Wednesday, May 17, 2023

দু‘আ ও মুনাজাতের আদব সমূহ

 


দুআ ও মুনাজাতের আদব সমূহ

-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার

শুরুকথা:

মানুষ মাত্রই মুখাপেক্ষিতা। তাই সে নিজ কাজ-কর্ম সম্পাদন করতে এবং প্রয়োজন পুরা করতে অন্যের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। তন্মধ্যে মুমিন বান্দা তার সকল কাজ সম্পাদনে নিজের সকল প্রয়োজনে কেবল আল্লাহর তাআলার দরবারেই প্রার্থনা করে। এতে অন্য কারো মধ্যস্থতা সে গ্রহণ করে না। কেননা মানুষের সকল প্রয়োজন আল্লাহ তাআলার কাছে রোনাজারি ও দুআর মাধ্যমেই পুরা হয় এতে কারো মধ্যস্থতার দরকার হয় না। এছাড়া হাদীসে এসেছে দুআ হল একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। অন্য হাদীসে এসেছে, দুআ ইবাদতের মগজ। তাই দুআর মাধ্যমে মনোবাঞ্ছা পূরণ হওয়ার সাথে সাথে এতে রয়েছে আরো বিশেষ ফায়দা। প্রত্যেক দুআর বিনিময় আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আলাদা আলাদা সওয়াব লাভ হয়।

দুআর এই ফযিলত ও ফায়দা লাভ করতে হলে কিছু শর্ত ও আদাব রক্ষা করা জরুরী। সে সব শর্ত ও আদাবের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে দুআ করলে দুআ কবুল হয় এবং দুআর দ্বারা পূর্ণ সুফল লাভ হয়। তন্মধ্য থেকে কিছু শর্ত ও আদাব এবং দুআ কবুল হওয়ার বিশেষ সময়ের কথা নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ

 

দুআ কবুল হওয়ার কিছু শর্তঃ

১. পোশাক-পরিচ্ছদ ও বাসস্থান হালাল হওয়া:

দুআকারীর পানাহার পোশাক-পরিচ্ছদ ও বাসস্থান হালাল হওয়া। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا، وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ، فَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا، إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ} [المؤمنون: 51] وَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ} [البقرة: 172] ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ، يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ، يَا رَبِّ، يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ، فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ؟ "

কোনো ব্যক্তি দীর্ঘ সফর করে এলোমেলো চুল ও ধূসর দেহ নিয়ে আসমানের দিকে দুহাত তুলে বলতে থাকেঃ হে আমার রব! হে আমার রব! অথচ তার পানাহার, পোশাক-পরিচ্ছদ সবই হারাম অতএব তার দুআ কিরূপে কবুল হবে?” (সহীহ মুসলিম: ১০১৫)

২. দু‘আ কবুল হতে অধৈর্য্য না হওয়া:

বাহ্যিকভাবে কবুল হতে বিলম্ব হচ্ছে মনে হলে অধৈর্য্য না হওয়া। এবং এ কথা না বলা যে, আমি দুআ করেছিলাম কিন্তু তা কবুল হয়নি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: " يُسْتَجَابُ لِأَحَدِكُمْ مَا لَمْ يَعْجَلْ، فَيَقُولُ: قَدْ دَعَوْتُ فَلَا - أَوْ فَلَمْ - يُسْتَجَبْ لِي "

তোমাদের দুআ কবুল হবে যদি না তোমরা তাড়াহুড়া করো। এবং এ কথা না বলো যে, আমি দুআ করলাম কিন্তু তা কবুল হল না।” (মুসলিম: ২৭৩৫)

৩. দু‘আর মধ্যে নাজায়েয কিছু না চাওয়া:

প্রার্থিত বিষয় নাজায়েয কিছু না হওয়া। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: " مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَدْعُو بِدَعْوَةٍ لَيْسَ فِيهَا إِثْمٌ، وَلَا قَطِيعَةُ رَحِمٍ، إِلَّا أَعْطَاهُ اللهُ بِهَا إِحْدَى ثَلَاثٍ: إِمَّا أَنْ تُعَجَّلَ لَهُ دَعْوَتُهُ، وَإِمَّا أَنْ

কোনো মুসলমান যখন কোনো দুআ করে তখন আল্লাহ তাআলা তাকে হয়ত তার কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি দান করেন অথবা তার থেকে অনুরূপ অনিষ্টতা দূর করে দেন, যদি না সে কোনো গুনাহের জন্য অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার দুআ করে।” (তিরমিযী: ৩৪৬৮, মুসনাদে আহমদ: ১১১৩৩)

৪. দুআ কবুল হওয়ার জন্য এটিও শর্ত সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ হতে নিষেধ বিদ্যমান থাকা:

দুআ কবুল হওয়ার জন্য এটিও শর্ত যে, মুসলিম উম্মাহর মাঝে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ হতে নিষেধ বিদ্যমান থাকা। কেননা ব্যাপকভাবে এ আমল বন্ধ হয়ে গেলে দুআ কবুল হওয়ার প্রতিশ্রুতি বলবৎ থাকে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: دَخَلَ عَلَيَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَرَفْتُ فِي وَجْهِهِ أَنْ قَدْ حَضَرَهُ شَيْءٌ فَتَوَضَّأَ وَمَا كَلَّمَ أَحَدًا ثُمَّ خَرَجَ فَلَصِقْتُ بِالْحُجْرَةِ أَسْمَعُ مَا يَقُولُ فَقَعَدَ عَلَى الْمِنْبَرِ فَحَمِدَ اللَّهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ ثُمَّ قَالَ: "يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللَّهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى يَقُولُ لَكُمْ مُرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ قَبْلَ أَنْ تَدْعُونِي فَلَا أُجِيبُكُمْ وَتَسْأَلُونِي فَلَا أُعْطِيكُمْ وَتَسْتَنْصِرُونِي فَلَا أنصركم"

হে লোক সকল! আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে বলেছেন, তোমরা সৎকাজের আদেশ করো এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করো এমন সময় আসার পূর্বে যখন তোমরা আমাকে ডাকবে কিন্তু আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো না। তোমরা আমার নিকট কিছু চাইবে কিন্তু আমি তা পূর্ণ করবো না। তোমরা শত্রুর বিরুদ্ধে আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে কিন্তু আমি তোমাদেরকে সাহায্য করবো না।” (সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৯০)

 

 

 

দুআর আদব সমূহঃ

১. উযুর সাথে মুনাজাত করা। (সহীহ মুসলিম: ২৪৯৮)

২. কিবলামুখী হয়ে মুনাজাত করা। (সহীহ বুখারী: ৩৯৬০, সহীহ মুসলিম: ৮৯৪)

৩. মুনাজাতের সময় সিনা বরাবর হাত তোলা এবং মুনাজাত শেষে চেহারায় হাত মোছা। (মুসনাদে আহমাদ: ১১০৯৩, আবু দাউদ: ১৪৮৫)

৪. দুআর পূর্বে কোনো নেক আমল করা। (সহীহ মুসলিম: ২৭৪৩)

৫. আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্বের পূর্ণ অনুভূতি নিয়ে অত্যন্ত বিনয় ও খুব কাকতি-মিনতি করে এভাবে দুআ করা যে, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে দিয়েই দাও, আমার তো আর কোনো রব নেই, তুমি কবুল না করলে আমার কোনো উপায় নেই। এভাবে বিনয়ের সাথে বারবার বলতে থাকা। (সহীহ ইবনে হিব্বান: ৮৭১)

৬. দুআর শুরুতে ও শেষে আল্লাহর প্রশংসা ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দরূদ পাঠ করা এবং আমীনদ্বারা দুআ শেষ করা। (আবু দাউদ: ১৪৮১, তিরমিযী: ৩৪৭৬)

৭. এই ইয়াকীন ও বিশ্বাসের সাথে মুনাজাত করা যে, আমি যা চাইলাম আমার মাওলা নিশ্চিত আমাকে তা দিবেন। (বুখারী: ৬৩৩৯, মুসলিম: ২৬৭৮)

৮. নিম্নস্বরে কায়মনোবাক্যে মুনাজাত করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা তোমাদের প্রভুকে কায়মনোবাক্যে ও অনুচ্চস্বরে ডাকো, নিশ্চয় তিনি সীমা-লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” (আল আরাফ: ৫৫)

৯. মুনাজাতে কান্নাকাটি করা। কান্না না আসলে কান্নার ভান করা। (মুসলিম: ২০২, ইবনে মাজাহ: ৪১৯৬)

১০. সকল মুমিনের জন্য দুআ করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “আপনি আপনার নিজের ভুলের জন্য ইস্তিগফার করুন এবং সকল মুমিন নর-নারীদের জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করুন।” (সূরা মুহাম্মদ: ১৯)। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, “যে ব্যক্তি মুমিন নর-নারীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রত্যেক নর-নারীর বদলায় তার আমলনামায় একটি করে নেকী লেখা হয়। (ত্ববারানী; মুসনাদুশ শামিয়্যীন: ২১৫৫, মাজমাউয যাওয়াইদ: ১০/২১০)

১১. প্রথমে নিজেকে দিয়ে দুআ শুরু করা। হযরত উবাই ইবনে কাব রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কারো আলোচনা করে তার জন্য দুআ করতে চাইতেন তখন প্রথমে নিজের জন্য দুআ করতেন, এরপর আলোচিত ব্যক্তির জন্য দুআ করতেন।

১২. কোনো গুনাহের কাজ সম্পন্ন হওয়ার দুআ না করা। নাজায়েয কোনো কিছুর জন্য দুআ না করা। এসব দুআ তো কবুল হয়ই না বরং ঈমান চলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

 

দুআ কবুল হওয়ার বিশেষ কিছু সময়ঃ

১. প্রত্যেক ফরয নামাযের পর।

বি.দ্র. প্রত্যেক ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা মুস্তাহাব। তবে এই মুনাজাত নামাযের অংশ নয় এবং এখানে ইমামের ইত্তিবাবা অনুসরণ নেই। সুতরাং কেউ যদি করতে চাই একাকি করতে নিষেধ নেই। সম্মিলিত ভাবে শব্দ উচ্চারণ করে পড়লে আপনি মোস্তাহাব আদায় করছেন ঠিক কিন্তু অন্যে খতি হচ্ছে (মাসবুল ব্যক্তির জন্য ফরজ আদায়ের ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে)। তবে যারা করতে চান একাকী করেন নিষেধ নেই। যারা বলেন, ফরয নামাযের পর মুনাজাত করা আবশ্যক তাদের কথা কোন সহীহ হাদীস নেই

২. আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ে। (আবু দাউদ: ৫২১, তিরমিযী: ২১২)

৩. রাতের শেষভাগে। (তিরমিযী: ৩৪৯৯)

৪. জুম’আর দিন খুবার মাঝে কিংবা আসর ও মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়ে। (বুখারী: ৯৩৫, মুসলিম: ৮৫২)

৫. যমযমের পানি পান করার সময়। (মুসনাদে আহমদ: ১৪৮৪৯, ইবনে মাজাহ: ৩০৬২)

৬. শরীআত সম্মত যিকিরের মজলিসে থাকা অবস্থায়। (বুখারী: ৬৪০৮, মুসলিম: ২৭২৯)

৭. সিজদা অবস্থায়। মুমিন বান্দা এ অবস্থায় আল্লাহ তাআলার অতি নিকটে চলে যায়। (সহীহ মুসলিম: ৪৮২)

৮. অসুস্থ ব্যক্তির নিকট দুআ করার সময়। কারণ তার নিকটে গিয়ে যা বলা হয় এর উপর ফেরেশতারা আমীনবলতে থাকে। (সহীহ মুসলিম: ৯১৯)

৯. বৃষ্টির সময়। (মুস্তাদরাকে হাকেম: ২/১১৪)

১০. জিহাদের ময়দানে যুদ্ধরত অবস্থায়। (আবু দাউদ: ২৫৪০, সুনানে দারেমী: ১২০০)

সাত ব্যক্তির জন্য ফিরিস্তারা দোয়া করেন:

১.ওযু অবস্থায়  ঘুমানো ব্যক্তি।(সহীহ ইবনে হিব্বান-৩খন্ড ৩২৮-৩২৯পৃ.)

২.নামাজের জন্য মসজিদে অপেক্ষারত ব্যক্তি।(সহীহ মুসলিম৬১৯)

৩.প্রথম কাতারে নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি।(মুসনাদের আহমাদ-২২৩১৭)

৪.রাসূল (সা.) এর প্রতি দুরুদ পাঠকারী ব্যক্তি।(সহীহ আত-তারগীব-৬৮০)

৫.রোগী পরিদর্শনকারী ব্যক্তি।(সহীহ ইবনে হিব্বান-২৯৫৮)

৬.মুসলিম ভাইয়ের জন্য দোয়াকারী ব্যক্তি।(সহীহ মুসলিম-৮৮)

৭.কল্যাণের পথে দানকারী ব্যক্তি।(সহীহ বুখারী-১৪৪২)

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দুআর শর্ত ও আদাবের প্রতি লক্ষ্য রেখে দুআ কবুলের বিশেষ মুহূর্তগুলো সহ সব সময় বেশি বেশি দুআ করার তাউফীক দান করুন। আমীন। (সংগৃহীত)---এ সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে আমার ওয়েব সাইট ভিজিট করুন অনেক লেখা পা্বেন। www.iqra520.blogspot.com

 

No comments:

Post a Comment

razzakhowlader59@gmil.com