Tuesday, November 19, 2024

মুমিন বান্দার কর্তব্য-“আল্লাহর হক”

মুমিন বান্দার কর্তব্য-“আল্লাহর হক”

এম এ রাজ্জাক হাওলাদার

 এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত হলে তাদের পাশে দাঁড়ানো, বিপদ মুক্তির জন্য সাহায্য করা ইসলামের শিক্ষা। তাদের দুর্দিনে আর্থিক সহায়তা, খাবার-দাবার, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং চিকিৎসাসেবায় এগিয়ে আসা ইমানের দাবি। নামাজ, রোজা, জ্ব, জাকাতের মতো অসহায়-দুর্গত মানুষের সাহায্য করাও ইবাদত।

হক (বিকল্প প্রতিবর্ণীকরণ: হক্ব) হল সত্যের সমার্থক আরবি প্রতিশব্দ। ইসলামে এই শব্দ দ্বারা সত্যের পাশাপাশি ন্যায় ও বাস্তবতাকে বোঝানো হয়। আল-হক্ব হল আল্লাহ তাআলার ৯৯টি গুনবাচক নামের মধ্যে অন্যতম একটি নাম। সূফিবাদেহক শব্দটি দ্বারা ঈশ্বরকে চূড়ান্ত বাস্তবতা হিসেবে গণ্য করা হয়।-(ইউকিপিডিয়া)

আল্লাহ তায়ালা যেসব হক আদায় করা একজন মুমিনের জন্য কর্তব্যঃ  আর তা হলো: হক শব্দটির বিশ্লেষণ করেলে এ ভাবে বলা যায় হকশব্দের অর্থ অধিকার, অংশ ও প্রাপ্য। সুতরাং হক দুই প্রকার।

()হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক ()হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক।

. আল্লাহর হক : হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক হলো যা মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার কাছে প্রাপ্য।

আর এটি শুধু তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমনএকমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক না করা।

. বান্দার হক : আল্লাহ ছাড়া আল্লাহর অন্য সৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত হককে হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক বলা হয়। যেমনমা-বাবার হক, স্বামী-স্ত্রীর হক ইত্যাদি।

এখানে আমরা আল্লাহর হক সম্পর্কে আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।

মহান আল্লাহ তাঁর হক সম্পর্কে বলেন,

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا

আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না।’ (সুরা নিসা-০৪ আয়াত : ৩৬)

অপর হাদীসে রয়েছে,

عَنْ مُعَاذٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: كُنْتُ رِدْفَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى حِمَارٍ يُقَالُ لَهُ عُفَيْرٌ، فَقَالَ: «يَا مُعَاذُ، هَلْ تَدْرِي حَقَّ اللَّهِ عَلَى عِبَادِهِ، وَمَا حَقُّ العِبَادِ عَلَى اللَّهِ؟»، قُلْتُ: اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: «فَإِنَّ حَقَّ اللَّهِ عَلَى العِبَادِ أَنْ يَعْبُدُوهُ وَلاَ يُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا، وَحَقَّ العِبَادِ عَلَى اللَّهِ أَنْ لاَ يُعَذِّبَ مَنْ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا»، فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلاَ أُبَشِّرُ بِهِ النَّاسَ؟ قَالَ: «لاَ تُبَشِّرْهُمْ، فَيَتَّكِلُوا»

মুআজ (রা.) বলেন, উফায়র নামক একটি গাধার পিঠে আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পেছনে আরোহী ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, হে মুআজ! তুমি কি জানো বান্দার ওপর আল্লাহর হক কী এবং আল্লাহর ওপর বান্দার হক কী? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ভালো জানেন। তখন তিনি বলেন, নিশ্চয়ই বান্দার ওপর আল্লাহর হক হলো বান্দা তাঁর ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। আর আল্লাহর ওপর বান্দার হক হলো তাঁর ইবাদতে কাউকে শরিক না করলে আল্লাহ তাকে শাস্তি দেবেন না। (বুখার: ২৮৫৬)

উক্ত হাদসে আল্লাহর দুটি হক প্রমাণিত হয়। যথা:

১. একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা, ২. শিরক না করা।

বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর প্রধান হক হলো বান্দা একমাত্র তাঁর ইবাদত করবে। ইবাদত শব্দের অর্থ আনুগত্য করা, নত হওয়া ও বিনম্র হওয়া। আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়ন ও নিষেধ থেকে বিরত থাকাই ইবাদত। আল্লাহর ইবাদত করা এমন গুরুত্বপূর্ণ হক,

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

যে জন্য আল্লাহ মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। (সুরা জারিয়াত-৫১ আয়াত : ৫৬)

মহান আল্লাহর দ্বিতীয় হক হলো তাঁর ইবাদতে কাউকে শরিক না করা। আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার করা। শিরকের মাধ্যমে আল্লাহর নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয়। এ কারণেই শিরক জঘন্যতম অপরাধ।

নিম্নে আল্লাহর হক সম্পর্কিত আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হলো

(ক)আল্লাহর প্রতি ঈমান গ্রহণ করা : বান্দার প্রতি আল্লাহর অন্যতম হক হলো তাঁর প্রতি ঈমান আনা। মহান আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا آمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَى رَسُولِهِ

হে মুমিনরা! তোমরা (পূর্ণরূপে) বিশ্বাস স্থাপন করো আল্লাহর ওপর, তাঁর রাসুলের ওপর এবং ওই কিতাবের ওপর, যা তিনি নাজিল করেছেন।’ (সুরা নিসা- আয়াত : ১৩৬)

(খ)ঈমানের ওপর দৃঢ় থাকা কর্তব্য : মুমিনের প্রতি আল্লাহর হক হলো ঈমানের ওপরে দৃঢ় থাকা। কোনো অবস্থায় ঈমান ত্যাগ না করা, ঈমান বিধ্বংসী কাজ না করা ইত্যাদি। মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ

নিশ্চয়ই যারা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। অতঃপর তার ওপর দৃঢ় থাকে, তাদের ওপর ফেরেশতামণ্ডলী নাজিল হয় এবং বলে যে, তোমরা ভয় পেয়ো না ও চিন্তান্বিত হয়ো না। আর তোমরা জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেওয়া হয়েছিল।’ (সুরা হা-মিম-সাজদাহ-৪১ আয়াত : ৩০)

(গ)ইখলাসের সঙ্গে ইবাদত পালন করা : বান্দার কাছে আল্লাহর অন্যতম হক হলো শুধু তাঁরই জন্য ইবাদত করা। সুরা ফাতিহায় প্রতি রাকাতে আমরা বলি,

إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

আমরা কেবলমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য চাই।’ (সুরা ফাতিহা-০১ আয়াত : )

(ঘ)সৃষ্টিকর্তকে ভয় করা : আল্লাহ তাআলার হক হলো একমাত্র তাঁকেই ভয় করা। আল্লাহ বলেন,

وَإِيَّايَ فَارْهَبُونِ

তোমরা শুধু আমাকেই ভয় করো।’ (সুরা বাকারাহ-০২ আয়াত : ৪০)

(ঙ)সালাত আদায় কায়েম করা : ঈমানের পর সালাতের স্থান। অন্যত্র তিনি বলেন,

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

বলো, আমার সালাত ও আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ, সব কিছু জগৎসমূহের রব আল্লাহর জন্য।’ (সুরা আনআম-০৬ আয়াত : ১৬২)

(চ)জাকাত আদায় করা : ইসলামে সালাতের পর জাকাতের স্থান। এটি মহান আল্লাহর অন্যতম হক।

(ছ)সিয়াম পালন করা : সিয়াম পালন করাও আল্লাহর হক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বলেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: " يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ: الصَّوْمُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ، يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَأَكْلَهُ وَشُرْبَهُ مِنْ أَجْلِي، وَالصَّوْمُ جُنَّةٌ، وَلِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ: فَرْحَةٌ حِينَ يُفْطِرُ، وَفَرْحَةٌ حِينَ يَلْقَى رَبَّهُ، وَلَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ "

সিয়াম আমার জন্যই, আমিই এর প্রতিদান দেব। সে আমার সন্তোষ অর্জনের জন্যই তার প্রবৃত্তি ও পানাহার ত্যাগ করেছে।’ (বুখার-৭৪৯২)

(জ)জ্ব পালন করা : সম্পদশালী মুসলিমের ওপর আল্লাহর জন্য তাঁর ঘর জিয়ারত করা আল্লাহর অন্যতম হক। আল্লাহ বলেন,

 وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ

আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ ফরজ করা হলো ওই লোকদের ওপর, যাদের এখানে আসার সামর্থ্য আছে। আর যে ব্যক্তি তা অস্বীকার করে (সে জেনে রাখুক যে) আল্লাহ জগদ্বাসী থেকে অমুখাপেক্ষী।’ (সুরা আলে ইমরান-০৩ আয়াত : ৯৭)

(ঝ)আল্লাহর আইন/বিচার মেনে নেওয়া : আল্লাহর বিচার ফয়সালা মেনে নেওয়া তাঁর অন্যতম অধিকার। মহান আল্লাহ বলেন,

 إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ

আদেশ দানের ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া কারো নেই।’ (সুরা ইউসুফ-১২ আয়াত : ৪০)

(ঞ)অবিলম্বে তাওবা করা : প্রত্যেক প্রাণীই মরণশীল। তাই প্রত্যেক মানুষের উচিত অনতিবিলম্বে তাওবা করা। আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً

হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা করো বিশুদ্ধ তাওবা।’ (সুরা তাহরিম-৬৬ আয়াত : ৮)

(ট)আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা : মহান আল্লাহ মানুষকে বহু নিয়ামত দিয়েছেন। মানুষ তা গণনা করে শেষ করতে পারবে না। তাই মানুষের প্রতি আল্লাহর অন্যতম হক হলো আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। আল্লাহ বলেন,

فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ

অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমি তোমাদের স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সুরা বাকারাহ-০২ আয়াত : ১৫২)

(ঠ)আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা : আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা করা আল্লাহর অন্যতম হক। তিনি বলেন,

وَعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ

একান্তভাবে আল্লাহর ওপর ভরসা করো, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।’ (সুরা মায়িদা-০৫ আয়াত : ২৩)

(ড)সর্বক্ষণিক ল্লাহকে স্মরণ রাখা : আল্লাহকে স্মরণ করা আল্লাহর অন্যতম নির্দেশ। মহান আল্লাহ বলেন,

فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ

অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমি তোমাদের স্মরণ করব।’ (সুরা বাকারাহ-০২ আয়াত : ১৫২)

(ঢ)আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা : নিরঙ্কুশ ভালোবাসা পাওয়ার একমাত্র অধিকারী হলেন আল্লাহ তাআলা। নবী করিম (সা.)এর হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: " ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ: أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَأَنْ يُحِبَّ المَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِي الكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِ "

তিনটি গুণ যার মধ্যে আছে, সে ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে১. আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তার কাছে অন্য সব কিছু থেকে বেশি প্রিয় হওয়া; ২. কাউকে একমাত্র আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা; ৩. কুফরিতে প্রত্যাবর্তনকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতো অপছন্দ করা। (বুখার-১৬)

পরিশেষ বলতে  পরি যে মুমিনের কর্তব্য-আল্লাহর হকগুলো যথযথো ভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Bottom of Form

 

No comments:

Post a Comment

razzakhowlader59@gmil.com