Friday, October 09, 2020

ঈদুল আযহা, কুরবানীর পরিচয় ও আহকাম

 


(ঈদের আলোচনা)

ঈদুল আযহা, কুরবানীর পরিচয় ও আহকাম

০২. ভূমিকাঃ

মানুষ সমাজ জীবনে নানা রকম ধর্মীয় ও সামাজিক আনন্দ-উৎসব পালন করে থাকে।অমরা মুসলমানগন দুটি বড় ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকি, যেমনঃ ঈদুল আজহা (১০ই যিলহজ্ব) ও ঈদুল ফিতর (১লা শাওয়াল)। সুতরাং আজ আমরা ঈদুল আযহা, কুরবানীর পরিচয় ও আহকামসম্পর্কে আলোচনা করব। (ইন্শায়াল্লাহ্)

০৩. ঈদ শব্দের অর্থঃ

১। আজ পবিত্র ঈদুল আযহা। ঈদ শব্দের শাব্দিক অর্থ খুশী, আনন্দ, উৎসব, প্রত্যাবর্তন, ফিরে আসা, বার বার আগমন, পূণর্মিলন ইত্যাদি।

আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ঈদ হচ্ছে বান্দার জন্য বিরাট নিয়ামত, আতিথেয়তা বা জিয়াফত। তাই রাসূল (সাঃ) ঈদের দিন রোযা রাখাকে হারাম করেছেন।

হাদীস শরীফে রয়েছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ «أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنْ صِيَامِ يَوْمَيْنِ يَوْمِ الْأَضْحَى، وَيَوْمِ الْفِطْرِ» -(مسلم-2539)

 রাসূল (সাঃ) দুদিন রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন, ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের দিন। (মুসলিম-ই.ফা.বা-২৫৩৯,,সে-২৫৩৮)

 

 

 

০৪.  আযহা শব্দের অর্থঃ

আযহা শব্দের অর্থ অর্ধ-দ্বিপ্রহর, রক্তপ্রবাহিত করণ ইত্যাদি। কুরআন ও হাদীসে এই দিনটির আরোও কিছু নাম ও পরিচয় পাওয়া যায়। যেমনঃ- ঈদুল আযহা বা অর্ধ-দুপুরের আনন্দ। ইয়াওমুন নাহার বা রক্ত প্রবাহের দিন। ইয়াওমুয যাবাহ বা  পশু যবেহের দিন। ইয়াওমুন নুসুক বা কুরবানীর দিন। ইয়াওমুল কুরবানী বা আত্মত্যাগ ও  নৈকট্যলাভের দিন।

 

কুরবানী শব্দের অর্থ ও তার প্রচলন

০৫. কুরবানী قربانى শব্দটি আরবী কুরবানقربان যা ক্বারবقرب শব্দ থেকে একটু পরিবর্তন হয়ে এসেছে। কুরবানقربان শব্দটি পবিত্র কুরআনে  ৩ (তিন) জায়গায় এসেছে- যেমন- (১) সুরা আলে ইমরান-আয়াত-১৮৩,(২) সুরা আল মায়েদা, আয়াত-২৭, (৩) সুরা আল আহক্বাফ, আয়াত-২৮।

এর অর্থ নৈকট্য, সান্নিধ্য। পবিত্র কুরআনে এসেছে-

 فَلَوْلَا نَصَرَهُمُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِن دُونِ اللَّهِ قُرْبَانًا آلِهَةً ۖ بَلْ ضَلُّوا عَنْهُمْ ۚ وَذَٰلِكَ إِفْكُهُمْ وَمَا كَانُوا يَفْتَرُونَ [٤٦-٢٨] ﴿الأحقاف ٢٨﴾

অতঃপর আল্লাহ্র পরিবর্তে তারা যাদেরকে সান্নিধ্য লাভের জন্যে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিল, তারা তাদেরকে সাহায্য করল না কেন ? বরং তারা তাদের কাছ থেকে উধাও হয়ে গেল। এটা ছিল তাদের মিথ্যা ও মনগড়া বিষয়। (সুরা আহকাফ-২৮)

০৬. অআত্মোৎসর্গ, পশু যবেহ করা, রক্ত প্রবাহিত করা ইত্যাদি।

শরীয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট কতিপয় গৃহপালিত হালাল প্রাণীকে জিলহজ্জ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে আল্লাহ্ তায়ালার নৈকট্য অর্জনের জন্য উৎসর্গ করাকে কুরবানী বলে। ইসলামি শরিয়তে এটি ইবাদত হিসেবে সিদ্ধ। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে যে পশু জবেহ করা হয় তা তিন ধরনের। যেমনঃ- (১) হাদী (২) কুরবানী (৩) আক্বীক্বাহ্।

০৭. কুরবানীকে মানাসিকও বলা হয়। পবিত্র কুরআনে এসেছে-

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ

আর আমি প্রত্যেক উ¤মতের জন্য কুরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহ্র দেয়া চতু¯পদ জন্তু যবেহ করার সময় আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করে। (সুরা হজ্জ, আয়াত-৩৪)

ঈদের উৎপত্তি বা সুচনা

০৮. ইসলাম পূর্বযুগের উৎসব ও আমাদের ঈদ উৎসবঃ

            পৃথিবীর সকল ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষের জন্য রয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই আনন্দ উৎসবের বিভিন্ন দিন। যেমনঃ হাদীসে এসেছে-

عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَدِمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ وَلَهُمْ يَوْمَانِ يَلْعَبُونَ فِيهِمَا فَقَالَ «مَا هَذَانِ الْيَوْمَانِ؟» قَالُوا كُنَّا نَلْعَبُ فِيهِمَا فِي الْجَاهِلِيَّةِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ" قَدْ أَبْدَلَكُمُ اللَّهُ بِهِمَا خَيْرًا مِنْهُمَا يَوْمَ الْأَضْحَى وَيَوْمَ الْفِطْرِ ".( رَوَاهُ أَبُو دَاوُد-1134-شعب الايمان-3437- [حكم الألباني] صحيح)

হযরত আনাস বিন মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আগমন করলেন তখন তাদের অর্থাৎ মদীনাবাসীদের দুটি দিন নির্ধারিত ছিল, যে দিনগুলিতে তারা খেলাধুলা ও আনন্দ ফুর্তি করত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এই দুটি দিবস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, দিবস দুটি কি? মদীনাবাসিরা প্রতুত্তোরে বলেন, আমরা জাহেলিয়ার যুগে এই দুই দিবসে খেলাধুলা (উৎসব) করতাম। তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের এই দিনদ্বয়ের পরিবর্তে উহার চেয়েও উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। আর তা হল ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিত্র। (আবু দাউদ-১১৩৬, আহমদ, নাসাঈ)

০৯. অন্য একটি হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ لِكُلِّ قَوْمٍ عِيدًا، وَهَذَا عِيدُنَا».(بخارى-957-مسلم-1934)

 হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “প্রত্যেকটি জাতীরই একটা আনন্দের দিন রয়েছে আর ইহা হল আমাদের (ঈদের) আনন্দের দিন। (বুখারী-৯৫৭, মুসলিম-১৯৩৪)

 

১০. কুরবানীর মর্মকথা:

মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কুরবানী হলো হযরত আদম (আঃ)-এর দুই সন্তান হাবিল ও কাবিলের কুরবানী। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেনঃ

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِن أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الآخَرِ-سورة المائدة২৭-

আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের (হাবিল ও কাবিলের) বাস্তব অবস্থা পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়েই (পিতার নির্দেশে)কিছু কুরবানী নিবেদন করেছিল, তখন তাদের একজনের কুরবানী গৃহীত হয়েছিল এবং অপরজনের কুরবানী গৃহীত হয়নি। (সূরা মায়েদা, আয়াত-২৭)

১১. উল্লেখ্য কুরবানীদাতা হাবিলযিনি মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহ্র নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্যে একটি অতি সুন্দর দুম্বা কুরবানী পেশ করেন। ফলে তার কুরবানী কবুল হয়। পক্ষান্তরে কাবিলতিনি অমনোযোগী অবস্থায় কিছু খাদ্য-শস্য কুরবানী হিসেবে পেশ করলেন। ফলে তার কুরবানী কবুল হয়নি। সুতরাং প্রমানিত হলো কুরবানী মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ছাড়া কবুল হয় না।

১২. সেকালে কুরবানী গৃহিত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল এ যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কুরবানীকে ভস্মিভূত করে দিত। যে কুরবানী অগ্নি ভস্মিভূত করতো না, তাকে প্রত্যাখ্যাত মনে করা হতো। পবিত্র কুরআনে এসেছে-

الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ عَهِدَ إِلَيْنَا أَلَّا نُؤْمِنَ لِرَسُولٍ حَتَّىٰ يَأْتِيَنَا بِقُرْبَانٍ تَأْكُلُهُ النَّارُ ﴿آل‌عمران١٨٣﴾

সে সমস্ত লোক যারা বলে যে, আল্লাহ্ আমাদেরকে এমন কোন রসূলের ওপর বিশ্বাস না করতে বলে রেখেছেন যতক্ষণ না তারা আমাদের নিকট এমন কুরবানি নিয়ে আসবেন যাকে আগুন গ্রাস করে নেবে। (সুরা আলে ইমরান-আয়াত-১৮৩)

 

যুগে যুগে প্রত্যেক উম্মতের উপর কুরবানীর হুকুম:

১৩. কুরবানীর ইতিহাস ততটাই প্রাচীন যতটা প্রাচীন দীন-ধর্ম অথবা মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস। মানুষের জন্যে আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে যত শরীয়ত নাযিল হয়েছে প্রত্যেক শরীয়তের সকল নবীর উম্মতের জন্য কুরবানীর বিধান বা হুকুম ছিলো। এব্যাপারে আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেনঃ

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ-سورة الحج৩৪-

আর আমি প্রত্যেক উ¤মতের জন্য কুরবানীর এক নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহ্র দেয়া চতু¯পদ জন্তু যবেহ করার সময় আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করে। (সুরা হজ্জ, আয়াত-৩৪)

 

১৪. নবী ইব্রাহীম (আঃ) কর্র্তৃক পুত্র ইসমাইলকে কুরবানীর বিবরণ:

হজ্জ্ব ও ঈদুল আজহার কুরবানী মূলত নবী ইবরাহীম (আঃ)-এর কুরবানীর অনুসরণ। আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বৎসর পূর্বে, খৃস্টপূর্ব ২০০০ সালের দিকে ইরাকের উরনামক স্থানে ইবরাহীম (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা, পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজের সকলের বিরোধিতা ও প্রতিরোধের মুখে তিনি তাওহীদের প্রচারে অনড় থাকেন। একপর্যায়ে তিনি ইরাক থেকে ফিলিস্তিনে হিজরত করেন। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। ৮৬ বৎসর বয়সে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরর গর্ভে তাঁর প্রথম পুত্র ইসমাঈল (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন। বৃদ্ধ বয়সের এ প্রিয় সন্তানকে কুরবানী করতে আল্লাহ্ তাঁকে নির্দেশ দেন। আল্লাহ্ বলেন,

رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ (১০০) فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ (১০১) فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ (১০২) فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ (১০৩) وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ (১০৪) قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ (১০৫) إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ (১০৬) وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ (১০৭) وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ (১০৮) سَلَامٌ عَلَى إِبْرَاهِيمَ (১০৯) كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ (১১০) إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِينَ (১১১) وَبَشَّرْنَاهُ بِإِسْحَاقَ نَبِيًّا مِنَ الصَّالِحِينَ (১১২) (صف-১০০-১১২-

১৫. অতঃপর ইব্রাহীম (আঃ)আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে দোয়া করলেন, হে আমার মালিক! আমাকে তুমি একজন নেক সন্তান দান করো। এরপর আমি তাকে একজন সহনশীল (ধৈর্যশীল) পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। সে যখন তার (পিতার) সাথে চলাফেরা (দৌড়াদৌড়ি) করার মতো বয়সে উপনীত হলো, তখন সে (ইবরাহীম) তাকে (ছেলেকে) বললো, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখিছি, আমি তোমাকে যবাই করতেছি, (বলো এ ব্যাপারে) এখন তোমার অভিমত কি?

১৬. (স্বপ্নের কথা শুনে) সে বললো, হে আমার (øেহপরায়ণ) পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি (অবিলম্বে) তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ্ (আল্লাহ চাহে তো) আপনি আমাকে (এ সময়েও) সবরকারীদের (ধৈর্যশীলদের) মাঝে পাবেন। অতঃপর যখন তারা (পিতা-পুত্র) দুজনই (আল্লাহ্ তায়ালার ইচ্ছার সামনে) আত্মসমর্পণ করলো এবং সে তাকে (যবাই করার উদ্দেশ্যে) কাত করে শুইয়ে দিলো, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি (আমার দেখানো) স্বপ্ন সত্য প্রমাণ করেছো।

 ১৭. আমি এভাবেই সৎকর্মশীল মানুষদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিলো একটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা মাত্র! (এ কারণেই) আমি তার (ছেলের) পরিবর্তে (আমার নিজের পক্ষ থেকে) দিলাম যবেহ্ করার জন্যে এক মহান জন্তু। পরবর্তী মানুষদের জন্যে এ বিধান তার স্মরণে আমি অব্যাহত রেখে দিলাম। ইবরাহীমের প্রতি সালাম (শান্তি) বর্ষিত হোক। এমনিভাবে আমি (আমার) নেক বান্দাদের প্রতিদান (পুরস্কার) দিয়ে থাকি! অবশ্যই সে ছিলো আমার মোমেন (বিশ্বাসী) বান্দাদের একজন। আমি তাকে সুসংবাদ দিয়েছি ইসহাকের, সে সৎকর্মীদের মধ্য থেকে একজন নবী। (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত-১০০-১১১)

قَالَ ابْن عَبَّاس أنزل الله تَعَالَى عَلَيْهِ كَبْشًا من الْجنَّة، وَهُوَ الْكَبْش الَّذِي تقبله الله تَعَالَى من هابيل، وَيُقَال كَبْش رعى فِي الْجنَّة أَرْبَعِينَ خَرِيفًا، وَقَالَ الْحسن الْبَصْرِيّ أروية من الْجَبَل-(.تفسير السمعاني-ج-ص-৪০৯-

 وقوله تعالى {وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ} عن علي رضي الله عنه قال بكبش أبيض أقرن قد ربط بسمرة، وقال ابن عباس رضي الله عنهما كَبْشٌ قَدْ رَعَى فِي الْجَنَّةِ أَرْبَعِينَ خَرِيفًا، وَرُوِيَ عَنْ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ أَنَّهُ قَالَ كَانَ الكبش يرتع في الجنة، حتى شقق عنه ثبير، وكان عليه عهن أحمر (ذكر أن الكبش هو الذي قر به ابن آدم وكان في الجنة حتى فدي به إسماعيل وهو منقول عن بعض السلف) - ابن كثير-ج-২ -ص১৮৭-

قَالَ اللَّهُ تَعَالَى {فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلامٍ حَلِيمٍ} وَهَذَا الْغُلَامُ هُوَ إِسْمَاعِيلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ، فَإِنَّهُ أولُ وَلَدٍ بُشِّرَ بِهِ إِبْرَاهِيمُ، عَلَيْهِ السَّلَامُ، وَهُوَ أَكْبَرُ مِنْ إِسْحَاقَ بِاتِّفَاقِ الْمُسْلِمِينَ وَأَهْلِ الْكِتَابِ- ابن كثير سالامه-ج-ص২৬-

 

উম্মাতে মুহাম্মদী (সাঃ)-এর ওপর কুরবানীর হুকুম:

১৮. আল্লাহ্ তায়ালা তার রাসূলকে কাওসার দান করেছেন। এর শুকরিয়া আদায়ে তিনি তাকে এ দিনে কুরবানি ও সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। (লাতায়েফুল মাআরিফ; ইবনে রজব (রঃ) পৃঃ ৪৮২-৪৮৩) মহান আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন,

إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ-فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ﴿الكوثر ١- ٢﴾

নিশ্চয় আমি আপনাকে কাউসার দান করেছি। অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশে নামায পড়ুন এবং কুরবানি করুন। (সূরা কাউসার-২)

১৯. আমরা জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে যে কুরবানী করে থাকি তা আমাদের মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর মাধ্যমে প্রবর্তীত হয়েছে। হাদীস শরীফে রয়েছে,

عَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ، قَالَ قَالَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا هَذِهِ الْأَضَاحِيُّ؟ قَالَ «سُنَّةُ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ» - (ابن ماجه-3247- مسند احمد-19283- بيهقى-6956- مسادرك حاكم-3467)‏

 একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সাহাবীগণ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! এ কুরবানী কী? জবাবে হুজুর (সাঃ) বললেন ইহা তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর সুন্নাত। (ইবনে মাজাহ-৩২৪৭,আহমদ-১৯২৮৩,বায়হাকী-৬৯৫৬,হাকেম-৩৪৬৭)

২০. আমাদের আদি পিতা ইব্রাহীম (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-

وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ مِّلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ ﴿الحج ٧٨﴾

ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা রাখেননি। তোমরা তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের ধর্মে কায়েম থাক। তিনিই তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলমান। (সুরা হজ্ব-৭৮)

 

২১. কুরবানীর ফযিলত:

 (ক)কুরবানীই হচ্ছে কুরবানীর দিন সমূহের সর্বোত্তম আমলঃ 

  রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ

عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ «مَا عَمِلَ ابْنُ آدَمَ يَوْمَ النَّحْرِ عَمَلًا أَحَبَّ إِلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، مِنْ هِرَاقَةِ دَمٍ، وَإِنَّهُ لَيَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ، بِقُرُونِهَا، وَأَظْلَافِهَا، وَأَشْعَارِهَا، وَإِنَّ الدَّمَ، لَيَقَعُ مِنَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَقَعَ عَلَى الْأَرْضِ، فَطِيبُوا بِهَا نَفْسًا» -(ترمذى-1493ابن ماجه-3126 مشكواة-1470- (صَحِيحٌ)

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, কুরবানীর দিন কুরবানীর পশুর রক্ত প্রবাহিত করা (যবেহ করা) অপেক্ষা আল্লাহ্র নিকট অধিক প্রিয় মানুষের কোন আমল হয় না। কিয়ামতের দিন এর শিং, লোম ও পায়ের খুরসহ উপস্থিত হবে। (ইবনে মাজাহ-৩১২৬, তিরমিযি-১৪৯৩)

২২. (খ) পশু রক্ত যমিন স্পর্শ করার পূর্বেই আল্লাহর দরবারে কবূল হয়ে যায়ঃ

রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ

وَإِنَّ الدَّمَ، لَيَقَعُ مِنَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَقَعَ عَلَى الْأَرْضِ، فَطِيبُوا بِهَا نَفْسًا -(ترمذى-১৪৯৩ابن ماجه-৩১২৬مشكواة-১৪৭০- (صَحِيحٌ

কুরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালার কাছে সম্মানিত স্থানে পৌঁছে যায় (কবূল হয়ে যায়)। সুতরাং তোমরা প্রফুল­চিত্তে কুরবানী কর। (ইবনে মাজাহ-৩২৪৬, তিরমিযি-১৪৯৩)

 

 

২৩. (গ)প্রথম রক্তবিন্দুর সাথেই বান্দার গুণাহ-খাতা ক্ষমা হয়ে যায়ঃ

রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِفَاطِمَةَ عَلَيْهَا الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ «قَوْمِي إِلَى أُضْحِيَّتِكَ فَاشْهَدِيهَا فَإِنَّ لَكِ بِأَوَّلِ قَطْرَةٍ تَقْطُرُ مِنْ دَمِهَا يُغْفَرُ لَكِ مَا سَلَفَ مِنْ ذُنُوبُكَ» قَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ، هَذَا لَنَا أَهْلَ الْبَيْتِ خَاصَّةً أَوْ لَنَا وَلِلْمُسْلِمِينَ عَامَّةً؟ قَالَ «بَلْ لَنَا وَلِلْمُسْلِمِينَ عَامَّةً» -(المستد رك على الصحيحين للحاكم-7525-مسند البزار-1202)

হে ফাতেমা! তুমি তোমার কুরবানীর পশুর দিকে যাও এবং (পশুর কুরবানীকার্য) প্রত্যক্ষ কর। কেননা পশু থেকে নির্গত প্রথম রক্ত বিন্দুর অসিলাতেই তোমার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। হযরত ফাতেমা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন; ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই প্রতিদান কি শুধু আমাদের (নবীর পরিবারের) জন্যই নির্ধারিত নাকি আমাদের ও সমস্ত মুসলানদের জন্যই নির্ধারিত? তিনি বললেনঃ না বরং আমাদের ও সমস্ত মুসলমানের জন্যই নির্ধারিত। (ছহীহ হাকেম-৭৫২৫, বাযযার-১২০২)

২৪. (ঘ) পশুর প্রতিটি লোমের বিনিময়ে একটি করে সওয়াবঃ

রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ

عَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ قَالَ قَالَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ  وَسَلَّمَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا هَذِهِ الْأَضَاحِيُّ؟ قَالَ «سُنَّةُ أبيكم إِبْرَاهِيم عَلَيْهِ السَّلَام» قَالُوا فَمَا لَنَا فِيهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ «بِكُلِّ شَعْرَةٍ حَسَنَةٌ» . قَالُوا فَالصُّوفُ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ «بِكُلِّ شَعْرَةٍ مِنَ الصُّوفِ حَسَنَة» (رَوَاهُ أَحْمد -19283- ابْن مَاجَه-3127-مستدرك حاكم- 3467- هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحُ الْإِسْنَادِ-سنن الكبرى-19017)

সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! কুরবানীতে আমাদের কি (সওয়াব) রয়েছে? জবাবে হুজুর (সাঃ) বললেন, কুরবানীর জন্তুর প্রতিটি পশমের পরিবর্তে একটি করে নেকী কয়েছে। তারা আবারো জিজ্ঞেস করলেন, পশম ওয়ালা পশুদের জন্য কি হবে (এদের পশম তো অনেক বেশী) হুজুর (সাঃ) বললেন, পশম ওয়ালা পশুর প্রত্যেক পশমের পরিবর্তে এক একটি নেকী রয়েছে। (ইবনে মাজাহ-৩১২৭,আহমদ-১৯২৮৩,ছহীহ হাকেম-৩৪৬৭)

 

২৫. কুরবানীর দর্শন ও প্রাণশক্তি:

জাহেলীযুগের লোকেরা পশু কুরবানী করার পর তার গোশত বায়তুল্লাহ্র সম্মুখে এনে রেখে দিতো। তার রক্ত বায়তুল্লাহ্র দেয়ালে লেপে দিতো। আর তারা মনে করতো তাদের কুরবানী তাদের ইলাহর কাছে পৌঁছে দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে তাদের এ কাজকে প্রত্যাক্ষান করে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন-

لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ ۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ ۗ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ ﴿الحج٣٧﴾

কুরবানীর পশুর রক্ত-মাংস আল্লাহর কাছে কিছুই পৌঁছে না; বরঞ্চ তোমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের তাকওয়াই তাঁর কাছে পৌঁছে। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহ্র মহত্ত¡ ঘোষনা কর এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং হে নবী নিষ্ঠার সাথে যারা নেক কাজ করে আপনি তাদের জান্নাতের সু-সংবাদ শুনিয়ে দিন’’। (সূরা হাজ্জ, আয়াত ৩৭)

২৬. রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ

عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ، وَإِنَّمَا لِامْرِئٍ مَا نَوَى (بخارى-1-مسلم-4774)

হজরত উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্নিত। তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন-প্রত্যেকটি আমলের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং কোন ব্যাক্তি কেবল তাই লাভ করবে যা সে নিয়্যাত করেছে। (বুখারী-০১, মুসলিম-৪৭৭৪ ই.ফা.বা)

২৭. রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেনঃ

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «إِنَّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى أَجْسَادِكُمْ وَلَا إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ»-(مسلم-6708)

আল্লাহ তায়ালা তোমাদের শরীরের দিকে, চেহারার দিকে এবং তোমাদের সম্পদের দিকে দেখেন না বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমল (অর্থাৎ নিয়তের বিশুদ্ধতা ও আমলের উৎকর্ষতা)। (মুসলিম-৬৭০৮)

২৮. কুরবানীর শর্তাবলিঃ

প্রথম হচ্ছে ছাহেবে নিসাব হওয়া। বাকী শর্ত নিম্মরুপ-

ক। এমন পশু দ্বারা কুরবানী দিতে হবে যা শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেগুলো হল উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা। এ গুলোকে কুরআনের ভাষায় বলা হয় বাহীমাতুল আনআম। (সূরা হজ্জ, আয়াত-৩৪; মুসলিম-১৯৬৩)

খ। শরীয়তের দৃষ্টিতে কুরবানীর পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরী।

গ। কুরবানীর পশু যাবতীয় দোষ ত্রæটি মুক্ত হতে হবে। (তিরমিযি-১৫৪৬; নাসায়ী-৪৩৭১)

ঘ। যে পশুটি কুরবানী করা হবে তার উপর কুরবানী দাতার পূর্ণ মালিকানা সত্ত¡ থাকতে হবে। বন্ধকি পশু, কর্জ করা পশু বা পথে পাওয়া পশু দ্বারা কুরবানী আদায় হবে না।

ঙ। কুরবানীর পশু কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট করা।

২৯. সামর্থ্য থাকা সত্তেও যারা কুরবানী করে না তাদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাবধান বানী

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ «مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ، وَلَمْ يُضَحِّ، فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا» (ابن ماجة-3123-دارقطنى-4743-احمد-8074)

 আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্তেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।” (ইবনে মাজাহ-৩১২৩; দারে কুতনী-৪৭৪৩; আহমদ-৮০৭৪)

৩০. কুরবানীর পশুর চামড়া, গোশত, চর্বি ইত্যাদির বিধান:

কুরবানীর গোশ্তকে তিন ভাগ করে এক ভাগ ফকীর-মিসকীনদের মাঝে বিতরণ, একভাগ পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের বা বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে বিতরণ এবং একভাগ নিজ পরিবার বর্গের জন্য রাখা মুস্তাহাব বলে উলামায়ে কেরামগন উল্লেখ করেছেন। কুরবানীর গোশ্ত যে তিন ভাগ করতে হয় নিচের আয়াতটিতে তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় বলে উলামাগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেনঃ আল্লাহ্ তাআলা বলেন

وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُمْ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا صَوَافَّ فَإِذَا وَجَبَتْ جُنُوبُهَا فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ كَذَلِكَ سَخَّرْنَاهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ﴿الحج ٣٦﴾

 সুতরাং সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় তাদের যবেহ্ করার সময়তোমরা আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ কর। অতঃপর যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তা থেকে তোমরা আহার কর এবং আহার করাও যে কিছু প্রার্থনা করে না তাকে এবং যে প্রার্থনা করে তাকে।

(সুরা হজ্জ, আয়াত-৩৬)

৩১. মহান আল্লাহ্ আরো বলেন,

لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ ﴿الحج ٢٨﴾

যাতে তারা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহ্র নাম স্মরণ করে তার দেয়া চতুষ্পদ জন্তু যবেহ্ করার সময়। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও। (সুরা হজ্জ, আয়াত-২৮)

৩২. সামর্থবানগণ জিলহজ্জ মাসে যে কুরবানী দেন সে গোস্ত অমুসলিমদেরকে খেতে দেয়াতে দোষের কিছু নেই। তবে মান্নত ও ওসিয়তের কুরবানীর গোস্ত তাদেরকে দেয়া যাবে না। (ফাতওয়া ও মাসায়েল, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৭১)

**  মিসকীনদের অংশ সমাজের এক স্থানে জমা করে সুষ্ঠু ও সুন্দর ভাবে মিসকীনদের মধ্যে বিতরণ করার ব্যবস্থা খুবই উত্তম বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু সমাজে যারা গোশ্ত জমা দিয়েছেন, তারা আবার সমাজ কর্তৃক বিতরণকৃত গোস্তের অংশ ফেরত নেয়ার যে নিয়ম কোন কোন এলাকায় প্রচলন আছে তা মোটেও বৈধ না।    

৩৩. ** জবাইকারী বা অন্য কাউকে কুরবানীর বিনিময় হিসেবে পশুর মাথা দিয়ে দেয়া বৈধ নয় যদি হাদিয়া হিসেবে দেয়া হয় তাহলে তো কোন কথাই নেই।

** কসাইকে গোস্ত বানানোর বিনিময়ে পৃথক ভাবে পারিশ্রমিক না দিয়ে কুরবানীর কিছু গোস্ত দেয়া মোটেও জায়েয নেই। তবে দান বা উপহার হিসেবে কসাইকে কিছু দিলে তা না-জায়েজ হবে না।

أَنَّ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ أَبِي لَيْلَى، أَخْبَرَهُ أَنَّ عَلِيَّ بْنَ أَبِي طَالِبٍ، أَخْبَرَهُ «أَنَّ نَبِيَّ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَهُ أَنْ يَقُومَ عَلَى بُدْنِهِ، وَأَمَرَهُ أَنْ يَقْسِمَ بُدْنَهُ كُلَّهَا، لُحُومَهَا وَجُلُودَهَا وَجِلَالَهَا، فِي الْمَسَاكِينِ وَلَا يُعْطِيَ فِي جِزَارَتِهَا مِنْهَا شَيْئًا» قَالَ «نَحْنُ نُعْطِيهِ مِنْ عِنْدِنَا»(بخارى-1608-1609-مسلم-3050-3053)

** কুরবানীর গোস্ত বিক্রয় বা বিনিময় করা বৈধ নয়। (বুখারী-১৬১০,মুসলিম-৩০৫০)

৩৪.** কুরবানীর চামড়া তিন উপায়ে ব্যবহার করা যাবে (১) কুরবানী দাতা নিজে ব্যবহার করতে পারবেন, (২) অথবা কাউকে হাদিয়া দিতে পারবেন, (৩) কিংবা বিক্রি করতে পারেন। তবে যদি বিক্রি করেন তাহলে তার সম্পূর্ণ অর্থ মিসকীনদের দিয়ে দিতে হবে। (ফাতওয়া ও মাসায়েল, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৬৭)

**  বন্ধুত্বের খাতিরে স্বল্পমূল্যে চামড়া বিক্রয় করা যাবে না।

**  চামড়ার টাকা অমুসলিমদেরকে দেয়া যাবে না।

 

কুরবানীর প্রাণী জবাই করার নিয়মাবলি

৩৫. (ক) কুরবানীর পশু ঈদের নামাযের পরে জবাই করাঃ (বুখারী-৫১৪৭,মুসলিম-৫১৮৫)

(খ) নিজ হাতে কুরবানী করাঃ(বুখারী-৫১৬০,মুসলিম-৪৯২৭)

(গ) নিজে জবাই করতে না পারলে অন্তত পশুর সামনে কুরবানীদাতাগণ উপস্থিত থাকাঃ (ছহীহ মুসতাদরাকে হাকেম-৭৫২৫, বাযযার-১২০২)

৩৬.(ঘ) কুরবানীর পশু জবেহ করার সময় যে সকল বিষয় লক্ষণীয়

     (ক) পশুকে কষ্ট না দেয়া।

     (খ) যা কুরবানী করা হবে তার সাথে সুন্দর আচরণ করা।

     (গ) কুরবানী বা জবেহ করা পশু জান বের হওয়া পর্যন্ত আরাম প্রশান্তি দেয়া। জবাই করাতে প্রাণীর কষ্ট তো হবেই, এর উপর আরো অধিক কষ্ট দেওয়া নিষেধ। (মুসলিম-৪৮৯৭, তিরমিযি-১৪০৯)

 

৩৭. কুরবানী বা জবেহ করার সময় দুআ পড়া:

কুরবানীর পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে باسم الله و الله اكبر বলাটাই জরুরী, নিম্মলিখিত দুআ পাঠ জরুরী নয়, তবে মুখস্ত থাকলে পড়াই ভাল।

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ ضَحَّى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِكَبْشَيْنِ فِي يَوْمِ الْعِيدِ، فَقَالَ حِينَ وَجَّهَهُمَا «إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ، إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ،  اللَّهُمَّ إِنَّ هَذَا مِنْكَ وَلَكَ، عَنْ مُحَمَّدٍ وَأُمَّتِهِ»، ثُمَّ سَمَّى اللَّهَ وَكَبَّرَ وَذَبَحَ - (ابو داؤد-2795‘ابن ماجة-3121- دارمى-1989)‏

 

৩৮.  ঈদের নামাজ আদায়ের পদ্ধতি:

যদিও বাংলায় বা আরবীতে গৎ বাঁধা নিয়ত জরুরী না তবুও আমাদের দেশাচার হিসেবে নিয়তটি বলছিঃ (আমি ঈদুল ফিতরের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ অতিরিক্ত ছয় তাকবীরের সহিত এই ইমামের পিছনে আদায় করছি আল্লাহু আকবার”)। এই তাকবীরে তাহরীমা বলে উভয় হাত বাঁধতে হবে। তারপর ইমাম ও মুসল্লীগণ সকলকেই অন্যান্য নামাজে পঠিত সানাটি পাঠ করতে হবে। সানা পাঠের পর এই স্থানে তিনটি অতিরিক্ত তাকবীর দিতে হবে। প্রথম দুই তাকবীরে উভয় হাত কানের লতী পর্যন্ত উঠিয়ে হাত ছেড়ে দিতে হবে, তৃতীয় তাকবীরের পর হাত ছেড়ে না দিয়ে বেঁধে ফেলতে হবে।

৩৯. তারপর ইমাম সাহেব সুরা ফাতিহা ও অন্য একটা সুরা তেলাওয়াত করবেন এবং যথানিয়মে প্রথম রাকাত শেষ করবেন। তারপর দ্বিতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে প্রথমেই সুরা ফাতিহা ও অন্য একটি সুরা তেলাওয়াতের পর ঠিক রুকুতে যাওয়ার পূর্বমুহুর্তে আরও তিনটি তাকবীর দিবেন, যার প্রতিটিতেই হাত কানের লতী বরাবর উঠিয়ে ছেড়ে দিতে হবে। অতঃপর রুকুর তাকবীর দিয়ে রুকুতে গমন করতে হবে। নামাজের বাঁকী অংশ অন্যান্য নামাজের ন্যায়ই শেষ করতে হবে।

অতপর নামাযের পর ঈদুল ফিতরের দুই খুতবা পাঠ করা হবে। এই খুতবা পাঠ করা সুন্নাত, তবে জুমুআর খুতবার ন্যায় এই খুতবাহও শোনা ওয়াজিব। খুতবার সময় হাটা-চলা করা, কথা-বার্তা বলা বা খুতবা শুনতে ব্যাঘাত হয় এমন কোন কিছু করা নিষিদ্ধ।

উপসংহার

৪০.  সম্মানিত ভাইয়েরা! মনে রাখতে হবে, সকল দৈহিক ইবাদত এবং আর্থিক ত্যাগ সম্বলিত ইবাদতের উদ্দেশ্য হতে হবে একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালার জন্য। কুরবানী ও জীবন দানের প্রেরণা ও চেতনা সমগ্র জীবনে জাগ্রত রাখার জন্য নবী (সাঃ)-কে  নির্দেশ প্রদান করে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ-لَا شَرِيكَ لَهُ ۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ﴿الأنعام ١٦٢- ١٦٣﴾

আপনি বলুনঃ আমার সালাত, আমার কুরবানী এবং আমার জীবন ও আমার মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহ্রই জন্যে। তাঁর কোন অংশীদার নেই। আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি হলাম সবার আগে মুসলমান তথা আনুগত্যশীল। (সূরা আনয়াম, আয়াত-১৬২-১৬৩) আল্লাহ আমাদেরকে আজকের খোৎবা বুঝার তাওফিক দান করুন, আমীন।

 

No comments:

Post a Comment

razzakhowlader59@gmil.com