রোগীর সেবা ও আমাদের করণীয়
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
ভূমিকা:
অন্যের ব্যথায় সমব্যথী হওয়া এবং পরের বিপদে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা একটি
মহৎ গুণ। এক ধরনের নেকীর কাজ। হিতৈষী মনোভাব ও সহমর্মিতার গুণ ছাড়া মানবিকতা ও
মহানুভবতার বিকাশ পূর্ণতা পায় না। আমি তিনবেলা পেট পুরে খেতে পারি। একাধিক পদের
তরকারি ছাড়া আমার খাবার রোচে না। বিচিত্র স্বাদ আস্বাদন ছাড়া আমার রসনা তৃপ্ত হয়
না। বাসার নৈশ প্রহরী কুকুরকে নিত্য টাটকা গোশত খাওয়াই। দুই বেলা শাহী খাবার খেতে
দেই। শ্যাম্পু ছাড়া ওর গোসল হয় না। অথচ পাশের বস্তিতে খাবার না পেয়ে অবোধ শিশুরা চিৎকার
করে কাঁদে। জঠরজ্বালা সইতে না পেরে কত বনী আদম পথের ধারে উপুড় হয়ে কাতরায়।
ফল-ফ্রুটস খেতে খেতে আমার আদরের দুলালের অরুচি ধরে যায়। অথচ বাড়ির বুয়ার অভুক্ত
সন্তানদের মুখে মৌসুমী ফলটি পর্যন্ত ওঠে না। ক্ষুদে মাছির লঘু পদভার পড়ামাত্র
সুডৌল আপেল, রসে টইটুম্বর
আঙ্গুর ও টসটসে কমলা ওরা প্রায়শই নিক্ষেপ করে ডাস্টবিনে। অথচ এরা পঁচা ও উচ্ছিষ্ট
ফল খাওয়ার জন্য ইতর প্রাণীর সঙ্গে যুদ্ধ করে ডাস্টবিনে। ফ্যাশন বদলের সঙ্গে সঙ্গেই
আমার মেয়ের শীতবস্ত্র আর গ্রীষ্মের পোশাক বদল হয়। অথচ অদূরের গাঁয়েই কি-না
শীতবস্ত্রের অভাবে গরীবের প্রাণ যায়।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, 'তোমরা রোগী দেখতে যাও এবং জানাজায় অংশগ্রহণ করো, কেননা তা তোমাদেরকে পরকালের
কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। একজন অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সান্তনার বাণী
শোনালে, খোঁজ-খবর নিলে, একটু সেবাযত্ন করলে তার
দুশ্চিন্তা লাঘব হয়। সে অন্তরে অনুভব করবে প্রশান্তি।
নিম্নে এর বিভিন্ন দিক নিয়ে
আলোচনা করছি-----
(ক) অসুস্থের সেবা
ও রোগী দেখার ফজিলত:
অসুস্থ ব্যক্তির সেবা-যত্ন করা, তার খোঁজ-খবর নেওয়া ও সান্তনার বাণী শোনানো হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) রোগীর সেবাযত্ন করাকে সর্বোৎকৃষ্ঠ নেক আমল ও ইবাদত
ঘোষণা করেছেন। সাহাবি হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা রোগী দেখতে যাও এবং জানাজায়
অংশগ্রহণ করো, কেননা তা তোমাদেরকে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।–(মুসনাদে আহমদ: ৩/৪৮)
একজন অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সান্তনার বাণী শোনালে, খোঁজ-খবর নিলে, একটু সেবাযত্ন করলে তার দুশ্চিন্তা লাঘব
হয়। সে অন্তরে অনুভব করবে প্রশান্তি। তাই মানবিক বিচারে রোগীর খোঁজ-খবর নেওয়া, সেবাযত্ন করা উচিত।
পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের কেউ
অসুস্থ হলে তার খোঁজ-খবর নেওয়ার ব্যাপারে অবহেলা করা উচিত নয়।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের ৫টি হক রয়েছে। তা হলো- ১.
সালামের জবাব দেওয়া, ২. হাঁচির উত্তর দেওয়া, ৩. দাওয়াত কবুল করা, ৪. অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া ও ৫. জানাজায়
অংশগ্রহণ করা। -সহিহ বোখারি: ১২৪০
হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে যাওনি। বান্দা
বলবে, আপনি তো বিশ্বজাহানের প্রতিপালক- আমি আপনাকে কিভাবে দেখতে
যেতে পারি? আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল। তুমি
তাকে দেখতে গেলে সেখানে আমাকে পেতে...।(সহিহ মুসলিম-২১৬২)
রোগীকে দেখার ফজিলত
রোগী দেখার অসংখ্য ফজিলতের কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আলী (রা.) বর্ণনা
করেন, আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শোনেছি, যে ব্যক্তি সকালবেলা কোনো অসুস্থ
মুসলমানকে দেখতে যায়, সত্তর হাজার ফেরেশতা বিকাল পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করতে থাকে।
আর বিকেলে রোগী দেখতে গেলে সকাল পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা দোয়া করে... ।(সুনানে
তিরমিজি: ৯৬৭)
রোগী দেখতে গিয়ে এ দোয়াটি পাঠ করার কথা হাদিসে বলা হয়েছে-
اَللهُمَّ
اَذْهَبْ الِبَاسَ رَبِّ النَّاسَ وَاَشْفَ اَنْتَ الشَّافِىْ لاَ شَفَاءَ اِلَّا
شَفَاوَكَ شَفَاءَ لاَ
يَغْادَرُ سَقَمَا
“হে আল্লাহ!এই অসুবিধা দুর করিয়া দাও। তোমার সুস্থতা
দান ছাড়া কাহারও সুস্থতা নাই। এমন সুস্থতা দাও যে,
কোন রোগ-বালাই যেন ইহার বহির্ভূত না থাকে। (তিরমিযী,
কিতাবুদ দাওয়াত, বাব ফী দু‘আইল মারীদ-৩৫৬৫ খ-৫ পৃ.৫৬১)
(খ) রোগী দেখার নিয়ম ও আদব সমূহ:
রোগী দেখার নিয়ম ও আদব গুলো হচ্ছে--
১. অজুসহকারে রোগী দেখতে যাওয়া। এ মর্মে
হজরত আনাস (রা.)রেওয়ায়েত করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কোনো অসুস্থ মুসলমান ভাইকে
দেখতে যায়-তাকে জাহান্নাম থেকে ৬০ বছরের পথ দূরে রাখা হবে।-(আবু দাউদ: ৩০৯৭)
২. রোগীর অবস্থা বুঝে শরীরে হাত রেখে রোগের কথা জিজ্ঞাসা করা।
রাসূল (সা.) বলেছেন,
শুশ্রুষার পূর্ণতা
হলো- রোগীর কপালে বা শরীরে হাত রেখে জিজ্ঞেস
করা, কেমন আছেন?
–(-তিরমিজি )
৩. রোগীর সামনে এমন কথা বলা যাতে সে সান্তনা লাভ করে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো রোগীকে দেখতে গেলে বলতেন, এমন সান্তনামূলক কথা বলতেন বলে হাদিসে পাওয়া যায়।
৪. রোগীর কাছে বেশি সময় ক্ষেপন না করা। রাসূল (সা.) বলেন,
রোগী দেখার সময়
হলো- উটের দুধ দোহন পরিমাণ। আরেক বর্ণনায়
এসেছে, রোগী দেখার উত্তম পন্থা হলো- তাড়াতাড়ি ফিরে আসা।
৫. রোগী কিছু খেতে চাইলে এবং তা তার জন্য ক্ষতিকর না হলে খেতে
দেওয়া। রাসূল (সা.) বলেছেন,
রোগী যদি কিছু
খেতে চায়- তবে তাকে খেতে দেওয়া উচিত। -(ইবনে মাজাহ )
৬. রোগীর সামনে উচ্চ আওয়াজে কথা না বলা। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন,
সুন্নত হলো- রোগীর পাশে কম সময় বসা এবং উঁচু আওয়াজে
কথা না বলা।
৭. রোগীর জন্য দোয়া করা। বিভিন্ন দোয়া হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
রাসূল (সা.) বলেন,
কোনো রোগীর কাছে
গিয়ে নিম্নের দোয়াটি সাতবার পাঠ করলে মৃত্যুরোগ ছাড়া সব রোগ থেকে সে সুস্থ হয়ে
ওঠবে- ইনশাআল্লাহ।
দোয়াটি হলো-
اَسْاَلُ اللهُ الْعَظِيْمِ
رَبِّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ اَنْ يَّشَفَيْكَ (ابوداود )
“আসআলুল্লাহাল
আজিম, রাব্বাল আরশিল আজিম, আই ইয়াশফিয়াকা।” -(আবু দাউদ: ৩১০৬)
“আমি তোমার রোগমুক্তির জন্য আরশে আযীমের
মহান প্রভু আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করিতেছি।”
(তিরমিযী-২০৮৩)
৮. রোগীর কাছে নিজের জন্য দোয়া চাওয়া। রাসূল (সা.) বলেন,
‘তোমরা রোগী দেখতে
গেলে তার কাছে নিজের জন্য দোয়া চাও। কেননা তার দোয়া ফেরেশতাদের দোয়ার সমতুল্য। –(ইবনে মাজাহ)
৯.মুমুর্ষ রোগীর হলে তার জন্য দোয়-আইশা (রা.) বলেন, আমি রাসূল (সা.)-কে
মুমুর্ষ অবস্থায় এই দুআ পাঠ করিতে শুনিয়াছি।
اَللهُمَّ اَغْفِرْلِىْ
وَاَرْحَمْنِىْ وَالْحِقْنِىْ بِالرَفَيْقَ اِلَّا عَلَىْ
“হে
আল্লাহ আমাকে ক্ষমা কর, আমার প্রতি দয়া কর এবং আমাকে মহান বন্ধুর সহিত মিলাইয়া
দাও।” (তিরমিযী-৩৪৯৬ খ-৫ পৃ.৫২৫)
(গ) রোগীর সেবা করা ইবাদত:
রোগীর সেবা করা মুমিন মুসলমানের পারস্পরিক
দ্বীনি অধিকার। নবিজীর সুন্নাত। এটি সামাজিক কোনো দায়বদ্ধতা নয়। রোগীর প্রতি
সমবেদনা, সহানুভূতি ও সহযোগিতা করা উত্তম ইবাদত। বরং তা
থেকে বিরত থাকা আল্লাহ থেকে বিরত থাকার শামিল। হাদিসের একাধিক বর্ণনা থেকে তা
প্রমাণিত।
১. নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'কেয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম, তুমি আমাকে সেবা করনি। বান্দা বলবে, হে প্রভু! আপনি তো সব সৃষ্টির প্রতিপালক, আমি কীভাবে আপনার সেবা করতাম?
তখন আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, তুমি তার সেবা করনি, তুমি যদি তার সেবা করতে তাহলে সেখানে আমাকে
পেতে!'
(-মুসলিম)
২. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের ৬টি হক রয়েছে। এর মধ্যে
একটি হলো- কোনো মুসলমান যখন অসুস্থ হয়ে যাবে তখন তার সেবা করা।' (-মুসলিম)
অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ খবর নেয়া বা তাকে দেখতে যাওয়া বা তার
যে কোনো সহযোগিতায় রয়েছে অনেক ফজিলত ও মর্যাদা। হাদিসে আরও এসেছে-
৩. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন কোনো বান্দা তার অসুস্থ মুসলমান ভাইকে দেখতে যায় অথবা
তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য যায় তখন একজন ফেরেশতা উচ্চস্বরে আকাশ থেকে চিৎকার করে
বলেন- তুমি ভালো থাক, তোমার চলাফেরা ভালো ছিল, তুমি বেহেশতে ঠিকানা করে নিয়েছ।' (-তিরমিজি)
মুমিন মুসরমান রোগী দেখতে গিয়ে তার জন্য দোয়া করেন। দোয়া
করাও ইবাদত। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রোগীর জন্য দোয়া করতেন।
অন্যদের দোয়া করার উপদেশ দিয়েছেন। রোগীর সুস্থতায় তিনি পড়তেন।
১. রোগীর সুস্থতায় পড়তেন-
أَسْأَلُ اللهَ الْعَظِيْمَ
رَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ اَن يَشْفِيَكَ
অর্থ: 'আমি মহান আরশের
মালিক আল্লাহর কাছে তোমার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছি।' (-মিশকাত)
২. রোগীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন-
لَا بَاْسَ طُهُوْرَ اِنْ
شَاءَ اللهُ
অর্থ : 'ভয়ের কোনো কারণ নেই, আল্লাহর ইচ্ছায় সুস্থ হয়ে যাবে।'
৩. রোগীর কষ্ট লাগবে পড়তেন-
اَللَّهُمَّ اَذْهِبِ
الْبَاْسَ رَبَّ النَّاسِ اِشْفِهِ وَ اَنْتَ الشَّافِىْ لَا شِفَاءَ اِلَّا
شِفَاءٌ لَّا يُغَادِرُ سُقْمًا
অর্থ: 'হে আল্লাহ! এ
কষ্টকে দূর করে দাও। হে মানুষের প্রভু! তাকে সুস্থতা দান কর। তুমিই সুস্থতা
দানকারী। তুমি ছাড়া আর কারো কাছে সুস্থতার আশা নেই। এমন সুস্থতা দান কর যে, রোগের নাম নিশানাও না থাকে।' (বুখারী ও মুসলিম)
সুতরাং যারা অসুস্থ তাদের মনোবল বাড়াতে বেশি বেশি খোঁজ খবর
নেয়াসহ মানসিকভাবে তাদের সান্ত্বনা দেওয়া সুন্নাত ও ইবাদত। মুমিন মুসলমানের একান্ত
করণীয় রোগীর পাশে থাকা। তাদের সেবা করা। রোগীর সেবা করার মাধ্যমে নিজেদের ইবাদতে
শামিল করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী
রোগীর সেবা করার মতো ইবাদত ও তাদের জন্য দোয়া করার তাওফিক দান করুন।
(ঘ) মানুষের সেবা সম্পর্কে কুরআন হাদীসের নির্দেশ:
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে সমাজকল্যাণমূলক
কাজকে ইবাদত ও সওয়াবের কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,
لَيْسَ
الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ
مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ
وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى
وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ
“পূর্ব
ও পশ্চিমে মুখ ফেরানোটাই সৎকর্ম নয়,
বরং প্রকৃত
সৎকর্মশীল ওই ব্যক্তি, যে বিশ্বাস স্থাপন করে আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতামণ্ডলী, আল্লাহর কিতাব ও নবীদের ওপর এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে
সম্পদ ব্যয় করে নিকটাত্মীয়, এতিম,
মিসকিন, মুসাফির, প্রার্থী ও দাসমুক্তির জন্য।” (সুরা বাকারা-২:১৭৭)
এখানে ইসলামে
সমাজকল্যাণমূলক কাজের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো—
(১) এতিম প্রতিপালন :
সমাজের সবচেয়ে
অসহায় অবহেলিত, নিঃস্ব,
লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও নিরাপত্তাহীনভাবে দিনাতিপাত করে একজন এতিম শিশু। তাই সমাজকল্যাণমূলক
কাজে সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে এক নম্বরে আছে এতিম শিশু।
এতিমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করার বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে আল্লাহ বলেন,
إِنَّ
الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي
بُطُونِهِمْ نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا
“যারা অন্যায়ভাবে এতিমের সম্পদ ভক্ষণ করে, তারা তাদের পেটে শুধু আগুন ভর্তি করে। শিগগির তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (সুরা নিসা-৪:১০)
এতিম প্রতিপালনকারীদের মর্যাদা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
عَنْ
أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:
«كَافِلُ الْيَتِيمِ لَهُ أَوْ لِغَيْرِهِ أَنَا وَهُوَ كَهَاتَيْنِ فِي
الْجَنَّةِ» وَأَشَارَ مَالِكٌ بِالسَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى (مسلم ـ 2983)
“আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে
থাকব। এ কথা বলে তিনি তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল দিয়ে ইশারা করেন এবং এ দুটির মধ্যে কিছুটা
ফাঁকা করেন।” (বুখারী-৫৩০৪;
মুসলিম-২৯৮৩)
(২) বিধবাকে সহায়তা দান :
সমাজের আরেক অসহায়
শ্রেণির নাম হচ্ছে বিধবা। বিশেষ করে দরিদ্র,
নিঃস্ব, অবহেলিত বিধবা নারী।এমন বিধবাকে সাহায্য-সহযোগিতা করাকে রাসুলুল্লাহ (সা.)
ইবাদততুল্য নেকির কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি বিধবা ও মিসকিনের সমস্যা সমাধানের জন্য ছোটাছুটি করে সে যেন
আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে লিপ্ত।
বর্ণনাকারী বলেন, আমার মনে হয় রাসুলুল্লাহ (সা.)এ কথাও
বলেছেন, সে যেন ওই ব্যক্তির মতো যে সারা রাত
সালাত আদায় করে এবং সারা বছর সিয়াম পালন করে। (বুখারী-৫৩৫৩)
(৩) নিঃস্ব ও ক্ষুধার্তকে খাবার দান : মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হলো তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের
লক্ষ্যে নিঃস্ব-দরিদ্র, এতিম ও কারাবন্দিদের খাদ্য দান করে। এ
সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَيُطْعِمُونَ
الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا (8) إِنَّمَا
نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا
“তারা আল্লাহর মহব্বতে অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিদের খাবার দেয়। (তারা বলে) শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের
জন্য আমরা তোমাদের খাদ্য দান করি। আর আমরা তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান ও
কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।”
(সুরা দাহর-৭৬:৮-৯)
অভাবীদের খাদ্য দান না করা জাহান্নামিদের বৈশিষ্ট্য। জান্নাতিরা জাহান্নামিদের
জিজ্ঞেস করবে,
مَا
سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ (42) قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ (43) وَلَمْ
نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِينَ
‘‘কোন বস্তু তোমাদের ‘সাকারে’ (জাহান্নামে)প্রবেশ করাল? তারা বলবে, আমরা মুসল্লিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না।
আমরা অভাবগ্রস্তকে খাবার দিতাম না।’’
(সুরা মুদ্দাসসির-৭৪:৪২-৪৪)
(৪) রোগীর সেবা : রোগীর সেবার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
عَنْ
أَبِي سَعِيدٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:
«عَائِدُ الْمَرِيضِ فِي مَخْرَفَةِ الْجَنَّةِ حَتَّى يَرْجِعَ» (مسلم ــ2568)
“কোনো ব্যক্তি যখন রোগীকে সেবা করে বা
দেখতে যায়, তখন সে জান্নাতের উদ্যানে ফল আহরণ করতে
থাকে। বলা হলো, হে রাসুল (সা.)! ‘খুরফা’ কী?
তিনি বলেন, জান্নাতের ফল।” (মুসলিম-২৫৬৮;
তিরমিজি-৯৬৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
عَنْ
أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:
مَنْ عَادَ مَرِيضًا أَوْ زَارَ أَخًا لَهُ فِي اللهِ نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ
طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الجَنَّةِ مَنْزِلاً.(ترمذى ــ 2008)
যখন কোনো মুসলিম তার কোনো ভাইয়ের রোগ দেখতে যায় অথবা সাক্ষাৎ করতে যায়, তখন আল্লাহ বলেন, তোমার জীবন সুখের হলো, তোমার চলন উত্তম হলো এবং তুমি জান্নাতে একটি ইমারত বানিয়ে নিলে। (তিরমিজি-২০০৮)
(৫) প্রতিবেশীর হক আদায় :
আত্মীয়-স্বজনের পর
প্রতিবেশী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.)বলেছেন,
عَنِ
ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى
اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا زَالَ جِبْرِيلُ يُوصِينِي بِالْجَارِ، حَتَّى
ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ» (بخارى ــ 6015)
জিবরাঈল (আ.) সদা-সর্বদা আমাকে প্রতিবেশীর অধিকার পূর্ণ করার উপদেশ
দিতেন।এমনকি আমার মনে হচ্ছিল যে তিনি প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে
দেবেন।(বুখারী-৫৬৬৯ , শামে-৬০১৫, মুসলিম-২৬২৪,২৬২৫ শামে)
প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে যে ব্যক্তি পেটপুরে খায় সে প্রকৃত মুমিন নয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
عَنِ
ابْنِ عَبَّاسٍ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَيْسَ
الْمُؤْمِنُ بِالَّذِي يَشْبَعُ وَجَارُهُ جَائِعٌ إِلَى جَنْبِهِ» (للبيهقى ــ71)
ওই ব্যক্তি ঈমানদার নয়, যে ব্যক্তি তৃপ্তিসহকারে পেটপুরে খায়, অথচ তার পাশেই তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে। (সহিহ আত-তারগিব-২৫৬১; বায়হাকি-২০১৬০)
(৬) কর্জে হাসান বা উত্তম ঋণ : আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কর্জে হাসানের
গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।চির অভিশপ্ত সুদি কারবারকে প্রতিহত করতে হলে কর্জে
হাসানের বিকল্প নেই। সামাজিক দৈন্য,
পারিবারিক কলহসহ
নানা অসংগতি দূরীকরণে কর্জে হাসান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর মাধ্যমে পরস্পরের
মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ়করণ, দারিদ্র্য বিমোচন, ধনী-দরিদ্রের বিভেদ সহজেই দূর করা সম্ভব। কাউকে ঋণ দেওয়া সদকার সমান সওয়াবের
কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
عَنِ
ابْنِ مَسْعُودٍ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «مَا
مِنْ مُسْلِمٍ يُقْرِضُ مُسْلِمًا قَرْضًا مَرَّتَيْنِ إِلَّا كَانَ كَصَدَقَتِهَا
مَرَّةً» ابن ماجه ــ 2430)
যদি কোনো মুসলিম ব্যক্তি তার অন্য কোনো মুসলিম ভাইকে দুইবার ঋণ দান করে তাহলে
তার আমলনামায় এ অর্থ একবার সদকা করার মতো হবে। (ইবনু মাজাহ-২৪৩০)
(৭) ত্রাণ বিতরণ :
ধনী-গরিব-নির্বিশেষে
মানুষ দুর্যোগে নিপতিত হয়ে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে নিঃস্ব হতে পারে। যেমন—ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন,
বন্যা, নদীভাঙনসহ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা যেকোনো সংকটময় অবস্থায় অসহায় মানুষের
সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য আহবান জানিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
عَنْ سَالِمٍ، عَنْ
أَبِيهِ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ:
«الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يُسْلِمُهُ، مَنْ كَانَ فِي
حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِي حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً،
فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ بِهَا كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ
سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ» (مسلم ــ 2580)
যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দুনিয়ার বিপদসমূহের কোনো একটি বিপদ দূর করে দেবে, আল্লাহ তার আখিরাতের বিপদসমূহের মধ্য থেকে একটি (কঠিন) বিপদ দূর করে দেবেন।
(বুখারী-২৪৪২;
মুসলিম-২৫৮০)
(৮) শরণার্থীদের আশ্রয় দান :
মুহাজিরদের
আশ্রয়দানকারী আনসারদের প্রশংসায় মহান আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا
الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا
يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى
أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ
فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
‘আর যারা মুহাজিরদের আগমনের আগে এ নগরীতে
বসবাস করত এবং ঈমান এনেছিল। যারা মুহাজিরদের ভালোবাসে এবং তাদের (ফাই থেকে) যা
দেওয়া হয়েছে, তাতে তারা নিজেদের মনে কোনোরূপ আকাঙ্ক্ষা
পোষণ করে না। আর তারা নিজেদের ওপর তাদের অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তাদের আছে অভাব। আসলে যারা হৃদয়ের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম।’ (সুরা হাশর-৫৯:৯)
তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত সমাজকল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করে মহান আল্লাহর
সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং জান্নাত লাভের পথ সুগম করা। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক
দান করুন।
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে সমাজকল্যাণমূলক কাজকে ইবাদত ও
সওয়াবের কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,
لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ
تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ
آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ
وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى
وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ
الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا
وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ
الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ
‘পূর্ব ও পশ্চিমে মুখ ফেরানোটাই সৎকর্ম নয়, বরং প্রকৃত সৎকর্মশীল ওই ব্যক্তি,
যে বিশ্বাস স্থাপন
করে আল্লাহ, পরকাল,
ফেরেশতামণ্ডলী, আল্লাহর কিতাব ও নবীদের ওপর এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে
সম্পদ ব্যয় করে নিকটাত্মীয়, এতিম,
মিসকিন, মুসাফির, প্রার্থী ও দাসমুক্তির জন্য।’ (সুরা বাকারা-২:১৭৭)
এখানে ইসলামে সমাজকল্যাণমূলক কাজের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো—
(৯) এতিম প্রতিপালন :
সমাজের সবচেয়ে
অসহায় অবহেলিত, নিঃস্ব,
লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও নিরাপত্তাহীনভাবে দিনাতিপাত করে একজন এতিম শিশু। তাই সমাজকল্যাণমূলক
কাজে সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে এক নম্বরে আছে এতিম শিশু।
এতিমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করার বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ
يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ
نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا
‘যারা অন্যায়ভাবে এতিমের সম্পদ ভক্ষণ করে, তারা তাদের পেটে শুধু আগুন ভর্তি করে। শিগগির তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সুরা নিসা-৪:১০)
এতিম প্রতিপালনকারীদের মর্যাদা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ،
قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «كَافِلُ الْيَتِيمِ
لَهُ أَوْ لِغَيْرِهِ أَنَا وَهُوَ كَهَاتَيْنِ فِي الْجَنَّةِ» وَأَشَارَ مَالِكٌ
بِالسَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى(مسلم ــ 2983)
আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব। এ কথা বলে তিনি তর্জনী ও
মধ্যমা আঙুল দিয়ে ইশারা করেন এবং এ দুটির মধ্যে কিছুটা ফাঁকা করেন। (বুখারী-৫৩০৪; মুসলিম-২৯৮৩)
(১০) বিধবাকে সহায়তা দান :
সমাজের আরেক অসহায়
শ্রেণির নাম হচ্ছে বিধবা। বিশেষ করে দরিদ্র,
নিঃস্ব, অবহেলিত বিধবা নারী। এমন বিধবাকে সাহায্য-সহযোগিতা করাকে রাসুলুল্লাহ (সা.)
ইবাদততুল্য নেকির কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি বিধবা ও মিসকিনের সমস্যা সমাধানের জন্য ছোটাছুটি করে সে যেন
আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে লিপ্ত।
বর্ণনাকারী বলেন, আমার মনে হয় রাসুলুল্লাহ (সা.)এ কথাও
বলেছেন, সে যেন ওই ব্যক্তির মতো যে সারা রাত
সালাত আদায় করে এবং সারা বছর সিয়াম পালন করে।(বুখারী-৫৩৫৩)
(১১) নিঃস্ব ও ক্ষুধার্তকে খাবার দান : মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হলো তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের
লক্ষ্যে নিঃস্ব-দরিদ্র, এতিম ও কারাবন্দিদের খাদ্য দান করে। এ
সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَيُطْعِمُونَ
الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا (8) إِنَّمَا
نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا
‘তারা আল্লাহর মহব্বতে অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিদের খাবার দেয়। (তারা বলে) শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের
জন্য আমরা তোমাদের খাদ্য দান করি। আর আমরা তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান ও
কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’ (সুরা দাহর-৭৬:৮-৯)
অভাবীদের খাদ্য দান না করা জাহান্নামিদের বৈশিষ্ট্য। জান্নাতিরা জাহান্নামিদের
জিজ্ঞেস করবে,
مَا سَلَكَكُمْ فِي
سَقَرَ (42) قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ (43) وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ
الْمِسْكِينَ
‘‘কোন বস্তু তোমাদের ‘সাকারে’ (জাহান্নামে) প্রবেশ করাল? তারা বলবে, আমরা মুসল্লিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না।
আমরা অভাবগ্রস্তকে খাবার দিতাম না।’’
(সুরা মুদ্দাসসির-৭৪:৪২-৪৪)
(ঙ) দুঃস্থ মানবতার সেবায় আমাদের
করণীয়:
প্রাণঘাতী বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে বিপর্যস্ত
মানবতা। অধিকাংশ মানুষই অসহায় দারিদ্রপীড়িত। করোনার কারণে এ অসহায়ত্ব বেড়ে গেছে
অনেকগুণ। কর্ম বন্ধ হওয়ায় সাধারণ মানুষের অভাবও বেড়ে গেছে। অভাবের তাড়নায় চিন্তিত
অস্থির মানুষ স্বাভাবিক কাজ তথা জীবন-যাপনে গতি হারিয়ে ফেলেছে। মানবতার উপকারে আসে
এমন চিন্তাভাবনাও লোপ পেয়েছে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনায় রোগীদের জন্য অথবা দুঃস্থ মানবতার সেবায় মানুষের রয়েছে অনেক
করণীয়।
(১)রোগীর সেবাদান: হাদিসে পাকে এসেছে,
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ঈমানের ৭৭টি শাখা রয়েছে। তন্মধ্যে একটি
হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো। এক কথায় যাকে বলা হয় মানবসেবা। হাদিসের
আলোকে বুঝা যায়, মানব সেবাও ইসলামের অন্যতম একটি শাখা।
মানব সেবায় যারা জড়িত তাদের সবার মাঝে এ কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী হিসেবে যে
শক্তি কাজ করে, সেটা হচ্ছে মানুষের মানবতাবোধ। যার মাঝে মানবতাবোধ আছে সেই
মানবসেবার একাজে এগিয়ে আসে।প্রাণঘাতী মহামারি করোনায় এ মানবতাবোধের প্রয়োজন সবচেয়ে
বেশি।
(২)ক্ষুধার্থকে খাদ্য দান:
আমাদের সমাজে যে সমস্ত প্রতিবেশি যদি পেটে ক্ষুধা নিয়ে রাত যাপন করে, কেউ যদি কোনো পথশিশুকে ক্ষুধার তড়নায়
কাতরাতে দেখে আর সে যদি ক্ষুধার্ত প্রতিবেশি কিংবা ক্ষুধার্ত পথশিশুর পাশে এসে না
দাঁড়ায়, তাহলে বুঝতে হবে তার মাঝে মানবতার লেশমাত্রও নেই।
যার মাঝে মানবতাবোধ আছে সে অবশ্যই অসহায় দুঃস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে। তার
সামর্থ অনুযায়ী এগিয়ে আসবে সহযোগিতা করবে। আর এটাইতো মানবতার সেবা। এটা মহান
আল্লাহ তাআলার গুণসমূহের মধ্যে অন্যতম গুণ।
(৩)অভাবমুক্ত করা:
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা সর্বোত্তম উপমা দিয়ে মানুষের স্মরণে রাখার মতো
নসিহত ঘোষণা করেছেন-
أَلَمْ يَجِدْكَ
يَتِيمًا فَآوَى - وَوَجَدَكَ ضَالًّا فَهَدَى - وَوَجَدَكَ عَائِلًا فَأَغْنَى -
فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ - وَأَمَّا السَّائِلَ فَلَا تَنْهَرْ -
وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ
তিনি কি আপনাকে (আল্লাহ তাআলা প্রিয় নবি (সা.)-কে) ইয়াতিম রূপে পাননি? অতপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি আপনাকে
পেয়েছেন পথহারা, অতপর পথপ্রদর্শন করেছেন। তিনি আপনাকে পেয়েছেন নিঃস্ব, অতপর অভাবমুক্ত করেছেন।সুতরাং আপনি
ইয়াতিমের প্রতি কঠোর হবেন না। সওয়ালকারীকে ধমক দেবেন না। এবং আপনার পালনকর্তার
নেয়ামতের কথা প্রকাশ করুন।' (সুরা দোহা-৭৬:৬-১১)
এ আয়াতগুলোতে উঠে এসেছে মানবতার সেবার প্রতি উদ্বুদ্ধকারী নসিহতগুলো। যেভাবে
আল্লাহ তাআলা বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার অসহায়ত্বের সময়
আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এবং মানুষের অসহায়ত্বের সময় করণীয়
কী হবে তা বর্ণনাও করেছেন।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা দুঃস্থ মানবতার সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে নসিহত
পেশ করে বলেন-
وَيُطْعِمُونَ
الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا - إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ
لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنكُمْ جَزَاء وَلَا شُكُورًا
“তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে। তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা
তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।”
(সুরা দাহর-৭৬:৮-৯)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা অসহায় ইয়াতিম মিসকিন এবং বন্দীদের খাবার দান করাকে
মুমিনের অন্যতম গুণ বা বৈশিষ্ট্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। অসহায়দের পাশে না
দাঁড়ানো, তাদের খোঁজ-খবর না রাখা, তাদের বিপদে এগিয়ে না আসা; এগুলো কোনো মুমিনের বৈশিষ্ট্য হতে পারে
না। বরং মুমিনগণ দুঃস্থ মানবতার সেবায় সদা তৎপর। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের
উদ্দেশ্যে বলেন-
وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ
اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ - وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ
“মুমিন তারাই যারা অসাড় কাজ-কর্ম বা কথা-বার্তা থেকে বিরত থাকে এবং যারা জাকাত
প্রদানে সক্রিয় হয়।” (সুরা মুমিনুন-২৩:৩-৪)
এ আয়াতের সমর্থনে অন্য আয়াত দ্বারা দুঃস্থ মানবতার সেবায় সহযোগিতার খাত
বিস্তারিত বর্ণনা করেন। তাতে ওঠে এসেছে কারা পাবে এ সহযোগিতা। আর কারা দুঃস্থ এবং
অসহায়, যাদের সহযোগিতা করা আবশ্যক। দুঃস্থদের সহযোগিতায় বিধান জারি
করে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ
لِلْفُقَرَاء وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ
قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللّهِ وَابْنِ
السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِّنَ اللّهِ وَاللّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
“জাকাত হল কেবল ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক
এবং তা দাস-মুক্তিতে ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্য এবং
মুসাফিরদের জন্য, এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” (সুরা তাওবা-৯:৬০)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা প্রথমেই ফকির ও মিসকিনের কথা উল্লেখ করেছেন। জাকাতের
আটটি খাতের প্রথমেই রয়েছে ফকির। ফকির হলো সেই ব্যক্তি যারা ইয়াতিম শিশু, বিধবা নারী, উপার্জনহীন বেকার এবং এমন সব লোক যারা
সাময়িক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।
বর্তমান মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে যারা কাজ-কর্মহীন হয়ে বেকার
জীবন-যাপন করছে, জীবন-যাপনে নেই কোনো সহায় সম্বল তারাও দুঃস্থ ও অসহায়।
তাদের সহযোগিতার জন্যই কুরআনের আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের জন্য বিধান জারি
করেছেন। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ (সা.)প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে দারিদ্র থেকে
আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করতেন-
উচ্চারণ: “আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল কুফরি ওয়াল ফিকরি।”
অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার কাছে কুফর এবং দারিদ্র থেকে আশ্রয়
প্রার্থনা করছি।
মিসকিনের কথা বলতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী
অর্থ-সম্পদ পায় না, যাকে সাহায্য করার জন্য চিহ্নিত করা যায় না এবং নিজে দাড়িয়ে
কারো কাছে সাহায্যও চায় না ওই ব্যক্তি মিসকিন। অর্থাৎ মিসকিন হলো একজন সম্ভ্রান্ত
ভদ্র গরিব অসহায় মানুষ। সুতরাং দ্বিধাহীনভাবে এ কথা বলা চলে যে, ইসলাম দুঃস্থ মানবতার সেবার অনন্য ও
সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম।
কুরআন-সুন্নাহর আলোকেও এ কথা প্রতিয়মান হয় যে, ইসলাম রোগীর সেবা ও দুঃস্থ মানবতার সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগ
করতে জোর নির্দেশনা দেয়। শুধু তাই নয়, ধনীর ব্যক্তির জন্য গরিব-অসহায় দুঃস্থ
ব্যক্তিদের সহযোগিতা করা কিংবা জাকাত দেয়াকে আবশ্যক করে দিয়েছে ইসলাম।
(৪)ঈমানের দাবী পূরণ:
করোনার মত মহামারি এ দুঃসময়ে সমাজের বিত্তবানদের জন্য দুঃস্থ মানবতার সেবায়
এগিয়ে আসা একান্ত আবশ্যক। নিজ প্রতিবেশি থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে সমাজের
সর্বস্তরের দুঃস্থ মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া ঈমানের একান্ত দাবি।
রাসুলুল্লাহ(সা.)জীবনের শুরুতে নবুয়ত লাভের আগে যৌবনে
দুঃস্থ ও অসহায় মানবতার সেবায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পৃথিবীর ইতহাসের শ্রেষ্ঠ সংগঠন “হিলফুল
ফুজুল”। হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে
বুঝা যায়, প্রিয় নবি (সা.)দুঃস্থ ও অসহায় রোগীর সেবা কিংবা অভাবি মানুষের প্রতি কতটা ব্যথিত ও উদার ছিলেন
তা বিশ্বনবির দিকে তাকালেই এ প্রমাণ পাওয়া যায়।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ(সা.) ইরশাদ করেছেন, “ওই ব্যক্তি পরিপূর্ণ মুমিন নয়, যে তৃপ্তি সহকারে আহার করে আর তার
প্রতিবেশি ক্ষুধার্ত ও অনাহারে অভূক্ত থাকে।”
পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলামই মানবতার এক জীবন্ত ধর্ম, যে ইসলামের অনুসারীরা যুগে যুগে দুঃস্থ
মানবতার সেবায় কৃতিত্ব ও গৌরবের স্বাক্ষর রেখেছে। তাই প্রাণঘাতী মহামারি
করোনাভাইরাসের এ বৈশ্বিক সংকটের সময় কুরআন-সুন্নাহর আমল নিজেদের মধ্যে বাস্তবায়ন
করে দুঃস্থ ও অসহায়দের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা ঈমানদার মুসলমানদের একান্ত করণীয় কাজ।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে করোনার এই প্রাদুর্ভাবের সময় নিজ নিজ উদ্যোগে
দুঃস্থ ও অসহায় রোগীর সেবা মানুষকে সহযোগিতা করে সমাজে অবদান রাখার
তাওফিক দান করুন। কুরআন-সুন্নাহর উপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন।
(চ)রোগীর সেবায়
আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ:
বিভিন্ন কারণে মানুষ অসুস্থ হতেই পারে বা রোগী হতেই পারে। আমাদের আত্মীয়স্বজন এবং পাড়াপ্রতিবেশী অসুস্থ হলে তাদের
জন্য আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া, তার সেবা শুশ্রুষা করা এবং তার জন্য
উপযুক্ত খাদ্য সামগ্রী নিয়ে যাওয়া ও তার খোঁজ খবর নেয়া ইসলামি শিক্ষার
অন্তর্ভুক্ত।
হজরত আলী (রা.)বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘‘যে ব্যক্তি সকালে কোনো মুসলমান রোগীকে
দেখতে যায়, সত্তর হাজার ফিরিশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য নেক দোয়া
করতে থাকে। যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় কোনো মুসলমান রোগীকে দেখতে যায়, পরদিন সকাল পর্যন্ত নেক দোয়া করতে থাকেন।
আর তাকে জান্নাতের একটি বাগান দান করা হয়।’’ (তিরমিজি শরিফ)
রোগীর সেবা-যত্ন করাকে আল্লাহ ও তার রাসুল অনেক পছন্দ করতেন। এমনকি অসুস্থ ব্যক্তির
সেবা-যত্নকে স্বয়ং আল্লাহতায়ালার সেবা-যত্নের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সুবহান
আল্লাহ। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ(সা.) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন মানুষকে ডেকে
বলবেন-হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, তখন তুমি আমাকে দেখতে (সেবা-যত্ন করতে)
আসনি।
মানুষ বলবে- হে প্রভু! আপনি রাব্বুল আলামিন, আমি কিভাবে আপনার সেবা করব? আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে পারনি যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল; কিন্তু তখন তুমি তাকে দেখতে যাওনি।
তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে (অসুস্থ ব্যক্তিকে) দেখতে যেতে (সেবা-যত্ন
করতে) তাহলে সেখানে আমার দেখা পেতে? (-মুসলিম ও মিশকাত)
(১) রোগীর সেবা-যত্ন করা:
রোগীর সেবা-যত্ন করার মাধ্যমে আমরা সহজেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারি।
আমরা যখন কোন রোগীকে দেখতে যাব তখন তার পুণ্যকর্মগুলো স্মরণ করে কথা বলতে পারি।
কেননা হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ (সা.)বলেন, “যখন তুমি কোনো রোগীর কাছে যাবে কিংবা
মরণোন্মুখ ব্যক্তির কাছে যাবে, তখন তার সঙ্গে মঙ্গলজনক কথাবার্তা বলো। কেননা তুমি যা বলো
ফিরিশতাগণ তার ওপর আমিন আমিন বলে।” (-মুসলিম ও মিশকাত)
(২) রোগী দেখতে যাওয়া:
রোগী দেখতে যাওয়া ও তার সেবার করায় অনেক পুণ্য নিহিত এমনকি আকাশ থেকে ফেরেশতাও
তার জন্য দোয়া করতে থাকেন। যেভাবে হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে
যায়, তখন আকাশ থেকে এক ফিরিশতা তাকে লক্ষ্য করে বলতে থাকে, মোবারক হও তুমি এবং মোবারক হোক তোমার এই পথ
চলা এবং তুমি জান্নাতে একটি স্থান করে নিলে।” (-ইবনে মাজাহ)
হজরত ইবনে আব্বাস(রা.)থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ(সা.)একজন বেদুঈনকে দেখতে গেলেন। আর তার নিয়ম
এই ছিল যে, যখন তিনি কোনো রোগীকে দেখতে যেতেন তখন বলতেন- ‘লা-বা’সা তুহু-রুন ইনশাআল্লাহ।’
অর্থ:‘ভয় নেই, আল্লাহর মেহেরবানীতে আরোগ্য লাভ করবে, ইনশাআল্লাহ।’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত)
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমাদের মধ্যে কেউ যখন অসুস্থ হতো তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তার ডান হাত রোগীর শরীরে বুলাতেন এবং
বলতেন-
‘আজহাবিল বা’সা রব্বান না-সি, ওয়াশফি আনতাশ শা-ফি-, লা শিফাআ’ ইল্লা শিফা উকা শিফা-আ’ লা ইউগাদিরু সুক্বমা।
অর্থ: ‘হে মানুষের প্রতিপালক! এ রোগ দূর কর এবং আরোগ্য দান কর, তুমিই আরোগ্য দানকারী। তোমার আরোগ্য
ব্যতিত কোনো আরোগ্য নেই। এমন আরোগ্য, যা বাকী রাখে না কোনো রোগ।’ (বুখারী, মিশকাত)
আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে সুস্থ রাখুন আর যারা অসুস্থ আছেন তাদেরকে আরোগ্য
দান করুন, আমিন।
শেষকথা:
পরিশেষে বলতে চাই যে, আমরা রোগীর সেবা করে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ
অর্জন করতে চাই। আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ সকলে মানুষের সেবা করা। একজন রোগী যখন
অসহয় হয় তখন তার কাসে গিয়ে কথাবলা কিংবা সেবা করা যে কত মহত কাজ তা যদি সকলে জানতো
তবে প্রতি দিনই রোগীর সেবা জন্য আগীয়ে আসতো। আমি সকলের উদ্দেশে বলতে চাই আপনারা নিজেদের কর্মকাণ্ড শুধু
মসজিদ-মাদরাসা স্থাপন, কুরআন শিক্ষা ইত্যাদির মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে এতিমদের
পুনর্বাসন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বিধবাদের সহায়তা প্রদান, যৌতুক প্রতিরোধ, মাদকদ্রব্য নির্মূল, বৃক্ষরোপন, স্যানিটেশন প্রকল্প, ইসলামভিত্তিক ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প, বেকারদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি সেবাকর্মের
মাধ্যমে মানুষের আরও কাছে ঘেঁষতে চেষ্টা করুন। আর্ত-মানবতার সেবায় ইসলামের প্রকৃত
চিত্র তুলে ধরুন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই পার্থিব লালসা ও
ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসের রোগ থেকে নিজেদের দূরে থাকতে হবে।
সুতরাং জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে ব্যাপক সেবাকর্মের
মাধ্যমে প্রমাণ করে দিন ইসলাম শুধু
মুসলমানের জন্যই আসে নি বরং পৃথিবীর সব মানুষের জন্যই এসেছে। এছাড়াও ভুল বোঝাবুঝি
ও অপপ্রচার রোধে নিজেদের সেবার ক্ষেত্র, আয়ের উৎস ইত্যাদির বিবরণ সম্বলিত তথ্য
সরকার ও জনসমক্ষে তুলে ধরে আর্থিক স্বচ্ছতার বিষয়টিও নিশ্চিত করুন। আল্লাহ আমাদের রোগীর সেবা আগিয়ে আসার তাওফিক দান করুন।
আমিন।
No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com