ভুমিকম্পের কারণ
ও প্রতিকারের উপায়
এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
(প্রথম পর্ব)
শুরুকথা:
ভূ-অভ্যন্তরে শিলায় পীড়নের জন্য যে শক্তির
সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হঠাৎ মুক্তি ঘটলে ভূ-পৃষ্ঠ
ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূ-ত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এই রূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী
কম্পনকে ভূমিকম্প বলে। কম্পন-তরঙ্গ থেকে যে শক্তির সৃষ্টি হয়, তা ভূমিকম্পের মাধ্যমে প্রকাশ
পায়।
ভূমিকম্প ( Earthquake):
পৃথিবীর কঠিন
ভূত্বকের কোন কোন অংশ প্রাকৃতিক কোন কারণে কখনো কখনো অল্প সময়ের জন্য হঠাৎ কেঁপে
ওঠে। ভূত্বকের এরূপ আকস্মিক কম্পনকে ভূমিকম্প বলে। ভূকম্পন সাধারণত কয়েক সেকেন্ড
স্থায়ী হয়, আবার কখনো কিছু সময় পর পর অনুভূত হয়। এ
কম্পন কখনো অত্যন্ত মৃদু আবার কখনো অত্যন্ত প্রচন্ড হয়।
ভূমিকম্পের প্রধান কারণ ( Main
cause of earthquakes) :
১। পৃথিবীর উপরিভাগ কতগুলো ফলক/ প্লেট দ্বারা
গঠিত। এই প্লেট সমূহের সঞ্চালন প্রধানত ভূমিকম্প ঘটিয়ে থাকে।
২। অগ্ন্যুৎপাতের ফলে প্লেট সমূহের উপর
ভূমিকম্পন সৃষ্টি হয়।
অপ্রধান কারণঃ
(১) শিলাচ্যুতি বা শিলাতে ভাঁজের সৃষ্টিঃ কোন কারণে ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে বড় ধরনের
শিলাচ্যুতি ঘটলে বা শিলাতে ভাঁজের সৃষ্টি হলে ভূমিকম্প হয়। ১৯৩৫ সালে বিহারে এবং
১৯৫০ সালে আসামে এই কারণেই ভূমিকম্প হয়।
(২) তাপ বিকিরণঃ ভূত্বক তাপ বিকিরণ করে সংকুচিত হলে ফাটল ও
ভাঁজের সৃষ্টি হয়ে ভূমিকম্প হয়।
(৩) ভূগর্ভস্থ বাষ্পঃ পৃথিবীর অভ্যন্তরে অত্যাধিক তাপের কারণে
বাষ্পের সৃষ্টি হয়। এই বাষ্প ভূত্বকের নিম্নভাগে ধাক্কা দেওয়ার ফলে প্রচন্ড
ভূকম্পন অনুভূত হয়।
(৪) ভূগর্ভস্থ চাপের বৃদ্ধি বা হ্রাসঃ অনেক সময় ভূগর্ভে হঠাৎ চাপের হ্রাস বা
বৃদ্ধি হলে তার প্রভাবে ভূমিকম্প হয়।
(৫) হিমবাহের প্রভাবঃ হঠাৎ করে হিমবাহ পর্বতগাত্র থেকে নিচে পতিত
হলে ভূপৃষ্ঠ কেঁপে ওঠে এবং ভূমিকম্প হয়।
ভূমিকম্পের ফলাফল (Effects
of earthquakes):
ভূমিকম্পের ফলে
ভূপৃষ্ঠে অনেক ধরনের পরিবর্তন ঘটে এবং বহু ধ্বংসলীলা সাধিত হয়। বাড়িঘর ধন-সম্পদ
ও যাতায়াত ব্যবস্থা বিনষ্ট হয়। এতে জীবনেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে। নিচে
ভূমিকম্পের ফলাফল আলোচনা করা হলোঃ
(১) ভূমিকম্পের ফলে ভূত্বকের
মধ্যে অসংখ্য ভাঁজ, ফাটল বা ধসের সৃষ্টি হয়। নদীর গতিপথ পাল্টে
যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ১৭৮৭ সালে আসামে যে ব্যাপক ভূমিকম্প হয় তাতে পুরাতন
ব্রহ্মপুত্র নদের তলদেশ কিছুটা উঁচু হয়ে যায়। ফলে নদীটি তার গতিপথ পাল্টে
বর্তমানে যমুনা নদী দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে।
(২) ভূমিকম্পের ফলে অনেক সময় সমুদ্রতল উপরে
উথিত হয়, পাহাড়- পর্বত বা দ্বীপের সৃষ্টি করে। আবার
কোথাও স্থলভাগের অনেক স্থান সমুদ্রতলের ডুবে যায়। ১৮৯৯ সালে ভারতের কচ্ছ উপসাগরের
উপকূলে প্রায় ৫,০০০ বর্গকিলোমিটার স্থান সমুদ্রগর্ভে
নিমজ্জিত হয়।
(৩) ভূমিকম্পের ফলে অনেক সময় নদীর গতি
পরিবর্তন হয় বা কখনো কখনো বন্ধ হয়ে যায়। কখনো কখনো নদী শুকিয়ে যায়। আবার সময়
সময় উচ্চভূমি অবনমিত হয়ে জলাশয় এর সৃষ্টি হয়। ১৯৫০ সালে আসামের ভূমিকম্পে দিবং
নদীর গতি পরিবর্তিত হয়।
(৪) ভূমিকম্পের ফলে অনেক সময় পর্বতগাত্র থেকে
হিমানী সম্প্রপাত হয় এবং পর্বতের উপর শিলাপাত হয়।
(৫) ভূমিকম্পের ফলে হঠাৎ করে সমুদ্র উপকূল সংলগ্ন এলাকা জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়।
ভূমিকম্প
কী?
ভূমিকম্প হচ্ছে
ভূমির কম্পন। ভূ অভ্যন্তরে যখন একটি শিলা অন্য একটি শিলার উপরে উঠে আসে তখন ভূমি
কম্পন হয়। পৃথিবীপৃষ্ঠের অংশবিশেষের হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন বা আন্দোলনই ভূমিকম্পন।
হঠাৎ যদি ঘরের কোনো জিনিস দুলতে শুরু করে—যেমন, দেয়ালঘড়ি, টাঙানো ছবি বা খাটসহ অন্য যেকোন আসবাব—বুঝতে হবে
ভূমিকম্প হচ্ছে। সহজ কথায় পৃথিবীর কেঁপে ওঠাই ভূমিকম্প।
সারা পৃথিবীতে বছরে গড়ে ছয় হাজার ভূমিকম্প
হয়। এগুলোর বেশিরভাগই মৃদু, যেগুলো আমরা টের পাই না। সাধারণত তিন ধরনের
ভূমিকম্প হয়ে থাকে—প্রচণ্ড, মাঝারি ও মৃদু। আবার উৎসের গভীরতা অনুসারে
ভূমিকম্পকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়—অগভীর, মধ্যবর্তী ও গভীর ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের
কেন্দ্রস্থল ভূ-পৃষ্ঠের ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে অগভীর, ৭০ থেকে ৩০০
কিলোমিটারের মধ্যে হলে মধ্যবর্তী এবং ৩০০ কিলোমিটারের নিচে হলে তাকে গভীর ভূমিকম্প
হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ভূমিকম্প কেন হয়:
ভূ-অভ্যন্তরে
স্থিত গ্যাস যখন ভূ-পৃষ্ঠের ফাটল বা আগ্নেয়গিরির মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে তখন সেই
গ্যাসের অবস্থানটি ফাঁকা হয়ে পড়ে আর পৃথিবীর উপরের তলের চাপ ওই ফাঁকা স্থানে দেবে
গিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখে। তখনই ভূ-পৃষ্ঠে প্রবল কম্পনের অনুভব হয় যা ভূমিকম্প নামে
পরিচিত। সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে—ভূ-পৃষ্ঠের হঠাৎ
পরিবর্তন জনিত কারণে, আগ্নেয়গিরি সংঘটিত হওয়ার কারণে ও শিলাচ্যুতি
জনিত কারণে।
ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব:
ভূমিকম্পের
স্থায়িত্ব সাধারণত কয়েক সেকেন্ড হয়ে থাকে। কিন্তু এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হয়ে
যেতে পারে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। ভূমিকম্পের মাত্রা অনুযায়ী ব্যাপক প্রাণহানি ও
ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ণয়ের জন্য যে যন্ত্র ব্যবহৃত হয় তার
নাম রিখটার স্কেল। রিখটার স্কেলে এককের সীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত। এই স্কেলে মাত্রা
৫-এর বেশি হওয়া মানেই ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কা। ভূমিকম্প এক ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলে এর
মাত্রা ১০ থেকে ৩২ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা—৫ -৫.৯৯ মাঝারি, ৬- ৬.৯৯ তীব্র, ৭-৭.৯৯ ভয়াবহ
এবং ৮-এর উপর অত্যন্ত ভয়াবহ।
ভূমিকম্পের সময় করনীয়
কাজ:
Ø ভূমিকম্প হচ্ছে টের
পেলে বা খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে ফাঁকা ও উন্মুক্ত স্থানে আশ্রয় নিন।
Ø উঁচু ভবনে থাকলে
এবং বের হতে না পারলে জানালা বা দেয়ালের পাশে অবস্থান না নিয়ে শক্ত কোনো বীম, টেবিলের নিচে
অবস্থান নিন।
Ø হতবিহ্বল না হয়ে
ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন।
Ø বহুতল ভবনে একই
জায়গায় অনেক মানুষ একসঙ্গে না থেকে ভাগ হয়ে আশ্রয় নিন।
Ø আপনার মুঠোফোনে
ফায়ার সাভির্স এবং দরকারি মোবাইল নম্বরগুলো আগাম সতর্কতা হিসেবে আগেই রেখে দিন।
বিপদের সময় আপনার কাজে লাগবে।
Ø দ্রুত নামার
জন্য ভবন থেকে লাফিয়ে পড়বেন না।
Ø ভূমিকম্পের সময়
সম্ভব হলে মাথার ওপর শক্তকরে বালিশ অথবা অন্য কোনো শক্ত বস্তু [কাঠবোর্ড, নরম কাপড় চোপড়ের
কুণ্ডলি] ধরে রাখুন।
Ø গ্যাস এবং
বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে দূরে অবস্থান নিন।
Ø উচু ভবন থেকে
দ্রুত নামার জন্য লিফট ব্যবহার করবেন না।
Ø ভূমিকম্পের সময়
গাড়িতে থাকলে গাড়ি খোলা জায়গায় থামিয়ে গাড়িতেই থাকুন।
Ø একবার
ভূমিকম্পের পরপরই আরেকটা ছোট ভূমিকম্প হয় যাকে ‘আফটার শক’ বলে। নিজেকে বিপদমুক্ত ভাবতে অন্তত একঘণ্টা
সময় নিন।
Ø ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি রোধে যা করণীয়:
প্রতিনিয়ত বিশ্ব
কোন না কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে। ভূমিকম্প প্রাকৃতিক দূর্যোগের
মধ্যে খুবই বিধ্বংসী একটি। ভূমিকম্প সাধারণত কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই
সংঘটিত হয়ে থাকে। তাই এর ক্ষয়ক্ষতিও অনেক বেশি হয়ে থাকে। ভূমিকম্প যেহেতু আচমকা
সংঘটিত হয়ে থাকে সেহেতু অনেকেই তাৎক্ষণিক বুঝে উঠতে পারেন না কী করবেন। তবে একটু
সচেতন হলে এবং কয়েকটি বিষয় মেনে চললে সহজেই ভূমিকম্পের ধাক্কা থেকে যথাসম্ভব
নিরাপদে থাকা যাই। ভূমিকম্পের সময় কি করণীয় সে সম্পর্কে সচেতন সৃষ্টির লক্ষ্যে জানাচ্ছে
ডিএমপি নিউজ।
ভূমিকম্পের
সময় আপনি কি করবেনঃ
১. ভূকম্পন অনুভূত হলে আতঙ্কিত হবেন না।
২. ভূকম্পনের সময় বিছানায় থাকলে বালিশ দিয়ে
মাথা ঢেকে টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোন আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয়
নিন।
৩. রান্না ঘরে থাকলে গ্যাসের চুলা বন্ধ করে
দ্রুত বেরিয়ে আসুন।
৪. বীম, কলাম ও পিলার ঘেষে আশ্রয় নিন।
৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালে শিশুদের
স্কুল ব্যাগ মাথায় দিয়ে শক্ত বেঞ্চ অথবা শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নিতে বলুন।
৬. ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু বাড়ি, বৈদ্যুতিক খুঁটি
থেকে দুরে খোলাস্থানে আশ্রয় নিন।
৭. গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী, হাসপাতাল, মার্কেট ও
সিনেমা হলে থাকলে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে ভিড় কিংবা ধাক্কাধাক্কি না করে দুহাত
মাথা ঢেকে বসে পড়ূন।
৮. ভাঙ্গা দেয়ালের নিচে চাপা পড়লে বেশি নড়া
চড়ার চেষ্টা করবেন না। কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখুন, যাতে ধুলা বালি শ্বাসনালিতে না ঢোকে।
৯. একবার কম্পন হওয়ার পর আবারও কম্পন হতে
পারে। তাই সুযোগ বুঝে বের হয়ে খালি জায়গায় আশ্রয় নিন।
১০. উপর তলায় থাকলে কম্পন বা ঝাঁকুনি না থামা
পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে লাফ দিয়ে বা লিফট ব্যবহার করে নামা থেকে
বিরত থাকুন।
১১. কম্পন বা ঝাঁকুনি থামলে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত
বেরিয়ে পড়ুন এবং খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিন।
১২. গাড়ীতে থাকলে ওভার ব্রীজ, ফ্লাইওভার, গাছ ও বৈদ্যুতিক
খুঁটি থেকে দূরে গাড়ী থামান। ভূকম্পন না থামা পর্যন্ত গাড়ীর ভেতরে থাকুন।
১৩. ব্যাটারীচালিত রেডিও, টর্চলাইট, পানি এবং
প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম বাড়িতে রাখুন।
১৪. বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করুন।
ভূমিকম্প থেকে মূক্তি পেতে করণীয়:
ভূমিকম্পজনিত
দুর্যোগ থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষার প্রয়োজনে সম্ভাব্য ভূমিকম্প মোকাবিলায়
সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে নিচের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
১. জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
২. ভূমিকম্প মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতি।
৩. ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার, ত্রাণ ও পুনর্গঠন কর্মসূচি ইত্যাদি।
শেষকথা:
ভূমিকম্পো একটি প্রকৃতিক দূর্যোগ। মানুষের উপর
বিভিন্ন সময় মহান আল্লাহ তায়ালা পরীক্ষা স্বরূপ দিয়ে থাকেন।সম্প্রতি তুরুস্ক ও
সিরিয়ায় গত ০৬ই ফেব্রুয়ারী-২০২৩ তারিখ সোমবার ভোররাতে ৭.৮ মাত্রায় ভূকম্পোনে নিহত হয় অসংখ্য মানুষ। বিদস্ত স্থাপনায় চাপা পরে
রয়েছে অনেক মানুষ। আমরা তাদের জন্যে দোয়া করি।