গীবত বা পরনিন্দা-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
▬▬▬◈◉◈▬▬▬◈◉◈▬▬▬◈◉◈▬▬▬
গীবতের
সংজ্ঞা:
#গীবত(#ﻏﻴﺒﺔ) আরবী শব্দ। আভিধানিক অর্থ-কুৎসা, পরনিন্দা, পরচর্চা, পরোক্ষে নিন্দা ইত্যাদি। কারো অগোচরে তার
পোশাক-পরিচ্ছদ, বংশ, চরিত্র, দেহাকৃতি, কর্ম, দ্বীন, চলাফেরা, ইত্যাদি যে কোনো বিষয়ে কোন দোষ অপরের কাছে
প্রকাশ করা।
ইবনুল
আছীর রহ. বলেছেন:
গীবত হলো কোন মানুষের অগোচরে তার মন্দ বিষয়
উল্লেখ করা, যদিও সে
ত্রুটি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে।
এ
প্রসঙ্গে হাসান বসরী (রহ.) বলেন:
পরচর্চায় তিন ধরণের পাপ হতে পারে। অপরের
মধ্যে যে দোষ বিদ্যমান তা আলোচনা করা গীবত; যে ত্রুটি তার মধ্যে নেই তা আলোচনা করা অপবাদ; আর তার সম্বন্ধে যা কিছু শ্রুত তা আলোচনা করা
মিথ্যা বলার শামিল।
গীবতের পরিচয় সম্পর্কে হাদীসের এক বর্ণনায়
এসেছে,
“মুত্তালিব ইবনু আব্দিল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত
তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ বলেছেন :
ﻋﻦ ﺍﻟﻤﻄﻠﺐ ﺑﻦ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﻗﺎﻝ : ﻗﺎﻝ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ :
ﺍﻟﻐﻴﺒﺔ ﺃﻥ ﺗﺬﻛﺮ ﺍﻟﺮﺟﻞ ﺑﻤﺎ ﻓﻴﻪ ﻣﻦ ﺧﻠﻔﻪ
গিবত হলো কোনো ব্যক্তি সম্বন্ধে তার অগোচরে
এমন কিছু বলা যা তার মধ্যে বিদ্যমান।”
হাদীসের
অপর এক বর্ণনায় এসেছে,
ﻋَﻦْ ﺃَﺑِﻲ ﻫُﺮَﻳْﺮَﺓَ ﺃَﻥَّ ﺭَﺳُﻮﻝَ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠَّﻪُ
ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﻗَﺎﻝَ ﺃَﺗَﺪْﺭُﻭﻥَ ﻣَﺎ ﺍﻟْﻐِﻴﺒَﺔُ ﻗَﺎﻟُﻮﺍ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻭَﺭَﺳُﻮﻟُﻪُ
ﺃَﻋْﻠَﻢُ ﻗَﺎﻝَ ﺫِﻛْﺮُﻙَ ﺃَﺧَﺎﻙَ ﺑِﻤَﺎ ﻳَﻜْﺮَﻩُ ﻗِﻴﻞَ ﺃَﻓَﺮَﺃَﻳْﺖَ ﺇِﻥْ ﻛَﺎﻥَ
ﻓِﻲ ﺃَﺧِﻲ ﻣَﺎ ﺃَﻗُﻮﻝُ ﻗَﺎﻝَ ﺇِﻥْ ﻛَﺎﻥَ ﻓِﻴﻪِ ﻣَﺎ ﺗَﻘُﻮﻝُ ﻓَﻘَﺪْ ﺍﻏْﺘَﺒْﺘَﻪُ
ﻭَﺇِﻥْ ﻟَﻢْ ﻳَﻜُﻦْ ﻓِﻴﻪِ ﻓَﻘَﺪْ ﺑَﻬَﺘَّﻪُ
“আবূ হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন : তোমরা কি জান গীবত কাকে
বলে? সাহাবায়েকিরাম
রা. উত্তর করলেন : আল্লাহ ও তদীয় রাসূলই সম্যক জ্ঞাত। তিনি বললেন : গীবত হলো তোমার
ভাই সম্পর্কে এমন কিছু বলা যা তাকে নাখোশ করবে। জানতে চাওয়া হলো : যদি আমার ভাইয়ের
মধ্যে তা বিদ্যমান থাকে তাহলেও কি? তিনি জবাবে বললেন : তোমার ভাইয়ের মধ্যে যা
কিছু বিদ্যমান তা বললেই গীবত হবে; অন্যথায় তুমি তাকে অপবাদ দিলে।”(মুসলিম; মিশকাত হা/৪৮২৮)
মহানবী
সা. বলেন-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّهُ قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا
الْغِيبَةُ قَالَ ” ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ ” . قِيلَ أَفَرَأَيْتَ
إِنْ كَانَ فِي أَخِي مَا أَقُولُ قَالَ ” إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدِ
اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدْ بَهَتَّهُ ”..
হযরত আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রশ্ন করা হলো, গীবত কী? তিনি বললেন, তোমরা ভাইয়ের ব্যাপারে তোমার এমন কিছু বলা যা
শুনলে সে অসন্তুষ্ট হয়। পুনরায় প্রশ্ন করা হলো, আমি যা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে বর্তমান
থাকে? তিনি বললেন, তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে থাকে তাহলেই
তুমি তার গীবত করলে। আর তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে না থাকে তবে তুমি তাকে
মিথ্যা অপবাদ দিলে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৮৭৪)
গিবত
দূর্গন্ধময় দূষিত বায়ুঃ
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আমরা
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে ছিলাম। তখন দুৰ্গন্ধময় দুষিত বায়ু প্রবাহিত হলে তিনি
বলেনঃ তোমরা জানো, তা কি? এটা হলো মুমিন লোকদের গীবতকারীদের বায়ু।
(আবু দাউদ)
حَدَّثَنَا أَبُو مَعْمَرٍ قَالَ: حَدَّثَنَا عَبْدُ الْوَارِثِ،
عَنْ وَاصِلٍ مَوْلَى أَبِي عُيَيْنَةَ قَالَ: حَدَّثَنِي خَالِدُ بْنُ
عُرْفُطَةَ، عَنْ طَلْحَةَ بْنِ نَافِعٍ، عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ:
كُنَّا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَارْتَفَعَتْ رِيحٌ
خَبِيثَةٌ مُنْتِنَةٌ، فَقَالَ: «أَتَدْرُونَ مَا هَذِهِ؟ هَذِهِ رِيحُ الَّذِينَ
يَغْتَابُونَ الْمُؤْمِنِينَ»
গিবত
সংঘটিত হওয়ার উদাহরণঃ
গিবত সাধারণত মুখ দ্বারাই সংঘটিত হয়ে থাকে।
কারণ গিবত হলো অপরের অগোচরে তার সম্বন্ধে অপছন্দনীয়। তবে মুখ ছাড়া মানব দেহের যে
সকল অঙ্গ ব্যবহার করে অন্যের দোষ-ত্রুটি উল্লেখ করা হয় তাও গিবতের পর্যায়ভূক্ত।
যেমন হাতের ইঙ্গিত ও লেখনি; চোখের ইঙ্গিত; পা দ্বারা অভিনয় করে অন্যকে হেয় করা গিবতের
শামিল। এ ছাড়া কান দ্বারা গিবত শ্রবণ করা বা অন্তরে অন্তরে অপরের দোষক্রুতি চর্চা
করা বা তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা সহ তার মর্যাদাহানিকর সকল চর্চাই মুখের গিবতের
সমপর্যায়ের।
হাদীসে
এসেছে, আয়েশা
(রা.) বলেন :
জনৈকা মহিলা আমাদের কাছে এসেছিল। তার চলে
যাওয়ার পর আমি হাতের ইশারায় তার খর্বতার কথা উল্লেখ করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : তুমি ঐ মহিলার গিবত করলে।
এমনিভাবে খঞ্জ বা টেরা চক্ষু বিশিষ্ট কোন
ব্যক্তির চলন ও চাহনি অনুসরণে কেউ খুড়িয়ে চললে বা টেরা চক্ষে তাকালে উক্ত ব্যক্তির
গিবত করা হয়। তবে ব্যক্তি বিশেষের নামোল্লেখ না করে যদি কেউ সাধারণভাবে বলে যে, খঞ্জ ব্যক্তি এভাবে হাটে, টেরা চক্ষু বিশিষ্ট ব্যক্তি এভাবে তাকায় এবং
তাতে দর্শকগণ বিশেষ কারো চলন ও চাহনি বুঝতে না পারে তাহলে তা গিবত হবে না। অর্থাৎ
আকার-ইঙ্গিতে নিন্দিত ব্যক্তিকে চেনা গেলে তা গিবত হবে; অন্যথায় গিবত হবে না।
লেখনির
মাধ্যমে গিবত :
কলম মানুষের মনের অনুভূতি প্রকাশের একটি
মাধ্যম। তাই মুখের দ্বারা যেমন গিবত সংঘটিত হয় তেমনি লেখনির মাধ্যমেও গিবত হয়ে
থাকে। যেমন শরয়ী উপকার বা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংরক্ষণ ব্যতীত বেহুদা
অন্যের দোষ-ত্রুটি লেখনির মাধ্যমে প্রচার করা গিবতের শামিল। তবে বিশেষ কাউকে
নির্দিষ্ট না করে কোন দল বা গোষ্ঠির গঠনমূলক সমালোচনা করায় কোন দোষ নেই।
বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (স.) কোন জাতি বা গোষ্ঠীর কোন
কাজকে অপছন্দ করলে বলতেন : ঐ লোকগুলোর কি হলো যে তারা এসব কাজ করছে।
অন্তর
দ্বারা গিবত:
অন্তরের গিবত হলো মনে মনে কারো সম্বন্ধে
কু-ধারণা পোষণ করা। পবিত্র কুর’আন ও হাদীসে এ কু-ধারণা থেকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
ﺍﺟْﺘَﻨِﺒُﻮﺍ ﻛَﺜِﻴﺮًﺍ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻈَّﻦِّ ﺇِﻥَّ ﺑَﻌْﺾَ ﺍﻟﻈَّﻦِّ ﺇِﺛْﻢٌ
“তোমরা অধিকাংশ ধারণা থেকে বিরত থাকো। নিশ্চয়ই
কতক ধারণা পাপের কাজ।”[সূরা হুজুরাত
১২]
হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,
ﻋَﻦ ْﺃﺑﻲ ﻫﺮﻳﺮﺓ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﻗﺎﻝ ﻗﺎﻝ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ِّ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠَّﻪُ
ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ : ﺇِﻳَّﺎﻛُﻢْ ﻭَﺍﻟﻈَّﻦَّ ﻓَﺈِﻥَّ ﺍﻟﻈَّﻦَّ ﺃَﻛْﺬَﺏُ ﺍﻟْﺤَﺪِﻳﺚِ
আবূ হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন; রাসূল বলেছেন : তোমরা ধারণা পোষণ থেকে দূরে
থাকো। নিশ্চয়ই ধারণা করা কঠিনতম মিথ্যা।
এছাড়া কখনও এমন হয় যে, গিবতকারী কারো নাম উল্লেখ না করে এভাবে বলে, আজ আমার নিকট যে লোকটি এসেছিল সে এরূপ বা
একজন মানুষের এরকম ত্রুটি রয়েছে আমি তার নাম বলবো না তবে আপনারা বুঝে থাকলে বুঝতে
পারেন। এক্ষেত্রে গিবতকারী এ ধরণের উক্তিকে গিবত বহির্ভূত মনে করে; কিন্তু বাস্তবে তা গিবতের অন্তর্ভূক্ত।
কৌশলগত
গিবত:
এ ধরণের গিবত অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরিপক্ক আলিম
ও দ্বীনদার লোকদের দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তারা মনে করে যে, এতে কোন দোষ নেই বা এটা গিবতের অন্তর্ভূক্ত
নয়; প্রকৃত পক্ষে
তা মারাত্মক ও জঘন্য গিবত। যেমন তাদের সামনে কোন ব্যক্তির উল্লেখ করা হলে বলে :
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমারেদকে রাজা-বাদশাহদের দ্বারস্থ হওয়া
ও তুচ্ছ জিনিসের জন্য নিজেদেরকে বিলিয়ে দেয়ার মতো পরীক্ষায় ফেলেন নাই।
অথবা এভাবে বলে :
আল্লাহ তায়ালার কাছে নির্লজ্জতা বা
লজ্জাহীনতা থেকে পানাহ চাই; আল্লাহ
তায়ালার কাছে দোয়া করি তিনি যেন আমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেন।
এসকল উক্তির দ্বারা দু’ধরণের অপরাধ হয়।
#একটি গিবত,
#অপরটি রিয়া বা লৌকিকতা। অর্থাৎ অপরের ত্রুটি
বর্ণনার পাশাপাশি নিজের প্রশংসা নিহিত থাকে এ ধরণের উক্তির মধ্যে।
আবার কখনো এমন হয় যে, তাদের সামনে কারো গিবত করা হলে তারা বলে: #সুবহানাল্লাহ ! কি আশ্চর্য! লোকটিকে তো আমরা ভাল বলেই জানতাম, তার দ্বারা এসব অপকর্ম সংঘটিত হয়েছে ! আল্লাহ
তা‘আলা আমাদেরকে
রক্ষা করুন। এ সকল উক্তির দ্বারা একদিকে গিবতকারীকে সত্যায়ন করা হয় এবং তাকে উৎসাহ
দেয়া হয়। অপরদিকে যারা এখনো নিন্দিত ব্যক্তির অপকর্ম জানতে পারেনি তাদের দৃষ্টি
আকর্ষণ করা হয় এবং তাদেরকে তা অবগত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়।
#এমনিভাবে তাদের সামনে কারো গিবত করা হলে তারা বলে :
আল্লাহ আমাদিগকে তাওবা করার তাওফীক দিন। এসকল
উক্তি দ্বারা নিজেদের জন্য বা গিবতকৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা প্রকৃত উদ্দেশ্য নয়; বরং অন্যের গিবত প্রসার ও নিজের প্রশংসার
জন্যই এমনটি বলা হয়ে থাকে যা বাস্তবতার আলোকে অনুমেয়। কারণ কারো কল্যাণের জন্য
দোয়া করার উদ্দেশ্য থাকলে তা জনসমক্ষে উক্ত ব্যক্তির নিন্দা করার সময় না করে
নির্জনে করাই শ্রেয়।
এছাড়া উপরোক্ত শ্রেণীর গিবতকারীদের গিবতের
সাথে কপটতাও বিদ্যমান। কারণ বাহ্যত তার প্রতিক্রিয়া নিন্দিত ব্যক্তির স্বপক্ষে মনে
হলেও বাস্তবে তার বিপরীত। এধরণের লোকদের সামনে কারো গিবত করা হলে তারা গিবতকারীকে
বলে “ চুপ কর, গিবত করিওনা” এ উক্তির দ্বারা প্রকৃতপক্ষে গিবতের প্রতি
অবজ্ঞা বা প্রতিবাদ উদ্দেশ্য হলে ভাল কথা; অন্যথায় তা নিফাকী বা কপটতা হিসেবে বিবেচিত
হবে। কারণ শ্রোতা মণ্ডলী এই তিরষ্কারের কারণ অন্বেষণে প্রবৃত্ত হলে নিন্দিত
ব্যক্তির দোষ আরো অধিক প্রকাশিত হয়ে পড়বে এবং তাতে সে নিজেও গিবতকারীর সমপর্যায়ের
অপরাধী হবে।
বুহতান পরিচিতি:
বুহতান (ﺑﻬﺘﺎﻥ)
আরবী শব্দ। আভিধানিক অর্থ-অপবাদ, দুর্নাম, মিথ্যা, রটনা ইত্যাদি। ইসলামের চিরস্থায়ী বিধান হলো, কারো প্রশংসা করতে হলে তার অসাক্ষাতে আর
সমালোচনা করতে হলে সাক্ষাতে করতে হয়। এ বিধান লংঘন করে যখনই কারো অসাক্ষাতে নিন্দা, সমালোচনা বা কুৎসা রটানো হয়, তখন তা শরীয়াত বিরোধী কাজে পরিণত হয়।
এ
ধরনের কাজ তিন রকমের হতে পারে এবং তিনটিই কবীরা গুনাহ।
#প্রথমত: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ বা
দোষ আরোপ করা হয়, তা যদি মিথ্যা, বা প্রয়োজনীয় সাক্ষ্যপ্রমাণহীন হয়, তবে তা নিছক অপবাদ। আরবীতে একে বুহতান বা
কাযাফ বলা হয়।
এ
প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে :
আবূ হুরায়রা রা. বলেন: একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন : তোমরা কি জান গীবত কী? সাহাবায়েকিরাম বললেন: আল্লাহ ও তার রাসূলই
অধিক জ্ঞাত। তিনি বললেন: গীবত হলো তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কিছু বলা যা শুনলে সে
অসন্তুষ্ট হবে। বলা হলো: যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে তা বিদ্যমান থাকে তাহলেও কি গীবত
হবে? তিনি জবাবে
বললেন: তোমার ভাইয়ের মধ্যে যা কিছু বিদ্যমান তা বললে গীবত হবে; আর তা না থাকলে বুহতান তথা মিথ্যা অপবাদ হবে।
গীবতের
শরয়ী বিধানঃ
ইসলামী শরীয়াতে গীবত হারাম। এ প্রসেঙ্গ মহান
আল্লাহ বলেন:
ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁَﻣَﻨُﻮﺍ ﺍﺟْﺘَﻨِﺒُﻮﺍ ﻛَﺜِﻴﺮًﺍ ﻣِﻦَ
ﺍﻟﻈَّﻦِّ ﺇِﻥَّ ﺑَﻌْﺾَ ﺍﻟﻈَّﻦِّ ﺇِﺛْﻢٌ ﻭَﻟَﺎ ﺗَﺠَﺴَّﺴُﻮﺍ ﻭَﻟَﺎ ﻳَﻐْﺘَﺐْ
ﺑَﻌْﻀُﻜُﻢْ ﺑَﻌْﻀًﺎ ﺃَﻳُﺤِﺐُّ ﺃَﺣَﺪُﻛُﻢْ ﺃَﻥْ ﻳَﺄْﻛُﻞَ ﻟَﺤْﻢَ ﺃَﺧِﻴﻪِ ﻣَﻴْﺘًﺎ
ﻓَﻜَﺮِﻫْﺘُﻤُﻮﻩُ ﻭَﺍﺗَّﻘُﻮﺍ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﺗَﻮَّﺍﺏٌ ﺭَﺣِﻴﻢٌ
“ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা অনেক অনুমান বর্জন
কর। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান পাপ। আর তোমরা কারও দোষ অনুসন্ধান কর না এবং একে অপরের
গীবত কর না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? তোমরা তো অবশ্যই তা ঘৃণা কর। তোমরা আল্লাহকে
ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ বড়ই তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।”
এ
প্রসঙ্গে হাদীসের অনেক বর্ণনা রয়েছে। এক বর্ণনায় এসেছে :
ﻋَﻦْ ﺃَﻧَﺲِ ﺑْﻦِ ﻣَﺎﻟِﻚٍ ﻗَﺎﻝَ ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺻَﻠَّﻰ
ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﻟَﻤَّﺎ ﻋُﺮِﺝَ ﺑِﻲ ﻣَﺮَﺭْﺕُ ﺑِﻘَﻮْﻡٍ ﻟَﻬُﻢْ ﺃَﻇْﻔَﺎﺭٌ
ﻣِﻦْ ﻧُﺤَﺎﺱٍ ﻳَﺨْﻤُﺸُﻮﻥَ ﻭُﺟُﻮﻫَﻬُﻢْ ﻭَﺻُﺪُﻭﺭَﻫُﻢْ ﻓَﻘُﻠْﺖُ ﻣَﻦْ ﻫَﺆُﻟَﺎﺀِ ﻳَﺎ
ﺟِﺒْﺮِﻳﻞُ ﻗَﺎﻝَ ﻫَﺆُﻟَﺎﺀِ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻳَﺄْﻛُﻠُﻮﻥَ ﻟُﺤُﻮﻡَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻭَﻳَﻘَﻌُﻮﻥَ
ﻓِﻲ ﺃَﻋْﺮَﺍﺿِﻬِﻢْ
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন : মি’রাজের রাত্রিতে আমি একদল লোকের পাশ দিয়ে
গমনের সময় দেখলাম তারা স্বীয় মুখমণ্ডল ও বক্ষের গোশ্ত পিতল বা তামার নখ দ্বারা
ছিন্ন করছে। আমি জিব্রাঈলের কাছে জানতে চাইলাম এরা কারা? তিনি বললেন: ওরা মানুষের গোশত ভক্ষণ করতো ও
তাদের সম্মান হরণ করতো।
হাদীসের
অপর এক বর্ণনায় এসেছে :
ﻋَﻦْ ﺃَﺑِﻲ ﺑَﺮْﺯَﺓَ ﺍﻟْﺄَﺳْﻠَﻤِﻲِّ ﻗَﺎﻝَ ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ
ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﻳَﺎ ﻣَﻌْﺸَﺮَ ﻣَﻦْ ﺁﻣَﻦَ ﺑِﻠِﺴَﺎﻧِﻪِ ﻭَﻟَﻢْ
ﻳَﺪْﺧُﻞْ ﺍﻟْﺈِﻳﻤَﺎﻥُ ﻗَﻠْﺒَﻪُ ﻟَﺎ ﺗَﻐْﺘَﺎﺑُﻮﺍ ﺍﻟْﻤُﺴْﻠِﻤِﻴﻦَ ﻭَﻟَﺎ ﺗَﺘَّﺒِﻌُﻮﺍ
ﻋَﻮْﺭَﺍﺗِﻬِﻢْ ﻓَﺈِﻧَّﻪُ ﻣَﻦْ ﺍﺗَّﺒَﻊَ ﻋَﻮْﺭَﺍﺗِﻬِﻢْ ﻳَﺘَّﺒِﻊُ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻮْﺭَﺗَﻪُ
ﻭَﻣَﻦْ ﻳَﺘَّﺒِﻊْ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻮْﺭَﺗَﻪُ َﻓْﻀَﺤْﻪُ ﻓِﻲ ﺑَﻴْﺘِﻪِ
আবু বারযা আসলামী ও বারা ইবনে আযেব (রা.)
থেকে বর্ণিত, তারা বলেন :
রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন: হে মু’মিন সম্প্রদায়! যারা মুখে ঈমানের অঙ্গীকার
করেছো; কিন্তু এখনো
তা অন্তরে প্রবেশ করেনি। তোমরা মুসলমানদের অগোচরে তাদের নিন্দা করো না এবং তাদের
দোষ অন্বেষণ করো না। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ অন্বেষণ করে আল্লাহ তা‘আলা তার দোষ অন্বেষণ করেন। আর আল্লাহ তা‘আলা যার দোষ অন্বেষণ করেন তাকে স্বীয় গৃহে
লাঞ্ছিত করেন।
আব্দুল্লাহ
ইবনুল মুবারক (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি
বলেছেন:
আমি যদি কারো গিবত করতে চাই তাহলে আমি আমার
পিতা-মাতার গিবত করবো। কারণ তারা আমার পুণ্য পাওয়ার ব্যাপারে অধিক হক্বদার।
ইমাম
গাজ্জালী (রহ.) বলেছেন:
আমরা আমাদের পূর্বসূরীদেরকে দেখেছি যে, তাঁরা নামায ও রোযার মত মহৎ ইবাদাতের চাইতেও
পরনিন্দা গিবত পরিত্যাগ করাকে বড় ইবাদাত মনে করতেন। জনৈক ব্যক্তিকে বলা হলো যে, অমুক আপনার গিবত করেছেন। বিনিময়ে তিনি
গিবতকারীর জন্য একঝুঁড়ি খেজুর পাঠালেন এবং বললেন: আমার কাছে এ সংবাদ পৌঁছেছে যে, আপনি আপনার পুণ্য আমার কাছে হাদিয়া পাঠিয়েছেন, তাই আমি এই খেজুরের মাধ্যমে প্রতিদান দিতে
ইচ্ছা পোষণ করছি। তবে পূর্ণ বিনিময় না দিতে পারার কারণে আমি ওজরখাহি করছি।
হযরত
হাসান বসরী (রহ.) বলেছেন:
আল্লাহর কসম! মু’মিন ব্যক্তির দ্বীনের মধ্যে পরনিন্দার
প্রচলনের কুপ্রভাব মানব দেহে বসন্তের ফোস্কার চাইতেও দ্রুত প্রসার লাভকারী।
তিনি আরো বলেছেন: হে আদম সন্তান! তুমি ততক্ষণ
পর্যন্ত প্রকৃত ঈমানের সন্ধান পাবে না যতক্ষণ না তুমি নিজে যে দোষে দুষ্ট সে দোষের
কারণে অপরের গিবত পরিত্যাগ না করো এবং নিজের দোষ সংশোধনের চেষ্টা না করো।
আর যখন তুমি নিজের দোষ সংশোধনের চেষ্টায়
লিপ্ত হবে তখন তাতেই তুমি ব্যস্ত থাকবে। এবং এ জাতীয় ব্যক্তিই আল্লাহ তা‘আলার কাছে অধিক প্রিয়।
এক ব্যক্তি তাকে বললো: আপনি আমার গিবত করছেন।
উত্তরে তিনি বললেন : তোমার মর্যাদা আমার কাছে এ পর্যন্ত পৌঁছায়নি যে, আমার পুণ্যের মধ্যে তোমাকে অংশীদার বানাব।
একদল লোক খাবার মজলিসে বসে খাদ্য গ্রহণ
করছেন। এমতাবস্থায় একজনের গিবত করা হলো। তখন এক ব্যক্তি বলে উঠল যে, ‘‘আমাদের পূর্বপুরুষরা গোশত ভক্ষণের পূর্বে
রুটি খেত, আর তোমরা রুটি
খাওয়ার পূর্বেই গোশত ভক্ষণ করছো’’।
এখানে গিবতকে গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা
হয়েছে।
একব্যক্তি তার বন্ধুর সামনে অপরের মন্দ বিষয়
উল্লেখ করলে বন্ধু তাকে জিজ্ঞেসা করলো: তুমি কি রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছ? তিনি উত্তরে বললেন: না। বন্ধু আবার প্রশ্ন করলো: তুমি কি তুর্কীদের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছো? উত্তরে তিনি
বললেন: না।
অতঃপর বন্ধু বললো :তোমার আক্রমণ থেকে রোমান ও
তুর্কীরা রেহাই পেলো; কিন্তু তোমার
মুসলিম ভ্রাতা রেহাই পেলো না।
বিভিন্ন
মনীষীগণ বলেছেন:
তিনটি কাজ করতে তুমি অপারগ হলে অন্য তিনটি
কাজ তোমাকে করতে হবে।
#তুমি কল্যাণমূলক কিছু করতে অক্ষম হলে অকল্যাণমূলক
কাজ থেকে বিরত থাকবে।
#মানুষের উপকার করতে অপারগ হলে তোমার অনিষ্টতা থেকে
তাদেরকে মুক্তি দিবে।
#আর তুমি রোযা পালন করতে অক্ষম হলেও মানুষের গোশত
ভক্ষণ করবে না।
মালেক
ইবনে দীনার বলেছেন:
একদা ঈসা (আ.) স্বীয় সহচরদের নিয়ে একটি মৃত
কুকুরের পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। সহচরগণ বললেন: কুকুরটি কতই না দুর্গন্ধময়! ঈসা
(আ.) বললেন: কিন্তু উহার দাঁতের শুভ্রতা খুবই চমৎকার। এখানে কোন মানুষের মন্দ দিক
নিয়ে আলোচনার চাইতে তার ভাল দিকটি তুলে ধরার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
যে সকল কারণে গীবত তথা পরনিন্দা সংঘটিত হয়ে
থাকে সেগুলো হলো:
১.গিবত বা পরনিন্দার প্রধান বা অন্যতম কারণ হলো
ক্রোধ। কেউ কারো প্রতি ক্রুদ্ধ হলে সে অবলীলায় তার
দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করতে থাকে। সত্য-মিথ্যা, বাস্তব-অবাস্তবের তোয়াক্কা না করে মনে যা আসে
তাই ব্যক্ত করতে থাকে ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে গিবতের মাধ্যমেই ক্রোধ
নিবারণ করে থাকে সাধারণ লোকেরা। অবশ্য যারা দ্বীনদার, পরহেযগার ও আলিম এবং গিবতের ভয়াবহতা সম্বন্ধে
ওয়াকিফহাল তারা অন্যভাবে ক্রোধ সংবরণ করার চেষ্টা করে থাকেন।
২.গিবতের আরেকটি কারণ বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গী-সাথীদের
সাথে তাল মিলানো এবং তাদের সন্তুষ্টি অর্জন। অর্থাৎ সাথীরা
যখন পরনিন্দায় লিপ্ত হয় তখন তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে গিবতে জড়িয়ে পড়ে অনেকে।
কারণ সে মনে করে যে, এ ব্যাপারে
বন্ধুদের সাথে দ্বিমত করলে তাদের সাথে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে বা অসন্তোষ
জন্মাতে পারে। এভাবে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে ও অপরের পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে
কেবলমাত্র বন্ধুদের মনতুষ্টির জন্য গিবত করা কতটা অযৌক্তিক বা অগ্রাহ্য তা সকলকে
ভাবা উচিত।
৩.নিজের দোষত্রুটি লুকানোর উদ্দেশ্যে অন্যের গিবত করা
হয় কখনো কখনো। যেমন কোন ব্যক্তি জানতে পারলো যে, কেউ তার অপকর্মের বিরুদ্ধে কোন বিচারালয়ে বা
আদালতে সাক্ষ্য দেবে বা বিবৃতি দেবে তখন সে ঐ ব্যক্তির গিবত বা নিন্দা করতে থাকে
যাতে তার সাক্ষ্যের গুরুত্ব লাঘব হয়ে যায় এবং তার বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য ও
পরিত্যাহ্য হয়।
৪. নিজের অপকর্মকে যৌক্তিক প্রমাণ করা বা নিজেকে
দোষমুক্ত করার জন্য গিবত বা পরনিন্দার মতো পাপে লিপ্ত হয় অনেকে। যেমন কোন ব্যক্তি
নিজে অপরাধ করে এবং তা থেকে নিস্কৃতি লাভের জন্য বলে, অমুক ব্যক্তি ওতো এ অন্যায় করেছে। উপরন্তু
আমার এ কাজ করার পিছনে বিশেষ কারণ ছিল; কিন্তু তার তো তাও ছিলনা। মনে রাখতে হবে যে, এ ধরনের পরনিন্দাকারী দু’টি পাপের কাজ সংঘটিত করলো। প্রথমত: সে পাপ
কাজে লিপ্ত হলো; দ্বিতীয়ত :
নিজেকে দোষ মুক্ত করার জন্য অন্যের গিবত করলো। এতদোভয়ের মধ্যে দ্বিতীয় পাপটি
অধিকতর জঘন্য।
৫.গিবত করার আরেকটি কারণ হলো নিজেকে বড় করে জাহির
করা। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে কেউ কেউ অন্যকে হেয় ও তুচ্ছ হিসেবে উপস্থাপন
করে। যেমন তারা বলে : অমুক ব্যক্তি মূর্খ বা স্বল্পবুদ্ধি। অমুক দুর্বল চিত্তের
লোক, অমুকের কথায়
কী যায় আসে ? অমুকের কী
মূল্য আছে? এ সকল উক্তির
মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নিজের প্রশংসা করা হয় এবং প্রত্যক্ষভাবে অন্যের নিন্দা করা হয়, যা অত্যন্ত গর্হিত ও নিন্দিত কাজ।
৬.গিবতের অন্যতম আরেকটি কারণ হলো ঈর্ষা ও
পরশ্রিকাতরতা। কতক লোকের স্বভাব এরকম যে, অন্যের সুনাম, সুখ্যাতি এবং সুযশ মোটেই সহ্য হয়না। কোন
লোকের উন্নতি সাধিত হলে বা স্বীয় কীর্তির জন্য অভিনন্দিত হতে দেখলে হিংসার দাবানলে
জ্বলে উঠে তার অন্তর। তখন ঐ নন্দিত ব্যক্তিকে খাটো করার জন্য তার দোষ অন্বেষণ ও
জনসম্মুখে তা প্রচারে লিপ্ত হয় সে। এ ক্ষেত্রে তার লক্ষ্য থাকে কীর্তিমান লোকটিকে
হেয় ও তুচ্ছ করে উপস্থাপন করা এবং তার সুখ্যাতিকে ম্লান করে দেয়া। প্রকৃতপক্ষে
নিন্দুক নিজেই গিবত ও হিংসার মতো দু’টি জঘন্য পাপে লিপ্ত হলো; কিন্তু এতে নিন্দিত ব্যক্তির কোন ক্ষতি হবে
না।
৭.হাসি-তামাশা, কৌতুক ও রসিকতার মাধ্যমে কখনো কখনো গিবত করা
হয়ে থাকে। যেমন লোকদেরকে হাসানোর জন্য ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে অন্যের ত্রুটি প্রকাশ
করা। এ ধরণের গিবতের মূল কারণ হলো অহংকার ও আত্মগরিমা।
৮.গিবত বা পরনিন্দার প্রত্যক্ষ কারণ সমূহের আরেকটি
হলো মানুষের প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন এবং ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা। অনেক সময়
মানুষ অন্যকে কলঙ্কিত ও অপদস্থ করার উদ্দেশ্য তার ক্রিয়াকলাপ নিয়ে উপহাস ও
ঠাট্টা-বিদ্রুপে মত্ত হয়। এখানে স্মর্তব্য যে, উপহাসক উপহাসের মাধ্যমে অপরকে লোকের নিকট
যতটুকু অপদস্থ করছে সে নিজে আল্লাহর নিকট তদপেক্ষা বেশী অপদস্থ হচ্ছে।
৯.গিবত সংঘটিত হওয়ার আরেকটি কারণ হলো বেকারত্ব।
মানুষ যখন কর্মহীন থাকে তখন তার সময় কাটে না। সময় অতিবাহিত হয় না বলে বিরক্তির
উদ্রেক হয়। শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে তখন অন্যের দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠে
এবং গিবত করতে থাকে।
১০.প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নৈকট্য লাভের জন্য
সহকর্মীদের সমালোচনা করা। এতে নিজেকে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ও
বড় পদে আসীন হওয়ার আকাঙ্খা লুকায়িত থাকে।
১১. গিবতের আরেকটি কারণ হলো দাম্ভিকতা, অহমিকা ও আত্ম তৃপ্তি এবং স্বীয় ভুল-ত্রুটি
নিয়ে ভাবনাহীনতা। এক ধরণের মানুষ আছে যারা নিজেদের শত অপরাধ সত্ত্বেও সেদিকে
ভ্রুক্ষেপ করে না; বরং সর্বদা
অন্যের দোষ তালাশ করে বেড়ায়।
১২.ধর্মীয় অনুভূতি থেকে কোন মানুষ অন্যের অন্যায়ের
প্রতিবাদ ও ভুল সংশোধনের জন্য আশ্চার্যন্বিত হয়ে বলতে থাকে : অমুক এ কাজ করতে
পারলো! তার একাজ করা উচিত হয়নি। তার একাজ পরিত্যাগ করা উচিত। এক্ষেত্রে তার এ
প্রতিবাদ প্রশংসার্হ; কিন্তু
অপরাধীর নামোল্লেখ করার কারণে সে অনিচ্ছাকৃতভাবে গিবত করার অপরাধে অপরাধী হবে এবং
গুণাহগার হবে।
১৩.কারো প্রতি করুণা প্রদর্শন বা দয়ার্দ হওয়া। যেমন
কারো পাপ দেখে চিন্তাগ্রস্থ হওয়া ও দুঃখ প্রকাশ করা। এতে গিবত করা বা পাপীকে হেয়
করা উদ্দেশ্য থাকে না। কাজটি শরী‘আতের দৃষ্টিতে প্রশংসনীয়। কিন্তু শয়তান বিদ্বেষবশত : পাপী ব্যক্তির নামোল্লেখ
করতে প্ররোচিত করে এবং অসতর্কতাবশত লোকটি ভাল নিয়ত থাকা সত্ত্বেও গিবতের অপরাধে
জড়িয়ে পড়ে। ফলে পুণ্য লাভের আশায় তিনি যে অপর মু’মিন ভাইয়ের পাপাচারের জন্য দুঃখ ও সহমর্মিতা
প্রকাশ করলেন তা গিবতের পাপে ধ্বংস হয়ে গেল।
১৪.পাপকাজে লিপ্ত হওয়ার অপরাধে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের
আশায় কারো প্রতি ক্রোধান্বিত হওয়া। এটা নিঃসন্দেহে খুব সাওয়াবের কাজ। কিন্তু এখানে
পাপীর নামোল্লেখ করলে গিবতের অন্তর্ভূক্ত হবে এবং পুণ্যের পরিবর্তে পাপ হবে; বরং করণীয় হলো পাপীকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ
থেকে নিষেধ করা এবং তার পাপ গোপন রাখা ও তা অন্যের সামনে প্রকাশ না করা। এ শেষোক্ত
তিনটি কারণ এত সুক্ষ্ম যে, সাধারণ লোকতো
দূরের কথা আলিম সমাজ ও তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দুস্কর। কারণ তারা মনে করে যে, কারো পাপে আশ্চার্যন্বিত হওয়া, করুণা প্রদর্শন করা বা ক্রোধান্বিত হওয়া যদি
আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় হয় তাহলে পাপীর নামোল্লেখে দোষ নেই; অথচ নামোল্লেখের কারণেই পুণ্য লাভের
প্রত্যাশা গিবতের পাপে ব্যর্থ হয়ে গেল।
এ
ছাড়া নিম্নোক্ত কারণেও মানুষের পরস্পরের মধ্যে গীবত সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন :
১. রাগ
২. অপরের সন্তুষ্টি অর্জন
৩. দোষ-ত্রুটি লুকানো
৪. নিজেকে দোষমুক্ত করার
৫. নিজেকে বড় বলে দাবি করা
৬. হিংসা
৭. দাম্ভিকতা, অহমিকা ও আত্মতৃপ্তি এবং স্বীয় ভুল-ত্রুটি
নিয়ে ভাবনাহীনতা
৮. কারো প্রতি করুণা প্রদর্শন বা দয়ার্দ হওয়া
গীবত
বা পরনিন্দার কুফলঃ
গীবত একটি ভাইরাসের মত, যা একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে সংক্রামকের মত
বাহিত হয়। অর্থাৎ একজনের দোষ অপর একজনের নিকট বললে সে আবার ঐ দোষ অন্য আরেকজনের
নিকট প্রকাশ করে থাকে। আর এতে সমাজে অনেক কুফল পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
গীবতের
কুফল সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা
বলেন :
ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁَﻣَﻨُﻮﺍ ﺍﺟْﺘَﻨِﺒُﻮﺍ ﻛَﺜِﻴﺮًﺍ ﻣِﻦَ
ﺍﻟﻈَّﻦِّ ﺇِﻥَّ ﺑَﻌْﺾَ ﺍﻟﻈَّﻦِّ ﺇِﺛْﻢٌ ﻭَﻟَﺎ ﺗَﺠَﺴَّﺴُﻮﺍ ﻭَﻟَﺎ ﻳَﻐْﺘَﺐْ
ﺑَﻌْﻀُﻜُﻢْ ﺑَﻌْﻀًﺎ ﺃَﻳُﺤِﺐُّ ﺃَﺣَﺪُﻛُﻢْ ﺃَﻥْ ﻳَﺄْﻛُﻞَ ﻟَﺤْﻢَ ﺃَﺧِﻴﻪِ ﻣَﻴْﺘًﺎ
ﻓَﻜَﺮِﻫْﺘُﻤُﻮﻩُ ﻭَﺍﺗَّﻘُﻮﺍ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﺗَﻮَّﺍﺏٌ ﺭَﺣِﻴﻢٌ
“ ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা অনেক অনুমান বর্জন
কর। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান পাপ। আর তোমরা কারও দোষ অনুসন্ধান কর না এবং একে অপরের
গীবত কর না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? তোমরা তো অবশ্যই তা ঘৃণা কর। তোমরা আল্লাহকে
ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ বড়ই তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।”
আবূ
হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি
বলেন :
মায়েজ আল-আসলামী (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে চার চার বার নিজের ব্যভিচারের
কথা বললেন। প্রত্যেকবারই আল্লার রাসূল (সা.) তাঁর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সর্বশেষে
রাসূল (সা.) তার উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। তিনি বললেন:
আমি চাই আপনি আমার উপর হদ প্রয়োগ করে আমাকে
পবিত্র করুন। অতঃপর তাকে প্রস্তর নিক্ষেপ করে হদ প্রয়োগের নির্দেশ দিলেন
রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং তা বাস্তবায়িত হলো। এরপর রাসূলুল্লাহ
(সা.) দু’জন আনসারীকে বলাবলি করতে শুনলেন যে, অমুক ব্যক্তির অপরাধ আল্লাহ তা‘আলা লুকিয়ে রাখলেন অথচ সে নিজে তা প্রকাশ
করার কারণে তাকে কুকুরের মতো প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করা হলো। #বর্ণনাকারী বলেন:
এ কথা শ্রবণ করার পর তিনি নিশ্চুপ রইলেন।
অতঃপর কিছু সময় পথ চললেন। পথিমধ্যে একটি মৃত গাধার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তিনি
ঐ ব্যক্তিদ্বয়ের খোঁজ করলেন। তারা বললেন: আমরা উপস্থিত আছি। তিনি বললেন: তোমরা দু’জনে এ মৃত গাধার মাংস ভক্ষণ করো। তারা বললেন:
হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। কেউ কি এই জিনিস ভক্ষণ করে নাকি? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন:
কিছুক্ষণ পূর্বে তোমরা যে ব্যক্তির সম্মান
হরণ করলে তা এই মৃত গাধার মাংস ভক্ষণের চাইতেও কঠিন ও ভয়াবহ। যার হাতে আমার জীবন
তার শপথ করে বলছি, সেতো (মায়েজ
আসলামী) এখন বেহেশতের নহর সমূহে সাতরিয়ে বেড়াচ্ছে।
গীবতের কূফল সম্পর্কে হাদীসের এক বর্ণনায়
জানা যায় যে,
ﻋَﻦْ ﺃَﺑِﻲ ﺑَﺮْﺯَﺓَ ﺍﻟْﺄَﺳْﻠَﻤِﻲِّ ﻗَﺎﻝَ ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ
ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﻳَﺎ ﻣَﻌْﺸَﺮَ ﻣَﻦْ ﺁﻣَﻦَ ﺑِﻠِﺴَﺎﻧِﻪِ ﻭَﻟَﻢْ
ﻳَﺪْﺧُﻞْ ﺍﻟْﺈِﻳﻤَﺎﻥُ ﻗَﻠْﺒَﻪُ ﻟَﺎ ﺗَﻐْﺘَﺎﺑُﻮﺍ ﺍﻟْﻤُﺴْﻠِﻤِﻴﻦَ ﻭَﻟَﺎ ﺗَﺘَّﺒِﻌُﻮﺍ
ﻋَﻮْﺭَﺍﺗِﻬِﻢْ ﻓَﺈِﻧَّﻪُ ﻣَﻦْ ﺍﺗَّﺒَﻊَ ﻋَﻮْﺭَﺍﺗِﻬِﻢْ ﻳَﺘَّﺒِﻊُ ﺍﻟﻠَّﻪُ
ﻋَﻮْﺭَﺗَﻪُ ﻭَﻣَﻦْ ﻳَﺘَّﺒِﻊْ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻮْﺭَﺗَﻪُ َﻓْﻀَﺤْﻪُ ﻓِﻲ ﺑَﻴْﺘِﻪِ
“বারা ইবনে আযিব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন : হে মু’মিন সম্প্রদায়! যারা মুখে ঈমানের অঙ্গিকার
করেছো; কিন্তু এখনো
তা অন্তরে প্রবেশ করেনি। তোমরা মুসলমানদের অগোচরে তাদের নিন্দা করো না এবং তাদের
দোষ খোঁজ করে বেড়াইও না। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ অন্বেষণ করে আল্লাহ তা‘আলা তার দোষ তালাশ করেন। আর আল্লাহ তা‘আলা যার ছিদ্রান্বেষণ করেন তাকে স্বীয় গৃহে
লাঞ্ছিত করেন।”
ﻋَﻦْ ﺃَﻧَﺲِ ﺑْﻦِ ﻣَﺎﻟِﻚٍ ﻗَﺎﻝَ ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺻَﻠَّﻰ
ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﻟَﻤَّﺎ ﻋُﺮِﺝَ ﺑِﻲ ﻣَﺮَﺭْﺕُ ﺑِﻘَﻮْﻡٍ ﻟَﻬُﻢْ ﺃَﻇْﻔَﺎﺭٌ
ﻣِﻦْ ﻧُﺤَﺎﺱٍ ﻳَﺨْﻤُﺸُﻮﻥَ ﻭُﺟُﻮﻫَﻬُﻢْ ﻭَﺻُﺪُﻭﺭَﻫُﻢْ ﻓَﻘُﻠْﺖُ ﻣَﻦْ ﻫَﺆُﻟَﺎﺀِ ﻳَﺎ
ﺟِﺒْﺮِﻳﻞُ ﻗَﺎﻝَ ﻫَﺆُﻟَﺎﺀِ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻳَﺄْﻛُﻠُﻮﻥَ ﻟُﺤُﻮﻡَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻭَﻳَﻘَﻌُﻮﻥَ
ﻓِﻲ ﺃَﻋْﺮَﺍﺿِﻬِﻢْ
“আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন: মি’রাজের রাত্রিতে আমি একদল লোকের পাশ দিয়ে
গমনের সময় দেখলাম তারা স্বীয় মুখমণ্ডল ও বক্ষের গোশ্ত পিতল বা তামার নখ দ্বারা
ছিন্ন করছে। আমি জিব্রাঈলের কাছে জানতে চাইলাম এরা কারা? তিনি বললেন : ওরা মানুষের গোশ্ত ভক্ষণ করতো ও
তাদের সম্মান হরণ করতো।”
উপরোক্ত বর্ণনার ভিত্তিতে এ কথা বলা যায় যে, গিবত একটি জঘন্য কবীরা গুনাহ, যা বান্দার হকের সাথে জড়িত। আর আল্লাহর হকের
চাইতে বান্দার হক্ব নষ্ট করা অধিক ভয়াবহ যা আল্লাহ ক্ষমা করেন না।
গিবত করা সর্বসম্মতভাবে হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ। অনুরূপভাবে গিবত শ্রবণ করাও হারাম ও নিষিদ্ধ
কর্ম। কারণ মানুষের চক্ষু, কর্ণ ও অন্তর
সবকিছুই স্বীয় কৃতকর্মের জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
ﺇِﻥَّ ﺍﻟﺴَّﻤْﻊَ ﻭَﺍﻟْﺒَﺼَﺮَ ﻭَﺍﻟْﻔُﺆَﺍﺩَ ﻛُﻞُّ ﺃُﻭﻟَﺌِﻚَ ﻛَﺎﻥَ
ﻋَﻨْﻪُ ﻣَﺴْﺌُﻮﻟًﺎ
“নিশ্চয় কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত
হবে।”
আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ.) বলেন: ক্বিয়ামতের
দিন কান, চক্ষু ও অন্তঃ
করণকে প্রশ্ন করা হবে। কানকে প্রশ্ন করা হবে: তুমি সারা জীবন কি কি শুনেছ?
চক্ষুকে প্রশ্ন করা হবে: তুমি সারা জীবন কি
কি দেখেছ? অন্তঃকরণকে প্রশ্ন করা হবে: তুমি সারা জীবন
মনে কি কি কল্পনা করেছ এবং কি কি বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছ?
#যদি কান দ্বারা শরীয়ত বিরোধী কথাবার্তা শুনে থাকে; যেমন কারও গিবত এবং হারাম গানবাদ্য কিংবা
চক্ষু দ্বারা শরীয়ত বিরোধী বস্তু দেখে থাকে; যেমন বেগানা স্ত্রীলোক বা শুশ্রী বালকের
প্রতি কু-দৃষ্টি করা কিংবা অন্তরে কুর’আন ও সুন্নাহ বিরোধী বিশ্বাসকে স্থান দিয়ে
থাকে অথবা কারো সম্পর্কে প্রমাণ ছাড়া কোন অভিযোগ মনে কায়েম করে থাকে।
অত্র আয়াত প্রমাণ করে যে, গীবত করা মৃত ব্যক্তির গোশত ভক্ষণ করার
শামিল।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন- ‘মিরাজ কালে আমি এমন কিছু লোকের নিকট দিয়ে
অতিক্রম করলাম, যাদের নখগুলি
পিতলের তৈরি, তারা তা দিয়ে তাদের
মুখমণ্ডল ও বক্ষগুলিকে ছিঁড়ছিল। আমি জিজ্ঞাস করলাম, এরা কারা হে জিবরীল? তিনি বললেন এরা তারাই যারা মানুষের গোশত খেত
এবং তাদের ইজ্জত-আবরু বিনষ্ট করত।’
আব্দুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (রা) বলেন- (একদা)
আমরা নাবী কারীম (সা.)-এর নিকটে ছিলাম। এমতাবস্থায় একজন ব্যক্তি উঠে চলে গেল। তার প্রস্থানের পর
একজন তার সমালোচনা করল। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাকে বললেন,তোমার দাঁত
খিলাল কর। লোকটি বলল, কি কারণে দাঁত
খিলাল করব? আমিতো কোন
গোশত ভক্ষণ করিনি। তখন তিনি বললেনঃ নিশ্চয়ই তুমি তোমার ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করেছ
অর্থাৎ ‘গীবত’ করেছ।
গীবত
করলে কবরে শাস্তি হয়:
একদা রাসূলুল্লাহ্ (সা.) দুটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তিনি থমকে দাঁড়ালেন এবং বললেন, ‘এই দুই কবরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তবে
তাদেরকে তেমন বড় কোনো অপরাধে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না (যা থেকে বেঁচে থাকা তাদের
জন্য সহজ ছিল)। এদের একজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, চোগলখোরী করার কারণে এবং অন্যজনকে শাস্তি
দেওয়া হচ্ছে পেশাবের ব্যাপারে অসতর্কতার কারণে। (পেশাবের ছিটা থেকে বাচত না ) অপর
হাদিসে চোগলখোরীর পরিবর্তে গীবত করার কথা উল্লেখ রয়েছে। (মুসলিম ,আবূ দাউদ, তিরমিযী)
গীবতের
ভয়াবহতা বুঝানোর জন্যেই বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে হাদীসে-
রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- الغيبة أشد من الزناء “গীবত করা যিনা থেকেও মারাত্মক।”
[মেশকাত, বায়হাকি]
অতএব বুঝা গেল যিনা করলে যে গুনাহ হয় এর
চাইতে বেশি গুনাহ হয় গীবত করলে।
অপর হাদীসে রাসুলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেন
اَلرِّبَا اثْنَانِ وَسَبْعُونَ بَابًا أَدْنَاهَا مِثْلُ
إِتْيَانِ الرَّجُلِ أُمَّهُ وَأَرْبَا الرِّبَا اسْتِطَالَةُ الرَّجُلِ فِيْ
عِرْضِ أَخِيهِ
‘সূদের (পাপের) ৭২টি দরজা বা স্তর রয়েছে।
তন্মধ্যে নিম্নতম স্তর হচ্ছে স্বীয় মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া তুল্য পাপ এবং
ঊর্ধ্বতম স্তর হ’ল কোন ব্যক্তি
কর্তৃক তার এক ভাইয়ের মান-সম্ভ্রমের হানি ঘটান তুল্য পাপ’। (তাবারাণী; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৮৭১)
গীবতের গুনাহ যেমন বড় তেমনি এর পরিণতিও খুবই
ভয়াবহ। এটা বুঝানোর জন্য রাসূল (সা.) গীবতকারীদের ইহকালীন ও পরকালীন শাস্তি সম্পর্কে ইরশাদ করেন,
১। ইহকালীন শাস্তিঃ
عَنْ أَبِي بَرْزَةَ الأَسْلَمِيِّ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ
صلى الله عليه وسلم “ يَا مَعْشَرَ مَنْ آمَنَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يَدْخُلِ
الإِيمَانُ قَلْبَهُ لاَ تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِينَ وَلاَ تَتَّبِعُوا
عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنِ اتَّبَعَ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعِ اللَّهُ
عَوْرَتَهُ وَمَنْ يَتَّبِعِ اللَّهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ فِي بَيْتِهِ ” .
হযরত আবূ বারযাহ আল-আসলামী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, হে সেসব লোক যারা কেবল মুখেই ঈমান এনেছে
কিন্তু ঈমান অন্তরে প্রবেশ করেনি! তোমরা মুসলিমদের গীবত করবে না ও দোষত্রুটি তালাশ
করবে না। কারণ যারা তাদের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়াবে আল্লাহও তাদের দোষত্রুটি
খুঁজবেন। আর আল্লাহ কারো দোষত্রুটি তালাশ করলে তাকে তার ঘরের মধ্যেই অপদস্থ করে
ছাড়বেন। সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং
৪৮৮০।
২। পরকালীন শাস্তিঃ
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله
عليه وسلم “ لَمَّا عُرِجَ بِي مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ
نُحَاسٍ يَخْمِشُونَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُورَهُمْ فَقُلْتُ مَنْ هَؤُلاَءِ يَا
جِبْرِيلُ قَالَ هَؤُلاَءِ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ وَيَقَعُونَ
فِي أَعْرَاضِهِمْ ” . قَالَ أَبُو دَاوُدَ حَدَّثَنَاهُ يَحْيَى بْنُ
عُثْمَانَ عَنْ بَقِيَّةَ لَيْسَ فِيهِ أَنَسٌ .
হযরত আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেছেন মি’রাজের রাতে আমি এমন এক কওমের পাশ দিয়ে
অতিক্রম করছিলাম যাদের নখগুলো তামার তৈরী এবং তা দিয়ে তারা অনবরত তাদের মুখমণ্ডলে
ও বুকে আচড় মারছে। আমি বললাম, হে জিবরীল ! এরা কারা? তিনি বললেন, এরা সেসব লোক যারা মানুষের গোশত খেতো অর্থাৎ, মানুষের গীবত করত এবং মানুষের ইজ্জতের উপর
হামলা করত।” এবং তাদের
মানসম্মানে আঘাত হানতো। সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৮৭৮।
৩। উভয় শাস্তিঃ
عَنِ الْمُسْتَوْرِدِ، أَنَّهُ حَدَّثَهُ أَنَّ النَّبِيَّ صلى
الله عليه وسلم قَالَ “ مَنْ أَكَلَ بِرَجُلٍ مُسْلِمٍ أَكْلَةً فَإِنَّ
اللَّهَ يُطْعِمُهُ مِثْلَهَا مِنْ جَهَنَّمَ وَمَنْ كُسِيَ ثَوْبًا بِرَجُلٍ
مُسْلِمٍ فَإِنَّ اللَّهَ يَكْسُوهُ مِثْلَهُ مِنْ جَهَنَّمَ وَمَنْ قَامَ
بِرَجُلٍ مَقَامَ سُمْعَةٍ وَرِيَاءٍ فَإِنَّ اللَّهَ يَقُومُ بِهِ مَقَامَ سُمْعَةٍ
وَرِيَاءٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ” .
হযরত আল-মুসতাওরিদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি অপর
মুসলিমের গীবত করতে করতে এক লোকমা ভক্ষন করবে আল্লাহ তাকে এজন্য জাহান্নাম হতে
সমপরিমাণ ভক্ষন করাবেন। আর যে ব্যক্তি অপর মুসলিমের দোষত্রুটি বর্ণনা করতে করতে
পোশাক পরবে আল্লাহ তাকে অনুরূপ জাহন্নামের পোশাক পরাবেন। আর যে ব্যক্তি অপর
ব্যক্তির (কুৎসা) রটিয়ে খ্যাতি ও প্রদর্শনীর স্তরে পৌছবে, মহান আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তাকে ঐ খ্যাতি ও
প্রদর্শনীর জায়গাতেই (জাহান্নামে) স্থান দিবেন। সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৮৮১।
আর গীবতের ক্ষতিসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো- যার
গীবত করা হয় তার আমলনামায় গীবতকারীর সওয়াব চলে যায়৷
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, নিশ্চয়ই কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার কাছে
মর্যাদার দিক দিয়ে সর্বাধিক নিকৃষ্ট সেই লোক হবে, যাকে মানুষ তার অনিষ্টের ভয়ে ত্যাগ করেছে।
[বুখারি, মুসলিম]
অহংকার৷ অহংকার হচ্ছে, সত্যকে উপেক্ষা করা এবং মানুষকে তুচ্ছ
তাচ্ছিল্য করা। সহিহ মুসলিম সত্যকে উপেক্ষার অর্থ, সত্য জেনেও সেটাকে প্রত্যাখ্যান করা।আর
মানুষকে তুচ্ছ করার অর্থ, মানুষকে ছোট
মনে করা, মানুষকে হেয়
প্রতিপন্ন করা। অহংকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ ধ্বংস করে দেন, তার প্রভাব-প্রতাপ নস্যাৎ করে দেন ও তার
জীবনকে সংকুচিত করে দেন।
অহংকারের কঠোর পরিণাম ও শাস্তির বর্ণনা করে
কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি (তোমাদের ডাকে) সাড়া দেব। যারা আমার
ইবাদত নিয়ে অহংকার করে তারা শীঘ্রই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সুরা মুমিন : আয়াত ৬০)
যারা আল্লাহ তাআলার দাসত্বকে লজ্জাবোধ করবে
কিংবা আল্লাহকে প্রভু বলে মেনে নিতে অহংকার করবে, তাদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা হজরত ঈসা
আলাইহিস সালাম ও ফেরেশতাদের উদাহরণ উল্লেখ করে ঘোষণা দেন->>
মসীহ (ঈসা)
আল্লাহর বান্দা হবেন, তাতে তার কোনো
লজ্জাবোধ নেই এবং ঘনিষ্ঠ ফেরেশতাদেরও (আল্লাহর দাসত্ব করবে তাদেরও) লজ্জাবোধ নেই।
বস্তুতঃ যারা আল্লাহর দাসত্ববোধকে লজ্জাবোধ
করবে এবং অহংকার করবে, তিনি তাদের
সবাইকে (পরকালে) নিজের কাছে সমবেত করবেন।অতঃপর যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তিনি তাদেরকে পরিপূর্ণ সওয়াব দান করবেন, বরং স্বীয় অনুগ্রহে আরও বেশী দেবেন।
পক্ষান্তরে যারা লজ্জাবোধ করেছে এবং অহংকর করেছে তিনি তাদেরকে দেবেন বেদনাদায়ক
শাস্তি। আল্লাহকে ছাড়া তারা কোনো সাহায্যকারী ও সমর্থক পাবে না। (সুরা নেসা :
আয়াত ১৭২-১৭৩)
অহংকার বশতঃ যদি কেউ আল্লাহ নির্দেশ অমান্য
করে তবে সে ব্যক্তি অস্বীকারকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে। যেমনিভাবে ইবলিস আল্লাহর
দরবার থেকে বিতাড়িত হয়েছিল।
আল্লাহ তাআলা সে কথা উল্লেখ করে বলেন-এবং যখন
আমি হযরত আদম (আঃ)-কে সেজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে নির্দেশ দিলাম, তখনই ইবলিস ব্যতিত সবাই সেজদা করলো। সে
(নির্দেশ) পালন করতে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করলো। ফলে সে কাফেরদের
অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ৩৪)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
অহংকারীদের ব্যাপারে মুমিন বান্দাকে সতর্ক করেছেন। তিনি তার উম্মতকে হুশিয়ার করে
দিয়ে জানিয়েছেন কারা হবে জাহান্নামি।
হাদিসে এসেছে-হজরত হারিসাহ ইবনু ওহাব খুযায়ী
রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের জান্নাতীদের সম্পর্কে জানাবো না? (তারা হলেন): ওই সব লোক- যারা অসহায় এবং যাদের
তুচ্ছ মনে করা হয়। তারা যদি আল্লাহর নামে শপথ করে, তাহলে তা তিনি নিশ্চয়ই পুরা করে দেন।আমি কি
তোমাদের জাহান্নামীদের সম্পর্কে জানাবো না? তারা হলো-
(1)কর্কশ স্বভাবের অধিকারী; (2)
শক্ত হৃদয়ের
অধিকারী এবং (3)অহংকারী।’ (বুখারী)
অপর হাদীসে ইরশাদ হয়েছে তিল পরিমাণ অহংকার
যার অন্তরে আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না, আর তিল পরিমাণ ঈমান যার অন্তরে আছে সে দোজখে
যাবে না।
-জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৯৮
অহংকারের কারণেই ইবলিস বিতাড়িত হয়েছিলেন
জান্নাত থেকে। আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাত থেকে বিতাড়িত করতে গিয়েও অহংকারের অপরাধে
কথা সুস্পষ্ট করে বলেছিলেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন-‘তুমি এ স্থান থেকে নেমে যাও; এখানে থেকে অহংকার করবে তা হতে পারে না।
সুতরাং বের হয়ে যাও। তুমি অধমদের অন্তর্ভূক্ত।’
(সুরা আরাফ : আয়াত ১৩)
অহংকার মানুষকে অন্যায়ের দিকে ধাবিত করে। যে
কারণে আল্লাহ তাআলা অহংকারী ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন-‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কোনো উদ্ধত অহংকারীকে
পছন্দ করেন না।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৮)
হাদিসে কুদসিতে এসেছে অহংকার আল্লাহ তাআলা চাদর। এ
চাদর ধরে যারা টানাটানি করে আল্লাহ তাআলা তা সহ্য করেন না। অহংকারকারীকে আল্লাহ
তাআলা জাহান্নামে নিক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছেন। তাই মানুষের উচিত অহংকারের মতো বড় পাপ
না করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করে বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন-‘বড়ত্ব আমার চাদর এবং মহানত্ব আমার ইযার
(লুঙ্গি)। কেউ যদি এ দুইটির কোনো একটির ব্যাপারে আমার
সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হয় তবে আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।’ (মুসলিম, মিশকাত)
যেহেতু অহংকার জান্নাতের অন্তরায় জাহান্নামে
যাওয়ার অন্যতম কারণ। তাই মুমিন মুসলমানের অহংকারমুক্ত থাকা জরুরি। হাদিসে এসেছে-‘যার অন্তরে এক যাররা (অণু) পরিমাণ অহংকার
থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসলিম, মিশকাত)
মনে রাখতে হবে অহংকারী ব্যক্তিও বড় গোনাহগার।
কারণ শয়তানের প্রথম অপরাধই ছিল অহংকার।
হিংসা-বিদ্বেষ থেকেই একে অপরের গীবত করে ৷মনে
রাখতে হবে হিংসা-বিদ্বেষ একটি ভয়ানক সংক্রামক ব্যাধি। মানুষের হীন মনমানসিকতা, ঈর্ষাপরায়ণতা, সম্পদের মোহ, পদমর্যাদার লোভ-লালসা থেকে হিংসা-বিদ্বেষের
উৎপত্তি ও বিকাশ হয়। হিংসা-বিদ্বেষ মুমিনের সৎ কর্ম ও পুণ্যকে তার একান্ত অজান্তে
কুরে কুরে খেয়ে ফেলে। মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, শঠতা-কপটতা, অশান্তি, হানাহানি প্রভৃতি সামাজিক অনাচারের পথ পরিহার
করে পারস্পরিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে এবং ইসলামের পরিশীলিত
জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ হবে—এটিই ধর্মের
মূলকথা।
তাই নবী করিম (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ
করেছেন, ‘তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে নিবৃত্ত থাকবে। কেননা, হিংসা মানুষের নেক আমল বা পুণ্যগুলো এমনভাবে
খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন
লাকড়িকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়।’ (আবু দাউদ)
হিংসা-বিদ্বেষের কঠিন পরিণতি সম্বন্ধে মহানবী
(সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার মানুষের আমলগুলো পেশ করা হয় এবং সব মুমিন
বান্দার গুনাহখাতা মাফ করে দেওয়া হয়; কিন্তু যাদের পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ ও
দুশমনি আছে, তাদের ক্ষমা
করা হয় না। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন: তাদের ছেড়ে দাও, যেন তারা ফিরে আসে অর্থাৎ মিলে যায়।’ (মুসলিম)
কুধারণা থেকেও মানুষ একে অপরের গীবত করে ৷
কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে
তোমার যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ কোরো না। অবশ্যই কান, চোখ ও হৃদয়—এগুলোর প্রতিটি সম্পর্কে (কিয়ামতের দিন)
কৈফিয়ত তলব করা হবে।
[সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৬
বর্তমানে একটি বড় সমস্যা হলো, না জেনে কথা বলা, অমূলক সন্দেহ করা, আপনজনের কথা বাছ-বিচার ছাড়াই বিশ্বাস করা
ইত্যাদি। অথচ সমাজে এমন বহু কথা ছড়িয়ে পড়ে, যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। এ ধরনের
ভিত্তিহীন গুজব মানুষে মানুষে সম্পর্ক নষ্ট করে। তাই শোনা কথার সত্যতা যাচাই করা
জরুরি। ইসলামে খবরের সত্যতা যাচাইয়ে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের কাছে কোনো বার্তা
নিয়ে আসে, তোমরা তা
পরীক্ষা করে দেখবে। যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্পদের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও
এবং পরে যাতে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের অনুতপ্ত হতে না হয়।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ৬)
#যাচাই না করে কোনো খবর প্রকাশ করা ও বিশ্বাস করা
মিথ্যাবাদী হওয়ার নামান্তর।
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যা শুনেছে, তা-ই (যাচাই করা ছাড়া) বর্ণনা করা মিথ্যাবাদী
হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (মুসলিম শরিফের ভূমিকা : ১/১০৭; আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৯২)
অপর হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, রাসুলুল্লাহ
(সা.) সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা অন্যের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করা
থেকে বেঁচে থাকবে, কেননা এরূপ
ধারণা জঘন্যতম মিথ্যা। আর কারও দোষ অনুসন্ধান করবে না, কারও গোপনীয় বিষয় অন্বেষণ করবে না, একে অন্যকে ধোঁকা দেবে না, পরস্পর হিংসা করবে না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করবে
না, পরস্পর
বিরুদ্ধাচরণ করবে না, বরং তোমরা
সবাই এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে থাকবে।’
(বুখারি ও মুসলিম)
তাছাড়া কেউ অপরাধ করলেই তার সমালোচনা করা
একারনেও উচিত নয় কারন হতে পারে সে ভুল করে তাওবা করেছে।
হাদীস শরীফে এসেছে হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল
(রাযি:) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন, যে ব্যক্তি আপন (মুসলমান) ভাইকে কোন এমন
গুনাহের উপর লজ্জা দিল, যে গুনাহ থেকে
সে তওবা করেছে, তবে এই
লজ্জাদাতা ততক্ষন পর্যন্ত মৃত্য বরণ করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজে ঐ গুনাহের মধ্যে
লিপ্ত না হবে।– তিরমিযী, মুন্তাখাব হাদীস (৩১৮ একরামে মুসলিম)
গীবত
থেকে বেচে থাকার উপায়ঃ-
গীবত থেকে বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরি। এ থেকে
বাঁচার কয়েকটি উপায় আছে
(১)#প্রথম উপায় হচ্ছে অপরের কল্যাণ কামনা করা।
কেননা, রাসূল সা.
বলেছেন, ‘দীন হচ্ছে নিছক কল্যাণ কামনা করা।’ [বুখারি ও মুসলিম]
(২)#দ্বিতীয়ত, আত্মত্যাগ অর্থাৎ যেকোনো প্রয়োজনে অপর ভাইকে
অগ্রাধিকার দেয়া। যেমন আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন-‘তারা নিজের ওপর অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার
দেয়, যদিও তারা
অনটনের মধ্যে থাকে।’ [সূরা হাশর : ৯]
(৩)#তৃতীয়ত, অপরের অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়া।
(৪)#চতুর্থ কুরআন ,হাদীস এবং মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী বেশি বেশি
করে অধ্যয়ন করে অন্তরে আল্লাহপাকের ভয় সৃষ্টি করা ৷
এ ক্ষেত্রে জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে
সর্বাগ্রে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
مَّا يَلْفِظُ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ
সে যে কথাই উচ্চারন করে, তাই গ্রহন করার জন্যে তার কাছে সদা প্রস্তুত
প্রহরী রয়েছে৷ (সূরা ক্বাফ– 18)
হাদীস শরীফে রাসূলে কারীম (দ:)ইরশাদ করেছেন র
‘যে ব্যক্তি আমার জন্য তার জিহ্বা ও
লজ্জাস্থানের জিম্মাদার হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হবো।’
[বুখারি]
অপর হাদীসে রাসূল সা. বলেছেন, ‘বান্দা যখন ভোরে নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয় তখন
শরীরের সব অঙ্গ জিহ্বার কাছে আরজ করে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহর নাফরমাণী কাজে পরিচালিত করো না।
কেননা, তুমি যদি ঠিক
থাক, তবে আমরা সঠিক
পথে থাকব। কিন্তু যদি তুমি বাঁকা পথে চলো, তবে আমরাও বাঁকা হয়ে যাবো। [তিরমিযী]
সর্ব শেষ বিষয় হলো নিজে গীবত করবোনা এবং কারো
গীবত শুনবো না সর্বপরি যে ভাইয়ের গীবত করা হয় তার পক্ষ নিয়ে সাধ্যমত তাকে সহযোগিতা
করাও আবশ্যক। সম্ভব হলে ঐ মজলিসেই গীবতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,
مَنْ رَدَّ عَنْ عِرْضِ أَخِيهِ رَدَّ اللهُ عَنْ وَجْهِهِ
النَّارَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের মান-সম্ভ্রমের
বিরুদ্ধে কৃত হামলাকে প্রতিহত করবে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তার থেকে জাহান্নামের আগুনকে প্রতিহত
করবেন’৷
(মুসনাদে আহমাদ হা/২৭৫৮৩; তিরমিযী)
যে সকল ক্ষেত্রে অসাক্ষাতে কারোও দোষ-ত্রুটি
আলোচনা করা গীবতের অন্তর্ভুক্ত নয়:*
ইমাম নববী (রহ:) বলেন, ”সৎ ও শরীয়ত সম্মত উদ্দেশ্য সাধন যদি গীবত
ছাড়া সম্ভব না হয়, তাহলে
এক্ষেত্রে গীবত জায়েয।” তার মতে ছয়
ধরণের গীবত জায়েয। যথা:
১. মজলুম ব্যক্তি জালেমের বিরুদ্ধে অভিযোগ
করতে পারে।
২. ত্রুটি সংশোধনের জন্য কোন ব্যক্তির দোষ
এমন ব্যক্তির কাছে বলা, যে তা সংশোধন
করার ক্ষমতা রাখে।
৩. মুফতির নিকট মাসয়ালা জানতে গিয়ে প্রয়োজনে
কোন ব্যক্তির (সম্ভব হলে নাম উল্লেখ না করে) ত্রুটি বলা যায়।
৪. কোন ব্যক্তি কারো সাথে বিয়ে বা ব্যবসায়ের
সম্পর্ক করতে চাইলে এবং তার সম্পর্কে অন্য ব্যক্তির সাথে পরামর্শ চাইলে তার
দোষ-গুণ স্পষ্টভাবে বলে দেবে যা সে জানে (মনে হিংসা-বিদ্বেষ না রেখে)।
৫. যে সব লোক সমাজে প্রকাশ্যে পাপ কাজ, বিদয়াত বা গোমরাহির প্রসার ঘটাচ্ছে, তাদের দোষ-ত্রুটির তীব্র সমালোচনা জায়েয।
৬. চেনার উদ্দেশ্যে কাউকে ছদ্মনাম বা খারাপ
উপনামে ডাকা জায়েয (তাকে হেয় করার উদ্দেশ্যে নয়)।
(আল্লামা ইমাম নববী রচিত মুসলিম শরীফের
ব্যাখ্যা গ্রন্থ)
আল্লাহ আমাদের গীবদের ভয়াবহতা থেকে হেফাজত করুন আমিন।
No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com