সাপ-বিচ্ছু প্রসঙ্গে
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
মহান আল্লাহর অন্যতম সৃষ্টি সাপ। পবিত্র কোরআনেও সাপের
আলোচনা এসেছে। মহান আল্লাহ ফেরাউনের জাদুকর বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজ পয়গম্বরকে
সহযোগিতা করার জন্য তাঁর হাতের লাঠিকে মুজিজাস্বরূপ সাপ বানিয়ে দিয়েছিলেন।আবার হাদীসে এসেছে,
যারা তাদের সম্পদের জাকাত
আদায় করবে না,
পরকালে তাদের সম্পদ সাপ হয়ে
তাদের দংশন করবে।
আদি পিতা আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.)-কে ধোঁকা দেওয়ার জন্য ইবলিস
সাপের পেটে করে জান্নাতে প্রবেশ করেছিল—এ কথা ভিত্তিহীন। (আল ইসরাঈলিয়্যাত ওয়াল মাউজুআত ফি কুতুবিত
তাফাসির :১৭৮-১৮০;
আলবাদ্উ ওয়াত তারিখ, মুতাহহির ইবনে তাহের আলমাকদিসি : ২/৯৫-৯৬)
কেউ কেউ মনে করে সাপ অভিশপ্ত প্রাণী। কিন্তু প্রকৃত কথা হলো
সাপ-বিচ্ছু প্রকৃতির উপাদান। এগুলোর ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে।
পরিবেশের
ভারসাম্য রক্ষায় অন্যান্য প্রাণীর মতো সাপেরও বহু ভূমিকা আছে। ভূমিকা রয়েছে
অর্থনীতিতেও। কিন্তু কখনো কখনো এদের আক্রমণে মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতিবছর আনুমানিক ৫৪ লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার
হয়। এর মধ্যে
প্রায় লাখের মতো মানুষ মারা যায়, আর চার
লাখ মানুষ সাপের কামড়ে পঙ্গু ও অঙ্গবিকৃতির শিকার হয়। (বিবিসি)
তাই নবীজি (সা.) সাপের ব্যাপারে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। কখনো
এদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে এদের হত্যার করার অনুমতি দিয়েছেন।
এমনকি নামাজের ভেতরও যদি অনিষ্টকারী সাপের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, তবে তখন সাপের অনিষ্ট থেকে বাঁচতে আগে সাপ সামলানোর পরামর্শ
দিয়েছেন। হাদীস শরিফে ইরশাদ হয়েছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ
رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " اقْتُلُوا
الْأَسْوَدَيْنِ فِي الصَّلَاةِ: الْحَيَّةَ، وَالْعَقْرَبَ "
আবু
হুরায়রা (রা.) বলেন,
‘তোমরা নামাজরত অবস্থায়ও কালো
সাপ ও কালো বিচ্ছু হত্যা করো।’ (আবু
দাউদ:৯২১)
কেননা এ দুটি প্রাণীই বিষাক্ত, যেকোনো মুহূর্তে তারা মানুষের জীবনহানি করার মতো ক্ষতিও করে
ফেলতে পারে। তাই কখনো তারা মানুষের খুব কাছাকাছি চলে এলে এবং তাদের দ্বারা
আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে অবশ্যই তাদের হত্যা করার সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে যেসব সাপের মানুষের ক্ষতি করার প্রবল আশঙ্কা
রয়েছে।
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنِ ابْنِ عُمَرَ
رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، أَنَّهُ سَمِعَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ يَخْطُبُ عَلَى المِنْبَرِ يَقُولُ: «اقْتُلُوا
الحَيَّاتِ، وَاقْتُلُوا ذَا الطُّفْيَتَيْنِ وَالأَبْتَرَ، فَإِنَّهُمَا
يَطْمِسَانِ البَصَرَ، وَيَسْتَسْقِطَانِ الحَبَلَ»
ইবনে উমর
(রা.)থেকে বর্ণিত,
তিনি নবী (সা.)-কে মিম্বারের
ওপর ভাষণ দানের সময় বলতে শুনেছেন, ‘সাপ মেরে
ফেল,
বিশেষ করে মেরে ফেল ওই সাপ, যার মাথার ওপর দুটো সাদা রেখা আছে এবং লেজ কাটা সাপ। কারণ এ
দুই প্রকারের সাপ চোখের জ্যোতি নষ্ট করে দেয় ও গর্ভপাত ঘটায়।’ (বুখারী:৩২৯৭)
সুতরাং কোনো
ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা না দেখা দিলে নির্বিচারে সাপ হত্যা ইসলামের দৃষ্টিতে অনুমোদিত
নয়।
অপর হাদীসে এসেছে,
قَالَ عَبْدُ
اللَّهِ: فَبَيْنَا أَنَا أُطَارِدُ حَيَّةً لِأَقْتُلَهَا، فَنَادَانِي أَبُو
لُبَابَةَ: لاَ تَقْتُلْهَا، فَقُلْتُ: إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدْ أَمَرَ بِقَتْلِ الحَيَّاتِ قَالَ: إِنَّهُ نَهَى بَعْدَ
ذَلِكَ عَنْ ذَوَاتِ البُيُوتِ، وَهِيَ العَوَامِرُ،
আবদুল্লাহ
(রা.) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, একদা আমি একটি সাপ মারার জন্য তার পিছু ধাওয়া করছিলাম। এমন
সময় আবু লুবাবা (রা.) আমাকে ডেকে বলেন, সাপটি মেরো না। তখন আমি বললাম, আল্লাহর রাসুল (সা.) সাপ মারার জন্য আদেশ দিয়েছেন। তিনি
বলেন,
এরপরে নবী (সা.) যে সাপ ঘরে
বাস করে,
যাকে ‘আওয়ামির’ বলা হয়, এমন সাপ মারতে নিষেধ করেছেন। (বুখারী:৩২৯৮)
এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকার তথ্যমতে, বিশ্বে প্রায় তিন হাজার প্রজাতির সাপ আছে। বাংলাপিডিয়ার
তথ্যমতে,
বাংলাদেশে প্রায় ৯০ প্রজাতির
সাপ আছে,
যার তিন-চতুর্থাংশই নির্বিষ।
এগুলো ফসলের ক্ষতিকর প্রাণীদের খেয়ে বেঁচে থাকে। আবার বিষাক্ত সাপের বিষও জীবন
রক্ষাকারী ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বিশ্ব অর্থনীতিতে সাপের বিষের বাজার বেশ বড়, এবং এটি অত্যন্ত মূল্যবান হওয়ায় বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিকভাবেও
অনেকে সাপ পালন করেন। গণমাধ্যমের তথ্যমতে, প্রতি লিটার সাপের বিষের দাম কোটি কোটি টাকা। তাই গণহারে সব
সাপ হত্যা করা থেকেও বিরত থাকতে হবে।
ক্ষেত্রবিশেষে সাপ যেমন বিপদ, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাপ সম্পদ। তাই এ ব্যাপারে যেমন
সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে,
ক্ষতি করার আশঙ্কা দেখা দিলে
আত্মরক্ষার্থে তাদের প্রতিহত করতে হবে। তেমনি নিরাপদ দূরত্বে থাকলে তাদের ক্ষতি
করা থেকেও বিরত থাকতে হবে। এবং সর্বদা অনিষ্টকারী প্রাণী থেকে মহান আল্লাহর কাছে
আশ্রয়ও চাইতে হবে।
হাদীস শরিফে এসেছে,
عَنْ أَبِي
هُرَيْرَةَ، قَالَ: أُتِيَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: بِلَدِيغٍ
لَدَغَتْهُ عَقْرَبٌ، قَالَ: فَقَالَ: «لَوْ قَالَ
أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ لَمْ يُلْدَغْ»
أَوْ «لَمْ يَضُرَّهُ»
একবার বিচ্ছু দ্বারা দংশিত
এক ব্যক্তিকে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাছে আনা হলে তিনি বলেন, সে যদি বলত, ‘আউজু বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন শাররি মা খলাক’, অর্থ ‘আল্লাহর
পরিপূর্ণ কালামের মাধ্যমে তাঁর সৃষ্ট সব প্রাণীর অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই’, তাহলে তাকে দংশন করতে পারত না অথবা তার ক্ষতি করতে পারত না।
(আবু দাউদ:৩৮৯৯)
বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে
মহান আল্লাহর প্রিয় হাবিব (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সকাল ও সন্ধ্যা এই দোয়া ৩ বার পড়বে, মহান আল্লাহ তাকে সব প্রাণী, বিশেষ করে সাপ, বিচ্ছু প্রভৃতি বিষাক্ত ও কষ্টদায়ক প্রাণীর অনিষ্ঠ থেকে
রক্ষা করবেন। (তিরমিজি:৩৬০৪)
মহানবী (সা.)-এর শেখানো এই দোয়াটি যারা নিয়মতি সকাল-বিকাল
আমল করবে, আল্লাহ
তাআলা তাদের বিষাক্ত পোকা-মাকড় ও যাবতীয় হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে হেফাজত করবেন।
দোয়াটি
হলো (আরবি) :
أَعُوذُ
بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
উচ্চারণ : আউজু
বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন শাররি মা খলাক।
অর্থ : আমি
আল্লাহর পরিপূর্ণ কলেমার দ্বারা প্রত্যেক শয়তান, বিষাক্ত প্রাণী এবং প্রত্যেক কুদৃষ্টির অনিষ্ট থেকে আশ্রয়
চাইছি।
সুতরাং সাপ বিচ্ছু অনেক সময় আমাদের উপকারে আসে। রাসূল (সা.) এর হাদীস অনুযায়ী আমাদের আমল করা উচিৎ।
No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com