারি-২৩৬)

প্রাকৃতিক প্রয়োজনের বেগ নিয়ে নামাজে না দাঁড়ানো : 

হজরত সাওবান (রা.) হতে বর্ণিত- হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘প্রাকৃতিক প্রয়োজনের বেগ নিয়ে কেউ যেন নামাজে না দাঁড়ায়।’ (তিরমিজি-৩৫৭)

কাতার সোজার হওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ : 

কাতার ঠিক করা ওয়াজিব। এটি নামাজ পরিপূর্ণ করার অন্তর্ভুক্ত। ইমাম সাহেবের বিষয়টি খেয়াল করতে হবে। ওমর (রা.) হতে বর্ণিত আছে- তিনি কাতার ঠিক করার জন্য একজন লোক নিযুক্ত করতেন।

যে পর্যন্ত না তাকে জানানো না হতো যে, কাতার সোজা হয়েছে সে পর্যন্ত তিনি তাকবির (তাহরিমা) বলতেন না। ওসমান এবং আলী (রা.) এদিকে তীক্ষ্ন নজর রাখতেন এবং তারা বলতেন, তোমরা সোজা হও। আলী (রা.) তো নাম ধরেই বলতেন, অমুক একটু আগাও, অমুক একটু পিছাও।  (তিরমিজি-১/৩০২)

 

 

মুসল্লিদের অসন্তুষ্টি নিয়ে ইমামতি না করা :

আমর ইবনে হারেস ইবনে মুস্তালিক (রহ.) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘কথিত আছে, দুই ব্যক্তির ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ শাস্তি হবে : যে নারী তার স্বামীর অবাধ্যচরণ করে এবং কোনো গোত্রের ইমাম যাকে তারা অপছন্দ করে।’ (তিরমিজি-৩৫৯)

ইমাম মুসল্লিদের প্রতিনিধি : 

ইমাম তার অধীন লোকদের পক্ষ থেকে আল্লাহর দরবারে প্রতিনিধিত্ব করেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের মধ্যকার উত্তম ব্যক্তিকে তোমাদের ইমাম নিয়োগ করবে। কারণ তিনি হবেন তোমাদের পক্ষে তোমাদের প্রতিপালকের প্রতিনিধি।’ (দারাকুতনি-১৮৮১)

ইমাম দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে : 

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত- রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো কওমের ইমাম নিযুক্ত হয়, সে যেন আল্লাহকে ভয় করে এবং জেনে রাখে যে, সে তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। যদি সে তার দায়িত্ব সুচারুরূপে আঞ্জাম দেয়, তবে তার পশ্চাদ্বর্তী মুসল্লির সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে। কিন্তু তাদের সওয়াব সামান্যও কম করা হবে না। তবে নামাজে যদি কোনো ত্রুটি হয়, তবে তার দায়িত্ব তারই।’ (আল মুজামুল আওসাত-৭৭৫৫)

মুসল্লিদের খোঁজ-খবর নেওয়া : 

মুসল্লিদের খোঁজ-খবর নেওয়া একজন আদর্শ ইমামের কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে খুব চমৎকার বলা হয়েছে হাদিস শরিফে। হজরত আবু সুলাইমান মালেক ইবনে হুয়াইরিস (রা.) বলেন, ‘আমরা কয়েকজন সমবয়সি যুবক নবী করিম (সা.)-এর খেদমতে হাজির হলাম এবং বিশ দিন পর্যন্ত তাঁর খেদমতে থাকলাম।

তিনি যখন অনুভব করলেন যে, আমরা ঘরে ফিরতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছি, তখন তিনি আমাদের বাড়ির লোকজন সম্পর্কে আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন। আমরা নিজ বাড়ির অবস্থা তাঁর কাছে বর্ণনা করলাম। তিনি অত্যন্ত কোমল হূদয় ও দয়ালু ছিলেন।

বললেন, আচ্ছা, এবার তোমরা নিজেদের পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যাও! তাদেরকে গিয়ে (এখানে যা শিখে গেলে তা) শেখাও এবং সৎকাজে আদেশ কর এবং আমাকে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখলে, সেরূপ নামাজ পড়। যখন নামাজের সময় হবে, তখন তোমাদের মধ্যে একজন উঠে আজান দেবে এবং তোমাদের মধ্যে যে সবার বড়, সে ইমামতি করবে। (আল আদাবুল মুফরাদ-২১৩)

আর শুধু নামাজ পড়ালেই হবে না; বরং মুসল্লিদের নামাজ শুদ্ধ হচ্ছে কি না খেয়াল রাখতে হবে। যারা নামাজ পড়ে না, তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে মসজিদে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। নবীজি (সা.) তো হাটে-বাজারে, অলিতে-গলিতে, বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ঘুরে মানুষকে নামাজের দাওয়াত দিয়েছেন। আল্লাহর দিকে ডেকেছেন। তাহলে ইমামদের এতে লজ্জা হবে কেন?

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, ইমামের জন্য ফরজের আগে-পরের সুন্নত নামাজের প্রতি বিন্দুমাত্র অমনোযোগিতা খুবই দৃষ্টিকটু। এটা মুসল্লিদের ওপর প্রভাব পড়ে। তাই একজন ইমামের জন্য শুধু সুন্নতে মুয়াক্কাদা নয়; বরং নফলের প্রতিও গুরুত্বারোপ করা উচিত।

মসজিদের ইমাম সমাজেরও ইমাম : 

ইমামতি সাধারণ কোনো পেশা নয়। এর রয়েছে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য। সেবার মানসিকতা নিয়েই এ পেশায় আত্মনিয়োগ করা উচিত। একজন ইমাম শুধু মসজিদের ইমাম নন; বরং তিনি সমাজেরও ইমাম। মানুষ, মনুষ্যত্ব ও সমাজ নিয়েও একজন নবীর উত্তরাধিকারী ইমামকে ভাবতে হবে। একজন ইমাম হতে পারেন মানবতার পথপ্রদর্শক।

ইমাম বোধসম্পন্ন হলে, তার সংশ্রবে থেকে মুসল্লিরা ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মিতার গুণ শেখে। একজন ইমামই পারেন দিগ্ভ্রান্ত মানুষকে সরল পথে পরিচালিত করতে। আল্লাহর সত্তার সঙ্গে মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিতে। ইমামকে সকলের আস্থাভাজন হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেন সকলে নিজের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, জাগতিক ও ধর্মীয় সব বিষয়ে মতের আদান-প্রদান করতে পারেন। লেনদেন, বিয়ে-শাদি ও অন্যান্য কার্যক্রমে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নির্বাচন করতে পারেন।  

বেতন-ভাতা প্রসঙ্গ : 

বর্তমান সময়ে বাজারের অবস্থা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। তা ছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থাও অনেক ব্যয়বহুল। তাই একজন ইমামের সম্মানজনক বেতন-ভাতা ধার্য করা, তাঁর জীবন-যাপনের স্তরকে ওপরে উঠানো উচিত, যাতে করে বিনা টেনশনে তিনি একাগ্রতার সঙ্গে দিনের খেদমত আঞ্জাম দিতে পারেন।

শেষকথা:

সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, মসজিদে নববিতে আখেরি নবি সাইয়্যেদুল মুরসালিন ইমামুল আম্বিয়া মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) আজীবন ইমামের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মসজিদে নববিকে তিনি শুধু নামাজের জন্য সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং সমাজ উন্নয়নের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি তা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। আমরা যদি প্রতিটি মসজিদকে নবিজির দেখানো সেই মসজিদে নববির রোল মডেল রূপে গড়ে তুলতে পারি তাহলে আমাদের সমাজ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে, সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূর হবে, সমাজে ব্যাপকভাবে জনকল্যাণমূলক কাজ পরিচালনা করা সম্ভব হবে।  

 

 

 

 

No comments:

Post a Comment

razzakhowlader59@gmil.com