কুরবানীর গোশতের সামাজিক বণ্টন-প্রসঙ্গ
এম
এ রাজ্জাক হাওলাদার
কুরবানীর গোশত কুরবানিদাতার ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিলি-বণ্টন করা
ঐতিহ্যবাহী রেওয়াজ। ইসলামের শুরু থেকেই এভাবে চলে আসছে। সামাজিকভাবে সমাজপতিদের
নেতৃত্বে কুরবানীর গোশত বণ্টনের কোনো দৃষ্টান্ত অনুসরণীয় প্রথম তিন যুগে পাওয়া যায়
না। তার পরও নতুন চালু হওয়া এ সামাজিক বণ্টন প্রথা বেশদ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে।
প্রচলিত সামাজিক বণ্টনের ধরণ, স্থানভেদে সামান্য ভিন্নতার সঙ্গে অনেকটাই
এমন- প্রত্যেক কুরবানিদাতা তার কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ
মসজিদে দিয়ে আসেন। মসজিদ কমিটির নেতৃত্বে সবার জমাকৃত গোশত সমাজের সবার মাঝে সমান
করে বণ্টন করা হয়।
আমরা দেখতে পাই যে, কুরবানীর দিন দুপুরের পর থেকে একটা সাধারণ
দৃশ্য সকলেরই চোখে পড়ে। কুরবানীদাতার বাড়ির দরজায় একদল মানুষের ভিড়। তাদের কেউ একা
এবং কেউ পরিবারসহ। কেউ পেশাদার ভিক্ষুক এবং কেউ গরীব কর্মজীবি, যার নিজের
কুরবানী দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আজ তারা সবাই এক কাতারে। কুরবানীর গোশত সংগ্রহের
জন্য তারা দলে দলে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কুরবানীদাতা নিজে বা
তার পক্ষ থেকে কোনও লোক তাদের হাতে হাতে এক-দুই টুকরা করে গোশত বিতরণ করছে। হাতে
গোশত বিতরণ করছে আর মুখে কাউকে ধমকাচ্ছে, কাউকে বকছে, কাউকে তাড়া করছে এবং কারও উদ্দেশ্যে বিশেষ
কোনও মন্তব্য করছে।
সুতরাং এ সমস্ত থেকে
সম্মিলিত বন্টন পদ্ধতি আমাদের জন্য সহজ করে বটে কিন্তু সামাজিক ভাবে বন্টন পদ্ধতির একটাই মাত্র সুবিধা, তা হলো- কুরবানিদাতার বাড়িতে ভিক্ষুকদের ভিড় থাকে না
এবং কুরবানিদাতাকে গোশতের ব্যাগ নিয়ে বাড়ি বাড়ি
যেতে হয় না। এ সুবিধার কারণেই মূলত কুরবানিদাতাদের অনেকেই এ পদ্ধতিকে পছন্দ করে
থাকেন। কিন্তু এ পদ্ধতির বেশ কিছু শরয়ি সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর নিয়ে আমি আলোচনা করছি এর
মধ্যে অন্যতম কারণ গুলো হচ্ছে-
১. ইসলামের প্রথম তিন খলিফার যুগের অনুসৃত পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে।
২. কুরবানি একটি ব্যক্তিগত ইবাদত, দলবদ্ধ ইবাদত নয়। কিন্তু প্রচলিত গোশত বণ্টন
পদ্ধতির জেরে কুরবানি দলবদ্ধ ইবাদতের রূপ পরিগ্রহ করছে।
৩. কুরবানীর গোশত আদৌ বিতরণ করা হবে কি-না, বিতরণ করা হলে কতটুকু অংশ বিতরণ করা হবে তা
সম্পূর্ণ কুরবানিদাতার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। শরিয়ত
তাকে কোনো কিছুতেই বাধ্য করেনি। কিন্তু প্রচলিত সামাজিক বণ্টন পদ্ধতিতে সমাজপতিরা
কুরবানিদাতার এ ঐচ্ছিক অধিকার হরণ করে। গোশতের
নির্ধারিত একটি অংশ সামাজের জন্য দিতে তাকে বাধ্য করা হয়। কোথাও কোথাও তো গোশত না
দিলে সমাজচ্যুত করার হুমকিও দেওয়া হয়। আবার কোথাও জোরাল কোনো হুমকি না থাকলে
সমাজের লোকদের বাঁকাদৃষ্টি ও তীর্যক মন্তব্যের ভয়ে সমাজপতিদের নির্ধারিত অংশ দিতে
কুরবানিদাতা বাধ্যবাধকতা অনুভব করেন। যা
আল্লাহতায়ালা বাধ্য করেননি, আল্লাহ যা
ঐচ্ছিক রেখেছেন সমাজ ও সমাজপতিরা তা বাধ্য করার অধিকার কিভাবে পায়?
৪. মসজিদের মাসিক চাঁদা, মুষ্ঠির চাল না দিলে কুরবানীর গোশতের ভাগ না
দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। অপরদিকে যারা মসজিদের মাসিক চাঁদা, মুষ্ঠির চাল ইত্যাদি দিয়ে আসছেন তারা এ সূত্র
ধরে গোশতের ভাগকে নিজের প্রাপ্য অধিকার জ্ঞান করে।
দ্বি-পাক্ষিক বস্তু আদান-প্রদানে যখন একটি
অপরটির ওপর নির্ভরশীল থাকে- তখন স্পষ্টই তা বেচাকেনা। অতএব, প্রচলিত সামাজিক বণ্টনে সারা বছরের মাসিক চাঁদা
ও মুষ্ঠির চালের বিনিময়ে কুরবানির গোশত বিক্রি করা হচ্ছে।
অথচ এ
মাসয়ালা সবাই জানে যে, কুরবানীর
গোশত বিক্রি করা নাজায়েয। না জেনে বিক্রি করে থাকলে তার মূল্য অথবা সেই পরিমাণ
গোশত কুরবানীর বাইরে থেকে গরিবদের মাঝে দান করা ওয়াজিব।
৫. অন্য সমাজের মসজিদে নামাজ পড়লে কুরবানীর
গোশতের ভাগ না দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয় কোথাও কোথাও।
অথচ কুরবানীর গোশত প্রদানে ইসলাম কোনো শর্ত
রাখেনি। এমনকি অমুসলিমদেরও কুরবানীর গোশত দেওয়ার অনুমতি ইসলামে আছে। ইসলাম যা
নিঃশর্তে প্রদান করতে বলেছে, তা প্রদানের জন্য নিজেদের মসজিদে নামাজ পড়ার শর্ত দেওয়ার অধিকার সমাজপতিরা
কোথায় পায়?
৬. প্রচলিত বণ্টন পদ্ধতিতে সমাজের সবাইকে
গোশতের ভাগ দেওয়া হয়। যারা কুরবানি করেনি তাদেরকে দেওয়া হয়, আবার যারা কুরবানি করেছেন তাদেরও দেওয়া হয়। ফল দাঁড়াচ্ছে, সমাজের জন্য গোশত দিয়ে দেওয়ার পর তার কিছু
অংশ কুরবানি দাতারা ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
সতুরাং কোন ব্যক্তিকে দেওয়ার পর ফিরিয়ে নেওয়া একটি ঘৃণিত কাজ, নিকৃষ্ট স্বভাব। হাদিসে এর উপমা দেওয়া হয়েছে
নিজের বমি নিজেই খাওয়া।
এ
প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে,
عَنْ اِبْنِ
عَبَّاسٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَحِلُّ لِرَجُلٍ أَنْ يُعْطِي عَطِيَّةً، ثُمَّ يَرْجِعُ فِيهَا،
فَمَثَلُهُ مَثَلُ الْكَلْبِ أَكَلَ حَتَّى إِذَا شَبِعَ قَاءَ، ثُمَّ عَادَ فِي قَيْئِهِ»
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু
আনহু থেকে বর্ণিত, মহানবী হজরত
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “দেওয়ার পর ফিরিয়ে নেওয়া কোনো মানুষের জন্য
হালাল নয়। এর দৃষ্টান্ত হলো- কুকুরের মতো। কুকুরের যখন খেতে খেতে তৃপ্তি মিটে যায়, তখন সে বমি করে। কিছুক্ষণ পরে নিজেই আবার
নিজের সেই বমি চেটে চেটে খায়।” (সূত্র: মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা: ২১৭১০ শামেলা)
৭. যদিও কুরবানীর গোশত বিলি করা ওয়াজিব না, সবটুকু গোশত নিজের পরিবারের লোকদের খাওয়ানো
জায়েয আছে কিন্তু মুস্তাহাব হলো তিন ভাগের দুই ভাগ বিলি করা। এক ভাগ গরিবদের মাঝে
বিলি করা, আরেক ভাগ
আত্মীয় স্বজন, পড়শি ও বন্ধুদের মাঝে বিলি করা। মহান আল্লাহ তায়ালা এ প্রসঙ্গে
বলেছেন,
فَكُلُوْا مِنْهَا وَاَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَ الْمُعْتَرَّ،
كَذٰلِكَ سَخَّرْنٰهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ.
“তখন তার গোশত থেকে নিজেরাও খাও এবং ধৈর্যশীল
অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও এবং তাকেও, যে নিজ অভাব প্রকাশ করে। এভাবেই আমি এসব
পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।” (সূরা হজ্ব
২২ : ১৩৬)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক
হাদীসে ইরশাদ করেছেন-
كُلُوْا وَادّخِرُوْا وَتَصَدّقُوْا.
“তোমরা খাও, জমা করে রাখ এবং দান-খয়রাত কর।” (সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭২; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ৪৪২৬; মুআত্তা
মালিক, হাদীস ২১৩৫)
আমাদের সমাজে প্রচলিত সামাজিক বণ্টনে যারা কুরবানীর গোশত
জমা দেয় তারা কিন্তু গরিবের ভাগটাই এখানে জমা দেয়। যার জন্য বাড়িতে কোনো গরিব, মিসকিন, ভিক্ষুক আসলে তাদের সোজা বলে দেয়, গরিবের ভাগ মসজিদে দিয়ে দিছি। অথচ মসজিদ
কর্তৃপক্ষ ও সমাজপতিরা কুরবানীর গোশতের এ গরিবের ভাগ সমাজের ধনি, গরিব, স্বচ্ছল, অস্বচ্ছল নির্বিশেষে সবাইকে দেয়। এটা চরম
লজ্জাকর একটি কাজ।
৮. সাধারণত প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলে অনেক পাড়া, মহল্লা এমন থাকে যেখানের কেউই কুরবানি দেয় না। মহল্লাবাসী সবাই দরিদ্র, দিনমজুর। কিন্তু পাশের মহল্লায়, গ্রামে অনেকেই কুরবানি দেয়।
আগে এ ধরণের পাড়ার দরিদ্ররা কুরবানীর দিন আশ-পাশের পাড়া-মহল্লার কুরবানিদাতাদের বাড়িতে যেত। সবার থেকে কিছু
কিছু গোশত পেত। যাতে তাদের দু’এক দিন অনায়েসেই চলে যেত। তৃপ্ত করে গোশত খেত।
কিন্তু
সামাজিক বণ্টন প্রথার রেওয়াজ তাদের গোশত খাওয়ার এ সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন তারা
পাশের মহল্লার কুরবানিদাতাদের বাড়িতে গেলে গোশত পায় না। কুরবানিদাতা উত্তর দেয়, গরিবের ভাগ মসজিদে দিছি। তোমরা মসজিদে যাও।
আর মসজিদে গেলে সমাজপতিরা তাদের উত্তর দেয়, খাতায় তোমার নাম নেই। তুমি এ সমাজের না।
তোমাকে আমরা গোশত দিতে পারব না।
দলবদ্ধভাবে
গোশত বিলি করার উদ্যোগ:
বাড়ি থেকে গোশত বিলি করার অসুবিধার কারণে যদি
একান্তই দলবদ্ধভাবে গোশত বিলি করার উদ্যোগ নিতে হয় তবে নিম্নলিখিত শর্তগুলো নিশ্চিত করতে হবে। যথা-
এক. গোশত বিতরণে এ দিকে আদৌ ভ্রুক্ষেপ করা যাবে
না যে, কে মসজিদে
চাঁদা দেয় আর কে দেয় না। মসজিদ বা কোনো প্রতিষ্ঠানের দানের সঙ্গে কুরবানীর গোশতকে
কোনোভাবেই সম্পৃক্ত করা যাবে না।
দুই. সামাজিক সীমানাকে গুরুত্ব দেওয়া যাবে না।
তিন. সামাজিক আয়োজনে গোশত জমা দিতে বা গোশতের
নির্দিষ্ট পরিমাণ জমা দিতে কুরবানিদাতাদের বাধ্য করা যাবে না। এমনকি কোনো
কুরবানিদাতা সমাজে গোশত জমা না দিয়ে নিজে
ব্যক্তিগতভাবে গরিবদের মাঝে বিলি করলে তার সমালোচনা করা যাবে না, তার নিন্দা করা যাবে না, তাকে সমাজচ্যুত করা যাবে না। গোশত জমাদানকে
সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক রাখতে হবে।
চার. গোশতের ভাগ বিতরণের জন্য মুসলমান, নামাজি, পরহেজগার ইত্যাদি কোনো শর্তারোপ করা যাবে না।
পাঁচ. যারা কুরবানি দিয়েছে এবং যারা সমাজে ধনি হিসেবে
খ্যাত তাদেরকে সম্মিলিত গোশতের ভাগ দেওয়া যাবে না।
সমাজের কুরবানিদাতাদের এবং ধনিদের গোশত দিতে হলে
বাড়িতে কুরবানি দাতারা তিনের যে দু’ভাগ গোশত রেখে দিয়েছে তার দ্বিতীয় ভাগ থেকে
নিজ উদ্যোগে দিবে। কেননা, এ দ্বিতীয়
ভাগ আত্মীয়, পড়শি ও
বন্ধুদের জন্য।
ছয়. সামজের বাইরের ভাসমান দরিদ্রদের জন্য এবং
অন্যান্য দরিদ্র সমাজগুলোর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য গোশতের বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
এটা দু’ভাবে হতে পারে। হয়তো কুরবানিদাতারা গোশতের একটা অংশ বাড়িতে রেখে
দিবে। সমাজের বাইরে থেকে আগত ভিক্ষুকদের মাঝে নিজ হাতে দিবে। অথবা হয়তো দলবদ্ধ
গোশত নিজ সমাজের দরিদ্রদের মাঝে বণ্টনের আগেই উল্লেখযোগ্য একটা অংশ আলাদা করে
ফেলবে। যা নিজ সমাজের বাইরের গরিবদের মাঝে ও দূরদূরান্ত থেকে আগত ভিক্ষুকদের মাঝে
বিতরণ করবে।
কুরবানির গোশতের সামাজিক বন্টন জায়েজ নেই:
কুরবানির গোশতের বাধ্যতামূলক
সামাজিক বন্টন জায়েজ নেই। দেখতে সুন্দর ও মানবিক মনে হলেই যায়েজ হয়ে যায় না।
যায়েজের জন্য প্রয়োজন শরঈ দলীল। কুরবানির গোশত তিন ভাগ করা উত্তম ও মুস্তাহাব।
অবশ্য পুরো গোশত যদি নিজে রেখে দেয় তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। প্রয়োজনে বণ্টনে কমবেশি
করাতেও কোনো দোষ নেই (আল-মুগনী ১১/১০৮; মির‘আত ২/৩৬৯; ঐ, ৫/১২০ পৃঃ)।
বর্তমানে বিভিন্ন মহল্লায় প্রচলন আছে, কুরবানির গোশতের এক-তৃতীয়াংশ একস্থানে জমা করে মহল্লায় যারা
কুরবানি করতে পারেনি তাদের
তালিকা করে সুশৃংখলভাবে তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। প্রয়োজনে তাদের বাড়িতে পৌঁছে
দেওয়া হয়। কাজটি দেখতে ভালো হলেও এটি জায়েজ নেই। কেননা এই প্রচলনের ফলে কারও দিতে
মনে না চাইলেও তাকে সমাজের খাতিরে দিতে হয়। না দিলে সামাজিক চাপ ও বদনামের স্বীকার
হতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষ সামাজিক ভাবে মনিটরিং করা হয়, কেহ একতৃতীয়াংশের কম দিলেন কি না।
এধরনের প্রচলন খাইরুল কুরুনে পাওয়া যায় না। রাসূলুল্লাহ (সা.)
ইরশাদ করেছেন,
কোনো মুসলমানে মাল তার
সন্তুষ্টি ছাড়া গ্রহণ করা হালাল নয়। (মুসনাদে আহমদ : ১৫/২৯৩, রদ্দুল মুহতার : ৬/৪২৭, আলমগিরী/হিন্দিয়া : ৫/৩০০, হেদায়াহ : ৪/৪৪৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪)
বাধ্যতামূলক সামাজিক বন্টন ও বাস্তবতা-১
আমার একান্ত পরিচিত একটি গ্রামের আপন ৩ ভাই। তারা ঢাকায়
ইমামতি করেন। ঈদের নামাজ পড়ানো এবং মাদরাসার বিভিন্ন দায়িত্বের কারণে তাদের কেউ
ঈদের দিন গ্রামের বাড়িতে থাকতে পারেন না। তাই ঈদের পরদিন তিন ভাই মিলে বাড়িতে
গিয়ে কুরবানি করেন। তারা সামর্থের সর্বোচ্চ পরিমাণ কুরবানির গোশত
সমাজের গরিবদের মাঝে নিজেদের পক্ষ থেকে বিতরণ করেন। এরপরেও সমাজের পক্ষ থেকে তাদের
বিপক্ষে অপপ্রচার করা হয়েছে যে, "সমাজে
গোস্ত দিতে হবে এই কারণে তারা ঈদের দিন কুরবানি করে
না।"
পরবর্তীতে সাধারণ মানুষ যেন তাদের গোস্ত গ্রহণ না করে এমন
অলিখিত নোটিশ জারি করা হয়। এ বছর তারা মনের কষ্টে ঢাকায় কুরবানি দেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা কি বাধ্যতামূলক নয়? এ বিষয়ে কি বিশ্লেষণ করা হবে?
বাধ্যতামূলক সামাজিক বন্টন ও বাস্তবতা-২
তারা আপন দুই ভাই। একজন কুরবানি দিয়েছেন সাত ভাগের এক ভাগ।এর মধ্যে তিন ভাগের একভাগ
সমাজের লোকজন এসে নিয়ে গেছেন। এরপর দেখা গেল যে ভাই কুরবানি দেন নাই- তিনি সমাজ থেকে যে পরিমাণ গোস্ত পেয়েছেন
তার চেয়ে কুরবানি দাতার গোশতের পরিমাণ কম। অথচ তার পরিবারের সদস্য
সংখ্যা বেশি। আত্মীয় মেহমানের জন্য তার আরো বেশি গোশতের প্রয়োজন।
এমন পরিস্থিতিতে এই লোকের কাছ থেকে সমাজের লোক পাঠিয়ে
বাধ্যতামূলক তিনভাগের এক ভাগ নিয়ে যাওয়াটা কতটুকু স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হতে পারে?
বাধ্যতামূলক সামাজিক বন্টন ও বাস্তবতা-৩
সামাজিকভাবে গোস্ত বন্টন করা হয় এমন একটি গ্রামে সরেজমিনে
নিরীক্ষা করে দেখা গেছে- কুরবানি
দাতাদের প্রত্যেকটি গরুর সাথে সমাজের পক্ষ থেকে এক একজন লোক দায়িত্বে নিয়োজিত
করা হয়,
যেন গোস্ত কম দিল কিনা সেটা
যাচাই করতে পারে এবং একতৃতীয়াংশ গোস্ত নিয়ে যেতে পারে। এছাড়া কোন কারনে কেউ যদি
এক তৃতীয়াংশের কম গোস্ত প্রদান করে তাহলে তা নিয়ে সমালোচনা করা হয় এবং কুরবানি দাতাকে বিভিন্নভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। কাউকে
এমনও বলতে শোনা যায়- তিনি গোস্ত কেন দিয়েছেন? সবটা নিজেই খেয়ে ফেলুক, তার গোস্তের দরকার নাই। গোটা সমাজে এটা নিয়ে আলোচনা
সমালোচনা সৃষ্টি করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে কি বলা যায় ঐচ্ছিক প্রদান করছে। এটা কি
বাধ্যতামূলক সামাজিক বন্টন নয়?
বিকল্প প্রস্তাব আমার-
ছোট পরিসরে এলাকাভিত্তিক বাড়ি, পাড়া অথবা মহল্লা ভাগ করে স্বেচ্ছাসেবী কিছু সংখ্যক
দায়িত্বশীল পূর্ব নির্ধারিত স্থানে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকবেন। যারা
স্বেচ্ছায় গোস্ত প্রদান করতে চান তারা গোস্ত প্রদান করবেন।
কে কম দিল? কে বেশি দিল? এমন কোন বিষয় মনিটরিং করা হবে না। কে দিল কে দিল না? তা নিয়েও কোন ধরনের আলোচনা সমালোচনা করা হবে না।
এরপর
নির্দিষ্ট সময়ে যে পরিমাণ গোস্ত জমা হবে তা নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রকৃত গরিব লোকজনের
বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হবে। কোন প্রভাব প্রতিপত্তি প্রদর্শন করা হবে না। কোন
প্রকারের জবরদস্তি মূলক কর্মসূচি এবং অলিখিত বাধ্যতামূলক নিয়ম কানুন করা হবে না।
এভাবে যদি প্রকৃত গরিবদের মাঝে গোশত বন্টন করা হয় তাহলে শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন অসুবিধা নেই। এ নিয়ম কুরবানি দাতা এবং গোস্ত গ্রহণকারী প্রকৃত গরিবদের জন্য কল্যাণকর হতে পারে।
পরিশেষেকথা, ইসলাম যা ব্যক্তিগত রেখেছে তা ব্যক্তিগত
রাখাই অধিকতর কল্যাণকর। তাকে দলবদ্ধ বা সমাজবদ্ধ রূপ দেওয়া অনুচিত। তাই কুরবানীর
গোশত বিতরণে সামাজিক বণ্টনের দিকে পারতপক্ষে না যাওয়াই শ্রেয়। আর সে দিকে যেতে হলে
উদ্ভুত শরয়ি সমস্যাগুলোর সুষ্ঠু সমাধান করে, সকল শর্ত যথাযথভাবে পালন করে তবেই সামাজিক
বণ্টনের উদ্যোগ নেওয়া। কেননা, সামাজিক বণ্টনের প্রচলিত ধরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com