মৃত জীব
জন্তু ইসলামে হারাম কেন ?
এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
ইসলাম সৃজনশীল এবং আল্লাহ প্রদত্ত সুন্দর এক
জীবন বিধান । এতে রয়েছে সুশৃংখল নিয়ম-কানুন, আবার রয়েছে বিধি নিষেধ। এমনি এক বিষয় মৃত
জীব জন্তুর মাংস।
পৃথিবীর
বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে ও ধর্মে মৃত জীবের মাংস ভক্ষণ নিয়ে দৃষ্টিভংগী:
সমস্ত আসমানী গ্রন্থে ও ধর্মে মুর্দা খাওয়াকে
হারাম ঘোষণা করা হয়েছে ও সর্বত্র জবেহ করা জন্তু খাওয়াকে পছন্দ করা হয়েছে। যবেহ
করার পদ্ধতি ও নিয়ম যতই বিভিন্ন হোক না কেন? ( ইসলামে হালাল হারামের বিধান পৃষ্ঠা-৬৬)
ইসলামের
দৃষ্টিকোণ থেকে কেনো মৃত জীব জন্তুর মাংস হারাম?
১.হারাম বস্তু সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো মৃত
জীব জন্তুর মাংস। ইসলামের বিধি মোতাবেক কোনো মুসলমান মৃত জীব জন্তুর মাংস ভক্ষণ করতে পারবে না। কারণ এটা ইসলামে সুষ্পষ্ট
কঠোর হারাম। মুসলমানদের জন্য যা কিছু খারাপ, ক্ষতিকর, বিপদজনক তাই হারাম আর যা কিছু ভালো, উপকারী তাই হালাল।
২.আমাদের প্রতি মহান আল্লাহর রহমত হচ্ছে,
তিনি আমাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ খাওয়া বৈধ করেছেন এবং শুধুমাত্র অপবিত্র
বস্তুসমূহ হারাম করেছেন। তিনি বলেন,
وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ
তিনি তাদের জন্য পবিত্রবস্তু হালাল করেন এবং
অপবিত্র বস্তু হারাম করেন। (সূরা আল আরাফ-৭/১৫৭) এখানে খাবায়েছ এর অর্থ যা শারিরীক, মানসিক ক্ষতিকর বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে।
৩.আল্লাহ পাক কুরআনের কয়েকটি আয়াতে মৃত জীব জন্তুর মাংস
হারাম ঘোষণা করেছেন।
إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ
الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ
وَلَا عَادٍ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
তিনি তোমাদের ওপর হারাম করেছেন, মৃত জীব, রক্ত, শূকরের গোশত। (সূরা আল বাক্বারাহ-২/১৭৩, সূরা আন নাহল-১৬/১১৫)
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ
তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে মৃত জীব, রক্ত, শূকরের গোশত। (সূরা আল মায়েদাহ-৫/৩)
قُلْ لَا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَى طَاعِمٍ
يَطْعَمُهُ إِلَّا أَنْ يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ
خِنْزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ فَمَنِ
اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَإِنَّ رَبَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
আপনি বলুন যা কিছু বিধান ওহীর মাধ্যমে আমার
কাছে পৌছেছে, তন্মধ্যে আমি
কোনো হারাম খাদ্য পাই না কোনো ভক্ষণকারীর জন্যে, যা সে ভক্ষণ করে; কিন্তু মৃত অথবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শূকরের
মাংস। (সূরা আল আনআম-৬/১৪৫)
আরো
কিছু জরুরী
বিষয় হলো:
ক. এখানে মৃত বলতে মৃত জন্তুর সব কিছুই হারাম
বলেছেন অনেকেই।
খ. অনেকেই শুধু মাংস হারাম বলেছেন।
গ. অধিকাংশ উলামার মত হলো হালাল পশুর চামড়া
দাবাগত করলে তা ব্যবহার হালাল। হাদীসে এসেছে,
امر ان يستمتع بجلود الميتة اذا دبغت
মৃত জীবের চামড়া দাবাগত করে উপকার নিতে অনুমতি দেয়া হয়েছে। আবু দাউদ-৪১২৪,২৫ (দূর্বল হাদীস) তিরমিজী-১৭২৭, ২৮ (সহীহ হাদীস) (বিস্তারিত জানতে দেখুন তিরমিজী শরীফের-১৭২৮ নং হাদীসের পাদটীকা এবং তাফসীরে মায়ারিফুল কুরআন)
মাছ
মৃত হলেও তা হালাল কেনো?
১.
বৈজ্ঞানিক কারণ:
ক. বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত যে স্থলভাগের
সব প্রাণী বাতাস থেকে "অক্সিজেন" গ্রহণ করে এবং "কার্বণ ডাই
অক্সাইড' পরিত্যাগ করে। ঐসব প্রাণীকে যখন যবেহ করা হয়, তখন বিষাক্ত "কার্বণ ডাই অক্সাইড"
রক্তের সাথে বের হয়ে যায়। কিন্তু যখন এসব প্রাণী মৃত্যুবরণ করে, তখন বিষাক্ত রক্ত দেহের ভেতর মাংসের সাথে
মিশে যায়। যা মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর। সে কারণেই এসব মৃত প্রাণী ভক্ষণ নিষিদ্ধ।
খ. অপরদিকে মাছ পানি থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে, যা "কার্বণ ডাই অক্সাইড" মুক্ত। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করলেও তাতে ক্ষতিকর কোন উপাদান থাকে না। এজন্যই জলজ হালাল প্রাণী মৃত হলেও মানুষের জন্য তা হালাল করা হয়েছে। (সূত্র: শরহে বুলূগুল মারাম)
ইসলামের
দৃষ্টিতে মৃত মাছ কেনো হারাম নয়?
আর
সামুদ্রিক প্রাণী হালাল যথা মাছ সে ব্যাপারে
আল কুরআন থেকে দলীল:
أُحِلَّ لَكُمْ صَيْدُ الْبَحْرِ وَطَعَامُهُ
তোমাদের জন্য সমুদ্র শিকার ও সমুদ্রের খাদ্য হালাল করা হয়েছে। (সূরা আল মায়িদা-৫/৯৬)
এ আয়াতের
তাফসীরে সম্মানিত মুফাসসির বৃন্দের অভিমত:
১. কেউ কেউ বলেছেন খাদ্য (তাআমুহু) দ্বারা
মাছের "শুঁটকি" হালাল সেটাই বুঝানো হয়েছে। (তাবারী-১১/৫৯)
২. ইবনে আব্বাস (রা:) এর মতে, (صيد البحر) সামুদ্রিক শিকার বলতে সমুদ্র থেকে জীবিত
অবস্থায় পাওয়া মাছ ইত্যাদি হালাল বুঝানো হয়েছে।
৩. কারো কারো মতে (طعامه) সমুদ্রের খাদ্য বলতে মৃত শিকার যা সমুদ্রের উপকূলে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় সেটাও হালাল এরুপ বুঝানো হয়েছে। (বিস্তারিত দেখুন তাফসীরে ইবনে কাসীর)
আল
হাদীস থেকে দলীল :
احلت لنا ميتتان و دمان فاما الميتتان فالحوت والجراد واما الدمان
فلكبد والطحال
আমাদের জন্য দু’প্রকার মৃত জন্তু এবং দু’প্রকার রক্ত ভক্ষণ করা হালাল করা হয়েছে। মৃত
জন্তু হলো মাছ ও পঙ্গপাল। আর রক্ত হলো কলিজা এবং প্লীহা। (ইবনে মাজা-৩৩১৪) সহীহ হাদীস।
هو الطهور ماءه الحل ميتته
সমুদ্রের পানি পবিত্র এবং সমুদ্রের মৃত
প্রাণী হালাল। (নাসায়ী-৫৯, তিরমিজী-৬৯, আবু দাউদ-৮৩, ইবনে মাজা-৩৮৬,৮৭) সহীহ হাদীস।
উক্ত
হাদীসের ব্যাখ্যায় উলামা মুহাক্কিক বৃন্দ বলেছেন:
ক. এখানে মৃত দ্বারা শুধু মাছ কেই উদ্দেশ্য
করা হয়েছে। (ইমাম আবু হানীফা (রহ:) এর মত এ রকমই)
খ. মাছ মরে, পচে, গলে, ফুলে গেলে সেটা খাওয়া আবার হারাম বলা
হয়েছে। (নাসায়ী শরীফের-৫৯ নং হাদীসের পাদটীকা)
গ. মৃত মাছ পবিত্র এবং মানব দেহের জন্য
ক্ষতিকর নয় তাই আল্লাহ তা হালাল করেছেন।
ঘ. প্রবাহিত রক্ত যেহেতু হারাম তাই সেটা বের
করে দেয়ার জন্য প্রাণীকে যবেহ করা হয়। স্থল প্রাণী মারা গেলে রক্ত আর বের হয়না
কিন্তু মাছ জীবিত মৃত উভয় অবস্থায় রক্ত একই ভাবে প্রবাহিত হয় এটাও একটি কারণ।
যুক্তির
বিচারে:
১. মৃত জীব জন্তুর মাংস কেন নিষেধ করা হয়েছে
এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো
আল্লাহ তাআলা হারাম করেছেন তাই হারাম।
২. সুস্থ মানব প্রকৃতি মৃত জীব ঘৃণা করে।
বিবেকবান মানুষ মুর্দার খাওয়াকে অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ বলে মনে করে। তা মানুষের জন্যে
নিতান্তই অশোভন ও হীন কাজ বলে বিশ্বাস করে। এ কারণেই সমস্ত আসমানী গ্রন্থে ও ধর্মে
মুর্দার খাওয়াকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে ও সর্বত্র জবেহ করা জন্তু খাওয়াকে পছন্দ
করা হয়েছে। যবেহ করার পদ্ধতি ও নিয়ম যতই বিভিন্ন হোক না কেন।
৩. মানুষ যা লাভ করার ইচ্ছা করেনি, মনে কামনাও জাগেনি, তা সে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করুক, সেটা আল্লাহ্র পছন্দ নয়। মুর্দারের অবস্থা
ঠিক তেমনই। তবে যে জন্তু যবেহ করা হয় কিংবা যা শিকার করা হয়, তাতে মানুষের সংকল্প ও চেষ্টা-যত্নের কোন অংশ
শামিল থাকে বলে তা পছন্দনীয় হয়ে থাকে।
৪. যে জন্তু স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছে, তার সম্পর্কে আশংকা থাকে, হতে পারে সেটি চিরন্তন রোগাক্রান্ত বা কোন
দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কিংবা বিষাক্ত ঘাস বা উদ্ভিদ খেয়ে মরেছে। আর তাহলে তা খাওয়ার
দরুন বিরাট ক্ষতি হওয়ার আশংকা রয়েছে। অথবা হতে পারে তা খুব বেশি দুর্বল বা
স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার দরুন সেটি মরেছে।
৫. মানুষের জন্যে মুর্দা হারাম করে আল্লাহ তা’আলা পশু-পাখিগুলোর জন্য বিশেষ রহমতে খাদ্যের
ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মানুষই যদি এগুলো খেয়ে ফেলে জীব জন্তু জানোয়ার কি খাবে? কেননা সেগুলোও আমাদের ন্যায় আল্লাহ্র সৃষ্টি
এগুলোর প্রতি আল্লাহ তাআলা রহমত করে আমাদের জন্য হারাম করেছেন মৃত জীব।
৬. আরো একটি দিক হলো এই যে, মানুষ তার মালিকানাধীন জন্তুগুলোকে
রোগাক্রান্ত বা দুর্বল হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবার জন্যে ফেলে না রাখে। বরং হয় চিকিৎসা
করাবে অবিলম্বে কিংবা যবেহ করে চিরশান্তি দান করবে।
(আল্লামা ড: ইউসুফ আল কারযাভীর ইসলামে হালাল
হারামের বিধান ৬৬-৬৭ পৃষ্ঠা)
বিজ্ঞান
ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে:
১.মৃত পশুর শরীরে সহজেই রোগ জীবাণু তৈরী হয়
যা অপবিত্র আর তাই মৃত পশু হারাম।
২.প্রাণীর দেহ পবিত্রকারী হলো আত্মা, আত্মা যখন দেহ থেকে বের হয়ে যায়, তখন দেহ থেকে দুর্গন্ধযুক্ত বায়ু ও পদার্থ
বের করার মতো কিছু থাকে না। ফলে ওই দূষিত বায়ু ও পদার্থ তার সমস্ত শরীরকে নষ্ট করে
দেয়। দেহে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ও দূষিত বায়ু প্রভাব বিস্তার করে।
৩.অনেকেই বলেছেন আত্না স্বাভাবিকভাবে বের
হয়ে গেলেই গেলেই শরীর নাপাক হয়ে যায় এ জন্যই মানুষ মারা গেলে সে নাপাক হয়ে
যায় বিধায় মাইয়্যেতকে গোসল দেয়া ফরয।
৪.যে ব্যক্তি শৈশব থেকেই মৃত প্রাণী খেতে
অভ্যস্ত হয়ে যায় তার আকার-আকৃতি স্বভাব-চরিত্র এমন বিশ্রী হয়ে যায়, যেন তার স্বভাবটাই মনুষ্যত্ব থেকে বের হয়ে
যায়। নিকৃষ্ট স্বভাব ও পাষাণ অন্তর যেন তার অভ্যাসে পরিণত হয়।
৫.মৃতের মাঝে এক ভয়ানক বিষক্রিয়া রয়েছে, যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। যারা মৃত জন্তু
ভক্ষণকারী, তাদের ভাষা ও
জ্ঞান মোটা হয় এবং কুৎসিত হয়। অর্থাৎ মৃত জীব ভোজন মেধা বিকাশে অন্তরায়।
৬.প্রবাহিত রক্ত হারাম যা যবেহ করার মাধ্যমে
রক্ত বের করে প্রাণীকে হালাল করা হয়। মৃত জীব জন্তুর রক্ত ভেতরে মাংসের সঙ্গে
মিশে যায় বিধায় হারাম।
৭.রক্তের মাঝে এমন বিষক্রিয়া থাকে, যার ফলে মানুষ বৃদ্ধ হয়ে যায়, প্যারালাইসিস রোগ দেখা দেয় এবং হাত পায়ের
জোড়া ঢিলা হয়ে যায়।
৮.রক্ত ভক্ষণ মানুষকে হিংস্র প্রাণীর
স্বভাবের দিকে ধাবিত করে, স্বভাবে ক্রোধ
ও উত্তেজনা ভাব সৃষ্টি করে। তাই আল্লাহ প্রদত্ত হেকমতের দাবির ভিত্তিতে এ
বস্তুগুলো হারাম করা হয়েছে।
৯.মাংসের মধ্যে যেসব উপাদান থাকে মনে হয় মরে গেলে ঐ সব উপাদান নষ্ট হয়ে যায়। (বুখারী-৫৪৭৫ এর পাদটীকা ও অন্যান্য)
শেষকথা:
পরিশেষে
বলা যায় যে, মৃত প্রাণী ভক্ষণ প্রসঙ্গে এতখন কুরআন ও হাদীদের যুক্তি দিয়ে বুঝাতে
চেষ্টা করলাম। আসা করি আপনারা বুঝতে পেরেছেন। মাহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের উক্ত
বিষয়ের ওপর আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com