কুড়ানো মানিকের গল্প
-এম
এ রাজ্জাক হাওলাদার
কুড়ানো মানিক-(০১) শাসকের দায়িত্ব
একবার খেলাফতে
উসমানিয়ার শাসক সুলাইমান কানুনী [১৫২০-৬৬ খ্রিঃ]
দরবারে এক
বৃদ্ধ মহীলা এই অভিযোগ নিয়ে হাজির হলেন যে
খলীফার
সিপাহীরা তার পশু চুরি করে নিয়েগেছেন তখন সে ঘুমিয়ে ছিল তার ঘরে।
শাসক সুলাইমান
বৃদ্ধার উওরে বললেনঃ
তোমার উচিৎ ছিল যে, নিজের পশুগুলো হেফাজতের জন্য রাতে জেগে থাকা
এবং ঘুম থেকে দুরে থাকা। খলীফার কথা শুনে বৃদ্ধা কিছুক্ষন নীরবে খলীফার দিকে
তাকিয়ে রইলেন। এরপর খলীফার উওর এই বাক্যে দিলেনঃ
আমি আপনার ক্ষেএে ভেবেছিলাম যে, আপনি আমাদের দেখা শুনার জন্য জেগে আছেন এজন্য আমি নিশ্চিন্তে প্রশান্তির ঘুম ঘুমিয়েছিলাম।
বৃদ্ধার সন্তোষজনক উওরে সুলাইমানের নিজের ভুলের
স্বীকৃতি ছারা কোন উপায় ছিল না। সুতরাং তিনি বললেনঃ তুমি সত্য কথা বলেছ।
মাজাল্লাতুল ফায়সালঃ ২৬৪/১২৬ মেয়ে লোকের
বুদ্ধিমত্তাঃ ৪৩
কুড়ানো মানিক-(০২) "ওহুদ যুদ্ধের এক বীরাঙ্গনা রমণীর
ইতিহাস"
ওহুদের ময়দানে
এক নারী মহা পরাক্রমশালী বীর পুরুষের ন্যায় যুদ্ধ করেছিলেন। এই বীরাঙ্গনার নাম
"নাসিবা (রাঃ)"।
নাসিবার
স্বামী এবং পুত্রদ্বয় ওহুদের যুদ্ধে গমন করলে নাসিবা (রাঃ) নিশ্চেষ্টভাবে গৃহে বসে
থাকা অপেক্ষা যুদ্ধে গমন করা শ্রেয় বলে স্থির করলেন এবং আহত মুসলমান সৈনিকদেরকে
পানি প্রদান করার জন্যে মশক আনয়ন পূর্বক আহত সৈনিকদেরকে উহা প্রদান করছিলেন।
কিন্তু যখন মুসলমানদের করুণ অবস্থা, তখন নাসিবা আর স্থির থাকতে পারলেন না। এক আহত
সৈনিকের হাত হতে তরবারী গ্রহণ করে শত্রু সৈন্যকে আক্রমণ করতে প্রবৃত্ত হলেন।
বিশ্বনবী হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ) স্বয়ং দূর হতে এই বীর রমণীর সৌর্য্য বীর্য দর্শন করছিলেন।
রণক্ষেত্রে নাসিবা তাঁর পুত্রদ্বয়কে নিয়ে হযরতের সম্মুখেই যুদ্ধ করছিলেন। তাঁর
হস্তে ঢাল ছিল না। তাই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) একজন সৈনিককে বললেন, "নাসিবাকে একখানি ঢাল দিয়ে এসো।" সৈনিক
হযরতের আদেশে এক খানি ঢাল নিয়ে নাসিবার নিকটে নিক্ষেপ করলে নাসিবা (রাঃ) সেই ঢাল
তুলে নিয়ে ক্রুদ্ধা সিংহীর ন্যায় সদর্পে পরিভ্রমণ করে কুরাইশদের অস্ত্রাঘাত করতে
লাগলেন। সেই সময় একজন কুরাইশ অশ্বারোহী নাসিবার উপরে তরবারির আঘাত করল, কিন্তু নাসিবা স্বীয় হস্তস্থিত ঢাল দিয়ে আঘাত
ব্যর্থ করে দিলেন এবং তৎক্ষণাৎ শত্রুর অশ্বের উপর তরবারী দিয়ে আঘাত করলেন। এতে
অশ্বটা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। কুরাইশ সৈন্য পতনোন্মুখ অশ্ব হতে লম্ফ দিয়ে ভূমিতে
দণ্ডায়মান হল।
হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ) দূর হতে এই ব্যাপারটা দর্শন করে নাসিবার পুত্র আবদুল্লাহকে জননীর
সাহায্যার্থে যেতে আদেশ করলে আবদুল্লাহ দ্রুত পদে জননীর নিকটে উপস্থিত হন। তখন
নাসিবা পুত্রের সহায়তায় সেই কুরাইশকে আক্রমণপূর্বক তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেন।
একজন কুরাইশের অস্ত্রের আঘাতে আবদুল্লাহর অত্যন্ত শোণিত পাত হওয়াতে তিনি দুর্বল
হয়ে ভূতলে পতিত হলেন। তদ্দর্শনে নাসিবা পুত্রের নিকটে গমন করে বললেন,"বৎস! উঠ। শত্রুর সাথে যুদ্ধ কর। আমার গর্ভে
জন্মগ্রহণ করে ধূলির শয্যায় শয়ন করা কখনও তোমার পক্ষে সমীচীন নয়।" কথা শুনে
আবদুল্লাহ মহা উৎসাহ সহকারে দণ্ডায়মান হয়ে শত্রু সংহারে প্রবৃত্ত হলেন। মুহাম্মাদ
(সাঃ) এই নারীর সাহস, ক্ষমতা, তেজ আর বীরত্ব দেখে সেই বীরাঙ্গনার জন্য প্রাণ
উজার করে দোয়া করেছিলেন।
তাই আমি
অপেক্ষায় রইলাম কবে যে এই বাংলার জন্য এরূপ নাসিবা আর জয়নাব আল গাজালির আগমন ঘটবে।
কবে যে আমাকে বলবে! "হে বৎস! যাও জালিমের জুলুমবাজী থেকে তৌহিদি জনতাকে রক্ষা
কর। বাংলার জমিনে কোরআনের রাজ কায়েম কর। ধ্বংস কর কাফের, ফাসেক, নাস্তিক, মুরতাদদের।
কুড়ানো মানিক-(০৩) উমার
(রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ আব্দুল্লাহ শাহেদ
উমার (রাঃ)
ইসলাম গ্রহণ নবুওয়াতের ৬ষ্ঠ সনের যুল-হাজ্জ মাসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম তার ইসলাম কবূলের জন্যে আল্লাহর দরবারে দু’আ করেছিলেন। নবী (সাঃ) বলেছিলেনঃ ‘‘হে আল্লাহ্! উমার বিন খাত্তাব এবং আবু জাহেল
বিন হেশাম এর মধ্য হতে আপনার নিকট যে অধিক প্রিয় তাকে দিয়ে ইসলামকে শক্তিশালী
করুন।আল্লাহর কাছে উমার (রাঃ) অধিক প্রিয় ছিলেন”। (বুখারী)
উমার (রাঃ) অত্যন্ত কঠিন প্রকৃতির লোক ছিলেন।
মুশরিক থাকাবস্থায় তিনি মুসলমানদেরকে কষ্ট দিতেন এবং তাদের উপর কঠোর ছিলেন।
উমার (রাঃ)এর
ইসলাম গ্রহণের ঘটনা এইযে, তাঁর বোন
ফাতেমা বিনতে খাত্তাব এবং তাঁর স্বামী সাঈদ বিন যায়েদ গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
খাব্বাব (রাঃ) ফাতেমাকে কুরআন শিক্ষা দিতেন। একদিন উমার (রাঃ) রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবীদের উপর আক্রমণ করার জন্য তরবারি নিয়ে বের হলেন। এ
সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৪০ জনের মত লোক নিয়ে সাফা পাহাড়ের নিকটে
একটি বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। সেখানে হামযাহ, আবু বকর এবং আলী (রাঃ)ও ছিলেন। রাস্তায় নুআইম
ইবনে আব্দুল্লাহ এর সাথে দেখা হলো।
নুআইম ইবনে আব্দুল্লাহও তার গোত্রের লোকদের
অত্যাচারের ভয়ে ইসলাম গোপন রেখেছিল। তিনি উমারকে জিজ্ঞেস করলেনঃ কোথায় যাচ্ছেন? উমার বললেনঃ শুনেছি মুহাম্মাদ বেদীন হয়ে গেছে, সে আমাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং আমাদের
মা’বূদদেরকে গালি
দিচ্ছে এবং আমাদের জ্ঞানীদেরকে বোকা বলছে ও আমাদের দ্বীনকে দোষারূপ করছে। তাই তাকে
হত্যা করতে যাচ্ছি।
নুআইম বললেনঃ
আপনার কি মনে হয় মুহাম্মাদকে হত্যা করলে তার গোত্রের লোকেরা আপনাকে ছেড়ে দিবে? তা ছাড়া মুহাম্মাদকে হত্যার পূর্বে নিজের ঘর
ঠিক করা দরকার। তোমার বোন এবং ভগ্নীপতি সাঈদ বিন যায়েদ ইসলাম গ্রহণ করেছে। এ কথার
মাধ্যমে নুআইমের উদ্দেশ্য ছিল উমারকে মুহাম্মাদ (সাঃ)এর দিকে যাত্রা থেকে বিরত
রাখা।
উমার
মুহাম্মাদকে হত্যার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বোনের বাড়ির দিকে যাত্রা করল। এ সময়
খাব্বাব ফাতেমা এবং তাঁর স্বামী সাঈদকে কুরআন মাযীদের সূরা তহা পড়াচ্ছিলেন। উমারের
আগমণ অনুভব করে খাব্বাব ঘরের এক পাশে লুকিয়ে গেলেন এবং ফাতেমাও কুরআনের কপিটি
লুকিয়ে ফেললন। অথচ উমার এর আগেই খাব্বাবের কন্ঠস্বর শুনেছিল।
উমার ঘরে
প্রবেশ করে জিজ্ঞেস করলঃ আমি কিসের আওয়াজ শুনতে পেলাম? তারা বললঃ তুমি কিছুই শুনতে পাওনি। সে বললঃ
আল্লাহর শপথ! আমি শুনেছি, তোমরা উভয়েই
নাকি মুহাম্মাদের অনুসারী হয়ে গিয়েছ। এই বলে সাঈদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাকে প্রহার
করা শুরু করল। ফাতেমা প্রতিরোধ করতে গেলে তার মুখমন্ডলে আঘাত করে রক্ত প্রবাহিত
করে দিল। পরিশেষে তারা স্বীকার করল যে, আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান এনেছি।
তোমার মন যা চায় তাই করতে পার।
উমার তার
বোনের চেহারায় রক্ত দেখে লজ্জিত হল এবং বললঃ তোমরা যে পুস্তিকাটি পাঠ করতেছিলে তা
আমাকে দাও। আমি দেখতে চাই এতে কি রয়েছে।
ফাতেমা বললঃ
আমাদের ভয় হচ্ছে, তুমি এটিকে
অপদস্ত করবে এবং আমাদেরকে তা আর ফেরত দিবেনা। উমার দেব-দেবীর নামে শপথ করে বললঃ
অবশ্যই তা ফেরত দিবে। ফাতেমা বললঃ তুমি অপবিত্র। পবিত্র লোক ব্যতীত অন্য কেউ কুরআন
স্পর্শ করতে পারেনা। উমার উঠে গোসল করে আসল। ফাতেমা তার হাতে কুরআন মযীদ দেয়ার পর
সে সূরা ত্বহা পাঠ করল। সূরা ত্বহার প্রথমাংশ পাঠ করেই সে বললঃ কত সুন্দর এই
কালাম।
এ কথা শুনে
খাব্বাব বের হয়ে এসে বললঃ আপনার ব্যাপারে আল্লাহর নবীর দু’আ কবূল হয়ে গেছে। কেননা আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, হে আল্লাহ! উমার ইবনে খাত্তাব অথবা আবু জাহেল
ইবনে হিশাম- এ দু’জনের একজনের
মাধ্যমে ইসলামকে শক্তিশালী কর। হে উমার! তুমি আল্লাহকে ভয় কর। হে উমার! তুমি
আল্লাহকে ভয় কর।
উমার (রাঃ) তখন বললেনঃ হে খাব্বাব! মুহাম্মাদ
কোথায় আছে? আমাকে দেখিয়ে
দাও। আমি তাঁর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করবো। খাব্বাব বললেনঃ তিনি একদল সাহাবীসহ
সাফা পাহাড়ের নিকস্থ কোন বাড়িতে অবস্থান করছেন।
উমার তরবারি
হাতে নিয়ে সেদিকে চললেন। দরজায় গিয়ে করাঘাত করার সাথে সাথে একজন দাড়িয়ে দরজার ফাঁক
দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখলেন, উমার উন্মুক্ত
তরবারি হাতে নিয়ে উপস্থিত। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামকে সংবাদ দিলেন।
হামযাহ (রাঃ)
বললেনঃ তাকে আসতে বল। সে যদি ভাল নিয়তে এসে থাকে তাহলে তার সাথে আমরা ভাল ব্যবহার
করব। আর যদি মন্দ নিয়তে এসে থাকে তবে আমরা তার তলোওয়ার দিয়েই তাকে হত্যা করব।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তাকে আসার অনুমতি দাও। সে ভিতরে
প্রবেশ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামতার চাদর ধরে শক্ত করে টান
দিলেন এবং বললেনঃ হে খাত্তাবের পুত্র উমার! কি কারণে তুমি এখানে এসেছো? আল্লাহর শপথ! আমার মনে হয় তোমার উপরে আল্লাহর
শাস্তি নাজিল হওয়ার পূর্বে বিরত হবেনা।
এ কথা শুনে
উমার (রাঃ) বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি এসেছি আল্লাহর প্রতি এবং আল্লাহর রাসূলের
প্রতি ঈমান আনয়নের জন্যে।
এ কথা শুনে
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন উঁচু কন্ঠে তাকবীর পাঠ করলেন, যা শুনে ঘরের সকলেই বুঝতে সক্ষম হল যে, উমার মুসলমান হয়ে গেছে। মুসলমানগণ সেখান থেকে
বের হয়ে আসলেন।
এভাবেই উমার
(রাঃ) এবং হামযাহ (রাঃ)এর ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে তাঁরা শক্তিশালী হল।ইবনে মাসঊদ
(রাঃ) বলেনঃ উমার (রাঃ)এর ইসলাম গ্রহণের পর থেকে আমরা সম্মানিত ছিলাম।
কুড়ানো
মানিক-(০৪) সত্যের সামনে উমার:
রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ইন্তেকালের পর যখন আবু বকর (রাঃ) খলীফা হলেন
তখন আরবের কতিপয় সম্প্রদায় মুরতাদ হয়ে গেল অর্থাৎ যাকাত দিতে অস্বীকার করল। তখন
আবু বকর (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। উমার (রাঃ) তখন বললেনঃ আপনি
কিভাবে ঐ সমস্ত লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন? অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেছেনঃ আমাকে মানুষের সাথে যুদ্ধ করার আদেশ দেয়া হয়েছে যে পর্যন্ত না তারা
লা-ইলাহা ইল্লাহ পাঠ করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি তা পাঠ করবে সে আমার হাত থেকে তার
জান-মাল নিরাপদ করে নিল। তবে ইসলামের দাবীর কথা ভিন্ন। অর্থাৎ ইসলামের বিধান
অনুযায়ী কেউ যদি দন্ড পাওয়ার উপযোগী কোন অপরাধ করে তবে ইসলাম গ্রহণের কারণে তার
উপর থেকে সে দন্ডবিধি রহিত হবেনা; বরং তাকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে। আর তার অন্তরের হিসাবের ভার আল্লাহর উপর
ন্যস্ত রইল।
আবু বকর (রাঃ)
উমার (রাঃ)এর উপরোক্ত কথা শুনে বললেনঃ আল্লাহর শপথ! যারা নামায ও যাকাতের মধ্যে
পার্থক্য করবে আমি তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্ধ করব। কেননা যাকাত হল সম্পদের হক।
আল্লাহর শপথ! তারা যদি আমাকে একটি ছাগল ছানা প্রদানেও বাঁধা দেয়, যা তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামএর যামানায় প্রদান করত তাহলে আমি এ অস্বীকৃতির কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
করব।
উমার (রাঃ)
বলেনঃ আল্লাহর শপথ! আবু বকরের দৃঢ়তা শুধু এ জন্যই ছিল যে, আল্লাহ তা’আলা যুদ্ধের জন্য আবু বকরের বক্ষ প্রশস্ত করে
দিয়েছেন এবং আমি সুস্পষ্টরূপে উপলদ্ধি করতে পারলাম যে আবু বকরের সিদ্ধান্তই ছিল
সঠিক।
কিন্তু
পরিতাপের বিষয় হল, বর্তমানে কিছু
অজ্ঞ লোকের ধারণা, মুসলমান হওয়ার
জন্য শুধু মুখে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলাই যথেষ্ট। চাই সে ইসলামের অন্যান্য বিধান
পালন করুক বা না করুক। কোন সন্দেহ নেই যে, কালেমা তায়্যেবা পাঠ করা ঈমানের প্রধান
নিদর্শন। কিন্তু এই বাক্যটি পাঠ করার পরও কেউ যদি ইসলামের কোন রূকন অস্বীকার করে
তাহলে সে ইসলামের গন্ডি থেকে বের হয়ে কাফের হিসাবে গণ্য হবে। এতে কোন সন্দেহ নেই।
আরও আশ্চর্যের
বিষয় এই যে, বর্তমানে অনেক
জ্ঞানী লোক আছেন, যারা ইসলামের
খেদমত করতে চান ঠিকই। কিন্তু তাদের মনের অজান্তে এবং ত্রুটিপূর্ণ গবেষণার কারণে
তাদের ভুল হয়ে যাওয়া কোন দোষের বিষয় নয়। কোন দ্বীনি ভাই এসে সেই ভুলটি সংশোধন করতে
চাইলে কেন যে তারা সেই ভুলটি স্বীকার করতে চান না এবং কি কারণে তারা ভুল সংশোধন
করতে চান না, তা বোধগম্য
নয়। আজ থেকে দশ বছর আগে যা সহজ ছিল না, আজ তা খুবই সহজ হয়ে গেছে। ঘরে ঘরে
কম্পিউটার-ইন্টারনেট প্রবেশ করেছে। যে কোন ভুলকে যাচাই-বাছাই করে অতি অল্প সময়ের
মধ্যেই সংশোধন করে নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমরা কি তা করছি?
পরিশেষে বলতে
চাই, আমাদের সমাজে
আবু বকরের মত লোকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে, যার সাথী হবেন উমার এবং উমারের মত লোকের যথেষ্ট
প্রয়োজন রয়েছে, যিনি সত্যের
পথে চলতে গিয়ে ভুল করে বসলে তাকে সংশোধন করে দিবেন আবু বকরের মত সত্যের পথে অবিচল
একজন ব্যক্তি।
হযরত আবু
হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূলূল্লাহ এর খেদমতে উপস্হিত
ছিলাম এবং উনার চর্তুপাশ্বে বসা ছিলাম । হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং হযরত উমর (রাঃ) ও
আমাদের সাথে ঐ মজলিসে উপস্হিত ছিলেন। এরই মধ্যে
রাসূলূল্লাহ (সাঃ) আমাদের মাঝখান হতে উঠে কোন এক দিকে চলে গেলেন। তারপর তার ফিরে আসতে অনেক দেরী হচ্ছিল বলে আমরা শংকিত হয়ে পড়লাম যে, একাকী আমাদেরকে ছেড়ে গিয়ে তিনি কোন দূর্ঘটনায়
পড়লেন কিনা ? এ চিন্তুায় আমরা অস্হির হয়ে গেলাম এবং সবাই উনার খোজে বেরিয়ে পড়লাম। সবার আগে আমিই অস্হির হয়ে উনার সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। খুজতে খুজতে শেষ পর্যন্ত আনসারদের বনু নজ্জার গোত্রের এক বাগানে এসে পৈাছলাম। বাগানটি চার দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত ছিলো। আমি এখানে এসে
চারদিক ঘুরতে লাগলাম যে ভিতরে যাওয়ার কোন রাস্তা পাই কিনা। কিন্তু কোন রাস্তা খোজে পেলাম না। হঠাৎ দেখলাম
যে একটি ছোট্র একটি নালা। যা বাহিরের একটি কুয়া থেকে বাগানের ভিতর
প্রবাহিত হচ্ছে। আমি নিজেকে সংকুচিত করে এই সরু নালা দিয়ে
বাগানের ভিতর পৈাছে গেলাম এবং রাসূলূল্লাহ (সাঃ)এর সামনে হাজির হলাম।
রাসূলূল্লাহ
(সাঃ) আমাকে দেখে বললেন, আবু হুরায়রা ? আমি উত্তর দিলামঃ হ্যা, ইয়া রাসূলূল্লাহ। তিনি বললেনঃ কিভাবে এখানে আসা হলো ? আমি বললামঃ ইয়া রাসূলূল্লাহ! আপনি আমাদের মাঝে
ছিলেন, হঠাৎ উঠে
আসলেন। তারপর যখন দেখলাম আপনার ফিরতে দেরী হচ্ছে, তখন আমাদের আশংকা হলো যে, আমাদের থেকে পৃথক হয়ে একাকী আপনি কোন অসুবিধার
সম্মুখীন হলেন কিনা। এই আশংকায় আমরা সবাই ঘাবড়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আর সবার আগে আমিই শংকিত হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। শেষ পর্যন্ত আমি এ বাগানে এসে পৈাছলাম আর শিয়ালের মত শরীর কুচকে এই সরু পথেই
কোন রকমে ঢুকে পড়লাম। অন্যান্য লোকেরাও আমার পেছনে রয়েছে।
এমন সময়
রাসূলূল্লাহ (সাঃ) নিজের পাদুকাদ্বয় আমার হাতে দিয়ে বললেনঃ আমার এই জুতা দুটি নিয়ে
যাও এবং এ বাগান থেকে বের হবার পর এমন যে ব্যাক্তির সাথেই তোমার সাক্ষাৎ হয়, যে আন্তুরিক বিশ্বাস নিয়ে 'লা-ইলাহা ইল্লাহর' সাক্ষ্য দেয় তাকে জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও
।
আবু হুরায়রা
(রাঃ) বলেন, আমি সেখান
থেকে বের হয়ে সামনে রওয়ানা দিলাম । সর্বপ্রথম যার সাথে আমার সাক্ষাৎ হলো তিনি হলেন
হযরত উমর । তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আবু হুরায়রা ! তোমার হাতে এ পাদুকাদ্বয়ের রহস্য
কি ? আমি উত্তর
দিলাম, এ দুটি হচ্ছে
হুযুর (সাঃ) এর জুতা মোবারক । আমাকে তিনি এগুলো দিয়ে পাঠিয়েছেন যে, এমন যার সাথেই আমার সাক্ষাৎ হয়, যে আন্তরিক ভাবে লা-ইলাহা ইল্লাহর' সাক্ষ্য প্রদান করে , আমি যেন তাকে জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়ে দেই ।
আবু হুরায়রা
(রাঃ) বলেন, এই কথা শুনে
হযরত উমর (রাঃ) আমার বুকে হাত দ্বারা এমন জোরে আঘাত করলেন যে, আমি চিৎ হয়ে পড়ে গেলাম । তারপর তিনি বললেন যে, পিছনের দিকে ফিরে যাও । আমি কাদঁতে কাদঁতে হুযুর
(সাঃ) এর নিকট ফিরে আসলাম আর ওমরও আমার পেছন পেছন এসে হাজির হলেন ।
রাসূল (সাঃ)
আমাকে এ অবস্হায় দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আবু হুরায়রা ! তোমার কি হয়েছে ? আমি বললাম, ওমর (রাঃ) এর সাথে আমার সাক্ষাৎ হলো । আপনি
আমাকে যে সুসংবাদ দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন , আমি তাকে সেই সুসংবাদ শুনালাম , তখন তিনি আমার বুকের উপর এমন আঘাত করলেন যে আমি
চিৎ হয়ে পড়ে গেলাম । আর তিনি আমাকে এও বললেন যে, পিছনে ফিরে যাও । রাসূল (সাঃ) তখন ওমর (রাঃ) কে
লক্ষ্য করে বললেন যে, উমর তুমি কেন
এমনটি করলে ?
হযরত উমর
(রাঃ) নিবেদন করলেন, ইয়া রাসূলূল্লাহ
! আমার মাতাপিতা আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত হউক । আপনি কি আবু হুরায়রাকে আপনার
পাদুকাদ্বয় দিয়ে এজন্য পাঠিয়ে ছিলেন যে, সে এমন যার সাথেই সাক্ষাৎ করবে , যে আন্তরিকভাবে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ'র সাক্ষ্য প্রদান করে , তাকেই যেন জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়ে দেয় ।
হুযুর (সাঃ) বললেন, হ্যা, আমিই তাকে একথা বলে পাঠিয়ে ছিলাম । উমর (রাঃ)
বললেন, দয়া করে আপনি
এরূপ করবেন না । কেননা, আমার আশংকা হয়
যে, মানুষ একথা
শুনে এর উপরই ভরসা করে বসে থাকবে (এবং আমল ও সাধনা থেকে উদাসীন হয়ে যাবে )। তাই
তাদেরকে এভাবে আরো আমল করতে দিন। মহানবী (সাঃ) বললেন, আচ্ছা , তাদেরকে আমল করার জন্য ছেড়ে দাও ।
(মুসলিম)
হযরত উমর
(রাঃ) কর্তৃক আবু হুরায়রা (রাঃ) কে এমন কঠোর ব্যবহার এর মর্ম উপলব্ধি করার জন্য
সাহাবীদের মধ্যে উনার বিশেষ মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে । তিনি মহানবী (সাঃ)
এর সকল কর্মের সহযোগী এবং উপদেষ্টার মতো ছিলেন । সাহাবা কেরামগণও উনার মর্যাদা
সম্পর্কে বিশেষ অবহিত ছিলেন । আর যেভাবে প্রত্যেক দলের বা পরিবারের বড় ব্যাক্তিটি
ছোটদের শাসন করে তেমনি করে তিনি অন্য সাহাবীদের উপরও এরূপ আধিকার প্রয়োগ করতেন ।
সুতরাং বাহ্যিক দৃষ্টিতে এটা খারাপ মনে হলেও এর অর্ন্তনিহিত গুরুত্ব অনেক । মহানবী
(সাঃ) থেকে শুরু করে প্রত্যেক সাহাবী-ই উম্মতের ভালো চাইতেন । তাই আবু হুরায়রা
(রাঃ) এটা নিয়ে কোন উচ্চ বাচ্যও করেন নি ।
সূ্ত্রঃ
মারেফূল হাদিস । প্রথম খন্ড । হযরত মাওলানা মুহাম্মদ মনজুর নোমানী (রহঃ)
৫.সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার ধর্ম
জর্দানের
সুন্দর 'ফাহল' নগরী। ইরাক-জর্দান এলাকায় এটা রোমানদের শেষ
দুর্গ। নিরুপায় রোমক বাহিনী মুসলিম সেনাপতি আবু উবাইদার কাছে সন্ধির প্রস্তাব
দিল। সন্ধি সম্বন্ধে আলোচনার জন্য সেনাপতি আবু উবাইদাহ (রা) মুয়াজ ইবন জাবাল (রা)-কে পাঠালেন রোমক শাসক সাকলাবের
দরবারে।
মুয়াজ দরবারে
পৌঁছলে সাকলাব তাঁকে পরম সমাদরে একটি কারুকার্যখচিত আসনে বসবার জন্য অনুরোধ করলেন।
কিন্তু মুয়াজ
দরবারের মাটির আসনেই বসে পড়লেন। সাকলাব বললেন, "আমরা আপনাকে মর্যাদা দিতে চাই, কিন্তু নিজেই আপনি আপনার সম্মান নষ্ট
করেছেন।"
মুয়াজ বললেন, "যে আসন দরিদ্র প্রজাদের বক্ষরক্তে চারু চিত্রের
রূপ ধারণ করেছে, সে আসনকে আমরা
ঘৃণা করি।" সাকলাব বললেন, "এই আসন দরিদ্র প্রজাদের অর্থে নির্মিত তা আপনি কেমন করে বুঝলেন?"
মুয়াজ বললেন, "আপনার জৌলুসপূর্ণ বেশ-ভূষা আর আপনার সৈন্যদের
বেশ দেখেই এটা আমি বুঝেছি।"
রোমান শাসক সাকলাব
বললেন, "আপনাদের উর্ধ্বতন কর্মচারী ও আপনাদের প্রভুও কি এরূপ আসনে বসেন না?"
মুয়াজ বললেন, "না, আমীরুল মুমিনীনও এরূপ আসনে উপবিষ্ট হন না।
আমাদের প্রভুর কথা বলছেন? একমাত্র
আল্লাহ ব্যতীত আমরা কাউকেও প্রভু বলে সম্বোধন করি না। আমরা নিজেকে কখনও কোন মানবের
দাস বলে ভাবি না। মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্ব চালিয়ে যাওয়াকে আমরা মানব ধর্মের
বহির্ভূত কাজ বলে মনে কর।"
রোমান শাসকের
চোখ দু'টিতে নিঃসীম
বিস্ময় ঝরে পড়ল। একটু সময় নিয়ে তিনি বললেন, "আপনারা যদি এমন ন্যায়নিষ্ঠ হন, তাহলে পররাজ্য অধিকারে আসেন কেন?" মুয়াজ বললেন, "আমরা পররাজ্য অধিকার করি ঠিক, কিন্তু কোন ন্যায় পরায়ন ও সত্য নিষ্ঠের রাজ্য
আমরা দখল করি না। দখল করি আপনাদের মত স্বার্থপরের রাজ্য। তারপর সেখানকার মৃতপ্রায়
মানুষকে নতুন জীবন দান করি- প্রত্যেকটি মানুষকে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকবার জন্য
উদ্বুদ্ধ করি।"
সর্বশেষে
সাকলাব বললেন, "আমরা আপনাদেরকে বালকা জিলাসহ জর্দানের কিয়দংশ দিয়ে দেব, আপনারা আমাদের সাথে সন্ধি করুন।" মুয়াজ
বললেন, "না, আমরা ধন বা
রাজ্যলোভে যুদ্ধ করি না। আমরা সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতার ধর্ম প্রচার করি। হয়
আপনারা ইসলামের সত্য ও ন্যায়ের পথ অনুসরণ করুন, নতুবা জিযিয়া দিন। এ দু'টির কোনটিই গৃহীত না হলে যুদ্ধ অনিবার্য।"
দুর্বিনীত
রোমক শাসক যুদ্ধের পথই অনুসরণ করল। কিন্তু যুদ্ধ ডেকে আনল তার জন্য চরম পরাজয়। আর
মুসলমানদের হাতে তুলে দিল ফাহল, বেসান, আম্মান, জিরাশ, মায়াব প্রভৃতি নগরীসহ গোটা জর্দান প্রদেশ।
আবু বকর
রাদিয়াল্লাহু আনহু তার অতুলনীয় বিশ্বাসপরায়ণতার জন্য উপাধি পেয়েছিলেন আস
সিদ্দিক।শুধু বিশ্বাস ও আমলেই নয়, দানশীলতার ক্ষেত্রেও তার কোন তুলনা ছিলনা।উমার
ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেছেন, "তাবুক যুদ্ধের প্রাক্কালে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের যার
যা আছে তা থেকে যুদ্ধ তহবিলে দান করার আহবান জানালেন। এ আহবান শুনে আমি নিজে
নিজেকে বললাম, "আমি যদি আবু বকরকে অতিক্রম করতে পারি, তাহলে আজই সেই
দিন"।
এই চিন্তা করে
আমি আমার সম্পদের অর্ধেক মহানবীর (সা) খেদমতে হাজির করলাম। আল্লাহ রাসূল (সা)
জিজ্ঞাসা করলেন, "পরিবারের জন্য তুমি কী রেখেছ? বললাম, "যেই পরিমাণ এনেছি সেই পরিমাণ রেখে এসেছি"।
এরপর আবুবকর
তার দান নিয়ে হাজির হলেন। মহানবী (সা) ঠিক ঐভাবেই তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আবু বকর, পরিবারের জন্য কী অবশিষ্ট আছে?" আবু বকর জবাব দিলেন, "তাদের জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল
রয়েছেন"।
আমি আমার
কানকে আগের মতন করেই বললাম, "কোন ব্যাপারেই আবু বকরকে কোনদিন ছাড়িয়ে যেতে পারবো না"।

No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com