ইসলামে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা
আমরা সবাই মানুষ। ব্যক্তি হিসেবে, সমাজের সদস্য হিসেবে আমাদের রয়েছে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অপুরন্ত নিয়মত। মানবকুলের শিরমনি হযরত মুহাম্মদ
(সাঃ) এবং সাহাবায় আজমাঈন রেখে যাওয়া আদর্শ সকলের জন্য অনুকরনীয়। ইসলাম Human Rights বা মানবাধিকারের সর্বাদিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
আর ইসলামী রাষ্ট্রে মানুষ মানুষের অধিকার দিয়েছেন। শিক্ষা,
অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান এ ০৪টি বিষয় সকলের অধিকার দিয়েছেন ইসলাম ও রাষ্ট্রে। তাইতো ইসলাম বলে মানুষ মানুষের জন্য কোন ভেদাভেদ নেই। সাদা-কালো, আরব-অনারব কিংবা রক্তের
কোন পার্থাক্য ব্যক্তির কোন আলাদা মর্যাদা নেই। ১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে
শ্রমিকের অধিকার বা মানবাধিকার ঘোষিত হয় ০৮টি
অধিকারের কথা। যা সকলের দাবি ছিল।
বর্তমান সমাজে নানা
ধরণের Human
Rights বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নানান রকমের সংগঠন বের হচ্ছে। মূলত ইসলামই সব চাইতে বেশী মানবাধিকার দিয়েছেন যা অন্য কোন জাতি বিংবা মানুষ
দিতে পারেনাই।
সুতরাং ইসলামে শ্রমিকের
অধিকার, মানবাধিকার, ও পারস্পারিক সৌহার্দ্য ও ভ্রোতৃত্ববোধ দেখিয়েছেন। যা নিম্মে মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন-
وَلاَ تَقْتُلُواْ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ
اللَّهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ وَمَن قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِ
سُلْطَانًا فَلاَ يُسْرِف فِّي الْقَتْلِ إِنَّهُ كَانَ مَنْصُورًا
‘‘সে প্রাণকে হত্যা করো না, যাকে আল্লাহ্ হারাম করেছেন; কিন্তূ ন্যায়ভাবে।
যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়, আমি তার উত্তরাধিকারীকে ক্ষমতা দান করি। অতএব, সে যেন হত্যার ব্যাপারে সীমা লঘন না করে। নিশ্চয় সে সাহায্যপ্রাপ্ত।।’’ (সুরা বণী ইসরাঈল-৩৩)
মোট কথা ইসলামে শ্রমিকের
অধিকার ও ভ্রাতৃত্ববোধর কোন বিকল্প নেই। সকলের অধকিার যাতে সঠিক ভাবে পায় তার জন্য আমাদের চেষ্টা করতে
হবে।
শ্রমিক হচ্ছে যারা
কাজ করে তারা। জাগতিক দৃষ্টিতে আমরা দেখি যারা গরিব-দুখি তারা কল-কারখানায় ইত্যাদিতে
কাজ করে তাই তাদেরকে আমরা শ্রমিক বলি। ইসলাম
সকল মানুষকে অধিকার দিয়েছেন।
জীবিকা অর্জনের অন্যতম
উপায় হচ্ছে শ্রম। তাই ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদাকে উচ্চ করে বলেন-
وَمَا أُرِيدُ أَنْ أَشُقَّ عَلَيْكَ
سَتَجِدُنِي إِن شَاء اللَّهُ مِنَ الصَّالِحِينَ
আমি তোমাকে কষ্ট দিতে
চাই না, কোন কঠিন ও দুঃসাধ্য কাজ তোমার উপর চাপাতেও চাহি না, আল্লাহ চাহেন তো তুমি
আমাকে সৎকর্মপরায়ণ পাবে। (সূরা কাছাছ-২৭)
রাসূল কারিম শ্রমিকের মজুরী দানের জন্য আদেশ করেন-
قَالَ
رَسُوْلُ اللهِ (صـ) وَلَمْ يَكُنْ
يَظْلِمُ اَحَدًا اَخْرَهُ- (بخارى)
নবী করীম (সাঃ) শ্রমিকের
মজুরী দানের ব্যাপারে কোনরূপ জুলুম করতেন না,
জুলুমের প্রশ্রয় দিতেন না। (বুখারী, কুহাসা-২য়-৯০পৃঃ)
অন্য একখানা হাদীসে শ্রমিকের নিজের হাতে
কাজ করার উৎসহ যোগান সম্পর্কে এক বর্ণনায়
আছে, ‘‘ হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, একদা এক আনসারী সাহাবী নবী করীম (সাঃ) এর নিকট এসে কিছু চাইলেন। তখন তিনি তাকে
বললেন, তোমার ঘরে কি কোন কিছু নাই? উত্তরে সাহাবী বলেন, হ্যাঁ হুজুর আছে। একখানা
কম্বল, যার একাংশ আমি পরিধান করি এবং অপর অংশ
শয্যারূপে ব্যবহার করি। তাছাড়া পানি পান করার জন্য একটি পান পাত্রও আছে। রাসূল বললেন, তাহলে এদুটি জিনিসই আমার নিকট নিয়ে এসো। সাহাবী তাঁর কথা
মত নিয়ে আসলেন। নবী ঐ জিনিষ গুলি লোকদের কাছে
নিলাম দিলেন এবং সাহাবীদের বলেন দুই দিরহাম দিয়ে
এই মালটি ক্রয় করবে কে । একজন সাহাবী রাজী হলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উক্ত সাহাবীকে
ডেকে বলেন এই নেও দিরহাম এক দিরহাম দিয়ে তুমি
পরিবারের জন্য খাদ্য ক্রয় করিও এবং অন্য দিরহাম দিয়ে তুমি একটি কুঠার ক্রয় করে জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কেটে বিক্রয় করে তোমার জীবিকা নিবারন করবে। রাসূল (সাঃ) তাকে বলেন অপরের নিকট ভিক্ষার দরুন
কিয়ামতের দিনে তোমার চেহারায় দাগ নিয়ে আসা অপেক্ষা জীবিকার্জনের এটা অনেক বেশি উত্তম
পন্থা।’’ (আবুদাউদ,ইবনে মাজা, মিশকাত-১৬৩ পৃঃ দৈজীই-৪৯৫ পৃঃ)
সুতরাং এক শ্রেনীর
মানুষের শ্রমের পরিবর্তে সহজ ভাবে ভিক্ষার
পেশাকে জীবনে বেচে নিয়েছে। রাসূলে কারীম (সাঃ) ভিক্ষার পরিবর্তে পরিশ্রম করে কাজ করার
ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। তদুপরি তিনি শ্রম বিনিয়োগের কার্যকরী পন্থা নির্ধারণ করে
দিয়েছেন। এমনিভাবে সমাজের বেকার সমস্যা সমাধানেও তিনি অগ্রনী ভুমিকা রেখে ছিলেন। ইসলামের
দৃষ্টিতে হালাল কাজেও হালাল পথে শ্রম বিনিয়োগ
কিছুমাত্রও লজ্জার ব্যাপার নয়। বরং এ হচ্ছে নবীগণের ‘‘সু’ন্নাত’’।
তাইতো ইসলামের ইতিহাস অধ্যায়ন করলে দেখা যায় যে, নবী ও রাসূলগণ পরিশ্রম করে ছিলেন যার প্রমাণ নিম্মে দেওয়া হলোঃ
নবী/ রাসূলের নাম কোন গ্রন্থে লেখা আছে কি কাজ করতেন
১.হযরত দাউদ (আঃ) মুসতাদরাকে হাকিম বর্ম তৈরী করতেন
২.হযরত আদম (আঃ) ‘‘ কৃষিকাজ করতেন
৩.হযরত নূহ (আঃ) ‘‘ কাঠমিস্ত্রীর কাজ করতেন
৪.হযরত ইদ্রীস (আঃ) ‘‘ সেলাই (দর্জী) কাজ করতেন
৫.হযরত মূসা (আঃ) ‘‘ রাখালের কাজ করতেন
৬.শেষ নবী হযতর মুহাঃ (সাঃ) কুরআনে বর্ণিত রাখাল ও
ব্যবসা কাজ করতেন
সূত্রঃ ফাতহুল বারী ৪র্থ খন্ড-৩০৬পৃঃ দৈজীই-৪৯৬পৃঃ
মালিক শ্রমিকের সম্পর্ক
মালিক ও শ্রমিকের মধ্যকর
সম্পর্ক এমন হওয়া প্রয়োজন যে তারা একে অপরের
ভাই ভাই। তাইতো শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে কিরূপ
সম্পর্ক হওয়া উচিত এ সম্বন্ধে রাসূলে কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেনঃ
هُمْ
اِخْوَانُكُمْ جَعَلَهُمُ اللهُ تَحْتَ اَيْدِيْكُمْ فَمَنْ جَعَلَ
اللهُ اَخَاهُ تَحْتَ يَدَيْهِ فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَاكُلُ وَ
لَيْلِبَسُهُ مِمَّا يَلْبِسُ وَلاَ
يُكَلِّفُهُ مِنَ الْعَمَلِ مَا
يَغْلِبُهُ فَاِنْ كَلَّفَهُ مَا يَغْلِبُهُ فَلْيُعْنِهِ عَلَيْهِ
তারা (অধিনস্ত ব্যক্তিবর্গ)
তোমাদের ভাই। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তোমাদের
অধীনস্ত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা কারো (দীনি
) ভাইকে তার অধীনস্থ করে দিলে সে যা খাবে তাকে তা থেকে খাওয়াবে এবং সে যা পরিধান করবে
তাকে তা থেকে পরিধান করতে দিবে। আর যে কাজ তার জন্য কষ্টকর ও সাধ্যতীত তা করার জন্যে
তাকে বাধ্য করবে না। আর সেই কাজ যদি তার দ্বারাই সম্পন্ন করতে হয় তবে সে তাকে অবশ্যই সাহায্য করবে।’’ (বুখারী-২য়-৮৯৪পৃঃ, দৈজীই-৪৯৬পৃঃ)
নবী করীম (সাঃ) শ্রমিকের প্রতি সহৃদয়তা পূর্ণ ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। মজুর ও চাকরের অপরাধ অসংখ্যবার ক্ষমা করা তিনি মহত্বের লক্ষণ বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি নিজেও তাদের প্রতি হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ করতেন।
রাসূলের একান্ত সহচর হযরত ইবনে মালিক (রাঃ) দীর্ঘ (১০) দশ বছর পর্যন্ত তার খিদমত
করেছেন এবং ছায়ার মতো তাঁর পাশে রয়েছেন। দীর্ঘকালের মধ্যে তিনি তাঁর নিকট কোন কৈফিয়ত
তলব করেননি এবং কোন কাজের দরুন তাঁকে কখনো ভৎসনাও
করেননি। ( দৈজীই-৪৯৭পৃঃ)
মালিকে অধিকার ও কর্তব্য
শ্রমিক ও মালিকের অধিকার
ও কর্তব্যের বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমান পৃথিবীতে মালিক-শ্রমিক অসন্তোষ, শ্রমিক ছাটাই ও আন্দোলন
ইত্যাদি অনভিপ্রেত অবস্থায় উদ্ভব হচ্ছে দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। মুলতঃ এ সকল
বিষয় ইসলামের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট।
ইসলামী দৃষ্টিতে শ্রমিকের উপর মালিকের কতগুলি কর্তব্য রয়েছে যা নিন্মে বর্ণনা করা হলোঃ
ক। কর্মক্ষম, সুদক্ষ ও শক্তিমান এবং আমানতার বিশ্বস্ত
ব্যক্তিকে নিয়োগ করাঃ
মালিকের প্রধান কর্তব্য
হলো, কর্মক্ষম, সুদক্ষ ও শক্তিমান এবং আমানতার বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে বা ব্যক্তিদেরকে কাজে নিয়োজিত
করা। কর্মক্ষম ও আমানতদারী এ দুই গুণ ব্যতীত কোন কাজে বা শিল্পে সফলতা অর্জন সম্ভব
নয়।
মালিকের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে উলেখ করেন,
إِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ
الأَمِينُ
তোমার মুজর হিসাবে
সে-ই উত্তম হবে, যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত। (সূরা কাছাছ-২৬)
খ। সময় ও মজুরী নির্ধারণ করাঃ
মালিকের দ্বিতীয় কর্তব্য
হচ্ছে সময় ও মজুরী নির্ধারণ করে শ্রমিকের কাজে নিয়োগ করা। অন্যথায় শ্রমিক-মালিক অসন্তোষ
দেখা দেয় এবং উৎপাদন বিঘিœত হয়। তাই হাদীসে রাসূল কারীম (সাঃ) বলেন,
اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ (صـ) نَهَى عَنْ
اِسْتِيْجَارِ الْاَ جِيْرِ حَتَّى يُبَيِّنِّ لَهُ اُجْرَهُ
মজুরের মজুরী নির্ধারণ
না করে তাকে কাজে নিয়োগ করতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিষেধ করেছেন। (বায়হাকী সূত্রঃ ইসলামের অর্থনীতি-১১৭ পৃঃ দৈজীই-৪৯৮পৃঃ)
গ। নূন্যতম মজুরী প্রত্যেক শ্রমিকের নির্ধারণঃ
ইসলামী অর্থনীতির মজুরী
নির্ধারণ সুত্র হলো, ন্যূনতম মজুরী প্রত্যেক শ্রমিকের প্রয়োজনানুসারে
নির্ধারিত হবে। অর্থাৎ প্রত্যেক শ্রমিককে কমপক্ষে এমন মজুরী দিতে হবে, যেন সে এর দ্বারা তার ন্যায়নুগ ও স্বাভাবিক চাহিদা মিটাতে পারে। রাসূলের একটি হাদীসে উলেখ করেন, ‘‘অধীনস্তদের খোরপোষ দিতে হবে।’’ (দৈজীই-৪৯৮ পৃঃ মুসলিম সূত্রঃ ইসলামে শ্রমিকের
অধিকার)
অন্য একখানা মজুরী সম্পর্কে হাদীসে এসেছে-
قَالَ رَسُوْلُ
اللهِ (صـ) نَهَى عَنِ اسْتَجَارَةز اَلاَ
جِيْرِ حَتَّى بُيِّنَ لَهُ اَجْرَهُ –( بخارى)
‘‘
রাসূল (সাঃ) বলেন, তোমরা মজুরের মজুরী নির্ধারণ না করে তাকে
নিযুক্ত করতে নিষেধ করেছেন।’’ (বুখারী, কুহাসা-২য়-৯০পৃঃ)
ঘ। ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেওয়াঃ
কুরআন হাদীস পর্যালোচনা
করলে দেখা যায় যে, মালিক শ্রমিকদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিবে
অথবা এমন মজুরী দিবে, যাতে তাদের প্রয়োজন মিটে যায়। প্রয়োজনীয়তা
নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির দক্ষতা,
যোগ্যতা, পরিবেশ, চাহিদা, জীবনযাত্রা ইত্যাদি পর্যালোচনা করে নির্ধারণ করতে হবে।
মালিক শ্রমিক থেকে
কি ধরণের কাজ নিতে চায় বা করাতে চায় তা পূর্বে আলোচনা করে নেওয়া মালিকের কর্তব্য। কোন
শ্রমিককে এ কাজের জন্য নিয়োগ করে তার সম্মতি ছাড়া তাকে অন্য কাজে নিয়োজিত করা জায়িয নেই। (দৈজীই-৪৯৮ পৃঃ
, হিদায়া ৩য়-২৯৩পৃঃ)
চ। শ্রমিকের পারিশ্রমিক প্রদান করাঃ
ইসলামের দৃষ্টিতে কাজ
করা মাত্রই শ্রমিকের তার পারিশ্রমিক প্রদান করা মালিকের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। তবে অগ্রিম বা অন্য কোন রকম কোন শর্ত থাকলে তা ভিন্ন
কথা। বস্তুত মজুর সম্প্রদায় হাড়। ভাঙ্গা পরিশ্রম করে কাজ করে থাকে। তারা তাদের নিজেদের এবং পরিবারবর্গের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের
জন্য এ পরিশ্রম করে এবং এই মজুরীই তাদের একমাত্র উপায়। এমতাবস্থায় তারা যদি পরিশ্রম
করে মজুরী না পায় কিংবা প্রয়োজন অপেক্ষা কম পায় অথবা নির্দিষ্ট সময়মত প্রাপ্য না পায়, তবে তাদের দুঃখের কোন
অন্ত থাকে না। দুঃখ ও হতাশায় তাদের হৃদয়-মন চূর্ণ ও ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শ্রমিকের মজুরী সম্বন্ধে স্পষ্ট ঘোষণা করেছেনঃ
اَعْطُوْا
الْاَجِيْرَةَ قَبْلَ اَنْ يَجِفَّ عَرَقَهُ – ابن ماجه عَنْ اِبْنِ
عُمَرَ (رضـ) قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ (صـ)
শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকাবার আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও। ( কুহাস-২য়-৮৯পৃ ,ইবনে মাজা, সূত্রঃ হিদায়া ৩য়-২৯৩, দৈজীই-৪৯৯)
শ্রমিকের পারিশ্রমিক
ও ঋণ পরিশোধ নিযে ধনী ব্যক্তিদের তালবাহানা করা যুলুম। শ্রমের ব্যাপারে শ্রমিক ও মালিকের
মধ্যে চুক্তি সম্পাদান করে নেওয়া বাঞ্চনী। চুক্তি মুতাবিক শ্রমিক থেকে কাজ উসুল করে নেওয়ার পূর্ণ অধিকার মুনিবের
থাকবে এবং শ্রমিক মালিকের নিকট কাজের ব্যাপারে জবাবদিহী করতে বাধ্য থাকবে।
ইসলাম যেমনিভাবে মালিকদের
উপর বিভিন্ন দায়িত্ব-কর্তব্য ও নিধি-নিষেধ আরোপ করেছে, তেমনিভাবে শ্রমিক ও
মজুরদের উপরও বিভিন্ন দায়িত্ব-কর্তব্য আরোপ
করেছে। কারণ সুসম্পর্ক কোন দিনই একতরফাভাবে কায়েম হতে পারে না। এর জন্য উভয় পক্ষের
সদিচ্ছার প্রয়োজন। পারস্পরিক সমঝোতা ব্যতিরেকে
তা কোনক্রমেই সম্ভব হয়ে উঠতে পারে না।
ইসলামের দৃষ্টিতে একজন
শ্রমিক নিজের উপর মালিকের কাজের দায়িত্ব নিয়ে এমন এক নৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যে, এরপর সে এ কাজ শুধু পেটের জন্য করে না। বরং করবে আখিরাতের সফলতার আশায়। কেননা চুক্তি
পূর্ণ করার ব্যাপারে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ
وَأَوْفُواْ بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ
مَسْؤُولاً
তোমরা অঙ্গীকার পূর্ন
কর। নিশ্চয় অঙ্গীকার স¤পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (সূরা বনী ইসরাঈল-৩৪)
শ্রমিকের দায়িত্ব হচ্ছে
চুক্তি মুতাবিক মালিকের দেওয়া যিম্মাদারী অত্যন্ত আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদন
করা। মজুর বা শ্রমিক দায়িত্ব গ্রহণের পর কাজে কোররূপ গাফিলতি করতে পারবে না। ইসলামী
শরীয়তের দৃষ্টিতে এটা এক মারাত্মক অপরাধ। তাই মহান আল্লাহ তায়ালা কালামে পাকে ঘোষণা করেন,
وَيْلٌ
لِّلْمُطَفِّفِينَ - 0 الَّذِينَ إِذَا
اكْتَالُواْ عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُونَ -0 وَإِذَا
كَالُوهُمْ أَو وَّزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ -0
‘‘মন্দ পরিণাম তাদের
জন্য যারা মাপে কম দেয়, যারা লোকের নিকট থেকে মেপে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন তাদের জন্য
মেপে অথবা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়। ’’ (সূরা মুতাফফিফীন-১-৩)
ইসলাম মুলত এমন পরিবেশ
সৃষ্টি করতে চায়, যেখানে সবার অধিকারই সংরক্ষিত থাকে এবং
চাওয়ার আগেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রত্যেকের অধিকার আদায় করে দিতে সকলেই উদ্ধুদ্ধ থাকে। ইসলামী সমাজে কোন দাবী পেশের দরকার হয় না।
অপর দিকে বৃদ্ধ ও অসুস্থতার জন্য ভাতা লাভ শ্রমিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার। ইসলাম এ অধিকারের কথা স্বীকার করে। কেননা শ্রমিকের একমাত্র পুঁজিই হল শ্রম। কিন্তু সে বৃদ্ধ বা অসুস্থ হয়ে পড়লে তার বেঁচে থাকার আর কোন পুঁজিই
থাকে না, যা দিয়ে সে অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করবে।
শ্রমিক যদি তার শ্রম
বিনিয়োগ করার মত পর্যাপ্ত সুযোগ না পায়, তবে সে বেকারত্বের এক অসহনীয় অবস্থায় সম্মুখীন হয়ে পড়ে। দেশে বেকারত্বের সংখ্যা
বেড়ে যায়। ফলে সমসাময়িক অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে
বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। সারা দেশে হাহাকার পড়ে যায়। তখন যুবশক্তি তাদের কর্মক্ষতা ইত্যাদিতে
ব্যবহার করতে শুরু করে। অরাজকতা সমস্ত দেশকে গ্রাস করে ফেলে। তাই সকল কল্যাণমূখী রাষ্ট্রেরই
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নির্মান করা পবিত্রতম দায়িত্ব। সূতরাং শ্রমিকের সামনে অফুরন্ত
সুযোগের দুয়ার খুলে দিয়েছে। শ্রম বিনিয়োগের ক্ষেত্রসমূহের মধ্যে উলেখযোগ্য হচ্ছে।
(১) মুদারাবাতঃ শ্রম বিনিয়োগ করে একজন তার পুঁজি বিনিয়োগ করে আর অন্যজন
স্বীয় শ্রম বা মেহনত দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে এবং উভয়ই লাভ-লোকসানের অংশীদার
হয়।
(২) মুযারাআতঃ কৃষি ভুমিতে উৎপন্ন দ্রব্যের অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে শ্রম
বিনিয়োগ করা নাম মুযারাআত।
(৩) মুসাকাতঃ ফলফলাদির বাগানে উপরোক্ত শ্রম বিনিয়োগ হলে তাকে ‘‘মুসাকাত’’ বলে।
(৪) শিরকতে সানায়েঃ ব্যবসার মধ্যে যা উজ্জ রাখা হয় তাতে শিরকতে সানায়ে বলে।
(৫) শিরকতে উজুহঃ অংশীদারী ব্যবসাকে
শিরকতে উজুহ বলে।
(৬) ইহইয়াতে মাওয়াতঃ অনাবাদি ভূমি আবাদ করলে শ্রম বিনিয়োগ করা কে শিকতে উজুহ বলে।
৭) ইজারারঃ সুনির্ধারিত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোন কারখানা বা শিল্পকর্মে অথবা কোন কারবারে শ্রম বিনিয়োগ করাকে
ইজারা বলা হয়। আধুনিক অর্থনীতির পরিভাষায় এ ধরণের শ্রম বিনিয়োগকারীকেই শ্রমিক বলা হয়।
উপরের বিষয় গুলি আমরা
মনোযোগ দিয়ে শুনিছে এবং আমলে আনার চেষ্টা করব। ইনশাআল্লাহ।
সর্ব পরি আর একটি কথা
বলতে চাই তা হচ্ছে, ইসলামী আইনেও শ্রমিকের
অধিকার রয়েছে। এমনকি সমাজের শ্রমিক শ্রেণীর ব্যাপারেও ইসলাম সুষ্ঠু সমাধান পেশ করেছে।
শ্রমিকের অধিকারের ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশ
হলো শ্রমিকের ন্যায্য মজুরী দিতে হবে। শরীরের ঘাম শুকাবার আগেই তা পরিশোধ করতে হবে।
এ ব্যাপারে তার উপর সাধ্যের কোন দায়িত্ব চাপানো
যাবেনা। শিক্ষা , স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও বাসস্থান
ইত্যাদি একটি লোকের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। এই অধিকার নিশ্চয়তা বিধান করা
প্রত্যেক মালিকের বা সরকারের অপরিহার্য কর্তব্য।
কোন ছল-ছুতা ও মিথ্যা অজুহাত দাঁড় করিয়ে শ্রমিক ছাটাই করা অন্যায়।
শ্রমিক জীবন একটি পবিত্রতম
পেশা এর মধ্যেও রয়েছে অধিকারের প্রশ্ন যা Human
Rights মধ্যে পরে। পৃথিবীর
সবচেয়ে নির্যাতিত শ্রেণী হল শ্রমিক শ্রেনী। শ্রমিক আন্দোলনের ফলে পূর্বের চেয়ে এদের
অবস্থা কিছুটা উন্নত হলেও এখনও মানবোতর অবস্থায়ই
তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে। আজকের শ্রমিক শ্রেণী সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিপতিদের হাতে চরম ভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে। আবার কোথাও লাল সাম্রাজ্যবাদী
সমাজতন্ত্রীদের হাতে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ
জীবনাদর্শ হিসেবে শ্রমজীবীদের সকল সমস্যার সার্বিক ও ন্যায়ানুগ সমাধানের দিকনির্দেশ
করেছে। শ্রমিকের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَلاَ تُجَادِلْ عَنِ الَّذِينَ يَخْتَانُونَ
أَنفُسَهُمْ إِنَّ اللَّهَ لاَ يُحِبُّ مَن كَانَ خَوَّانًا أَثِيمًا
‘‘যারা মনে বিশ্বাস ঘাতকতা পোষণ করে তাদের পক্ষ থেকে বিতর্ক করবেন না। আল্লাহ পছšদ করেন না তাকে, যে বিশ্বাস ঘাতক পাপী
হয়। ’’ (সূরা নিসা-১০৭)
সুতরাং আসুন আজকের ও
আগামী দিনের সুন্দর সমাজ বির্নিমানে প্রয়োজন মানবাধিকার ও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা
এবং সকলের সাথে ভ্রাতৃত্বের সু-দৃঢ় বন্ধন তৈরী করা। আজকের এক শ্রেনীর মানুষ অন্যায়ের দূমড় ঝালে অকাতুরে
দিন কাটে আর একশ্রেণীর মানুষ বসে বসে তামাসা দেখছে। ইসলাম-ই সব ধর্মের চাইতে
Human Rights বা মানবাঅধিকার দিয়েছেন।
আহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সকলকে ইসলামের শ্রমিকের অধিকার ও মানবাধিকার এবং ভ্রাতৃত্বভোধ বজায় রেখে চলার তাওফিক দিন। আমিন।।
No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com