হজ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক
এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
ভুমিকা:
হজ্ব আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা বা
সঙ্কল্প করা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পালনার্থে
নির্দিষ্ট সময়ে, নির্ধারিত
তারিখে, নির্দিষ্ট
স্থান তথা কাবা শরিফ ও তৎসংশ্লিষ্ট স্থানগুলো জিয়ারত করার সঙ্কল্প করাকে হজ্ব বলা
হয়। হজ্ব ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ। হজে রয়েছে নানাবিধ ফায়দা ও শিক্ষা।
তন্মধ্যে অন্যতম শিক্ষা হলো মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের শিক্ষা। আল্লাহ তায়ালা
ইরশাদ করেন,
وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ
سَبِيلًا وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ
আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাবাগৃহে
যাতায়াতের জন্য (দৈহিক ও আর্থিকভাবে) সক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর হজ্ব করা ফরজ
(সূরা আলে ইমরান-৩:৯৭)
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘অনিবার্য প্রয়োজন কিংবা অত্যাচারী শাসক অথবা
কঠিন রোগ যদি (হজে সামর্থ্যবান) কোনো ব্যক্তিকে হজ্ব পালনে বিরত না রাখে, তবে সে যদি হজ্ব পালন না করে মারা যায়, সে যেন ইহুদি ও নাসারার মতোই মৃত্যুবরণ করে। (দারেমি)
সুতরাং যে ব্যক্তি হজ্বব্রত পালন করল, সে স্রষ্টার নির্দেশ পালন করে নিজেকে ধন্য ও
জান্নাতি মানবে পরিণত করল। পবিত্র মক্কা ও মদিনায় রয়েছে অগণিত পবিত্র স্থান। যেমন
আল্লাহ তায়ালার ঘর, হাজরে আসওয়াদ, সাফা-মারওয়া, আরাফার মাঠ, মিনা, মুজদালিফা, মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী, প্রিয়নবী (সা)-এর রওজা মোবারক, জান্নাতুল বাকি, জান্নাতুল মুয়াল্লা, জমজম কূপ ইত্যাদি। এসব স্থান দেখার ফলে ঈমান
বৃদ্ধি পায়। পবিত্র হজের মাধ্যমেই এসব স্থান দেখার সুবর্ণ সুযোগ লাভ হয়।
মুসলিম
উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক:
হজ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক। এ ধরনের
সম্মেলন অন্য কোনো ধর্ম বা জাতির মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় না। একমাত্র তৌহিদবাদী
মুসলমানরাই পৃথিবীর দিক-দিগন্ত থেকে ছুটে আসে কাবা পানে। এখানে বর্ণ ও ভাষার
ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাই এক কাতারে দণ্ডায়মান হয়ে একই কণ্ঠে উচ্চারণ করেন- ‘লাব্বাইক
আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক
লা শারিকালাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল
হামদা ওয়ান নি’মাতা
লাকা ওয়ালমুলক, লা
শারিকালাক।’ অর্থাৎ আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির, আপনার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির, নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও নিয়ামত আপনারই, আর সব সাম্রাজ্যও আপনার, আপনার কোনো শরিক নেই।
সমতার
শিক্ষা:
হজ্ব থেকে লাভ করা যায় সমতার শিক্ষা।
রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো ও নানা দেশের নানা ভাষী মানুষ
ইহরাম অবস্থায় ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সাদা কাপড় পরিধান করে একই কাতারে কাঁধে কাঁধ
মিলিয়ে ইবাদত করার এ দৃশ্য মমতা ও অভিন্নতার শিক্ষা দান করে।
ত্যাগের
প্রশিক্ষণ:
আল্লাহর রাহে হজ্বরত ইব্রাহিম (আ:), ইসমাইল আ: ও হাজেরা (আ:)-এর ত্যাগ-তিতিক্ষা, শ্রম, কোরবানি, আত্মসমর্পণ ও অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার
সুমহান ঐতিহ্য আল্লাহপ্রেমিক মানবের হৃদয়কে অনুপ্রাণিত করে। হজ্ব ও কোরবানি এ
ত্যাগের শিক্ষা দেয়।
ভ্রাতৃত্বের
শিক্ষা:
মহানবী (সা) বলেছেন, সব মুসলমান ভাই ভাই। তার জ্বলন্ত নিদর্শন হজ্বব্রত
পালন। সব ধরনের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আরাফার মাঠে সব একত্র হয়। যেন সবাই একই মায়ের
সন্তান। একই ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করে একই স্রষ্টার কাছে দোয়া করে। হজ্ব বিশ্ব
মুসলমানদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন জোরদার করে। হজ্ব শেষ করে নিজ নিজ দেশে গিয়ে
বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করে।
আল্লাহর
নিয়ামত লাভ:
হজ্বব্রত পালনকারীদের ওপর আল্লাহর নিয়ামত
বর্ষিত হয়। মহানবী (সা) বলেছেন, যখন হাজীরা আরাফাতে অবস্থান করে দোয়া ও
কান্নাকাটি করতে থাকেন, তখন আল্লাহ
তায়ালা দুনিয়ার আসমানে আসেন এবং ফেরেশতাদের বলেন, ‘আমার বান্দাহদের দেখো, ওদের চুল এলোমেলো হয়ে আছে, পরিধেয় বস্ত্র ধুলাবালিতে মলিন। দেখো, ওরা এ অবস্থায়ই আমার কাছে চলে এসেছে।’ লোকেরা যখন আরাফাতে উপস্থিত হয়ে কান্নাকাটি
করে, তখন আল্লাহর
তরফ থেকে তাদের জন্য বিশেষ রহমত বর্ষিত হয়। আর আল্লাহ তায়ালার রহমতে আরাফার দিন
অধিকসংখ্যক পাপীকে ক্ষমা করে দেয়ার ফলে শয়তান খুবই ব্যথিত হয়।
সামরিক
প্রশিক্ষণ:
হজের কার্যক্রম গভীরভাবে চিন্তা করলে মনে হবে
যেন একদল চৌকস সেনাবাহিনীর সামরিক মহড়া। মিনায় তাঁবু জীবন, আরাফায় বিশাল প্রান্তরে অবস্থান, মুজদালিফায় রাত যাপন, জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ, মিনায় পশু কোরবানি, আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ায় সায়ি ইত্যাদি কাজ যেন একদল
প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সামরিক মহড়া। যা কাফির, নাস্তিক-মুরতাদ, মুশরিক ও আল্লাহর শত্রুদের মনে ভয়ের সঞ্চার
করে।
আন্তর্জাতিক
যোগাযোগের মাধ্যম:
হজে উপস্থিত হয় বিশ্বের নানা দেশের মানুষ। এ
সুযোগে তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ইত্যাদি বিষয়ে যোগাযোগ করার সুযোগ
সৃষ্টি হয়। একে অন্যের সঙ্গে মিশে ভাবের আদান-প্রদান করা যায় এবং সুখ-দুঃখের
আলোচনা করা যায়। ফলে হজ্ব আন্তর্জাতিক যোগাযোগের একটি উত্তম ক্ষেত্র। হজ্ব বিশ্ব
মুসলিমের বার্ষিক মিলনমেলা। আল্লাহ তায়ালা দিনে পাঁচবার জামাতে কিছুসংখ্যক লোকের, তারপর সপ্তাহে একবার জুমার দিনে আরো কিছু
বেশি লোকের, তারপর বছরে
দুইবার আরো কিছু বেশি লোকের, তারপর বছরে একবার হজে আরাফার মাঠে বিশ্বের সব
মানুষকে একত্র করার সুব্যবস্থা করেছেন।
উপসংহার:
হজ্ব মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি বিশ্ব সম্মেলন
এবং ইসলামী ঐক্যের প্রতীক। ফলে ইসলামে এর গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহর পবিত্র ঘর দেখা
থেকে শুরু করে বিদায়ী তাওয়াফ পর্যন্ত প্রতিটি কাজই আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ, বিশ্ব মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য ও সংহতির প্রশিক্ষণ। হজের মাধ্যমে একজন
হাজী নিজেকে জান্নাতে যাওয়ার উপযোগী করে তোলেন। তাই মহানবী (সা) বলেছেন, ‘মকবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছুই
না’। (বুখারি ও মুসলিম)

No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com