Tuesday, January 18, 2022

সত্যদর্শন

 


সত্যদর্শন

এম রাজ্জাক হাওলাদার

 صدق সিদক অর্থ সততা, সত্যবাদিতা বা সত্যপ্রিয়তা। যে ব্যক্তির মধ্যে এ সত্যবাদিতা গুণটি রয়েছে, তাকে সাদিক صادق বা সত্যবাদী বলে। সত্যবাদিতা মানব জীবনের একটি মহৎগুণ। সত্যের মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থা ও ঘটনা প্রকাশ পায় বলে এর দ্বারা জীবনের মহৎ লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়সত্যকে আকড়িয়ে ধরলে জীবনে প্রকৃত সাফল্য আসে। মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন,

 قَالَ اللَّهُ هَذَا يَوْمُ يَنْفَعُ الصَّادِقِينَ صِدْقُهُمْ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

আাজকে দিনে সত্যবাদীদের সত্যবাদিতা তাদের উপকারে আসবে। তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত, তারা সেখানে অনন্তকাল বসবাস করবে। মহান আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। আর এটাই হচ্ছে বিরাট সাফল্য। (সূরা মায়িদাহ-/১১৯)

আদিকাল থেকেই পৃথিবীতে সত্য মিথ্যার সংঘাত চলে আসছে। মিথ্যার চাকচিক্য এত বেশী যে, স্বয়ং মিথ্যাবাদীও বুঝতে পারে না যে, সে মিথ্যা বলছে। অথচ মিথ্যা সর্বদা মিথ্যাই থাকে। তা কখনোই সত্য হয় না। মানুষ তার সীমিত জ্ঞানে ওটা ধরতে পারে না বলেই পৃথিবীতে মিথ্যা টিকে আছে এবং যুগ যুগ ধরে তা থাকবে ক্বিয়ামত না হওয়া পর্যন্ত। কেননা মিথ্যার প্ররোচনা দাতা শয়তান। আল্লাহ তাকে সৃষ্টি না করলে এবং ক্বিয়ামত অবধি তার হায়াত দীর্ঘ না করলে মিথ্যার সঙ্গে মানুষের পরিচয়ই কি-না সন্দেহ। আল্লাহ এটা করেছেন মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য এবং সত্য-মিথ্যা বাছাই করে কে সত্যসেবী তা যাচাই করার জন্য। মানুষ যতবড় জ্ঞানীই হৌক সে তার ভবিষ্যৎ জানেনা। এক মিনিট পরে তার জীবনে কি ঘটতে যাচ্ছে, সে বলতে পারে না। পৃথিবীতে বসবাস তা পরিচালনার জন্য যাকে যতটুকু জ্ঞান দেওয়ার প্রয়োজন, আল্লাহ তাকে ততটুকু দান করেছেন এবং প্রকৃত জ্ঞানের ভান্ডার নিজ হাতে রেখেছেন। সীমিত জ্ঞানের মানুষ চিরকাল নিজেদের মধ্যে হৈ চৈ করেছে স্রেফ আন্দাজ-অনুমানের উপর ভিত্তি করে। এমনকি শত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেও বিজ্ঞান মানুষকে এযাবৎ কেবল আংশিক সত্য’ (Partial truth) উপহার দিতে পেরেছে, ‘পূর্ণ সত্য’ (Absolute truth) নয়।

পৃথিবীতে মানব রচিত যত ধর্ম মতবাদের জন্ম হয়েছে বিলুপ্ত হয়েছে, সবকিছুই ছিল ধারণা কল্পনা নির্ভর। স্বল্পজ্ঞানী অধিকাংশ মানুষ সেগুলিকেই অব্যর্থ ধরে নিয়ে তার অন্ধ অনুসরণ করেছে। স্বর্গে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে জীবন্ত বিধবাকে মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় ঢুকিয়ে দিয়ে বাপ-মা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ীরা আনন্দে উলুধ্বনি করেছে মেয়েটি স্বর্গে গেল বলে। যাকে ভারতে সতীদাহবলা হয়। ধর্মনেতার লালসার খোরাক জোগানোর জন্য দেবদাসীনাম দিয়ে ভক্তিমতি মেয়েদের ইযযত হরণ করাকে পুণ্যের কাজ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে ধর্মের নামে। স্বামী মারা গেলে বিধবা স্ত্রী অন্যত্র আর বিবাহ করতে পারবে না বলে ধর্মীয় বিধান রচনা করে অসংখ্য নারীকে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করা হয়েছে ধর্মের নামে। স্বঘোষিত উচ্চশ্রেণীর লোকেরা ব্রহ্মার মুখ দিয়ে বেরিয়েছে আর নিম্নশ্রেণীর লোকেরা ব্রহ্মার পা থেকে বের হয়েছে বলে তাদের জন্য পৃথক ধর্মীয় বিধান রচনা করা হয়েছে এবং অবমাননাকর রীতি-নীতি তৈরী করা হয়েছে। পীরেরা মরেন না তারা কবরে জীবিত থাকেন, ভক্তের ডাক শোনেন তার ভাল-মন্দের ক্ষমতা রাখেনএমন ধোঁকা দিয়ে আনন্দে বিপদে সর্বাবস্থায় ভক্তের পকেট ছাফ করার কুট-কৌশল অব্যাহত রয়েছে সমাজে ধর্মের নামে। এমনকি বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা তাদের ইলেকশন ক্যাম্পেইন শুরু করেন বড় কোন পীর বা রাজনৈতিক নেতার কবরে ফাতেহা পাঠের মাধ্যমে। ভাবখানা এই যে, কবরবাসীর দো আশীর্বাদ নিয়েই শুভ কাজ শুরু করলাম। অথচ উক্ত কবরবাসী জীবিত অবস্থায় তার নিজের ভাল-মন্দের ক্ষমতা রাখতেন না। লোকেরা সেখানে টাকা দেয় তাকে খুশী করে বিপদে উদ্ধার লাভের আশায় তার অসীলায় পরকালে মুক্তি লাভের মিথ্যা ধোঁকায় পড়ে। অথচ জীবিত মানুষ ক্ষুধায় মৃতবৎ লেও তাকে সে সাহায্য করে না বা একটু সান্ত্বনাও দেয় না।

ধনী-গরীব বলে কিছুই থাকবে না, সবাই হবে সমান, এমনি এক অবাস্তব মতবাদের ধোঁকায় পড়ে শ্রেণী সংগ্রামের নামে রাশিয়ার বিপ্লবে কোটি ১৭ লক্ষ মানুষকে চীনা বিপ্লবে কোটি ৩৭ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে মহা উল্লাসে রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে। ইহুদী শত্রুরা যে ঈসাকে শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করার দাবী করল, খৃষ্টান ভক্তরা সেই ঈসাকে উপাস্য বানিয়েই কেবল ক্ষান্ত হয়নি বরং তাঁকে তাঁর মাকে এবং আল্লাহকে নিয়ে তিন উপাস্যের দাবীদার বনে গেল। তারা আরও বলল, ঈসা তার পূর্বের পরের সকল ভক্ত অনুসারীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে শূলে বিদ্ধ হয়েছেন। অথচ একজনের পাপের বোঝা অন্যজনে বইবে-এটা কখনোই কোন জ্ঞানী মানুষের কথা তে পারে না। আর সৃষ্টি কখনো উপাস্য তে পারে না। অথচ সবই মানুষ সত্য মনে করছে অলীক কল্পনা শয়তানী কুমন্ত্রণায় পড়ে। খৃষ্টপূর্বের প্লেটো সহ বর্তমান বিগত যুগের সকল অর্থনীতিবিদ সমাজ বিজ্ঞানীগণ বলেছেন, সূদী অর্থব্যবস্থাই দারিদ্রে্যর প্রধানতম হাতিয়ার। সূদ হটানো ব্যতীত দারিদ্র্য হটানো সম্ভব নয়। অথচ দুষ্টমতি ধনিক শ্রেণী রাজনৈতিক নেতারা সূদ ব্যবসায়ের পার্থক্য বুঝতে চান না। জনগণের ভোট নিয়ে জনগণের রক্ত শোষণ করছেন তারা পুঁজিবাদী অর্থনীতির মাধ্যমে জোঁকের মত সুচতুরভাবে।

বিবাহপূর্ব যৌনমিলন, পায়ুকামিতা, সমকামিতাকে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটির সুপ্রীম কোর্ট বৈধ বলে রায় দিয়েছে ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে। তাই বলে কি তা বৈধ বলে কারু বিবেকে সায় দিবে? এটাতো স্রেফ পাশবিক স্বাধীনতা! দলীয় শাসন কখনো নিরপেক্ষ প্রশাসন উপহার দিতে পারে না, আল্লাহভীরু ব্যক্তিগণ ব্যতীত। জ্ঞানী ব্যক্তিত্ববান মানুষ কখনো নেতৃত্ব চেয়ে নেন না, এগুলি স্বতঃসিদ্ধ কথা। অথচ সেগুলিই চলছে অপরিহার্য বিধান রূপে বছরের পর বছর ধরে। তাহলে কি সর্বদা এভাবে মিথ্যারই জয়গান চলবে? জন্ডিসের রোগী সাময়িকভাবে সবকিছুকে হলুদ দেখে, তাই বলে পৃথিবী সব হলুদ হয়ে যায় না। সাপে কাটা রোগী তিতাকে মিঠা বলে, তাই বলে তিতা কখনো মিঠা হয় না। অনুরূপভাবে সসীম জ্ঞানের মানুষ অনেক সময় মিথ্যাকে সত্য বলে, সত্যকে মিথ্যা বলে, তাই বলে সত্য কখনো মিথ্যা হয় না এবং মিথ্যা কখনো সত্য হয় না। কারু মতে বিজ্ঞানই সত্য। অথচ কোন বিজ্ঞানীই নিজেকে অভ্রান্ত সত্য বলে দাবী করেননি। বরং তারা সকলেই বলেছেন, Science gives us but a partial knowledge of reality ‘বিজ্ঞান আমাদেরকে কেবল আংশিক সত্যের সন্ধান দেয় তারা স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে কাজ শুরু করে থাকেন। তারা বলেন, ‘আমরা কতিপয় বাহ্য প্রকাশকে দেখি মাত্র, মূল বস্ত্তকে দেখিনা যেমন ধোঁয়া দেখে মানুষ আগুনের সন্ধানে ছুটে থাকে।

অতএব সবকিছুর মূলে যিনি সেই মহাসত্যকে খুঁজে পাওয়া তাঁর দিকে ধাবিত হওয়ার চিন্তা দর্শনই প্রকৃত অর্থে সত্যদর্শন যুগে যুগে নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে সেই সত্যেরই সন্ধান দিয়েছেন। শেষনবীর মাধ্যমে যা পূর্ণতা লাভ করেছে এবং কুরআন ছহীহ হাদীছের বুকে যা সংরক্ষিত আছে। পৃথিবীর সকল মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যান করলেও সত্য চিরকাল সত্যই থাকবে, কখনোই মিথ্যা হবে না।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلًا لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ (115) وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ (116)

তোমার প্রভুর বাক্য সত্য ন্যায়নীতি দ্বারা পূর্ণ। তার পরিবর্তনকারী কেউ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ যদি তুমি অধিকাংশ লোকের কথা শুনে চলো, তাহলে ওরা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। কেননা ওরা ধারণার অনুসরণ করে এবং ওরা অনুমানভিত্তিক কথা বলে (সূরা আনআম-৬/১১৫-১১৬)

 রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন,

عَنْ جَابِرٌ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حِينَ أَتَاهُ عُمَرُ فَقَالَ إِنَّا نَسْمَعُ أَحَادِيثَ مِنْ يَهُودَ تُعْجِبُنَا أَفْتَرَى أَنْ نَكْتُبَ بَعْضَهَا؟ فَقَالَ: «أَمُتَهَوِّكُونَ أَنْتُمْ كَمَا تَهَوَّكَتِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى؟ لَقَدْ جِئْتُكُمْ بِهَا بَيْضَاءَ نَقِيَّةً وَلَوْ كَانَ مُوسَى حَيًّا مَا وَسِعَهُ إِلَّا اتِّبَاعِي» . رَوَاهُ أَحْمد وَالْبَيْهَقِيّ فِي كتاب شعب الايمان

তোমরা কি (সত্য মিথ্যার দ্বন্দ্বে) দিশেহারা হয়ে থাকবে, যেমন ইহুদী-নাছারারা হয়েছে? নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে এসেছি স্বচ্ছ পরিচ্ছন্ন দ্বীন নিয়ে। যদি আজ মূসাও বেঁচে থাকতেন, তাহলে আমার অনুসরণ করা ব্যতীত তার কোন গত্যন্তর থাকতো না (আহমাদ, মিশকাত হা/১৭৭)

 অতএব আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ অহিপবিত্র কুরআন সহীহ হাদীছের অভ্রান্ত বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করাই প্রকৃত অর্থে সত্যদর্শন আল্লাহ আমাদের সত্যদর্শন করার তাওফীক দিন- আমীন!!

 

No comments:

Post a Comment

razzakhowlader59@gmil.com