ইবলিস শয়তান ফেরেশতা নাকি জিন ছিল ?
এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
আমরা জানি খ্রিষ্টানদের মধ্যে এমন ধারণা আছে যে, ইবলিস
আসলে একজন সম্মানিত ফেরেশতা ছিল, তারপর তাকে বের করে দেওয়া হয়
এবং সে শয়তান হয়ে যায়। অনেক মুসলিমও এই ধারণা রাখেন, যখন
তারা এই আয়াতটি পড়েন—
وَإِذْ
قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَى
وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ
“যখন ‘আমি’ ফেরেশতাদেরকে বলেছিলাম, ‘আদমের প্রতি সিজদা করো, তখন তারা সিজদা করেছিল, তবে ইবলিস ছাড়া।…” [সূরা বাকারা- ২:৩৪]
ইবলিসকে তার জ্ঞান এবং যোগ্যতার জন্য ফেরেশতা
উপাধি দেয়া হয় আর তার নতুন নাম দেয়া হয় আজাজিল (“আল্লাহ্
শক্তিদানকারী” in Hebrew) [(Hebrew:,
Azazel; Arabic: عَزازِيل, Azāzīl)]। অর্থাৎ ইবলিস জেনেটিকালি জিন হলেও সে ফেরেশতার সম্মান
প্রাপ্ত ছিল। এরপর আদমকে সিজদার আদেশ অমান্য করার পর তার নাম হয় ইবলিস বা অভিশপ্ত।
তারমানে এখানে ফেরেশতা হিসেবে সম্বোধন করলেও কোন সমস্যা থাকে না।
তাছাড়া আরবি ভাষা এই ধরনের বাক্য গঠন করতে দেয়— “সেদিন
সন্ধায় দাওয়াতে আমার সব আত্মীয়রাই এসেছিল, ফখরুদ্দীন ছাড়া।” এখানে
ফখরুদ্দীন আমার আত্মীয় ছিল না, সে ছিল বাবুর্চি। ( সাইয়িদ কুতব — In the Shade of the
Quran)
আরবি ব্যাকরণে তাগ্লীব নামে একটা ব্যাপার আছে।
এর মানে, যদি Majority-কে সম্বোধন করা হয়, তবে
Minority-ও এতে সাড়া দেবে। যেমন, এক
ক্লাসে ১০০ জনের মধ্যে ৯৯ জন ছেলে, একজন মেয়ে। যদি বলা হয়
আরবিতে, ছেলেরা দাঁড়াও, তবে, সেই
মেয়েও উঠে দাঁড়াবে। এটাই তাগ্লীব। মেয়েকে আলাদাভাবে সম্বোধনের দরকার নেই।
একইভাবে কুরআনে আল্লাহ্ যখন ফেরেশতাদের ডাকলেন, তখন
আলাদাভাবে জিন ইবলিশকে ডাকার দরকার নেই।
ইবলিস ফেরেশতা ছিল না- এর আরও একটা প্রমাণ হল
সে যদি ফেরেশতা হত, তাহলে আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্য করতো না। কারণ
কুরআনেই ফেরেশতাদের প্রাথমিক গুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে-
لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ
وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
“তারা আল্লাহ্র আদেশ অমান্য করে না, এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করে।” [সূরা আত-তাহরীম ৬৬:৬]
ইবলিস যে জিন ছিল এব্যাপারে
কুরআনে পরিষ্কার আয়াত রয়েছে-
وَإِذْ
قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ كَانَ
مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ أَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ
أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِي وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ بِئْسَ لِلظَّالِمِينَ بَدَلًا
“‘আমি’ যখন ফেরেশতাদেরকে বললাম, “আদমের প্রতি সিজদা করো’, তারা সবাই করেছিল, ইবলিস ছাড়া—সে ছিল জিনদের একজন।” [সূরা আল-কাহফ ১৮:৫০]
প্রশ্ন: জিন এবং ফেরেশতার
মধ্যে পার্থক্য কি? কেউ কেউ বলে থাকে যে, ইবলিস শয়তান জিন ছিল; ফেরেশতা নয়। এটা কতটুকু সত্য?
উত্তর: ফেরেশতা ও জিনের মাঝে অনেক দিক দিয়ে পার্থক্য আছে। সেগুলোর মধ্যে মৌলিক
চারটি পার্থক্য উপস্থাপন করা হল:
১ম
পার্থক্য: ফরেশতাগণ
সৃষ্টি হয়েছে নূর বা আলো থেকে। আর জিন সৃষ্টির হয়েছে আগুন থেকে।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«خُلِقَتِ المَلاَئِكَةُ مِنْ نُورٍ،
وَخُلِقَ الجَانُّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ، وَخُلِقَ آدَمُ مِمَّا وُصِفَ لَكُمْ»
“ফিরিশতাদেরকে
জ্যোতি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। জিন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে অগ্নিশিখা হতে। আর
আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেই বস্তু থেকে, যা
তোমাদেরকে বর্ণনা করা হয়েছে। [অর্থাৎ মাটি থেকে]।” (মুসলিম)
ইবলিস শয়তান ছিল জিনদের অন্তর্ভূক্ত। সে
নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে বলেছে:
قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ ۖ خَلَقْتَنِي مِن
نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ
“সে (ইবলিস)
বললঃ আমি তার চেয়ে উত্তম আপনি আমাকে আগুনের দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটির দ্বারা।”
২য় পার্থক্য: ফেরেশতাগণ কখনো আল্লাহর আনুগত্য
করেন। তারা কখনও তাঁর অবাধ্যতা করেন না। আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পর্কে বলেছেন:
لَّا يَعْصُونَ اللَّـهَ مَا أَمَرَهُمْ
وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
“তারা
আল্লাহ তা’আলা যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করে।” (সূরা আত তাহরীম: ৬)
পক্ষান্তরে জিন জাতির মধ্যে কিছু আছে ঈমানদার
আর কিছু আছে কাফের। কিছু আছে নেককার এবং কিছু আছে পাপিষ্ঠ-যেমন রয়েছে মানুষের
মধ্যে।
জিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন: (জিনরা
বলেছিলো)
وَأَنَّا مِنَّا الْمُسْلِمُونَ وَمِنَّا
الْقَاسِطُونَ ۖ فَمَنْ أَسْلَمَ فَأُولَـٰئِكَ تَحَرَّوْا رَشَدًا – وَأَمَّا
الْقَاسِطُونَ فَكَانُوا لِجَهَنَّمَ حَطَبًا
“আমাদের
কিছুসংখ্যক আজ্ঞাবহ এবং কিছুসংখ্যক অন্যায়কারী। যারা আজ্ঞাবহ হয়, তারা সৎপথ বেছে নিয়েছে। আর যারা অন্যায়কারী, তারা তো
জাহান্নামের ইন্ধন।” (সূরা জিন: ১৪ ও ১৫)
ফেরশতাগণ মানুষকে সর্বদা ভালো কাজের আদেশ
করেন; কখনও খারাপ কাজের আদেশ করেন না।
পক্ষান্তরে ভালো ও সৎ জিনরা মানুষকে ভালো কাজের আর খারাপ জিনরা পাপাচার ও
অন্যায়-অপকর্মের নির্দেশ দেয়।
৩য় পার্থক্য: ফেরেশতদের মধ্যে জৈবিক চাহিদা
নাই। পক্ষান্তরে জিনদের মাঝে জৈবিক চাহিদা আছে।
৪র্থ
পার্থক্য: ফেরেশতা ও
জিন উভয়েই বিভিন্ন আকার-আকৃতি ধারণ করতে সক্ষম কিন্তু ফেরেশতারা কখনও খারাপ ও
ভয়ঙ্কর জিনিসের রূপ ধারণ করেন না বরং তারা কখনও কখনও সুন্দর ও ভালো জিনিসের আকার
ধারণ করে মানুষের সামনে হাজির হয়। যেমন, বিখ্যাত
হাদীসে জিবরাঈল। জিবরাঈল ফেরেশতা একজন সুদর্শন যুবকের আকৃতিতে দ্বীন ইসলাম শিখানোর
জন্য সাহাবীদের সামনে উপস্থিত হয়ে সবী সা. কে কতিপয় প্রশ্নের মাধ্যমে তাদেরকে
দ্বীন শিখিয়েছেন।
পক্ষান্তরে জিনরা ভালো-মন্দ ঊভয় জিনিসের আকার
ধারণ করে। খারাপ জিনগুলো কখনও কখনো ভয়ঙ্কর ও নোংরা জিনিসের আকার ধারণ করে মানুষরকে
ভয় দেখায়।
ইলবিস
শয়তান কি জিন ছিলো না কি ফেরেশতা ছিলো?
এর উত্তরে আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণীটি
যথেষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا
لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ كَانَ مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ
رَبِّهِ
“যখন আমি
ফেরেশতাদেরকে বললামঃ আদমকে সেজদা কর, তখন সবাই
সেজদা করল ইবলীস ব্যতীত।সে ছিল জিনদের একজন। সে তার পালনকর্তার আদেশ অমান্য করল।” (সূরা কাহফ: ৫০)
অতএব ওপরের আলোচনায় প্রতিয়মান হয় যে, ইবলিস শয়তান ফেরেস্তা ছিলনা ছিল শয়তান।
No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com