হযরত ওমর(রা.)বলিষ্ঠ নেতৃত্ব
এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
ইতিহাসের
সফলতম রাষ্ট্রনায়ক ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.) ছিলেন ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক।
সর্বপ্রথম তাকেই ‘আমিরুল মুমিনিন’ তথা
‘বিশ্বাসীদের নেতা’
উপাধিতে
ভূষিত করেন রাসুলের সাহচর্যে ধন্য সাহাবিরা। প্রথম খলিফা আবুবকর (রা.) তার মৃত্যুর
আগেই সাধারণ মানুষের মতামতের ভিত্তিতে ওমরকে খলিফা মনোনীত করে যান। তার মর্যাদা
সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার পরে যদি কেউ নবী হতেন
তাহলে তিনি ওমর ইবনে খাত্তাবই হতেন।’
(মিশকাত-৬০৩১)
শৈশবেই তার মধ্যে বলিষ্ঠ নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত হয়।
হিজরতের আনুমানিক চল্লিশ বছর আগে মক্কার কুরাইশ বংশের বনি আদি পরিবারে তার জন্ম।
রাসুল (সা.)-এর নবুওয়তের মিশন শুরু করার সময় তিনি ছিলেন মক্কার প্রভাবশালী
যুবনেতা। অন্যদের মতো তিনিও প্রথম দিকে ইসলামের বিরোধিতা করেন। ইসলামগ্রহণের
অপরাধে নিজের দাসদাসী ও পরিবারের লোকদের নির্যাতনও করেন। একদিন রাসুল (সা.)
আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ,
ওমর
অথবা আবুজাহেলের মাধ্যমে ইসলামের মর্যাদা সমুন্নত করুন।’ প্রত্যুষেই
ওমর নবীজির দরবারে হাজির হয়ে ইসলাম কবুল করেন। তারপর প্রকাশ্যে মসজিদুল হারামে
নামাজ পড়েন। (তিরমিজি-৩৬৮১)
এরপর থেকে ইসলামের চরম শত্রু ওমর ইসলামের পরম বন্ধু হিসেবে
আবির্ভুত হন। রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশার প্রতিটি পদে তিনি রাসুলের বিশ্বাস্ত সহযোগী
হিসেবে কাজ করেছেন; আঞ্জাম দিয়েছেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
প্রথম খলিফা আবুবকর (রা.)-এর খেলাফতকালেও প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
ইসলামি রাষ্ট্রের সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তার সঙ্গে পরামর্শ করেই সম্পন্ন
করতেন আবুবকর (রা.)। স্বয়ং রাসুল (সা.) বিভিন্ন সময় আবুবকরের পর তার মর্যাদার কথা
বলেছেন। তার নেতৃত্বের সুসংবাদও দিয়েছেন বিভিন্ন সময়। জীবন সায়াহ্নে রাসুল (সা.)
ইরশাদ করেছেন, ‘আমি বলতে পারছি না আর কতদিন তোমাদের মধ্যে
বেঁচে থাকব। আমার অবর্তমানে তোমরা আবুবকর-ওমরকে মান্য করবে।’ (তিরমিজি-৩৬৬৩)
হযরত ওমরের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণেই ছোট ইসলামি রাষ্ট্র
পৃথিবীর দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। তার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী তৎকালীন বিশ্বের দুই
বৃহৎ পরাশক্তি বাইজান্টাইন ও সাসানি সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে ইসলামি রাষ্ট্রের
সীমানা বিস্তার করে। তার হাত ধরেই রাজস্ব,
বিচার
বিভাগ, বাজার ব্যবস্থাপনা,
নগরায়ণ
প্রভৃতি প্রয়োজনীয় বিভাগগুলো গড়ে ওঠে। বলিষ্ঠ নেতৃত্বের সহজাত গুণের কারণে তিনি
হয়ে ওঠেন ইসলামের ইতিহাসের কিংবদন্তি রাষ্ট্রনায়ক। যেসব গুণের সাহায্যে তিনি
অত্যন্ত সুচারুরূপে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তার
মধ্য থেকে কয়েকটি গুণের কথা এখানে তুলে ধরছি।
চারিত্রিক দৃঢ়তা :
চারিত্রিক দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতার জন্য ওমর (রা.) শৈশব থেকেই
পরিচিত ছিলেন। যে কথা বা কাজ তিনি ঠিক মনে করতেন, তা
থেকে কোনোকিছুই তাকে ফেরাতে পারত না;
কাউকেই
তিনি ভয় পেতেন না। তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনাই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ততদিন পর্যন্ত
সবাই গোপনে ইসলাম পালন করতেন। তিনি ইসলামগ্রহণের পর কাবা চত্বরে গিয়ে প্রকাশ্যে
ঘোষণা দেন এবং সবাইকে নিয়ে নামাজ আদায় করেন। হিজরতের সময়ও কাফিরদের সামনে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে মক্কা
ত্যাগ করেন। এমন বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী হওয়ার কারণেই রাসুল (সা.) তাকে বলেন, ‘হে
ইবনুল খাত্তাব, আমার প্রাণ যে সত্ত্বার হাতে তার কসম করে বলছি, শয়তান
যখন তোমাকে এক রাস্তায় দেখে, তখন সে অন্য রাস্তায় মুখ
করে।’ (সহীহ বুখারী)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই
আল্লাহতায়ালা সত্যকে ওমরের মুখে ও অন্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। (তিরমিজি-১৭৩৬)। তার সত্যবাদিতা ও দৃঢ়তার
কথা অন্য হাদিসে এসেছে এভাবে,
‘নিশ্চয়ই
আল্লাহ ওমরের জিহ্বায় সত্য রেখে দিয়েছেন। ফলে তিনি কেবল সত্যই উচ্চারণ করেন।’ (আবুদাউদ-১৮৩৪)
দায়িত্ব সচেতনতা :
খেলাফতের দায়িত্ব পালনকালে ওমর (রা.)-কে একবার আলী (রা.)
কোথাও দ্রুত ছুটে যেতে দেখেন। আলী (রা.) তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে ওমর জানালেন, জাকাতের
একটি উট হারিয়ে গেছে। সেটি খোঁজার জন্যই তিনি ছুটছেন। এতেই বোঝা যায়,
ওমর
(রা.) দায়িত্ব পালনে কত সচেতন ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘ফোরাত
নদীর তীরে যদি একটি ছাগলও হারিয়ে যায়,
ওমরকে
শেষ বিচারের দিন এর জন্য দায়ী থাকতে হবে।’
হযরত ওমর (রা.) এতই দায়িত্ব-সচেতন ছিলেন যে, সারাদিনের
দায়িত্ব পালন শেষেও সন্ধ্যায় মদিনা ও আশপাশের এলাকায় মানুষের অবস্থা তদারকির জন্য
ছদ্মবেশে বের হতেন। তাছাড়া মুসলিম-অমুসলিম যে কোনো নাগরিক তার কাছে এসে যেকোনো
অভিযোগ সরাসরি জানাতে পারে মতো অবাধ সুযোগ তিনি রেখেছিলেন।
জ্ঞান ও প্রজ্ঞা :
রাসুল (সা.) বলেছেন,
‘একবার
ঘুমে আমি স্বপ্ন দেখি, আমি দুধ পান করছি। পান করে আমি এতই পূর্ণ হয়ে
গেলাম যে, আমার নখ বেয়ে দুধ গড়িয়ে পড়ছিল। তাই আমি দুধ পান
করার জন্য ওমরের কাছে (পাত্র) বাড়িয়ে দিলাম।’
উপস্থিত
সাহাবিরা এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করলে আল্লাহর রাসুল উত্তরে বলেন, ‘(দুধের
এই উপমা) জ্ঞান।’ (সহীহ বুখারী)
তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এতই উন্নত ছিল, অনেক
সময় তার মতামতের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ কথাই আল্লাহ পবিত্র কোরআনের আয়াত হিসেবে নাজিল
করেন। বদরযুদ্ধের বন্দিদের সম্পর্কে তার মতামত অধিকতর সঠিক ছিল বলে কোরআনে বর্ণিত
হয়েছে। তার জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘পরবর্তী
উম্মতের মধ্যে বহু মুহাদ্দিস তথা জ্ঞানী অতিবাহিত হয়েছেন। আমার উম্মতের মধ্যে যদি
কেউ মুহাদ্দিস থাকেন, তিনি ওমর।’
(বুখারী-৩৪৬৯)
দুরদর্শিতা :
হযরত ওমর (রা.) যেকোনো মানুষের সঙ্গে সময় কাটানোর পর তার
মেধা ও যোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা করতে পারতেন। এর মাধ্যমে তিনি কোনো ব্যক্তির
প্রতিভা ও দুর্বলতা বুঝতে পারতেন। মানুষ চেনার এই যোগ্যতার মাধ্যমেই তিনি সঠিক
ব্যক্তিকে সঠিক দায়িত্বে নিয়োগ দিতে পারতেন। এসব গুণ ও যোগ্যতার মাধ্যমেই ওমর
(রা.) পৃথিবীর বুকে একটি শক্তিশালী ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে যেতে সক্ষম হন।
পরবর্তী সময়ে খেলাফতের এই শক্তিই অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্বশক্তি হিসেবে তৎকালীন
পৃথিবীতে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করে নেয়।
প্রিয় বন্ধুরা! উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান
করুন। আমিন।
No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com