আসহাবে রাসূলের জীবন কথা-১ম খন্ড
ভূমিকা
সাহাবা কারা?
‘সাহাবী’ শব্দটি
আরবী ভাষার ‘সুহবত’ শব্দের
একটি রূপ। একবচনে ‘সাহেব’ ও ‘সাহাবী’ এবং
বহুবচনে ‘সাহাবা’ ব্যবহৃত
হয়। আভিধানিক অর্থ সঙ্গী,
সাথী, সহচর, এক সাথে
জীবন যাপনকারী অথবা সাহচর্যে অবস্থানকারী। ইসলামী পরিভাষায় ‘সাহাবা’ শব্দটি
দ্বারা রাসূলুল্লাহর (সা)মহান সংঙ্গী-সাথীদের বুঝায়। ‘সাহেব’ শব্দটির
বহুবচনের আরো কয়েকটি রূপ আছে। তবে রাসূলুল্লাহর (সা) সংগী-সাথীদের বুঝানোর জন্য ‘সাহেব’-এর
বহুবচনে ‘সাহাবা’ ছাড়া ‘আসহাব’ ও ‘সাহব’ও ব্যবহৃত
হয়ে থাকে।
আল্লামা ইবন হাজার রাহ. ‘আল–ইসাবা ফী তাময়ীযিস সাহাবা’ গ্রন্থে সাহাবীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেনঃ ইন্নাস সাহাবিয়্যা
মান লাকিয়ান নাবিয়্যা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা মু’মিনান বিহি ওয়া মাতা আলাল ইসলাম’- অর্থাৎ সাহাবী সেই ব্যক্তি যিনি রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি
ঈমান সহকারে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং ইসলামের ওপরই মৃত্যুবরণ করেছেন।
উপরোক্ত সংজ্ঞায় সাহাবী হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত আরোপ করা
হয়েছে। ১. রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি ঈমান ২. ঈমানের অবস্থায় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ
(আল-লিকা) ৩. ইসলামের ওপর মৃত্যুবরণ (মাউত ’আলাল ইসলাম)।
প্রথম শর্তটি দ্বারা এমন লোক সাহাবী বলে গণ্য হবে না যারা
রাসূলুল্লাহর সা. সাক্ষাৎ তো লাভ করেছে কিন্তু ঈমান আনেনি। যেমনঃ আবু জাহল, আবু লাহাব প্রমূখ মক্কার কাফিরবৃন্দ। দ্বিতীয় শর্ত অর্থাৎ
সাক্ষাৎ দ্বারা এমন ব্যক্তিও সাহাবী বলে গণ্য হবেন, যিনি হুজুরের তো সাক্ষাৎ লাভ করেছেন, কিন্তু অন্ধত্ব বা এ জাতীয় কোন অক্ষমতার কারণে চোখে দেখার
সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যেমনঃ অন্ধ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা.।
তৃতীয় শর্ত অর্থাৎ মাউত ’আলাল ইসলাম দ্বারা এমন লোকও সাহাবীদের দলে শামিল হবেন, যাঁরা ঈমান অবস্থায় রাসূলুল্লাহর সা. সাক্ষাৎ লাভে ধন্য
হয়েছেন। তারপর মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হয়েছেন। তারপর আবার ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান
হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন। পুনরায় ইসলাম গ্রহণের পর নতুন করে রাসূলুল্লাহর সা.
সাক্ষাৎ লাভ না করলেও তিনি সাহাবী বলে গণ্য হবেন। এটাই সর্বাধিক সঠিক মত। যেমনঃ
হযরত আশ’য়াস ইবন কায়েস রা. ও আরো অনেকে। হাদীস বিশারদগণ আশয়াস ইবন
কায়েসকে সাহাবীদের মধ্যে গণ্য করে তাঁর বর্ণিত হাদীস সহীহ ও মুসনাদ গ্রন্থসমূহে
সংকলন করেছেন। অথচ তিনি ইসলাম গ্রহণের পর মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হয়ে যান এবং হযরত
আবু বকরের রা. খিলাফতকালে আবার ইসলামে ফিরে আসেন।
শেষোক্ত শর্তের ভিত্তিতে এমন ব্যক্তি সাহাবী বলে গণ্য হবেনা
যে ইসলামের অবস্থায় রাসূলুল্লাহর সা. সাক্ষাৎ লাভ করেছে, কিন্তু পরে মুরতাদ অবস্থায় মারা গেছে। যেমনঃ আবদুল্লাহ ইবনে
জাহাশ আল-আসাদী। সে মুসলমান হয়ে হাবশায় হিজরাত করার পর খৃস্টান হয়ে যায় এবং সেখানে
মুরতাদ অবস্থায় মারা যায়। তাছাড়া আবদুল্লাহ ইবনে খাতাল, রাবীয়া ইবন উমাইয়্যা প্রমুখ মুরতাদ ব্যক্তিবর্গ। সাহাবী
হওয়ার জন্য ইসলামের ওপর মৃত্যুবরণ শর্তটি উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে
অনুপস্থিত।
উপরোক্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, ঈমান সহকারে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সাক্ষাতের পর তাঁর
সাহচর্য বেশী বা অল্প দিনের জন্য হউক, রাসূলুল্লাহর সা. থেকে কোন হাদীস বর্ণনা করুক বা না করুক, রাসূলুল্লাহর সঙ্গে কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করুক বা না করুক, এমন কি যে ব্যক্তির জীবনে মুহূর্তের জন্য রাসূলুল্লাহর সা.
সাক্ষাত লাভ ঘটেছে এবং ঈমানের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, এমন সকলেই সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত।
যারা রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি ঈমান আনেনি; কিন্তু পূর্ববর্তী অন্য কোন নবীর প্রতি ঈমান সহকারে
রাসূলুল্লাহর সা. সাক্ষাৎ লাভ করেছে, তারা সাহাবী নয়। আর ‘বুহাইরা’ রাহিবের
মত যাঁরা পূর্ববর্তী কোন নবীর প্রতি ঈমান সহকারে রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত লাভের
পূর্বে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং বিশ্বাস করেছেন, তিনি ভবিষ্যতে নবী হবেন- এমন ব্যক্তিদের সাহাবা হওয়া
সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। মুসলিম মনীষীরা তাঁদের সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করতে
পারেননি।
উল্লেখিত সংজ্ঞার শর্তাবলী জ্বীনদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
জ্বীনরাও ‘সাহাবা’ ছিলেন।
কুরআন মজিদে এমন কিছু জ্বীনের কথা বলা হয়েছে যাঁরা রাসূলুল্লাহর সা. কুরআন
তিলাওয়াত শুনে ঈমান এনেছিলেন। নিঃসন্দেহে তারা অতি মর্যাদাবান সাহাবা ছিলেন।
সাহাবীর উল্লেখিত সংজ্ঞাটি ইমাম বুখারী, ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বলসহ অধিকাংশ পণ্ডিতের নিকট সর্বাধিক
সঠিক বলে বিবেচিত। অবশ্য সাহাবীর সংজ্ঞার ক্ষেত্রে আরো কয়েকটি অপ্রসিদ্ধ মতামতও
আছে। যেমন,
কেউ কেউ সাক্ষাতের (আল-লিকা)
স্থলে চোখে দেখার (রু’ইয়াত) শর্ত আরোপ করেছেন। কিন্তু তাতে এমন সব ব্যক্তি বাদ
পড়ে যাবেন যাঁরা মুমিন হওয়া সত্ত্বেও অন্ধত্বের কারণে রাসূলুল্লাহকে সা. চোখে
দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যেমনঃ আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম রা.। অথচ
তিনি অতি মর্যাদাবান সাহাবী ছিলেন।
হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব বলেনঃ সাহাবী হওয়ার জন্য শর্ত
হচ্ছে,
এক বা দু’বছর রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্য অথবা তাঁর সাথে দু’একটি গাযওয়া বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ। কিছু সংখ্যক উলামায়ে উসূল
ও উলামায়ে ইলমুল কালাম-এর মতে, সাহাবী
হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে,
রাসূলুল্লাহর সা. দীর্ঘ
সাহচর্য ও সুন্নাতে নববীর সা. অনুসরণের ক্ষেত্রে তাঁর পরিচিতি ও খ্যাতি। কেউ কেউ
আবার বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার শর্ত আরোপ করেছেন। একদল আলিমের মতে যে ব্যক্তি বয়ঃপ্রাপ্ত
হওয়ার পর এক নজর রাসূলুল্লাহকে সা. দেখেছেন, তিনি সাহাবী। আর যিনি বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বে
রাসূলুল্লাহকে সা. দেখেছেন,
তিনিও সাহাবী। তবে এ হিসেবে
যে,
রাসূল সা. তাকে দেখেছেন।
কিন্তু তিনি রাসূলকে সা. দেখেছেন সে হিসেবে নয়। কিন্তু হাদীস বর্ণনার দিক দিয়ে এমন
ব্যক্তি সাহাবী নন,
বরং তাবঈর মর্যাদা লাভ
করবেন। প্রশ্ন হতে পারে,
যদি কেউ রাসূলুল্লাহর সা.
ইনতিকালের পর দাফনের পূর্বে তাকে দেখে থাকেন, যেমনটি ঘটেছিল প্রখ্যাত আরবী কবি ‘আবু জুয়ারিব আল-হুজালীর’ ক্ষেত্রে- তাঁর ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত হবে? আলিমদের মধ্যে এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। তবে গ্রহণযোগ্য মত
হলো,
এমন ব্যক্তি সাহাবীদের
দলভুক্ত হবেন না।
ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ এ ব্যাপারে একমত যে, রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্য বা ‘সুহবত’ এমন একটি
মর্যাদা,
যার সমকক্ষ আর কোন মর্যাদা
মুসলমানদের জন্য নেই। সুহবতের মর্যাদা ছাড়াও দ্বীনের ভিত্তিকে শক্তিশালী ও মজবুত
করা,
ইসলামের তাবলীগ ও শরীয়াতের
খিদমতের ক্ষেত্রে কঠোর শ্রমদান ও আত্মত্যাগের কারণে প্রতিটি মুসলমানের কাছে
সাহাবায়ে কিরামের একটি পবিত্র ও উচ্চ মর্যাদা আছে। এ কারণে কোন কোন আলিমের মতে
সাহাবীদেরকে হেয় প্রতিপন্নকারী ব্যক্তি ‘যিন্দীক’। আবার কারো মতে, এটা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সাহাবীদের মর্যাদা
সাহাবীদের পরস্পরের মধ্যে মর্যাদা হিসেবে স্তরভেদ থাকতে
পারে,
কিন্তু পরবর্তী যুগের কোন
মুসলমান,
তা তিনি যত বড় জ্ঞানী, গুণী ও সাধক হোন না কেন কেউই একজন সাধারণ সাহাবীর মর্যাদাও
লাভ করতে পারেন না। এ ব্যাপারে কুরআন, সুন্নাহ্ এবং ইজমা একমত।
এই সাহাবীরাই আল্লাহর রাসূল সা. ও তাঁর উম্মাতের মধ্যে
প্রথম মধ্যসূত্র। পরবর্তী উম্মাত আল্লাহর কালাম পবিত্র কুরআন, কুরআনের ব্যাখ্যা, আল্লাহর রাসূলের পরিচয়, তাঁর শিক্ষা, আদর্শ, মোটকথা
দ্বীনের সবকিছুই একমাত্র তাঁদেরই সূত্রে, তাঁদেরই মাধ্যমে জানতে পেরেছে। সুতরাং এই প্রথম সূত্র
উপেক্ষা করলে,
বাদ দিলে অথবা তাঁদের প্রতি
অবিশ্বাস সৃষ্টি হলে দ্বীনের মূল ভিত্তিই ধসে পড়ে। কুরআন ও হাদীসের প্রতি অবিশ্বাস
দানা বেঁধে ওঠে।
‘হাফেজ ইবন আবদিল বার’ সাহাবীদের মর্যাদা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. সুহবত ও তাঁর সুন্নাতের হিফাজত ও ইশায়াতের
দুর্লভ মর্যাদা আল্লাহ তা’আলা এইসব মহান ব্যক্তির ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন। এ কারণেই
তাঁরা ‘খায়রুল কুরুন’ ও খায়রু উম্মাতিন’ এর মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন।র্অথাৎ তাদের যুগ সর্বোত্তম যুগ
এবং তারা সর্বত্তোম উম্মাত।
হাফেজ আবু বকর ইবন খতীব আল-বাগদাদী বলেনঃ ‘‘উল্লেখিত ভাব ও বিষয়ের হাদীস ও আখবারের সংখ্যা অনেক এবং
সবই ‘নাসসুল কুরআনের’ ভাবের সাথে সংগতিপূর্ণ। অর্থাৎ তাতে সাহাবীদের সুমহান
মর্যাদা,
আদালাত, পবিত্রতা ইত্যাদি ভাব ব্যক্ত হয়েছে। আল্লাহ ও রাসূল কর্তৃক
তাদের আদালাতের ঘোষণা দানের পর পৃথিবীর আর কোন মানুষের সনদের মুখোপেক্ষী তাঁরা নন।
আল্লাহ ও রাসূল সা. তাঁদের সম্পর্কে কোন ঘোষণা না দিলেও তাঁদের হিজরাত, জিহাদ, সাহায্য, আল্লাহর রাহে ধন-সম্পদ ব্যয়, পিতা ও সন্তানদের হত্যা, দ্বীনের ব্যাপারে উপদেশ দান, ঈমান ও ইয়াকীনের দৃঢ়তা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড এ কথা প্রমাণ করতো
যে,
আদালাত, বিশ্বাস, পবিত্রতা
ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে যত ন্যায়পরায়ণ ও পবিত্র ব্যক্তিই
জন্মগ্রহণ করুন না কেন,
তাঁরা ছিলেন সকলের থেকে
উত্তম।’’
কোন কোন সাহাবীর জীবদ্দশায় রাসূল সা. তাদেরকে জান্নাতের
সুসংবাদ দিয়েছেন। তবে মুসলিম পণ্ডিতদের অনেকে সাহাবীদের সকলেই জান্নাতী বলে অভিমত
ব্যক্ত করেছেন। ইবনে হাজার ‘আল–ইসবা’ গ্রন্থে স্পেনের ইমাম ইবন হাযামের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন।
তিনি বলেনঃ ‘আস-সাহাবাতু কুল্লুহুম মিন আহলিল জান্নাতী কাতআন- সাহাবীদের
সকলেই নিশ্চিতভাবে জান্নাতী।’
রাসূল সা. তাঁর সাহাবীদের গালি দেওয়া বা হেয় প্রতিপন্ন করার
উদ্দেশ্যে সমালোচনা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ ‘‘আল্লাহ, আল্লাহ!
আমার পরে তোমরা তাদেরকে সমালোচনার লক্ষ্যে পরিণত করো না। তাদেরকে যারা ভালোবাসে, আমার মুহাব্বতের খাতিরেই তারা ভালোবাসে, আর যারা তাদেরকে হিংসা করে, আমার প্রতি হিংসার কারণেই তারা তা করে।’’
সাহাবী চিনবার উপায়
প্রশ্ন হতে পারে, কে সাহাবী এবং কে সাহাবী নয়, তা কিভাবে নির্ণয় করতে হবে? ‘রিজাল ও হাদীস’ শাস্ত্র বিশারদগণ এ ব্যাপারে কতিপয় মূলনীতির অনুসরণ করেছেন।
প্রথমতঃ ‘খবরে তাওয়াতুর’ অর্থাৎ একজন মানুষ সম্পর্কে যখন প্রতিটি যুগের অসংখ্য মানুষ
বর্ণনা বা সাক্ষ্য দেবে যে তিনি সাহাবী ছিলেন। দ্বিতীয়তঃ ‘খবরে মাশহুর’ অর্থাৎ প্রতিটি যুগের প্রচুর সংখ্যক মানুষ সাক্ষ্য দিবে যে, অমুক সাহাবী। তৃতীয়তঃ কোন একজন সাহাবীর বর্ণনা বা সাক্ষ্যের
ভিত্তিতে। চতুর্থতঃ কোন একজন প্রখ্যাত তাবঈর বর্ণনা বা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে।
পঞ্চমতঃ কেউ নিজেই যদি দাবী করেন, আমি
সাহাবী। সে ক্ষেত্রে দু’টি বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে আছে কিনা তা দেখতে হবে। ১. ‘আদালাত’ বা
ন্যায়নিষ্ঠতা। এটি সাহাবীদের বিশেষ গুণ। সাহাবিয়্যাতের দাবীদার ব্যক্তির মধ্যে এ
গুণটি অবশ্যই থাকতে হবে। ২. ‘মুয়াসিরাত’ বা সমসাময়িকতা। সাহাবীদের যুগ শেষ হয়েছে হিজরী ১১০ সনে।
কারণ,
রাসূল সা. তাঁর ইনতিকালের
একমাস পূর্বে বলেছিলেন,
আজ এ পৃথিবীতে যারা জীবিত
আছে,
আজ থেকে একশ’ বছর পর তারা কেউ জীবিত থাকবে না। সুতরাং হিজরী ১১০ সনের পর
কেউ জীবিত থাকলে এবং সে সাহাবী বলে দাবী করলে, ‘রিজাল’ শাস্ত্র
বিশারদরা তাকে সাহাবী বলে মেনে নেননি। অনেকে এমন দাবী করেছিলেন; কিন্তু সে দাবী মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে। তাদের জীবনীও ‘রিজাল’ শাস্ত্রে
লিখিত আছে। এ ছাড়াও সাহাবী নির্ধারণের আরো কিছু নিয়ম নীতি মুহাদ্দিসগণ অনুসরণ
করেছেন।
সাহাবীদের সংখ্যা
সাহাবীদের সংখ্যা যে কত তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না।
ইমাম আবু যারআ আর-রাযী বলেছেন, রাসূল সা.
যখন ইনতিকাল করেন,
তখন যারা তাঁকে দেখেছেন এবং
তাঁর কথা শুনেছেন এমন লোকের সংখ্যা নারী-পুরুষ মিলে এক লাখেরও ওপরে। তাঁদের
প্রত্যেকেই রাসূলুল্লাহর সা. হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাহলে যে সকল সাহাবী কোন হাদীস
বর্ণনা করেননি তাঁদের সংখ্যা যে কত বিপুল তা সহজেই অনুমেয়। আবু যার’আর একথার সমর্থন পাওয়া যায় বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হযরত কা’ব ইবন মালিকের একটি বক্তব্য দ্বারা। তিনি তাবুক অভিযান
বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন,
‘‘মানুষের সংখ্যা অনেক। কোন
দফতর বা দিওয়ান তা গণনা করতে পারবে না।’’
সাহাবীদের যথাযথ হিসেব কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ, রাসূলুল্লাহর সা. জীবনের শেষ দিকে মানুষ দলে দলে ইসলাম
গ্রহণ করে তাঁর হাতে বাইয়াত হয়। কেউ কেউ বলেছেন, হিজরী দশম সনে মক্কা এবং তায়েফে একজনও অমুসলিম ছিল না। সকলে
ইসলাম গ্রহণ করে বিদায় হজ্জে অংশগ্রহণ করে। এমনিভাবে আরবের বহু গোত্র সম্পূর্ণরূপে
মুসলমান হয়ে যায়। তাদের অধিকাংশ ছিল মরুবাসী। তাদের হিসেব সংরক্ষণ করা কোনভাবেই
সম্ভব ছিলনা। তাছাড়া হযরত আবু বকরের রা. খিলাফতকালে ভণ্ড নবী ও ধর্মদ্রোহীদের
বিরুদ্ধে অভিযানকালে অসংখ্য সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। তাঁদের অনেকের পরিচয় ধরে
রাখা সম্ভব হয়নি।
পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াত ও অসংখ্য হাদীসে সাহাবীদের
মর্যাদা ও ফজীলত বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে কয়েকটি আয়াতের অর্থ উদ্ধৃত হলোঃ
‘‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল; তার সহচরগণ, কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের পরস্পরের প্রতি
সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সিজদায়
অবনত দেখবে। তাদের মুখমণ্ডলে সিজদার চিহ্ন থাকবে, তাওরাতে তাদের বর্ণনা এরূপই এবং ইন্জীলেও।’’ (সূরা আল–ফাতহঃ ২৯)
‘‘মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা
নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে, আল্লাহ
তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাতে সন্তুষ্ট এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন
জান্নাত,
যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেখোনে তারা চিরস্থায়ী হবে। এটা মহা কামিয়াবী।’’ (সূরা আত–তাওবাঃ ১০০)
‘‘এ সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের ঘরবাড়ী ও
সম্পত্তি হতে উৎখাত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ
ও তাঁর রাসূলের সাহায্য করে। তারাই তো সত্যাশ্রয়ী। মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা
এই নগরীতে (মদীনা) বসবাস করেছে ও ঈমান এনেছে তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে এবং
মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে তার জন্য তারা অন্তরে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না, আর তারা তাদেরকে নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয় নিজেরা
অভাবগ্রস্ত হলেও।’’ (সূরা আল–হাশরঃ ৮–৯) এ আয়াতে প্রথম মুহাজির ও পরে আনসারদের প্রশংসা করা হয়েছে।
এমনিভাবে সূরা আল ফাত্হঃ ১৮, সূরা আল ওয়াকিয়াঃ ১০, এবং সূরা আল আনফালের ৬৪ নাম্বার আয়াতসহ বিভিন্ন আয়াতে কোথাও প্রত্যক্ষ আবার কোথাও পরোক্ষভাবে
সাহাবায়ে কিরামের প্রশংসা এসেছে।
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সা. নিজেও তাঁর সাহাবীদের শানে
বক্তব্য রেখেছেন। তাঁদের সম্মান, মর্যাদা ও
স্থান নির্ধারণ করে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। যেমন হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. থেকে
বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ
‘‘আমার উম্মাতের মধ্যে সর্বোত্তম লোক হচ্ছে আমার যুগের
লোকেরা। তারপর তার পরের যুগের লোকেরা, তারপর তার পরের যুগের লোকেরা। তারপর এমন একদল লোকের
আবির্ভাব হবে যাদের কসম হবে তাদের সাক্ষ্যের অগ্রগামী। তাদের কাছে সাক্ষী চাওয়ার
আগেই তারা সাক্ষ্য দেবে।’’
‘‘তোমরা আমার সাহাবীদের গালি দেবেনা, কসম সেই সত্তার যাঁর হাতে আমার জীবন, তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনাও ব্যয় করো তবুও
তাদের যে কোন একজনের ‘মূদ’
বা তার অর্ধেক পরিমাণ যবের
সমতুল্য হবে না।’’
রাসূলুল্লাহ সা. থেকে ইবন আব্বাস রা. বর্ণনা করেছেনঃ ‘‘তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাবের যা কিছু দেওয়া হয়েছে, তার ওপর আমল করতে হবে। তা তরক করা সম্পর্কে তোমাদের কারো
কোন ওজর-আপত্তি গ্রহণযোগ্য হবে না। যদি আল্লাহর কিতাবে কোন সিদ্ধান্ত না পাওয়া যায়
তাহলে আমার সুন্নাতে খোঁজ করতে থাক। যদি তাতেও না পাওয়া যায় তাহলে আমার সাহাবীদের
কথায় তালাশ করতে হবে। আমার সাহাবীরা আকাশের তারকা সদৃশ। তার কোন একটিকে তোমরা
গ্রহণ করলে সঠিক পথ পাবে। আর আমার সাহাবীদের পারস্পরিক ইখতিলাফ বা মতপার্থক্য
তোমাদের জন্য রহমত স্বরূপ।’’
সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব উমার ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণনা
করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ
‘‘আমার পরে আমার সাহাবীদের পারস্পরিক মতপার্থক্য সম্পর্কে
আমার ‘রব’-
প্রভুকে জিজ্ঞেস করলাম।
আল্লাহ আমার কাছে ওহী পাঠালেনঃ হে মুহাম্মাদ, তোমার সাহাবীরা আমার কাছে আকাশের তারকা সদৃশ। তারকার মত
তারাও একটি থেকে অন্যটি উজ্জ্বলতর। তাদের বিতর্কিত বিষয়ের কোন একটিকে যে আঁকড়ে
থাকবে,
আমার কাছে সে হবে হিদায়াতের
ওপরে।’’
ইমাম শাফঈ হযরত আনাস ইবন মালিকের সনদে একটি হাদীস বর্ণনা
করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ আল্লাহ আমাকে ও আমার সাহাবীদেরকে মনোনীত করেছেন।
তাদের সাথে আমার বৈবাহিক সম্পর্ক কায়েম করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে আমার আনসার বানিয়ে
দিয়েছেন। শেষ যামানায় এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে যারা তাদের অবমাননা করবে।
সাবধান,
তোমরা তাদের ছেলে-মেয়ে বিয়ে
করবে না তাদের কাছে ছেলে-মেয়ে বিয়েও দেবে না। সাবধান, তাদের সাথে নামায পড়বে না, তাদের জানাযাও পড়বে না। তাদের ওপর
আল্লাহর লা’নত।
মিশকাত শরীফে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সা. বলেছেনঃ
আমার উম্মাতের মধ্যে একটি ফিরকাই নিশ্চিত জান্নাতী হবে। জিজ্ঞেস করা হলো, তারা কে? বললেনঃ
যারা আমার ও আমার সাহাবীদের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
অন্য একটি হাদীসে রাসূল সা. বলেছেনঃ ‘আমার উম্মাতের মধ্যে সাহাবীদের স্থান তেমন, যেমন খাবারের মধ্যে লবণের স্থান।’
সাহাবীদের সমাজ ছিল একটি আদর্শ মানব সমাজ। তাঁদের কর্মকাণ্ড
মানব জাতির জন্য একটি উৎকৃষ্টতম নমুনা স্বরূপ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁদের
সততা,
বিশ্বস্ততা, ভদ্রতা, আত্মত্যাগ
ও সদাচরণ তুলনাবিহীন। তাঁরা ছিলেন একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিশীল। গরীব ও
মুহতাজ শ্রেণীর প্রয়োজন ও চাহিদাকে তাঁরা সবসময় অগ্রাধিকার দিতেন। বীরত্ব ও
সাহসিকতায় তাঁরা ছিলেন নজীরবিহীন। রাসূলুল্লাহর সা. ইত্তেবা বা অনুসরণ ছিল তাঁদের
জীবনের মূল লক্ষ্য। তাঁদের জীবন-মরণ উভয়ই ছিল ইসলামের জন্য।
হযরত রাসূল করীম সা. যে সর্বোত্তম সমাজের ভিত্তি রেখেছিলেন, সাহাবায়ে কিরাম হচ্ছেন সেই সমাজের প্রথম নমুনা। রাসূল পাকের
সা. সুহবতের বরকতে তাঁরা মহান মানবতার বাস্তব রূপ ধারণ করেছিলেন। ‘আদল,
তাকওয়া, দিয়ানাত, ইহসান এবং
খাওফে খোদার তাঁরা ছিলেন সমুজ্জ্বল প্রতীক। তাঁদের মধ্যে এই অনুভূতি সদা জাগ্রত
ছিল যে,
এই পৃথিবীতে তাঁদের আগমণ
ইসলামের ঝাণ্ডা সমুন্নত করা ও মানব জাতির মধ্যে সমতা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার
জন্য। এখানে তাঁদেরকে খিলাফতে ইলাহিয়ার আমীন বা বিশ্বাসী রূপে আল্লাহর উদ্দেশ্য
পূরণ করতে হবে।
পবিত্রতা ও নিষ্কলুষতা তাঁদের মধ্যে এমন পরিচ্ছন্ন হৃদয় ও
ন্যায়ের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছিল যে, হক ও ইনসাফের ব্যাপারে তাঁরা যেমন নিজেদেরকে দায়িত্বশীল মনে
করতেন,
তেমন মনে করতেন অন্যদেরকেও।
তাঁরা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও নিজেদের সন্তান ও আত্মীয়-বন্ধুদের শরয়ী
বিধানের শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারেননি, বাঁচাতে চেষ্টাও করেননি।
মোটকথা ঈমান ও বিশ্বাস তাদের সামগ্রিক যোগ্যতাকে আলোকিত করে
দিয়েছিল। তাঁরা খুব অল্প সময়ে বিশ্বের সর্বাধিক অংশ প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁদের
সামরিক ও সাংগঠনিক যোগ্যতার ভুরিভুরি নজীর ইতিহাসের পাতায় বিদ্যমান।
সাহাবায়ে কিরামের আদর্শ সমাজের অনুরূপ সমাজ যদি আজ আমরা
গড়তে চাই,
আমাদের অবশ্যই তাঁদের
সম্পর্কে জানতে হবে। তাঁদের মত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কুরআনী সমাজ গড়ার যে চেতনা দেখা যাচ্ছে, তাকে সঠিক লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যেতে হলে সাহাবীদের জীবনীর
ব্যাপক চর্চা হওয়া দরকার। তাঁদের জীবন থেকেই দিক নির্দেশনা নিতে হবে। কিন্তু
দুঃখজনক হলেও সত্য যে,
বাঙ্গালী মুসলিম সমাজে
সাহাবীদের জীবনের চর্চা খুব কম। এখানে পীর-আওলিয়ার জীবনের কাল্পনিক কিস্সা-কাহিনী
যে পরিমাণে আলোচিত হয় তার কিয়দংশও সাহাবীদের জীবনীর আলোচনা হয়না।
আরবী-উর্দুসহ পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় সাহাবীদের জীবনীর ওপর
বহু বড় বড় গ্রন্থ রচিত হয়েছে। ইসলামী সাহিত্যের অন্যান্য শাখার ন্যায় এক্ষেত্রেও
বাংলা ভাষায় উল্লেখযোগ্য তেমন কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি। মাসিক ‘পৃথিবী’-র
নির্বাহী সম্পাদক ও বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক নাজির আহমদ তাঁর
পত্রিকার মাধ্যমে সাহাবীদের জীবনের কিছু কথা পাঠকদের কাছে তুলে ধরার ইচ্ছা প্রকাশ
করেন। মূলতঃ তাঁরই উৎসাহে আমি ধারাবাহিকভাবে ‘পৃথিবী’র পাতায়
লিখতে থাকি। ‘পৃথিবী’র পাতার
লেখাগুলিই ‘আসহাবে রাসূলের জীবনকথা’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে লেখা ও বই
আকারে প্রকাশের ব্যাপারে অধ্যাপক নাজির আহমদের উৎসাহ ও ভূমিকা না থাকলে হয়তো আমি
কখনো লিখতাম না এবং বই আকারেও প্রকাশও হতো না। তাই দু’আ করি, আল্লাহ তা’আলা তাঁকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
‘আসহাবে রাসূলের জীবনকথা’র প্রথম খণ্ডে মোট তিরিশজন সাহাবীর জীবনের আলোচনা এসেছে।
তাঁরা সকলেই মুহাজিরীন তাবকার অন্তর্ভুক্ত। তাঁদের মধ্যে ‘আশারা মুবাশ্শারা’র সেই গৌরবান্বিত দশ জন সাহাবীও সন্নিবেশিত হয়েছেন।
লেখাগুলো সংক্ষিপ্ত হলেও তথ্যসমূহ আরবী-উর্দুর মূল সূত্রসমূহ থেকে গৃহীত হয়েছে।
বিতর্কিত বিষয় যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি।
পরিশেষে, পাঠকবৃন্দ
এই লেখা থেকে বিন্দুমাত্র উপকৃত হলে আমার কষ্ট সার্থক বলে মনে করবো। কোথাও কোন
ভুল-ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে তা আমার গোচরে আনার জন্য পাঠকদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।
প্রকাশনার সাথে জড়িত ভাই কামরুল ইসলাম সহ সকলের প্রতি আমি
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আল্লাহ পাক আমার এ সামান্য শ্রমটুকু কবুল করুন। আমীন।
২৭-২-১৯৮৯ ইং
মুহাম্মাদ আবদুল মা’বুদ
আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,
ঢাকা
খাদীজা বিনতু খুওয়াইলিদ (রা)
নাম তাঁর খাদীজা। কুনিয়াত ‘উম্মু হিন্দ’ এবং লকব ‘তাহিরা’। পিতা
খুওয়াইলিদ,
মাতা ফাতিমা বিনতু যায়িদ।
জন্ম ‘আমুল ফীল’ বা
হস্তীবর্ষের পনের বছর আগে মক্কা নগরীতে। পিতৃ-বংশের উর্ধ্ব পুরুষ কুসাঈ-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সা. নসবের সাথে
তাঁর নসব মিলিত হয়েছে। জাহিলী যুগেই পূতপবিত্র চরিত্রের জন্য ‘তাহিরা’ উপাধি লাভ
করেন। (আল–ইসাবা) রাসূলুল্লাহ সা. ও খাদীজার রা. মধ্যে ফুফু-ভাতিজার দূর
সম্পর্ক ছিল। এ কারণে,
নবুওয়াত লাভের পর খাদীজা রা.
রাসূলুল্লাহকে সা. তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নাওফিলের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘আপনার ভাতিজার কথা শুনুন।’ সম্ভবতঃ বংশগত সম্পর্কের ভিত্তিতেই তিনি একথা বলেছিলেন।
পিতা খুওয়াইলিদ তৎকালীন আরব সমাজের বিশিষ্ট তাওরাত ও ইনজীল
বিশেষজ্ঞ ওয়ারাকা ইবন নাওফিলকে খাদীজার বর নির্বাচন করেছিলেন, কিন্তু কেন যে তা বাস্তবে রূপ লাভ করেনি সে সম্পর্কে
ঐতিহাসিকরা নীরব। শেষ পর্যন্ত আবু হালা ইবন যারারাহ আত-তামীমীর সাথে তাঁর প্রথম
বিয়ে হয়। জাহিলী যুগেই তাঁর মৃত্যু হয়। আবু হালার মৃত্যুর পর ’আতীক বিন আবিদ আল-মাখযুমীর সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয়। (শারহুল মাওয়াহিব, আল–ইসতিয়াব) তবে কাতাদার সূত্রে জানা যায়, তাঁর প্রথম স্বামী ’আতীক, অতঃপর আবু
হালা। ইবন ইসহাকও এ মত সমর্থন করেছেন বলে ইউনুস ইবন বুকাইর বর্ণনা করেছেন। (আল ইসাবাঃ ৪/২৮১) তবে প্রথমোক্ত মতটি ইবন আবদিল বার সহ অধিকাংশের মত বলে ইবন
হাজার উল্লেখ করেছেন।
খাদীজার পিতা খুওয়াইলিদ ইবন আসাদ ছিলেন ফিজার যুদ্ধে নিজ
গোত্রের কমাণ্ডার। তিনি ছিলেন বহু সন্তানের জনক। প্রথম পুত্র হিযাম। এই হিযামের
পুত্র প্রখ্যাত সাহাবী হাকীম জাহিলী যুগে মক্কার ‘দারুন নাদওয়ার’ পরিচালনাভার লাভ করেছিলেন। দ্বিতীয় সন্তান হযরত খাদীজা।
তৃতীয় সন্তান ‘আওয়াম’ প্রখ্যাত
সাহাবী হযরত যুবাইরের রা. পিতা। রাসূলুল্লাহর সা. ফুফু এবং হযরত হামযার আপন বোন
হযরত সাফিয়্যা রা. ছিলেন ‘আওয়ামের’ স্ত্রী বা
যুবাইরের রা. মা। সাফিয়্যা ছিলেন খাদীজার ছোট ভাইয়ের বউ। চতুর্থ সন্তান হালা। তিনি
ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. মেয়ে হযরত যয়নাবের রা. স্বামী আবুল আস ইবন রাবী’র মা। আবূল আ’স রাসূলুল্লাহর সা. বড় জামাই। পঞ্চম সন্তান রুকাইয়া। পাঁচ
ভাই-বোনের মধ্যে হিযাম,
আওয়াম এবং রুকাইয়া ইসলামের
আবির্ভাবের আগেই মারা যান। হযরত খাদীজা ও হালা ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ
করেছিলেন।
খাদীজার পিতার মৃত্যু কখন হয়েছিল, সে সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন, ‘ফিজার’ যুদ্ধে
মারা যান। ইমাম সুহাইলীর মতে ফিজার যুদ্ধের আগেই মারা যান। তখন খাদীজার বয়স
পঁয়ত্রিশ। কারো কারো মতে রাসূলুল্লাহর সা. বিয়ের পর তিনি মারা যান। (হায়াতুস সাহাবা– ২/৬৫২)।
পিতা বা স্বামীর মৃত্যু বা যে কোন কারণেই হোক কুরাইশ বংশের
অনেকের মত খাদীজাও ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী। ইবন সা’দ তাঁর ব্যবসা সম্পর্কে বলছেনঃ ‘খাদীজা ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও সম্পদশালী ব্যবসায়ী মহিলা।
তাঁর বাণিজ্য সম্ভার সিরিয়া যেত এবং তাঁর একার পণ্য কুরাইশদের সকলের পণ্যের সমান
হতো।’
ইবন সা’দের এ মন্তব্য দ্বারা খাদীজার ব্যবসায়ের পরিধি উপলব্ধি করা
যায়। অংশীদারী বা মজুরী বিনিময়ে যোগ্য লোক নিয়োগ করে তিনি দেশ বিদেশে মাল কেনাবেচা
করতেন।
রাসূলুল্লাহ সা. তখন পঁচিশ বছরের যুবক। এর মধ্যে চাচা আবু
তালিবের সাথে বা একাকী কয়েকটি বাণিজ্য সফরে গিয়ে ব্যবসায় সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা
অর্জন করে ফেলেছেন। ব্যবসায়ে তাঁর সততা ও আমানতদারীর কথাও মক্কার মানুষের মুখে
মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। সবার কাছে তিনি তখন আল-আমীন। তাঁর সুনামের কথা খাদীজার কানেও
পৌঁছেছে। বিশেষতঃ তাঁর ছোট ভাই-বউ সাফিয়্যার কাছে আল-আমীন মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে
বহু কথাই শুনে থাকবেন।
হযরত খাদীজা একবার কেনাবেচার জন্য সিরিয়ায় পণ্য পাঠাবার
চিন্তা করলেন। যোগ্য লোকের সন্ধান করছেন। এ প্রসঙ্গে ওয়াকিদী থেকে যারকানীর
বর্ণনাঃ ‘আবু তালিব মুহাম্মাদকে সা. ডেকে বললেনঃ ভাতিজা! আমি একজন
দরিদ্র মানুষ,
সময়টাও খুব সঙ্কটজনক।
মারাত্মক দুর্ভিক্ষের কবলে আমরা নিপতিত। আমাদের কোন ব্যবসায় বা অন্য কোন
উপায়-উপকরণ নেই। তোমার গোত্রের একটি বাণিজ্য কাফিলা সিরিয়া যাচ্ছে। খাদীজা তাঁর
পণ্যের সাথে পাঠানোর জন্য কিছু লোকের খোঁজ করছে। তুমি যদি তার কাছে যেতে, হয়তো তোমাকেই সে নির্বাচন করতো। তোমার চারিত্রিক নিষ্কলুষতা
তার জানা আছে। যদিও তোমার সিরিয়া যাওয়া আমি পছন্দ করিনে এবং ইয়াহুদীদের পক্ষ থেকে
তোমার জীবনের আশঙ্কা করি,
তবুও এমনটি না করে উপায় নেই।’ জবাবে রাসূল সা. বললেন, সম্ভবতঃ সে নিজেই লোক পাঠাবে। আবু তালিব বললেনঃ হয়তো অন্য
কাউকে সে নিয়োগ করে ফেলবে। চাচা-ভাতিজার এ সংলাপের কথা খাদীজার কানে গেল। ‘তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট লোক পাঠালেন।’ (টীকা, সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৮) উল্লেখ থাকে যে, কৈশোরে একবার রাসূল সা. চাচার সাথে সিরিয়া গিয়েছিলেন। তখন
পাদরী ‘বুহাইরা’ রাসূলুল্লাহ
সা. সম্পর্কে আবু তালিবকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন্। উপরোক্ত বর্ণনায় আবু তালিব সে
দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
খাদীজা লোক মারফত মুহাম্মাদের সা. কাছে প্রস্তাব পাঠালেন, তিনি যদি ব্যবসায়ের দায়িত্ব নিয়ে সিরিয়া যান, অন্যদের তুলনায় খাদীজা তাঁকে দ্বিগুণ মুনাফা দেবেন।
মুহাম্মাদ সা. রাজী হলেন।
খাদীজার রা. পণ্য-সামগ্রী নিয়ে তাঁর বিশ্বস্ত দাস মায়সারাকে
সঙ্গে করে মুহাম্মাদ সা. চললেন সিরিয়া। পথে এক গীর্জার পাশে একটি গাছের ছায়ায় বসে
আছেন তিনি। গীর্জার পাদ্রী এগিয়ে গেলেন মায়সারার দিকে। জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘গাছের নিচে বিশ্রামরত লোকাটি কে?’ মায়সারা বললেনঃ ‘মক্কার হারামবাসী কুরাইশ গোত্রের একটি লোক।’ পাদ্রী বললেনঃ ‘এখন এই গাছের নীচে যিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি একজন নবী ছাড়া
আর কেউ নন।’
ঐতিহাসিকরা এই পাদ্রীর নাম ‘নাসতুরা’ বলে
উল্লেখ করেছেন। (টীকা, সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৮) তবে ইবন হাজার ’আসকালানী এই পাদ্রীর নাম ‘বুহাইরা’ বলেছেন। (আল–ইসাবাঃ ৪/২৮১) তিনি আরো বলেছেন, এই বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে রাসূল সা. বসরার বাজারে গিয়েছিলেন।
তাবারী ইবন শিহাব যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. খাদীজার পণ্য নিয়ে সিরিয়া নয়, বরং ইয়ামনের এক হাবশী বাজারে গিয়েছিলেন। তবে সিরিয়া যাওয়ার
বর্ণনাটাই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। (তারীখুল উম্মাহ আল ইসলামিয়া, মুহাম্মদ আল–খিদরী বেকঃ ১/৬৪)
রাসূলুল্লাহ সা. সিরিয়ার বাজারে পণ্যদ্রব্য বিক্রী করলেন
এবং যা কেনার তা কিনলেন। তারপর মায়সারাকে সঙ্গে করে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। পথে
মায়সারা লক্ষ্য করলেন,
রাসূল সা. তাঁর উটের ওপর
সওয়ার হয়ে চলেছেন,
আর দু’জন ফিরিশতা দুপুরের প্রচণ্ড রোদে তাঁর ওপর ছায়া বিস্তার করে
রেখেছে। এভাবে মক্কায় ফিরে খাদীজার পণ্য-সামগ্রী বিক্রী করলেন। ব্যবসায়ে এবার
দ্বিগুণ অথবা দ্বিগুণের কাছাকাছি মুনাফা হলো। বাড়ী ফিরে বিশ্বস্ত ভৃত্য মায়সারা তাঁর মনিব খাদীজার
নিকট পাদ্রীর মন্তব্য এবং সফরের অলৌকিক ঘটনাবলী সবিস্তার বর্ণনা করলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৯)
হযরত খাদীজা রা. ছিলেন এক বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতি ভদ্র মহিলা।
তাঁর ধন-সম্পদ,
ভদ্রতা ও লৌকিকতায় মক্কার
সর্বস্তরের মানুষ মুগ্ধ ছিল। অনেক অভিজাত কুরাইশ যুবকই তাঁকে সহধর্মিনী হিসেবে লাভ
করার প্রত্যাশী ছিল। তিনি তাদের সকলকে প্রত্যাখ্যান করেন। মায়সারার মুখে সবকিছু শুনে
খাদীজা নিজেই রাসূলুল্লাহর সা. নিকট বিয়ের পয়গাম পাঠান। (সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৯)
বিয়ের প্রস্তাব কিভাবে এবং কেমন করে হয়েছিল সে সম্পর্কে
নানা রকম বর্ণনা রয়েছে। তবে খাদীজাই যে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর সা. নিকট
প্রস্তাবটি পেশ করেন সে ব্যাপারে সব বর্ণনা একমত।
একটি বর্ণনায় এসেছে, খাদীজা রা. নিজেই রাসূলুল্লাহর সা. সাথে কথা বলেন এবং তাঁর
পিতার নিকট প্রস্তাবটি উত্থাপন করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি
জানান এই বলে যে,
দারিদ্রের কারণে হয়তো
খাদীজার পিতা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করবেন। অবশেষে খাদীজার পিতা যখন অতিরিক্ত মদপান
করে মাতাল অবস্থায় ছিলেন তখন খাদীজা নিজেই বিষয়টি তাঁর কাছে উত্থাপন করেন এবং
সম্মতি আদায় করেন। কিন্তু সুস্থ হয়ে আবার তিনি বেঁকে বসেন। তবে খাদীজা পুনরায় তাঁর
সম্মতি আদায় করেন। (হায়াতুস সাহাবা– ২/৬৫২) অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, হযরত ইয়ালার স্ত্রী ও খাদীজার বান্ধবী ‘নাফীসা বিনতু মানিয়্যা’ এ ব্যাপারে পুরো উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম
খাদীজার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এভাবে প্রস্তাব পেশ করেনঃ ‘আপনাকে যদি ধন-সম্পদ, সৌন্দর্য ও জীবিকার নিশ্চয়তার দিকে আহ্বান জানানো হয়, আপনি কি গ্রহণ করবেন? ….এ কথাগুলি ছিল হযরত খাদীজা সম্পর্কে।
কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। নির্ধারিত তারিখে আবু তালিব, হামযাসহ রাসূলুল্লাহর সা. খান্দানের আরো কিছু ব্যক্তি
খাদীজার বাড়ী উপস্থিত হলেন। খাদীজাও তাঁর খান্দানের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে দাওয়াত
দিয়েছিলেন। সকলের উপস্থিতিতে আবু তালিব বিয়ের খুতবা পাঠ করলেন। সাহিত্যিক উৎকর্ষের
দিক দিয়ে এ খুতবা জাহিলী যুগের আরবী-গদ্য সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
পাঁচশ’
স্বর্ণমুদ্রা মোহর ধার্য হয়।
খাদীজা নিজেই উভয় পক্ষের যাবতীয় খরচ বহন করেছিলেন। তিনি দুই উকিয়া সোনা ও রুপো
রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পাঠান এবং তা দিয়ে উভয়ের পোশাক ও ওয়ালীমার বন্দোবস্ত করতে
বলেন। (হায়াতুস সাহাবা– ২/৬৫২) এভাবে হযরত খাদীজা হলেন ‘উম্মুল মুমিনীন’। এটা নবুয়াত প্রকাশের পনের বছর পূর্বের ঘটনা। সে সময় তাঁদের
উভয়ের বয়স সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতপার্থক্য থাকলেও সর্বাধিক সঠিক মতানুযায়ী
রাসূলুল্লাহর সা. বয়স ছিল পঁচিশ এবং খাদীজার চল্লিশ।
বিয়ের পনের বছর পর হযরত নবী করীম সা. নবুওয়াত লাভ করেন।
তিনি খাদীজাকে রা. সর্বপ্রথম এ বিষয়ে অবহিত করেন। পূর্ব থেকেই খাদীজা রাসূলুল্লাহর
সা. নবী হওয়া সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন। সহীহ বুখারীর ‘ওহীর সূচনা’ অধ্যায়ে একটি হাদীসে বিষয়টির বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। হযরত
আয়িশা রা. বলেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি প্রথম ওহীর সূচনা হয় ঘুমে সত্য স্বপ্নের
মাধ্যমে। স্বপ্নে যা কিছু দেখতেন তা সকাল বেলার সূর্যের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত।
তারপর নির্জনে থাকতে ভালোবাসতেন। খানাপিনা সঙ্গে নিয়ে হিরা গুহায় চলে যেতেন।
সেখানে একাধারে কয়েকদিন ইবাদতে মশগুল থাকতেন। খাবার শেষ হয়ে গেলে আবার খাদীজার
কাছে ফিরে আসতেন। খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আবার গুহায় ফিরে যেতেন। এ অবস্থায় একদিন তাঁর
কাছে সত্যের আগমণ হলো। ফিরিশতা এসে তাঁকে বললেনঃ আপনি পড়ুন।তিনি বললেনঃ ‘আমি তো পড়া-লেখার লোক নই।’ ফিরিশতা তাঁকে এমন জোরে চেপে ধরলেন যে তিনি কষ্ট অনুভব
করলেন। ছেড়ে দিয়ে আবার বললেনঃ ‘পড়ুন’। তিনি
আবারো বললেনঃ ‘আমি পড়া-লেখার লোক নই’। ফিরিশতা দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারও তাঁর সাথে প্রথমবারের মত আচরণ
করলেন। অবশেষে বললেনঃ ‘পড়ুন’ আপনার
প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিণ্ড
থেকে….’
রাসূল সা. ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে
ঘরে ফিরলেন। খাদীজাকে ডেকে বললেনঃ ‘আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও, কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও।’ তিনি ঢেকে দিলেন। তাঁর ভয় দূর হয়ে গেল। তিনি খাদীজার নিকট
পুরো ঘটনা খুলে বললেন এবং নিজের জীবনের আশংকার কথা ব্যক্ত করলেন। খাদীজা বললেনঃ না, তা কক্ষণো হতে পারে না। আল্লাহর কসম, তিনি আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার বন্ধন
সুদৃঢ়কারী,
গরীব-দুঃখীর সাহায্যকারী, অতিথিপরায়ণ ও মানুষের বিপদে সাহায্যকারী।’
অতঃপর খাদীজা রা. রাসূলুল্লাহকে সা. সংঙ্গে করে তাঁর চাচাতো
ভাই ওয়ারাকা ইবন নাওফিলের নিকট নিয়ে যান। সেই জাহিলী যুগে তিনি খৃস্টধর্ম গ্রহণ
করেছিলেন। হিব্রু ভাষায় ইনজীল কিতাব লিখতেন। তিনি বৃদ্ধ ও দৃষ্টিহীন। খাদীজা রা.
বললেনঃ ‘শুনুন তো আপনার ভাতিজা কি বলে।’ তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘ভাতিজা তোমার বিষয়টি কি?’ রাসূলুল্লাহ সা. পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। শুনে ওয়ারাকা
বললেনঃ ‘এতো সেই ‘নামূস’-আল্লাহ যাঁকে মুসার আ. নিকট পাঠিয়েছিলেন। আফসুস! সে দিন যদি
আমি জীবিত ও সুস্থ থাকতাম,
যেদিন তোমার দেশবাসী তোমাকে
দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে।’
রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস
করলেনঃ ‘এরা আমাকে দেশ থেকে বের করে দেবে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, তুমি যা নিয়ে এসেছো, যখনই কোন ব্যক্তি তা নিয়ে এসেছে, সারা দুনিয়া তাঁর বিরোধী হয়ে গেছে। যদি সে সময় পর্যন্ত আমি
বেঁচে থাকি,
তোমাকে সব ধরণের সাহায্য
করবো। (বুখারী, ১ম খণ্ড) এ ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যে ওয়ারাকার মৃত্যু হয়।
ইসলাম গ্রহণের পর হযরত খাদীজা তাঁর সকল ধন-সম্পদ তাবলীগে
দ্বীনের লক্ষ্যে ওয়াকফ করেন। রাসূল সা. ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে আল্লাহর ইবাদাত এবং
ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সংসারের সকল আয় বন্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে বাড়তে থাকে
খাদীজার দুশ্চিন্তা। তিনি ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে সব প্রতিকূল অবস্থার মুকাবিলা
করেন। আল–ইসতিয়াব গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুশরিকদের প্রত্যাখ্যান ও অবিশ্বাসের কারণে রাসূল সা. যে
ব্যথা অনুভব করতেন,
খাদীজার কাছে এলে তা দূর হয়ে
যেত। কারণ,
তিনি রাসূলকে সা. সান্ত্বনা দিতেন, সাহস ও উৎসাহ যোগাতেন। তাঁর সব কথাই তিনি বিনা দ্বিধায়
বিশ্বাস করতেন। মুশরিকদের সকল অমার্জিত আচরণ তিনি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে অত্যন্ত
হালকা ও তুচ্ছভাবে তুলে ধরতেন।’ (তাবাকাত– ৩/৭৪০)
নবুওয়াতের সপ্তম বছর মুহাররম মাসে কুরাইশরা মুসলমানদের বয়কট
করে। তাঁরা ‘শিয়াবে আবু তালিবে’ আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহর সা. সাথে খাদীজাও সেখানে
অন্তরীণ হন। প্রায় তিনটি বছর বনী হাশিম দারুণ দুর্ভিক্ষের মাঝে অতিবাহিত করে।
গাছের পাতা ছাড়া জীবন ধারণের আর কোন ব্যবস্থা তাদের ছিল না। স্বামীর সাথে খাদীজাও
হাসি মুখে সে কষ্ট সহ্য করেন। এমন দুর্দিনে হযরত খাদীজা রা. নিজের প্রভাব খাটিয়ে
বিভিন্ন উপায়ে কিছু খাদ্য খাবারের ব্যবস্থা মাঝে মাঝে করতেন। তাঁর তিন ভাতিজা-
হাকীম ইবন হিযাম,
আবুল বুখতারী ও যুময়া ইবনুল
আসওয়াদ- তাঁরা সকলে ছিলেন কুরাইশ নেতৃবর্গের অন্যতম। অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা
বিভিন্নভাবে মুসলমানদের কাছে খাদ্যশস্য পাঠানোর ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
একদিন হাকীম ইবন হিযাম তাঁর চাকরের মাধ্যমে ফুফু খাদীজার রা. কাছে কিছু গম
পাঠাচ্ছিলেন। পথে আবু জাহল বাধা দেয়। হঠাৎ আবুল বুখতারী সেখানে উপস্থিত হন। তিনি
আবু জাহলকে বললেন,
এক ব্যক্তি তাঁর ফুফুকে
সামান্য খাদ্য পাঠাচ্ছে,
তুমি তা বাধা দিচ্ছ? (সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৯২)
নামায ফরয হওয়ার হুকুম নাযিল হয়নি, হযরত খাদীজা রা. ঘরের মধ্যে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সেই
প্রথম থেকেই নামায আদায় করতেন। (তাবাকাত– ৮/১০) ইবন ইসহাক উল্লেখ করেছেন, একদিন আলী রা. দেখতে পেলেন, তাঁরা দু’জন অর্থাৎ
নবী সা. ও খাদীজা রা. নামায আদায় করছেন। আলী রা. জিজ্ঞেস করলেনঃ মুহাম্মাদ, এ কি? রাসূল সা.
তখন নতুন দ্বীনের দাওয়াত আলীর কাছে পেশ করলেন এবং একথা কাউকে বলতে নিষেধ করলেন। (হায়াতুস সাহাবা– ১/৭০) এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, উম্মাতে মুহাম্মাদীর সা. মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত খাদীজা রা.
রাসূলুল্লাহর সা. সাথে নামায আদায়ের গৌরব অর্জন করেন।
আফীক আল-কিন্দী নামক এক ব্যক্তি কিছু কেনাকাটার জন্য মক্কায়
এসেছিলেন। হযরত আব্বাসের রা. বাড়িতে অবস্থান করছিলেন তিনি। একদিন সকালে লক্ষ্য
করলেন,
এক যুবক কাবার কাছে এসে
আসমানের দিকে তাকালো। তারপর কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ালো। একজন কিশোর এসে তার পাশে
দাঁড়িয়ে গেল। তারপর এলো এক মহিলা। সেও তাদের দু’জনের পেছনে দাঁড়ালো। তারা নামায শেষ করে চলে গেল। দৃশ্যটি
আফীক কিন্দী দেখলেন। আব্বাসকে তিনি বললেনঃ ‘বড় রকমের একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে।’
আব্বাস বললেনঃ ‘হ্যাঁ’ তিনি আরো
বললেনঃ ‘এ নওজোয়ান আমার ভাতিজা মুহাম্মাদ।’ কিশোরটি আমার আরেক ভাতিজা আলী এবং মহিলাটি মুহাম্মাদের
স্ত্রী। ….আমার জানামতে দুনিয়ায় তারা তিনজনই মাত্র এই নতুন ধর্মের
অনুসারী।’ (তাবাকাতঃ ৮/১০–১১)
ইবনুল আসীর বলেন, এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মার ইজমা হয়েছে যে, হযরত খাদীজা রাসূলুল্লাহর সা. ওপর সর্বপ্রথম ঈমান আনেন।
ইসলাম গ্রহণের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল পঞ্চাশ বছর। তাঁর ইসলাম গ্রহণের প্রভাব তাঁর
পিতৃকুলের লোকদের ওপরও পড়ে। ইসলামের আবির্ভাবের সময় পিতৃকুল বনু আসাদ ইবন আবদিল
উয্যার পনের জন্য বিখ্যাত ব্যক্তি জীবিত ছিলেন। তাঁদের দশজনই ইসলাম গ্রহণ করেন।
অন্য পাঁচজন কাফির অবস্থায় বদর যুদ্ধে নিহত হন।
রাসূলুল্লাহর সা. সাথে পঁচিশ বছর দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত
করার পর নবুওয়াতের দশম বছরে দশই রামাদান পঁয়ষট্টি বছর বয়সে হযরত খাদীজা (রা)
মক্কায় ইনতিকাল করেন। জানাযা নামাযের বিধান তখনো প্রচলিত হয়নি। সুতরাং বিনা
জানাযায় তাঁকে মক্কার কবরস্তান জান্নাতুল মুয়াল্লায় দাফন করা হয়। হযরত নবী করীম
সা. নিজেই তাঁর লাশ কবরে নামান। (আল–ইসাবাঃ ৪/২৮৩)
হযরত খাদীজা রা. ওয়াফাতের অল্প কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহর সা.
বিশেষ হিতাকাঙ্ক্ষী চাচা আবু তালিব মারা যান। অবশ্য আল-ইসতিয়াবের একটি বর্ণনায় বলা
হয়েছে,
আবু তালিবের মৃত্যুর তিনদিন
পর খাদীজা ইনতিকাল করেন। বিপদে-আপদে এ চাচাই রাসূলুল্লাহকে সা. নানাভাবে সাহায্য
করতেন। রাসূলুল্লাহর সা. দুই নিকটাত্মীয়ের ওয়াফাতের কারণে মুসলিম উম্মাহ্র নিকট এ
বছরটি ‘আমুল হুয্ন’ বা শোকের বছর নামে অভিহিত হয়েছে।
হযরত খাদীজা রা. ছিলেন বহু সন্তানের জননী। প্রথম স্বামী আবু
হালার ঔরসে হালা ও হিন্দ নামে দু’ছেলে
জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী হওয়ার গৌরব
অর্জন করেন। হিন্দ বদর মতান্তরে উহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে অংশগ্রহণ করেন।
তিনি ছিলেন একজন প্রাঞ্জলভাষী বাগ্মী। উটের যুদ্ধে আলীর রা. পক্ষে শাহাদাত বরণ
করেন। দ্বিতীয় স্বামী ’আতীকের ঔরসে হিন্দা নামে এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও
ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। (শারহুল মাওয়াকিব, আল–ইসতিয়াব, হাশিয়া, সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৭) অবশ্য অন্য একট বর্ণনা মতে প্রথম পক্ষে তাঁর তিনটি সন্তান
জন্মলাভ করেন। দুই ছেলে- হিন্দ ও হারিস। হারিসকে এক কাফির কাবার রুকনে ইয়ামনীর
নিকট শহীদ করে ফেলে। এক কন্যা যয়নাব। আর দ্বিতীয় পক্ষের কন্যাটির কুনিয়াত ছিল
উম্মু মুহাম্মাদ। (দায়িরা–ই–মা’রিফ–ই–ইসলামিয়া)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. পবিত্র ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন তাঁর
ছয় সন্তান। প্রথম সন্তান হযরত কাসিম। অল্প বয়সে মক্কা শরীফে ইনতিকাল করেন। তাঁর
নাম অনুসারে রাসূলুল্লাহর সা. কুনিয়াত হয় আবুল কাসিম। মৃত্যুর পূর্বে তিনি হাঁটি
হাঁটি পা পা করে হাঁটা শিখেছিলেন। দ্বিতীয় সন্তান হযরত যয়নাব। তৃতীয় সন্তান হযরত
আবদুল্লাহ। তিনি নবুওয়াত প্রাপ্তির পর জন্মলাভ করেছিলেন, তাই ‘তাইয়্যেব
ও তাহির’
লকব লাভ করেন। অল্প বয়সে
ইনতিকাল করেন। চতুর্থ সন্তান হযরত রুকাইয়া। পঞ্চম সন্তান হযরত উম্মু কুলসুম। ষষ্ঠ
সন্তান হযরত ফাতিমা রা.। উল্লেখ্য যে, ইবরাহীম ছিলেন হযরত মারিয়ার গর্ভজাত সন্তান।
হযরত খাদীজা রা. সন্তানদের খুব আদর করতেন। আর্থিক সচ্ছলতাও
ছিল। উকবার দাসী সালামাকে মজুরীর বিনিময়ে সন্তানদের দেখাশোনার জন্য নিয়োজিত
করেছিলেন।
হযরত নবী কারীমের সা. পবিত্র স্ত্রীগণের মধ্যে হযরত খাদীজার
স্থান সর্বোচ্চ। তিনি প্রথম স্ত্রী, চল্লিশ বছর বয়সে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বিয়ে হয়। তাঁর
জীবদ্দশায় নবী করীম সা. আর কোন বিয়ে করেননি। হযরত ইবরাহীম ছাড়া রাসূলুল্লাহর সা.
সব সন্তানই তার গর্ভে পয়দা হয়েছেন।
উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজার ফজীলত ও মর্যাদা বর্ণনা করে
শেষ করা যাবে না। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, আরবের সেই ঘোর অন্ধকার দিনে কিভাবে এক মহিলা নিঃসঙ্কোচে
রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করছেন। তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ও
সংশয় নেই। সেই ওহী নাযিলের প্রথম দিনটি, ওয়ারাকার নিকট গমন এবং রাসূলুল্লাহর সা. নবী হওয়া সম্পর্কে
তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা- সবকিছুই গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়। রাসূলুল্লাহর সা.
নবুওয়াত লাভের পূর্ব থেকে খাদীজা যেন দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন- তিনি নবী হবেন। তাই
জিবরাঈলের আগমণের পর ক্ষণিকের জন্যও তার মনে কোন রকম ইতস্ততঃভাব দেখা দেয়নি। এতে
তাঁর গভীর দূরদৃষ্টি ও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নবুওয়াত লাভের
পূর্বে ও পরে সর্বদাই তিনি রাসূলুল্লাহকে সা. সম্মান করেছেন, তাঁর প্রতিটি কথা বিশ্বাস করেছেন। পঁচিশ বছরের দাম্পত্য
জীবনে মুহূর্তের জন্যও তাঁর মনে কোন প্রকার সন্দেহ দানা বাঁধতে পারেনি। সেই জাহিলী
যুগেও তিনি ছিলেন পূতঃপবিত্র। কখনো মূর্তিপূজা করেননি। নবী করীম সা. একদিন তাঁকে
বললেনঃ ‘আমি কখনো লাত-উযযার ইবাদত করবো না।’ খাদীজা বলেছিলেনঃ লাত-উয্যার কথা ছেড়ে দিন। তাদের প্রসঙ্গই
উত্থাপন করবেন না। (মুসনাদে আহমাদ– ৪/২২২)
নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর সা. ওপর প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারী এবং
তাঁর সাথে প্রথম সালাত আদায়কারীই শুধু তিনি নন। সেই ঘোর দুর্দিনে ইসলামের জন্য
তিনি যে শক্তি যুগিয়েছেন চিরদিন তা অম্লান হয়ে থাকবে। ইসলামের সেই সূচনা লগ্নে
প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. পরামর্শ দাত্রী। রাসূলুল্লাহর সা. সাথে
বিয়ের পর সমস্ত সম্পদ তিনি স্বামীর হাতে তুলে দেন। যায়িদ বিন হারিসা ছিলেন তাঁর
প্রিয় দাস। তাকেও তিনি স্বামীর হাতে তুলে দেন। রাসূলুল্লাহ সা. যায়িদকে বেশী
ভালোবাসতেন,
তাই তাঁকে খুশী করার জন্য
তাকে আযাদ করে দেন।
মক্কার একজন ধনবতী মহিলা হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজ হাতে
স্বামীর সেবা করতেন। একবার তিনি বরতনে করে রাসূলুল্লাহর সা. জন্য কিছু নিয়ে
আসছিলেন। হযরত জিবরীল আ. রাসূলকে সা. বললেন, ‘আপনি তাঁকে আল্লাহ তা’আলা ও আমার সালাম পৌঁছিয়ে দিন।’ (বুখারী)
হযরত রাসূলে করীম সা. প্রিয়তমা স্ত্রী খাদীজার রা. স্মৃতি
তাঁর মৃত্যুর পরও ভোলেননি। তাঁর মৃত্যুর পর বাড়ীতে যখনই কোন পশু জবেহ হতো, তিনি তালাশ করে তাঁর বান্ধবীদের ঘরে ঘরে গোশত পাঠিয়ে দিতেন।
হযরত আয়িশা বলেনঃ যদিও আমি খাদীজাকে রা. দেখিনি, তবুও তাঁর প্রতি আমার ঈর্ষা হতো। অন্য কারো বেলায় কিন্তু
এমনটি হতো না। কারণ,
নবী কারীম সা. সবসময় তাঁর
কথা স্মরণ করতেন।’
মাঝে মাঝে হযরত আয়িশা রা.
রাসূলুল্লাহকে সা. রাগিয়ে তুলতেন। রাসূল সা. বলতেনঃ ‘আল্লাহ আমার অন্তরে তাঁর ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’
হযরত খাদীজার রা. ওয়াফাতের পর তাঁর বোন হালা একবার রাসূলে
কারীমের সা. সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলেন। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর কণ্ঠস্বর শুনেই বলে
উঠলেন ‘হালা এসেছো’? রাসূলুল্লাহর সা. মানসপটে তখন খাদীজার স্মৃতি ভেসে উঠেছিল।
আয়িশা রা. বলে ফেললেন,
‘আপনি একজন বৃদ্ধার কথা মনে
করছেন যিনি মারা গেছেন। আল্লাহ তার চেয়ে অনেক উত্তম স্ত্রী আপনাকে দান করেছেন।’ জবাবে নবী কারীম সা. বললেনঃ ‘কক্ষনো না। মানুষ যখন আমাকে মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, সে তখন আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। সবাই যখন কাফির ছিল, তখন সে মুসলমান। কেউ যখন আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি, তখন সে আমাকে সাহায্য করেছে। তাঁর গর্ভেই আমার সন্তান
হয়েছে।’
আমরা মনে করি হযরত খাদীজার
(রা) মূল্যায়ন এর চেয়ে আর বেশী কিছু হতে পারে না।
হযরত খাদীজার (রা) ফজীলাত সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছেঃ ধরাপৃষ্ঠের সর্বোত্তম নারী মরিয়ম বিনতু ইমরান ও
খাদীজা বিনতু খুওয়াইলিদ। হযরত জিবরাঈল আ. বসে আছেন রাসূলুল্লাহর সা. কাছে। এমন সময়
খাদীজা (রা) আসলেন। জিবরাইল আ. রাসূলুল্লাহকে সা. বললেন, ‘তাঁকে মণি-মুক্তার তৈরী একটি বেহেশতী মহলের সুসংবাদ দিন।’ (বুখারী)
আবু বকর সিদ্দীক (রা)
আবদুল্লাহ নাম, সিদ্দীক ও আতীক উপাধি, ডাকনাম বা কুনিয়াত আবু বকর। পিতার নাম ’উসমান, কুনিয়াত
আবু কুহাফা। মাতার নাম সালমা এবং কুনিয়াত উম্মুল খায়ের। কুরাইশ বংশের উপর দিকে
ষষ্ঠ পুরুষ ‘মুররা’ তে গিয়ে
রাসূলুল্লাহর সা. নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহর জন্মের দু’বছরের কিছু বেশী সময় পর তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং অনুরূপ
সময়ের ব্যবধানে তাঁরা উভয়ে ইনতিকাল করেন। তাই মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল
রাসূলুল্লাহর সা. বয়সের সমান।
তিনি ছিলেন উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, পাতলা ছিপছিপে ও প্রশস্ত ললাট বিশিষ্ট। শেষ বয়সে চুল সাদা
হয়ে গিয়েছিল। মেহেন্দীর খিজাব লাগাতেন। অত্যন্ত দয়ালু ও সহনশীল ছিলেন।
তিনি ছিলেন সম্মানিত কুরাইশ ব্যক্তিবর্গের অন্যতম। জ্ঞান, মেধা, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা
ও সচ্চরিত্রতার জন্য আপামর মক্কাবাসীর শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। জাহিলী যুগে
মক্কাবাসীদের দিয়াত বা রক্তের ক্ষতিপূরণের সমুদয় অর্থ তাঁর কাছে জমা হতো। আরববাসীর
নসব বা বংশ সংক্রান্ত জ্ঞানে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ। কাব্য প্রতিভাও
ছিল। অত্যন্ত বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল-ভাষী ছিলেন। বক্তৃতা ও বাগ্মিতার খোদাপ্রদত্ত
যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন।
তিনি ছিলেন তাঁর গোত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয়, বন্ধুবৎসল ও অমায়িক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী, দানশীল ও চরিত্রবান। জাহিলী যুগেও কখনো শরাব পান করেননি।
তাঁর অমায়িক মেলামেশা,
পাণ্ডিত্য ও ব্যবসায়িক
দক্ষতার কারণে অনেকেই তাঁর সাথে বন্ধুত্ব ও সখ্যতা স্থাপন করতো। তাঁর বাড়ীতে
প্রতিদিন মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়মিত বৈঠক বসতো।
হযরত আবু বকরের পিতা আবু কুহাফা কুরাইশদের মধ্যে যথেষ্ট
মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন বয়োঃবৃদ্ধ ও সচ্ছল। তাঁর গৃহ কেবল ব্যবসা
বাণিজ্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল না, সামাজিক
কর্মকাণ্ডেও তাঁর মতামত অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করা হতো। মক্কা বিজয় পর্যন্ত
ইসলামের প্রতি তিনি আকৃষ্ট না হলেও পুত্র আবু বকরকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে রাখার
চেষ্টা করেছেন- এমন কোন প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। অবশ্য হযরত আলীকে রা. তিনি
দেখলে মাঝে মধ্যে বলতেনঃ ‘এই ছোকরারাই আমার ছেলেটিকে বিগড়ে দিয়েছে।’ মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতে হাজির হয়ে
ইসলামের ঘোষণা দেন। হিজরী ১৪ সনে প্রায় এক শ’ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। শেষ বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে
ফেলেছিলেন।
হযরত আবু বকরের মা উম্মুল খায়ের স্বামীর বহু পূর্বে মক্কায়
ইসলামের প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মক্কার ‘দারুল আরকামে’ ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। স্বামীর মত তিনিও
দীর্ঘজীবন লাভ করেন। প্রায় ৯০ বছর বয়সে ছেলেকে খিলাফতের পদে অধিষ্ঠিত রেখে ইহলোক
ত্যাগ করেন।
আবু বকর ছিলেন পিতার একমাত্র পুত্র সন্তান। অত্যন্ত আদর
যত্ন ও বিলাসিতার মধ্যে পালিত হন। শৈশব থেকে যৌবনের সূচনা পর্যন্ত পিতার উপর
নির্ভরশীল ছিলেন। বিশ বছর বয়সে পিতার ব্যবসা বাণিজ্যের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে
নেন।
শৈশব থেকে রাসূলুল্লাহর সা. সঙ্গে আবু বকরের বন্ধুত্ব ছিল।
তিনি রাসূলুল্লাহর সা. অধিকাংশ বাণিজ্য সফরের সঙ্গী ছিলেন। একবার রাসূলুল্লাহর সা.
সঙ্গে ব্যবসায় উপলক্ষে সিরিয়া যান। তখন তাঁর বয়স প্রায় আঠারো এবং রাসূলুল্লাহর সা.
বয়স বিশ। তাঁরা যখন সিরিয়া সীমান্তে, বিশ্রামের জন্য রাসূল সা. একটি গাছের নীচে বসেন। আবু বকর
একটু সামনে এগিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলেন। এক খৃস্টান পাদ্রীর সাথে তাঁর দেখা হয়
এবং ধর্ম বিষয়ে কিছু কথাবার্তা হয়। আলাপের মাঝখানে পাদ্রী জিজ্ঞেস করে, ওখানে গাছের নীচে কে? আবু বকর বললেন, এক কুরাইশ যুবক, নাম মুহাম্মাদ বিন আবদিল্লাহ। পাদ্রী বলে উঠলো, এ ব্যক্তি আরবদের নবী হবেন। কথাটি আবু বকরের অন্তরে গেঁথে
যায়। তখন থেকেই তাঁর অন্তরে রাসূলুল্লাহর সা. প্রকৃত নবী হওয়া সম্পর্কে প্রত্যয়
দৃঢ় হতে থাকে। ইতিহাসে এ পাদ্রীর নাম ‘বুহাইরা’ বা ‘নাসতুরা’ বলে
উল্লেখিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত লাভের ঘোষণায় মক্কায় হৈ চৈ পড়ে
গেল। মক্কার প্রভাবশালী ধনী নেতৃবৃন্দ তাঁর বিরোধিতায় কোমর বেঁধে লেগে যায়। কেউবা
তাঁকে মাথা খারাপ,
কেউবা জীনে ধরা বলতে থাকে।
নেতৃবৃন্দের ইঙ্গিতে ও তাদের দেখাদেখি সাধারণ লোকেরাও ইসলাম থেকে দূরে সরে থাকে।
কুরাইশদের ধনবান ও সম্মানী ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র আবু বকর রাসূলুল্লাহকে সা.
সঙ্গ দেন,
তাঁকে সাহস দেন এবং বিনা
দ্বিধায় তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনেন। এই প্রসঙ্গে রাসূল সা. বলেছেনঃ ‘আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, একমাত্র আবু বকর ছাড়া প্রত্যেকের মধ্যে কিছু না কিছু
দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করেছি।’
এভাবে আবু বকর হলেন বয়স্ক
আযাদ লোকদের মধ্যে প্রথম মুসলমান।
মুসলমান হওয়ার পর ইসলামের ভিত্তি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে তিনি রাসূলুল্লাহর
সা. সাথে দাওয়াতী কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মক্কার আশপাশের গোত্রসমূহে ইসলামের দাওয়াত
দিতেন। হজ্জ্বের মওসুমে বিভিন্ন তাঁবুতে গিয়ে লোকদের দাওয়াত দিতেন। বহিরাগত লোকদের
কাছে ইসলামের ও রাসূলের সা. পরিচয় তুলে ধরতেন। এভাবে আরববাসী রাসূলুল্লাহর সা.
প্রচারিত দ্বীন সম্পর্কে অবহিত হয়ে তাঁর ওপর ঈমান আনে। তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব ও
চেষ্টায় তৎকালীন কুরাইশ বংশের বিশিষ্ট যুবক উসমান, যুবাইর, আবদুর
রহমান,
সা’দ ও তালহার মত ব্যক্তিরা সহ আরো অনেকে ইসলাম গ্রহণ
করেছিলেন।
রাসূলুল্লাহ সা. যখন নবুওয়াতের প্রকাশ্য ঘোষণা দিলেন, আবু বকরের নিকট তখন চল্লিশ হাজার দিরহাম। ইসলামের জন্য তিনি
তাঁর সকল সম্পদ ওয়াক্ফ করে দেন। কুরাইশদের যেসব দাস-দাসী ইসলাম গ্রহণের কারণে
নিগৃহীত ও নির্যাতিত হচ্ছিল, এ অর্থ
দ্বারা তিনি সেই সব দাস-দাসী খরীদ করে আযাদ করেন। তেরো বছর পর যখন রাসূলুল্লাহর
সা. সাথে তিনি মদীনায় হিজরাত করেন তখন তাঁর কাছে এ অর্থের মাত্র আড়াই হাজার দিরহাম
অবশিষ্ট ছিল। অল্পদিনের মধ্যে অবশিষ্ট দিরহামগুলিও ইসলামের জন্য ব্যয়িত হয়। বিলাল, খাব্বাব, আম্মার, আম্মারের মা সুমাইয়্যা, সুহাইব, আবু
ফুকাইহ প্রমুখ দাস-দাসী তাঁরই অর্থের বিনিময়ে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ
করেন। তাই পরবর্তীকালে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ আমি প্রতিটি মানুষের ইহসান পরিশোধ
করেছি। কিন্তু আবু বকরের ইহসানসমূহ এমন যে, তা পরিশোধ করতে আমি অক্ষম। তার প্রতিদান আল্লাহ দেবেন। তার
অর্থ আমার উপকারে যেমন এসেছে, অন্য কারো
অর্থ তেমন আসেনি।
রাসূলুল্লাহর সা. মুখে মি’রাজের কথা শুনে অনেকেই যখন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে দোল
খাচ্ছিল,
তখন তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে
বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। হযরত হাসান রা. বলেনঃ ‘মি’রাজের কথা শুনে বহু সংখ্যক মুসলমান ইসলাম ত্যাগ করে। লোকেরা
আবু বকরের কাছে গিয়ে বলেঃ আবু বকর, তোমার বন্ধুকে তুমি বিশ্বাস কর? সে বলেছে, সে নাকি
গতরাতে বাইতুল মাকদাসে গিয়েছে, সেখানে সে
নামায পড়েছে,
অতঃপর মক্কায় ফিরে এসেছে।’
আবু বকর বললেনঃ তোমরা কি তাকে অবিশ্বাস কর? তারা বললঃ হ্যাঁ, ঐতো মসজিদে বসে লোকজনকে একথাই বলছে। আবু বকর বললেনঃ আল্লাহর
কসম,
তিনি যদি এ কথা বলে থাকেন
তাহলে সত্য কথাই বলেছেন। এতে অবাক হওয়ার কি দেখলে? তিনি তো আমাকে বলে থাকেন, তাঁর কাছে আল্লাহর কাছ থেকে ওহী আসে। আকাশ থেকে ওহী আসে
মাত্র এক মুহূর্তের মধ্যে। তাঁর সে কথাও আমি বিশ্বাস করি। তোমরা যে ঘটনায় বিস্ময়
প্রকাশ করছো এটা তার চেয়েও বিস্ময়কর। তারপর তিনি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে গিয়ে হাজির
হলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর নবী, আপনি কি জনগণকে বলছেন যে, আপনি গতরাতে বাইতুল মাকদাস ভ্রমণ করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আবু বকর বললেনঃ আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি সাক্ষ্য
দিচ্ছি,
আপনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূল।
রাসূলুল্লাহ সা. বললেনঃ হে আবু বকর, তুমি সিদ্দীক। এভাবে আবু বকর ‘সিদ্দীক’ উপাধিতে
ভূষিত হন।
মক্কায় রাসূলুল্লাহর সা. অভ্যাস ছিল প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায়
আবু বকরের বাড়ীতে গমন করা। কোন বিষয়ে পরামর্শের প্রয়োজন হলে তাঁর সাথে পরামর্শ
করা। রাসূল সা. দাওয়াত ও তাবলীগের উদ্দেশ্যে কোথাও গেলে তিনিও সাধারণতঃ সঙ্গে
থাকতেন।
মুসলমানদের ওপর মুশরিকদের অত্যাচার চরম আকার ধারণ করলে
একবার তিনি হাবশায় হিজরাত করার ইচ্ছা করেছিলেন কিন্তু ‘ইবনুদ দগিনাহ’ নামক এক গোত্রপতি তাঁকে এ সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রাখে। সে
কুরাইশদের হাত থেকে এ শর্তে নিরাপত্তা দেয় যে, আবু বকর প্রকাশ্যে সালাত আদায় করবেন না, কিন্তু দীর্ঘদিন এ শর্ত পালন করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে
দাঁড়ায়। তিনি ইবনুদ দাগনাহর নিরাপত্তা ফিরিয়ে দেন এবং অন্যান্য মুসলমান ভাইদের যে
অবস্থা হয় সন্তুষ্টচিত্তে তা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।
রাসূলুল্লাহর সা. হিজরাতের সেই কঠিন মুহূর্তে আবু বকরের
কুরবানী,
বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্য ও বন্ধুত্বের কথা ইতিহাসে চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে।
তাঁর সাহচর্যের কথা তো পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে ঘোষিত হয়েছে। ইবন ইসহাক বলেন ‘‘আবু বকর রাসূলুল্লাহর সা. কাছে হিজরাতের অনুমতি চাইলে রাসূলুল্লাহ
সা. তাঁকে বলতেনঃ তুমি তাড়াহুড়া করোনা। আল্লাহ হয়তো তোমাকে একজন সহযাত্রী জুটিয়ে
দেবেন। আবু বকর একথা শুনে ভাবতেন যে, রাসূলুল্লাহ সা. হয়তো নিজের কথাই বলছেন। তাই তিনি তখন থেকেই
দুটো উট কিনে অত্যন্ত যত্ন সহকারে পুষতে থাকেন। এই আশায় যে, হিজরাতের সময় হয়তো কাজে লাগতে পারে।’’
উম্মুল মু’মিনীন
হযরত আয়িশা রা. বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. দিনে অন্ততঃ একবার আবু বকরের বাড়ীতে
আসতেন। যে দিন হিজরাতের অনুমতি পেলেন সেদিন দুপুরে আমাদের বাড়ীতে আসলেন, এমন সময় কখনো তিনি আসতেন না। তাঁকে দেখা মাত্র আবু বকর বলে
উঠলেন,
নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। তা
নাহলে এমন সময় রাসূলুল্লাহ সা. আসতেন না। তিনি বাড়ীতে প্রবেশ করলে আবু বকর তাঁর
খাটের একধারে সরে বসলেন। আবু বকরের বাড়ীতে তখন আমি আর আমার বোন আসমা ছাড়া আর কেউ
ছিল না। রাসূলুল্লাহ সা. বললেনঃ তোমার এখানে অন্য যারা আছে তাদেরকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে
দাও। আবু বকর বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমার দুই মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। আপনার কি হয়েছে? রাসূলুল্লাহ সা. বললেনঃ আল্লাহ আমাকে হিজরাত করার অনুমতি
দিয়েছেন। আবু বকর জিজ্ঞেস করলেন, আমিও কি
সংঙ্গে যেতে পারবো?
রাসূলুল্লাহ সা. বললেনঃ
হ্যাঁ,
যেতে পারবে। আয়িশা বলেনঃ সে
দিনের আগে আমি জানতাম না যে, মানুষ
আনন্দের আতিশয্যে এত কাঁদতে পারে। আমি আবু বকরকে রা. সেদিন কাঁদতে দেখেছি। অতঃপর
আবু বকর রা. বললেনঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল! এই দেখুন, আমি এই উট দুটো এই কাজের জন্যই প্রস্তুত করে রেখেছি।’
তাঁরা আবদুল্লাহ ইবন উরায়কাতকে পথ দেখিয়ে নেয়ার জন্য ভাড়া
করে সাথে নিলেন। সে ছিল মুশরিক, তবে
বিশ্বাসভাজন। রাতের আঁধারে তাঁরা আবু বকরের বাড়ীর পেছন দরজা দিয়ে বের হলেন এবং
মক্কার নিম্নভূমিতে ‘সাওর’ পর্বতের
একটি গুহায় আশ্রয় নিলেন। হাসান বসরী রা. থেকে ইবন হিশাম বর্ণনা করেনঃ তাঁরা রাতে
সাওর পর্বতের গুহায় পৌঁছেন। রাসূলুল্লাহর সা. প্রবেশের আগে আবু বকর রা. গুহায়
প্রবেশ করলেন। সেখানে কোন হিংস্র প্রাণী বা সাপ-বিচ্ছু আছে কিনা তা দেখে নিলেন।
রাসূলুল্লাহকে সা. বিপদমুক্ত রাখার উদ্দেশ্যেই তিনি এরূপ ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
মক্কায় উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজার ওফাতের পর রাসূলকে সা. যখন আবু বকর রা.
বিমর্ষ দেখলেন,
অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আদব সহকারে
নিজের অল্পবয়স্কা কন্যা আয়িশাকে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বিয়ে দেন। মোহরের অর্থও
নিজেই পরিশোধ করেন।
হিজরাতের পর সকল অভিযানেই তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে
অংশগ্রহণ করেন। কোন একটি অভিযানেও অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হননি।
তাবুক অভিযানে তিনি ছিলেন মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী। এ
অভিযানের সময় রাসূলুল্লাহর সা. আবেদনে সাড়া দিয়ে বাড়ীতে যা কিছু অর্থ-সম্পদ ছিল
সবই তিনি রাসূলুল্লাহর সা. হাতে তুলে দেন। আল্লাহর রাসূল সা. জিজ্ঞেস করেন, ‘ছেলে-মেয়েদের জন্য বাড়ীতে কিছু রেখেছো কি?’ জবাব দিলেন, ‘তাদের জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলই যথেষ্ট।’
মক্কা বিজয়ের পর নবম হিজরীতে প্রথম ইসলামী হজ্জ আদায়
উপলক্ষে রাসূলুল্লাহ সা. আবু বকরকে রা. ‘আমীরুল হজ্ব’ নিয়োগ করেন। রাসূলুল্লাহর সা. অন্তিম রোগ শয্যায় তাঁরই
নির্দেশে মসজিদে নববীর নামাযের ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। মোটকথা, রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় আবু বকর রা. তাঁর উযীর ও
উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন।
রাসূলূল্লাহর সা. ওফাতের পর আবু বকর রা. তাঁর স্থলাভিষিক্ত
হন। ‘খলীফাতু রাসূলিল্লাহ’- এ লকবটি কেবল তাঁকেই দেওয়া হয়। পরবর্তী খলীফাদের ‘আমীরুল মু’মিনীন’ উপাধি দেওয়া হয়েছে।
ব্যবসায় ছিল তাঁর পেশা। ইসলাম-পূর্ব যুগে কুরাইশদের এক
ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পরেও জীবিকার প্রয়োজনে এ পেশা চালিয়ে যেতে
থাকেন। তবে খলিফা হওয়ার পর খিলাফতের গুরু দায়িত্ব কাঁধে পড়ায় ব্যবসার পাট চুকাতে
বাধ্য হন। হযরত ’উমার ও আবু উবাইদার পীড়াপীড়িতে মজলিসে শূরার সিদ্ধান্ত
মুতাবিক প্রয়োজন অনুপাতে ‘বাইতুল মাল’ থেকে ন্যূনতম ভাতা গ্রহণ করতে স্বীকৃত হন। যার পরিমাণ ছিল
বাৎসরিক আড়াই হাজার দিরহাম। তবে মৃত্যুর পূর্বে তাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি
বিক্রি করে ‘বাইতুলমাল’ থেকে
গৃহীত সমুদয় অর্থ ফেরতদানের নির্দেশ দিয়ে যান।
রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের সংবাদে সাহাবামণ্ডলী যখন সম্পূর্ণ
হতভম্ব,
তাঁরা যখন চিন্তাই করতে
পারছিলেন না,
রাসূলের সা. ওফাত হতে পারে, এমনকি হযরত ’উমার রা. কোষমুক্ত তরবারি হাতে নিয়ে ঘোষণা করে বসেন- ‘যে বলবে রাসূলের সা. ওফাত হয়েছে তাঁকে হত্যা করবো।’ এমনই এক ভাব-বিহ্বল পরিবেশেও আবু বকর রা. ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়
ও অবিচল। সমবেত জনতাকে লক্ষ্য করে তিনি ঘোষণা করেনঃ ‘যারা মুহাম্মাদের ইবাদাত করতে তারা জেনে রাখ, মুহাম্মাদ মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু যারা আল্লাহর ইবাদত কর
তারা জেনে রাখ আল্লাহ চিরঞ্জীব- তাঁর মৃত্যু নেই।’ তারপর এ আয়াত পাঠ করেনঃ ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল ছাড়া আর কিছু নন। তাঁর পূর্বে বহু
রাসূল অতিবাহিত হয়েছে। তিনি যদি মারা যান বা নিহত হন তাহলে তোমরা কি পেছনে ফিরে
যাবে?
যারা পেছনে ফিরে যাবে তারা
আল্লাহর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। যারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শিগগিরই আল্লাহ তাদের
প্রতিদান দেবেন।’ (সূরা আলে ইমরান–১৪৪) আবু বকরের মুখে এ আয়াত শুনার সাথে সাথে লোকেরা যেন সম্বিত
ফিরে পেল। তাদের কাছে মনে হল এ আয়াত যেন তারা এই প্রথম শুনছে। এভাবে রাসূলুল্লাহর
সা. ইনতিকালের সাথে সাথে প্রথম যে মারাত্মক সমস্যাটি দেখা দেয়, আবু বকরের রা. দৃঢ় হস্তক্ষেপে তার পরিসমাপ্তি ঘটে।
রাসূলুল্লাহর সা. কাফন-দাফন তখনো সম্পন্ন হতে পারেনি। এরই
মধ্যে তাঁর স্থলাভিষিক্তির বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করলো। মদীনার জনগণ, বিশেষত আনসাররা ‘সাকীফা বনী সায়েদা’ নামক স্থানে সমবেত হলো। আনসাররা দাবী করলো, যেহেতু আমরা রাসূলুল্লাহকে সা. আশ্রয় দিয়েছি, নিজেদের জান-মালের বিনিময়ে দুর্বল ইসলামকে সবল ও শক্তিশালী
করেছি,
আমাদের মধ্য থেকে কাউকে
রাসূলুল্লাহর সা. স্থলাভিষিক্ত করতে হবে। মুহাজিরদের কাছে এ দাবী গ্রহণযোগ্য হলো
না। তারা বললোঃ ইসলামের বীজ আমরা বপন করেছি এবং আমরাই তাতে পানি সিঞ্চন করেছি।
সুতরাং আমরাই খিলাফতের অধিকতর হকদার। পরিস্থিতি ভিন্নদিকে মোড় নিল। আবু বকরকে রা.
ডাকা হল। তিনি তখন রাসূলুল্লাহর সা. পবিত্র মরদেহের নিকট। তিনি উপস্থিত হয়ে
ধীর-স্থিরভাবে কথা বললেন। তাঁর যুক্তি ও প্রমাণের কাছে আনসাররা নতি স্বীকার করলো।
এভাবে রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের পর দ্বিতীয় যে সমস্যাটি দেখা দেয়, আবু বকরের রা. বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায় তারও সুন্দর সমাধান হয়ে
যায়।
আবু বকর খলীফা নির্বাচিত হলেন। খলীফা হওয়ার পর সমবেত
মুহাজির ও আনসারদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেনঃ ‘আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমাকে খলীফা বানানো হয়েছে। আল্লাহর
কসম,
আমি চাচ্ছিলাম, আপনাদের মধ্য থেকে অন্য কেউ এ দায়িত্ব গ্রহণ করুক। আমি
স্মরণ করিয়ে দিতে চাই,
আপনারা যদি চান আমার আচরণ
রাসূলুল্লাহর সা. আচরণের মত হোক, তাহলে
আমাকে সেই পর্যায়ে পৌঁছার ব্যাপারে অক্ষম মনে করবেন। তিনি ছিলেন নবী। ভুলত্রুটি
থেকে ছিলেন পবিত্র। তাঁর মত আমার কোন বিশেষ মর্যাদা নেই। আমি একজন সাধারণ মানুষ।
আপনাদের কোন একজন সাধারণ ব্যক্তি থেকেও উত্তম হওয়ার দাবী আমি করতে পারিনে। ….আপনারা যদি দেখেন আমি সঠিক কাজ করছি, আমার সহায়তা করবেন। যদি দেখেন আমি বিপথগামী হচ্ছি, আমাকে সতর্ক করে দেবেন। তাঁর সেই নীতিনির্ধারণী সংক্ষিপ্ত
প্রথম ভাষণটি চিরকাল বিশ্বের সকল রাষ্ট্রনায়কদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
তাঁর চরিত্রের সীমাহীন দৃঢ়তার আর এক প্রকাশ ঘটে
রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের অব্যবহিত পরে উসামা ইবন যায়িদের বাহিনীকে পাঠানোর
মাধ্যমে। রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের অল্প কিছুদিন আগে মুতা অভিযানে শাহাদাত প্রাপ্ত
যায়িদ ইবন হারিসা,
জাফর ইবন আবী তালিব ও
আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার রা. রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য একটি বাহিনী প্রস্তুত
করেন। এ বাহিনীর কমাণ্ডার নিযুক্ত করেন নওজোয়ান উসামা ইবন যায়িদকে। রাসূলুল্লাহর
সা. নির্দেশে উসামা তাঁর বাহিনীসহ সিরিয়ার দিকে রওয়ানা হলেন। তাঁরা মদীনা থেকে বের
হতেই রাসূলুল্লাহ সা. অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁরা মদীনার উপকণ্ঠে শিবির স্থাপন করে
রাসূলুল্লাহ সা. অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁরা মদীনার উপকণ্ঠে শিবির স্থাপন করে রাসূলুল্লাহর
সা. রোগমুক্তির প্রতীক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু এ রোগেই রাসূল সা. ইনতিকাল করেন। আবু
বকর রা. খলীফা হলেন। এদিকে রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের সংবাদের আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন
দিকে নানা অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। কেউবা ইসলাম ত্যাগ করে, কেউবা যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়, আবার কেউবা নবুওয়াত দাবী করে বসে। এমনি এক চরম অবস্থায়
অনেকে পরামর্শ দিলেন উসামার বাহিনী পাঠানোর ব্যাপারটি স্থগিত রাখতে। কিন্তু আবু
বকর রা. অত্যন্ত কঠোরভাবে এ পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি যদি এ বাহিনী পাঠাতে
ইতস্ততঃ করতেন বা বিলম্ব করতেন তাহলে খিলাফতের দায়িত্ব লাভের পর এটা হতো
রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশের প্রথম বিরুদ্ধাচরণ। কারণ, অন্তিম রোগশয্যায় তিনি উসামার বাহিনীকে যাত্রার নির্দেশ
দিয়েছিলেন।
আবু বকর রা. উসামার বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন।
তখন আনসারদের একটি দল দাবী করলেন, তাহলে
অন্ততঃ উসামাকে কমাণ্ডরের পদ থেকে সরিয়ে অন্য কোন বয়স্ক সাহাবীকে তাঁর স্থলে নিয়োগ
করা হোক। উল্লেখ্য যে,
তখন উসামার বয়স মাত্র বিশ
বছর। সকলের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি হযরত উমার উপস্থাপন করলেন। প্রস্তাব শুনে আবু বকর
রা. রাগে ফেটে পড়লেন। তিনি উমারের রা. দাড়ি মুট করে বললেনঃ ‘রাসূলুল্লাহ সা. যাকে নিয়োগ করেছেন আবু বকর তাকে অপসারণ
করবে?’
এভাবে এ প্রস্তাব তিনি
প্রতাখ্যান করেন।
হযরত উমারও ছিলেন উসামার এ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত একজন সৈনিক।
অথচ নতুন খলিফার জন্য তখন তাঁর মদীনায় থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। খলীফা ইচ্ছা করলে
তাঁকে নিজেই মদীনায় থেকে যাওয়ার নির্দেশ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি উসামার ক্ষমতায়
হস্তক্ষেপ না করে তাঁর কাছে আবেদন জানালেন উমারকে মদীনায় রেখে যাওয়ার জন্য। উসামা
খলীফার আবেদন মঞ্জুর করলেন। কারণ, আবু বকর
বুঝেছিলেন উসামার নিয়োগকর্তা খোদ রাসূলুল্লাহ সা.। সুতরাং এ ক্ষেত্রে উসামার
ক্ষমতা তাঁর ক্ষমতার ওপরে। এভাবে আবু বকর রা. রাসূলুল্লাহর আদেশ যথাযথভাবে
বাস্তবায়ন করেন এবং তাঁর সামান্যতম বিরুদ্ধাচরণ থেকেও বিরত থাকেন।
রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের পর আবাস ও জুবইয়ান গোত্রদ্বয়
যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। বিষয়টি নিয়ে খলীফার দরবারে পরামর্শ হয়। সাহাবীদের
অনেকেই তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান না চালানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু আবু বকর রা.
অটল। তিনি বললেনঃ ‘আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহর সা. যুগে উটের যে বাচ্চাটি যাকাত পাঠানো হতো
এখন যদি কেউ তা দিতে অস্বীকার করে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবো।’
কিছু লোক নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার ছিল। আবু বকর রা. অসীম
সাহস ও দৃঢ়তা সহকারে এসব ভণ্ড নবীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ইসলামের বিরুদ্ধে
সকল ষড়যন্ত্র নস্যাত করে দেন। তাই ইতিহাসবিদরা মন্তব্য করেছেনঃ আল্লাহর সাহায্য ও
সহায়তার পর যদি আবু বকরের এ দৃঢ়তা না হতো, মুসলিম জাতির ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো।
এমনটি সম্ভব হয়েছে এজন্য যে, হযরত আবু বকরের রা. স্বভাবে দু’টি পরস্পরবিরোধী গুণের সমাবেশ ঘটেছিল, সীমাহীন দৃঢ়তা ও কোমলতা। এ কারণে তাঁর চরিত্রে সর্বদা একটা
ভারসাম্য বিরাজমান ছিল। কোন ব্যক্তির স্বভাবে যদি এ দু’টি গুণের কেবল একটি বর্তমান থাকে এবং অন্যটি থাকে অনুপস্থিত, তখন তার চরিত্রের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভবনা থাকে।
কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে এ দু’টি গুণ
তাঁর চরিত্রে সমানভাবে বিদ্যমান ছিল। হযরত আবু বকর রা. যদিও মুসলমানদের নেতা ও
খলীফা ছিলেন,
তবুও তাঁর জীবন ছিল খুব
অনাড়ম্বর। খলীফা হওয়া সত্ত্বেও মদীনার অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে জনগণের অবস্থা জানতেন
এবং তাদের ব্যক্তিগত কাজও সময় সময় নিজ হাতে করে দিতেন। হযরত উমার রা. বলেনঃ ‘আমি প্রতিদিন সকালে এক বৃদ্ধার বাড়ীতে তার ঘরের কাজ করে
দিতাম। প্রতিদিনের মত একদিন তার বাড়ীতে উপস্থিত হলে বৃদ্ধা বললেনঃ আজ কোন কাজ নেই।
এক নেককার ব্যক্তি তোমার আগেই কাজগুলি শেষ করে গেছে। হযরত উমার পরে জানতে পারেন, সেই নেককার লোকটি হযরত আবু বকর রা.। খলীফা হওয়া সত্ত্বেও
এভাবে এক অনাথ বৃদ্ধার কাজ করে দিয়ে যেতেন। হযরত আবু বকর রা. মাত্র আড়াই বছরের মত
খিলাফত পরিচালনা করেন। তবে তাঁর এ সময়টুকু ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
বলে বিবেচিত হয়। রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের পর তাঁর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অবদান
হলো,
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি
বজায় রাখা। আরবের বিদ্রোহসমূহ নির্মূল করা। রাষ্ট্র ও সরকারকে তিনি এত মজবুত
ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন যে মুসলমানরা ইরান ও রোমের মত দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে
যুদ্ধ ঘোষণা করতে সাহসী হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে তাদের বহু অঞ্চল দখল করে নেয়।
হযরত আবু বকরের রা. আরেকটি অবদান পবিত্র কুরআনের সংকলন ও
সংরক্ষণ। তাঁর খিলাফতকালের প্রথম অধ্যায়ে আরবের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয়।
সেইসব বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে কয়েকশত হাফেজে কুরআন শাহাদাত বরণ করেন। শুধুমাত্র
মুসায়লামা কাজ্জাবের সাথে যে যুদ্ধ হয় তাতেই সাত শ’ হাফেজ শহীদ হন। অতঃপর হযরত উমারের পরামর্শে হযরত আবু বকর
রা. সম্পূর্ণ কুরআন একস্থানে গ্রন্থাকারে সংকলন করেন এবং কপিটি নিজের কাছে সংরক্ষণ
করেন। ইতিহাসে কুরআনের এই আদি কপিটি ‘মাসহাফে সিদ্দীকী’ নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে হযরত ‘উসমানের রা. যুগে কুরআনের যে কপিগুলি করা হয় তা মূলতঃ ‘মাসহাফে সিদ্দীকীর’ অনুলিপি মাত্র।
পবিত্র কুরআন ও রাসূলের বাণীতে আবু বকরের সীমাহীন মর্যাদা ও
সম্মানের কথা বহুবার বহু স্থানে ঘোষিত হয়েছে।
হযরত আবু বকর রা. রাসূলুল্লাহ সা. থেকে হাদীস বর্ণনা
করেছেন। আল্লামা জাহাবী ‘তাজকিরাতুল হুফফাজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক। অত্যধিক
সতর্কতার কারণে তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অন্যদের তুলনায় খুব কম। উমার, উসমান, আবদুর
রহমান ইবন আউফ,
ইবন মাসউদ, ইবন উমার, ইবন আমর, ইবন আব্বাস, হুজাইফা, যায়িদ ইবন
সাবিত,
উকবা, মা’কাল,
আনাস, আবু হুরাইরা, আবু উমামা, আবু
বারাযা,
আবু মুসা, তাঁর দু’কন্যা
আয়িশা ও আসমা প্রমুখ সাহাবী তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। বিশিষ্ট তাবেয়ীরাও
তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন।
১৩ হিজরীর ৭ জমাদিউল উখরা হযরত আবু বকর রা. জ্বরে আক্রান্ত
হন। ১৫ দিন রোগাক্রান্ত থাকার পর হিজরী ১৩ সনের ২১ জামাদিউল উখরা মুতাবিক ৬৩৪
খৃস্টাব্দের আগস্ট মাসে ইনতিকাল করেন। হযরত আয়িশার রা. হুজরায় রাসূলুল্লাহর সা.
পাশে একটু পূব দিকে তাঁকে দাফন করা হয়। তিনি দু’বছর তিন মাস দশ দিন খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন।
’উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)
নাম ’উমার, লকব ফারুক এবং কুনিয়াত আবু হাফ্স। পিতা খাত্তাব ও মাতা
হান্তামা। কুরাইশ বংশের আ’দী গোত্রের লোক। ’উমারের অষ্টম উর্ধ্ব পুরুষ কা’ব নামক ব্যক্তির মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সা. নসবের সাথে তাঁর
নসব মিলিত হয়েছে। পিতা খাত্তাব কুরাইশ বংশের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। মাতা ‘হানতামা’ কুরাইশ
বংশের বিখ্যাত সেনাপতি হিশাম ইবন মুগীরার কন্যা। ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি
খালিদ বিন ওয়ালিদ এই মুগীরার পৌত্র। মক্কার ‘জাবালে ’আকিব’- এর পাদদেশে ছিল জাহিলী যুগে বনী ‘আ’দী ইবন কা’বের বসতি।
এখানেই ছিল হযরত উমারের বাসস্থান। ইসলামী যুগে ’উমারের নাম অনুসারে পাহাড়টির নাম হয় ‘জাবালে ’উমার’- ’উমারের পাহাড়। (তাবাকাতে ইবন সা’দ ৩/৬৬) ’উমারের চাচাত ভাই, যায়িদ বিন নুফাইল। হযরত রাসূলে কারীমের আবির্ভাবের পূর্বে
নিজেদের বিচার-বুদ্ধির সাহায্যে মূর্তিপূজা ত্যাগ করে জাহিলী আরবে যাঁরা
তাওহীদবাদী হয়েছিলেন,
যায়িদ তাঁদেরই একজন।
রাসূলুল্লাহর সা. জন্মের তের বছর পর তাঁর জন্ম। মৃত্যুকালেও
তাঁর বয়স হয়েছিল রাসূলুল্লাহর সা. বয়সের সমান ৬৩ বছর। তবে তাঁর জন্ম ও ইসলাম
গ্রহণের সন সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
গায়ের রং উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, টাক মাথা, গন্ডদেশ
মাংসহীন,
ঘন দাড়ি, মোঁচের দু’পাশ লম্বা
ও পুরু এবং শরীর দীর্ঘাকৃতির। হাজার মানুষের মধ্যেও তাঁকেই সবার থেকে লম্বা দেখা
যেত।
তাঁর জন্ম ও বাল্য সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। ইবন
আসাকির তাঁর তারীখে ’আমর ইবন ’আস রা.
হতে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তাতে জানা যায়, একদিন ’আমর ইবন ’আস কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবসহ বসে আছে, এমন সময় হৈ চৈ শুনতে পেলেন। সংবাদ নিয়ে জানতে পেলেন, খাত্তাবের একটি ছেলে হয়েছে। এ বর্ণনার ভিত্তিতে মনে হয়, হযরত ’উমারের
জন্মের সময় বেশ একটা আনন্দোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
তাঁর যৌবনের অবস্থাটাও প্রায় অনেকটা অজ্ঞাত। কে জানতো যে এই
সাধারণ একরোখা ধরনের যুবকটি একদিন ‘ফারুকে আযমে’ পরিণত হবেন। কৈশোরে ’উমারের পিতা তাঁকে উটের রাখালী কাজে লাগিয়ে দেন। তিনি
মক্কার নিকটবর্তী ‘দাজনান’ নামক
স্থানে উট চরাতেন। তিনি তাঁর খিলাফতকালে একবার এই মাঠ অতিক্রমকালে সঙ্গীদের কাছে
বাল্যের স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবেঃ ‘এমন এক সময় ছিল যখন আমি পশমী জামা পরে এই মাঠে প্রখর রোদে
খাত্তাবের উট চরাতাম। খাত্তাব ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও নীরস ব্যক্তি। ক্লান্ত হয়ে
একটু বিশ্রাম নিলে পিতার হাতে নির্মমভাবে প্রহৃত হতাম। কিন্তু আজ আমার এমন দিন
এসেছে যে,
এক আল্লাহ ছাড়া আমার উপর
কতৃত্ব করার আর কেউ নেই।’ (তাবাকাতঃ ৩/২৬৬–৬৭)
যৌবনের প্রারম্ভেই তিনি তৎকালীন অভিজাত আরবদের
অবশ্য-শিক্ষণীয় বিষয়গুলি যথাঃ যুদ্ধবিদ্যা, কুস্তি, বক্তৃতা ও
বংশ তালিকা শিক্ষা প্রভৃতি আয়ত্ত করেন। বংশ তালিকা বা নসবনামা বিদ্যা তিনি লাভ
করেন উত্তরাধিকার সূত্রে। তাঁর পিতা ও পিতামহ উভয়ে ছিলেন এ বিদ্যায় বিশেষ
পারদর্শী। তিনি ছিলেন তাঁর যুগের একজন শ্রেষ্ঠ কুস্তিগীর। আরবের ‘উকায’ মেলায়
তিনি কুস্তি লড়তেন। আল্লামা যুবইয়ানী বলেছেনঃ ‘উমার ছিলেন এক মস্তবড় পাহলোয়ান।’ তিনি ছিলেন জাহিলী আরবের এক বিখ্যাত ঘোড় সওয়ার। আল্লামা
জাহিয বলেছেনঃ ‘উমার ঘোড়ায় চড়লে মনে হত, ঘোড়ার চামড়ার সাথে তাঁর শরীর মিশে গেছে।’ (আল–বায়ান ওয়াত তাবয়ীন) তাঁর মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। তৎকালীন খ্যাতনামা কবিদের
প্রায় সব কবিতাই তাঁর মুখস্থ ছিল। আরবী কাব্য সমালোচনার বিজ্ঞান ভিত্তিক ধারার
প্রতিষ্ঠাতা প্রকৃতপক্ষে তিনিই। ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর মতামতগুলি পাঠ করলে
এ বিষয়ে তাঁর যে কতখানি দখল ছিল তা উপলব্ধি করা যায়। বাগ্মিতা ছিল তাঁর সহজাত গুণ।
যৌবনে তিনি কিছু লেখাপড়া শিখেছিলেন। বালাজুরী লিখেছেনঃ ‘রাসূলে কারীমের সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় গোটা কুরাইশ বংশে
মাত্র সতের জন লেখা-পড়া জানতেন। তাদের মধ্যে ’উমার একজন।
ব্যবসা বাণিজ্য ছিল জাহিলী যুগের আরব জাতির সম্মানজনক পেশা।
’উমারও ব্যবসা শুরু করেন এবং তাতে যথেষ্ট উন্নতিও করেন।
ব্যবসা উপলক্ষে অনেক দূরদেশে গমন এবং বহু জ্ঞানী-গুণী সমাজের সাথে মেলামেশার সুযোগ
লাভ করেন। মাসউদী বলেনঃ ’উমার রা. জাহিলী যুগে সিরিয়া ও ইরাকে ব্যবসা উপলক্ষে ভ্রমণে
যেতেন। ফলে আরব ও আজমের অনেক রাজা-বাদশার সাথে মেলামেশার সুযোগ লাভ করেন।’ শিবলী নু’মানী
বলেনঃ ‘জাহিলী যুগেই ’উমারের সুনাম সমগ্র আরবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কারণে কুরাইশরা
সর্বদা তাঁকেই দৌত্যগিরিতে নিয়োগ করতো। অন্যান্য গোত্রের সাথে কোন বিরোধ সৃষ্টি
হলে নিষ্পত্তির জন্য তাঁকেই দূত হিসেবে পাঠানো হত।’ (আল–ফারুকঃ ১৪)

No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com