ইসলামে নারীর অধিকার
এম এ
রাজ্জাক হাওলাদার
সুচনা:
পৃথিবীতে
ইসলামই নারীদের অধিকার সত্যিকারভাবে নিশ্চিত করেছে।বিশ্বের ইতিহাসের দিকে তাকালে
আমরা দেখতে পাই যে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর আগমনের পূর্বে নারীর অধিকারের বিষয়ে কোনো সুষ্পষ্ট ধারণা ছিল না।
সভ্যতার দাবিদার ইহুদী-খৃষ্টান ধর্মের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে
আমরা দেখি যে, পিতা, সন্তান বা স্বামীর
সম্পত্তিতে নারীর কোনো অধিকার দেওয়া হয় নি, কেবলমাত্র পিতার
যদি কোনো পুত্র সন্তান না থাকে তবে তার সম্পত্তি কন্যারা লাভ করবে। কিন্তু
সেক্ষেত্রে এ সকল কন্যা পিতার বংশের বাইরে কাউকে বিবাহ করতে পারবে না, কারণ এতে এক বংশের সম্পত্তি অন্য বংশে চলে যাবে।
উনবিংশ শতক
থেকে বিবাহিত নারীদের স্বতন্ত্রভাবে সম্পদ অর্জনের অধিকার দিয়ে আইন তৈরী করা হয়
১৮৪৮ খৃ. নিউ ইয়র্ক ষ্টেটে the Married Women`s Propert Act পাস করা হয়, যাতে সর্বপ্রথম স্বীকার করা হয় যে, নারীদেরও স্বতন্ত্র
আইনগত সত্ত্বা বা পরিচয় আছে।(This was the first law that clearly
established the idea that a married woman had an independent legal identity.)
ইসলামে
নারী:
কুরআনে
কারিমে ‘নিসা’ অর্থাৎ
‘মহিলা’ শব্দটি ৫৭বার এবং ‘ইমরাআহ’ অর্থাৎ ‘নারী’ শব্দটির ২৬বার উল্লেখ হয়েছে।পবিত্র কুরআনে ‘নিসা’
তথা ‘মহিলা’ শিরোনামে
নারীর অধিকার ও কর্তব্য সংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র বৃহৎ সুরা রয়েছে। এ ছাড়া কুরআনের
বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসে নারীর অধিকার, মর্যাদা ও তাদের
মূল্যায়ন সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।ইসলাম নারীর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত
করেছে। দিয়েছে নারীর জান-মালের নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ সম্মান।
নবী
মুহাম্মদ (স.)নারী জাতির প্রকৃত মুক্তি ও স্বাধীনতা দিয়েছেন। দিয়েছেন পূর্ণ অধিকার
ও মর্যাদা। মর্যাদা অর্থ গৌরব, সম্ভ্রম,
সম্মান, মূল্য ইত্যাদি। নারীর মর্যাদা বলতে
নারীর ন্যায়সংগত অধিকারকে বোঝায়। আর অধিকার অর্থ প্রাপ্য, পাওনা
ইত্যাদি। কারও অধিকার প্রদানের অর্থ হচ্ছে, তার প্রাপ্য বা
পাওনা যথাযথভাবে প্রদান করা। আর এ প্রাপ্য বা পাওনা বলতে তার অধিকারের স্বীকৃতি,
কর্তব্যের সঠিক বিশ্লেষণ ও সামাজিক জীবনে তার অবদানের যথার্থ মূল্যায়নকে
বোঝানো হয়।
ইসলামে
নারীর মর্যাদা:
নারীর
অধিকার বলতে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয় ও
আন্তর্জাতিক তথা সব ক্ষেত্রে নারীর যথার্থ মূল্যায়নকেই বোঝানো হয়। অতএব যদি কারও
ন্যায্য অধিকার স্বীকার না করা হয়, অথবা তার কর্তব্যে
বাধাদান বা তার সামর্থ্যরে অধিক কোনো দায়িত্ব-কর্তব্য তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়,
কিংবা তার অবদানগুলোর সঠিক মূল্যায়ন না করা হয়, তাহলে তার অধিকার ও মর্যাদা খর্ব করা হবে এবং তার প্রতি অবিচার করা হবে।
আর যখন তার অধিকারগুলো স্বীকার করা হয়, তার সামর্থ্য অনুসারে
তাকে দায়িত্ব-কর্তব্য আদায়ের পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হয় এবং সামাজিক জীবনে তার
অবদানগুলোর মূল্যায়ন করা হয়, তখন তার উপযুক্ত মর্যাদা দান
করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
বর্তমান
বিশ্বে নারীর যথাযথ অধিকার দেওয়া হচ্ছে না। তাদের ন্যায়সংগত অধিকার থেকে বঞ্চিত
করা করা হচ্ছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিম সমাজেও ইসলাম প্রদত্ত নারীর অধিকারকে অনেক সময় স্বীকার করা হয় না।
যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
নারীর
শিক্ষার ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা একেবারেই নেই বললেই চলে। অথচ আল্লাহতায়ালা
নারী-পুরুষ উভয়কেই সম্মান দিয়েছেন, পুরুষের থেকে নারীকে ভিন্নভাবে দেখেননি। বরং যুগ যুগ ধরে অবহেলিত ও
উপেক্ষিত নারী সমাজকে পুরুষের সমমর্যাদা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়ে অধিক
মর্যাদা দান করেছেন। এ
প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَهُنَّ مِثْلُ
الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ وَاللَّهُ
عَزِيزٌ حَكِيمٌ(سورة البقراة ـــ228)
স্ত্রীদেরও পুরুষদের ওপর ন্যায়সংগত অধিকার
রয়েছে। আর নারীদের ওপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে।(সুরা আল বাকারা-২:২২৮)
ইসলাম নারীর
প্রতি সব প্রকার অত্যাচার, অবিচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে
নারীকে সর্বক্ষেত্রে অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করেছে।ইসলাম বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর
যে অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করেছে এর অন্যতম হলো বিবাহের মাধ্যমে নারীকে অধিকার ও
মর্যাদা দান, স্বামী নির্বাচনের স্বাধীনতায় নারীকে মর্যাদা
দান, স্ত্রী হিসেবে নারীকে অধিকার প্রদান, মোহর দানের মাধ্যমে নারীকে সম্মান জানানো, সহবাসের
ক্ষেত্রে নারীকে অধিকার প্রদান, মা-কন্যা ও বোন হিসেবে
নারীকে সম্মান ও স্ত্রী হিসেবে নারীকে মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে।
ইসলামী
শরীআত নারীর মর্যাদার ঘোষণা করেছে। প্রসঙ্গত রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন,
عَنْ عَائِشَةَ،
قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ
وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِي، وَإِذَا مَاتَ صَاحِبُكُمْ فَدَعُوهُ.(ترمذى ــ3895)
তোমাদের মধ্যে উত্তম তারা, যারা নিজেদের
স্ত্রীদের জন্য উত্তম। (তিরমিযী-৩৮৯৫; মিশকাত-২৮১পৃ.)
স্ত্রীদের সাথে সদাচার ও উত্তম আচরণের নির্দেশ
দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ
فَإِنْ كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ
خَيْرًا كَثِيرًا (سورة النساء ــ 19)
তোমরা স্ত্রীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করে জীবন
যাপন করবে। অত:পর যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে হয়ত তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ
করছ, যাতে আল্লাহ অনেক কল্যাণ রেখেছেন।(সুরা নিসা-৪:১৯)
নারীর
অধিকার সমূহ:
নাবী
এবং পুরুষ কেউই পৃথিবীতে শুধু নিজের জন্য বাঁচতে আসেনি, বরং পারিবারিক কাঠামোর
মধ্যে থেকে পৃথিবীকে ভবিষ্যতের জন্য সমৃদ্ধ করা তাদের অন্যতম দায়িত্ব। এজন্য
সাধারণভাবে নারী অর্থ কন্যা, স্ত্রী অথবা মাতা এবং পুরুষ অর্থ পুত্র, স্বামী অথবা
পিতা। কন্যা, স্ত্রী এবং মাতা হিসেবে নারীর অধিকার সম্পর্কে আমাদের সচেতন হওয়া উচিৎ।
নারীর ৪ (চার) প্রকার অধিকার রয়েছে। যথা:
(ক)নারীর
ধর্মীয় অধিকার:
নারীর
ধর্মীয় অধিকার হলো ধর্মপালন করা। এটি জন্মগত অধিকার। সকল মানুষেরই এই অধিকার
রয়েছে। অনেক ধর্মে জাতি, বংশ, বর্ণ বা লিঙ্গের কারণে অনেক মানুষকে এ জন্মগত ধর্মীয়
অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এর প্রকৃত উদাহরণ ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্ম।
প্রচলিত
‘বিকৃত’ বাইবেলের বক্তব্য অনুসারে হাওয়া প্রথম নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করেন এবং আদমকে তা
ভক্ষণ করতে প্ররোচিত করেন, এ কারণে ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মে মানব জাতির পতনের জন্য
নারীকে দায়ি করা হয়।(খুত:ইসলাম-২২৪পৃ.)
ইসলামের
দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক। ইসলাম মনে করে নারীর প্রতি সম্মান
পুরুষের ব্যক্তিত্বের প্রমাণ। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.)বলেছেন, নারীকে সম্মানের পরিমাপের ওপর ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদার বিষয় নির্ভর
করে। তিনটি বিষয় নবী কারিম (সা.)-এর জীবনে লক্ষণীয় ছিল।
এক. নামাজের প্রতি অনুরাগ; দুই.
ফুলের প্রতি ভালোবাসা; তিন. নারীর প্রতি সম্মান। (সহিহ্ বুখারী ও মুসলিম)
ইসলাম
শিক্ষা দেয়, নারী ও পুরুষ মানুষ হিসেবে
সমান, মুসলমান হিসেবেও সমান।ইসলামি জ্ঞানার্জন উভয়ের জন্য
ফরজ। উভয়ের জন্য হালাল-হারামের সীমানা নির্দিষ্ট রয়েছে। উভয়ের মতামত দেওয়া ও
সমালোচনার অধিকার রয়েছে। সম্পত্তির
মালিকানার ক্ষেত্রে আল্লাহর ঘোষণা,
لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ
مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا
تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا
مَفْرُوضًا (سورة النساء ــ7)
তাদের পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের রেখে যাওয়া
ধন-সম্পদের পুরুষদের যেমন অংশ রয়েছে, (একইভাবে) নারীদের জন্যও (সে সম্পদে) অংশ রয়েছে। (সুরা আন নিসা-৪:৭)
নারী তার
নারীত্বের মর্যাদা বজায় রেখে সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন ও রাখছেন। নারী ছাড়া
অন্য কেউই মাতৃত্বের সেবা ও সহধর্মিণীর গঠনমূলক সহযোগী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম নয়।
মায়েদের ত্যাগ ও ভালোবাসা ছাড়া মানবীয় প্রতিভার বিকাশ ও সমাজের স্থায়িত্ব বজায়
রাখা সম্ভব নয়। মায়েরাই সমাজের প্রধানভিত্তি তথা পরিবারের প্রশান্তির উৎস।
মানুষ এক
আদম ও হাওয়া থেকে সৃষ্টি।বাইবেলে নারীকে কেন্দ্রকরে অপ্রাসঙ্গিক একটি কাহিনহীর উপর
ভিত্তি করে নারীকে তার ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং তাকে
জন্মগতভাবেই পাপী ও অপরাধী বলে চিত্রিত করা হয়েছে। কুরআন কারীমে কখনোই প্রচলিত
বাইবেলের এ গল্প সমর্থন করা হয় নি বা এ জন্য ‘হাওয়া’কে দায়ি করা হয় নি। বরং সর্বদা
আদম ও হাওয়াকে সমভাবে দায়ি করা হয়েছে। সকল ধর্মীয় বিষয়ে নারী ও পুরুষকে সমান
অধিকার প্রদান করা হয়েছে। তবে সমান দায়িত্ব দেওয়া হয় নি। সুতরাং সালাত, সিয়াম,
যাকাত ও সকল ক্ষেত্রেই নারীরা সমান অধিকার ভোগ করেনে। তবে নারী প্রকৃতির সাথে
সামঞ্জস্য রেখে দায়িত্ব কিছুটা হাল্কা করা হয়েছে।
এ
প্রসঙ্গে রাসূলে কারিম (স.) বলেন,
عَنِ الزُّهْرِيِّ،
سَمِعَ سَالِمًا، يُحَدِّثُ عَنْ أَبِيهِ، يَبْلُغُ بِهِ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «إِذَا اسْتَأْذَنَتْ أَحَدَكُمُ امْرَأَتُهُ إِلَى
الْمَسْجِدِ فَلَا يَمْنَعْهَا» «لَا تَمْنَعُوا النِّسَاءَ حُظُوظَهُنَّ مِنَ
الْمَسَاجِدِ، إِذَا اسْتَأْذَنُوكُمْ» (مسلم ــ442)
তোমাদের নারীগণ মসজিদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে
তাদেরকে নিষেধ করবে না, তাদেরকে অনুমতি দিবে। (অন্য বর্ণনায়: তাদেরকে মসজিদে গমনের
সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে না, আল্লাহর বান্দীদের মসজিদে সালাত পড়তে নিষেধ করবে না)
তবে তাদের বাড়িতে সালাম পড়াই তাদের জন্য উত্তম। (বুখারী- আসহীহ-১/৩০৫; মুসলিম-৪৪২ আস-সহীহ ১/৩২৬-৩২৯; শামে-১৪০; আবু দাউদ- আস-সুনান-১/১৫৫)
(খ)পারিবারিক
ও সামাজিক অধিকার:
ইসলামে নারীর পরিবার ও পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে তাদের অধিকার রয়েছে।
রাসূল (স.)-এর পূর্বে এবং তাঁর অনেক
পরেও অনেক দেশে নারীর বেঁচে থাকার অধিকারই ছিল না। ইসলাম পুর্বে ও বর্তমানেও ভারতে,
চীনে ও অন্যান্য দেশে
জন্মের আগে বা পরে কন্যা শিশুকে হত্যা করা হয়। স্বামীর মৃত্যুর সাথে সাথে
স্ত্রী বেঁচে থাকার অধিকার হারাত এবং স্বামীর চিতায় প্রাণ দিত। শিক্ষা, কর্ম, চাকরী, বিবাহ ইত্যাদি
ক্ষেত্রে নারীকে অধিকার বঞ্চিত করা হয়েছে বা তার মতামতের কোনো মূল্য দেওয়া হয় নি।
বাইবেলে নারীর শিক্ষার অধিকার সীমিত করা হয়েছে। তাদেরকে কেবলমাত্র স্বামীর নিকট
থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
ইসলাম-পূর্বে নারীরা ছিল অত্যন্ত অসহায়। তাদের ব্যাপারে বুদ্ধি ও যুক্তিসঙ্গত কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হত না। একমাত্র বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) নারী জাতির প্রকৃত মুক্তি ও স্বাধীনতা দিয়েছেন। দিয়েছেন পূর্ণ অধিকার ও মর্যাদা। মহাগ্রন্থ কুরআন ও হাদীসে বলা
হয়েছে, ইসলামের গৌরবময়, কালজয়ী নারী মুক্তির সনদ ও সুনিশ্চিত অধিকারের বার্তা। এভাবেই ইসলাম সর্বপ্রথম নারীদের সমাজে স্বাধীন, সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার প্রদান করে, এমনকি সূরা নিসা নামে পবিত্র কুরআনের একটি পূর্ণাঙ্গ সূরাই নাজিল হয়ছে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ
اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا
زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ
الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
(سورة النساء ــ 1)
হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার সঙ্গিনী ও তাদের দুইজন থেকে বহু নর-নারী (পৃথিবীতে) বিস্তার করেছেন। (সূরা নিসা-৪: ১)
এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা নারী ও পুরুষের সৃষ্টি একই উৎস থেকে এবং একই রক্ত-মাংস দ্বারা উভয়ের সৃষ্টি, তা উল্লেখ করেছেন। দৈহিক অবয়ব ব্যতীত সৃষ্টি ও মর্যাদার দিক দিয়ে মূলত নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আল্লাহপাক আরো বলেছেন:
هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ
وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ (سورة البقراة ــ 187)
তারা (স্ত্রীগণ) তোমাদের পোশাক এবং তোমরা (স্বামীগণ) তাদের পোশাক স্বরূপ। (সূরা আল-বাকারা-২:১৮৭)
অর্থাৎ পোশাক ও দেহের মধ্যে যেমন কোনো পর্দা বা আবরণ থাকে না, বরং উভয়ের মধ্যে পরস্পর সম্পর্ক ও মিলন একেবারে অবিচ্ছেদ্য, তদ্রূপ সম্পর্কই তোমাদের ও তোমাদের স্ত্রীগণের মধ্যে বিরাজমান রয়েছে এবং তা থাকা বাঞ্ছনীয়।
(গ)অর্থনৈতিক
অধিকার:
রাসূলুল্লাহ
(স.)-এর আগমনের পুর্বে এবং তাঁর পরেও প্রায় ১২/১৩ শত বৎসর পর্যন্ত নারীরা প্রায়
সকল প্রকার অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। পিতা, স্বামী, ভ্রাতা বা পুত্রের
সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার লাভের তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। নিজের পক্ষ থেকে
কোনো সম্পদ উপার্জন করতে পারলেও বিবাহের সাথে সাথে স্ত্রীর সম্পত্তি স্বামীর
মালিকানাধীন হয়ে যেত। উনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগ থেকে অর্থাৎ প্রায় দেড় শত বৎসর যাবৎ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ক্রমান্বয়ে আইনের মাধ্যমে
নারীর পৃথক সম্পত্তি মালিকানা লাভ, স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্বাধীনভাবে ব্যবসা,
বাণিজ্য, চুক্তি ইত্যাদি সম্পাদনের অধিকার দেওয়া হয়েছে। (সূত্র: খুত: ইসলাম-২২৬পৃ.)
পক্ষান্তরে ইসলামে প্রথম থেকেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত
করা হয়েছে। বিবাহিত ও অবিবাহিত সকল অবস্থায় একজন প্রাপ্তবস্ক নারী একজন প্রাপ্ত
বয়স্ক পুরুষের মত একইভাবে ব্যবসা, বাণিজ্য, চুক্তি, সম্পদ অর্জন, সম্পদ
ক্রয়বিক্রয় ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার সংরক্ষণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে পিতা, স্বামী বা অন্য কারো কোনোরূপ মাতবরী, তত্বাবধান বা
খরবদারির আইনগত অধিকার বা সুযোগ দেওয়া হয় নি।
শুধু নিজের
জন্য বেঁচে থাকতে নারী ও পুরুষকে সৃষ্টি করা হয় নি। বরং নিজের বেঁচে থাকা ও
অধিাকার বুঝে নেওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সমৃদ্ধ পৃথিবীর জন্য তৈরী করা মানুষের
অন্যতম দায়িত্ব।
ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্ম,
চাকরী ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন, সঞ্চয় ও
ব্যয়ের ক্ষেত্রে নারীদেরকে পুরুষদের সমান অধিকার প্রদান করা হয়েছে। যোগ্যতা
থাকা সত্ব্বেও শুধু নারী হওয়ার কারণে তার
প্রতি কোনোরূপ বৈষম্য করা হয় নি বা কোনো কর্ম, চাকরী,
ব্যবসা তার জন্য নিষিদ্ধ করা হয় নি।(সূত্র: খুত: ইসলাম-২২৭পৃ.)
(ঘ)রাজনৈতিক
অধিকার:
অন্যান্য
অধিকারের ন্যায় রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রেও নারীর প্রতি কোনো বৈষম্যমূলক বিধান
ইসলাম প্রদান করে নি। রাজনৈতিক অধিাকারের ক্ষেত্রে মূল বিষয় দুটি:
প্রথমত: রাষ্ট্র পরিচালনায় মতামত ও পরামর্শ প্রদানের সুযোগ।
দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্র পরিচলনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন।
কুরআন
কারীমে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, সকল জাগতিক বিষয়ে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে
কর্ম নির্বাহ করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রাসূলুল্লাহ (স.) ও খুলাফায়ে রাশেদীন বিভিন্ন সামাজিক ও
রাষ্ট্রীয় বিষয়, খলীফা নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের পরামর্শও
গ্রহণ করতেন। বর্তমান যুগের সার্বজনীন ভোট ব্যবস্থা তখন ছিল না। তবে সামাজিক বা
রাষ্ট্রয় বিষয়ে নারীদের পরামর্শ নেওয়া হতো। (সূত্র: খুত: ইসলাম-২২৮পৃ.)
বিশ্বের
উন্নত দেশগুলোতে নারী উন্নয় ও ক্ষমায়নের পথ প্রতিনিয়ত প্রশস্ত হচ্ছে। সত্তরের দশকে
নারীর রাজনৈতিক অধিকার ও মর্যাদার বিষয়টি জাতিসংঘের নীতিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়।
এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালকে জাতিসংঘ ‘‘বিশ্ব নারী বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। জাতিসংঘের সহায়তায় ১৯৭৫
সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। সেই থেকে শুরু করে
কোপেনহেগেন, নাইরোবি ও ১৯৭৫ সালে বেইজিং-এ পর পর চারটি আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন
অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশে
নারীর ক্ষমায়নের প্রধান সীমাবদ্ধতা:
বিশ্বের
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীর ক্ষমতায়নে যেমন বহুবিধ সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তেমনি
বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে যেসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে
সেগুলো হলো:
(১)সামাজিক
অবস্থা: বাংলাদেশে
নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর
অধিকার পুরোপুরি সংরক্ষিত হয় নি। এখনো নারী নির্যাতন, যৌতুক লোভী স্বামী কর্তৃক
স্ত্রী হত্যা, নারী অপহরণ ও পাচার, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ ইত্যাদি সমাজে অহরহ হচ্ছে।
(২)শিক্ষাক্ষেত্রে
অনগ্রসরতা: পরিবারের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষার মান
উন্নয়ন ও সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার জন্য নারীর ক্ষমতায়নের
ক্ষেত্রে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু নারীশিক্ষার অগ্রগতি আশানুরুপভাবে
হচ্ছেনা। নারী শিক্ষার জন্য সরকার বিশেষ
সুযোগ-সুবিধা দিলেও জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা বিস্তার হচ্ছে না।
(৩)সচেতনতার
অভাব: বাংলাদেশের
নারী ক্ষমতায়নের একটি বড় বাধা হচ্ছে নারীদের আত্মসচেতনতার অভাব। উচ্চ শিক্ষায়
শিক্ষিত হয়ে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণে তাদেরও যে অধিকার আছে এ সত্য
উপলদ্ধি করতে তারা প্রায় ব্যর্থ হয়।
(৪)ধর্মীয়
গোঁড়ামি: নারীর ক্ষমতায়নে ধর্মীয় গোঁড়ামিও অনেকাংশে দায়ী।
নারীরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ুক তা এক শ্রেণীর মানুষ
কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। গোড়পন্থিরা নারীদের চার দেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ
রাখতে চাচ্ছে। তাদের ফতোয়ার বলি হয়েছে বাংলার হাজার হাজার নারী। অবশ্য
সাম্প্রতিককালে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক সকল
ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
শেষকথা:
প্রিয়
হাযেরীন! শুধু আইন করে, বিচার করে, কোনো নারীকে দায়িত্ব দিয়ে, সমাজে নারীদের ুপ্রতি
বৈষম্য রোধ করা যায় না। বৈষম্য দূর করা ও
অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য এ বিষয়ে ইসলামের নির্দেশ, নারীর অধিকার, কন্যা, স্ত্রী
ও মাতার অধিকার প্রতিষ্ঠা করলে মহান আল্লাহর নিকট দুনিয়া ও আখিরাতে পুরুস্কার
রয়েছে।
শেষকরছি
কতগোগু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে, তা হলো: নারীবাদিতা, পুরুষতান্ত্রিকতা, স্ত্রীর
অত্যাচার, স্বামীর অত্যাচার ইত্যাদি বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে বিচ্ছিন্নতা তৈরি নয়,
আমাদের মূল দায়িত্ব হলো, অধিকার ও দায়িত্ববোধের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। পাশাপাশি
নারী অধিকারের দোহাই দিয়ে নারীকে তার প্রকৃতির বিরুদ্ধ কাজে লিপ্ত করা, নারীকে তার
প্রকৃতি নির্ধারিত কর্ম করতে নিরুৎসাহিত করা ইত্যাদি মানবতা বিধ্বংসী প্রবণতা রোধ
করতে হবে। মহান আল্লাহ
তায়ালা আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন। আমিন।
No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com