হিজরী
সাল
গণনার ইতিবৃত্ত
এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
প্রশাসনিকভাবে ইসলামী নববর্ষ-হিজরী তারিখ ও
সন গণনার ইতিবৃত্ত। আল্লাহরশুকরিয়া। বছর ঘুরে আবার এলো আমাদের মাঝে নতুন হিজরী
নববর্ষ। আজ পহেলা
মহররম-১৪৪৪, হিজরী নববর্ষ।
মুসলিম জাতির ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান তথা এবাদতের ক্ষেত্রে আরবী বা হিজরী মাসের
গুরুত্ব অনেক বেশি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমরা অনেকেই এ মাসের তারিখ, সাল, কিংবা মাসের নাম জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারিনা।
শুধু রমজানের রোজা, দুই ঈদ, আশুরা এ ধরনের ধর্মীয় এবাদত অনুষ্ঠানের সময় কেবল আমাদের আরবী তারিখের কথা মনে পড়ে।কেবল
আরবী মাস নয় বাংলা মাস এবং তারিখের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।
অর্থাৎ বাংলা মাস কোনটি বা তারিখ কত তা-ও
আমরা একজন বাঙালি হিসেবে আমরা অনেকেই বলতে পারি না।অথচ ইংরেজি মাসের নাম, তারিখ এবং সন আমরা প্রায় সকলেই বলতে পারি।
যাহোক, আরবী বা হিজরী
বর্ষ গণনা কবে থেকে শুরু হলো এবং কিভাবে শুরু হলো সে বিষয়টি নিয়ে নিম্নে আলোকপাত
করা হলো। আশা করি আমরা এ থেকে কিছুটা উপকৃত হতে পারব। ওয়া মা তাওফীকি ইল্লা
বিল্লাহ।
মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত ইসলামের ইতিহাসে এক
যুগান্তকারী ঘটনা। বিশ্বের ইতিহাসেও সবচেয়ে তাৎপর্যবহ, সুদূরপ্রসারী ঘটনা এটি। এটি দ্বীন ও মানবতার
বৃহত্তর স্বার্থে ত্যাগ, বিসর্জনের এক
সাহসী পদক্ষেপ। মুসলমানরা মক্কার কাফেরদের পাশবিক নির্যাতন-নিপীড়ন, অব্যাহত অমানবিক আচরণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ নীরবে সহ্য করার
পর তাদের স্পর্ধা আরো বেড়ে যায়। তারা মহানবী (সা.)-কেও হত্যার ষড়যন্ত্র করে।
আল্লাহ তাআলা তাদের সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেন। মহানবী (সা.) ও মক্কার নির্যাতিত
মুসলমানদের মদীনায় হিজরত করার নির্দেশ দেন। হিজরতের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজ
ও রাষ্ট্র গঠনের দ্বার উন্মোচিত হয়। এরপর সশস্ত্র যুদ্ধে তাগুতি শক্তির মোকাবিলার
শুভ সূচনা হয়। উদিত হয় মক্কা বিজয়সহ ইসলামের বিশ্বজয়ের রঙিন সূর্য। হিজরতের
ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মারক বানিয়ে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) হিজরী
নববর্ষের গোড়াপত্তন করেন। মুসলমানদের জন্য পৃথক ও স্বতন্ত্র চান্দ্রমাসের পঞ্জিকা
প্রণয়ন করেন। কেন একটি নতুন সাল গণনাপ্রথা চালু করতে হলো- এ নিয়ে বিভিন্ন অভিমত
পাওয়া যায়।
আল্লামা
আইনির বিবরণ: ‘হিজরি সাল প্রণয়নের কারণ নিয়ে মতবিরোধ আছে।
ইবনে সমরকন্দি বলেন, ‘আবু মুসা আশআরি (রা.) ওমর (রা.)-এর কাছে চিঠি লিখেছেন যে আপনার পক্ষ থেকে
আমাদের কাছে অনেক ফরমান আসে; কিন্তু তাতে তারিখ লেখা থাকে না। সুতরাং
সময়ক্রম নির্ধারণের জন্য সাল গণনার ব্যবস্থা করুন। তারপর ওমর (রা.) হিজরি সালের
গোড়াপত্তন করেন’। তাফসীরে রুহুল মায়ানী।’ আল্লামা ইবনুল আছির (রহ.) আল কামিল ফিত্
তারিখের মধ্যে এটিকে প্রসিদ্ধতম ও বিশুদ্ধতম অভিমত বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লামা
আইনি তারপর লিখেছেন, ‘আবুল
ইক্জান বলেছেন: ‘‘ওমর
(রা.)-এর কাছে একটি দলিল পেশ করা হয়, যাতে কেবল শাবান মাসের কথা লেখা হয়। তিনি
বলেন: এটা কোন শাবান! এ বছরের শাবান নাকি আগামী বছরের শাবান? তারপর হিজরি সন প্রবর্তন করা হয়।’’ আল্লামা শিবলি নোমানি (রহ.) এ অভিমতকে
প্রাধান্য দিয়েছেন। (আল ফারুক : পৃ. ১৯৫)
ইবনে
আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত: যখন ওমর (রা.) সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি পরামর্শ সভার আহ্বান করেন। সভায় সাদ বিন আবি ওয়াক্কাছ (রা.) রাসুলুল্লাহ
(সা.)-এর ওফাত থেকে সাল গণনার প্রস্তাব দেন। তালহা (রা.) নবুয়তের বছর থেকে সাল
গণনার অভিমত ব্যক্ত করেন।
আলী
(রা.) হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে বর্ষ গণনার প্রস্তাব দেন। তারপর তারা সবাই আলী (রা.)-এর প্রস্তাবে
ঐকমত্য পোষণ করেন। এরপর কোন মাস থেকে শুরু হবে- এ নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। আবদুর
রহমান বিন আউফ (রা.) রজব থেকে শুরু করার প্রস্তাব দেন। কেননা এটি চারটি সম্মানিত
মাসের মধ্যে প্রথমে আসে। তালহা (রা.) রমজান থেকে শুরু করার কথা বলেন। কেননা এটি
উম্মতের বরকতের মাস। আলী (রা.) ও ওসমান (রা.) মহররম থেকে শুরু করার পরামর্শ দেন।
(উমদাতুল ক্বারি : ১৭/৬৬) সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ ক্রমে হযরত ওমর (রাঃ)তা'আলা আনহু হিজরতের বর্ষ থেকে হিজরী নববর্ষ
গণনা করার অভিমত দেন এবং সাহাবাদের সর্বসম্মতিক্রমে মহররম মাসকে হিজরী সালের প্রথম
মাস হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দেন। এভাবে হিজরী সাল ও মাস গণনার হিসাব শুরু হয়ে
যায়। তখন থেকে-ই সরকারি ও প্রশাসনিক সকল চিঠিপত্রে হিজরী মাসের সন ও তারিখ লেখা ও গণনা শুরু হয়। যা অদ্যাবধি চালু
রয়েছে। বর্তমানে সৌদি আরবের প্রশাসনিক চিঠিপত্র হিজরী মাসের তারিখ ও সন উল্লেখ
করেই পত্রালাপ করা হয়ে থাকে। আজও সৌদি আরবের পাসপোর্ট ও ভিসায় আরবি মাসের তারিখ
ও হিজরী সন লেখা হয়ে থাকে।
নতুন বর্ষ আমাদের সকলকে
সচেতনতা ও ইবাদতে মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে এটাই হোক সকলের কাম্য। হিজরী বর্ষ চাঁদের
সাথে সম্পর্ক তাই পবিত্র কুরআনে এসেছে,
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ
وَالْحَجِّ
‘‘তারা
তোমাকে নতুন চাঁদসমূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তুমি বল, তা
মানুষের সময় নির্ধারক ও হজ্জের জন্য সময় নির্ধারক।’’ (সুরা বাকারা-২/১৮৯ আয়াত)
অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে, আমরা
বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলিম আমাদের ধর্মীয় পঞ্জিকার বিষয়ে কোনোই খোঁজ রাখি না।
এমনকি আজ কত হিজরী সাল তা অধিকাংশ ধার্মিক মুসলিম বলতে পারবেন না। আমরা যে ‘ইংরেজি সাল’ ব্যবহার করি
তা মোটেও ‘ইংরেজি’ নয়; বরং তা খৃস্টধর্মীয়। (সূত্রঃ খুতবাতুল ইসলাম-ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ
জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ)
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (র) স্যারের লেখা ‘‘খুতবাতুল ইসলাম’’-৩৩পৃ. বলা হয়েছে)
রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-এর সময়ে ও তার পূর্বে রোমান, পারসিয়ান ও
অন্যান্য জাতির মধ্যে তাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা প্রচলিত ছিল। আরবদের
মধ্যে কোনো নির্ধারিত বর্ষ গণনা পদ্ধতি ছিল না। বিভিন্ন ঘটনার উপর নির্ভর করে
তারিখ বলা হতো। যেমন, অমুক ঘটনার অত বৎসর পরে...। খলীফা উমারের
(রা) খিলাফতের তৃতীয় বা চতুর্থ বৎসর আবূ মূসা আশআরী (রা) তাঁকে পত্র লিখে জানান যে, আপনার সরকারী
ফরমানগুলিতে সন-তারিখ না থাকায় প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দেয়; এজন্য একটি
বর্ষপঞ্জি ব্যবহার প্রয়োজন। খলীফা উমার (রা) সাহাবীগণকে একত্রিত
করে পরামর্শ চান। কেউ কেউ রোম বা পারস্যের পঞ্জিকা ব্যবহার করতে পরামর্শ দেন।
কিন্তু অন্যরা তা অপছন্দ করেন এবং মুসলিমদের জন্য নিজস্ব পঞ্জিকার প্রয়োজনীয়তার
কথা বলেন। এ বিষয়ে কেউ কেউ পরামর্শ দেন যে, রাসূলুল্লাহ (صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ)-এর মীলাদ বা জন্ম থেকে সাল গণনা
শুরু করা হোক। কেউ কেউ তাঁর নুবুওয়াত থেকে, কেউ কেউ তাঁর হিজরত থেকে এবং কেউ কেউ তাঁর
ওফাত থেকে বর্ষ গণনার পরামর্শ দেন। হযরত আলী (রা) হিজরত থেকে সাল গণনার পক্ষে
জোরালো পরামর্শ দেন। খলীফা উমার (রা) এ মত সমর্থন করে বলেন যে, হিজরতই হক্ক ও
বাতিলের মধ্যে পার্থক্যের সূচনা করে; এজন্য আমাদের হিজরত থেকেই সাল গণনা শুরু করা
উচিত। অবশেষে সাহাবীগণ হিজরত থেকে সাল গণনার বিষয়ে একমত পোষণ করেন।
কোন্ মাস থেকে বর্ষ গণনা শুরু করতে হবে সে
বিষয়ে পরামর্শ চাওয়া হয়। কেউ কেউ রবিউল আউয়াল মাসকে বৎসরের প্রথম মাস হিসেবে গ্রহণ
করার পরামর্শ দেন; কারণ রাসূলুল্লাহ (صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) এ মাসেই হিজরত করে মদীনায় আগমন
করেন। ১২ই রবিউল আউয়াল তিনি মদীনায় পৌঁছান। কেউ কেউ রামাদান থেকে বর্ষ শুরুর
পরামর্শ দেন; কারণ রামাদান মাসে আল্লাহ কুরআন নাযিল
করেছেন। সর্বশেষ তাঁরা মুহাররাম মাস থেকে বর্ষ শুরুর বিষয়ে একমত হন; কারণ এ মাসটি
৪টি ‘হারাম’ বা সম্মানিত মাসের একটি। এছাড়া ইসলামের
সর্বশেষ রুকন হজ্জ পালন করে মুসলিমগণ এ মাসেই দেশে ফিরেন। হজ্জ পালনকে বৎসরের
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ কর্ম ধরে মুহাররাম মাসকে নতুন বৎসরের শুরু বলে গণ্য করার
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এভাবে রাসূলুল্লাহ صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-এর ইন্তেকালের প্রায় ৬ বৎসর পরে ১৬ বা ১৭
হিজরী সাল থেকে সাহাবীগণের ঐকমত্যের ভিত্তিতে হিজরী সালগণনা শুরু হয়। যদিও হিজরত
রবিউল আউয়াল মাসে সংঘটিত হয়, তবুও দুমাস এগিয়ে, সে বৎসরের মুহাররাম
থেকে বর্ষ গণনা শুরু হয়। (সূত্রঃ ১.তাবারী, আত-তারীখ ২/৩-৪; ইবনুল জাওযী, আল-মনতাযিম
২/১। হিজরী নববর্ষ ও আশুরা-খুতবাতুল ইসলাম, ৩৩পৃ. ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
রাহিমাহুল্লাহ)
হিজরী
নব বর্ষের শুভেচ্ছা বিক্ষাত আলেমদের
ফতোয়াঃ
এক. শাইখ মুহাম্মদ বিন উছাইমীন (রহঃ) কে হিজরি
বর্ষ উপলক্ষে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের হুকুম ও শুভেচ্ছার প্রত্যুত্তরে কি বলতে হবে সে
সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। জবাবে তিনি বলেন:
যদি কেউ আপনাকে শুভেচ্ছা জানায় তাহলে এর উত্তর
দিন। কিন্তু আপনি নিজের থেকে কাউকে শুভেচ্ছা জানাবেন না। এ মাসয়ালায় এটাই সঠিক
অভিমত। যদি কেউ আপনাকে বলে যে, ‘নববর্ষ উপলক্ষে আমরা আপনাকে শুভেচ্ছা
জানাচ্ছি’। আপনি জবাবে
বলুন: আল্লাহ্ আপনাকে কল্যাণ দিয়ে শুভ করুন এবং এ বছরটিকে কল্যাণ ও বরকতের বছরে
পরিণত করুন। কিন্তু আপনি প্রথমে অন্যদেরকে শুভেচ্ছা জানাবেন না। কেননা সলফে
সালেহিন নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতেন এমন কোন বর্ণনা আছে মর্মে আমি জানি না। বরং
আপনারা জেনে রাখুন সলফে সালেহিন ‘মহররম’ মাসকে নতুন বছরের প্রথম মাস হিসেবে গ্রহণ
করেছেন উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) এর খিলাফত আমলে এসে। [সূত্র: উনাইযাস্থ ‘দাওয়াত ও
ইরশাদ অফিস কর্তৃক প্রকাশিত শাইখের ‘মাসিক সাক্ষাৎকারের সংকলন’, সিডি
সংস্করণ-১, প্রশ্ন নং-৮৩৫]
দুই. শাইখ
আব্দুল কারীম আল-খুদাইর হিজরি বর্ষের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন সম্পর্কে বলেন:
বিভিন্ন উপলক্ষে যেমন- ঈদ উপলক্ষে মুসলমানের
জন্য সাধারণ দোয়া করতে কোন আপত্তি নেই; যদি ব্যক্তি এ দোয়ার ভাষ্যকে বিশেষ কোন ইবাদত
হিসেবে বিশ্বাস না করে। বিশেষতঃ এ ধরণের শুভেচ্ছার উদ্দেশ্য যদি হয় পারস্পরিক সম্প্রীতি
এবং মুসলমানের চেহারায় আনন্দ ও খুশি ফুটিয়ে তোলা।
তিন. ইমাম
আহমাদ (রহঃ) বলেন: আমি প্রথমে
কাউকে শুভেচ্ছা জানাই না। কেউ আমাকে শুভেচ্ছা জানালে আমি জবাব দেই। কেননা
অভিবাদনের জবাব দেয়া ওয়াজিব। কিন্তু, প্রথমে শুভেচ্ছা জানানো: এটি কোন আদিষ্ট
সুন্নত নয় এবং এ সম্পর্কে নিষেধও করা হয়নি।
পরিশেষে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া কামনা করি। হিজরী-১৪৪৪!এর জন্য। হিজরী নববর্ষের শুভেচ্ছা! সকল ভাইয়ের প্রতি। নতুন হিজরী বর্ষে আমাদের জীবনে আসুক— শান্তি, সমৃদ্ধি ও মুক্তির বার্তা। আমিন।
No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com