Wednesday, April 19, 2023

লাইলাতুল ক্বাদর মুসলিম উম্মাহর জন্য অবারিত শ্রেষ্ঠ উপহার

 

লাইলাতুল ক্বাদর মুসলিম উম্মাহর জন্য অবারিত শ্রেষ্ঠ উপহার

আরটি-১২২৮৫ এম এ রাজ্জাক হাওলাদার

 لَيْلَةٌ শব্দ এর অর্থ হলো রাত, ক্বাদ অর্থ হলো তাকদীর, সম্মান, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব। তাহলে লাইলাতুল ক্বাদরের অর্থ হচ্ছে সম্মানিত রজনী। আলেম সমাজের অধিকাংশের মতে রমযানের শেষ দশ তারিখের যে কোনো একটি বেজোড় রাত হচ্ছে এই ক্বাদরের রাত।

জীবন্ত মুজিজা মহাগ্রন্থ আলরআন ২৬ রমজান দিবাগত ২৭ রমজানের রাতে প্রথম অবতীর্ণ হয়েছিল। এই রাত বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদাপূর্ণ রাত। এই রাতকে আরবিতে লাইলাতুল কদরবা কদর রজনী বলা হয়।

ফারসিতে বলে শবে কদর। অর্থ সম্মানিত মর্যাদাপূর্ণ ও মহিমান্বিত, সম্ভাবনাময়, ভাগ্যনির্ধারণী রজনী। আল্লাহ তাআলা বলেছে,

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ (1) وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ (2) لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ (3) تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوْحُ فِيْهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ (4) سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ (5)

“নিশ্চয়ই আমি করআন নাজিল করেছি মাহাত্ম্যপূর্ণ কদরের রজনীতে। আপনি কি জানেন, সে মহিমাময় রাত্রি কী? মহিমান্বিত ওই নিশি সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাত্রিতে ফেরেশতারা রুহুল কুদুস হজরত জিবরাইল (আ.)এর সঙ্গে অবতরণ করেন; তাঁদের প্রভু মহান আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে ফজর পর্যন্ত।” (রা কদর-৯৭:১-৫)

হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ يَقُمْ لَيْلَةَ القَدْرِ، إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ» (بخارى ــ 35)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ক্বাদরের রাতে ঈমান সহকারে সওয়াবের আশায় ইবাদত করে তার পূর্বের গুনাহসমূহ মাফ করা হয়। (সহীহ বুখারী-৩৫)

 লাইলাতুল ক্বাদরের রাত্র সম্পর্কে কিছু উপহার তুলে ধরছি:

v লাইলাতুল ক্বাদর (ভাগ্য রজনী/ সম্মানীত রাত/মুবারক রাত) মুসলিম উম্মাহর প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ উপহার তাই রাসূল (সা.)এই রাত লাভের জন্য সারা বছর অধীর আগ্ৰহ নিয়ে অপেক্ষা করতেন। (সহীহ বুখারী-)

v হাদীসে এসেছে, تَحَرُّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِىْ الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الْاَخِرِ مِنَ رَمَضَانَ জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত দানের জন্য আল্লাহ তায়ালা মেহেরবানী করে শুধু মাত্র মুসলিম উম্মাহ কে মাহে রামাদানের শেষ দশকের বেজোড় (২১/২৩/২৫/২৭/২৯) রাতে ক্বাদর নির্ধারন করে দিয়েছেন।(বুখারী-২০৫৬;রিয়াদুস সালেহীন-১১৯৫)

v ক্বাদরের রাতেই আল্লাহ তায়ালা মহা গ্ৰন্থ আল-কুরআন লাওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আকাশে অবতীর্ণ করেন। (সূরা দুখান-৪৪:৩; সূরা ক্বাদর-৯৭:১)

v আল্লাহ তাআলা ক্বাদর রাত্রির মর্যাদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে একটি পরিপূর্ণ সূরা (ক্বাদর) নাযিল করেছেন। (সূরা ক্বাদর-৯৭:১-৫)

v এই রাতের ইবাদাতের সাওয়াব ১০০০ মাস(৮৩বছর ৪মাস) সার্বক্ষণিক দিনে জেহাদ ও রাতে সকল প্রকার নফল ইবাদাতের সাওয়াবের চেয়ে ও উত্তম বলে জানিয়ে দিয়েছেন। (সূরা ক্বাদর-৯৭:৩)

v  হাদীসে আরো এসেছে, 

إِنَّ هَذَا الشَّهْرَ قَدْ حَضَرَكُمْ، وَفِيْهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَهَا فَقَدْ حُرِمَ الْخَيْرَ كُلَّهُ، وَلَا يُحْرَمُ خَيْرَهَا إِلَّا مَحْرُوْمٌ» (ابن ماجه ــ1655)

এটি এমন এক রাত যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। আর যে এই রাত থেকে বঞ্চিত হল সে যাবতীয় কল্যাণ হতেই বঞ্চিত।(ইবনে মাজাহ-১৬৫৫)

v এই রাতে আল্লাহ তায়ালা হায়াত, মউত, রিজিক এর মত গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় গুলোর ফায়সালা পূনঃ নির্ধারণ করেন।(সূরা দুখান-৪৪:৪-৫ কুরতুবি)

v ক্বাদরের রাতে জিবরীল আমীনের নেতৃত্বে এক বিশাল ফেরেশ্তার দল পৃথিবীতে নেমে আসে এবং তারা মুমিন মুমিনাদের প্রতি কল্যান ও প্রাচুর্য বন্টন করেন। (সূরা ক্বাদর-৯৭:৪)

v ক্বাদরের রাতে ইবাদাতের অছিলায় বান্দার বিগত জীবনের সকল সগীরা গুনাহ গুলো ক্ষমা করে দেন।আর তওবার মাধ্যমে কবীরা গুনাহ গুলো ও ক্ষমা করে দেন।(বুখারী-২০৫৩,১৯০২,১৭৬৬; মুসলিম-৭৬০)

v এই রাতে একমাত্র হতভাগ্য ছাড়া অর্থাৎ (মদ্যপান কারী, পিতামাতার অবাধ্য চারী সন্তান,আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন কারী,ওমানুষের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ পোষণ কারী) ব্যতীত কাউকে ক্বাদরের সৌভাগ্য (রহমত)থেকে বঞ্চিত করেন না। (ইবনে মাজাহ-১৭১৩, সহীহ তারগীব-৯৮৬)

v ক্বাদরের রাতে যারা এশার সালাত জামাতের সাথে আদায় করবে আল্লাহ তাআলা তাদের কেও ক্বাদরের ফজিলত দান করেন। (মুসলিম-১৫২৩)

v এই রাতে জীবরীল আমীন ও তাঁর সঙ্গিরা দুনিয়ার ইবাদত কারী বান্দা বান্দী কে সালাম করেন ও তাদের জন্য দোয়া করেন, তাদের সাথে মোছাফাহা করেন এবং তারা যখন দোয়া করে সে দোয়ায় শরীক হয়ে আমীন আমীন বলেন। (মা আরেফুল হাদীস-৪:৭৬; হাদীস শরীফ-২খন্ড ১০০পৃ.)

v ক্বাদরের রাতে রাসূলে কারীম (সা.)কাতর কন্ঠে বেশি বেশি পাঠ করতেন "আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফ ওয়া ফা'ফু আননী" হে আল্লাহ তুমি মহান ক্ষমাকারী,ক্ষমা করা তুমি পছন্দ করো,অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।(তিরমিযি-৩৮৫৫)

v কদরের রাতে আল্লাহ তাআলা রাতের প্রথম অংশে ই প্রথম আকাশে নেমে আসেন, এবং আকাশে রহমতের দরজা উন্মুক্ত করে দেন এবং সূর্য উদয়ের পূর্ব পর্যন্ত বান্দার ফরিয়াদ শুনতে থাকেন।(বুখারী)

v এই রাতে আললাহ তায়ালা বান্দার তওবা কবুল করেন এবং সত্তর হাজার (অসংখ্য)পাপি বান্দাকে ক্ষমা করে জান্নাতী বান্দা হিসেবে ঘোষণা দেন। (সহীহ তারগীব-৯৮৪)

v ক্বাদরের রাতের ইবাদাতের অছিলায় আললাহ তায়ালা এই উম্মার মর্যাদা বনি ইসরাইলের নবী হযরত আইয়ুব (আ.), হযরত যাকারিয়া (আ.), হযরত হিযকিল (আ.) ও হযরক ইউশা ইবনে নূন (আ.) এর উপর মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। (তাফসিরে ইবনে কাসীর সূরা ক্বাদরের ফজিলত অধ্যায়)

v ক্বাদরের রাত্রির অছিলায় আল্লাহ তায়ালা হাশরের ময়দানে উম্মতে মুহাম্মাদীর মর্যাদাকে সকল নবীর উম্মতের উপর বুলুন্দ রাখতে চান। (দুররুল মানসুর)

v ক্বাদরের রাতকে গোপন রাখার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার হিকমাহ হলোঃ যাতে এই সব রাতেএই উম্মাত বেশি বেশি যিকির আযকার, দোয়া দরুদ, নফল ইবাদত, ইতেকাফ, কুরআন তেলাওয়াত, দান ছাদাকা, ইসতেগফার ইত্যাদী আদায়ের মাধ্যমে রাতকে খুঁজে নিতে পারে আর আল্লাহ এই অছিলায় তাদের নেকীর পাললা ভারী করে দিতে পারেন। (বুখারী-২০৬২; রিয়াদুস সালেহীন-১১৯০)

v এই নবীর উম্মাহর হায়াত কম তাই আল্লাহ তায়ালা রহমতের বহিঃপ্রকাশের জন্য একটি রাতকে এত মহিমান্বিত করে এই নবীর উপর নাযিল করেছেন, যাতে করে প্রিয় নবীর উম্মত অল্প ইবাদত বন্দেগী করেও বেশি সাওয়াবের অধিকারী হয়ে অন্য নবীর উম্মতের চেয়ে নিজেদের মর্যাদা অনেক উচ্চে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। (তাফসিরে মাআরেফুল কুরআন)

v ক্বাদরের রাত এলে রাসূল (সা.) সমস্ত মন প্রান আবেগ উঝার করে ইবাদাত বন্দেগী তে আত্মনিয়োগ করতেন যা অন্য সময় এতটা দেখা যেতো না। (তিরমিযি-৮০১)

v মাহে রমজানের শেষের দশক আসলে রাসূল (সা.)শুধু নিজেই ইবাদাতে বিভোর হতেন তা নয় বরং তার প্রিয় পরিবার বর্গকে ও সঙ্গে নিয়ে কোমর বেঁধে ইবাদতে নিমগ্ন হতেন (মুসলিম-২৮৪৪)

পরিশেষে মহান আল্লাহ তায়ালা আমাকে ও আমাদের প্রিয় বন্ধু মহলের কাছে কায়মনোবাক্যে গভীর আকুতি নিয়ে আবেদন করছি তিনি যেন আমাদের-কে প্রতি রামাদানে ক্বাদর রাত্রি নসিব করে দেন। হে করুনাময় আল্লাহ! আমাদের ফরিয়াদ টুকু কবুল করুন। আমীন। ছুম্মা আমিন।

 

No comments:

Post a Comment

razzakhowlader59@gmil.com