বিনোদন
ও খেলাধুলা ইসলামী প্রেক্ষিত
এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
শুরুকথা:
ইসলাম সুন্দর আর সুন্দরকে পছন্দ করে। তাই নিষ্কলুষ, উপকারী নির্দোষ বিনোদন ও গঠনমূলক সংস্কৃতি
চর্চা বা বিনোদনের বৈধতা দিয়েছে।হাদীসে এসেছে, ان الله جميل و يحب الجمال ‘‘আল্লাহ সুন্দর, তাই তিনি সুন্দরকেই পছন্দ করেন।’’(সহীহ মুসলিম-১৬৬)সুন্দর মন ও শরীর গঠনের অন্যতম প্রধান
২টি মাধ্যম খেলাধুলা আর বিনোদনকে ঢালাও ভাবে অবৈধ করা হয়নি। "A
Sound mind in a sound body" এহেতু ইসলাম এগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে।
ইবাদতের উদ্দেশ্যেই শরীর-স্বাস্থ্যের গঠন ও বিকাশকে
উৎসাহ দিয়েছে ইসলাম। হাদীসে এসেছে, المومن القوي خير و احب الي الله من المومن الضعيف ‘শারীরিকভাবে শক্তিশালী মুমিন
দূর্বল মুমিনের চেয়ে আল্লাহর কাছে অতি উত্তম এবং প্রিয়।’ (মুসলিম-৬৬৬৭, ইবনে মাজা-৪১৬৮) খেলা যখন শরীয়ত লঙ্ঘন করেনা, বিনোদন যখন সীমা অতিক্রম করেনা, সেক্ষেত্রে ইসলামে খেলা ও বিনোদনে বাধা নেই।
শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের মাধ্যম বিনোদন ও খেলাধুলা। কিন্তু এ গুলো যখন ব্যবসা, শত্রুতা, অশ্লীলতা ছড়ায়, নেশায় পরিণত হয়, ধবংস করে সময়, চরিত্র বিনষ্ট করে ঠিক তখনি ইসলাম নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
খেলাধুলার
ক্ষেত্রে হাদীসের দৃষ্টি কোন:
স্বাস্থ্য সুরক্ষা, রণ নৈপুণ্যের প্রয়োজনে তীর নিক্ষেপ, বর্শা চালনা, দৌড় প্রতিযোগিকে ইসলাম সমর্থন করে। لا سبق الا في نصل او خف او حافر (তীর নিক্ষেপ অথবা ঘোড়দৌড় কিংবা উটের
প্রতিযোগিতা ছাড়া ইসলামে অন্য প্রতিযোগিতা বৈধ নয়। (তিরমিযি-১৭০০, ইবনে মাজা-২৮৭৮)
হাদীসে
এসেছে,
من علم الرمي ثم تركه فليس منا او قد عصي
যে ব্যক্তি তীর চালনা শেখার পর তা ছেড়ে দেয়
সে আমার দলভুক্ত নয় বা সে অন্যায় কাজ করলো’ । (মুসলিম: ৪৮৪৩)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম "হাফইয়া" বা
মসজিদে জুরাইক থেকে "সানিয়াতুল
বিদা" পর্যন্ত সীমানার মধ্যে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ঘোড়া সমূহের দৌড়
প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান করেছেন। স্থান দুটোর দূরত্ব ছিল ৫/৬ মাইল। (বুখারী: ২৮৬৮)
নিছক
আনন্দ ফূর্তির কারণে খেলাধুলা হলে সেটা নিন্দনীয়:
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن
سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا
মানুষের মধ্যে এক শ্রেণির মানুষ এমন আছে, যারা খেলাধুলা-কৌতুক কথা ক্রয় করে মানুষকে
আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট করার জন্য। আর এটা নিয়ে ঠাট্টা,বিদ্রুপ করে।(সূরা লুকমান-৩১/৬)
এ স্থলে ঐ সকল কথা,কাজ, বস্তু ও বিষয়কে হারাম করা হয়েছে, যা মানুষকে আল্লাহ তায়ালার এবাদত ও তাঁর
স্মরণ থেকে গাফিল করে দেয়। তা গান-বাজনা হোক বা খেলাধুলা কিংবা ক্রীড়া-কৌতুক-সবই
এর অন্তর্ভুক্ত। (ইবনে কাসীর ও মায়ারিফুল কুরআন)
খেলাধুলা
কোন কোন শর্তে বৈধ আর কোন কোন শর্তে অবৈধ:
# ৩টি শর্তের সঙ্গে জায়েজ-নাজায়েজের
সম্পর্ক:
ক. শারীরিক উপকারিতা থাকতে হবে।
খ. শরীয়াতের কোনো বিধান লঙ্ঘন না হওয়া।
গ. অর্থনৈতিকভাবে কোন ক্ষতিসাধন না হওয়া। এ
তিনটি শর্তেখেলাধুলা জায়েজ, নচেৎ জায়েজ
নয়।
# ০৩ ধরণের খেলাকে বৈধ বলা হয়েছে:
ان و ليس اللهو الا في ثلثة تاديب
الرجل فرسه و ملاعبته امراته ورمية بقوسه
০৩ ধরণের খেলা বেহুদা নয়, ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দিবে জিহাদের জন্য, স্ত্রীর সাথে খেলা করা এবং তীর, ধনুকের খেলা। (তিরমিজী-১৬৩৭, ইবনে মাজা-২৮১১, নাসায়ী-৩৫৭৮, আবু দাউদ-২৫১৩ (দূর্বল হাদীস)
# যেসব শর্তে ইসলামী চিন্তাবিদগণ খেলাধূলা
জায়েয বলেছেন তাহলো:
১.
আল্লাহর যিকিরে প্রতিবন্ধক হবেনা:
ফরজ বিধান পালনের ক্ষেত্রে বা জিকির এর
প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেনা। খেলার নেশায় যেন ফরজ ছুটে না যায়। যেমন কোনো ফরজ
নামাজের সময়খেলা। উপরোল্লিখিত সূরা লুকমানের ৬নং আয়াত তাফসীরে বর্ণনা করা হয়েছে।
হাদীসে এসেছে, ما انهاك عن ءكر
الله فهو ميسر
(তোমাকে আল্লাহর জিকির থেকে যে জিনিষ বিরত রাখবে সেটা এক প্রকার জুয়া) নাসবুর
রায়া।
(২) শরিয়তের মহৎ উদ্দেশ্য যেন লঙ্ঘিত
না হয়:
পৃথিবীতে আমাদের আগমনের এক মহৎ উদ্দেশ্য
রয়েছে আর
ত হচ্ছে।
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
আমার এবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি
সৃষ্টি করেছি। (আয-যারিয়াত-৫১/৫৬) খেলাটি নিছক আনন্দের জন্য না হয়ে হবে জিহাদের প্রস্তুতি মূলক।
(৩) উরুদেশ ঢাকা থাকতে হবে এবং খেলাটি
অশ্লীলতা ছড়াবেনা:
সব সময় সতর ঢেকে রাখা ‘ফরজ’। অথচ অধিকাংশ খেলায় সতর খোলা থাকে। যথা ফুটবল
খেলায় পুরুষের উরুদেশের অর্ধেক বা তারও বেশি অংশ উন্মুক্ত থাকে।
হাদীসে বর্ণিত আছে, لا تكشف فخذك ولا تنظر الي فخذ حي
ولا ميت
হে আলী! তুমি নিজের উরুকে উম্মুক্ত করো না
এবং কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির উরুর দিকে দৃষ্টি দিওনা।(আবূ দাউদ: ৪০১৫)(দূর্বল হাদীস)
অন্য
হাদীসে এসেছে,
كان زرهد هذا من أصحاب الصفة قال جلس رسول الله صلي الله عليه وسلم
عندنا و فخذي منكشفة فقال اما علمت ان الفخذ عورة
হযরত জারহাদ ছিলেন আসহাবে সুফফার অন্যতম
সাহাবী, তার কাছে
রাসূল (সা:) বসা ছিলেন,আর আমার উরু
ছিল উন্মুক্ত। তিনি (সা:) বললেন, সাবধান! তুমি কি জানো না, উরু সতরের অন্তর্ভুক্ত। (আবু দাউদ-৪০১৪, তিরমিজী-২৭৯৫, ৯৬, ৯৭, ৯৮)
(৪) খেলাটি কারো জন্যই
ঝুঁকিপূর্ণ/ক্ষতির কারণ হবেনা:
নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলা বা ধ্বংসের মুখে
ঠেলে দেয়ার অনুমতি ইসলামে নেই।
وَلاَ تُلْقُواْ بِأَيْدِيكُمْ إِلَىالتَّهْلُكَةِ
নিজের জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়োনা।(আল-বাকারা-২/১৯৫)
হাদীসে এসেছে, لا ضرر ولا ضرار ‘ইসলামে নিজের ক্ষতি বা অন্যের ক্ষতি হয় এমন কাজ বৈধ নয়।’ (ইবনে মাজা-১৩৪৯, মুয়াত্তা
মালিক-১৪২৭)
প্রচলিত সব খেলাতে বিশেষভাবে ফুটবলে রয়েছে চরম ঝুঁকি।
(৫) খেলা উপার্জনের মাধ্যম না হওয়া:
খেলা হবে সব ধরনের জুয়া ও বাজিমুক্ত।
খেলাধুলার মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক বাজির অর্থও অবৈধ। এখন তো আন্তর্জাতিক/দেশীয়
সব খেলাধুলায় বাজি এবং বাজিকে কেন্দ্র করে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার উদ্ভব ঘটে থাকে যা
নিষিদ্ধ। পবিত্র
কুরআনে এসেছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ
وَالأَنصَابُ وَالأَزْلاَمُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ
لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُون
إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ
الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاء فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ
اللّهِ وَعَنِ الصَّلاَةِ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ
হে মুমিনগণ, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো
নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। শয়তান শুধু মদ ও জুয়া
দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ
ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না?। (আল-মায়িদা-৫/ ৯০-৯১)
(৬) প্রতিযোগিতার জয়-পরাজয়ে
শত্রুতা-মিত্রতা সৃষ্টি না হওয়া:
খেলাধুলার কারণে শত্রুতা-মিত্রতার সৃষ্টি
হলেতখন খেলাটি অবৈধ হয়। ভালো খেলার কারণে মাত্রা অতিরিক্ত অতিভক্তি বা খারাপ
খেলার কারণে ঘৃণা সৃষ্টি ইসলামে সিদ্ধ নয়। ফুটবলে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার সমর্থক কিংবা ক্রিকেটে
ভারত-পাকিস্তানের সমর্থকদের মধ্যে নিজেদের সমর্থিত দল নিয়ে মারামারি, হানাহানি ও শত্রুতা তৈরির ঘটনা পত্র-পত্রিকা
দেখা যায়। এসব শয়তানের কাজ। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ
الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاء فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ
اللّهِ وَعَنِ الصَّلاَةِ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ
নিশ্চয় শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের
মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে
তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত
হবেনা?। (আল-মায়িদা-৫/৯১)
পরিশেষ
কথা:
এসব শর্তে খেলাধুলার বৈধতা থাকলেও বর্তমানে
প্রচলিত খেলাধুলায় ইসলামি মূল্যবোধের প্রতিফলন লঙ্ঘিত হয় ব্যাপকভাবে। এসব খেলার
মধ্যে জীবনের ঝুঁকি, সালাতের প্রতি
অবজ্ঞা, বিজাতীয়দের
অনুসরণ, সময় ও অর্থের
অপচয়, জুয়া,বাজিধরা, রঙখেলা, পটকা ফুটানো, গ্যালারিতে নৃত্য-গান, নারী, পুরুষের অবাধ মেলামেশা, নোংরামি,লক্ষ্য করা যায়। তাই এ ধরনের খেলাধুলা
সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম। এ ছাড়াও খেলাধুলা হয়েছে মিলিয়ন, বিলিয়ন কামাইয়ের মাধ্যম এটাও ইসলাম ভালো
চোখে দেখেনি। আল্লাহ
তায়ালা আমাদের সঠিক বুঝ প্রদান করুন। আমিন।
No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com