Thursday, November 25, 2021

ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনী

 


ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনী

এম এ রাজ্জাক হাওলাদার

ভুমিকা: হযরত ইউসুফ (আঃ) ছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর প্রপৌত্র।ইউসুফ (আঃ)-এর পিতার নাম ইয়াকুব (আঃ), তার পিতা ইসহাক (আঃ) এবং তার পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)।

ইউসুফ (আঃ)-এর নামে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ১১১টি আয়াত সংবলিত একটি সুরা নাযিল করেছেন; সুরাটির নাম-"সুরা ইউসুফ"এই সুরাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই এই সুরার ৩ নং আয়াতে এই কাহিনীকে "আহসানুল কাসাস" তথা সবচেয়ে উত্তম কাহিনী বলে অভিহিত করেছেন।

হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর জীবন কাহিনীকে যত বিস্তারিতভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন এত বিস্তারিতভাবে তিনি অন্য কোন ঘটনা বর্ণনা করেননি।

কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইউসুফ (আঃ)-এর সত্য কাহিনীর সাথে মিথ্যা মিশিয়ে মানুষের মাঝে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় এবং এমন সব নোংরা কথাবার্তা এতে বলা হয়, যা একজন নবী তো দুরের কথা সাধারণ মানুষের জন্যও অবমাননাকর। এগুলো সবই ইসরাইলী রেওয়ায়েতের অংশ বলে ইসলামিক স্কলারগণ অভিমত দিয়ে থাকেন।

হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর নামে কি অপবাদ দেয়া হয়েছে?

তার নামে বলা হয়েছে যে, মিশরের তৎকালীন রাজার স্ত্রী জুলায়খার সাথে অশ্লীলকাজে লিপ্ত হওয়ার জন্য ইউসুফ (আঃ) নিজের পরিধানের কাপড় খুলে ফেলে মহিলার দুই পায়ের সম্মিলনস্থলে অন্তরঙ্গভাবে বসে গিয়েছিলেন। (ভাষায় প্রকাশ করতেই শিউরে উঠতে হয়) এ অবস্থায় তাকে বলা হল-তোমার নাম নবীদের তালিকায় আছে; অথচ, তুমি নির্বোধদের মত কাজ করতে যাচ্ছ? আরও বলা হয় যে, এ সময় তিনি দেয়ালে বা ছাদে তার পিতা হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর ছবি দেখতে পেয়েছিলেন। প্রথম আহবানে (আওয়াজে) ভ্রুক্ষেপ না করায় তিনি তার পিতাকে এ অবস্থায় দেখতে পান।

শুধু এতটুকুই শেষ নয় বরং, আরও বলা হয় যে, তার পিতা ইয়াকুব (আঃ) মুখে আঙ্গুল কামড়িয়ে তাকে সতর্ক করছেন দেখেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করায় ইয়াকুব (আঃ) তাকে প্রহার করলেন। ফলে তার আঙ্গুল থেকে কামনা বের হয়ে গেল।

আরও বলা হয় ইউসুফ ছাড়া ইয়াকুব (আঃ)-এর ১২ জন সন্তান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, ইউসুফকে মারার সময় তার (ইয়াকুব আ:) হাতের আঙ্গুল থেকে কামনা বের হয়ে গেছে। আর এর ফলে, তার সন্তান একজন কমে গিয়ে ইউসুফ (আঃ) ছাড়া ১২ এর স্থলে ১১ জন হয়েছে।

তিনি যে কারণে অশ্লীল কাজে জড়িত হননি এ সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلا أَن رَّأَى بُرْهَانَ رَبِّهِ

অর্থাৎ, মহিলা কুকর্মের জন্য সংকল্প করেছিল। ইউসুফ (আঃ) ও সংকল্প করতেন যদি না তিনি আল্লাহ তায়ালার "বুরহান" তথা জ্বলন্ত প্রমাণ প্রত্যক্ষ করতেন। (সুরা ইউসুফ:১২/২৪)

বুরহান তথা জ্বলন্ত প্রমাণের প্রকৃতি সম্বন্ধে বলা হয় যে, তিনি ঘরের ভিতরে কুরআনের তিনটি আয়াত লেখা দেখেছিলেনসেগুলো হল-

১. وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ ، كِرَامًا كَاتِبِينَ

অর্থাৎ, তোমাদের উপর সম্মানিত লেখকবৃন্দ (ফেরেশতাগণ) নিযুক্ত রয়েছেন। (সুরা ইনফিতার:৮২/১১)

২. وَمَا تَكُونُ فِي شَأْنٍ وَمَا تَتْلُو مِنْهُ مِنْ قُرْآنٍ وَلا تَعْمَلُونَ مِنْ عَمَلٍ إِلَّا كُنَّا عَلَيْكُمْ شُهُودًا إِذْ تُفِيضُونَ فِيه

অর্থাৎ, হে নবী (স.)! তুমি যে অবস্থায়ই থাক না কেন এবং কুরআন থেকে যা কিছুই শুনাও আর হে লোকেরা! তোমরা যা কিছু করো আমি তোমাদেরকে দেখতে থাকি। (সূরা ইউনুস: ১০/৬১)

৩. أَفَمَنْ هُوَ قَائِمٌ عَلَى كُلِّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ

অর্থাৎ, তবে কি (দুঃসাহস করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে) যিনি প্রত্যেকের কর্মকান্ডের প্রতি নজর রাখেন?...... (সুরা রা'দ: ১৩/৩৩)

কেউ কেউ বলেন, সেখানে তিনি আরেকটি আয়াতও দেখেছিলেন। আর সেটি হল:- আল্লাহ তায়ালার বাণী:

وَلا تَقْرَبُوا الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا

অর্থাৎ, আর তোমরা (জিনা করা তো দুরের কথা) জিনার কাছাকাছিও হইও না। নিশ্চয় সেটা অশ্লীল ও গর্হিত পন্থা। (সুরা বানী ইসরাইল:১৭/৩২)

সম্মানিত ভাই বোনেরা! এ কাহিনীগুলো বর্ণনা করা হয়েছে সুরা ইউসুফের একটি আয়াতের অর্থ বুঝতে ভুল করার কারণে। আয়াতটি হল-

وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلا أَن رَّأَى بُرْهَانَ رَبِّهِ كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاء إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ

অর্থাৎ, মহিলা অশ্লীল কাজে লিপ্ত হওয়ার জন্য ইউসুফ (আঃ)-কে নিয়ে সংকল্প করল এবং ইউসুফ (আঃ) ও তার রবের জ্বলন্ত প্রমাণ প্রত্যক্ষ না করলে তার সাথে অশ্লীল কাজে লিপ্ত হওয়ার সংকল্প করতেন। এমনটিই হলো,যাতে আমি তার থেকে অসৎবৃত্তি ও অশ্লীলতা দূর করে দিতে পারি। আর নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন আমার নির্বাচিত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।(সুরা ইউসুফ:১২/২৪)

এটাই আয়াতের আসল অর্থ। কিন্তু, বিরাম চিহ্নের ভুলের কারণে অনেকে অর্থটাকে ভুলভাবে বুঝেছেন।  তারা এর অর্থ করেছেন এভাবে, মহিলা কুকর্মে লিপ্ত হওয়ার সংকল্প করল; আর ইউসুফ (আঃ) ও কুকর্মে লিপ্ত হওয়ার সংকল্প করলেন। যদি তিনি আল্লাহ তায়ালার জলন্ত প্রমাণ না দেখতেন......... (তাহলে কত কিছুই না হয়ে যেত!!!)

একটা উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টা সবার কাছে ক্লিয়ার হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।

যেমন-রাজু চুরি করেছিল রানাও চুরি করত যদি তার পিতা তাকে আদব শিক্ষা না দিতেন......!!

এই বাক্যটাকে দুইভাবে নেয়া যায়;

১। রাজু চুরি করেছিল, রানাও চুরি করত; আর রানার পিতা যদি তাকে আদব শিক্ষা না দিত তাহলে, আরও কত কিছুই না সে করত!!!!

২। রাজু চুরি করেছিল। আর রানাকে তার পিতা আদব শিক্ষা না দিলে সেও চুরি করত।

একই রকম অবস্থা হয়েছে ঐ আয়াতে। ইসলামিক স্কলারগণের মতে, মহিলা কুকর্মে লিপ্ত হওয়ার জন্য সংকল্প করল। এতটুকুতেই একটা বাক্য পূর্ণ হয়ে গেছে। অতএব, এ আয়াত তেলাওয়াতের সময় " وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ " শব্দের পরে ওয়াকফ করতে হবে। অন্যথায়, অর্থ পরিবর্তন হয়ে যাবে। এর পরের শব্দ থেকে নতুন বাক্য শুরু হবে।

মিশরের একজন স্বনামধন্য ইসলামিক স্কলার আল্লামা মুতাওয়াল্লী আশ- শা'রাবী (রহঃ) একবার এই আয়াত নিয়ে আলোচনার সময় উপরোক্ত বানোয়াট কাহিনী সম্বন্ধে বলেছিলেন:

যার আরবী ভাষা সম্বন্ধে সামান্যতম জ্ঞানও আছে সেও বুঝতে পারবে যে, এই আয়াতে ইউসুফ (আঃ) কর্তৃক কুকর্মের জন্য সংকল্প করে মহিলার এগিয়ে যাওয়াকে "لَوْلاَ" তথা "যদি না " শব্দের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। অতএব, এর অর্থ হবে- তিনি যদি আল্লাহ তায়ালার জ্বলন্ত প্রমাণ অবলোকন না করতেন তাহলে, তিনিও তার ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে যেতেন।

সম্মানিত পাঠক ভাই বোনেরা!

আমরা যদি এ বিষয়টা নিয়ে একটু চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাব- কোন বাক্যে "যদি" শব্দ ব্যবহার করলে তার অর্থ হবে এমন যে, ঘটনাটা আসলেই ঘটে নি। যেমন- যদি তুমি গতকাল আসতে!-এ বাক্যে উল্লেখিত ব্যক্তি গতকাল আসেনি, যদি তুমি আমাকে ফোন করতে!- এখানে ব্যক্তি ফোন করেনি, যদি করিম পাশ করত!- করিম পাশ করেনি, যদি আবু বকর বেচে থাকত!!-আবু বকর বেচে নেই, যদি আমি সেখানে উপস্থিত থাকতাম তাহলে এমনটি হতে দিতাম না।ব্যক্তি উক্ত স্থানে উপস্থিত ছিল না।

ঠিক তদ্রুপ, ইউসুফ (আঃ) আল্লাহ তায়ালার জ্বলন্ত প্রমাণ দেখেছিলেন। কুরআনের আয়াতানুযায়ী সেটা না দেখলে তিনিও মহিলার সাথে কুকর্মে লিপ্ত হওয়ার সংকল্প কিংবা অশ্লীলতায় জড়িয়ে পড়তেন।

এসব কাহিনীগুলো যে মিথ্যা; তার প্রমাণ এই আয়াতেরই পরবর্তী অংশ। আল্লাহ বলেন:-

كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاء إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ

অর্থাৎ, এভাবেই আমি তার কাছ থেকে অশ্লীলতা ও মন্দকে সরিয়ে নিলাম। নিশ্চয় তিনি আমার একনিষ্ট বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। (সুরা ইউসুফঃ ১২/২৪)

এখানে আল্লাহ তায়ালা ইউসুফ (আঃ)-কে তার একনিষ্ট বান্দা বলে প্রশংসা করেছেন। যে লোক অশ্লীলতায় লিপ্ত হওয়ার জন্য নিজের পরিধিত সমস্ত পোশাক খুলে ফেলে জিনায় লিপ্ত হতে মহিলার সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থানে বসে গেছে তাকে কি এমন প্রশংসা করা যায়? আর সে লোক কি এমন প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য হতে পারে? (আল ইসরাইলিয়াত ওয়াল মাউদুয়াত ফি কুতুবিত তাফসীর)

এ ছাড়া উপরে বলা হয়েছে যে,ইউসুফ (আঃ)কুরআনের আয়াত দেখেছেন।আর তা কিভাবে সম্ভব হতে পারে? অথচ,ইসলামী স্কলারগণের কাছে অজানা নয় যে, এ আয়াতগুলো ইতিপুর্বে কখনও নাযিল হয়নি। বরং এগুলো শুধুমাত্র কুরআনে নাযিলকৃত আয়াত।অতএব, দেয়ালে কুরআনের আয়াত দেখার কাহিনীও মিথ্যা এবং বানোয়াট।(আল ইসরাইলিয়াত ওয়াল মাউদুয়াত থেকে সংক্ষেপিত)

উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে- তার থেকে সমস্ত মন্দকাজ ও অশ্লীলতাকে আল্লাহ তায়ালা সরিয়ে দিয়েছেন। "ইউসুফ (আঃ)-কে" এগুলো থেকে সরিয়ে নিয়েছেন এ কথা বলা হয়নি। অতএব, এ কথা স্পষ্ট যে, ইউসুফ (আঃ)-কে এসব অশ্লীলতা সামান্যতমও স্পর্শ করতে পারেনি।

আসুন! আমরা এবার পবিত্র কুরআনের আয়াতে এ সংক্রান্ত আলোচনায় একবার চোখ বুলিয়ে আসি।

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَرَاوَدَتْهُ الَّتِي هُوَ فِي بَيْتِهَا عَن نَّفْسِهِ وَغَلَّقَتِ الأَبْوَابَ وَقَالَتْ هَيْتَ لَكَ قَالَ مَعَاذَ اللّهِ إِنَّهُ رَبِّي أَحْسَنَ مَثْوَايَ إِنَّهُ لاَ يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ{23} وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلا أَن رَّأَى بُرْهَانَ رَبِّهِ كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاء إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ{24} وَاسُتَبَقَا الْبَابَ وَقَدَّتْ قَمِيصَهُ مِن دُبُرٍ وَأَلْفَيَا سَيِّدَهَا لَدَى الْبَابِ قَالَتْ مَا جَزَاء مَنْ أَرَادَ بِأَهْلِكَ سُوَءاً إِلاَّ أَن يُسْجَنَ أَوْ عَذَابٌ أَلِيمٌ{25} قَالَ هِيَ رَاوَدَتْنِي عَن نَّفْسِي وَشَهِدَ شَاهِدٌ مِّنْ أَهْلِهَا إِن كَانَ قَمِيصُهُ قُدَّ مِن قُبُلٍ فَصَدَقَتْ وَهُوَ مِنَ الكَاذِبِينَ{26} وَإِنْ كَانَ قَمِيصُهُ قُدَّ مِن دُبُرٍ فَكَذَبَتْ وَهُوَ مِن الصَّادِقِينَ{27} فَلَمَّا رَأَى قَمِيصَهُ قُدَّ مِن دُبُرٍ قَالَ إِنَّهُ مِن كَيْدِكُنَّ إِنَّ كَيْدَكُنَّ عَظِيمٌ{28} يُوسُفُ أَعْرِضْ عَنْ هَـذَا وَاسْتَغْفِرِي لِذَنبِكِ إِنَّكِ كُنتِ مِنَ الْخَاطِئِينَ{29} وَقَالَ نِسْوَةٌ فِي الْمَدِينَةِ امْرَأَةُ الْعَزِيزِ تُرَاوِدُ فَتَاهَا عَن نَّفْسِهِ قَدْ شَغَفَهَا حُبّاً إِنَّا لَنَرَاهَا فِي ضَلاَلٍ مُّبِينٍ{30} فَلَمَّا سَمِعَتْ بِمَكْرِهِنَّ أَرْسَلَتْ إِلَيْهِنَّ وَأَعْتَدَتْ لَهُنَّ مُتَّكَأً وَآتَتْ كُلَّ وَاحِدَةٍ مِّنْهُنَّ سِكِّيناً وَقَالَتِ اخْرُجْ عَلَيْهِنَّ فَلَمَّا رَأَيْنَهُ أَكْبَرْنَهُ وَقَطَّعْنَ أَيْدِيَهُنَّ وَقُلْنَ حَاشَ لِلّهِ مَا هَـذَا بَشَراً إِنْ هَـذَا إِلاَّ مَلَكٌ كَرِيمٌ{31} قَالَتْ فَذَلِكُنَّ الَّذِي لُمْتُنَّنِي فِيهِ وَلَقَدْ رَاوَدتُّهُ عَن نَّفْسِهِ فَاسَتَعْصَمَ وَلَئِن لَّمْ يَفْعَلْ مَا آمُرُهُ لَيُسْجَنَنَّ وَلَيَكُوناً مِّنَ الصَّاغِرِينَ{32} قَالَ رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ وَإِلاَّ تَصْرِفْ عَنِّي كَيْدَهُنَّ أَصْبُ إِلَيْهِنَّ وَأَكُن مِّنَ الْجَاهِلِينَ{33} فَاسْتَجَابَ لَهُ رَبُّهُ فَصَرَفَ عَنْهُ كَيْدَهُنَّ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

অর্থাৎ,আর তিনি যে মহিলার (রাজার স্ত্রী) বাড়ীতে ছিলেন সে তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অশ্লীলতায় লিপ্ত হওয়ার জন্য আহবান করল। আর সমস্ত দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল: আমার কাছে এসো! আমি শুধুমাত্র তোমার জন্যই সজ্জিত ও প্রস্তুত হয়েছি। তিনি বললেন: (নাউজুবিল্লাহ!) আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় চাই। নিশ্চয় তিনি আমার রব আর তিনিই আমার জন্য উত্তম আশ্রয়স্থল। নিশ্চয় অপরাধীগণ সফল হতে পারে না। উক্ত মহিলা তার সাথে কুকর্মে লিপ্ত হওয়ার সংকল্প করেছে। আর ইউসুফ (আঃ) ও তার রবের জ্বলন্ত প্রমাণ প্রত্যক্ষ না করলে তার সাথে অশ্লীল কাজ করার সংকল্প করতেন। এমনটিই হলো,যাতে আমি তার থেকে অসৎবৃত্তি ও অশ্লীলতা দূর করে দিতে পারি। আর নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন আমার একনিষ্ট বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। তারা উভয়ে দ্রুত দরজার দিকে দৌড় দিলেন। (ইউসুফ আ: এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্য, আর মহিলা তাকে ধরার জন্য) আর সে ইউসুফ (আঃ) এর পোশাক পিছন দিক থেকে ছিড়ে ফেলল। তারা উভয়েই দরজার কাছে মহিলার স্বামীকে পেয়ে গেলেন। মহিলা বলল: সেই ব্যক্তির কঠিন শাস্তি কিংবা বন্দী করা ছাড়া আর কিইবা প্রাপ্য হতে পারে যে, আপনার স্ত্রীর সাথে কুকর্মে লিপ্ত হতে চায়? ইউসুফ (আঃ) বললেন: সে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আহবান করেছে (ফুসলিয়েছে)। আর এ ব্যাপারে ঐ বাড়ীর একজন (দোলনায় থাকা শিশু বাচ্চা আশ্চর্যজনক ভাবে কথা বলল) সাক্ষ্য দিল: যদি তার পোশাক সামনের দিক থেকে ছেড়া থাকে তাহলে, মহিলা সত্য বলেছে; অতএব, পুরুষটি (ইউসুফ আ:) মিথ্যাবাদী। আর যদি পোশাক পিছনের দিক থেকে ছেড়া থাকে তাহলে, মহিলা মিথ্যা বলেছে; আর পুরুষটি (ইউসুফ আ:) সত্যবাদী।

অতঃপর যখন তিনি দেখলেন- পোশাক পিছনের দিক থেকে ছেড়া তখন তিনি (মহিলাকে উদ্দেশ্য করে) বললেন: এগুলো সব তোমাদের (মহিলাদের) চক্রান্ত; তোমাদের চক্রান্ত অত্যন্ত কঠিন। এবার ইউসুফ (আঃ) কে উদ্দেশ্য করে বললেন: ইউসুফ (আঃ)! তুমি (এ ব্যাপারটা) চেপে যাও। (মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন) তুমি তোমার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাও। নিশ্চয় তুমি অপরাধীনী।

শহরের অধিবাসী মহিলাগণ বলাবলি করতে লাগল- আযীযের (মিশরের তৎকালীন রাজার উপাধী) স্ত্রী তার গোলামকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফুসলিয়েছে; সে তার প্রতি অন্ধ ভালবাসায় পাগল হয়ে গেছে; আমরা তাকে স্পষ্ট ভুলের মধ্যেই দেখছি। অতঃপর যখন সে (আযীযের স্ত্রী) শহরের মহিলাদের চক্রান্ত বুঝতে পারল তখন তাদেরকে দাওয়াত দিয়ে একত্রিত করার ব্যবস্থা করল। আর তাদেরকে দেয়া খাদ্যের সাথে (ফলমুল; যা ছুরি দ্বারা কেটে খাওয়া হয়) একটি করে ছুরি দিল।

আর ইউসুফ (আঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলল: ইউসুফ! এদিকে বের হয়ে এসো! যখন তারা তাকে দেখল (তার চেহারা, সৌন্দর্য ইত্যাদি) বিস্মিত হয়ে গেল আর ছুরি দিয়ে নিজেদের হাত কেটে ফেলল। সকলেই স্বগতোক্তি করে উঠল: সুবহানাল্লাহ! (আরবরা আশ্চর্য হওয়ার অর্থে এ শব্দটাকে ব্যবহার করে থাকে) আল্লাহর কসম! এটা কোন মানুষ হতে পারে না; নিশ্চয় এটা কোন ফেরেশতাই হবে। (রাজার স্ত্রী এবার বলল) আর তোমরা এর ব্যাপারেই আমাকে দোষারোপ করেছিলে!! আমি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে ফুসলিয়েছিলাম, কিন্তু সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এবার যদি সে আমি যা বলব তা না করে তাহলে, অবশ্যই তাকে কারাবন্দী করে রাখা হবে এবং সে নিদারুণভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে। ইউসুফ (আঃ) বললেন: হে আল্লাহ! তারা আমাকে যেদিকে আহ্বান করছে তার চেয়ে জেলই আমার নিকট প্রিয়। আর যদি তুমি আমাকে তাদের চক্রান্ত থেকে হেফাজত না কর তাহলে, আমি তাদের দিকে ঝুকে পড়ে মুর্খদের পর্যায়ভুক্ত হয়ে যাব। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তার দুয়া কবুল করলেন। আর তাদের চক্রান্ত দূর করে দিলেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা,সর্বজ্ঞ। ( সুরা ইউসুফ: ১২/২৩-৩৪)

এরপরের ঘটনা সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُونِي بِهِ فَلَمَّا جَاءهُ الرَّسُولُ قَالَ ارْجِعْ إِلَى رَبِّكَ فَاسْأَلْهُ مَا بَالُ النِّسْوَةِ اللاَّتِي قَطَّعْنَ أَيْدِيَهُنَّ إِنَّ رَبِّي بِكَيْدِهِنَّ عَلِيمٌ{50} قَالَ مَا خَطْبُكُنَّ إِذْ رَاوَدتُّنَّ يُوسُفَ عَن نَّفْسِهِ قُلْنَ حَاشَ لِلّهِ مَا عَلِمْنَا عَلَيْهِ مِن سُوءٍ قَالَتِ امْرَأَةُ الْعَزِيزِ الآنَ حَصْحَصَ الْحَقُّ أَنَاْ رَاوَدتُّهُ عَن نَّفْسِهِ وَإِنَّهُ لَمِنَ الصَّادِقِينَ{51} ذَلِكَ لِيَعْلَمَ أَنِّي لَمْ أَخُنْهُ بِالْغَيْبِ وَأَنَّ اللّهَ لاَ يَهْدِي كَيْدَ الْخَائِنِينَ{52} وَمَا أُبَرِّئُ نَفْسِي إِنَّ النَّفْسَ لأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلاَّ مَا رَحِمَ رَبِّيَ إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَّحِيمٌ{53} وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُونِي بِهِ أَسْتَخْلِصْهُ لِنَفْسِي فَلَمَّا كَلَّمَهُ قَالَ إِنَّكَ الْيَوْمَ لَدَيْنَا مِكِينٌ أَمِينٌ

অর্থাৎ, (ইউসুফ আ: জেলে থাকা অবস্থায় রাজার স্বপ্নের ব্যাখ্যা ও তার করণীয় বলে দেয়ার পর) রাজা বললেন: তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। যখন লোকেরা তাকে নিতে আসল, তিনি বললেন: তোমাদের রাজার কাছে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর-সেই মহিলাদের খবর কি যারা ছুরিতে নিজেদের হাত কেটে ফেলেছিল? নিশ্চয় আমার রব তাদের চক্রান্ত সম্বন্ধে অবহিত। রাজা মহিলাদেরকে (একত্রিত করে) জিজ্ঞাসা করলেন: ইউসুফ (আঃ) সম্বন্ধে তোমাদের কি মতামত? যখন তোমরা তাকে (দাওয়াতের দিনে) তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফুসলিয়েছিলে? (তোমরা কি তার ভিতরে সন্দেহজনক কিছু দেখেছ?) তারা বলল: সুবহানাল্লাহ! আমরা তার ভিতরে সন্দেহজনক ও খারাপ কিছু দেখি নাই। (সব মহিলা যখন ইউসুফ আ: এর পক্ষে সাক্ষ্য দিল তখন রাজার স্ত্রীর সামনে অপরাধ স্বীকার করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না)

তাই, অগত্যা রাজার স্ত্রী বলতে বাধ্য হল: এখন সত্য প্রকাশ হয়ে গেছে। আমি নিজেই তাকে তার মতের বিরুদ্ধে ফুসলিয়েছিলাম; আর সে সত্যবাদী। আর এটা (অপরাধ স্বীকার করলাম) এ কারণে যে, সে (স্বামী) যেন জানতে পারে, আমি তার অবর্তমানে অশ্লীল কাজ করে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আর নিশ্চয় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন খেয়ানতকারীদের চক্রান্তকে সঠিক পথে চলতে দেন না। আর আমি নিজের অপরাধ অস্বীকার করছি না। কেননা, আত্মা সর্বদা খারাপ কাজের দিকে ঝুকে থাকে; তবে, যার উপর আল্লাহ তায়ালা দয়া করেন তার কথা ভিন্ন। নিশ্চয় আমার রব ক্ষমাশীল; পরম দয়ালু। রাজা (ইউসুফ আ: এর নির্দোষ ও আমানতদারীতার প্রমাণ পেয়ে) বললেন: তোমরা তাকে আমার কাছে নিয়ে এস। আমি তাকে আমার নৈকট্যপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করে নেব। (সুরা ইউসুফ: ১২/৫০-৫৪)

যারা তার নামে বানোয়াট কাহিনী বর্ণনা করে তারা বলে- ইউসুফ (আঃ) রাজার স্ত্রীর দিকে ঝুকে পড়েছিলেন বলে নিজেই স্বীকার করেছেন। স্বীকারোক্তি করে তিনি বলেছিলেন:

وَمَا أُبَرِّئُ نَفْسِي إِنَّ النَّفْسَ لأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلاَّ مَا رَحِمَ رَبِّيَ إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَّحِيمٌ

অর্থাৎ, আর আমি নিজের অপরাধ অস্বীকার করছি না। কেননা, আত্মা সর্বদা খারাপ কাজের দিকে ঝুকে থাকে; তবে, যার উপর আল্লাহ তায়ালা রহমত করেন তার কথা ভিন্ন। নিশ্চয় আমার রব ক্ষমাশীল; পরম দয়ালু। (সুরা ইউসুফ:১২/৫৩)

সম্মানিত ভাইবোনেরা!

আসুন! উপরের কয়েকটি আয়াতের দিকে মনযোগ দিই। এখানে ৫১ নং আয়াতের শেষাংশ থেকে ৫৩ নং আয়াতের আগ পর্যন্ত বলা হয়েছে:-

রাজার স্ত্রী বলল: এখন সত্য প্রকাশ হয়ে গেছে। আমি নিজেই তার মতের বিরুদ্ধে তাকে ফুসলিয়েছিলাম; আর সে সত্যবাদী। আর এটা (অপরাধ স্বীকার করলাম) এ কারণে যে, সে (স্বামী) যেন জানতে পারে, আমি তার অবর্তমানে অশ্লীল কাজ করে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আর নিশ্চয় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন খেয়ানতকারীদের চক্রান্তকে সঠিক পথে চলতে দেন না। (৫১এর আংশিক-৫২ নং আয়াত)

এর পরের আয়াতের শুরুতে আরবী অক্ষর "ওয়াও" এসেছে; যার অর্থ- এবং

এবার এর পরের আয়াত গুলোর দিকে একটু খেয়াল করি। সেখানে বলা হয়েছে-

وَمَا أُبَرِّئُ نَفْسِي إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّي إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَحِيمٌ

আর আমি নিজের অপরাধ অস্বীকার করছি না। কেননা, আত্মা সর্বদা খারাপ কাজের দিকে ঝুকে থাকে; তবে, যার উপর আল্লাহ তায়ালা রহমত করেন তার কথা ভিন্ন। নিশ্চয় আমার রব ক্ষমাশীল; পরম দয়ালু। (সুরা ইউসুফ:১২/৫৩)

রাজা (ইউসুফ (আ:) এর নির্দোষ ও আমানতদারীতার প্রমাণ পেয়ে) বললেন:

وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُونِي بِهِ أَسْتَخْلِصْهُ لِنَفْسِي فَلَمَّا كَلَّمَهُ قَالَ إِنَّكَ الْيَوْمَ لَدَيْنَا مَكِينٌ أَمِينٌ

তোমরা তাকে আমার কাছে নিয়ে এস। আমি তাকে আমার নৈকট্যপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করে নেব। (সুরা ইউসুফ:১২/৫৪)

উপরের আয়াতগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, ৫০ নং আয়াত থেকে রাজা, রাজার স্ত্রী আর পুর্বে দাওয়াতে আসা মহিলাদের মধ্যেই আলাপ আলোচনা চলছিল। এরই এক পর্যায়ে (৫৪ নং আয়াতে) রাজা বললেন: ইউসুফ (আঃ)-কে জেল থেকে নিয়ে এসো।

অতএব, স্পষ্ট হয়ে গেল যে, অপরাধ স্বীকারের কথাটা ইউসুফ (আঃ)-এর নয়। বরং, অপরাধ স্বীকারের কথাটা বলেছে রাজার স্ত্রী জুলায়খা ইউসুফ (আঃ)-এর কারামুক্তির আগেই। সেখানে তখন ইউসুফ (আঃ) উপস্থিত ছিলেন না। ইতিপুর্বে ৫১ নং আয়াতে সে আরও স্পষ্টভাবে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে।

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন: ইউসুফ (আঃ) সম্বন্ধে যেসব কাহিনী প্রচার করা হয় যেমন: তিনি নিজের পোশাক খুলে ফেলে মহিলার দুইপায়ের মাঝে বসেছিলেন এবং ইয়াকুব (আঃ)-এর ছবি দেখেছিলেন, তিনি মুখে আঙ্গুল কামড়ে ছেলেকে সতর্ক করছেন ইত্যাদি বর্ণনা আল্লাহ কিংবা রাসুল (স.) বলেননি। এগুলোর একটি অক্ষরও রাসুল (স.)-এর থেকে সংকলিত হয়নি। বরং, এগুলো ইহুদীদের থেকে এসেছে; যারা নবীদের উপর মিথ্যা ও তাদের শানে অশ্লীল বাক্য জুড়ে দিতে উস্তাদ। (মাজমুয়াতু ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া: ৫ম খন্ড; ২৪১)

এখন আমাদের জানা দরকার সেই জ্বলন্ত প্রমাণটা কি? যেটা দেখার কারণে ইউসুফ (আঃ) উক্ত মহিলার সাথে অশ্লীলতায় জড়িয়ে পড়েননি?

এ সম্বন্ধে শায়খ ইবনে উসাইমীন বলেন: যে বুরহান তথা জ্বলন্ত প্রমাণ না দেখলে ইউসুফ (আঃ) উক্ত অশ্লীলকাজে লিপ্ত হয়ে যেতেন তা হল- তার ঈমান ও আল্লাহ তায়ালার ভয়। কেননা, আল্লাহ তায়ালার উপর ঈমান ব্যক্তিকে হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে রাখে। আর তিনি তখন ঈমান থেকে উৎসরিত নুর দেখেছিলেন। (ফাতাওয়া ইসলামিয়া)

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) ও একই কথা বলে গেছেন। তিনি বলেছেন: উক্ত "বুরহান" তথা জ্বলন্ত প্রমাণ হল- তার অন্তরে রক্ষিত ঈমান। আর আল্লাহ তায়ালা এটিকে দিয়েই তাকে এ ধরণের খারাপ কাজ থেকে দূরে রেখেছেন। (ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া: ১০ম খন্ড; ১০১)

আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক চ্যান্সেলর আল্লামা সাইয়্যেদ ত্বানতাভী (ইন্তেকাল:২০১০ইং) বলেন: বুরহান তথা জ্বলন্ত প্রমাণ হল- কোন কাজ করা বা না করার সাথে সম্পৃক্ত যে জ্ঞান আল্লাহ তায়ালা তার অন্তরে গেথে দিয়েছেন তাই। তিনি জানতেন যে, আযীযে মিসর তথা মিসরের রাষ্ট্রপ্রধানের স্ত্রী যেদিকে তাকে আহ্বান করছে তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট কাজ; যা তার জন্য মানায় না। (তাফসীরে ওয়াসিত)

আল্লামা আবু বকর আল জাযায়েরী বলেন: বুরহান তথা জ্বলন্ত প্রমাণ হল-আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এমন বুঝ তার অন্তরে পয়দা করে দেয়া যে, রাজার স্ত্রীর এ ধরণের কর্মকান্ডের কারণে তার সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে না পড়ার মধ্যেই রয়েছে কল্যাণ। (আইসারুত তাফসীর)

আল্লামা ডক্টর ওহাবা যুহাইলী বলেন: বুরহান তথা জ্বলন্ত প্রমাণ হল- তার নবুওয়্যাত অথবা, আল্লাহ তায়ালার আনুগত্যের দিকে সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা।(তাফসিরে মুনীর)

সবশেষে একটি সম্পুরক প্রশ্নের উত্তর দিয়েই আলোচনা শেষ করব ইনশাল্লাহ। এ প্রশ্ন অনেকের মনে উদয় হলেও তার উত্তরটি আমার নিজের নয়; বরং, এর উত্তর দিয়েছেন আল্লামা মুতাওয়াল্লী আশ-শা'রাবী (রহঃ)তার অত্যন্ত জনপ্রিয় তাফসীরের কিতাব "তাফসীরে শা'রাবী" তে। তিনি বলেন:-

অনেকে প্রশ্ন করতে পারে, ইউসুফ (আঃ)-কে নিয়ে নাযিলকৃত আয়াত "মহিলা ইউসুফ (আঃ)-এর সাথে কুকর্ম করার জন্য সংকল্প করল, আর তিনিও তার সাথে কুকর্ম করার সংকল্প করতেন যদি না তার রবের পক্ষ থেকে জ্বলন্ত প্রমাণ না দেখতেন"।

এ আয়াতের অর্থ বুঝার ক্ষেত্রে অনেকেই ভুল করে থাকেন; যার কারণে উপরোক্ত বানোয়াট কাহিনীগুলোর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। অতএব, এত কঠিনভাবে আয়াতটিকে উপস্থাপন না করে আল্লাহ তায়ালা তো সহজেই বলে দিতে পারতেন যে, মহিলা কুকর্মের ইচ্ছা পোষণ করেছিল কিন্তু, ইউসুফ (আঃ)কুকর্মের ইচ্ছা পোষণ করেননিকিন্তু, এভাবে সরাসরি না বলে অন্যভাবে বলার পিছনে আল্লাহ তায়ালার কি উদ্দেশ্য ছিল? এভাবে বললে তো এত মিথ্যা কাহিনী বর্ণনা করা সম্ভবপর হত না। সমস্যার সমাধান সাথে সাথেই হয়ে যেত।

তিনি এর জবাবে বলেন: আল্লাহ তায়ালা যদি এ কথাটা সরাসরি এভাবে বলতেন যে, মহিলা তার সাথে কুকর্ম করার সংকল্প করেছিল কিন্তু, ইউসুফ (আঃ)সংকল্প করেননি। তাহলে, এ আয়াত নাযিলের উদ্দেশ্য পূর্ণ হত না। কিছুটা উদ্দেশ্য অপূর্ণই থেকে যেত।

তখন মানুষ মনে করত যে, ইউসুফ (আঃ) হয়ত শারীরিকভাবে অক্ষম ছিলেন কিংবা উক্ত মহিলা তার মনীবের স্ত্রী হওয়ার কারণে তিনি তার সাথে এমন কাজে জড়িত হতে লজ্জাবোধ করেছিলেনতাই, উক্ত মহিলার আহবানে তার মনে কোন প্রকার কামনা জাগ্রত হয়নি।

কিন্তু, আসল ব্যাপারটা মোটেও তেমন ছিল না। বরং, ইউসুফ (আঃ)স্বাভাবিক অবস্থায়ই ছিলেন। তার শারীরিক অবস্থাও স্বাভাবিক ছিল। আর আল্লাহ তায়ালার জ্বলন্ত প্রমাণ না দেখলে তিনি উক্ত মহিলার আহবানে সাড়া দিতেন। জ্বলন্ত প্রমাণ দেখার ঘটনাটা আগে থেকেই উপস্থিত থাকার কারণে তিনি তার সাথে অশ্লীল কাজে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছা পোষণ করেননি। (তাফসীরে শা'রাবী)

উপরোক্ত আলোচনার সার সংক্ষেপে বলা যায়-

১। রাজার স্ত্রী ইউসুফ (আঃ)-কে কুকর্মের দিকে আহবান করলে তিনি তা জোরেশোরে প্রত্যাখ্যান করলেন।

২। তিনি তার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য দৌড় দিয়েছিলেন।সে তাকে পিছন দিক থেকে ধরার জন্য পিছু পিছু দৌড় দিয়ে তার পোশাক পিছন দিক থেকে ছিড়ে ফেলেছিল।

৩। অনেকগুলো দরজা অতিক্রম করার পর শেষ দরজা অতিক্রম করেই তারা দরজার সামনে রাজাকে আকস্মিকভাবে পেয়ে গেল।

৪। নিজের অপরাধ আড়াল করার জন্য রাজার স্ত্রী মিথ্যার আশ্রয় নিল।ইউসুফ (আঃ)যখন রাজার স্ত্রীর ইতিবৃত্ত সংক্ষেপে বর্ণনা করলেন তখন ঐ বাড়ীর একজন শিশুও আশ্চর্যজনকভাবে কথা বলে একটি সুত্রের মাধ্যমে দোষী খুজে বের করার রাস্তা বলে দিল।

৫। ইউসুফ (আঃ)নির্দোষ হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন বেশকিছু পন্থায়:তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ-

শিশুর কথামত দেখা গেল, ইউসুফ (আঃ)-এর পোশাক পিছন দিক থেকে ছেড়া; এটা রাজার স্ত্রীর কাজ বলে প্রমাণিত হল।সে ইউসুফ (আঃ)-কে ধরতে গিয়ে পিছন থেকে তার পোশাক ছিড়ে ফেলেছে; এখানে ইউসুফ (আঃ)ছিলেন নির্দোষ।

শেষকথা:

মোটকথা হলো রাজার স্ত্রী শহরের মহিলাদের সামনে ইউসুফ (আঃ)-কে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানকারী হিসেবে বর্ণনা করেছিল।এ ছাড়া পুণরায় তার কথা না শুনলে কঠোর শাস্তিরও হুমকী দিল; যা প্রমাণ করে ইউসুফ (আঃ)অপরাধী ছিলেন না। হাত কেটে ফেলা আমন্ত্রিত মহিলাগণ রাজার জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিল যে, তারা ইউসুফ (আঃ-এর ভিতরে সন্দেহজনক কিছুই দেখেনিসবশেষে রাজার স্ত্রী স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, সে নিজেই ছিল অপরাধী। আর ইউসুফ (আঃ)ছিলেন সত্যবাদী।

 

No comments:

Post a Comment

razzakhowlader59@gmil.com