Sunday, February 27, 2022

ইসলামী দৃষ্টিতে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আমানতদারী

 


ইসলামী দৃষ্টিতে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আমানতদারী

এম এ রাজ্জাক হাওলাদার

সূচনা:

মহান আল্লাহ আমাদেরকে মানুষ হসিাবে সৃষ্টি করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আমাদেরকে অনেক দায়িত¦ ও কর্তব্য প্রদান করেছেন। দায়িত্ব ও কর্তব্য আমানতদারী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমানতদারী থাকলে কাজ সুন্দর হওয়ার পাশাপাশি আমরা অনেক সাওয়াবও পাবো। আজকের আলোচনায় ইসলামী দৃষ্টিতে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের আমানতদারী এ বিষয়ে নিয়ে কথা বলবো ইনশাআল্লাহ।

আমানতের সংজ্ঞা:

আমানত আরবী শব্দ। امن মূলধাতু থেকে নিষ্পন্ন। আভিধানিক অর্থ নিরাপত্তা প্রদান করা, আস্থা রাখা, বিশ্বাস করা, অভয় দান করা ও গচ্ছিত রাখা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় কোন ব্যক্তি গোষ্ঠির কাছে বিশ^াস করে বা আস্থা রেখে কোন জিনিসি গচ্ছিত রাখা হয় বা দিয়িত্ব প্রদান করা হয় তাকে বলে আমানত। এই দায়িত্ব পালন করাকে বলা হয় আমানতদারী।

আমানত রক্ষার আদেশ:

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا

নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার-মীমাংসা করতে আরম্ভ কর, তখন মীমাংসা কর ন্যায় ভিত্তিক। আল্লাহ তোমাদেরকে সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয় আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী। (সূরা নিসা- : ৫৮)

বিশ্বনবী (স.)-এর আমানত রক্ষার আদেশ:

عَنْ أَبِي حُصَيْنٍ، عَنْ أَبِي صَالِحٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَدِّ الْأَمَانَةَ إِلَى مَنِ ائْتَمَنَكَ، وَلَا تَخُنْ مَنْ خَانَكَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স.) বলেছেন, কেউ তোমার কাছে আমানত রাখলে তা তাকে ফেরত দাও। যে ব্যক্তি তোমার সাথে খিয়ানত করেছে তুমি তার খিয়ানত করো না। (আবু দাউদ : ৩৫৩৫)

প্রণি কুলের মধ্যে মানুষই আমানত রক্ষা করতে সক্ষম:

এ প্রসংঙ্গে কুরআনে এসেছে,

إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا

আমি আকাশ, পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে এই আমানত পেশ করেছিলাম, অতঃপর তারা একে বহন করতে অস্বীকার করল এবং এতে ভীত হল; কিন্তু মানুষ তা বহন করল। নিশ্চয় সে জালেম-অজ্ঞ। (সূরা আহযাব-৩৩ : ৭২)

আল্লাহর ভয়ে আমানত প্রত্যার্পণ করা:

وَإِنْ كُنْتُمْ عَلَى سَفَرٍ وَلَمْ تَجِدُوا كَاتِبًا فَرِهَانٌ مَقْبُوضَةٌ فَإِنْ أَمِنَ بَعْضُكُمْ بَعْضًا فَلْيُؤَدِّ الَّذِي اؤْتُمِنَ أَمَانَتَهُ وَلْيَتَّقِ اللَّهَ رَبَّهُ وَلَا تَكْتُمُوا الشَّهَادَةَ وَمَنْ يَكْتُمْهَا فَإِنَّهُ آثِمٌ قَلْبُهُ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيم

আর তোমরা যদি প্রবাসে থাক এবং কোন লেখক না পাও তবে বন্ধকী বস্তু হস্তগত রাখা উচিত। যদি একে অন্যকে বিশ্বাস করে, তবে যাকে বিশ্বাস করা হয়, তার উচিত অন্যের প্রাপ্য পরিশোধ করা এবং স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় কর! তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে কেউ তা গোপন করবে, তার অন্তর পাপপূর্ণ হবে। তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে খুব জ্ঞাত। (সূরা বাকারা- : ২৮৩)

আমানত সংরক্ষণ করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য:

وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ مؤمنون

যারা আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে হুশিয়ার থাকে। (সূরা মুমিনূন-২৩ : ০৮)

জেনেশুনে আমানতের খিয়ানত করা যাবে না:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَخُونُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ

হে ঈমানদারগণ! খিয়ানত করোনা আল্লাহর সাথে ও রাসূলের সাথে এবং খিয়ানত করো না নিজেদের পারস্পরিক আমানতে জেনে-শুনে। (সূরা আনফাল- : ২৭)

রাষ্ট্রের গোপনীয়তা প্রকাশ করা আমানতের খিয়ানত:

এ প্রসংঙ্গে হাদীসে এসেছে,

عَنْ عُبَيْدَ اللَّهِ بْنَ أَبِي رَافِعٍ، يَقُولُ: سَمِعْتُ عَلِيًّا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، يَقُولُ: بَعَثَنِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَا وَالزُّبَيْرَ، وَالمِقْدَادَ، فَقَالَ: انْطَلِقُوا حَتَّى تَأْتُوا رَوْضَةَ خَاخٍ، فَإِنَّ بِهَا ظَعِينَةً مَعَهَا كِتَابٌ، فَخُذُوا مِنْهَا قَالَ: فَانْطَلَقْنَا تَعَادَى بِنَا خَيْلُنَا حَتَّى أَتَيْنَا الرَّوْضَةَ،

আলী (রাঃ) বলেন, আমাকে এবং যুবায়ের ও মিক্বদাদ (রাঃ) কে রাসূলুল্লাহ (স.) এ কথা বলে পাঠালেন যে, তোমরা রওয়ানা হয়ে রাওযায়ে খাখ পর্যন্ত চলে যাও, সেখানে সাওয়ারীর পৃষ্ঠে হাওদায় উপবিষ্ট জনৈকা মহিলার নিকট একখানা পত্র আছে। তোমরা ঐ পত্রটি তার থেকে নিয়ে আসবে। আলী (রাঃ) বলেন, আমরা রওয়ানা দিলাম। আর আমাদের অশ^গুলো আমাদের নিয়ে খুব দ্রুত ছুটে চলল। শেষ পর্যন্ত আমরা রাওযায়ে খাখে পৌঁছে গেলাম।

فَإِذَا نَحْنُ بِالظَّعِينَةِ، قُلْنَا لَهَا: أَخْرِجِي الكِتَابَ، قَالَتْ: مَا مَعِي كِتَابٌ، فَقُلْنَا: لَتُخْرِجِنَّ الكِتَابَ، أَوْ لَنُلْقِيَنَّ الثِّيَابَ، قَالَ: فَأَخْرَجَتْهُ مِنْ عِقَاصِهَا، فَأَتَيْنَا بِهِ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَإِذَا فِيهِ: مِنْ حَاطِبِ بْنِ أَبِي بَلْتَعَةَ، إِلَى نَاسٍ بِمَكَّةَ مِنَ المُشْرِكِينَ،

গিয়েই আমরা হাওদায় আরোহিণী মহিলাটিকে পেয়ে গেলাম। আমরা বললাম, পত্রটি বের কর। সে বললো, আমার কাছে কোন পত্র নেই। আমরা বললাম, তুমি অবশ্যই পত্রটি বের করবে, অন্যথায় আমরা তোমায় বিবস্ত্র করে তালাশ করবো। রাবী বলেন, মহিলাটি তখন তার খোপা থেকে পত্রটি বের করে দিল। আমরা পত্রটি রাসূলুল্লাহ (স.) এর কাছে নিয়ে আসলাম। দেখা গেল এটি হাতেব ইবনে আবি বালতায়া (রাঃ) এর পক্ষ থেকে মক্কার কতিপয় মুশরিকের কাছে পাঠানো হয়েছে।

خْبِرُهُمْ بِبَعْضِ أَمْرِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا حَاطِبُ، مَا هَذَا؟ قَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، لاَ تَعْجَلْ عَلَيَّ، إِنِّي كُنْتُ امْرَأً مُلْصَقًا فِي قُرَيْشٍ، يَقُولُ: كُنْتُ حَلِيفًا، وَلَمْ أَكُنْ مِنْ أَنْفُسِهَا، وَكَانَ مَنْ مَعَكَ مِنَ المُهَاجِرِينَ مَنْ لَهُمْ قَرَابَاتٌ يَحْمُونَ أَهْلِيهِمْ وَأَمْوَالَهُمْ،

তিনি এতে মক্কার কাফিরদের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (স.) এর কিছু তৎপরতার সংবাদ দিয়েছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (স.) বললেন, হে হাতিব! এ কি কাজ করেছো? তিনি বললেন হে আল্লাহর রাসূল! আমার ব্যাপারে তাড়াতাড়ি কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। আমি কুরাইশদের সঙ্গে স্বগোত্রীয় কেউ ছিলাম না বরং তাদের বন্ধু তাদের মিত্র গোত্রের একজন ছিলাম। আপনার সঙ্গে যেসব মুহাজির আছেন কুরাইশ গোত্রে তাদের অনেক আত্মীয় স্বজন রয়েছেন। যারা এদের পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদের হিফাযত করছে।

فَأَحْبَبْتُ إِذْ فَاتَنِي ذَلِكَ مِنَ النَّسَبِ فِيهِمْ، أَنْ أَتَّخِذَ عِنْدَهُمْ يَدًا يَحْمُونَ قَرَابَتِي، وَلَمْ أَفْعَلْهُ ارْتِدَادًا عَنْ دِينِي، وَلاَ رِضًا بِالكُفْرِ بَعْدَ الإِسْلاَمِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَمَا إِنَّهُ قَدْ صَدَقَكُمْ فَقَالَ عُمَرُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، دَعْنِي أَضْرِبْ عُنُقَ هَذَا المُنَافِقِ،

আর কুরাইশ গোত্রে যেহেতু আমার বংশগত কোন সম্পর্ক নেই, তাই আমি ভাবলাম, যদি আমি তাদের কোন উপকার করে দেই তাহলে তারা আমার পরিবার-পরিজনের হিফাযতে এগিয়ে আসবে। কখনো আমি দ্বীন পরিত্যাগ করা কিংবা ইসলাম গ্রহণের পর কুফরের দিকে ফিরে যাওয়ার জন্য এ কাজ করিনি। রাসূলুল্লাহ (স.) তখন বললেন, হাতেব তোমাদের কাছে সত্য কথাই বলেছে। উমর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে অনুমতি দিন আমি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দিব|

فَقَالَ: إِنَّهُ قَدْ شَهِدَ بَدْرًا، وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّ اللَّهَ اطَّلَعَ عَلَى مَنْ شَهِدَ بَدْرًا فَقَالَ: اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ فَأَنْزَلَ اللَّهُ السُّورَةَ: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ تُلْقُونَ إِلَيْهِمْ بِالْمَوَدَّةِ وَقَدْ كَفَرُوا بِمَا جَاءَكُمْ مِنَ الْحَقِّ

রাসূলুল্লাহ (স.) বললেন, দেখ সে বদর যুদ্ধে যোগদান করেছে। তুমি তো জান না, হয়তো আল্লাহ তায়ালা বদরের যুদ্ধে যোগদানকারীদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে বলে দিয়েছেন, তোমরা যা খুশী করতে থাক, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তখন আল্লাহ তায়ালা এই সূরা নাযিল করেনঃ ওহে যারা ঈমান এনেছো! তোমরা আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা তো তাদেরকে বন্ধুরূপে বার্তা পাঠাও, অথচ তারা তোমাদের কাছে যে সত্য এসেছে তা প্রত্যাখ্যান করেছে।

يُخْرِجُونَ الرَّسُولَ وَإِيَّاكُمْ أَنْ تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ رَبِّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ خَرَجْتُمْ جِهَادًا فِي سَبِيلِي وَابْتِغَاءَ مَرْضَاتِي تُسِرُّونَ إِلَيْهِمْ بِالْمَوَدَّةِ وَأَنَا أَعْلَمُ بِمَا أَخْفَيْتُمْ وَمَا أَعْلَنْتُمْ وَمَنْ يَفْعَلْهُ مِنْكُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيلِ } [الممتحنة

তারা রাসূলকে এবং তোমাদের মক্কা থেকে বের করে দিয়েছে এ কারণে যে, তোমরা তোমাদের রব আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখ। যদি তোমরা বের হয়ে থাক আমার পথে জিহাদ করার উদ্দেশ্যে এবং আমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, তবে কেন গোপনে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাও? আর তোমরা যা গোপন কর তা আমি ভালো করেই জানি। তোমাদের যে কেউ এরূপ করে, সে তো সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। (সূরা মুমতাহিনা-৬০ : ০১) {সহীহ বুখারী : ৪২৭৪}

যার মধ্যে আমানতদার নেই তার ঈমান নেই:

عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: خَطَبَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: لَا إِيمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ , وَلَا دِينَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তির মধ্যে আমানতদারী নেই, তার ঈমান নেই। আর যে ব্যক্তি প্রতিশ্রুতি পালন করে না তার দ্বীনদারী নেই। (শুয়াবিল ঈমান : ৪০৪৫)

প্রত্যেক ব্যক্তিই আমানতদার:

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بن عمر رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: كُلُّكُمْ رَاعٍ فَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، فَالأَمِيرُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُمْ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُمْ، وَالمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ بَعْلِهَا وَوَلَدِهِ وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ، وَالعَبْدُ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ، أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স.) বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। কাজেই প্রত্যেকেই নিজ অধিনস্থদের বিষয়ে জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হবে। যেমন জনগণের শাসক তাদের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসতি হবে। একজন পুরুষ তার পরিবার পরিজনের দায়িত¦শীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী স্বামীর ঘরের এবং তার সন্তানের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। আর ক্রীতদাস আপন মনিবের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। কাজেই সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। শোন! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত¦শীল। কাজেই প্রত্যেকেই আপন অধিনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (সহীহ বুখারী : ২৫৫৪)

সরকারী পদ-পদবী একটি আমানত:

হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَلَا تَسْتَعْمِلُنِي؟ قَالَ: فَضَرَبَ بِيَدِهِ عَلَى مَنْكِبِي، ثُمَّ قَالَ: يَا أَبَا ذَرٍّ، إِنَّكَ ضَعِيفٌ، وَإِنَّهَا أَمَانَةُ، وَإِنَّهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ خِزْيٌ وَنَدَامَةٌ، إِلَّا مَنْ أَخَذَهَا بِحَقِّهَا، وَأَدَّى الَّذِي عَلَيْهِ

আবু যর (রাঃ) বলেন, আমি আবেদন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাকে প্রশাসক পদ প্রদান করবেন? রাবী বলেন, তিনি তখন তার হাত দিয়ে আমার কাঁধে আঘাত করে বললেন, হে আবু যর! তুমি দুর্বল অথচ এটি হচ্ছে একটি আমানত। আর কিয়ামতের দিন এ হবে লাঞ্ছনা ও অনুশোচনা। তবে যে এর হক্ব সঠিকভাবে আদায় করবে তার কথা ভিন্ন। (মুসলিম : ৪৬১৩)

পরামর্শ প্রদান করা আমানত:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الْمُسْتَشَارُ مُؤْتَمَنٌ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, পরামর্শদাতা একজন আমানতদার। (আবু দাউদ : ৫১২৮)

কথা বা তথ্যের আমানত:

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِذَا حَدَّثَ الرَّجُلُ الحَدِيثَ ثُمَّ التَفَتَ فَهِيَ أَمَانَةٌ

জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, কোন কথা বলার পর এদিক সেদিক তাকালে তা আমানত। (আবু দাউদ : ৪৮৬৮)

স্বামী-স্ত্রীর গোপন কথা আমানত এবং প্রকাশ করা খিয়ানত:

عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ سَعْدٍ، قَالَ: سَمِعْتُ أَبَا سَعِيدٍ الْخُدْرِيَّ، يَقُولُ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ مِنْ أَعْظَمِ الْأَمَانَةِ عِنْدَ اللهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، الرَّجُلَ يُفْضِي إِلَى امْرَأَتِهِ، وَتُفْضِي إِلَيْهِ، ثُمَّ يَنْشُرُ سِرَّهَا

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স.) বলেছেন, সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বড় আমানতের খিয়ানতকারী যে তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হয় এবং স্ত্রীও তার সাথে মিলিত হয়। অতঃপর সে তার স্ত্রীর গোপনীয়তা অন্যের কাছে প্রকাশ করে দেয়। (সহীহ মুসলিম : ৩৪৩৫)

অযোগ্য লোককে ক্ষমতায় বসানো আমানতের খিয়ানত:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: بَيْنَمَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي مَجْلِسٍ يُحَدِّثُ القَوْمَ، جَاءَهُ أَعْرَابِيٌّ فَقَالَ: مَتَى السَّاعَةُ؟ فَمَضَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُحَدِّثُ، فَقَالَ بَعْضُ القَوْمِ: سَمِعَ مَا قَالَ فَكَرِهَ مَا قَالَ. وَقَالَ بَعْضُهُمْ: بَلْ لَمْ يَسْمَعْ، حَتَّى إِذَا قَضَى حَدِيثَهُ قَالَ: أَيْنَ - أُرَاهُ - السَّائِلُ عَنِ السَّاعَةِ قَالَ: هَا أَنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَالَ: فَإِذَا ضُيِّعَتِ الأَمَانَةُ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ قَالَ: كَيْفَ إِضَاعَتُهَا؟ قَالَ: إِذَا وُسِّدَ الأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) একদা মহানবী (স.) মজলিশে জনসম্মুখে কিছু আলোচনা করছিলেন। ইতোমধ্যে তাঁর নিকট জনৈক বেদুঈন এসে জিজ্ঞেস করল, কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? মহানবী (স.) কোন জবাব না দিয়ে তাঁর আলোচনা অব্যাহত রাখলেন। এতে কেউ কেউ বললেন, লোকটি যা বলেছে তা তিনি শুনেছেন কিন্তু তার কথা পছন্দ করেন নি। আবার কেউ কেউ বললেন, বরং তিনি শুনতেই পাননি। মহানবী আলোচনা শেষে বললেন, কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারী কোথায়? সে বলল, এই যে আমি, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, যখন আমানত বিনষ্ট হবে তখন তুমি কিয়ামতের অপেক্ষা করবে। লোকটি জিজ্ঞাসা করল, আমানত কিভাবে বিনষ্ট হবে? যখন কোন অনুপযুক্ত ব্যক্তির উপর কোন কাজের দায়িত্ব দেয়া হয় তখন তুমি কিয়ামতে অপেক্ষা করবে। (সহীহ বুখারী : ৫৯)

আমানতের খিয়ানত করা মুনাফিকের আলামত:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: آيَةُ المُنَافِقِ ثَلاَثٌ: إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স.) বলেছেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি যথা: (১.) কথা বললে মিথ্যা বলে (২.) অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে এবং (৩.) আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে। (সহীহ বুখারী : ৩৩)

অন্য হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا: إِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ، وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স.) বলেছেন, চারটি স্বভাব যার মধ্যে বিদ্যমান সে হচ্ছে খাঁটি মুনাফিক। যার মধ্যে এর একটি স্বভাব থাকবে, তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকের একটি স্বভাব থেকে যায়। (ক) আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে (খ) কথা বললে মিথ্যা বলে (গ) অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে এবং (ঘ) বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। (সহীহ বুখারী :৩৪)

শেষান্তের কথা:

আজকের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, আমানতদারী একজন মুমিনের জন্য অতি উন্নত মানের এক গুণ। আমাদের সকলকে এ গুণটি অর্জন ও সংরক্ষণ করতে হবে সামগ্রিক জীবনে। ইসলামী দৃষ্টিতে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আমানতদারিতা থাকলে আমাদের কাজগুলো সুন্দর হবে এবং সকলে মিলে একটি ভালো পরিবেশ প্রতিষ্ঠা হবেমহান আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমিন।

No comments:

Post a Comment

razzakhowlader59@gmil.com