আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(০১)
হযরত
আবু বকর (রা.) এর জীবনী:
নবী রাসূলগণের পর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত আবু
বকর (রা) ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা। ইসলামের ইতিহাসে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে
থাকবে। নিম্নে তাঁর জীবনী সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো-
১. নাম
ও পরিচিতি : তাঁর
নাম আবদুল্লাহ। উপনাম আবু বকর, উপাধি عتبق ও صديق কুনিয়াত আবু কুহাফা। পিতার নাম ওসমান, মাতার নাম উম্মুল খায়ের সালমা
বিনতে সখর। তিনি রাসূল (স)-এর বাল্যকাল হতে মৃত্যু পর্যন্ত তথা সারা জীবনের
একমাত্র সাথি । তিনি নবী (স) থেকে ২ বছর ৪ মাসের ছোট ছিলেন।
২.
জন্ম : তিনি
৫৭১ বা ৭২ খ্রিস্টাব্দে আমুল ফীল-এর ২ বছর চার মাস পরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাসূল
(স)-এর চাচাতো ভাই ছিলেন ।
৩.
ইসলাম গ্রহণ : নবুয়তের
পূর্ব থেকেই রাসূল (স)-এর সাথে তাঁর ছিল ঘনিষ্ট সম্পর্ক। যার ফলে রাসূল (স) তাঁকে
ইসলামের দাওয়াত দেয়া মাত্রই তিনি তা গ্রহণ করেন এবং তিনিই ছিলেন পুরুষদের মধ্যে
সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী।
৪.
রাসূলের সাহচর্য : হযরত
আবু বকর (রা) মহানবী (স)-এর সার্বক্ষণিক সহচর ছিলেন। ফলে হিজরতে তিনিই রাসূল
(স)-এর একমাত্র সাথি ছিলেন ।
৫.
যুদ্ধে অংশগ্রহণ : হযরত
আবু বকর (রা) বদরসহ সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি তাবুক অভিযানে স্বীয় সকল
সম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে যুদ্ধ তহবিলে দান করেন।
৬.
খেলাফত লাভ : রাসূল
(স)-এর ইন্তেকালের পর তিনি ইসলামের প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন। একাধারে দু’বছর তিন মাস দশ দিন তিনি
খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন।
৭.
হাদীস বর্ণনা : বিশাল
ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত থাকায় সময়ের স্বল্পতার মধ্য দিয়ে
১৪২ খানা হাদীস বর্ণনা করেছেন। তবে তাঁর থেকে অনেক প্রসিদ্ধ রাবী হাদীস বর্ণনা
করেছেন।
৮.
ইন্তেকাল : হযরত
আবু বকর (রা) ১৩ হিজরীর ২১ জমাদিউসসানীতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী
স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস তাঁকে গোসল দেন। তাঁকে হযরত আয়েশা (রা)-এর হুজরায় রাসূল
(স)-এর পাশে দাফন করা হয়।
৯. আবু
বকর (রা)-এর বৈশিষ্ট্য : রাসূল (স)-এর ইন্তেকালের পরে হযরত আবু বকর (রা)-ই খলিফা হওয়ার জন্য সর্বাধিক
যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিলেন এবং খলিফার পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। হযরত আবু বকর (রা)
ছিলেন বহুবিধ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তাঁর বৈশিষ্ট্যাবলি থেকে কতিপয় নিম্নে আলোচনা
করা হলো-
১. তিনি ছিলেন রাসূল (স)-এর একমাত্র বিশ্বস্ত
বন্ধু এবং তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তিনিই একমাত্র সাহাবী, যাঁর সাহাবী হওয়ার ব্যাপারটি
কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন-
ثانِي اثْنَيْنِ إِذْهُمَا فِي
الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لا تَحْزَن
২. হযরত আবু বকর (রা)-এর গোটা জীবন, বিত্ত-বৈভব সবকিছুই ইসলামের জন্য উৎসর্গিত ছিল। রাসূল (স) বলেছেন, আমি আবু বকরের ঋণ শোধ করতে পারব না।
৩. রাসূল (স)-এর অসুস্থতার সময় তিনি মসজিদে
নববীতে নামাযের ইমামতি করেন। রাসূল (স) বলেছেন-
৪. রাসূল (স)-এর মদিনায় হিজরতের সময় তিনিই একমাত্র তাঁর সফরসঙ্গী
ছিলেন।
৫. তিনিই সর্বপ্রথম বয়স্কদের মধ্যে ইসলাম
গ্রহণ করেন।
৬. রাসূল (স) একমাত্র তাঁর সম্পর্কেই বলেছেন-
١. لَو اِتَّخَذْتُ مِنَ النَّاسِ خَلِيْلًا لَا تَخَذْتُ
أَبَا بَكْرٍ خَلِيلًا
٢. سَدُّوا عَلى كُلِّ خُوخَةٍ إِلَّا خُوحَ أَبِي بَكْرِ
৭. রাসূল (স)-এর মিরাজের অভিনব ঘটনাকে তিনিই সর্বপ্রথম সত্যায়ন করেছেন। এজন্য
রাসূল (স) খুশি হয়ে তাঁকে উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
৮. তিনি আশারায়ে মুবাশশারার অন্যতম। হাদীসে বলা হয়েছে, তাঁকে বেহেশতের সকল দরজা দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হবে। যেখান দিয়ে পছন্দ
তিনি প্রবেশ করবেন। মোটকথা, তিনি ছিলেন , أَفْضَلُ الْبَشَرِ
بَعْدَ الْأَنْبِيَاء তথা নবী
রাসূলগণের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।
ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) ৫৭৩
সালে মক্কার কুরাইশ বংশের বনু তাইম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবু
কুহাফা ও মায়ের নাম সালমা বিনতে সাখার। প্রাপ্তবয়স্কদের
মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণের সম্মান তাকে দেওয়া হয়। এ ছাড়া তিনি রাসূল (সা.)-এর
শ্বশুর ছিলেন। রাসূলের মৃত্যুর পর তিনি খলিফা হন এবং মুসলমানদের নেতৃত্ব দেন।
রাসূলের মেরাজের ঘটনা এক ব্যক্তির কাছে শুনে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস করেছিলেন।
মুহাম্মাদের প্রতি অতুলনীয় বিশ্বাসের জন্য তাকে ‘সিদ্দিক’ বা
বিশ্বস্ত উপাধি প্রদান করা হয়।
তরুণ বয়সে আবু বকর (রা.) একজন বণিক হিসাবে জীবিকা
নির্বাহ শুরু করেন। ইয়েমেন থেকে বাণিজ্য শেষে ফেরার পর তিনি মুহাম্মাদের ইসলাম
প্রচারের সংবাদ পান। এরপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণ অন্য অনেকের
ইসলাম গ্রহণের উৎসাহ জুগিয়েছে।
আবু বকরের পূর্ণ নাম আবদুল্লাহ ইবনে উসমান ইবনে
আমির ইবনে আমর ইবনে কাব ইবনে সাদ ইবনে তায়িম ইবনে মুররাহ ইবনে কাব ইবনে লুয়াই ইবনে
গালিব ইবনে ফিহর আল কুরাইশি। কুরআনে আবু বকরকে ‘গুহার
দ্বিতীয় ব্যক্তি’ হিসাবে সম্বোধন করা হয়েছে। হিজরতের সময়
মুহাম্মাদের সঙ্গে সাওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেওয়ার কারণে এভাবে সম্বোধন করা
হয়েছে।
আবু বকর প্রথম যুগের ইসলাম গ্রহণকারীদের
অন্যতম। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তিনি প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ সম্পর্কে বলা
হয়েছে, অন্যান্য সবার ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তাদের মনে কিছু মাত্রায়
দ্বিধা ছিল; কিন্তু আবু বকর বিনা দ্বিধায় ইসলাম গ্রহণ করেন।
আবু বকরের ইসলাম গ্রহণ অনেককে ইসলাম গ্রহণে
অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ইসলাম গ্রহণে উৎসাহ জোগান। তার দ্বারা
উৎসাহিত হয়ে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আবু বকর দাসদের প্রতি সদয় হয়ে অনেককে
কিনে নিয়ে মুক্ত করে দেন। আবু বকরের মুক্ত করা দাসরা অধিকাংশ নারী, বৃদ্ধ
বা দুর্বল ব্যক্তি ছিলেন।
৬২৪ সালে আবু বকর মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে
সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ বদরের যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি রাসূল (সা.) এর তাবুর প্রহরার
দায়িত্বে ছিলেন। পরের বছর উহুদের যুদ্ধেও তিনি অংশ নিয়েছেন। পরে আবু বকর ইহুদি বনু
নাদির গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নিয়েছেন।
৬২৭ সালে তিনি খন্দকের যুদ্ধ এবং পরবর্তী বনু
কুরাইজা অভিযানে অংশ নিয়েছেন। খন্দকের যুদ্ধের সময় মুহাম্মাদ (সা.) সৈনিকদের বেশ
কয়েকটি দলে ভাগ করে একেক অংশ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তন্মধ্যে একটি আবু
বকরের তত্ত্বাবধানে ছিল।
শত্রুরা নানাভাবে পরিখা অতিক্রমের চেষ্টা করলেও
আবু বকর তার দায়িত্বপ্রাপ্ত অংশে আক্রমণ ঠেকিয়ে দেন। তার নামে সে অংশে একটি মসজিদ
নির্মিত হয়, যা মসজিদ-ই-সিদ্দিকি বলে পরিচিতি লাভ করে।
৬২৮ সালে তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধিতে অংশ
নিয়েছিলেন। তিনি এ সন্ধির অন্যতম সাক্ষী হিসাবে স্বাক্ষর করেন। তিনি খায়বারের
যুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন।
৬৩০ সালে আবু বকর মক্কা বিজয়ে অংশ নেন। ৬৩০
সালে তিনি হুনায়নের যুদ্ধ এবং তাইফ অবরোধে অংশ নেন। হুনায়নের যুদ্ধের সময় মুসলিম
সেনাবাহিনী হুনায়ন উপত্যকার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা
শত্রুদের তীরের সম্মুখীন হয়।
অপ্রস্তুত অবস্থায় হামলা হওয়ায় মুসলমানদের
মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল। অনেকে ছোটাছুটি শুরু করলেও কয়েকজন সাহাবি মুহাম্মাদ
(সা.)কে রক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। আবু বকর তন্মধ্যে অন্যতম।
৬৩০ সালে তাবুক অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়। এতে
সহায়তার জন্য মুহাম্মাদ মুসলমানদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়াতে বলেন। উসমান ইবনে
আফফান এতে প্রায় নয়শ উট এবং একশ ঘোড়া দান করেন। উমর ইবনুল খাত্তাব তার সম্পদের
অর্ধেক দান করেন।
আবু বকর তার সব সম্পদ দান করে এক্ষেত্রে
দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তার বক্তব্য ছিল,
আমি
আল্লাহ ও তার রাসূলকে আমার ও আমার পরিবারের জন্য রেখেছি। ৬৩১ সালে মুসলমানদের একটি
দল মুক্তভাবে হজের উদ্দেশে মক্কা গমন করে। আবু বকর এ দলের নেতৃত্ব দেন। ইসলামের
ইতিহাসে তিনি প্রথম আমিরুল হজ বা হজের নেতা হিসাবে স্বীকৃত।
বিদায় হজ থেকে ফেরার কিছুকাল পর মুহাম্মাদ
(সা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় তিনি তার
মৃত্যুর চার দিন আগ পর্যন্ত নামাজের ইমামতি করেছেন। এরপর অসুস্থতার মাত্রার কারণে
ইমামতি করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
তিনি এ সময় আবু বকরকে নামাজের ইমাম হিসাবে
দায়িত্ব প্রদান করেন। মুহাম্মাদের মৃত্যু সংবাদ প্রচার হওয়ার পর উমর ইবনুল খাত্তাব
অশান্ত হয়ে পড়েন এবং তা মানতে অস্বীকৃতি জানান। এ সময় আবু বকর বাইরে এসে ঘোষণা
করেন, তোমাদের মধ্যে যারা মুহাম্মাদের অনুসরণ করতে তারা জেনে
রাখুক যে, মুহাম্মাদ মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা আল্লাহর
ইবাদত করতে, অবশ্যই আল্লাহ সর্বদাই জীবিত থাকবেন কখনো
মৃত্যুবরণ করবেন না। আবু বকরের বক্তব্যের পর উমরের অবস্থা শান্ত হয়।
আবু বকরের খিলাফত ২৭ মাস অর্থাৎ দুই বছরের কিছু
বেশি সময় স্থায়ী ছিল। এ সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তাকে বেশ কিছু অস্থিতিশীলতার
সম্মুখীন হতে হয় এবং তিনি তা সফলভাবে মোকাবিলা করেন। নতুন নবী দাবিকারী
বিদ্রোহীদের তিনি রিদ্দার যুদ্ধে দমন করেন। তিনি বাইজেন্টাইন ও সাসানীয়
সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন,
যা
ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
এসব অভিযানের ফলে মুসলিম সাম্রাজ্য কয়েক দশকের মধ্যে শক্তিশালী হিসাবে আবির্ভূত হয়। আবু বকর
সর্বপ্রথম গ্রন্থাকারে কুরআন সংকলন করেন। ইতোপূর্বে কুরআনের বিভিন্ন অংশ
বিচ্ছিন্নভাবে লিপিবদ্ধ ছিল। মৃত্যুর আগে আবু বকর (রা.) কুরআনের এ কপিটি তার
উত্তরসূরি উমর ইবনুল খাত্তাবকে দিয়ে যান। উমর (রা.)-এর শাসনকালে এটি তার কাছেই
রক্ষিত ছিল।
উমর কুরআনটি তার মেয়ে ও মুহাম্মাদ (সা.) এর
স্ত্রী হাফসা বিনতে উমরকে দিয়ে যান। পরবর্তী খলিফা উসমান ইবনে আফফান (রা.) এ
কুরআনের আরও প্রতিলিপি তৈরি করিয়ে তা খেলাফতের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেছিলেন।
৬৩৪ সালের ২৩ আগস্ট আবু বকর (রা.) মারা যান।
আয়েশা (রা.)- এর ঘরে মুহাম্মাদ (সা.)-এর পাশে তাকে দাফন করা হয়।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(০২)
হযরত ওমর (রাঃ)-এর
জীবনী:
মহানবী (সা.) এর ১৩
বছরের ছোট হযরত ওমর ৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইস বংশের আদিয়া গোএের এক
সম্ভ্রান্ত পরিবারে জম্নগ্রহন করেন। তাঁর চল বা ডাক নাম ছিল হফস। পিতার নাম ছিল
খাওাব এবং মায়ের নাম ছিল খানতামা। শ্যামলা ও দীর্ঘকায় ওমর খুব শক্তিশালী,তেজস্বী,বীর পুরুষ হিসেবে খ্যাতি অজন
করেন। তিনি একাধারে ছিলেন কুস্তিগিরি, বাগ্মী ও কবি।
ঐতিহাসিক বালাজুরীর মতে, জাহেলিয়া যুগে কুরাইশ বংশের মাএ ১৭
জন শিক্ষিত ব্যাক্তির মধ্য হয়রত ওমর ছিলেন অন্যতম। সফল ব্যাবসায়ী হিসাবে তাঁর
সুনাম ছিল এবং ব্যাবসার কারনে তিনি সিরিয়া ও পারস্য ভ্রমন করেন।
হযরত ওমর প্রথম জীবনে ইসলামের ঘোর বিরোধী হলেও ৬১৬ খ্রিস্টাব্দে নবী করীমের
নিকট ৩৩ বৎসর বয়সে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। জানা যায়, তার ইসলাম গ্রহণের জন্য রাসূল (সা.) স্বয়ং আল্লাহর কাছে
দোয়া করেছিলেন। তাঁর ইসলাম ধর্ম গ্রহণে ইসলামের ইতিহাসে এক গৌরোজ্জ্বল অধ্যায়ের
সূচনা হয়। ইসলাম গ্রহনের পর নবী করীম (স.) হযরত ওমর কে “ফারুক” উপাধিতে ভূষিত করে
সম্মানিত করেন।
তার জীবনের শুরুতে ওমর (রা.) ইসলামের ঘোর শক্র থাকা অবস্থায় তিনি নও
মুসলিমদের সাথে খুবই খারাপ ব্যাবহার ও তাঁদের নির্যাতন করতেন৷ জানা যায়, বাড়ির চাকরানি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করাই তিনি তাঁর ওপর অসহনীয়
নির্যাতন করেন৷ এমনকি তিনি মহানবীর প্রতি এতটাই ক্ষিপ্ত ছিলেন যে, একদিন তিনি তাঁর খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে মহানবী (সা.) কে
হত্যা করার উদ্দেশে রওয়ানা দেয়।
পথিমধ্যে নঈম বিন আব্দলা নামক জনৈক ব্যক্তির সাথে তার সাঙ্গাৎ হয়। নঈম তাঁকে
জিঙ্গাসা করলেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ? ওমর (রা.) উত্তরে বলেন, মুহাম্মদ কে হত্যা করতে যাচ্ছি। নঈম বলেন, আগে তোমার নিজের ঘরে গিয়ে দেখ স্বয়ং তোমার ভগ্নিপতি ইসলাম গ্রহন করেছে। একথা
শুনে রাগে অগ্নিশরমা হয়ে তিনি ভগ্নিপতি বাড়ির দিকে রওনা হন।
ওমর (রা.) এর আগমনের খবর পেয়ে তাঁর ভাগ্নিপতি ও তার স্ত্রী কুরআন শরীফের যে
অংশটুকু সূরা “তা-হা” পাঠ করতে ছিলেন তা লুকিয়ে রাখেন। ওমর( রা.) জানতে চাইলেন যে, তাঁরা তাদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথা সত্য কিনা। জবাবে তারা
জানায়,
তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছে। এতে অত্যাধিক
ক্ষিপ্ত হয়ে ওমর (রা.) তাঁদের উপর নির্মমভাবে নির্যাতন করতে লাগলো, কিন্তু তাতে কোন ফল হয় নি। তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্তে অটল
থাকলেন।
হযরত উমর বাড়িতে প্রবেশের আগে শুনতে পেয়েছিলেন তারা কিছু পড়ছে। হটাৎ তিনি
বলেন,
আমি এখানে প্রবেশের পূর্বে তোমরা যা পড়ছিলে
তা নিয়ে আসো তো দেখি। প্রথমে আনতে না চাইলেও পরে তার ভগ্নীপতি তার কাছে কোরআন
শরীফ নিয়ে আসেন।
তার কাছে কোরআন শরীফ দেবার পর তিনি সেখান থেকে পড়তে থাকেন। কোরআন কিছুটা পড়ে
তিনি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি বুঝতে পারেন যে, আর যাইহোক এই কোরআন শরীফ কোন মানুষের লেখা হতে পারেনা। অতঃপর তিনি সেখান থেকে
উঠে তরবারি নিয়ে রওনা দেন রাসূল (সা:) এর উদ্দেশে।
হযরত ওমর এর আসার সংবাদ পেয়ে সাহাবীরা রাসূল (সা:) কে রক্ষা করার জন্য
একত্রিত হোন। ওমর রাসূল (সা:) এর পায়ের কাছে তরবারি রেখে তিনি তাকে ইসলাম ধর্মে
দীক্ষিত করার জন্য রাসূল (সা:) কে অনুরোধ করেন। অতঃপর রাসূল (সা:) তাকে শাহাদাত
পাঠ করিয়ে ইসলামে বরণ করে নেন। এভাবে হযরত ওমর (রা.) নবুয়াতের ষষ্ঠ বৎসরে ৩৩ বৎসর
বয়সে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহন করার পর রাসূল (সা.) তাঁকে “ফারুক” অথাৎ সত্য মিথ্যার
প্রভেদকারী উপাধিতে ভূষিত করেন।
ওমর (রা) এর ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানগন অনেক শক্তিশালী হয় এবং ওমর (রা.) এর
তেজস্বিতার কারণে কাফের গণ ভীত হয়ে পরে। আর এ সুযোগে মুসলমানগন প্রকাশ্যে নব
উদ্যমে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। মহানবীর আদেশে তিনি বিশ জন মুসলমান কে নিয়ে মদিনায়
হিজরত করেন। মদিনাতে মহানবী যখন নামাজের জন্য কিভাবে আহ্বান করা হবে তা নিয়ে
চিন্তিত ছিলেন, তখন ওমর ফারুকই আজান দ্বারা নামাজের আহ্বান
সংকেত প্রচলন করার পরামর্শ দান করেন। যা পরবর্তী কালে ঐশীবানী দ্বারা অনুমোদিত হয়।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) খোদার হুকুমে সে পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং হযরত বেলালকে
প্রথম মুয়াজ্জিন হিসেবে নিযুক্ত করেন।
মদিনায় হিজরত এর পর কুরাইসগন যখন মদিনা আক্রমণ করে তখন বদর প্রাপ্তরের যুদ্ধ
ওমর মুসলমানদের পতাকার ছায়াতলে যুদ্ধ করেন। ওহুদের যুদ্ধে মহানবীর জীবন রক্ষার জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়ান। রাসূল
(সাঃ) জীবিত থাকা অবস্থায় এভাবেই প্রতিটি যুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন
ও রাসূল (সা:) এর জীবনে রক্ষার জন্য নিজ বুক পেতে দেন ।
হযরত উমর এর দুরুদর্শিতা, ঈমান, আখলাক, প্রজ্ঞা এমনি ছিল
যে মহানবীর (সা:) বলেছিলেন, তার পরে কেউ নবী হলে সে হত হযরত ওমর (রা:)
আনহু। রাসূল (সা:) এর মৃত্যুর পর যখন মুসলিমদের মাঝে বিষ্মৃঙ্খলা দেখা দেয় তখন
হযরত ওমর খোলা তরবারী হাতে নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই আর্থিক তহবিল করার কথা বলতেন তখনই
হযরত ওমর দানের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। হযরত উমর ছিলেন শ্রেষ্ট
দানশীলদের একজন। তিনি রাসূলের কোষে অসংখ্য স্বর্ণ মুদ্রা দান করেছেন। হযরত উমরের
দানশীলতা দেখে অনেক মুসলিম দানের প্রতি আগ্রহী হন ও বেশি বেশি করে দান করতে থাকেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুবরণ করবার পরে যখন মুসলিমদের
মাঝে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় তখন তিনি খোলা তরবারী হাতে নিয়ে হুংকার দেন। যার ফলে
উদ্ভূত সেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
খলিফা হযরত ওমরের
দূরদর্শিতার ফলে মুসলিমদের সাম্রাজ্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। যা কিনা অন্যন্যা যেকোন
সময়ের থেকে বেশি। এভাবেই খলিফা হিসেবে হযরত ওমর তার দূরদর্শিতা, একাগ্রতা, বিচক্ষণতার বলে
ইসলামের খেদমত করে গিয়েছেন।
খলিফা হিসেবে হযরত ওমর:
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে হযরত ওমর ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ। তার শাসন আমলে
যাবতীয় বিশৃঙ্খলা তিনি কঠোর হস্তে দমন করেন। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা দেয় যে, মদ্য পানের অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হওযায় তিনি তার নিজ
সন্তানকে ১০০ বেত্রাঘাত করেন। একজন শাসকদের অসাধারণ চরিত্র ফুটে উঠে এর মাধ্যমে।
খলিফা হয়রতের এমন অসাধারণ কঠোরতা তার শাসনামলে সকলের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার
সৃষ্টি করে। পূর্ববর্তী খলিফার তুলনামূলক নমনীয় আচরণের
ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা তিনি খুবই সূচারু রূপে সমাধান করেন। তার সময়ে নানা বিদ্রোহ
তিনি কঠোর হাতে দমন করেন।
হয়রত ওমরের মৃত্যু:
হযরত ওমর এর খিলাফতকাল ছিলো সর্বমোট ১০ বছর ৬ মাস। হযরত ওমর ফারুক (রা:) হিজরী ২৩ সালে ২৪ যিলহজ্জ্ব তারিখে বুধবার মসজিদে নববীতে ফজরের
নামাযে ইমামতি করার জন্য দাড়ালে হযরত মুগিরা ইবনে শোবা (রা:) এর একজন দাস আবু লুলু
বিষাক্ত তরবারী দ্বারা হযরত ওমর ফারুক (রা:) কে আঘাত করলে তিনি গুরুতর আহত হয়ে
পরেন। পরবর্তীতে আহত অবস্থায় তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর ২৭ যিলহজ্জ্ব তিনি শাহাদাত
বরণ করেন। হযরত ওমর (রা:) কে মসজিদে নববীতে হযরত সিদ্দিকে আকবর (রা:) এর কবরের
বামপাশে দাফন সম্পন সম্পন্ন করা হয়।
ইসলামের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি নাম খলিফা হযরত ওমর (রা:)।
পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত যার নাম প্রতিটি ঈমানদার মোমিনের অন্তরের আকাশে দীপ্তিমান
নক্ষত্রের মতন দীপ্তিমান থাকবে। আর তাইতো, খলিফা হযরত ওমর আমাদের অনুপ্রেরণা, আমাদের আদর্শ।
প্রাথমিক জীবন উমর
বর্তমান সৌদী আরবের মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খাত্তাব ইবনে
নুফাইল। তাদের পরিবার মূলত মধ্যবর্তী ধরনের ছিল। তিনি শিক্ষিত ছিলেন যা তখনকার আরব
সমাজে অনেকটাই ব্যতিক্রম ছিল এবং শিক্ষিতদের অন্যরকম সম্মান ছিল। সুস্বাস্থ্য, শক্তিশালী, সাহসী এবং বিশেষ করে রাগী
পুরুষ হিসেবেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন। যৌবনকালে একজন প্রথম শ্রেণীর কুস্তীগীর হিসেবে
প্রখ্যাত ছিলেন। তথনকার আমলে মদ পান আরবে খুবই সাধারণ বিষয় ছিল এবং অনেকের
বর্ণনামতে উমর ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মদ পান করতেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর তিনি
কখনও মদ্য স্পর্শ করেননি।
মুহাম্মদ(সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সময়কাল এ প্রাথমিক ইসলাম শত্রুতা
মুহাম্মদ(সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন প্রথম ইসলামের বাণী প্রচার করেন তখন উমর তাঁর তীব্র
বিরোধিতা করেন এবং কুরাইশদের প্রথাগত ধর্ম রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ইসলাম
বিরোধী হিসেবে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। আরবের প্রথাগত বহুঈশ্বরবাদী ধর্ম রক্ষার
খাতিরে ইসলাম গ্রহণকারী আরব এবং মুহাম্মদ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর
বিরোধিতায় অনড় এবং নিষ্ঠুর ভুমিকা নিয়েছিলেন। উমর এর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এই নূতন
ধর্ম ইসলাম কুইরাইসদের মাঝে বিবাদ এবং বিভাদ সৃষ্টি করবে।
কুরাইশদের নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে মুহাম্মদ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম) অনুসারিদের বললেন আবিসিনিয়া য় হিজরত করতে। ছোট একটা দলের এই
আবিসিনিয়ার হিজরতের ঘটনা উমর কে কুরাইশ বংশের ভবিষ্যৎ একতা সম্পর্কে ভীতি এবং
দুশ্চিন্তায় ফেলে দিল। যার ফলশ্রুতিতে উমর মুহাম্মদ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
কে হত্যার পরিকল্পনা করলেন।
ইসলাম
ধর্ম গ্রহণ
ইবনে ইসহাকের সীরাত
গ্রন্থ অনুসারে উমর "মুহাম্মদকে" (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন এবং একদিন সে উদ্দেশ্যেই মুক্ত তরবারী হাতে ঘর থেকে বের
হন। পথিমধ্যে তিনি একজনের সাক্ষাৎ লাভ করেন যিনি ইতোমধ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ
করেছিলেন। সেই ব্যক্তি তাঁকে নবীকে হত্যার পূর্বে প্রথমে নিজের ঘর সামলানোর জন্য
বলেন। তাঁর কাছে উমর জানতে পারেন তাঁর বোন ফাতিমা এবং ভগ্নীপতি ইসলাম গ্রহণ করেছে।
অগত্যা তিনি বোনের বাড়িতে যান এবং বোন ও ভগ্নীপতিকে কুরআন এর আয়াত আবৃতিরত
অবস্থায় আবিষ্কার করেন। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ভগ্নীপতিকে মারধর করেন ; ফাতিমা তাঁর স্বামীকে রক্ষা করতে এলে তাকেও আঘাতের শিকার হতে
হয়। প্রচণ্ডভাবে আহত হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কেউই ইসলাম ত্যাগ করতে সম্মত হন নি।
বোনের শরীরে রক্ত দেখে তিনি শান্ত হন এবং তাঁরা যা পাঠ করছিলো তা দেখতে চান।
পবিত্র হয়ে কুরআনের একটি আয়াত তিনি পাঠ করেন। আয়াতটি ছিল সূরা ত্বা-হা'র অংশ। সেই আয়াতটি তাঁকে এতই অভিভূত করে যে তিনি সেদিনই মুহাম্মদের
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে যেয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইসলাম
গ্রহণের পর ইসলাম প্রসারে তিনি ততটাই ভূমিকা রেখেছিলেন, গ্রহণের
পূর্বে ইসলামের বিরুদ্ধে যতটা ভূমিকা রাখতেন।কুরআনের অর্থ।
মদীনায়
হিজরত
আল্লাহর নির্দেশে
রাসূল (সাঃ) সাহাবীদেরকে মদীনায় হিজরত করতে নির্দেশ দেয়ার পর, ওমর (রাঃ) বেশ কয়েকজন সাহাবীকে সাথে নিয়ে প্রকাশ্যে হিজরত
করেন তিনি তখন জনসম্মুখে বলেছিলেন, কেউ যদি তার মাকে
সন্তানহারা এবং স্ত্রীকে বিধবা করতে চায়, সে যেন আমাকে বাধা
দিতে এগিয়ে আসে তার প্রবল সাহকিকতা ও বীরত্বের কারণে কুরাইশদের কেউ তাকে বাধা
দিতে সাহস পায়নি মদীনায় উমরের জীবন মদীনায় ওমর (রাঃ) নবীজী(সাঃ)-এর পাশে থেকে
হিজরতকারী মুসলিমদের একজন সহচর ও প্রতিনিধি মুসলিম নেতার ন্যায় ভূমিকা রাখেন মদীনায়
হিজরতের পর সংঘটিত বদরের যুদ্ধ, উহুদের যুদ্ধ এবং খন্দকের
যুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন|
হুদায়বিয়ার সন্ধির একজন অন্যতম সদস্য ও স্বাক্ষী ছিলেন তিনি এছাড়া
মক্কা বিজয়, হুনাইনের যুদ্ধ, খাইবারের
অভিযান, তাবুকের যুদ্ধ এবং বিদায় হজ্জেও তিনি অংশগ্রহণ করেন।
মুহাম্মাদ(সাঃ)-এর
মৃত্যু
নবীজী(সাঃ) এর
মৃত্যুর পর ওমর(রাঃ) নবীজী(সাঃ) কে অত্যধিক ভালোবাসার কারণে তা সহজে বিশ্বাস করতে
পারেন নি এবং এ খবর যারা প্রচার করবে তাদেরকে হত্যা করবেন বলে লোকজনের কাছে ঘোষণা
করতে থাকেন কিন্তু অনতিবিলম্বকাল পরে আবু বকর(রাঃ) এসে তাকে থামিয়ে সকলের কাছে
নবীজী (সাঃ) এর মৃত্যূসংবাদ ঘোষণা করেন আবূ বকর(রাঃ) নিজের বেদনাকে সংযত করে দৃঢ়
কন্ঠে বলেন,যারা মুহাম্মাদ(সাঃ) এর
উপাসনা করো তারা জেনে রাখ তিনি মারা গেছেন এবং যারা আল্লাহর উপাসনা কর তারা জেনে
রাখ, আল্লাহ অমর-অবিনশ্বর এবং এরপর সূরা আলে ইমরান থেকে এ
সম্পর্কিত একটি আয়াত পাঠ করেন। আবু বকর(রাঃ) এর এই দৃঢ়
বক্তব্য শুনে ওমর (রাঃ) সম্বিত ফিরে পান এবং নবীজী (সাঃ) এর ইন্তেকালের সত্যতা
বুঝতে পেরে অবনর্নীয় যাতনায় অঝরে অশ্রু বিসর্জন করেন।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(০৩)
হযরত উসমান(রা:):
খোদায়ী বিধানের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত, দানশীলতায় অগ্রগামী, লজ্জাশীলতায় সর্বকালীন দৃষ্টান্ত, ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত 'ওসমান ইবনে আফফান' ৫৭৩ মতান্তরে ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে (ড. সৈয়দ
মাহমুদুল হাসান) মক্কার ঐতিহ্যবাহী কোরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ
করেন।
আল ইসতিয়াবের বর্ণনানুসারে 'আমুল ফিল'-এর ছয় বছর পরে অর্থাৎ ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি
জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম 'আফফান' ও মায়ের নাম
আরওয়া বিনতে কোরাইশ। হজরত ওসমান (রা.)-এর বংশপরম্পরা পঞ্চম পুরুষ 'আবদে মানাফ'-এ গিয়ে রাসুলে করিম (সা.)-এর বংশধারায় মিলিত
হন।
তিনি ছিলেন মধ্যমাকৃতির অত্যন্ত সুদর্শন।
ইবনে আসাকির আব্দুল্লাহ ইবনে হাজাম মাজেনি থেকে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি
বলেছেন, 'হজরত ওসমান অপেক্ষা সুদর্শন কোনো পুরুষ আমি দেখিনি।' হজরত ওসমান (রা.)-এর জীবনের প্রাথমিক অবস্থার
ইতিহাস খুব সামান্যই সংরক্ষিত আছে। তবে যতটুকু জানা গেছে, জাহিলিয়াতের যুগে জন্ম হলেও জাহিলিয়াতের
বীভৎসতা তাঁর চরিত্রকে কলুষিত করতে পারেনি।
ইসলাম গ্রহণের আগে তিনি ছিলেন হানিফ ঘরানার
লোক। যাঁরা নিজের বিবেকের নির্দেশনায় খারাপ কাজ থেকে বিরত থেকেছেন। তিনি ছিলেন
আরবের মুষ্টিমেয় শিক্ষিত লোকের একজন। তিনি ছিলেন কোরাইশ বংশের অন্যতম কুস্তিবিদ্যা
বিশারদ। কোরাইশদের প্রাচীন ইতিহাস বিষয়েও তিনি ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী। বংশীয়
আভিজাত্যের ধারায় যৌবনে তিনি ব্যবসায় নিয়োজিত হন। সর্বোচ্চ সততা ও বিশ্বস্ততার
দরুন অল্প সময়েই তিনি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেন।
বিপুল ধন-ঐশ্বর্যের কারণে তিনি 'গনি' উপাধি লাভ করেন। মমতা, সহনশীলতা, আত্দমর্যাদাবোধ, দান ও লজ্জা ছিল তাঁর মহৎ চরিত্রের অন্যতম
বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও তিনি আশারায়ে মুবাশ্শারা'র একজন এবং সেই ৬ জন সাহাবীর মধ্যে অন্যতম
যাদের উপর মুহাম্মদ আমরণ সন্তুষ্ট ছিলেন।
এক
নজরে হযরত ওসমান (রাঃ)
পূর্ননামঃ উসমান ইবনে আফফান
জন্মঃ ৫৭৭ খিস্টাব্দ ।
পেশাঃ ব্যবসায়ী ।
উল্লেখযোগ্য পদবীঃ ইসলামের তৃতীয় খলিফা।
রাজত্বকালঃ ১১ নভেম্বর ৬৪৪ – ২০ জুন ৬৫৬ ।
সমাধিস্থলঃ জান্নাতুল বাকীর পিছনে জিউস (Jewish)
কবর স্থানে।
পূর্বসূরিঃ হযরত উমর (সাঃ) ।
উত্তরসূরিঃ হযরত আলী (রাঃ) ।
মৃত্যুঃ ৬৫৬ খ্রীষ্টাব্দের ২০ জুন ।
ওসমান
(রাঃ) এর পরিবার ও বংশ
উসমানের কুনিয়া আবু আমর, আবু আবদিল্লাহ, আবু লায়লা। তার উপাধি যুন-নূরাইন এবং
যূল-হিজরাতাইন। তার পিতা আফ্ফান এবং মাতা আরওরা বিনতু কুরাইয। তিনি কুরাইশ বংশের
উমাইয়্যা শাখার সন্তান ছিলেন। তার উর্ধ্ব পুরুষ আবদে মান্নাফে গিয়ে মুহাম্মদের
বংশের সাথে মিলিত হয়েছে। তার নানী বায়দা বিনতু আবদিল মুত্তালিব ছিলেন মুহাম্মদের
ফুফু।
ইসলাম গ্রহণের পর মুহাম্মদ তার কন্যা
রুকাইয়্যার সাথে তার বিয়ে দেন। হিজরী দ্বিতীয় সনে তাবুক যুদ্ধের পরপর মদিনায়
রুকাইয়্যা মারা যায়। এরপর নবী তার দ্বিতীয় কন্যা উম্মু কুলসুমের সাথে তার বিয়ে
দেন। এ কারণেই তিনি মুসলিমদের কাছে যুন-নূরাইন বা দুই জ্যোতির অধিকারী হিসেবে
খ্যাত। তবে এ নিয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে। যেমন ইমাম সুয়ূতি মনে করেন ইসলাম গ্রহণের
পূর্বেই ওসমানের সাথে রুকাইয়্যার বিয়ে হয়েছিল। তবে অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা এই
ধারণা পরিত্যাগ করেছেন।
উসমান এবং রুকাইয়্যা ছিলেন প্রথম হিজরতকারী
মুসলিম পরিবার। তারা প্রথম আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। সেখানে তাদের একটি ছেলে
জন্ম নেয় যার নাম রাখা হয় আবদুল্লাহ ইবন উসমান। এরপর উসমানের কুনিয়া হয় ইবী
আবদিল্লাহ।
হিজরী ৪র্থ সনে আবদুল্লাহ মারা যায়। তাবুক
যুদ্ধের পরপর রুকাইয়্যা মারা যান। এরপর উসমানের সাথে উম্মু কুলসুমের বিয়ে হয়
যদিও তাদের ঘরে কোন সন্তান আসেনি। হিজরী নবম সনে উম্মু কুলসুমও মারা যান।
বোনঃ আমেনা (amna)
স্ত্রীঃ
রোকাইয়া বিনতে মোহাম্মদ
উম্মে কুলসুম বিনতে মোহাম্মদ
নায়লা
রামলা বিনতে সোয়াইবাত
ফাতিমা বিনতে আল ওয়ালিদ
ফাখতাহ্ বিনতে গাজওয়ান
উম্মে আল-বানিন বিনতে উনাইব
উম্মে আমর বিনতে যুনদুব
ছেলেঃ
আমরো
ওমার
খালিদ
আবান
আব্দুল্লাহ-আল-আসগর
আল-ওয়ালিদ
সাঈদ
আব্দুল মালিক
মেয়েঃ
মরিয়াম
উম্মে উসমান
আয়েশা
উম্মে আমর
উম্মে আবান আল কাবরি
আরবি
উম্মে খালিদ
উম্মে আবাল আল-সাগরী
প্রাথমিক
জীবন ও ইসলাম গ্রহন
প্রাথমিক
জীবন
অন্যান্য অনেক সাহাবীর মতই ইসলাম গ্রহণের
পূর্বে উসমানের জীবন সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায়নি। জানা যায়, উসমান কুরাইশ বংশের অন্যতম বিখ্যাত
কুষ্টিবিদ্যা বিশারদ ছিলেন। কুরাইশদের প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে তার অগাধ জ্ঞান
ছিল। ইসলাম গ্রহণের পূর্বেও তার এমন বিশেষ কোন অভ্যাস ছিলনা যা ইসলামী নীতিতে
ঘৃণিত।
যৌবনেকালে
তিনি অন্যান্য অভিজাত কুরাইশদের মত
যৌবনেকালে তিনি অন্যান্য অভিজাত কুরাইশদের মত
ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা খাতে তার সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। মক্কার সমাজে একজন ধনী
ব্যবসায়ী ছিলেন বলেই তার উপাধি হয়েছিল গনী যার অর্ধ ধনী।
ইসলাম
গ্রহন
হজরত ওসমান (রা.) প্রথম পর্যায়ে ইসলাম
গ্রহণকারীদের অন্যতম। হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর উৎসাহে তিনি দ্বীনে ইসলাম
গ্রহণ করেন যৌবনে, যখন তাঁর বয়স
ত্রিশের কোটায়। তিনি নিজেই বলেছেন, 'আমি ইসলাম গ্রহণকারী চারজনের মধ্যে চতুর্থ।' হজরত আবু বকর, হজরত আলী ও জায়েদ বিন হারিসের পরে তিনি ইসলাম
গ্রহণ করেন।
কোরাইশ বংশের অত্যন্ত সম্মানিত ও বিত্তবান
ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম গ্রহণ করার কারণে তাঁকে কাফিরদের অমানসিক নির্যাতনের
শিকার হতে হয়েছে। তাঁর চাচা 'হাকাম ইবনে আবিল আস' তাঁকে রশি
দিয়ে বেঁধে বেদম প্রহার করত আর বলত, যতক্ষণ পর্যন্ত মুহাম্মদ (সা.)-এর ধর্ম ত্যাগ
না করবে, ততক্ষণ
পর্যন্ত তোকে ছাড়া হবে না।'
সীমাহীন নির্যাতনের পরও তাঁর ইমান একটুও
টলেনি। মুশরিকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সর্বপ্রথম মুসলমানদের যে দলটি হাবশায় হিজরত
করেছিল, হজরত ওসমান ও
তাঁর স্ত্রী রুকাইয়াও সে দলের সদস্য ছিলেন। হাবশায় দুই বছর অবস্থানের পর তিনি
মক্কায় ফিরে আসেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মদিনা হিজরতের পর তিনি আবার মদিনায়
হিজরত করেন। সে কারণে তাঁকে 'জুল হিজরাতাইন' বলা হয়।
হুদাইবিয়া
সন্ধি ও ওসমান (রাঃ) এর অবদান
হুদাইবিয়া সন্ধির পটভূমি কা’বা ছিলো ইসলামের মূল কেন্দ্র। এটি আল্লাহর
নির্দেমানুক্রমে হযরত ইবরাহীম (আ) ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ) নির্মাণ করেছিলেন।
মুসলমানরা ইসলামের এই কেন্দ্রস্থল থেকে বেরোবার পর ছয়টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছিলো।
পরন্ত হ্জ্জ ইসলামের অন্যতম মৌল স্তম্ভ হওয়া সত্ত্বেও তারা এটি পালন করতে পারছিলো
না। তাই কা’বা শরীফ
জিয়ারত ও হজ্জ উদযাপন করার জন্যে মুসলমানদের মনে তীব্র বাসনা জাগলো।
কা’বা
জিয়ারতের জন্যে সফর
আরবরা সাধারণত তামাম বছরব্যাপী যুদ্ধে মেতে
থাকতো। কিন্তু হজ্জ উপলক্ষে লোকেরা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে কা’বা পর্যন্ত যাতায়াত করতে এবং নিশ্চিন্তে
আল্লাহর ঘরের জিয়ারত সম্পন্ন করতে পারে, এজন্যে চার মাসকাল তারা যুদ্ধ বন্ধ রাখতো।
ষষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাসে হযরত (স) কা’বা জিয়ারতের সিদ্ধান্ত নিলেন। এহেন সৌভাগ্য
লাভের জন্যে বহু আনসার ও মুহাজির প্রতীক্ষা করছিলো। তাই চৌদ্দ শ’ মুসলমান হযরত (স)-এর সহগামী হলেন। যুল
হুলায়ফা নামক স্থানে পৌঁছে তাঁরা কুরবানীর প্রাথমিক রীতিসমূহ পালন করলেন। এভাবে
সবাইকে জানিয়ে দেয়া হলো যে, মুসলমানদের
উদ্দেশ্য শুধু কা’বা শরীফ
জিয়ারত করা, কোনোরূপ যুদ্ধ
বা আক্রমণের অভিসন্ধি নেই। তবুও কুরাইশদের অভিপ্রায় জেনে আসবার জন্যে হযরত (স) এক
ব্যক্তিকে মক্কায় প্রেরণ করলেন। সে এই মর্মে খবর নিয়ে এলো যে, কুরাইশরা সমস্ত গোত্রকে একত্রিত করে মুহাম্মদ
(স)-এর মক্কায় প্রবেশকে বাধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমন কি, তারা মক্কার বাইরে এক জায়গায় সৈন্য সমাবেশ
করতেও শুরু করেছে এবং মুকাবিলার জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে আছে।
কুরাইশদের
সঙ্গে আলোচনা
এই সংবাদ জানার পরও হযরত (স) সামনে অগ্রসর
হলেন এবং হুদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছে যাত্রা বিরতি করলেন। এ জায়গাটি মক্কা থেকে
এক মঞ্জিল দূরে অবস্থিত।৪৫ এখানকার খোজায়া গোত্রের প্রধান হযরত (স)-এর খেদমতে
হাযির হয়ে বললো : ‘কুরাইশরা
লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুতি নিয়েছে। তারা আপনাকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না।’ হযরত (স) বললেন : ‘তাদেরকে গিয়ে বলো যে, আমরা শুধু হজ্জের নিয়্যাতে এসেছি, লড়াই করার জন্য নয়। কাজেই আমাদেরকে কা’বা শরীফ তাওয়াফ ও জিয়ারত করার সুযোগ দেয়া
উচিত।’ কুরাইশদের
কাছে যখন এই পয়গাম গিয়ে পৌঁছলো, তখন কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোক বলে উঠলো : ‘মুহাম্মদের পয়গাম শোনার কোনো প্রয়োজন আমাদের
নেই।’ কিন্তু
চিন্তাশীল লোকদের ভেতর থেকে ওরওয়া নামক এক ব্যক্তি বললো : ‘না, তোমরা আমার উপর নির্ভর করো; আমি গিয়ে মুহাম্মদ (স)-এর সঙ্গে কথা বলছি।’ ওরওয়া হযরত (স)-এর খেদমতে হাযির হলো বটে, কিন্তু কোনো বিষয়েই মীমাংসা হলো না। ইতোমধ্যে
কুরাইশরা মুসলমানদের ওপর হামলা করার জন্যে একটি ক্ষুদ্র বাহিনী প্রেরণ করলো এবং
তারা মুসলমানদের হাতে বন্দীও হলো; কিন্তু হযরত (স) তাঁর স্বভাবসুলভ করুণার বলে
তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন এবং তাদেরকে মুক্তি দেয়া হলো। এর পর সন্ধির আলোচনা
চালানোর জন্যে হযরত উসমান (রা) মক্কায় চলে গেলেন; কিন্তু কুরাইশরা মুসলমানদেরকে কা’বা জিয়ারত করার সুযোগ দিতে কিছুতেই রাযী হলো
না; বরঞ্চ তারা
হযরত উসমান (রা)-কে আটক করে রাখলো।
রিযওয়ানের
শপথ
এই পর্যায়ে মুসলমানদের কাছে এই মর্মে সংবাদ
পৌঁছলো যে, হযরত উসমান
(রা) নিহত হয়েছেন। এই খবর মুসলমানদেরকে সাংঘাতিকভাবে অস্থির করে তুললো। হযরত (স)
খবরটি শুনে বললেন : ‘আমাদেরকে
অবশ্যই উসমান (সা)-এর রক্তের বদলা নিতে হবে।’ একথা বলেই তিনি একটি বাবলা গাছের নীচে বসে
পড়লেন। তিনি সাহাবীদের কাছ থেকে এই মর্মে শপথ গ্রহণ করলেন : ‘আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো, তবু লড়াই থেকে পিছু হটবো না। কুরাইশদের কাছ
থেকে আমরা হযরত উসমান (রা)-এর রক্তের বদলা নেবোই।’ এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা মুসলমানদের মধ্যে এক আশ্চর্য
উদ্দীপনার সৃষ্টি করলো। তারা শাহাদাতের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে কাফিরদের কাছ থেকে
প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত হলেন। এরই নাম হচ্ছে ‘রিযওয়ানের শপথ’। কুরআন পাকেও এই শপথের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সে সব ভাগ্যবান ব্যক্তি এ সময় হযরত (স)-এর পবিত্র হাতে হাত রেখে শপথ গ্রহণ
করেছিলেন, আল্লাহ তা’আলা তাঁদেরকে পুরস্কৃত করার কথা বলেছেন।
হুদাইবিয়া
সন্ধির শর্তাবলী
মুসলমানদের এই উৎসাহ-উদ্দীপনার কথা কুরাইশদের
কাছেও গিয়ে পৌঁছলো। সেই সঙ্গে এ-ও জানা গেলো যে, হযরত উসমান (রা)-এর হত্যার খবর সম্পূর্ণ
ভ্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে কুরাইশরা সন্ধি করতে প্রস্তুত হলো এবং এ সম্পর্কে আলোচনা
করার জন্যে সুহাইল বিন্ আমরকে দূত বানিয়ে পাঠালো। তার সঙ্গে দীর্ঘ সময়ব্যাপী
আলোচনা হলো এবং শেষ পর্যন্ত সন্ধির শর্তাবলী স্থিরিকৃত হলো। সন্ধিপত্র লেখার জন্যে
হযরত আলী (রা)-কে ডাকা হলো। সন্ধিপত্রে যখন লেখা হলো ‘এই সন্ধি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (স)-এর তরফ
থেকে তখন কুরাইশ প্রতিনিধি সুহাইল প্রতিবাদ জানিয়ে বললো : ‘আল্লাহর রাসূল’ কথাটি লেখা যাবে না; এ ব্যাপারে আমাদের আপত্তি আছে।’ একথায় সাহাবীদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের
সৃষ্টি হলো। সন্ধিপত্র লেখক হযরত আলী (রা) কিছুতেই এটা মানতে রাযী হলেন না। কিন্তু
হযরত (স) নানাদিক বিবেচনা করে সুহাইলের দাবি মেনে নিলেন এবং নিজের পবিত্র হাতে ‘আল্লাহর রাসূল’ কথাটি কেটে দিয়ে বললেন : ‘তোমরা না মানো, তাতে কি? কিন্তু খোদার কসম, আমি তাঁর রাসূল।’ এরপর নিম্নোক্ত শর্তাবলীর ভিত্তিতে সন্ধি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হলোঃ
১. মুসলমানরা এ বছর হজ্জ না করেই ফিরে যাবে।
২. তারা আগামী বছর আসবে এবং মাত্র তিন দিন
থেকে চলে যাবে।
৩. কেউ অস্ত্রপাতি নিয়ে আসবে না। শুধু তলোয়ার
সঙ্গে রাখতে পারবে: কিন্তু তাও কোষবদ্ধ থাকবে, বাইরে বের করা যাবে না।
৪. মক্কায় সে সব মুসলমান অবশিষ্ট রয়েছে, তাদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না। আর
কোনো মুসলমান মক্কায় ফিরে আসতে চাইলে তাকেও বাধা দেয়া যাবে না।
৫. কাফির বা মুসলমানদের মধ্য থেকে কেউ মদীনায়
গেলে তাকে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু কোনো মুসলমান মক্কায় গেলে তাকে ফেরত দেয়া হবে
না।
৬. আরবের গোত্রগুলো মুসলমান বা কাফির যে কোনো
পক্ষের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করতে পারবে।
৭. এ সন্ধি-চুক্তি দশ বছরকাল বহাল থাকবে।
হুদাইবিয়া
সন্ধির প্রভাব
সন্ধি-চুক্তি সম্পাদিত হবার পর হযরত (স)
সেখানেই কুরবানী করার জন্যে লোকদেরকে হুকুম দিলেন। সর্বপ্রথম তিনি নিজেই কুরবানী
করলেন। সন্ধি চুক্তি সম্পাদনের পর হযরত (স) তিন দিন সেখানে অবস্থান করলেন। ফিরবার
পথে সূরা ফাতাহ নাযিল হলো। তাতে এই সন্ধির প্রতি ইঙ্গিত করে এতে ‘ফাতহুম মুবীন’ বা সুস্পষ্ট বিজয় বলে অভিহিত করা হলো। যে
সন্ধি-চুক্তি মুসলমানরা চাপে পড়ে সম্পাদন করলো, তাকে আবার ‘সুস্পষ্ট বিজয়’ বলে আখ্যা দেয়া দৃশ্যত একটি বেখাপ্পা ব্যাপার
ছিলো। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ স্পষ্টত প্রমাণ করে দিলো যে, ইসলামের ইতিহাসে হুদাইবয়ার সন্ধি ছিলো একটি বিরাট বিজয়ের সূচনা মাত্র। এর
বিস্তৃত বিবরণ হচ্ছে নিম্নরূপ:
এতদিন মুসলমান ও কাফিরদের মধ্যে পুরোপুরি
একটা যুদ্ধংদেহী অবস্থা বিরাজ করছিলো। উভয় পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক মেলামেশার কোনোই
সুযোগ ছিলো না। এই সন্ধি-চু্ক্তি সেই চরম অবস্থার অবসান ঘটিয়ে রুদ্ধ দুয়ার খুলে
দিলো। এরপর মুসলমান ও অমুসলমানরা নির্বাধে মদীনায় আসতে লাগলো। এভাবে তারা এই নতুন
ইসলামী সংগঠনের লোকদেরকে অতি নিকট থেকে দেখার ও জানার সুযোগ পেলো। এর পরিণতিতে
তারা বিস্ময়কর রকমে প্রভাবিত হতে লাগলো। যে সব লোকের বিরুদ্ধে তাদের মনে ক্রোধ ও
বিদ্বেষ পুঞ্জীভূত হয়েছিলো, তাদেরকে তারা
নৈতিক চরিত্র, আচার-ব্যবহার
ও স্বভাব-প্রকৃতির দিক দিয়ে আপন লোকদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত মানের দেখতে পেলো।
তারা আরো প্রত্যক্ষ করলো, আল্লাহর যে সব
বান্দাহর বিরুদ্ধে তারা এদ্দিন যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করে আসছে, তাদের মনে কোনে ঘৃণা বা শত্রুতা নেই; বরং তাদের যা কিছুই ঘৃণা, তা শুধু বিশ্বাস ও গলদ আচার-পদ্ধতির
বিরুদ্ধে। তারা (মুসলমানরা) যা কিছুই বলে,তার প্রতিটি কথা সহানুভূতি ও মানবিক ভাবধারায়
পরিপূর্ণ। এতো যুদ্ধ-বিগ্রহ সত্ত্বেও তারা বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে সহানুভূতি
সদাচরণের বেলায় কোনো ত্রুটি করে না।
এরূপ মেলামেশার ফলে ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের
সন্দেহ ও আপত্তিগুলো সম্পর্কে সরাসরি আলোচনা করাও প্রচুর সুযোগ হলো। এতে করে ইসলাম
সম্পর্কে অমুসলিমরা কতোখানি ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত ছিলো, তা তারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারলো।
মোটকথা, এই পরিস্থিতি
এমনি এক আবহাওয়ার সৃষ্টি করলো যে, অমুসলিমদের হৃদয় স্বভাবতঃই ইসলামের প্রতি
আকৃষ্ট হতে লাগলো। এর ফলে সন্ধির-চুক্তির মাত্র দেড়-দুই বছরের মধ্যে এতো লোক ইসলাম
গ্রহণ করলো যে, ইতঃপূর্বে
কখনো তা ঘটেনি। এরই মধ্যে কুরাইশদের কতিপয় নামজাদা সর্দার ও যোদ্ধা ইসলামের প্রতি
আকৃষ্ট হলো এবং অমুসলিমদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে মুসলমানদের সঙ্গে হাত মিলালো।
হযরত খালিদ বিন্ অলিদ (রা) এবং হযরত আমর
বিন্ আস (রা) এ সময়ই ইসলাম গ্রহণ করলেন। এর ফলে ইসলামের প্রভাব-বলয় এতোটা বিস্তৃত
হলো এবং তার শক্তিও এতোটা প্রচণ্ড রূপ পরিগ্রহ করলো যে, পুরনো জাহিলিয়াত স্পষ্টত মৃত্যু-লক্ষণ দেখতে
লাগলো। কাফির নেতৃবৃন্দ এই পরিস্থিতি অনুধাবণ করে অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে উঠলো। তারা
স্পষ্টত বুঝতে পারলো, ইসলামের
মুকাবিলায় তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই অনতিবিলম্বে সন্ধি-চুক্তি ভেঙে দেয়ার এবং
এর ক্রমবর্ধমান সয়লাবকে প্রতিরোধ করার জন্যে আর একবার ইসলামী আন্দোলনের সাথে ভাগ্য
পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ তারা খুঁজে পেলো না।
খলিফা
মনোনীত হওয়ার ইতিহাস
হজরত ওমর (রা.) যখন ছুরিকাহত হয়ে
মৃত্যুশয্যায়, তখন তাঁর কাছে
পরবর্তী খলিফা মনোনয়নের দাবি উত্থাপিত হলে তিনি বলেন, তোমাদের সামনে এমন একটি দল রয়েছে, যাদের সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তাঁরা জান্নাতের অধিবাসী। তাঁরা হলেন হজরত
আলী, ওসমান, আব্দুর রহমান, সাদ, জুবাইর ও তালহা। তাঁদের যেকোনো একজনকে খলিফা
নির্বাচিত করতে হবে। হজরত ওমর (রা.)-এর মৃত্যুকালীন উপরিউক্ত উক্তি থেকে এ কথাই
প্রমাণিত হয়, আদর্শের
মানদণ্ডে উন্নীত রাসুল (সা.)-এর জবানে জান্নাতের বাশারাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই
খিলাফতের যোগ্যতম উত্তরাধিকারী। অর্থাৎ উপরিউক্ত ব্যক্তিদের আয়ুষ্কাল পর্যন্তই 'খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুয়্যাহ' সীমাবদ্ধ।
হজরত ওমর (রা,) উলি্লখিত ছয়জনকে নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করে তিন
দিনের সময় বেঁধে দিয়ে বললেন, 'আমার মৃত্যুর পর তাঁরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে
নিজেদের যেকোনো একজনকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে খলিফা মনোনীত করবেন।' হজরত ওমর (সা.)-এর ইন্তেকাল হলো। বোর্ড
সদস্যরা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসলেন, তুমুল তর্ক-বিতর্ক, বাগ্বিতণ্ডা চলল। সময় গড়িয়ে দুই দিন পেরিয়ে
গেল। মসজিদে নববি লোকে লোকারণ্য।
শেষদিনে আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) বললেন, 'আমি আমার খিলাফতের দাবি ত্যাগ করছি। এবার
তোমরা তোমাদের মধ্যে যোগ্যতম ব্যক্তি নির্বাচনের দায়িত্ব আমাকে অর্পণ করতে পারো।' সবাই খলিফা নির্বাচনের ক্ষমতা আব্দুর রহমানকে
অর্পণ করলেন। তিনি সম্ভ্রান্ত সবার সঙ্গে পরামর্শ করলেন। অতঃপর ওমর (রা.) কর্তৃক
বেঁধে দেওয়া সময়ের শেষ দিনে ফজরের নামাজের পর মসজিদে নববিতে সমবেত মদিনাবাসীর
উদ্দেশে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর তিনি খলিফা হিসেবে হজরত ওসমান (রা.)-এর হাতে
বাইয়াত গ্রহণ করেন, অতঃপর সবাই।
এভাবে মানবতাবাদী, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের
বিরুদ্ধে সদাতৎপর, বিনয় ও
ভদ্রতার অবতার হজরত ওসমান (রা.) খিলাফতের দায়িত্ব লাভ করেন।
খলিফা
হিসেবে হযরত ওসমান (রাঃ)
দ্বায়িত্ত গ্রহনের পরে হযরত উসমান (রাঃ) তা’লা পুরো রাজ্য জুড়ে বেশ ক’জন নির্দেশকারী তথা দূত নিযুক্ত করেছিলেন।
তাদের দ্বায়িত্ব ছিলো হযরত উমর (রাঃ) এর প্রণয়নকৃত আইনসমূহ কে অধিষ্ঠান করা। উসমান
(রাঃ) এর রাজত্ব বিস্তৃত করেছিলেন পশ্চিম থেকে পুরো মরোক্কো পর্যন্ত, পূর্ব দক্ষিন পূর্ব তথা বর্তমান পাকিস্তান
পর্যন্ত এবং উত্তর আমেরিকা থেকে আজারবাইজান পর্যন্ত।।
উসমান (রাঃ) এর রাজত্বকালে তিনিই সর্বপ্রথম
ইসলামিক নৌবাহিনি গড়ে তুলেছিলেন। উনার রাজত্বকালে তিনি প্রশাসনিক বিভাগ সমূহ কে
সংশোধন করেছিলেন এবং অনেক জন-প্রকল্প কে তিনি প্রসারন করেছিলেন, অনেক প্রকল্প কে সম্পূর্ন করেছিলেন নিজের
রাজত্বকালেই।
তার রাজত্বকালে শ্রীলংকা তেও ইসলাম ধর্ম
প্রচারের লক্ষ্যে দূত পাঠিয়েছিলেন।
ওসমান
(রাঃ) এর শাসনকালে উন্নয়ন
বিপুল ধন-ঐশ্বর্যের মালিক হজরত ওসমান (রা.)
মুসলিম জাহানের খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পরও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। হজরত হাসান
(রা.) থেকে বর্ণিত_তিনি বলেন, হজরত ওসমান (রা.) মসজিদে নববিতে মাথার নিচে
চাদর দিয়ে শুয়ে থাকতেন। মানুষ তাঁর পাশে এসে বসত। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। মনে
হতো তিনি তাদেরই একজন। জুবাইর ইবনে আব্দুল্লাহ বর্ণনা করেন, 'হজরত ওসমান সারা বছর রোজা রাখতেন এবং সারা
রাত নামাজ পড়তেন। রাতের প্রথমার্ধে একটু ঘুমাতেন।'
হজরত ওসমান (রা.) তাঁর শাসনামলের প্রথমদিকে
রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভূত সাফল্য
অর্জন করেন। তাঁর জনহিতকর কার্যাবলি সমাজের আদল পরিবর্তন করে দিয়েছিল। তিনি মদিনা
শহর রক্ষাবাঁধ 'মাহরু' নির্মাণ করেন। খাল খনন করে কৃষিতে প্রভূত
উন্নতি সাধন করেন। পয়ঃপ্রণালী ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করে জনগণের অত্যন্ত প্রিয়
খলিফায় পরিণত হন। মসজিদে নববির আধুনিকায়ন করেন তিনি। তাঁর সময় অর্থনৈতিক সচ্ছলতা
মদিনার ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল।
আগে জনগণকে প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য খলিফার
শরণাপন্ন হতে হতো। আর হজরত ওসমান (রা.)-এর সময় বাইতুল মালের সম্পদ খরচের জন্য
রীতিমতো এলান করে গ্রাহক খোঁজা হতো। হজরত হাসান (রা.) বলেছেন, ওসমান (রা.)-এর ঘোষক ঘোষণা করত, হে লোক সব, সবাই এসে তোমাদের ভাতা নিয়ে যাও। লোকেরা দলে
দলে এসে প্রচুর সম্পদ নিয়ে যেত। মানুষ দামি দামি পোশাক পরত। হজরত ওমর (রা.) ইসলামী
খিলাফতের সম্প্রসারণে যে অভিযান শুরু করেছিলেন, হজরত ওসমান (রা.)-এর সুযোগ্য নেতৃত্বে তা
এগিয়ে যেতে থাকে। তাঁর সময় ইসলামী খিলাফত-পূর্বে কাবুল ও বেলুচিস্তান এবং পশ্চিমে
ত্রিপলী পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। তাঁর সময়ই প্রথম নৌবাহিনী গঠিত হয়। নৌ-অভিযানে
সাইপ্রাস ও রোডস দ্বীপপুঞ্জ মুসলমানদের অধিকারে আসে। তাঁর সময়ই বাইজান্টাইন ও
পারস্য শক্তির ঔদ্ধত্য সম্পূর্ণভাবে
নির্মূল করা হয়।
হজরত ওসমান (রা.) বিশ্ব মুসলিমের জন্য সব
থেকে বড় যে অবদানটি রেখে গেছেন, তা হলো পবিত্র কোরআন সংকলন। তিনি বিভিন্ন
অঞ্চলে কোরআন পাঠে ভিন্নতা লক্ষ করে একটি নির্ভুল সংস্করণ তৈরির উদ্যোগ নেন। একটি
উপযুক্ত কমিটির তত্ত্বাবধানে হজরত হাফসার (রা.) কাছে সংরক্ষিত কোরআনের কপিকে মূল
ধরে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তা সম্পন্ন করে এর কপি মুসলিম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন
অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং মানুষের কাছে থাকা কোরআনের বিচ্ছিন্ন অংশগুলো সংগ্রহ
করে তা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
আল-কুরআন
সংকলনে অবদান
কোন আয়াত বা সূরা নাযিলের পরপর সাহাবাদের
মুখস্ত করতে ও লিখে রাখতে নির্দেশ দেয়া হত। এটা বলা ভুল যে হযরত ওসমান (রাঃ) কুরআন
সংকলন করেছেন প্রকৃতপক্ষে রাসুল (সাঃ)-এর জীবিতকালে কুরআন সংকলন ও সংরক্ষিত
হয়েছিল। যখন কোন আয়াত রাসুল (সাঃ) এর প্রতি নাযিল হতো তিনি অনতিবিলম্বে তা মুখস্ত
করে নিতেন এবং সাহাবাদের শোনাতেন এবং তাদেঁর মুখস্ত করতে ও লিখে রাখতে নির্দেশ
দিতেন,এবং তিনি
সাহাবাদের পড়িয়ে শোনাতে বলতেন শুদ্ধতা যাচাই করতেন অর্থাৎ সাহাবীদের স্মরন শক্তি
পরীক্ষা করে দেখতেন । তিনি সাহাবাদের সুরার ধারাবাহিকতা বলে রাখতেন ,যেমন-প্রথম যে সুরা নাযিল হয়েছে সুরা ইকরা যা
পবিত্র কুরআনে ৯৬নং সূরা যা তিনি জীবরঈল (আঃ) এর মাধ্যমে জানতে পেরেছেন । বর্তমানে
যে পর্যায় ক্রমিক সূরায় কুরআন সংকলিত আছে তার অনুরূপ ‘লাওহে মাহফুজে’ লিপিবদ্ধ রয়েছে। প্রতি রমজানে রাসুল (সাঃ)
জীবরাঈল (আঃ) দ্বারা পুনরাবৃত্তি করতেন । তাঁর মৃত্যুকালীন বছরে রমজানের সময় তিনি
দুবার পুনরাবৃত্তি করছিলেন।
কুরআন
একত্রিকরন:
কুরআন সংরক্ষিত হয়েছিল বিভিন্ন আঙ্গিকে-গাছের
বাকলে,চমড়ায় ,উটের সেডলে ,সমতল পাথরে,গাছের পাতায়। ১ম খলীফা আবু বকর (রাঃ) এর
খিলাফত কালে ইয়ামামার যুদ্ধে বহু কুরআনে হাফেজ শহীদ হন। হযরত আবু বকর (রাঃ) ও ওমর
(রাঃ) সাহাবীগনের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে যয়িদ-বিন-সাবিদ(রাঃ)-কে কুরআন সংকলনের জন্য
দায়িত্ব প্রদান করেন। সব সাহাবীদের একসাথে করে যয়িদ-বিন-সাবিদ (রাঃ) সব কুরআনের
আয়াতকে একসাথে করেন। এরপর তা দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ) এর তত্তাবধানে আসলে
তাঁর হাত হতে হযরত হাফসা (রাঃ) এর নিকট পৌঁছায়।
হযরত
ওসমান (রাঃ) খিলাফতকাল:
তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান (রাঃ)এর সময় ইসলাম
যখন প্রসার লাভ করছিল । বিভিন্ন স্থানের মধ্যে উচ্চারনগত সমস্যা দেখা দেয়ায় তিনি
বিভিন্ন দেশের কুরআন হাফেজ এবং সংকলকদেরকে ডেকে পাঠান ও হযরত হাফসা(রাঃ) এর নিকট
হতে সংরক্ষিত কুরআন লিখে রাখতে বলেন ও তা সম্প্রচার করতে বলেন আর বাকী কুরআন তিনি
পুড়িয়ে ফেলতে নির্দেশ দেন, কারন সব
সাহাবীদের পক্ষে সমস্ত কুরআনের আয়াত সংরক্ষিত ছিলনা কারো কাছে ছিল ৫০০ আয়াত বা তার
কম বা বেশি। পূর্বের কুরআনে হুবহু তুর্কির ফাত্তাকি যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে ।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, (সূরা হিজর-১৫,আয়াত-৯)
‘‘আমরা কুরআন অবতীর্ন করেছি এবং আমরাই এর
সংরক্ষনকারী।’’
দানশীলতা
সমাজের ভুখা-নাঙ্গা মানুষের প্রতি হজরত ওসমান
(রা.) ছিলেন সর্বদা দরাজহস্ত। একবার মদিনায় বড় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এমন সময় খবর এল
ওসমানের (রা.) ব্যবসার এক হাজার উট বোঝাই খাদ্যশস্য আমদানির পথে। মদিনার
ব্যবসায়ীরা এসে ওসমান (রা.)-এর বাড়িতে ভিড় জমান। তিনি তাঁদের সংরক্ষণাগারে নিয়ে
গেলেন, যেখানে সারি
সারি খাদ্যশস্যভর্তি বস্তা সাজানো ছিল।
তিনি তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমরা আমাকে কী লাভ দেবে?' তাঁরা বললেন, ১০ টাকা ক্রয় মূল্যের ওপর দুই টাকা। তিনি
বললেন, 'আমি আরো বেশি লাভ পেতে পারি।' তাঁরা দাম বাড়াতে বাড়াতে ১০ টাকায় পাঁচ টাকা
দিতে সম্মত হলো। হজরত ওসমান (রা.) বললেন, 'আমি দশে দশ লাভ পেতে পারি।'
অতঃপর তিনি ঘোষণা করলেন_'তোমরা সাক্ষী থাকো, আমি সব খাদ্যশস্য মদিনার অভাবি লোকদের সদকা
করে দিলাম।' এভাবে সমাজের
ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূর করতে তিনি তাঁর বিপুল ঐশ্বর্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন।
৬৩০ খ্রিস্টাব্দে হিরাক্লিয়াস মদিনার
বিরুদ্ধে লক্ষাধিক সৈন্যের এক সুসজ্জিত বাহিনী প্রেরণ করলে রাসুলুল্লাহ (সা.)
মুসলমানদের যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য যুদ্ধ তহবিলে সামর্থ্যানুযায়ী সবাইকে দান করতে
বলেন। হজরত ওসমান (রা.) সে সময় এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা, এক হাজার উট ও ৭০টি ঘোড়া সরবরাহ করেন।
রাসুল (সা.)-এর পরিবারের জন্যও তাঁর সম্পদ
ছিল উন্মুক্ত। ঘৃণ্য দাসপ্রথা উচ্ছেদে তাঁর ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। তিনি প্রতি
জুমাবার একটি করে গোলাম অথবা বন্দি মুক্ত করে দিতেন। কারণবশত কোনো শুক্রবার না
পারলে পরবর্তী শুক্রবারে দুটি দাস মুক্ত করে দিতেন।
রাসুল
(সঃ) এর বন্ধু
আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে হজরত
ওসমান (রা.)-এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মানবতার কল্যাণে জীবন ও সম্পদ
উৎসর্গকারী এ সাহাবি সম্পর্কে রাসুলে খোদা (সা.) বলেছেন, 'উসমান হলো তাঁদেরই একজন, যাঁরা আল্লাহ ও রাসুলকে বন্ধু ভাবেন এবং
আল্লাহ ও রাসুল তাঁদের বন্ধু ভাবেন।'
রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথমে নিজের মেয়ে হজরত
খাদিজার (রা.) গর্ভজাত সন্তান রুকাইয়াকে ওসমান (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহ দেন। হজরত
রুকাইয়ার ইন্তেকাল হলে তাঁর সহোদরা উম্মে কুলসুমকে হজরত ওসমান (রা.)-এর সঙ্গে বিয়ে
দেওয়া হয়। রাসুল (সা.)-এর দুই মেয়েকে বিয়ের কারণে তাঁকে 'জিননুরাইন' বলা হয়। উম্মে কুলসুমের ইন্তেকালের পর রাসুল
(সা.) বলেন, 'আমার যদি আরো একটি মেয়ে থাকত, তাহলে তাকেও আমি ওসমানের সঙ্গে বিয়ে দিতাম।' তিনি রাসুল (সা.)-এর নির্দেশে পীড়িত স্ত্রী
রুকাইয়ার সেবায় মদিনায় অবস্থানের কারণে একমাত্র বদর ছাড়া সব যুদ্ধেই রাসুলুল্লাহ
(সা.)-এর সঙ্গে অংশ নেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে একাধিকবার জান্নাতের
শুভ সংবাদ দিয়েছেন। রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, 'প্রত্যেক নবীরই বন্ধু থাকে, জান্নাতে আমার বন্ধু হবে ওসমান।' তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর কাতেবে ওহি দলের
অন্যতম।
মৃত্যুর
পূর্বের পেক্ষাপট ও মৃত্যু
হজরত ওসমান (রা.) খিলাফতের মসনদে আসীন হয়েই
বড় ধরনের এক সমস্যার সম্মুখীন হন। 'উবায়দুল্লাহ ইবনে উমার' হজরত ফারুকে আজমের হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে
কয়েকজন নাসারা ও মুনাফিক প্রকৃতির মুসলমানকে হত্যা করেন। বিষয়টি খলিফার সামনে বড়
ধরনের বিশৃঙ্খলার পূর্বাভাস হিসেবে আবির্ভূত হলো।
হজরত ওসমান (রা.) নিজের সম্পদ থেকে নিহতদের
ওয়ারিশদের রক্তপণ দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করলেন। ফলে মুসলমানদের ভেতরের সব
বিভেদের অবসান হয়। হজরত ওসমান (রা.) অত্যন্ত জনপ্রিয় খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন
করে যেতে লাগলেন। কিন্তু খলিফার সরলতা, সহিষ্ণুতা ও উদারতার সুযোগে স্বার্থান্বেষী
চক্র হজরত ওসমান (রা.)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে।
বনি হাশিম ও বনি উমাইয়ার বিরোধ, কোরাইশ-অকুরাইশ দ্বন্দ্ব, মুহাজির-আনসার সম্প্রীতি বিনষ্ট, ইবনে সাবরে অপপ্রচার, অমুসলিমদের বিদ্বেষ ইত্যাদি কারণে মুসলিম
সাম্রাজ্যে এক চরম সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি হলো। খিলাফতের অষ্টম বছরে এসে হজরত
ওসমান (রা.) স্বজনপ্রীতি, কোরআন
দগ্ধীকরণ, চারণভূমির
রক্ষণাবেক্ষণ, আবুজর গিফারির
নির্বাসন, বাইতুল মালের
অর্থ অপচয় ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে বিরুদ্ধবাদীদের চরম বিরোধিতা ও বিদ্রোহের
সম্মুখীন হন।
হজরত আলী (রা.)-এর সমর্থকদের অপপ্রচার
বিদ্রোহের আগুনে ইন্ধন হিসেবে কাজ করে। অথচ খলিফার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগই ছিল
মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর
ও অবাস্তব। হাম্মাদ ইবনে সালামা বর্ণনা করেন, 'ওসমান (রা.) যেদিন খলিফা নির্বাচিত হন, সেদিন তিনি সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিলেন। আর যখন
তাঁকে লোকেরা হত্যা করল, তিনি সেদিন
থেকেও উত্তম ছিলেন যেদিন তাঁকে খলিফা বানানো হয়েছিল।' রাসুলুল্লাহ (সা.) বলে গেছেন, 'আল্লাহ পাকের হিকমতানুসারে জিননুরাইনের ওপর
মতানৈক্য দেখা দেবে এবং লোকেরা তাঁকে শহীদ করবে। অথচ তিনি তখন হকের ওপরই থাকবেন এবং তাঁর
বিরোধীরা থাকবে বাতিলের ওপর।'
শেষ পর্যন্ত মিসর, বসরা ও কুফার বিদ্রোহী গোষ্ঠী একাট্টা হয়ে
৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় সমবেত হয়ে খলিফার পদত্যাগ দাবি করে। হজ উপলক্ষে অধিকাংশ
মদিনাবাসী মক্কা গমন করায় তারা এ সময়কেই মোক্ষম সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। খলিফা
পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানালে তারা হত্যার হুমকি দিয়ে তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখে। হজরত
ওসমান (রা.) রক্তপাতের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। বিশাল মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে
মুষ্টিমেয় বিদ্রোহীর কঠোর শাস্তিদানের পরিবর্তে তিনি তাদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে
থাকলেন। হজরত আলী, তালহা ও
জুবাইর (রা.)-এর ছেলেদের দ্বারা গঠিত ১৮ নিরাপত্তারক্ষী বিপথগামী বিদ্রোহীদের
মোকাবিলায় ব্যর্থ হন। অবশেষে তারা ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন হিজরি ৩৫ সনের ১৮
জিলহজ্জ শুক্রবার আসরের নামাজের পর ৮২ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ খলিফাকে অত্যন্ত বর্বরভাবে
হত্যা করে। তিনি ১২ দিন কম ১২ বছর খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। জুুবাইর ইবনে মুতইম
(রা.) তাঁর জানাজায় ইমামতি করেন। জান্নাতুল বাকিতে তাঁকে দাফন করা হয়।
হজরত ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের ফলাফল ছিল
সুদূরপ্রসারী ও ভয়াবহ। ওয়েল হাউসেন বলেন, 'ইহার ফলে গৃহযুদ্ধের যে কপাট খুলিয়া যায়, তাহা আর কখনো বন্ধ হয় নাই।'
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(০৪)
হযরত
আলী (রা.)এর জীবনী
নাম ও
বংশ পরিচয়: নাম আলী, পিতার নাম আবু তালিব, মাতার নাম: ফাতিমা বিনতে আসাদ। ৬০০
খৃষ্টাব্দে তিনি মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হযরত মুহাম্মদ
সা. এর চাচাত ভাই। তার ডাক নাম আবু তোরাব ও আবুল হাসান।
ইসলাম
গ্রহণ ও মদীনায় গমন: রাসূল সা. এর নবুওয়াতের শুরুতেই হযরত আলী রা. ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন আলী রা.
এর বয়স ছিল মাত্র দশ বছর। বালকদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি
আর্থিকভাবে অসচ্ছল থাকলেও অসি ও মসি দ্বারা ইসলামের প্রচুর খিদমত করেছেন। তিনিও
মাহানবীর সাথে কুরাইশদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। তিনিই সেই সৌভাগ্যবান
সাহাবী আল্লাহর নবী হিজরত করার সময় যাকে মক্কায় তার আমানত আদায়ের জন্য রেখে যান।
জীবনের মায়া ত্যাগ করে তিনি নবীজির বিছানায় শুয়ে ছিলেন। আর সবাই তার এই নবীপ্রেম
দেখে আশ্চর্য হলো। পরবর্তীতে তিনিও মদীনায় হিজরত করেন। তার আগে তিনি নবীজির কাছে
সবার গচ্ছিত আমানত ও পাওনা মিটিয়ে দেন।
আদর্শ ও
চরিত্র: মুসলিম
জাহানের চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রা. আল্লাহ ও তার রাসূলের একনিষ্ট প্রেমিক ছিলেন।
দৃঢ় বিশ্বাসী, রণক্ষেত্রে
সাহসী, ব্যক্তিগত
আচরণে নম্র, আলোচনা ও
বিচারকার্যে ছিলেন সুবিজ্ঞ। নিজের ভিতর ইসলামী গুণাবলীর মহান আদর্শ তিনি স্থাপন
করেছিলেন নিজের ভিতর। ছিলেন নবীর প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে তার বিশ্বস্ত সঙ্গি।
পূর্ববর্তী খলীফাদের সহৃদ পরামর্শদাতা। মোটকথা, তিনি ছিলেন নবীর আদর্শ ও চরিত্রের রঙ্গে পুরো
রঙ্গিণ ছিলেন।
আলী রা.
এর বিবাহ: মহানবী হযরত
মুহাম্মদ সা. হযরত আলী রা. এর সাথে নিজের আদরের কন্যা হযরত ফাতেমা রা. কে বিবাহ
দেন। তাদের পরবর্তী দাম্পত্য জীবন ছিলো অত্যন্ত সুমধুর। হযরত ফাতেমার গর্ভে হাসান, হুাসাইন ও মুহসিন নামে তিনজন ছেলে এবং জয়নব ও
উম্মে কলসুম নামে দুজন কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। মুহসিন ছোটকালেই ইন্তেকাল
করেন। পরবর্তীতে হাসান হুসাইনের দ্বারাই তাদের ব্বংশ বিস্তৃত হয়। আর তারাই ইতিহাসে
সৈয়দ নামে পরিচিত।
হযরত আলী
রা. এর জ্ঞানের গভীরতা: আলী রা. ছিলেন অসাধারণ আল্লাহ প্রদত্ব জ্ঞানের অধিকারী। স্মৃতিশক্তি ও জ্ঞান
গরিমায় ভরপুর ছিলেন এই নবী জামাতা। কুরআন, হাদীস, কাব্য, দর্শণ ও আইনশাস্রে ছিল তার সর্বিক বিচরণ।
নাহু শাস্রের প্রবক্তাও এই মুরতাযা। ছিলেন তাফসীরকারক। ফতোয়ার কাজও করতেন নবীর
যামানায়। ওহি লিখকও ছিলেন এই খলীফা। লিখে শেষ করা যাবেনা তার জ্ঞান কীর্তি। কারণ
নবী সা. নিজে বলেছেন, আমি জ্ঞানের
নগরী আর আলী তার দরজা।
বীরত্ব ও
সাহসিকতা: ইসলামের জন্য
হযরত আলী রা. এর অবদান ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তার সসীম শক্তি ও বীরত্বকে ইসলামের
খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। রাসূল সা. এর জীবনে প্রায় সব যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করেন
এবং প্রতিটি যুদ্ধে তিনি তার শৌর্যবির্যের পরিচয় দেন। বদরের যুদ্ধে তিনি মহানবী
সা. এর পতাকা বহন করেন। এ যুদ্ধে তিনি কুরাইশদের বিখ্যাত বীর আমর ইবন আবুদ্দোজা কে
পরাজিত ও নিহত করে। এ সময় বীরত্বের জন্য তিনি মহানবী সা. এর কাছ হতে জুলফিকার
তরবারি লাভ করেছিলেন। এমনি ভাবে তিনি উহুদ, খন্দক, খায়বার যুদ্ধে শত্রুকে পরাজিত করে বিখ্যাত
কামুস দূর্গ জয় করে অসাধারণ সৌর্য বীর্য প্রদর্শন করেন। তার বীরত্বে সন্তুষ্ট হয়ে
মহানবী সা. তাকে আসাদুল্লাহ বা আল্লাহর বাঘ উপাধিাতে ভূষিত করেন।
হযরত আলী
রা. শাহাদাত: বিদ্রোহী
খারেজীগণ হযরত আলী মুআবিয়া ও আমর ইবনুল আস রা. কে ইসলামের শান্তি শৃঙ্খলা বিনাসের
কারণ বলে দায়ী করে। তাই তারা এ তিনজনকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। সেমতে কুফা, দামেষ্ক ও ফুসতাত প্রত্যেকে নিজ নিজ মসজিদ
হতে বের হওয়ার পথে তাদেরকে শেষ করে দেয়ার ইচ্ছা করে আততায়ীরা। সৌভাগ্যক্রমে আমর
ইবনুল আস সেদিন অনুপস্থিত ছিলেন। মুআবিয়া রা. আততায়ীর হাতে আহত হলেও প্রাণে বেচে
যায়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা! আবদুর ইবনে মুলজামের খঞ্জরের আঘাতে হযরত আলী রা.
গুরুতর আহত হন। সেই আঘাতেই ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারী তিনি শাহাদাত লাভ করেন।
আর এই মাহান খলীফার মৃত্যুর সাথে সাথেই সীরাতে মুস্তাকীমের উপর প্রতিষ্ঠিত
খোলাফায়ে রাশেদীনের পবিত্র খেলাফতের পরিসমাপ্তি ঘটে।
হযরত আলী (রাঃ)
20
ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা:) এর ইন্তেকালের পরে
মুসলিম দুনিয়ায় এক মহা দুর্যোগের সূত্রপাত ঘটে। ইসলামী রাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ
গোত্র দ্বন্দ্ব পুনরায় মাথা চারা দেয়। চারিদিকে অশান্তি সৃষ্টি হয়। ওসমান (রা:) এর
হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ভীষণ ভাবে জোরদার হয়। হজরত আলী (রা:) কে খলিফা
নির্বাচনে সমস্ত অবস্থা এক নতুন পথে মোড় নেয়। নতুন খলিফা সাহস ও শক্তি
দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু অবস্থা সামাল দেওয়ার মত ছিল
না। কারণ খেলাফতের স্থায়িত্ব ও সংকটময় ছিল।
বাল্যকাল :
৬০০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার
বিখ্যাত কোরায়েশ বংশে হজরত আলী (রাঃ) জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর
পিতার নাম আবু তালেব ও মাতার নাম বিবি ফাতেমা। আবু তালেব ছিলেন নবী (সাঃ)- এর আপন
চাচা।
দাদা আবু মুত্তালিবের
ইন্তেকালের পরে নবী (সাঃ) -কে তিনি সস্নেহে লালিত পালিত করেন।
নবী (সাঃ)-এর আপন চাচাতো ভাই হজরত আলী (রাঃ)। এই কারনেই নবীজির সঙ্গে
হজরত আলী ( রাঃ)-এর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। যখন নবীজি(সাঃ) নবুয়াতপ্রাপ্তহন তখন
হজরত আলী (রাঃ) -এর বয়স দশ বছর তাই তিনি প্রথম থেকেই ইসলামের প্রতি অনুরাগী
ছিলেন।
যুবক পুরুষের মধ্যে তিনিই প্রথম পুরুষ যিনি তৎকালীন আরবে
ইসলাম ধর্মকে দ্বিধাহীন ভাবে মেনে নেন। যেদিন নবীজি মক্কা থেকে
মদিনায় হিযরত করেন তখন নবীজি আলী (রাঃ) -কে নিজের বিছানায় শুয়ে থাকতে
বলেন। তিনি ওই অনুরোধ থেকে পিছিয়ে আসেনি এটা জেনেও যে মৃত্যু নিশ্চিত। পরের দিন
শত্রুরা নবীজি কে খুঁজতে খুঁজতে ঘরে এসে দেখে নবীজির বিছানায় আলী ঘুমিয়ে আছেন।
মদিনার জীবন:
তারপর নবীজির নির্দেশে তিনিও
মদিনায় হিযরত করেন। হজরত আলী (রাঃ) ছিলেন পয়গম্বরের
ছায়া স্বরূপ। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কন্যা বিবি ফাতেমার
সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তিনি ছিলেন প্রচুর সাহসী, শক্তিশালী, বিনয়ী ও সরল। তিনি ইসলামের সততা নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। প্রতিটি যুদ্ধে তিনি তাঁর সাহসিকতার পরিচয় দেন।অসীম বীরত্বের জন্য
তিনি 'শেরে-ই- খোদা' নামে
পরিচিত। নবীজি তাঁকে ' লা-ফাতাহ-ইল্লা-আলী'
উপাধি দেন। আরবের শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি ছিলেন
অন্যতম। হুদাইবিয়া সন্ধি পত্র তিনিই তৈরি করেন। ইসলাম ধর্ম ও ইসলামী
সাম্রাজ্যের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তার জন্য তিনি সব রকম ত্যাগ করতে রাজি
ছিলেন।
খেলাফত নির্বাচন :
হজরত ওসমান (রাঃ)
এর দুঃখ জনক শাহাদাতের পরে আরব দুনিয়ায় অকাল কেয়ামত ও বিশৃঙ্খলা
ছাড়িয়ে পড়ে।
রাজধানী মদিনা আয়ত্তের বাইরে চলে
যায়।এমন সময়ে চতুর্থ খলিফা নির্বাচন নিয়ে মহা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। কয়েক দিন পরে মদিনায়
ইবনে সাবা ও গন্যমান্য
ব্যাক্তি গণ ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে আলী( রাঃ) - কে খলিফা পদে নিয়োগ
করেন।
হজরত আলী (রাঃ)-এর চরিত্র ও কৃতিত্ব:
হজরত আলী (রাঃ) ছিলেন ইসলামের সেবক ও ধৈর্য্যের প্রতীক।
বীর হামজা(রাঃ) ও ওমর (রাঃ) - এর সমকক্ষ ছিলেন
তিনি । হযরত আলী (রাঃ) ছিলেন ইসলামের সরলমতী একজন সেবক।
ইসলামের দুর্দিনে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন।
হজরত আলী (রাঃ) -এর দারিদ্র ছিল জীবনের প্রধান বন্ধু। তাই হজরত মুহাম্মদ
(সাঃ) তিনাকে সাহায্য করতেন । তিনি ইসলামের শক্তিশালী সেবক ছিলেন তাই আলী কে
শেরে-খোদা বলেন। তিনি কোরান ও হাদিস ব্যাখ্যা করে পড়তে পারদর্শী ছিলেন। তাই
নবী মুহাম্মদ ( সাঃ) হজরত আলী (রাঃ)-কে বাব-উল-ইলম বা জ্ঞানের দরজা
বলে অভিহিত করেছেন। হজরত আলী (রাঃ)-এর ইন্তেকালের পরে তাঁর জ্যেষ্ঠ
পুত্র হাসান (রাঃ) খলিফা পদে নিযুক্ত হন।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(০৫)
হাসান বিন আলী (রা.)
ভূমিকা :
নবী করীম (সা.)-এর দৌহিত্র, ইসলামের
চতুর্থ খলীফা আলী (রা.) ও ফাতেমা (রা.)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র হাসান (রা.) ছিলেন স্বীয়
পিতা আলী (রা.)-এর পরে খেলাফতের দায়িত্ব পালনকারী ছাহাবী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত
ইবাদতগুযার, ন্যায়পরায়ণ ও
মুত্তাক্বী-পরহেযগার এবং জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ছাহাবী। তাঁর জীবনী নিম্নে
উল্লেখ করা হল।
নাম ও বংশ পরিচয় :
তাঁর নাম হাসান,
উপনাম
আবু মুহাম্মাদ, লকব বা উপাধি জান্নাতী
যুবকদের সরদার (سَيِّدُ شَبَابِ أَهْلِ الجَنَّةِ),
নিসবতী
নাম আল-হাশেমী আল-ক্বারাশী।[1] তাঁর পূর্ণ বংশ পরিচয় হচ্ছে, হাসান
ইবনু আলী ইবনে আবী তালিব ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশেম ইবনে আব্দে মানাফ।[2] তিনি ফাতিমা (রা.)-এর পুত্র এবং খাদীজা (রা.)
ও মুহাম্মাদ (সা.)-এর দৌহিত্র।[3]
জন্ম ও শৈশব :
বিশুদ্ধ মতে,
হাসান
(রা.) তৃতীয় হিজরীর ১৫ই রামাযান মদীনা মুনাওয়ারায় জন্মগ্রহণ করেন।[4] কেউ কেউ তাঁর জন্ম শা‘বান
মাসে বা তার পরে হয়েছে বলে উল্লেখ করলেও তা সঠিক নয়। আহমাদ ইবনু আব্দুর রহমান
আল-বারক্বী ও ইবনু সা‘দ বলেন,
হাসান
(রা.) তৃতীয় হিজরীর মধ্য রামাযানে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন।[5] আববাস (রা.)-এর স্ত্রী হাসান (রা.)-কে দুধ
পান করান। উম্মুল ফযল লুবাবা বিনতুল হারেছ আল-হিলালিয়া (রা.) বলেন, হে
আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমি স্বপ্নে আপনার দেহের কোন একটি অঙ্গ আমার ঘরে দেখতে
পেলাম। তিনি বলেন, তুমি ভালোই দেখেছ। ফাতেমা
একটি সন্তান প্রসব করবে এবং তুমি তাকে দুধ পান করাবে। অতএব ফাতেমা (রা.) হাসান (রা.)-কে
প্রসব করেন এবং তিনি তাকে কুছাম-এর ভাগের দুধ পান করান’।[6]
নামকরণ ও আক্বীক্বা
:
হাসান (রা.)-এর নামকরণ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, আলী
(রা.) বলেছেন, যখন হাসানের জন্ম হ’ল
আমি তার নাম রাখলাম, হারব (অর্থ- যুদ্ধ)। এরপর
রাসূলুল্লাহ (সা.) এসে বললেন, আমার নাতিকে দেখাও। তোমরা
ওর কি নাম রেখেছ? আমি বললাম, হারব।
তিনি বললেন, না, বরং
ওর নাম হাসান’।[7]
রাসূল (সা.) হাসান ও হুসাইন (রা.)-এর পক্ষ থেকে একটি করে
দুম্বা আক্বীক্বা করেন। ইবনু আববাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَقَّ عَنِ
الْحَسَنِ، وَالْحُسَيْنِ كَبْشًا كَبْشًا ‘রাসূলুল্লাহ
(সা.) হাসান ও হুসাইন (রা.)-এর পক্ষ থেকে একটি করে দুম্বা আক্বীক্বা করেছেন।[8] অতঃপর তিনি ফাতেমা (রা.)-কে বলেন,يَا فَاطِمَةُ، احْلِقِي رَأْسَهُ، وَتَصَدَّقِي بِزِنَةِ شَعْرِهِ
فِضَّةً ‘হে ফাতেমা! তার মাথা
মুন্ডন করে দাও এবং তার চুলের ওযনের সমপরিমাণ রূপা দান কর। তদনুযায়ী আমি তার চুল
ওযন করলাম। তার ওযন এক দিরহাম বা তার কাছাকাছি হয়’।[9]
শিক্ষাদীক্ষা ও
হাদীছ বর্ণনা :
রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুকালে হাসান (রা.)-এর বয়স ছিল সাড়ে ৭
বৎসর। তিনি শৈশবে নবী করীম (সা.)-এর সান্নিধ্য প্রাপ্ত খাতুনে জান্নাত ফাতিমা (রা.)-এর
সার্বিক তত্ত্বাবধান ও আলী (রা.)-এর নিবিড় পরিচর্যায় ইলমে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।
তিনি স্বীয় নানা মুহাম্মাদ (সা.)-এর নিকট থেকে কিছু হাদীছ মুখস্থ করেন। আর পিতা
আলী (রা.) ও মাতা ফাতেমা (রা.) থেকে হাদীছ শেখেন। তাঁর থেকে তার পুত্র হাসান ইবনু
হাসান, সুওয়াইদ ইবনু গাফলাহ,
আবুল
হাওরা আস-সা‘দী,
শা‘বী, হুবায়রাহ
ইবনু ইয়ারীম, আছবাগ ইবনু নাবাতাহ, আল-মুসাইয়িব
ইবনু নাখবাহ প্রমুখ হাদীছ বর্ণনা করেন।[10] হাদীছ গ্রন্থগুলোতে তাঁর বর্ণিত কিছু হাদীছ
পাওয়া যায়। বাকী ইবনু মাখলাদ স্বীয় মুসনাদে হাসান (রা.) কর্তৃক বর্ণিত রাসূল (সা.)-এর
১৩টি হাদীছ উল্লেখ করেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহঃ) স্বীয় মুসনাদে হাসান (রা.)
কর্তৃক বর্ণিত ১০টি হাদীছ উল্লেখ করেন। আর সুনানে আরবা‘আতে
তাঁর থেকে বর্ণিত ৬টি হাদীছ উল্লেখিত হয়েছে।[11]
রাসূল (সা.) কর্তৃক
প্রশিক্ষণ :
হাসান (রা.) শৈশবে বিভিন্ন বিষয়ে রাসূল (সা.) থেকে সরাসরি
প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন। আবূ হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি
বলেন, ‘হাসান ইবনু আলী (রা.) ছাদাক্বার একটি খেজুর হাতে নিয়ে তা
মুখে দিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) ‘কাখ-কাখ’ শব্দ
দ্বারা ইংগিত করে বললেন, ارْمِ بِهَا، أَمَا عَلِمْتَ
أَنَّا لَا نَأْكُلُ الصَّدَقَةَ؟ এটা ফেলে দাও। তুমি কি জান না আমরা ছাদাক্বা খাই না’?[12]
দৈহিক গঠন :
হাসান (রা.) ছিলেন সাদা রক্তিমাভ সুন্দর চেহারার অধিকারী।
তার ছিল কালো ডাগর দু’টি চোখ,
নরম
ও সমান চিবুক, লম্বা ঘন শ্মশ্রু, চাঁদির
ন্যায় শুভ্র ও প্রশস্ত কাঁধ এবং কোঁকড়ানো চুল। তিনি অধিক দীর্ঘ ও অতি খাটো ছিলেন
না বরং মধ্যম আকৃতির সুন্দর দেহের মানুষ ছিলেন। তিনি মেহেদী ও কাতাম দ্বারা খেযাব
লাগাতেন।[13]
পারিবারিক জীবন :
হাসান (রা.) বহু বিবাহ করেছিলেন। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,وَكَانَ كَثِيرَ التَّزَوُّجِ، وَكَانَ لَا يُفَارِقُهُ أَرْبَعُ
حَرَائِرَ، وَكَانَ مِطْلَاقًا مِصْدَاقًا، ‘তিনি
অধিক বিবাহকারী ছিলেন। আর ৪ জন স্বাধীন স্ত্রী তার থেকে কখনও পৃথক হ’ত
না। তিনি অধিক তালাক প্রদানকারী ও অধিক মোহরানা প্রদানকারী ছিলেন’।[14] বলা হয়ে থাকে, তিনি
৭০ জন মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন।[15] ঐতিহাসিকগণ তার স্ত্রীগণের মধ্যে কয়েকজনের
নাম উল্লেখ করেছেন। তারা হ’লেন,
খাওলা
আল-ফাযারিয়াহ, জা‘দাহ
বিনতুল আশ‘আছ,
আয়েশা
আল-খাছ‘আমিয়াহ, উম্মু ইসহাক্ব বিনতু
ত্বলহা বিনতে ওবায়দুল্লাহ আত-তামীমী,
উম্মু
বাশীর বিনতু আবী মাসঊদ আনছারী, হিন্দ বিনতু আব্দুর রহমান
ইবনে আবী বকর, উম্মু আব্দুল্লাহ বিনতুশ
শালীল ইবনে আব্দুল্লাহ প্রমুখ।[16]
হাসান বিন আলী (রা.)-এর ১৫ জন পুত্র এবং ৮জন কন্যা সন্তান
ছিল।[17] তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম হচ্ছে- হাসান, যায়েদ, ত্বালহা, ক্বাসেম, আবুবকর, আব্দুল্লাহ
[এরা সবাই হোসাইন (রা.)-এর সাথে কারবালায় শহীদ হন], আমর, আব্দুর
রহমান, হুসাইন, মুহাম্মাদ, ইয়া‘কূব, ইসমাঈল, হামযাহ, জা‘ফর, আক্বীল
প্রমুখ।[18]
হাসান (রা.)-এর মর্যাদা :
নবী করীম প্রিয় দৌহিত্র হাসানকে অত্যধিক ভালবাসতেন, পৃথিবীতে
যার তুলনা বিরল। তার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করতেন। কখনও তিনি
হাসানকে নিজের কাঁধে উঠাতেন। কখনও তাকে কোলে নিয়ে ছালাত আদায় করতেন। রাসূল (সা.)-এর
নিকটে হাসান (রা.)-এর অনন্য মর্যাদা ফুটে উঠেছে নিম্নোক্ত হাদীছ সমূহে।-
(ক) হাসান (রা.)-এর প্রতি রাসূল (সা.)-এর মহববত ও অনুগ্রহ :
রাসূল
(সা.) স্বীয় দৌহিত্র হাসানকে প্রাণাধিক মহববত করতেন। যেমন নিম্নের হাদীছে এসেছে,
1.
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ
صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ أَحَبَّ الْحَسَنَ وَالْحُسَيْنَ فَقَدْ
أَحَبَّنِي، وَمَنْ أَبْغَضَهُمَا فَقَدْ أَبْغَضَنِي،
১.
আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
(সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি হাসান ও
হুসায়নকে ভালোবাসে, সে আমাকেই ভালোবাসে এবং যে
ব্যক্তি তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে সে আমার প্রতিই বিদ্বেষ পোষণ করে’।[19]
২.
শাদ্দাদ (রা.) বলেন, একদা যোহর অথবা আছরের
ছালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি আমাদের মাঝে বের হ’লেন।
তাঁর কোলে ছিল হাসান অথবা হুসাইন। তিনি সামনে গিয়ে তাকে নিজের ডান পায়ের কাছে
রাখলেন। অতঃপর তিনি তাকবীর দিয়ে ছালাত শুরু করলেন। ছালাত পড়তে পড়তে তিনি একটি
সিজদাহ (অস্বাভাবিক) লম্বা করলেন। (ব্যাপার না বুঝে) আমি লোকের মাঝে মাথা তুলে
ফেললাম। দেখলাম, তিনি সিজদাহ অবস্থায় আছেন, আর
তাঁর পিঠে শিশুটি চড়ে বসে আছে! অতঃপর পুনরায় আমি সিজদায় ফিরে গেলাম। আল্লাহর আসূল
(সা.) ছালাত শেষ করলে লোকেরা তাঁকে বলল,
হে
আল্লাহর আসূল (সা.)! আপনি ছালাত পড়তে পড়তে একটি সিজদাহ (অধিক) লম্বা করলেন। এর ফলে
আমরা ধারণা করলাম যে, কিছু হয়তো ঘটল অথবা আপনার
উপর অহী অবতীর্ণ হচ্ছে। তিনি বললেন,
এ
সবের কোনটাই নয়। আসলে (ব্যাপার হ’ল), আমার
বেটা (নাতি) আমাকে সওয়ারী বানিয়ে নিয়েছিল। তাই তার মন ভরে না দেওয়া পর্যন্ত (উঠার
জন্য) তাড়াতাড়ি করাটাকে আমি অপসন্দ করলাম’।[20]
৩.
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) ছালাত পড়তেন, আর
সিজদাহ অবস্থায় হাসান ও হুসাইন তাঁর পিঠে চড়ে বসত। লোকেরা তাদেরকে এমন করতে নিষেধ
করলে তিনি ইশারায় বলতেন, ওদেরকে (নিজের অবস্থায়)
ছেড়ে দাও। অতঃপর ছালাত শেষ করলে তাদের উভয়কে কোলে বসিয়ে বলতেন, যে
ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে, সে যেন এদেরকে ভালোবাসে’।[21]
4.
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ كُنْتُ
مَعَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِى سُوقٍ مِنْ أَسْوَاقِ الْمَدِينَةِ
فَانْصَرَفَ فَانْصَرَفْتُ فَقَالَ أَيْنَ لُكَعُ ثَلاَثًا ادْعُ الْحَسَنَ بْنَ
عَلِىٍّ. فَقَامَ الْحَسَنُ بْنُ عَلِىٍّ يَمْشِى وَفِى عُنُقِهِ السِّخَابُ،
فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِيَدِهِ هَكَذَا، فَقَالَ الْحَسَنُ
بِيَدِهِ، هَكَذَا فَالْتَزَمَهُ فَقَالَ اللَّهُمَّ إِنِّى أُحِبُّهُ،
فَأَحِبَّهُ، وَأَحِبَّ مَنْ يُحِبُّهُ.
৪.
আবূ হুরায়রা (রা.) হ’তে বর্ণিত, তিনি
বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে মদীনার কোন এক বাজারে
ছিলাম। তিনি (বাজার থেকে) ফিরলেন। আমিও ফিরলাম। তিনি বললেন, ছোট
শিশুটি কোথায়? এ কথা তিনবার বললেন। হাসান
ইবনু আলীকে ডাক। দেখা গেল হাসান ইবনু আলী হেঁটে চলেছে। তাঁর গলায় ছিল মালা। নবী
করীম (সা.) এভাবে তাঁর হাত উঠালেন। হাসানও এভাবে নিজের হাত উঠালো। তারপর তিনি
তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ! আমি একে
ভালবাসি, আপনিও তাকে ভালবাসুন এবং
যে ব্যক্তি তাকে ভালবাসে, তাকেও আপনি ভালবাসুন’।
আবূ
হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এ
কথা বলার পর থেকে হাসান ইবনু আলীর চেয়ে অন্য কেউ আমার কাছে অধিকতর প্রিয় হয়নি।[22]
5.
عن أسامة بن زيد قال: كَانَ رسول الله صلى الله عليه
وسلم يَأْخُذُنِيْ فَيُقْعِدُنِيْ عَلَى فَخِذِهِ وَيُقْعِدُ الْحَسَنَ بْنَ عَلِي
عَلَى فَخِذِهِ الأُخْرَى ثُمَّ يَقُوْلُ: اَللَّهُمَّ إِنِّي أَرْحَمُهُمَا
فَارْحِمْهُمَا،
৫.
উসামা বিন যায়েদ (রা.) হ’তে বর্ণিত, তিনি
বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে ধরে তাঁর উরুর উপরে বসালেন এবং
হাসান বিন আলীকে অন্য উরুর উপরে বসালেন। অতঃপর বললেন, হে
আল্লাহ! আমি এদের দু’জনের প্রতি দয়ার্দ্র। সুতরাং তুমি তাদের
উভয়ের উপরে দয়া কর’।[23]
6.
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ الْأَقْرَعَ بْنَ
حَابِسٍ، أَبْصَرَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يُقَبِّلُ
حُسَيْنًا فَقَالَ: إِنَّ لِي عَشَرَةً مِنَ الْوَلَدِ مَا فَعَلْتُ هَذَا
بِوَاحِدٍ مِنْهُمْ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ
لَا يَرْحَمُ لَا يُرْحَمُ
৬.
আবূ হুরায়রা (রা.) হ’তে বর্ণিত, তিনি
বলেন, আক্বরা বিন হাবিস (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে দেখলেন যে, তিনি
হাসানকে চুমু খাচ্ছেন। ইবনু আবী ওমর তার বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি
হাসান অথবা হুসাইনকে চুমু খেয়েছেন। আক্বরা (রা.) বলেন, আমার
দশটি সন্তান আছে। কিন্তু আমি তাদের কাউকে কখনো চুমু দেইনি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে
ব্যক্তি দয়া করে না সে দয়াপ্রাপ্ত হয় না’।[24]
৭.
ইয়ালা আল-আমেরী (রা.) থেকে বর্ণিত,
তিনি
বলেন, হাসান ও হোসাইন (রা.) দৌড়াতে দৌড়াতে নবী করীম (সা.)-এর নিকট
আসলেন। তিনি তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, সন্তান
কৃপণতা ও কাপুরুষতা সৃষ্টিকারী’।[25]
8.
عَنْ مُعَاوِيَةَ قَالَ َأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صلى
الله عليه وسلم يَمُصُّ لِسَانَهُ أَوْ قَالَ شَفَتَهُ يَعْنِى الْحَسَنَ بْنَ
عَلِىٍّ صَلَوَاتُ اللهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَنْ يُعَذَّبَ لِسَانٌ أَوْ
شَفَتَانِ مَصَّهُمَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم
৮.
মু‘আবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি
বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে দেখলাম তার জিহবা অথবা ঠোট চুষছেন।
অর্থাৎ হাসান বিন আলী (রা.)-এর। নিশ্চয়ই যে জিহবা অথবা ঠোটদ্বয় রাসূল (সা.) চুষছেন
তাকে কখনও শাস্তি দেওয়া হবে না’।[26]
9.
عَنْ ابْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: بَيْنَا
رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى الْمِنْبَرِ يَخْطُبُ إِذْ
أَقْبَلَ الْحَسَنُ، وَالْحُسَيْنُ عَلَيْهِمَا السَّلَامُ عَلَيْهِمَا قَمِيصَانِ
أَحْمَرَانِ يَمْشِيَانِ وَيَعْثُرَانِ، فَنَزَلَ وَحَمَلَهُمَا، فَقَالَ: صَدَقَ
اللهُ: {إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ} [التغابن: 15] رَأَيْتُ
هَذَيْنِ يَمْشِيَانِ وَيَعْثُرَانِ فِي قَمِيصَيْهِمَا فَلَمْ أَصْبِرْ حَتَّى
نَزَلْتُ فَحَمَلْتُهُمَا،
৯.
বুরায়দা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
(সা.) মিম্বারের উপর দাঁড়িয়ে খুৎবা দিচ্ছিলেন,
ইত্যবসরে
হাসান ও হুসায়ন (রা.) আসলেন। তাদের পরিধানে দু’টি লাল জামা ছিল। তাঁরা
চলছিলেন এবং জামায় আটকে আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। তিনি নীচে নেমে আসলেন এবং
উভয়কে উঠিয়ে নিলেন আর বললেন, আল্লাহ তা‘আলা
সত্যই বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের সস্পদ ও
তোমাদের সন্তান-সন্ততি পরীক্ষা স্বরূপ’ (তাগাবুন ৬৪/১৫); আমি
এদের দেখলাম যে, এরা চলছিল এবং জামায় আটকে
আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচিছল। তখন আমি ধৈর্যধারণ করতে পারলাম না। অবশেষে নীচে নেমে
এসে তাদের উঠিয়ে নিলাম’।[27]
(খ) রাসূল (সা.)-এর সাথেহাসান (রা.)-এর সাদৃশ্য :
রাসূল (সা.)-এর চেহারার সাথে হাসান (রা.)-এর অত্যধিক মিল
ছিল। আবু জুহাইফা (রা.) হ’তে বর্ণিত, তিনি
বলেন,رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ
أَشْبَهَ النَّاسِ بِهِ الْحَسَنُ بْنُ عَلِىٍّ. ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে দেখেছি। তিনি ছিলেন হাসান বিন আলী
(রা.)-এর সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ’।[28] আনাস (রা.) বলেন, لَمْ يَكُنْ أَحَدٌ أَشْبَهَ بِالنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم مِنَ
الْحَسَنِ بْنِ عَلِىٍّ. ‘হাসান ইবনু আলী (রা.)
অপেক্ষা নবী করীম (সা.)-এর সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ আর কেউ ছিলেন না’।[29]
(গ) হাসান (রা.) আহলে বায়তের অন্তর্গত :
হাসান (রা.)-এর বিশেষ মর্যাদার আরেকটি দিক হচ্ছে তিনি আহলে
বায়তের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ছাফিয়া বিনতে শায়বা (রা.) হ’তে
বর্ণিত, তিনি বলেন যে,
আয়েশা
(রা.) বলেছেন,خَرَجَ النَّبِيُّ صَلَّى
اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غَدَاةً وَعَلَيْهِ مِرْطٌ مُرَحَّلٌ، مِنْ شَعْرٍ
أَسْوَدَ، فَجَاءَ الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ فَأَدْخَلَهُ، ثُمَّ جَاءَ الْحُسَيْنُ
فَدَخَلَ مَعَهُ، ثُمَّ جَاءَتْ فَاطِمَةُ فَأَدْخَلَهَا، ثُمَّ جَاءَ عَلِيٌّ
فَأَدْخَلَهُ، ثُمَّ قَالَ: {إِنَّمَا يُرِيدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ
الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا} ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) সকালে বের হ’লেন।
তার পরনে ছিল কালো পশমের নকশীদার চাদর। হাসান ইবনু আলী (রা.) আসলেন, তিনি
তাকে চাদরের ভেতর প্রবেশ করিয়ে নিলেন। হুসায়ন ইবনু আলী (রা.) আসলেন, তিনিও
চাদরের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়লেন। ফাতেমা (রা.) আসলেন, তাকেও
ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললেন। তারপর আলী (রা.) আসলেন তাকেও ভেতরে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপরে
বললেন, হে আহলে বায়ত আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের হ’তে
অপবিত্রতাকে দূরীভূত করে তোমাদের পবিত্র করতে চান’ (আহযাব ৩৩/৩৩)।[30]
(ঘ)হাসান ও হুসাইন (রা.) দুনিয়ার দু’টি সুগন্ধি ফুল :
পৃথিবীতে সবাই ফুল ভালবাসে। সে ফুলে সুগন্ধি থাকলে তা
মানুষের হৃদয় কেড়ে নেয়। রাসূল (সা.) হাসান ও হুসাইন (রা.)-কে সুগন্ধি ফুলের সাথে তুলনা
করেছেন। হাদীছে এসেছে, ইবনু আবূ নু‘আয়ম
থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, كُنْتُ شَاهِدًا لاِبْنِ عُمَرَ وَسَأَلَهُ رَجُلٌ عَنْ دَمِ
الْبَعُوضِ. فَقَالَ مِمَّنْ أَنْتَ فَقَالَ مِنْ أَهْلِ الْعِرَاقِ. قَالَ
انْظُرُوا إِلَى هَذَا، يَسْأَلُنِى عَنْ دَمِ الْبَعُوضِ وَقَدْ قَتَلُوا ابْنَ
النَّبِىِّ صـ وَسَمِعْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ هُمَا
رَيْحَانَتَاىَ مِنَ الدُّنْيَا. ‘আমি ইবনু ওমর (রা.)-এর
কাছে ছিলাম। তখন তাঁর কাছে জনৈক লোক মশার রক্তের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো। তিনি
বললেন, তুমি কোন্ দেশের লোক?
সে
বলল, আমি ইরাকের বাসিন্দা। ইবনু ওমর (রা.) বললেন, তোমরা
এর দিকে তাকাও, সে আমাকে মশার রক্তের
ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে, অথচ তারা নবী করীম (সা.)-এর
সন্তানকে (নাতিকে) হত্যা করেছে। আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ওরা
দু’জন (হাসান ও হুসাইন) দুনিয়াতে আমার দু’টি
সুগন্ধি ফুল’।[31]
(ঙ) হাসান (রা.) দুনিয়াতে সরদার :
হাসান (রা.) দুনিয়াতে নেতা হবেন, যে
সুসংবাদ রাসূল (সা.) পূর্বেই দিয়েছিলেন। আবূ বকরাহ (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি
বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) হাসান ইবনু আলী (রা.) সম্পর্কে বললেন,إِنَّ ابْنِي هَذَا سَيِّدٌ، وَإِنِّي أَرْجُو أَنْ يُصْلِحَ اللهُ
بِهِ بَيْنَ فِئَتَيْنِ مِنْ أُمَّتِي، ‘আমার
এ ছেলে (নাতী) নেতা হবে। আর আমি কামনা করি,
আল্লাহ
তার মাধ্যমে আমার উম্মাতের দু’টি দলের মধ্যে সমঝোতা
করাবেন’।[32] তিনি অন্যত্র বলেন,إِنَّ ابْنِى هَذَا سَيِّدٌ، وَلَعَلَّ اللهَ أَنْ يُصْلِحَ بِهِ
بَيْنَ فِئَتَيْنِ عَظِيمَتَيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ، ‘আমার
এ সন্তান (দৌহিত্র) একজন নেতা। সম্ভবত তার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা
মুসলমানদের দু’টি বড় দলের মধ্যে মীমাংসা করাবেন’।[33]
(চ) হাসান ও হুসাইন (রা.) জান্নাতী যুবকদের সরদার :
হাসান (রা.)-এর মর্যাদার সবচেয়ে বড় দিক হ’ল
তিনি জান্নাতী যুবকদের নেতা হবেন। আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) হ’তে
বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, الحَسَنُ وَالحُسَيْنُ سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الجَنَّةِ، ‘হাসান ও হুসাইন (রা.) জান্নাতী যুবকদের সরদার’।[34] অন্যত্র তিনি বলেন,إِنَّ هَذَا مَلَكٌ لَمْ يَنْزِلِ الأَرْضَ قَطُّ قَبْلَ هَذِهِ
اللَّيْلَةِ اسْتَأْذَنَ رَبَّهُ أَنْ يُسَلِّمَ عَلَيَّ وَيُبَشِّرَنِي بِأَنَّ
فَاطِمَةَ سَيِّدَةُ نِسَاءِ أَهْلِ الجَنَّةِ وَأَنَّ الحَسَنَ وَالحُسَيْنَ
سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الجَنَّةِ، ‘একজন ফেরেশতা যিনি আজকের এ রাতের আগে কখনও
পৃথিবীতে অবতরণ করেননি। তিনি আমাকে সালাম করার জন্য এবং আমার জন্য এ সুখবর বয়ে
আনার জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনুমতি চেয়েছেন যে, ফাতেমাহ
জান্নাতের নারীদের নেত্রী এবং হাসান ও হুসাইন জান্নাতের যুবকদের নেতা’।[35]
ছাহাবায়ে কেরামের নিকটে হাসান (রা.)-এর
সম্মান :
আবুবকর ছিদ্দীক (রা.) হাসান (রা)-কে সম্মান করতেন। শ্রদ্ধা
প্রদর্শন করতেন, ভালবাসতেন এবং তাঁর জন্যে
নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রা.)ও অনুরূপ করতেন। ওয়াকিদী মূসা ইবনু মুহাম্মাদ সূত্রে তাঁর
পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ওমর (রা.) যখন সরকারী
কোষাগার ও রাজস্ব বিভাগ প্রবর্তন করে ভাতা ব্যবস্থার প্রচলন করেন, তখন
তিনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের সমহারে হাসান এবং হুসায়ন (রা.)-এর
প্রত্যেকের জন্যে ৫০০০ দিরহাম করে সরকারী ভাতা নির্ধারণ করেন। তৃতীয় খলীফা ওছমান (রা.)ও
হাসান ও হুসায়ন (রা.)-কে সম্মান করতেন এবং ভালবাসতেন। শেষ জীবনে ওছমান (রা.)
গৃহবন্দী হ’লে হাসান (রা.) অন্যদের সাথে গলায় তরবারি
ঝুলিয়ে বিদ্রোহীদের আক্রমণ থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্যে খলীফার দরজায় প্রহরারত
ছিলেন। এতে খলীফা ওছমান (রা.) শংকিত হ’লেন, না
জানি বিদ্রোহীদের আক্রমণে হাসান (রা.)-এর কোন ক্ষতি হয়। তাই তিনি কসম করে তাঁকে
নিজ গৃহে ফিরে যাবার অনুরোধ করলেন। খলীফা ওছমান (রা.) এ অনুরোধ করেছিলেন আলী (রা.)-এর
মানসিক প্রশান্তির লক্ষ্যে এবং হাসান (রা.)-এর জীবনের ঝুঁকির আশংকায়।
চতুর্থ খলীফা আলী (রা.) স্বয়ং পুত্র হাসানকে খুবই সম্মান
করতেন, মর্যাদা দিতেন। একদিন তিনি হাসান (রা.)-কে বললেন, বৎস!
তুমি একটু বক্তব্য দাও, আমি তা শুনব। হাসান (রা.)
বললেন, আববা আপনি সামনে থাকলে আমার বক্তব্য দিতে লজ্জা করে। আলী (রা.) আড়ালে গিয়ে বসলেন, যেখান
থেকে বক্তব্য শোনা যায়। হাসান (রা.) দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতে শুরু করলেন। আড়াল থেকে
আলী (রা.) তা শুনছিলেন। তিনি একটি সারগর্ভ ও সুন্দর বক্তব্য দিলেন। বক্তব্য শেষ
হবার পর খুশি মনে আলী (রা.) বললেন,
এরা
একে অপরের বংশধর, আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বোত্তম।
হাসান ও হুসায়ন (রা.) যখন কোন বাহনে আরোহণ করতেন তখন ইবনু আববাস (রা.) ঐ বাহনের
রেকাব ধরে থাকতেন। এতে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রা.)
বলতেন, হাসান (রা.)-এর মত শিশু কোন মহিলা গর্ভে ধারণ করেনি।[36]
হাসান (রা.)-এর ইবাদত-বান্দেগী :
হাসান (রা.) অত্যন্ত ইবাদত গুযার মানুষ ছিলেন। ইবনু কাছীর
(রহঃ) বলেন,كَانَ الْحَسَنُ إِذَا صَلَّى
الْغَدَاةَ فِي مَسْجِدِ رَسُولِ الله يَجْلِسُ فِي مُصَلَّاهُ يَذْكُرُ اللهَ
حَتَّى تَرْتَفِعَ الشَّمْسُ، وَيَجْلِسُ إِلَيْهِ مَنْ يَجْلِسُ مِنْ سَادَاتِ
النَّاسِ يَتَحَدَّثُونَ عِنْدَهُ، ثُمَّ يَقُومُ فَيَدْخُلُ عَلَى أُمَّهَاتِ
الْمُؤْمِنِينَ فَيُسَلِّمُ عَلَيْهِنَّ وَرُبَّمَا أَتْحَفْنَهُ ثُمَّ يَنْصَرِفُ
إِلَى مَنْزِلِهِ. ‘হাসান (রা.) মসজিদে নববীতে
ফজরের ছালাত আদায় করে মুছাল্লায় (ছালাতের স্থানে) বসে থাকতেন এবং সূর্যোদয় পর্যন্ত
আল্লাহর যিকর করতেন। আর নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে কেউ কেউ তার সাথে বসে আলোচনা করতেন।
অতঃপর তিনি উম্মাহাতুল মুমিনীনদের নিকটে গিয়ে তাঁদেরকে সালাম দিতেন। কোন কোন সময়
তাঁরা হাসান (রা.)-কে উপহার দিতেন। অতঃপর তিনি বাড়ী ফিরে যেতেন’।[37] হাফেয যাহাবী (রহঃ) উল্লেখ করেন, হাসান
(রা.) পদব্রজে, কখনো নগ্ন পায়ে ২৫ বার
মদীনা মুনাওয়ারা থেকে মক্কা শরীফে গিয়ে হজ্জ পালন করেছেন এবং উটগুলি তাঁর সামনে
থাকতো।[38] আববাস ইবনু ফাযল হাসান ইব্ন আলী (রা) থেকে
বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, ‘মহান আল্লাহর গৃহে পায়ে হেঁটে যাওয়া ব্যতীত আমি মৃত্যুর পর
তাঁর সাথে সাক্ষাত করব তাতে আমি লজ্জাবোধ করি। এ সূত্রে ২০ বার তিনি হজ্জ শেষে
পায়ে হেঁটে মদীনায় আসেন।[39]
হাসান (রা.)-এর দানশীলতা :
হাসান (রা.)-এর পুরো জীবন তাকওয়া, ইবাদত-বন্দেগী, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা, মানবতার
কল্যাণ কামনা, দয়া-অনুগ্রহ, ধৈর্য-সহনশীলতা, মহানুভবতা
ও দানশীলতার অনন্য দৃষ্টান্ত ছিল। তিনি কোন সাহায্য প্রার্থীকে কোন অবস্থায় নিজ
গৃহ থেকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। ইবনে সা‘দ আলী বিন যায়েদ যাদ‘আন
থেকে বর্ণনা করেন, ইমাম হাসান (রা.) তাঁর
সমুদয় সম্পদ দু’বার আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেছেন, তিনবার
তাঁর অর্ধেক সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ছাদাক্বাহ করে দিয়েছেন।[40]
মুহাম্মাদ ইবন সীরীন বলেছেন, কোন
কোন সময় হাসান ইবনু আলী (রা.) এক ব্যক্তিকে এক লক্ষ দিরহাম দান করতেন। সাঈদ ইবনু
আবদুল আযীয বলেছেন, একদিন হাসান (রা.) তাঁর
পাশে থাকা এক ব্যক্তিকে দেখলেন যে,
সে
মহান আল্লাহর কাছে ১০ হাযার দিরহাম প্রার্থনা করছে। এটি শুনে হাসান (রা.) নিজ গৃহে
গমন করলেন এবং লোকটির জন্যে ১০ হাযার দিরহাম পাঠিয়ে দিলেন।[41]
ঐতিহাসিকগণ বলেছেন যে,
একদা
হাসান (রা) এক কৃষ্ণকায় ক্রীতদাসকে দেখলেন যে,
সে
একটি রুটি খাচ্ছে। তার পাশে ছিল একটি কুকুর। যুবকটি নিজে এক লোকমা খাচ্ছেন আর
কুকুরকে এক লোকমা খাওয়াচ্ছেন। পালাক্রমে সে রুটি খাচ্ছিল ও কুকুরকে খাওয়াচ্ছিল।
হাসান (রা.) বললেন, কিসে তুমি এ মহৎ কাজে
উৎসাহিত হয়েছ? যুবকটি বলল, আমি
খাব আর কুকুরটি উপোস থাকবে এটি আমার নিকট লজ্জাকর মনে হচ্ছে। তাই এমনটি করছি।
হাসান (রা.) যুবকটিকে বললেন, ‘আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত
তুমি এখানে থাক। হাসান (রা.) ক্রীতদাসটির মালিকের নিকট গেলেন। তার নিকট থেকে
ক্রীতদাসটিকে ক্রয় করে নিয়ে তাকে মুক্ত করে দিলেন। যে বাগানে সে ছিল ঐ বাগানটিও
ক্রয় করে তাকে দান করে দিলেন। ক্রীতদাসটি বলল,
ওহে
আমার মালিক! যার সন্তুষ্টির জন্যে আপনি আমাকে এই বাগান দান করেছেন তাঁরই
সন্তুষ্টির জন্যে আমি এই বাগান দান করে দিলাম।[42]
আবূ জা‘ফর বাকির বলেছেন, এক
লোক হুসায়ন ইবনু আলী (রা)-এর নিকট কোন এক প্রয়োজনে তাঁর সাহায্য নিতে এসেছিল, হুসায়ন
(রা.) ই‘তিকাফে ছিলেন। ফলে তিনি সাহায্য করতে অপরাগতা
প্রকাশ করলেন। লোকটি সাহায্যের জন্যে হাসান (রা)-এর নিকট গেল। সে তাঁর নিকট
সাহায্য চাইল। তিনি তার প্রয়োজন পূর্ণ করে দিলেন এবং বললেন, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে আমার একজন ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে দেয়া
আমার নিকট এক মাস ই‘তিকাফ অপেক্ষা অধিক প্রিয়।[43] যেমন রাসূল (সা.) বলেন, কোন
ভাইয়ের প্রয়োজনে তার সাথে চলা এই মসজিদে (নববীতে) ১ মাস ই‘তিকাফ
করা অপেক্ষা আমার কাছে প্রিয়তর’।[44]
[রেফারেন্স সমূহ]
[1]. ড. আলী মুহাম্মাদ
আছ-ছাল্লাবী, আমীরুল মুমিনীন আল-হাসান
ইবনু আলী ইবনে আবী ত্বালিব (রা.) শাখছিয়াতুহু ওয়া আছরুহু, (কায়রো : দারুত তাওযী‘
ওয়ান
নাশর আল-ইসলামিয়া, ১ম প্রকাশ, ১৪২৫
হি./২০০৪ খৃ.), পৃ. ১৭।
[2]. হাফেয শামসুদ্দীন
আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন
নুবালা, ৩/২৪৫ পৃ.।
[3]. আমীরুল মুমিনীন আল-হাসান
ইবনু আলী (রা.), পৃ. ১৭।
[4]. ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইস্তি‘আব
ফী মা‘রিফাতিল আছহাব (বৈরূত: দারুল জীল, ১ম
প্রকাশ, ১৪১২হি./১৯৯২খৃ.),
১ম
খন্ড, পৃ. ৩৮৪।
[5]. আমীরুল মুমিনীন আল-হাসান
ইবনু আলী (রা.), পৃ. ১৭।
[6]. আহমাদ হা/২৬৯১৭, ২৬৯২১, সনদ
হাসান।
[7]. আহমাদ হা/৭৬৯; হাকেম
হা/৪৭৮৩; ছহীহ ইবনে হিববান হা/৬৯৫৮, সনদ
হাসান।
[8]. আবূদাউদ হা/২৮৪১; ইরওয়া
হা/১১৬৭,সনদ ছহীহ।
[9]. তিরমিযী হা/১৫১৯, সনদ
হাসান; ইরওয়া হা/১১৭৫।
[10]. সিয়ারু আ‘লামিন
নুবালা, ৩/২৪৬ পৃ.।
[11]. আমীরুল মুমিনীন আল-হাসান
ইবনু আলী (রা.), পৃ. ৭৬।
[12]. বুখারী হা/১৪৯১; মুসলিম
হা/১০৬৯; মিশকাত হা/১৮২২।
[13]. হুসাইন বিন মুহাম্মাদ বিন
হাসান আদ-দিয়ার আল-বাকরী (মৃ. ৯৬৬ হি.),
তারীখুল
খামীস ফী আহওয়ালে আনফুসিন নাফীস (বৈরূত : দারু ছাদির, তাবি.), ১/৪১৯
পৃ.।
[14]. হাফেয ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ
ওয়ান নিহায়াহ, (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৪০৭হি./১৯৮৬খৃ.), ৮/৩৮
পৃ.।
[15]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৩৮
পৃ.।
[16]. আমীরুল মুমিনীন আল-হাসান
ইবনু আলী (রা.), পৃ. ২৭।
[17]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ
ছাফওয়াহ, ১/৭৫৯ পৃ.।
[18]. সিয়ারু আ‘লামিন
নুবালা, ৪/৩৪৭ পৃ.।
[19]. ইবনু মাজাহ হা/১৪৩; ছহীহুল
জামে‘ হা/৫৯৫৪।
[20]. আহমাদ হা/১৬১২৯; নাসাঈ
হা/১১৪১, সনদ হাসান।
[21]. ইবনে খুযাইমা ৮৮৭; বায়হাক্বী
৩২৩৭; ছহীহাহ হা/৩১২।
[22]. বুখারী হা/৫৮৮৪; মুসলিম
হা/২৪২১; মিশকাত হা/৬১৩৪।
[23]. ছহীহ ইবনে হিববান হা/৬৯৬১, হাদীছ
ছহীহ।
[24]. মুসলিম হা/২৩১৮; তিরমিযী
হা/১৯১১।
[25]. আহমাদ হা/১৭১১১; ইবনু
মাজাহ হা/৩৬৬৬; মিশকাত ৪৬৯১, ৪৬৯২; ছহীহুল
জামে‘ হা/১৯৮৯।
[26]. আহমাদ হা/১৬৮৯৪, সনদ
ছহীহ।
[27]. নাসাঈ হা/১৫৮৫, সনদ
ছহীহ।
[28]. আহমাদ হা/১৮৭৭০, সনদ
ছহীহ।
[29]. বুখারী হা/৩৭৫২; মিশকাত
হা/৬১৩৭।
[30]. মুসলিম হা/২৪২৪; মিশকাত
হা/৬১২৭।
[31]. বুখারী হা/৩৭৫৩, ৫৯৯৪; তিরমিযী
হা/৩৭৭০।
[32]. বুখারী হা/২৭০৪; আবুদাঊদ
হা/৪৬৬২; মিশকাত হা/৬১৩৫।
[33]. বুখারী হা/২৭০৪; মিশকাত
হা/৬১৩৫।
[34]. তিরমিযী হা/৩৭৬৮; ছহীহাহ
হা/৭৯৬; মিশকাত হা/৬১৬৩।
[35]. তিরমিযী হা/৩৭৮১; মিশকাত
হা/৬১৭১; ছহীহাহ হা/২৭৮৫।
[36]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৩৮
পৃ.।
[37]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৩৭
পৃ.।
[38]. সিয়ারু আ‘লামিন
নুবালা, ৩/২৬৭পৃ.; তাক্বীউদ্দীন মাক্বরেযী
(মৃ. ৮৪৫ হি.), ইমতাউল আসমা (বৈরূত : ১ম
প্রকাশ ১৯৯৯ খ্রি.), ৫/৩৬১ পৃ.।
[39]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৩৮
পৃ.।
[40]. তারীখুল খামীস ফী আহওয়ালে
আনফুসিন নাফীস, ১/৪১৯ পৃ.।
[41]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৩৯
পৃ.।
[42]. ঐ.।
[43]. ঐ.।
[44]. ছহীহাহ হা/৯০৬; ছহীহুল
জামে‘ হা/১৭৬।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(০৬)
খলীফা হিসাবে হাসান (রা.)
:
আব্দুল্লাহ ইব্নু আহমাদ আবূ আলী সুওয়াইদ আল-তাহহান সাফীনা (রা.)
থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্
(সা.) বলেছেন, ‘আমার পর ৩০ বছর খেলাফত
ভিত্তিক শাসন অব্যাহত থাকবে’।[1] এ বাণী শুনে জনৈক শ্রোতা বলল, ঐ
৩০ বছরের মধ্যে ৬ মাস হ’ল আমীর মু‘আবিয়া
(রা.)-এর শাসনকাল। তখন সাফীনা বলেন,
‘ঐ
৬ মাস কেমন করে মু‘আবিয়ার শাসনামলে সংযোজিত হবে? ঐ
ছয় মাস বরং গণ্য হবে হাসান (রা.)-এর শাসনকাল। কারণ বৈধ খলীফা হিসাবে জনসাধারণ
হাসান (রা.)-এর হাতে বায়‘আত করেছিল। প্রায় ৪০ বা ৪২ হাযার লোক তখন খলীফারূপে
হাসান (রা.)-এর হাতে বায়‘আত করেছিলেন।[2]
খালিদ ইবনু আহমাদ বলেছেন, আমি
আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, ৯০ হাযার লোক হাসান (রা.)-এর
হাতে রায়‘আত করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি খেলাফত থেকে
সরে দাঁড়ান এবং আমীর মু‘আবিয়া (রা.)-এর সাথে আপোষ-মীমাংসায় উপনীত হন।
হাসান (রা.)-এর খেলাফতকালে সামান্য রক্তপাতও ঘটেনি। এমনকি এক শিংগা পরিমাণ রক্তও
ঝরেনি। ইবনু আবী খায়ছামা ইবনু জারীর থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি
বলেছেন, আলী (রা.) যখন নিহত হ’লেন, তখন
কূফার লোকেরা হাসান (রা.)-এর হাতে বায়‘আত করেছিল। তারা তাঁর
প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করেছিল এবং তারা তাঁকে আলী (রা.)-এর চাইতেও অধিক
ভালবেসেছিল।
ইবনু আবী খায়ছামা হারূণ ইবনু মা‘রূফ
ইব‡ন
শাওয়াব থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আলী
(রা.)-এর হত্যাকান্ডের পর হাসান (রা.) ইরাকীদের নিকট গেলেন, আর
মু‘আবিয়া সিরীয়দের সাথে মিলিত হ’লেন।
তারপর উভয় পক্ষ যুদ্ধের মুখোমুখি হ’ল। হাসান (রা.)
যুদ্ধ-বিগ্রহ অপসন্দ করলেন এবং এই শর্তে মু‘আবিয়া (রা.)-এর সাথে
সমঝোতা করলেন যে, তাঁর শাসনামলের পর হাসান (রা.)-এর
নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর
হাসান (রা.)-এর সমর্থকগণ এই আপোষ-মীমাংসায় ক্ষুব্ধ হয়ে হাসান (রা.)-কে উদ্দেশ্য
করে বলত, ‘হে মুমিনদের গ্লানি!
উত্তরে হাসান (রা.) বলতেন, ‘জাহান্নামের আগুন অপেক্ষা
দুনিয়ার গ্লানি ও অপমান শ্রেয়’।[3]
আবূ বকর ইবনু আবিদ দুনিয়া আববাস ইবনু হিশামের পিতা থেকে
বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আলী
(রা.) নিহত হবার পর তাঁর পুত্র হাসান (রা.)-এর হাতে জনসাধারণ বায়‘আত
করেছিল। তারপর তিনি ৭ মাস ১১ দিন খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। ইবনু আসাকির বলেন, তিনি
৭ মাস ৭ দিন খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন।[4] আববাস ব্যতীত অন্য ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, আলী
(রা.) নিহত হবার পর কূফার অধিবাসীগণ হাসান (রা.)-এর হাতে বায়‘আত
করেছিল, আর মু‘আবিয়া (রা.)-এর হাতে
সিরীয়গণ বায়তুল মুক্বাদ্দাসে বায়‘আত করেছিল। ৪০ হিজরী সনের
শেষ দিকে জুম‘আর দিনে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে সার্বজনীন বায়‘আত
অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ৪১ সনে হাসান (রা.) কূফা রাজ্যের এক জনপদে এক গৃহে মু‘আবিয়া
(রা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। উভয়ে তখন সমঝোতায় উপনীত হন এবং হাসান (রা.) তখনকার মত
মু‘আবিয়া (রা.)-এর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। অন্য মতে, আমীর
মু‘আবিয়া (রা.)-এর কূফা গমন এবং উভয়ের মধ্যে সমঝোতায় উপনীত
হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল ৪১ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে।[5]
মু‘আবিয়া (রা.)-এর সাথে
সন্ধির পরে হাসান (রা.)-এর ভাষণ :
৪০ হিজরীর ১৭ই রামাযান আলী (রা.)-এর মৃত্যুর পর ইরাক, মক্কা, মদীনা
ও ইয়ামনবাসী হাসান ইবনু আলী (রা.)-এর হাতে খেলাফতের বায়‘আত
গ্রহণ করলে তার নেতৃত্বেই পঞ্চম খলীফার অগ্রযাত্রা শুরু হয় এবং তিনি ছয় মাস খেলাফতের
দায়িত্ব পালন করেন। এর দ্বারা রাসূল (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী ‘আমার
পরে খেলাফত ত্রিশ বছর থাকবে’[6] কার্যকর হয়। কিন্তু শামবাসী মু‘আবিয়া
বিন আবু সুফিয়ান (রা.)-এর হাতে খেলাফতের বায়‘আত গ্রহণ করে এবং মিসরবাসী
বিভক্ত হয়ে দু’পক্ষ দু’দলকে সমর্থন দেয়। হাসান (রা.)
মু‘আবিয়া (রা.)-কে আনুগত্যের শপথ নেওয়ার জন্য আহবান জানালে
তিনি অস্বীকার করেন। এমতাবস্থায় হাসান (রা.) মু‘আবিয়া
(রা.)-এর বিরুদ্ধে এক বিশাল সৈন্য দল প্রস্ত্তত করে শাম-এর উদ্দেশ্যে বের হয়ে ‘মাসকিন’ নামক
স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। বিপক্ষে মু‘আবিয়া (রা.)-এর বিশাল
সৈন্যদলও মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এমতাবস্থায় মু‘আবিয়া (রা.)-এর পক্ষ থেকে
আলোচনার প্রস্তাব সম্বলিত চিঠি আসলে হাসান (রা.) নিজ পক্ষের ছাহাবীগণের সাথে
পরামর্শ করে মুসলিম ঐক্য অটুট রাখার এবং রক্তপাত এড়ানোর বৃহত্তর স্বার্থে মু‘আবিয়া
(রা.)-কে মুসলমানদের খলীফা হিসাবে মেনে নেন।[7] যার ইঙ্গিত রাসূল (সা.) তাঁর বাণীতে দিয়ে
যান।[8]
মু‘আবিয়া (রা.) ও হাসান (রা.)-এর সমঝোতার বিষয়টি
ছহীহ বুখারীতে এভাবে এসেছে যে, হাসান (বছরী) (রহঃ) বলেন, আল্লাহর
কসম! হাসান ইবনু আলী (রা.) পর্বত প্রমাণ সেনাদল নিয়ে মু‘আবিয়া
(রা.)-এর মুখোমুখী হ’লেন। আমর ইবনুল আছ (রা.) বললেন, আমি
এমন সেনাদল দেখতে পাচ্ছি, যারা প্রতিপক্ষকে হত্যা না
করে ফিরে যাবে না। মু‘আবিয়া (রা.) তখন বললেন, আল্লাহর
কসম! (মু‘আবিয়াহ ও আমর ইবনুল আছ) উভয়ের মধ্যে মু‘আবিয়াহ
(রা.) ছিলেন উত্তম ব্যক্তি, হে আমর! এরা ওদের এবং ওরা
এদের হত্যা করলে, আমি কাকে দিয়ে লোকের
সমস্যার সমাধান করব? তাদের নারীদের কে
তত্ত্বাবধান করবে? তাদের দুর্বল ও শিশুদের কে
রক্ষণাবেক্ষণ করবে? অতঃপর তিনি কুরায়শের বনু
আবদে শামস শাখার দু’ব্যক্তি আব্দুর রহমান বিন সামুরাহ ও
আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.)-কে হাসান (রা.)-এর নিকটে পাঠালেন। তিনি তাদের বললেন, তোমরা
উভয়ে এ ব্যক্তির নিকটে যাও এবং তাঁর নিকটে সন্ধির প্রস্তাব পেশ করো, তার
সঙ্গে আলোচনা কর ও তাঁর বক্তব্য জানতে চেষ্টা কর। তারা তাঁর নিকটে গেলেন এবং তাঁর
সঙ্গে কথা বললেন, আলাপ-আলোচনা করলেন এবং
তাঁর বক্তব্য জানলেন। হাসান ইবনু আলী (রা.) তাদের বললেন, আমরা
আব্দুল মুত্তালিবের সন্তান, এই সম্পদ আমরা পেয়েছি। আর
এরা রক্তপাতে লিপ্ত হয়েছে। তারা উভয়ে বললেন,
তিনি
(মু‘আবিয়াহ রা.) আপনার নিকটে এরূপ বক্তব্য পেশ করেছেন। আর আপনার
বক্তব্যও জানতে চেয়েছেন ও সন্ধি কামনা করেছেন। তিনি বললেন, এ
দায়িত্ব কে নেবে? তারা বললেন, আমরা
এ দায়িত্ব নিচ্ছি। অতঃপর তিনি তাঁর সঙ্গে সন্ধি করলেন। হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, আমি
আবূ বাকরাহ (রা.)-কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে আমি
মিম্বরের উপর দেখেছি, হাসান বিন আলী (রা.) তাঁর
পাশে ছিলেন। তিনি একবার লোকদের দিকে আরেকবার তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘আমার এ সন্তান একজন নেতা। সম্ভবত তার মাধ্যমে আল্লাহ
মুসলিমদের দু’টি বড় দলের মধ্যে মীমাংসা করাবেন’।[9]
সন্ধির পরে হাসান (রা.) দাঁড়িয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত
ভাষণে বললেন, ‘হে লোক সকল! আপনারা যদি
সুদূর জাবলাক নগরী ও জাবরাম নগরীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে এমন একজন পুরুষ লোক খোঁজেন যার
নানা স্বয়ং নবী করীম (সা.) তাহ’লে আমি ও আমার ভাই ছাড়া
কাউকে পাবেন না। এই মুহূর্তে আমরা মু‘আবিয়া (রা.)-এর প্রতি
আনুগত্য প্রকাশ করেছি। আমরা ভেবে দেখেছি যে,
মুসলমানদের
রক্তপাত ঘটানোর চাইতে রক্তপাত বন্ধ করা কল্যাণকর। তবে আমি জানি না এটি আপনাদের
জন্যে পরীক্ষা এবং অল্পদিনের ভোগ-বিলাসও হ’তে পারে। এই কথায় তিনি
আমীর মু‘আবিয়া (রা.)-এর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। ফলে মু‘আবিয়া
(রা.) রেগে গেলেন এবং হাসান (রা.)-কে বললেন,
‘এর
দ্বারা আপনি কি বুঝাতে চেয়েছেন? উত্তরে হাসান (রা.) বললেন, ‘আমি এর দ্বারা তা-ই বুঝাতে চেয়েছি আল্লাহ যা বুঝিয়েছেন’।[10] অন্যত্র এসেছে, তিনি
বলেন,فإن أكيسَ الكيس التُّقى، وأحمق الحمق الفجور، وإن
هذا الأمر الذي اختلفت فيه أنا ومعاوية، إما أن يكون حق امرئ فهو أحقُّ به مني،
وإما أن يكون حقًّا هو لي، فقد تركته إرادةَ إصلاح الأمة وحقن دمائها، ثم التفت
إلى معاوية، فقال ‘নিশ্চয়ই
সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা হচ্ছে আল্লাহভীতি এবং সর্বোচ্চ নির্বুদ্ধিতা হচ্ছে পাপাচার। আর এ
বিষয় যা নিয়ে আমার ও মু‘আবিয়ার মাঝে মতভেদ রয়েছে, আমি
এ বিষয়ে হকদার হ’লেও তিনি আমার চেয়ে অধিক হকদার। আর এটা আমার
হক হ’লেও উম্মতের কল্যাণ এবং তাদের রক্তপাত বন্ধ করার জন্য আমি
তা ত্যাগ করলাম’। অতঃপর তিনি মু‘আবিয়া
(রা.)-এর দিকে ফিরে বললেন,وَإِنْ أَدْرِي لَعَلَّهُ
فِتْنَةٌ لَكُمْ وَمَتَاعٌ إِلَى حِينٍ ‘আমি জানি না হয়ত বিলম্বের
মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে পরীক্ষা এবং রয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগের
সুযোগ’ (আম্বিয়া ২১/১১১)।[11]
অন্যত্র এসেছে,
মু‘আবিয়া
(রা.) হাসান (রা.)-কে ভাষণ দেওয়ার অনুরোধ করলেন। হাসান (রা.) ভাষণ দানের জন্য
দাঁড়ালেন। ভাষণে তিনি আল্লাহর প্রশংসা,
গুণগান
ও রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রতি দরূদ পাঠের পর বললেন, হে
জনগণ! আমাদের প্রথম ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদ (সা.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ আপনাদেরকে সত্য
পথের দিশা দিয়েছেন। আর আমাদের শেষ ব্যক্তি (হাসান, নিজের
প্রতি ইঙ্গিত করেন) দ্বারা আপনাদেরকে রক্তপাত থেকে রক্ষা করেছেন। শাসন ক্ষমতার
একটি মেয়াদ নির্ধারিত রয়েছে। আর দুনিয়া হ’ল কূপ থেকে পানি তোলার
বালতি সদৃশ। কখনো এর হাতে কখনো ওর হাতে। আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেছেন,وَإِنْ أَدْرِي لَعَلَّهُ فِتْنَةٌ لَكُمْ وَمَتَاعٌ إِلَى حِينٍ ‘আমি জানি না হয়ত বিলম্বের মধ্যে তোমাদের জন্য
রয়েছে পরীক্ষা এবং রয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগের সুযোগ’ (আম্বিয়া ২১/১১১)।[12]
খেলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তরের কারণ সম্পর্কে হাসান (রা.)-এর
বক্তব্য স্পষ্ট ছিল। হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) উল্লেখ করেন, মুহাম্মাদ
ইবনু সা‘দ আলী ইবনে মুহাম্মাদ যায়দ ইব‡ন আসলাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি
বলেছেন, হাসান (রা.)-এর নিকট এক লোক উপস্থিত হ’ল।
তিনি তখন মদীনাতে অবস্থান করছিলেন। তাঁর হাতে ছিল ছোট্ট একটি পুস্তিকা। লোকটি
তাঁকে জিজ্ঞেস করল, এটি কি? উত্তরে
হাসান (রা.) বললেন, মু‘আবিয়া
(রা.)-এর পুত্র এই পত্রের মাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে সীমালংঘন করতে চায় ও আমাকে ভয়
দেখায়। লোকটি বলল, আপনি অর্ধেক রাজত্বের
মালিক। হাসান (রা.) বললেন, হ্যাঁ, তা
বটে। তবে আমি এই ভয় করেছিলাম যে, ৭০/৮০ হাযার লোক যদি
রক্তক্ষরণ নিয়ে কিংবা ৭০/৮০ হাযারের চাইতে কম বা বেশী ক্বিয়ামতের দিন উপস্থিত হয়
এবং আল্লাহর দরবারে তাদের রক্তপাতের কারণ জানতে চায়, এজন্যে
খেলাফত ত্যাগ করে রক্তপাত বন্ধ করেছি।[13] মু‘আবিয়া (রা.) ৪১ হিজরীর
রবীউল আউয়াল মাসে মুসলিম জাহানের খলীফা নির্বাচিত হন এবং প্রায় বিশ বছর তাঁর
নেতৃত্বে ইসলামী শাসন পরিচালিত হয়।[14] ইবনু আব্দিল বার্র (রহঃ) বলেন, হাসান
(রা.) ৪১ হিজরীর জুমাদাল উলা মাসের মাঝামাঝিতে মু‘আবিয়া
(রা.)-এর নিকটে খেলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। তখন মু‘আবিয়া
(রা.)-এর বয়স হয়েছিল ২ মাস কম ৪৬ বছর।[15]
হাসান (রা.) ইসলামের পঞ্চম খলীফা :
হাসান (রা.)-এর খেলাফতকাল অতি অল্প সময়ের জন্য হ’লেও
তিনিই ইসলামের পঞ্চম খলীফা হিসাবে পরিগণিত হন। কেননা নবী করীম (সা.)-এর উক্তি,الخِلَافَةُ فِي أُمَّتِي ثَلَاثُونَ سَنَةً ‘আমার
উম্মাতের খেলাফতের সময়কাল (শাসনকাল) হবে ত্রিশ বছর’।[16] আর এই ত্রিশ বছর পূর্ণ হয় হাসান (রা.)-এর
খেলাফতের মাধ্যমে। এজন্য তাকে ইসলামের পঞ্চম খলীফা হিসাবে গণ্য করা হয়।[17] ড. আলী আছ-ছাল্লাবী বলেন,وقد قرر جمع من أهل العلم عند شرحهم لقوله صلى الله عليه وسلم
الخِلَافَةُ فِي أُمَّتِي ثَلَاثُونَ سَنَةً أن الاشهر التي تولى فيها الحسن بن
على بعد موت أبيه كانت داخله في خلافة النبوة، ‘বিদ্বানগণের
একটি দল ‘আমার উম্মাতের খেলাফতের সময়কাল হবে ত্রিশ বছর’ এই
হাদীছের ব্যাখ্যায় স্বীকার করেন যে,
হাসান
(রা.) তাঁর পিতার পরে যে কয় মাস দায়িত্ব পালন করেছিল, তা
নবুওয়াতের খেলাফতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত’।[18] আবু বকর আল-আরাবী ও কাযী আয়ায (রহঃ), ইমাম
ত্বাহাবী, আল-মানাবী ও ইবনু হাজার
আল-হায়তামী (রহঃ)ও অনুরূপ বলেছেন। হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,وَالدَّلِيلُ عَلَى أَنَّهُ أَحَدُ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ
الْحَدِيثُ الَّذِي أَوْرَدْنَاهُ فِي دَلَائِلِ النُّبُوَّةِ، ‘দালাইলুন নবুওয়াত’ গ্রন্থে
আমরা যে হাদীছ উল্লেখ করেছি, সেটাই প্রমাণ তিনি (হাসান)
খুলাফায়ে রাশেদীনের অন্যতম ছিলেন’।[19]
উষ্ট্রের যুদ্ধে হাসান (রা.)-এর ভূমিকা :
৩৫ হিজরীর যিলহজ্জ মাসে ওছমান (রা.) বিদ্রোহীদের হাতে
শাহাদত বরণ করলে লোকেরা আলী (রা.)-এর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করে। বিদ্রোহীরাও
আলী (রা.)-এর হাতে বায়‘আত নেয়। আলী (রা.) প্রথমে রাষ্ট্রীয় শৃংখলা
ফিরিয়ে আনা এবং বিদ্রোহীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে
কিছুটা বিলম্ব করেন। এতে কেউ কেউ আলী (রা.)-এর প্রতি রুষ্ট হন। অন্যদিকে হজ্জের
মওসুম হওয়ায় রাসূল (সা.)-এর স্ত্রীগণ সহ বহু ছাহাবী হজ্জব্রত পালনে মক্কায় ছিলেন।
এভাবে চার মাস অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর ত্বালহা ও যুবায়ের (রা.) মক্কায় গমন করেন।
সেখানেই ওছমান হত্যার ক্বিছাছ (হত্যার বদলে হত্যা) গ্রহণের প্রস্ত্ততি নেওয়ার জন্য
বছরায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং আয়েশা (রা.), ত্বালহা, যুবায়ের
প্রমুখ ছাহাবী বছরার পথে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে আয়েশা (রা.) বছরার নিকটবর্তী ‘হাওআব’ (ماء الحوأب) নামক স্থানে পৌঁছলে কুকুর
ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। তখন রাসূল (সা.)-এর হাদীছ তাঁর স্মরণ হয়ে যায়। একদা তাঁকে
রাসূল (সা.) বলেন,كَيْفَ بِإِحْدَاكُنَّ
تَنْبَحُ عَلَيْهَا كِلاَبُ الْحَوْأَبِ، ‘তোমাদের
মধ্যকার একজনের অবস্থা কেমন হবে, যখন হাওআবের কুকুর তার
বিরুদ্ধে ঘেউ ঘেউ করবে’?[20] অন্যত্র তিনি বলেন,أَيَّتُكُنَّ صَاحِبَةُ الْجَمَلِ الْأَدْبَبِ، تَخْرُجُ
فَيَنْبَحُهَا كِلاَبُ حَوْأَبٍ، يُقْتَلُ عَنْ يَمِيْنِهَا وَعَنْ يَسَارِهَا
قَتْلَى كَثِيْرٌ، ثُمَّ تَنْجُو بَعْدَمَا كَادَتْ- ‘তোমাদের মধ্যে উটে আরোহণকারিণীর অবস্থা কি হবে, যখন
সে বের হবে? অতঃপর তার বিরুদ্ধে
হাওআবের কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করবে? তার ডানে ও বামে বহু মানুষ
নিহত হবে। এরপর কোন মতে সে প্রাণে রক্ষা পাবে’।[21] তখন আয়েশা (রা.) বাড়িতে ফিরে যাওয়ার মনস্থ
করলেন। এসময় যুবায়ের (রা.) বললেন, বরং আপনি সামনে অগ্রসর হন।
লোকেরা আপনাকে দেখে হয়তো সন্ধিতে চলে আসবে। আল্লাহ আপনার মাধ্যমে হয়তো বিবদমান দু’টি
দলের (আলী ও মু‘আবিয়ার) মধ্যে মীমাংসা করে দিবেন। তখন তিনি
সামনে অগ্রসর হন’।[22]
অন্যদিকে তাদের এই পদক্ষেপকে আলী (রা.) খেলাফতের অখন্ডতার
জন্য হুমকি মনে করেন এবং সেনাবাহিনী সহ বছরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। অনেক প্রসিদ্ধ
ছাহাবী তাঁর এই পদক্ষেপ থেকে নিজেদের দূরে রাখেন। এমনকি হাসান বিন আলী (রা.) স্বীয়
পিতাকে এ পদক্ষেপ থেকে ফিরানোর জন্য বহু চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। আব্দুল্লাহ ইবনু
আববাস (রা.) বলেন, আমরা উষ্ট্রের যুদ্ধে ৬০০
লোক বের হ’লাম। আমরা ‘রাবযাহ’ নামক
স্থালে পৌঁছলে হাসান (রা.) দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। তখন আলী (রা.) বললেন, কথা
বল, কুমারী মেয়েদের মত কান্না বন্ধ কর। তখন হাসান (রা.) বললেন, إني كنت أشرتُ عليك بالمقام؛ (أي: بعدم الخروج لقتال طلحة
والزبير)، وأنا أشيره الآن، ‘আমি আপনাকে এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম।
(অর্থাৎ ত্বালহা ও যুবায়েরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বের না হ’তে)।
এখনও আমি আপনাকে সেই দিকে ইশারা করছি’।[23]
এদিকে আলী (রা.) প্রথমে আয়েশা, ত্বালহা
ও যুবায়ের (রা.)-এর নিকটে কা‘কা‘ বিন
আমরকে মুসলমানদের একতা ও ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার আহবান জানিয়ে প্রেরণ করেন। এসময়
আয়েশা (রা.) জবাব দেন যে, আমরা মুসলমানদের মধ্যে
মীমাংসা করতে এসেছি। কা‘কা‘
বিন
আমর উক্ত সংবাদ আলী (রা.)-এর নিকট পেশ করলে তিনি খুশী হন। আয়েশা (রা.) আলীর নিকট
দূত পাঠিয়ে বলেন, আমরা যুদ্ধের জন্য আসিনি।
বরং মীমাংসার জন্য এসেছি। এরপর আলী (রা.) লোকদের শান্ত করতে বিভিন্ন ঘটনা স্মরণ
করিয়ে ভাষণ দেন। যাতে তিনি বলেন, আমরা আগামীকাল চলে যাব, ওছমান
হত্যায় যারা জড়িত তারা ব্যতীত সকলে আমাদের সাথে যাবে।
ফলে ফিৎনাবাজ আশতার,
শুরাইহ
বিন আওফা, আব্দুল্লাহ বিন সাবা ও
ওছমান হত্যার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আড়াই হাযার লোক ভীত হয়ে গোপন
চক্রান্তে লিপ্ত হয় (এদের মধ্যে কোন ছাহাবী ছিলেন না)। প্রথমে তারা আলী (রা.)-কে
হত্যার পরিকল্পনা করে। কিন্তু তা অসম্ভব দেখে অন্য ষড়যন্ত্র করে। রাত্রে যখন সবাই
ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তারা ত্বালহা ও
যুবায়ের (রা.)-এর বাহিনীর উপর হামলা করে এবং ফজরের পূর্বেই পালিয়ে যায়। এতে
ত্বালহা ও যুবায়ের (রা.) মনে করেন যে,
এটি
আলী (রা.)-এর বাহিনী করেছে। ফলে উভয় দলের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ বেধে যায়।
আয়েশা (রা.) যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য উটের উপর আরোহণ করে ময়দানে অবতীর্ণ হন। কিন্তু
খারেজীরা তাঁর বাহনের পায়ে তীর মারলে তিনি নীচে পড়ে যান। পরে তাঁকে নিরাপদ স্থানে
পাঠিয়ে দেওয়া হয়।[24]
এ যুদ্ধের মূল কারণ ছিল ওছমান হত্যার বিচার থেকে রক্ষা
পাওয়ার জন্য হত্যাকারীদের নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র। আয়েশা (রা.) এই অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধের
জন্য অনুতপ্ত হয়ে ইবনু ওমর (রা.)-কে বলেন,
হে
আবু আব্দুর রহমান! আপনি আমাকে উটের যুদ্ধে যেতে বাধা দেননি কেন? উত্তরে
তিনি বলেন, আপনার উপর এক ব্যক্তি
(ইবনু যুবায়ের) প্রভাব বিস্তার করেছিল,
এজন্য
কিছু বলিনি। তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আপনি নিষেধ
করলে আমি যেতাম না’।[25]
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
আয়েশা
(রা.) বলেন, আমার ইচ্ছা ছিল যে, আমাকে
আমার গৃহে রাসূল (সা.) ও পিতা আবু বকরের পাশে দাফন করা হবে। কিন্তু রাসূল (সা.)-এর
মৃত্যুর পর আমি একটি ঘটনা ঘটিয়েছি। সেজন্য তোমরা আমাকে রাসূল (সা.)-এর অন্য
স্ত্রীদের সাথে দাফন করবে। অতঃপর তাঁকে বাকী‘
কবরস্থানে
দাফন করা হয়।[26]
আলবানী (রহঃ) বলেন,
‘আমরা
এতে নিঃসন্দেহ যে, আয়েশা (রা.)-এর বের হওয়াটা
ভুল ছিল। আর এজন্য তিনি হাওআবে নবী করীম (সা.)-এর সতর্কবাণী স্মরণ হওয়ার পর ফিরে
যাওয়ার ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু যুবায়ের (রা.) ‘আল্লাহ আপনার মাধ্যমে হয়তো
বিবদমান দু’টি দলের (আলী ও মু‘আবিয়া)
মধ্যে মীমাংসা করে দিবেন’ একথা বলে তাঁকে ফিরে যেতে
বাধা দেন। আমরা নিঃসন্দেহ যে, তিনিও এ ব্যাপারে ভুলকারী
ছিলেন’।[27]
অপরদিকে আলী (রা.) যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বলেছিলেন, হায়
যদি আমি এর বিশ বছর পূর্বে মারা যেতাম![28] আলী (রা.) এজন্য অনুতপ্ত হন এবং বার বার আল্লাহর
কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।[29] অন্যদিকে যুবায়ের (রা.) যুদ্ধ ত্যাগ করে
উপত্যকায় চলে যান। তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় আমর বিন জুরমূয হত্যা করে। আলী (রা.)
জানতে পারলে দুঃখ করে বলেন, হে যুবায়েরের হত্যাকারী!
তুমি জাহান্নামের দুঃসংবাদ গ্রহণ কর।[30] আর ত্বালহা (রা.) জনৈক ব্যক্তির তীরের আঘাতে
নিহত হ’লে আলী (রা.) নিহতদের মধ্যে তাকে দেখতে পান। তখন তিনি তাঁর
মুখমন্ডল থেকে ময়লা সরাতে সরাতে বলেছিলেন,
হে
আবু মুহাম্মাদ! আপনার প্রতি আল্লাহর রহমত নাযিল হোক। আকাশের তারকারাজির নীচে
আপনাকে এ অবস্থায় দেখাটা আমার জন্য খুবই কষ্টকর’।[31]
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, আয়েশা
(রা.) যুদ্ধ করেননি এবং যুদ্ধ করার জন্য বেরও হননি। বরং তিনি মুসলমানদের মধ্যে
মীমাংসা করার জন্য বের হয়েছিলেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে, তার
বের হওয়াতে মুসলমানদের কল্যাণ রয়েছে। পরে তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁর
বের না হওয়াতেই কল্যাণ ছিল। সেজন্য উষ্ট্রের যুদ্ধে গমণের কথা স্মরণ হ’লে
তিনি এত বেশী কাঁদতেন যে, তাঁর ওড়না ভিজে
যেত।...অনুরূপভাবে ত্বালহা, যুবায়ের ও আলী (রা.) এই
অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধের জন্য অনুতপ্ত হন। কারণ এটি তাঁদের কারোরই এখতিয়ারাধীন ছিল না (মিনহাজুস সুন্নাহ ১/২২৮)।[32]
স্মর্তব্য যে,
ছাহাবায়ে
কেরামের মতভেদপূর্ণ বিষয়ে চুপ থাকাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের
নীতি। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন, আমার ছাহাবীদের ব্যাপারে
তোমরা চুপ থাকো।[33] ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, আহলে
সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা হ’ল, তারা
ছাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে তাদের হৃদয় ও জিহবাকে সংযত রাখেন এবং তাদের মাঝে
মতভেদগত বিষয়ে চুপ থাকেন।[34]
ছিফ্ফীনের যুদ্ধে হাসান (রা.)-এর ভূমিকা :
৩৭ হিজরীতে সংগঠিত ছিফফীন যুদ্ধেরও মূল কারণ ছিল ওছমান (রা.)-এর
হত্যাকারী বিদ্রোহীদের গভীর ষড়যন্ত্র। ৩৫ হিজরীর যিলহজ্জ মাসে ওছমান (রা.) শাহাদত
বরণ করলে লোকেরা আলী (রা.)-এর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করে। বিদ্রোহীরাও
আলী (রা.)-এর হাতে বায়‘আত নেয়। আলী (রা.) প্রথমে রাষ্ট্রীয় শৃংখলা
ফিরিয়ে আনার জন্য এবং বিদ্রোহীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে বাধ্য হয়ে তাদের বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নিতে কিছুটা বিলম্ব করেন। এতে ওছমান (রা.)-এর চাচাতো ভাই সিরিয়ার আমীর মু‘আবিয়া
(রা.) ও তার সাথীরা তাঁর প্রতি রুষ্ট হন। যদিও মু‘আবিয়া
আলী (রা.)-এর শ্রেষ্ঠত্বকে দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করতেন। কিন্তু তিনি ওছমান (রা.)-এর
হত্যাকারীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত বায়‘আত করতে অস্বীকার করেন।
ফলে আলী (রা.) ও মু‘আবিয়া (রা.)-এর মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে
ওঠে।
আলী (রা.)-এর খেলাফত ছিল সর্বসম্মত। আর কারো অবাধ্যতার জন্য
খেলাফত ত্যাগ করা হাদীছ সম্মত নয়। কেননা তাতে খেলাফতের ঐক্য বিনষ্ট হয়। যেমন ওছমান
(রা.)-এর প্রতি অছিয়ত করে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, ‘হয়তো আল্লাহ তোমাকে একটি জামা পরিধান করাবেন। পরে যদি
লোকেরা তোমার সেই জামাটি খুলে নিতে চায়,
তখন
তুমি তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী জামাটি খুলে ফেলো না’।[35] এখানে জামাটি অর্থ খেলাফত।[36]
অতঃপর ৩৭ হিজরীর ছফর মাসে ছিফফীন যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাবেঈ
বিদ্বান মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (৩৩-১১০ হি.)-এর ধারণা মতে, তিন
দিন তিন রাতের এই যুদ্ধে ৭০ হাযার মুসলমান নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুর রহমান
বিন আবযী বলেন, লোকেরা ধারণা করে যে, ৭০
হাযারের মধ্যে ৪৫ হাযার সিরীয় পক্ষে এবং ২৫ হাযার ইরাকীদের পক্ষে নিহত হন।[37] নিঃসন্দেহে এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে একটি মহা
বিপর্যয়কর ঘটনা।
ছিফ্ফীনের যুদ্ধে হাসান (রা.)-এর ভূমিকা প্রসঙ্গে ড. আলী
আছ-ছাল্লাবী বলেন,كان موقف الحسن بن علي رضي
الله عنه هو موقف أهل السنة والجماعة من الحرب التي وقعت بين الصحابة الكرام رضي
الله عنهم وهو الإمساك عما شجر بينهم إلا فيما يليق بهم رضي الله عنهم، ‘হাসান (রা.)-এর অবস্থান ছিল অনুরূপ যেরূপ
ছাহাবীগণের মধ্যে সংগঠিত যুদ্ধের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের
অবস্থান ছিল। সেটা হ’ল- যে বিষয়ে তাঁরা মতবিরোধ করেছেন, সে
ব্যাপারে নীরব থাকা। তবে যে বিষয়ে তাঁরা যথার্থ ছিলেন’।[38]
তিনি আরো বলেন,مسلك الفرقة الناجية أهل السنة
والجماعة والذين من أئمتهم وسادتهم أمير المؤمنين علي وابنيه الحسن والحسين وهو
الإمساك عما حصل بينهم رضي الله عنه ولا يخوض فيه إلا بما هو لائق بمقامهم،. ‘ফিরক্বা নাজিয়াহ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত
ও তাদের ইমাম ও নেতা আমীরুল মুমিনীন আলী ও তদীয় দু’পুত্র
হাসান-হুসাইন (রা.)-এর মাসলাক ছিল তাদের (ছাহাবীগণের) মাঝে সংগঠিত বিষয়ে নীরব
থাকা। আর তাতে লিপ্ত না হওয়া, কিন্তু তাদের শানে যা
উপযুক্ত’।[39]
মোদ্দাকথা অনেক ছাহাবী ওছমান হত্যার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া
হয়ে উঠেন। কারণ তারা ভেবেছিলেন যে,
ওছমানের
পক্ষ হওয়ায় তারা হেদায়াতের উপর আছেন। কিন্তু এজন্য আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র
যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া তাঁদের সঠিক হয়নি। কেননা এ সময় খলীফা ছিলেন আলী (রা.)। সর্বাগ্রে তাঁর প্রতি শর্তহীন আনুগত্য
অপরিহার্য ছিল। তাছাড়া ওছমান (রা.) নিজে স্বীয় খেলাফত বা জীবন রক্ষার জন্য যুদ্ধ
করেননি এবং অন্যদের অনুমতি দেননি। আর হত্যায় উদ্যত ব্যক্তির বিরুদ্ধে করণীয় কি হবে, সা‘দ
বিন আবী ওয়াকক্বাছ (রা.)-এর এমন এক প্রশ্নের উত্তরে রাসূল (সা.) বলেছিলেন, তুমি
আদমের উত্তম সন্তানটির মত হও’।[40] ফিৎনার সময় করণীয় কি হবে, এমন
প্রশ্নের উত্তরেও রাসূল (সা.) একই কথা বলেছিলেন।[41] এজন্য বহু ছাহাবী যুদ্ধ হ’তে
বিরত ছিলেন। [ক্রমশঃ]
[1]. আবূদাউদ হা/৪৬৪৬;
তিরমিযী
হা/২২২৬; ছহীহাহ হা/৪৫৯।
[2]. ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইস্তী‘আব, ১/৩৮৫ পৃঃ।
[3]. হুসাইন ইবনু মুহাম্মাদ
ইবনে হাসান আদ-দাইয়ার আল-বাকরী (মৃঃ ৯৬৬হিঃ), তারীখুল খামীস ফী আহওয়ালে আনফুসিন নাফীস, (বৈরূত : দারু ছাদির, তাবি),
২/২৯০; আবুল ফারজ আলী ইবনু ইবরাহীম ইবনে আহমাদ আল-হালাবী (মৃঃ
১০৪৪হিঃ), আস-সীরাতুল হালাবিয়া, (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ২য় প্রকাশ,
১৪২৭
হিঃ), ৩/৪০৫।
[4]. ইবনু আসাকির (মৃত্যু ৫৭১হিঃ), তারীখু দিমাশক,
১৩/৩০৩
পৃঃ।
[5]. আল-ইস্তী‘আব, ১/৩৮৭ পৃঃ।
[6]. আবূদাঊদ হা/৪৬৪৬, তিরমিযী হা/২২২৬;
মিশকাত
হা/৫৩৯৫।
[7]. হাকেম হা/৪৮০৮।
[8]. বুখারী হা/২৭০৪, মিশকাত হা/৬১৩৫।
[9]. বুখারী হা/২৭০৪, ৩৬২৯,
৩৭৪৬, ৭১০৯।
[10]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ
৮/৪৬ পৃঃ।
[11]. আবু নু‘আইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া ২/৩৮; আল-ইস্তী‘আব ১/৩৮৮ পৃঃ।
[12]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ
৮/২০ পৃঃ।
[13]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ
৮/৪৬ পৃঃ।
[14]. বিস্তারিত দ্রঃ আল-বিদায়াহ
ওয়ান নিহায়াহ ৮/১৬-১৮, ইবনুল আছীর, কামেল ফিত তারীখ ৩/৫-৮।
[15]. আল-ইস্তী‘আব ১/৩৮৭ পৃঃ।
[16]. তিরমিযী হা/২২২৬; আবু দাউদ হা/৪৬৪৬-৪৭; ছহীহাহ হা/৪৫৯;
ছহীহুল
জামে‘ হা/৩২৫৭।
[17]. ড. আলী মুহাম্মাদ আছ-ছাল্লাবী, আমীরুল মুমিনীন হাসান ইবনু
আলী ইবনে আবী তালেব: শাখছিয়াতুহু ওয়া আছরুহ, (মিশর : দারুত তাওযী‘ ওয়ান নাশর আল-ইসলামী, ১ম প্রকাশ ১৪২৫ হিঃ/২০০৪ খ্রিঃ), পৃঃ ২০৩।
[18]. আমীরুল মুমিনীন হাসান ইবনু
আলী ইবনে আবী তালেব: হায়াতুহু ওয়া আছরুহ, পৃঃ ২০৩।
[19]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ
৮/১৬-১৭, ১১/১৩৪ পৃঃ।
[20]. হাকেম হা/৪৬১৩; আহমাদ হা/২৪২৯৯;
ছহীহাহ
হা/৪৭৪।
[21]. মুসনাদে বাযযার হা/৪৭৭৭; মাজমাঊয যাওয়ায়েদ হা/১২০২৬, সনদ ছহীহ।
[22]. হাকেম হা/৪৬১৩; আহমাদ হা/২৪২৯৯;
ছহীহাহ
হা/৪৭৪।
[23]. ইবনু সা‘দ, আত-ত্বাবাকাতু কুবরা, ১/২৭৩-৭৪ পৃঃ।
[24]. আল-বিদায়াহ ৭/২২৯-২৪০।
[25]. যায়লাঈ, নাছবুর রায়াহ ৪/৭০; আল-ইস্তী‘আব ১/২৭৫; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/১৯৩, ৩/২১১;
ছহীহাহ
হা/৪৭৪-এর আলোচনা দ্রঃ।
[26]. হাকেম হা/৬৭১৭; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/১৯৩, সনদ ছহীহ।
[27]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৪৭৪-এর
আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[28]. হাকেম হা/৪৫৫৭; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৫৯৯০, সনদ ছহীহ।
[29]. আল-ইস্তী‘আব ১/২৯২।
[30]. হাকেম হা/৫৫৮০; আহমাদ হা/৭৯৯,
সনদ
হাসান।
[31]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ
৭/২৪৭।
[32]. বিস্তারিত দ্রঃ সিলসিলা
ছহীহাহ হা/৪৭৪-এর আলোচনা; ইবনুল ‘আরাবী,
আল-‘আওয়াছিম মিনাল ক্বাওয়াছিম ১/১৫৬-১৬২; সায়ফ বিন ওমর আসাদী, আল-ফিৎনাতু ওয়া ওয়াক্ব‘আতুল জামাল;
ড.
আকরাম যিয়া উমরী, ‘আছরুল খিলাফাতির রাশেদাহ
পৃ. ৪৫০-৪৬১।
[33]. ত্বাবারাণী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৪।
[34]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/১৫৪-৫৫।
[35]. তিরমিযী হা/৩৭০৫; ইবনু মাজাহ হা/১১২; মিশকাত হা/৬০৬৮।
[36]. মোল্লা আলী ক্বারী (মৃত্যু ১০১৪হিঃ), মিরক্বাতুল মাফাতীহ শরহু
মিশকাতুল মাছাবীহ (বৈরূত : দারুল ফিকর,
১ম
প্রকাশ, ১৪২২হিঃ/২০০২ খ্রিঃ), ৯/৩৯২৪।
[37]. আকরাম যিয়া আল-উমরী, ‘আছরুল খিলাফাহ পৃ. ৪৭১-৭২।
[38]. আমীরুল মুমিনীন হাসান ইবনু
আলী ইবনে আবী তালেব, পৃঃ ১৭৯; আক্বীদাতু আহলিস সুন্নাহ ফিছ ছাহাবাতি, ২/৭২৭।
[39]. আমীরুল মুমিনীন হাসান ইবনু
আলী ইবনে আবী তালেব, পৃঃ ১৭৯।
[40]. আবুদাঊদ হা/৪২৫৭।
[41]. আবুদাঊদ হা/৪২৫৯; মিশকাত হা/৫৩৯৯।
রোগশয্যায় হাসান (রা.) :
আবুবকর ইবনু আবিদ দুনিয়া আব্দুর রহমান ইবনু সালিম
আতিকী...উমায়র ইবনু ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন,
তিনি
বলেন, دخلتُ أنا ورجل آخر مِن قريش على الحسن بن علي، فقام
فدخل إلى الخلاء، ثم خرج، فقال: لقد لفظتُ طائفةً (قطعة) مِن كَبِدي أقلبها بهذا
العود، ولقد سُقِيتُ السَّمَّ مرارًا، وما سُقيتُ مرةً هي أشد مِن هذه، قال: وجعل
يقول لذلك الرجل: سَلْني قبل ألا تَسْأَلَني، فقال: ما أسألك شيئًا، يعافيك الله؛ ‘আমি ও একজন কুরায়শ বংশীয় লোক একদিন হাসান
ইবনু আলী (রা.)-এর নিকট গেলাম। আমাদেরকে দেখে তিনি উঠে শৌচাগারে গিয়ে (প্রয়োজন
সেরে) সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন। অতঃপর বললেন,
‘আমি
আমার কলিজার কিছু অংশ এখন ফেলে এলাম। এই কাঠি দিয়ে আমি সেটি নেড়ে নেড়ে দেখে এলাম।
আমাকে বহুবার বিষ পান করানো হয়েছে। কিন্তু এবারের বিষ পান করানো ছিল সবচেয়ে কঠিন।
তখন হাসান (রা.) ঐ কুরায়শী লোকটিকে বলতে লাগলেন, ‘আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ হারিয়ে ফেলার আগে যা জিজ্ঞেস
করার জিজ্ঞেস করে নাও’। লোকটি বলল, ‘এখন আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করব না। আল্লাহ্ আপনাকে সুস্থ
করে তুলুন’।[1] বর্ণনাকারী বলেন, তারপর
আমরা তাঁর নিকট থেকে বিদায় নিলাম। পরদিন আমরা তাঁর নিকট গেলাম। তখন তিনি ছিলেন
মুমূর্ষু অবস্থায়, তাঁর প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাঁর ভাই
হুসায়ন (রা.) এসে তাঁর মাথার নিকটে বসে বললেন,
‘ভাইজান!
কে আপনাকে বিষ পান করিয়েছে? হাসান (রা.) বললেন, ‘তুমি কি তাঁকে হত্যা করতে চাও? হুসায়ন
(রা.) বললেন, হ্যাঁ। হাসান (রা.) বললেন,لَئِنْ كَانَ صَاحِبَيِ الَّذِي أَظُنُّ للَّه أَشَدُّ نِقْمَةً.
وَفِي رِوَايَةٍ: فالله أَشَدُّ بَأْسًا وَأَشَدُّ تَنْكِيلًا، وَإِنْ لَمْ
يَكُنْهُ مَا أُحِبُّ أَنْ تَقْتُلَ بِي بَرِيئًا. ‘আমি যাকে সন্দেহ করি সে-ই যদি প্রকৃত শত্রু হয়ে থাকে (বিষ
পান করিয়ে থাকে) তাহ’লে আল্লাহ্ই তার কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা
করবেন। অপর বর্ণনায় আছে, তবে আল্লাহ শক্তিতে
প্রবলতর ও শাস্তিদানে কঠোরতর। আর যদি আমি যাকে সন্দেহ করি সে প্রকৃত দোষী না হয়, তাহ’লে
আমার কারণে তুমি একজন নির্দোষ মানুষকে হত্যা করবে তা আমি চাই না’।[2]
মুহাম্মাদ ইবনু ওমর আল-ওয়াকিদী বলেন, আব্দুল্লাহ
ইবনু জা‘ফর উম্মু বকর বিনতু মিসওয়ার থেকে বর্ণনা করেন, তিনি
বলেন, হাসান (রা.)-কে কয়েকবার বিষ পান করানো হয়েছে। প্রতিবারই
তিনি রক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু শেষবারে তিনি আর রক্ষা পেলেন না, মারা
গেলেন। তখন বিষক্রিয়ায় তাঁর কলিজা ছিঁড়ে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ওয়াক্বিদী আরো
বলেন, কথিত আছে যে,
তাঁকে
বিষ পান করানো হয়েছিল তাতে তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে আবার বিষ পান করোনো
হয়েছিল, তিনি আবার রক্ষা পেয়েছিলেন। এরপর তৃতীয়বার তাঁকে বিষ পান
করানো হয়েছিল এবং সেবার তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[3]
তাঁর মৃত্যু যখন খুব নিকটে তখন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বলেছিলেন, বিষে
তাঁর নাড়ি-ভুঁড়ি ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। এ চিকিসৎক তখন বারবার হাসান (রা.)-কে দেখতে
আসতেন। এক পর্যায়ে হুসায়ন (রা.) বললেন,
‘ভাই
আবূ মুহাম্মাদ! আপনি আমাকে বলে দিন,
কে
আপনাকে বিষ পান করিয়েছে? হাসান (রা.) বললেন, কেন
ভাই! তুমি কি করবে? হুসায়ন (রা.) বললেন, আমি
আপনাকে দাফন করার আগে তাকে হত্যা করব। এখনি তাকে ধরতে না পারলে সে এমন কোন স্থানে
চলে যেতে পারে যেখানে তাকে আর ধরা যাবে না। হাসান (রা.) বললেন, ভাই!
দুনিয়াতো কয়েক দিনের সংসার! এটি ধ্বংসশীল। ওকে ছেড়ে দাও। আমি ও সে উভয়েতো আল্লাহর
সম্মুখে উপস্থিত হব। হাসান (রা.) ঐ দোষী ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেননি।
মুহাম্মাদ ইবনু সা‘দ বলেন, ইয়াহইয়া
ইবনু হাম্মাল...উম্মু মূসা থেকে বর্ণনা করেছেন, জা‘দা
বিনতু আশ‘আছ ইবনে ক্বায়েস হাসান (রা.)-কে বিষ পান
করিয়েছিলেন। তাতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
সুফিয়ান ইবনু উয়ায়না রাক্বাবাহ ইবনে মুছক্বালাহ থেকে বর্ণনা
করেন, তিনি বলেন, হাসান (রা.) যখন মৃত্যু
পথযাত্রী তখন তিনি বললেন, তোমরা আমাকে উঠানে নিয়ে
যাও, আমি আল্লাহর এই বিশাল জগত দেখে নিই। তারা বিছানাসহ তাঁকে
উঠানে নিয়ে আসল। তিনি উপরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘হে
আল্লাহ! আমি আমার প্রাণ বিসর্জনের বিনিময়ে আপনার নিকট ছওয়াব কামনা করছি। কারণ আমার
এই প্রাণ আমার অত্যন্ত প্রিয় বস্তু। বর্ণনাকারী বলেন, বস্তুত
মহান আল্লাহ তাঁর যে পরিণতি ঘটালেন তার বিনিময়ে তিনি আল্লাহর নিকট ছওয়াব কামনা
করলেন।[4]
আবূ নু‘আয়ম বলেছেন, হাসান
(রা.)-এর বেদনা যখন বেড়ে গেল তখন তিনি খুব অস্থির হয়ে পড়লেন। তখন একজন লোক তাঁর
নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, ‘হে আবূ মুহাম্মাদ! এত
অস্থিরতা কেন? এখন শুধু এতটুকু হবে যে, আপনার
দেহ থেকে প্রাণ পৃথক হবে আর তারপর আপনি পৌঁছে যাবেন আপনার পিতা-মাতা আলী ও ফাতিমা
(রা.)-এর নিকটে, আপনার মামা আল-কাসেম, ত্বাইয়েব
ও ইবরাহীম (রা.)-এর নিকটে, আপনার নানা-নানী নবী করীম
(সা.) ও খাদীজা (রা.)-এর নিকটে। আপনার চাচা হামযাহ ও জা‘ফর
(রা.)-এর নিকটে, আপনার খালা রুকাইয়া, উম্মু
কুলছূম ও যায়নাব (রা.)-এর নিকটে। বর্ণনাকারী বলেন, এ
কথা শুনে হাসান (রা.) সম্বিৎ ফিরে পেলেন এবং সুস্থির হয়ে উঠলেন।[5]
বিষ প্রয়োগে হত্যার সন্দেহ ও তার খন্ডন :
হাসান (রা.) কিভাবে মারা গেছেন, তার
সঠিক তথ্য কোন ছহীহ সূত্রে পাওয়া যায় না। তবে হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ)
বলেন, বলা হয়ে থাকে যে,
তিনি
বিষপানে মারা গেছেন। উমায়ের ইবনু ইসহাক বলেন,
আমি
এক সাথীকে নিয়ে হাসান (রা.)-এর নিকটে গেলাম। তখন তিনি বললেন, আমাকে
একাধিকবার বিষ পান করানো হয়েছে। কিন্তু এত বিষাক্ত বস্ত্ত ইতিপূর্বে কখনও পান
করিনি। এরই মধ্যে তার ভাই হুসাইন সেখানে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কে
আপনাকে বিষ পান করিয়েছে? তিনি সেটা বলতে অস্বীকার
করলেন।[6] ক্বাতাদা থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে।[7]
বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, মু‘আবিয়া
(রা.) বা তাঁর ছেলে ইয়াযীদের নির্দেশনায় হাসান (রা.)-এর স্ত্রী তাঁকে বিষ পান
করিয়েছিলেন। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,
এগুলি
অশুদ্ধ ও ভিত্তিহীন।[8] শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, মু‘আবিয়া
(রা.) হাসান (রা.)-কে বিষ পান করিয়ে হত্যা করেছেন মর্মে কিছু লোক যা বলে থাকে, তা
কোন দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। অতএব এ ব্যাপারে কিছু বলা না জেনে বলার ন্যায় হবে।[9] অন্যত্র তিনি আরো বলেন,فيما تزعمه الشيعة من أن معاوية سم الحسن: لم يثبت ذلك ببينة
شرعية، ولا إقرار معتبر، ولا نقل يجزم به، وهذا مما لا يمكن العلم به، فالقول به
قول بلا علم، ‘এ ব্যাপারে শী‘আরা
ধারণা করে যে, মু‘আবিয়া
(রা.) হাসান (রা.)-কে বিষ প্রয়োগ করেছিলেন। এটা কোন শারঈ দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়, কোন
নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি কর্তৃক স্বীকৃত নয় এবং নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংকলিত নয়। আর এটা
এমন বিষয় যে সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান অর্জিত হয় না। সুতরাং এ ব্যাপারে কিছু বলা
অজ্ঞতা প্রসুত কথার ন্যায়’।[10]
হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী (রহঃ) বলেন, আমি
বলব, আমার গবেষণায় এটা (বিষ প্রয়োগের ঘটনা) বিশুদ্ধ নয়।[11] ইবনু খালদূন (রহঃ) বলেন, এটা
শী‘আদের প্রচারণা।[12]
আবুবকর আল-আরাবী (রহঃ) বলেন,فإن قيل : قد دس يعني معاوية على الحسن من سمه؟ قلنا هذا محال من
وجهين، أحدهما : أنه ما كان ليتقي من الحسن بأسًا، وقد سلم الأمر. الثاني : أنه
أمر مغيب لا يعلمه إلا الله، فكيف تحملونه- بغير بينة- على أحد من خلقه، في زمان
متباعد لم نثق فيه بنقل ناقل، بين أيدي قوم ذوي أهواء، وفي حال فتنة وعصبية، ينسب
كل واحد إلى صاحبه ما لا ينبغي، فلا يقبل منها إلا الصافي، ولا يسمع فيها إلا من
العدل المصمم.
‘যদি বলা হয়, মু‘আবিয়া
(রা.) হাসান বিন আলী (রা.)-কে বিষ প্রয়োগ করেছিলেন। আমরা বলব যে, এটা
দু’টি দিক দিয়ে অসম্ভব। ১. তিনি হাসান (রা.)-এর পক্ষ থেকে কোন
ক্ষতির আশংকা করতেন না। আর বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল। ২. এটা ছিল গায়েবের বিষয়, যা
আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানেন না। সুতরাং প্রমাণ ছাড়া বিষয়টি আল্লাহর সৃষ্টির কারো উপরে
কিভাবে আরোপ করা যেতে পারে, এমন দূরবর্তী সময়ের ঘটনার
ব্যাপারে, যা নির্ভরযোগ্য কোন সংকলক
সংকলন করেননি? যখন গোলযোগপূর্ণ ও
দলপ্রীতির অবস্থা বিরাজ করছিল। সে সময় একজন অপরজনের প্রতি অবাঞ্ছিত বিষয় আরোপ করত।
সুতরাং নিরেট নির্ভেজাল ব্যক্তি ব্যতীত কারো নিকট থেকে ঐসব গ্রহণ করা যাবে না। আর
এ ব্যাপারে ন্যায়নীতির উপরে দৃঢ় ব্যক্তি ব্যতিরেকে কারো নিকট থেকে কিছু শ্রবণ করাও
যাবে না।[13]
শায়খ ওছমান আল-খুমাইস বলেন,المشهور أن الحسن مات مسموما، لكن لا يعلم إلى اليوم من الذي وضع
له السم، الله أعلم، ولعل الراجح أنه مات كما يموت الناس موتا عاديالم يسمّه أحد، ‘প্রসিদ্ধ আছে যে, হাসান
(রা.) বিষ প্রয়োগে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত জানা যায়নি যে, কে
তাকে বিষ প্রয়োগ করেছে। আল্লাহ অধিক জ্ঞাত। অগ্রাধিকারযোগ্য কথা হ’ল
তিনি স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন,
যেভাবে
মানুষ মারা যায়। কেউ তাকে বিষ প্রয়োগ করেনি’।[14] তাছাড়া হাসান (রা.) মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন।
সে সময় মু‘আবিয়া (রা.) সিরিয়ায় অবস্থান করছিলেন। অতএব
মু‘আবিয়া (রা.) হাসানের স্ত্রীকে বিষ প্রয়োগের জন্য
পাঠিয়েছিলেন, এটা ধারণাকারীর ধারণা
মাত্র।[15] হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, আমার
মতে, এই বর্ণনা (ইয়াযীদের ইঙ্গিতে জা‘দা
বিনতু আশ‘আছ কর্তৃক বিষ পান করানোর ঘটনা) সঠিক নয়। আর
মু‘আবিয়া (রা.)-এর ইশারায় বিষ পান করানোর বর্ণনা বিশুদ্ধ না
হওয়াটা তো অধিকতর সুস্পষ্ট।[16] সুতরাং বিষপানে তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি যেমন
প্রমাণিত নয়, তেমনি কে তাঁকে বিষ পান
করিয়েছে, তা অজ্ঞাত। তাই এ বিষয়ে
নীরব থাকাই শ্রেয়।
মৃত্যু তারিখ :
হাসান (রা.) ৪০ দিন অসুস্থ ছিলেন। অতঃপর তিনি ৪৫ বৎসর ৬ মাস
কিছু দিন বয়সে ৫ রবীউল আউয়াল ৪৯ হিজরীতে মদীনা মুনাওয়ারায় মৃত্যুবরণ করেন।
বাক্বীউল গারক্বাদ কবরস্থানে ফাতেমাতুয যাহরা (রা.)-এর কবরের পাশেই তাঁকে দাফন করা
হয়।[17]
তাকীউদ্দীন মাক্বরীযী (মৃত্যু ৮৪৫হিঃ) বলেন, ومات الحسن بالمدينة في ربيع الأول سنة خمس، وقيل: في سنة تسع
وأربعين، وقيل سنة إحدى وخمسين، ودفن بالبقيع، ... وكان سنة يوم مات ستا وأربعين
سنة، وقيل: سبعا وأربعين سنة. ‘হাসান (রা.) রবীউল আউয়াল
মাসে মদীনায় ৪৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। বলা হয়, ৪৯
মতান্তরে ৫১ হিজরীতে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকে বাক্বীউল গারক্বাদে দাফন করা হয়। ...
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৬ মতান্তরে ৪৭ বছর’।[18]
আল্লামা ইবনু হাজার হায়তামী মাক্কী (রহঃ) বর্ণনা করেন, হাসান
(রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় ছিলেন ৭ বছর এবং পিতা আলী (রা.)-এর সাথে ৩০
বৎসর। ৬ মাস খলীফাতুল মুসলিমীন ছিলেন,
তারপর
সাড়ে ৯ বছর মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থান করে আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন।[19]
ইয়া‘কূব ইবনু সুফিয়ান বলেন, মুহাম্মাদ
ইবনু ইয়াহইয়া বর্ণনা করেন যে, সুফিয়ান জা‘ফর
ইবনু মুহাম্মাদের পিতা থেকে বর্ণনা করেন,
তিনি
বলেন, আলী (রা.) নিহত হন,
যখন
তাঁর বয়স ছিল ৫৮ বছর। হাসান (রা.)ও একই বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। হুসায়ন (রা.)ও শহীদ
হন ঐ বয়সে।[20]
শু‘বা আবুবকর ইবনু হাফছ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি
বলেছেন, আমীর মু‘আবিয়া (রা.)-এর শাসনামলে
১০ বছর অতিক্রম হবার পর কয়েক দিনের মধ্যে সা‘দ (রা.) ও হাসান (রা.)
মৃত্যুবরণ করেন। উলাইয়া জা‘ফর ইবনু মুহাম্মাদের পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি
বলেন, হাসান (রা.)-এর মৃত্যু হয়েছে ৪৭ বছর বয়সে। আরো একাধিক
ব্যক্তি এরূপ বলেছেন। এটিই বিশুদ্ধ অভিমত। তবে প্রসিদ্ধ অভিমত হ’ল
৪৯ হিজরী সনে তাঁর মৃত্যু হয়। কেউ কেউ বলেন,
তাঁর
মৃত্যু ৫০ হিজরীতে মতান্তরে ৫১ বা ৫৮ হিজরীতে হয়েছে।[21]
জানাযাহ ও দাফন :
সাঈদ ইবনুল ‘আছ (রা.) তাঁর জানাযায়
ইমামতি করেন।[22] হাকেম নাইসাপুরী সালেম ইবনু আবী হাফছাহ হ’তে
বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি
আবু হাযেমকে বলতে শুনেছি,إني لشاهدٌ يومَ مات الحسن بن
علي، فرأيتُ الحسين بن علي يقول لسعيد بن العاص (وهو أمير على المدينة يومئذٍ)،
ويطعنُ في عنقه، ويقول: تقدَّم فلولا أنها سُنَّة ما قدَّمتُك، وكان بينهم شيء أي:
خلاف، ‘হাসান (রা.) যেদিন মৃত্যুবরণ করেন, সেদিন
আমি উপস্থিত ছিলাম। তখন আমি দেখলাম,
হুসাইন
বিন আলী (রা.) সাঈদ ইবনুল আছ (রা.) (মদীনার তৎকালীন গভর্ণর)-এর কাঁধে গুতা মেরে
তাকে বললেন, সামনে অগ্রসর হও, এটা
সুন্নাত না হ’লে আমি তোমাকে সামনে দিতাম না। তাদের মাঝে
কোন বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য ছিল’।[23]
ওয়াকিদী বলেন,
ইব্রাহীম
ইবনু ফাযল আবূ আতীক থেকে বর্ণনা করেছেন,
তিনি
বলেন, আমি জাবের ইবনু আব্দিল্লাহ্ (রা.)-কে বলতে শুনেছি ‘যেদিন
হাসান (রা.)-এর মৃত্যু হয়, সেদিন আমি সেখানে ছিলাম।
তখন হুসায়ন (রা.) এবং মারওয়ান ইবনু হাকামের মধ্যে চরম গন্ডগোল সৃষ্টি হবার উপক্রম
হয়েছিল। হাসান (রা.) তার ভাই হুসায়ন (রা.)-কে এ মর্মে অছিয়ত করে গিয়েছিলেন যে, তাঁকে
যেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পাশে দাফন করা হয়। তবে তাতে যদি কোন গন্ডগোল কিংবা
ঝগড়া-বিবাদের আশঙ্কা হয় তাহ’লে যেন বাক্বীউল গারক্বাদে
দাফন করা হয়।
ইবনু
কাছীর (রহঃ) উল্লেখ করেন,فَأَبَى مَرْوَانُ أَنْ
يَدَعَهُ، وَمَرْوَانُ يَوْمَئِذٍ مَعْزُولٌ يُرِيدُ أَنْ يُرْضِيَ معاوية، ولم
يَزَلْ مَرْوَانُ عَدُوًّا لِبَنِي هَاشِمٍ حَتَّى مَاتَ، ‘হাসান
(রা.)-এর লাশ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পাশে দাফন করতে মারওয়ান বাধা দিয়েছিল। ঐ সময়
মারওয়ান ছিল চাকুরীচ্যুত। এটা দ্বারা সে আমীর মু‘আবিয়া
(রা.)-এর মানোরঞ্জনের চেষ্টা করেছিল। মারওয়ান কিন্তু আমৃত্যু হাশিমী সম্প্রদায়ের
দুশমন ছিল’।[24] জাবের (রা.) বলেন,فَكَلَّمْتُ يَوْمَئِذٍ حُسَيْنَ بْنَ عَلِيٍّ فَقُلْتُ: يَا أَبَا
عَبْدِ اللهِ اتَّقِ اللهَ ولا تثر فتنة فَإِنَّ أَخَاكَ كَانَ لَا يُحِبُّ مَا
تَرَى، فَادْفِنْهُ بِالْبَقِيعِ مَعَ أُمِّهِ فَفَعَلَ. ‘অতঃপর আমি হুসায়ন বিন আলী (রা.)-এর সাথে কথা বললাম। আমি
বললাম, হে আবূ আব্দিল্লাহ্! আল্লাহকে ভয় করুন, অশান্তির
জন্ম দিবেন না (রক্তপাতের সূচনা করবেন না)। কেননা আপনার ভাই এসব পসন্দ করতেন না, যা
দেখছেন। আপনার প্রিয় ভাইকে আপনার মায়ের পাশে দাফন করুন। তারপর হুসায়ন (রা.) তাই
করলেন’।[25]
আব্দুল্লাহ ইবনু নাফে‘
স্বীয়
পিতা থেকে বর্ণনা করেন, ওমর বলেন,حَضَرْتُ مَوْتَ الْحَسَنِ بْنِ عَلِيٍّ فقلت للحسين بن على اتَّقِ
اللهَ وَلَا تُثِرْ فِتْنَةً وَلَا تَسْفِكِ الدماء: وادفن أخاك إلى جانب أُمِّهِ،
فَإِنَّ أَخَاكَ قَدْ عَهِدَ بِذَلِكَ إِلَيْكَ، قَالَ فَفَعَلَ الْحُسَيْنُ. ‘আমি হাসান বিন আলী (আঃ)-এর মৃত্যুর সময়
উপস্থিত হ’লাম। আমি হুসায়ন বিন আলী (আঃ)-কে বললাম, আল্লাহকে
ভয় করুন, অশান্তির জন্ম দিবেন না, রক্তপাতের
সূচনা করবেন না। আপনার প্রিয় ভাইকে আপনার মায়ের পাশে দাফন করুন। কেননা আপনার ভাই
তাও বলে গিয়েছেন। তারপর হুসায়ন (রা.) তাই করলেন’।[26]
অপর এক বর্ণনায় এসেছে,
হাসান
(রা.) তাঁর জীবদ্দশায় আয়েশা (রা.)-এর অনুমতি চেয়েছিলেন, যাতে
তাঁকে মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর পাশে দাফন করা হয়। আয়েশা (রা.) অনুমতি
দিয়েছিলেন। হাসান (রা.) মৃত্যুবরণ করলেন। তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পাশে দাফন
করার উদ্যোগ নেয়া হ’ল। উমাইয়া বংশের লোকজন বাধা দিল। হুসায়ন (রা.)
ওদের বাধা অতিক্রম করার জন্যে অস্ত্রে সজ্জিত হ’লেন।
উমাইয়াগণও অস্ত্রে সজ্জিত হ’ল। তারা বলল, ‘আমরা হাসান (রা.)-কে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর পাশে দাফন করতে
দিব না। ওছমান (রা.)-কে দাফন করা হয়েছে বাক্বীউল গারক্বাদে আর হাসান (রা.)-কে দাফন
করা হবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পাশে?
তা
হবে না। এ নিয়ে ভীষণ সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিল। এই পরিস্থিতিতে সা‘দ
ইবনু
আবী ওয়াক্কাছ (রা.),
আবূ
হুরায়রাহ (রা.), জাবের (রা.) ও ইবনু ওমর (রা.)
প্রমুখ সংঘর্ষে না জড়াতে হুসায়ন (রা.)-কে পরামর্শ দিলেন। তিনি তাঁদের পরামর্শ মেনে
নিলেন এবং হাসান (রা.)-কে তাঁর মায়ের কবরের নিকট বাক্বীউল গারক্বাদে দাফন করলেন।[27]
ইবনু কাছীর (রহঃ) উল্লেখ করেন, মুহাম্মাদ
ইবনু ইসহাক বলেছেন, মুসাবির বলেছেন,رَأَيْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ قائما على مسجد رسول الله يَوْمَ مَاتَ
الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ وَهُوَ يُنَادِي بِأَعْلَى صَوْتِهِ: يَا أَيُّهَا
النَّاسُ مَاتَ الْيَوْمَ حب رسول الله فَابْكُوا. وَقَدِ اجْتَمَعَ النَّاسُ
لِجِنَازَتِهِ حَتَّى مَا كَانَ الْبَقِيعُ يَسَعُ أَحَدًا مِنَ الزِّحَامِ. ‘যেদিন ইমাম হাসান (রা.)-এর মৃত্যু হ’ল
সেদিন আবূ হুরায়রা (রা.)-কে দেখেছি তিনি মসজিদে নববীতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছেন, ‘হে লোক সকল! আজ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় মানুষের মৃত্যু
হ’ল। তোমরা সকলে তাঁর জন্যে কাঁদ’।
তাঁর
জানাযায় সর্বস্তরের মানুষ সমবেত হয়। এমনকি বাক্বীউল গারক্বাদে মানুষের ভিড়ে কারো
দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না’।[28]
পরিশেষে বলব,
ইসলামের
৫ম খলীফা জান্নাতী যুবকদের সর্দার হাসান বিন আলী (রা.) ছিলেন অতি বিনয়ী, উদারমনা
ও নির্ঞ্ঝাট মানুষ। মুসলিম উম্মাহর প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম মহববত। খিলাফতের
দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া এবং উষ্ট্র ও ছিফ্ফীনের যুদ্ধে তাঁর অনন্য ভূমিকাই তার
প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তাঁর ঘটনাবহুল জীবনীতে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রয়েছে। আল্লাহ
আমাদেরকে তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন গড়ার তাওফীক দিন-আমীন!
[1]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৪২ পৃঃ।
[2]. হিলয়াতুল আওলিয়া,
২/৩৮পৃঃ; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৪২ পৃঃ।
[3]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৪২-৪৩ পৃঃ।
[4]. ঐ, ১১/২০৯ পৃঃ।
[5]. ঐ, ৮/৪৫ পৃঃ।
[6]. আল-ইছাবাহ ২/৭৩,
বর্ণনাটি
ছহীহ; তাহযীবুত তাহযীব ৪/১২৭।
[7]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৩/২৭৪।
[8]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১১/২০৮।
[9]. ইবনু তায়মিয়াহ,
মিনহাজুস
সুন্নাহ ৪/৪৬৯ পৃঃ।
[10]. আবু বকর আল-আরাবী (মৃঃ ৫৪৩হিঃ), আল-‘আওয়াছেম মিনাল ক্বাওয়াছেম, (বৈরূত : দারুল জীল, ২য় প্রকাশ,
১৪০৭
হিঃ/১৯৮৭ খ্রিঃ), পৃঃ ২২১, টীকা ৪১৩ দ্রঃ।
[11]. তারীখুল ইসলাম,
পৃঃ
৪০।
[12]. তারীখে ইবনু খালদুন ২/৬৪৯ পৃঃ।
[13]. আল-‘আওয়াছেম মিনাল ক্বাওয়াছেম, পৃঃ ২২০-২১।
[14]. ইসলাম সুয়াল ওয়া জওয়াব, প্রশ্ন নং ২১২৩৮৯।
[15]. ইসলাম ওয়েব. নেট,
ফৎওয়া
নং ২৪৪২৭৯।
[16]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৪৩ পৃঃ।
[17]. ইবনুল জাওযী,
ছিফাতুছ
ছাফওয়াহ, ১ম খন্ড, পৃঃ ৭৬২; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/৩৪।
[18]. তাকীউদ্দীন মাক্বরীযী, ইমতা‘উল আসমা‘ বিমা লিননবী মিনাল আহওয়াল ওয়াল আমওয়াল ওয়াল হাফাদাহ ওয়াল
মাতা‘ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল
ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৯ খ্রিঃ),
৫/৩৬১
পৃঃ।
[19]. আস-সাওয়ায়েকুল মুহরাকা, পৃঃ ৩৪৬।
[20]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৪৮,
১১/২১২
পৃঃ।
[21]. ঐ, ৮/৪৮, ১১/২১২ পৃঃ।
[22]. তারীখুল খোলাফা,
সাওয়ানেহে
কারবালা, পৃঃ ৬১-৬২; ইবনু আসাকির (মৃত্যু ৫৭১হিঃ), তারীখু দিমাশক,
১৩/৩০৩
পৃঃ।
[23]. আলবানী,
আহকামুল
জানায়েয, পৃঃ ১২৮, সনদ ছহীহ;
আল-বিদায়াহ
ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৪৮ পৃঃ।
[24]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৪৪ পৃঃ।
[25]. ঐ, ৮/৪৪, ৪৮; ১১/২১০ পৃঃ।
[26]. ঐ, ৮/৪৪, ৪৮; ১১/২১০ পৃঃ।
[27]. ঐ, ৮/৪৪ পৃঃ।
[28]. ঐ, ৮/৪২, ১১/২১১ পৃঃ।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(০৭)
উক্কাশা বিন মিহছান (রা.)
ইসলামের প্রচার-প্রসারে ও দ্বীনের হেফাযতে
যারা অমর অবদান রেখেছিলেন এবং আমলে ছালেহ করে জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে
ধন্য হয়েছিলেন, উক্কাশা ইবনু মিহছান (রা.) ছিলেন তাদের
অন্যতম। ইসলাম ও মুসলমানদেরকে রক্ষার জিহাদে জীবন বাজি রেখে যেমন তিনি যুদ্ধ করেছিলেন
তেমনি পরকালীন জীবনে নাজাতের লক্ষ্যে সাধ্যমত সৎআমল করার প্রাণান্ত চেষ্টা
করছিলেন। আর তাই দুনিয়াতেই তিনি জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন। নিম্নে এ ছাহাবীর
জীবনী সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হ’ল।-
নাম ও বংশ পরিচয় : তাঁর নাম উক্কাশা, কুনিয়াত বা উপনাম আবু মিহছান। পিতার নাম
মিহছান ইবনু হারছান। পূর্ণ বংশ পরিচয় হচ্ছে- উক্কাশা ইবনু মিহছান ইবনে হারছান ইবনে
ক্বায়েস ইবনে মুররাহ ইবনে কাছীর[1] ইবনে গানাম ইবনে দূদান ইবনে আসাদ ইবনে খুযায়মাহ।[2] জাহিলী যুগে বনী আবদে শামসের হালীফ বা চুক্তিবদ্ধ ছিলেন।[3] তিনি অত্যন্ত সুদর্শন পুরুষ ছিলেন।[4]
জন্ম : তার জন্মসন জানা যায় না। তবে রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর সময় (১১ হিজরীর ১লা রবীউল
আউয়াল মোতাবেক ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুন সোমবার)[5] উক্কাশা বিন মিহছানের বয়স হয়েছিল ৪০ বছর[6] মতান্তরে ৪৪ বছর।[7] সে হিসাবে উক্কাশা বিন মিহছান ৫৯২ মতান্তরে ৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ
করেন।
ইসলাম গ্রহণ ও হিজরত : তিনি হিজরতের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং অন্যদের সাথে মক্কা ছেড়ে মদীনায়
চলে যান।[8]
যুদ্ধে অংশগ্রহণ : বদর যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য দারুণ প্রসিদ্ধি লাভ করেন। উক্কাশা বিন মিহছান বদর
যুদ্ধের দিন তার ভাঙ্গা তরবারি নিয়ে রাসূল (সা.)-এর নিকটে আসেন। তখন রাসূল (সা.)
তাকে একটি কাঠের টুকরা দিয়ে বলেন, তুমি এটা দিয়ে
যুদ্ধ কর। অতঃপর যখন তিনি এটি হাতে নিয়ে নড়াচড়া করেন তখন তা লম্বা, শক্ত ও ধবধবে সাদা তরবারিতে পরিণত হয়ে যায়। অতঃপর এটি নিয়ে
তিনি যুদ্ধ করেন। যতক্ষণ না আল্লাহ মুসলমানদের বিজয় দান করেন। সেদিন থেকে উক্ত
তরবারিটির নাম হয় ‘আল-‘আওন’ (العَوْن) বা সাহায্যকারী। এরপর থেকে তিনি রাসূল (সা.)-এর সাথে সকল
যুদ্ধে উক্ত তরবারি নিয়ে যোগদান করেন। এমনকি আবুবকর (রা.)-এর খিলাফতকালে রিদ্দার
যুদ্ধে উক্ত তরবারি নিয়েই তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং শহীদ হন। তুলায়হা বিন খুওয়াইলিদ
আল-আসাদী তাঁকে হত্যা করেন’।[9] ইবনু ইসহাক এটি বিনা সনদে উল্লেখ করেছেন। সেকারণ এটি যঈফ।[10] ওহোদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি চরম
বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন করেন।[11]
২য় হিজরীর রজব মাসে (জানুয়ারী ৬২৪ খৃঃ)
আব্দুল্লাহ বিন জাহশের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত নাখলা অভিযানে উক্কাশা ইবনে মিহছান
অংশগ্রহণ করেন।[12]
দায়িত্ব পালন : ৬ষ্ঠ হিজরীর রবীউল আউয়াল অথবা রবীউল আখের মাসে ৪০ জনের একটি সেনাদল বনু আসাদ
গোত্রের ‘গামর’ প্রস্রবণের (ماء غَمْر) দিকে উক্কাশার
নেতৃত্বে প্রেরিত হয়। কেননা বনু আসাদ গোত্র মদীনায় হামলা করার জন্য সৈন্য সংগ্রহ
করছিল। মুসলিম বাহিনীর আকস্মিক উপস্থিতিতে তারা পালিয়ে যায়। পরে গণীমত হিসাবে ২০০
উট নিয়ে অত্র বাহিনী মদীনায় ফিরে আসে।[13]
জান্নাতের সুসংবাদ :
উক্কাশা বিন মিহছান (রা.) রাসূল (সা.)-এর
মাধ্যমে সরাসরি জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এছাড়া তিনি ঐসব ছাহাবীদের
অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাদের ব্যাপারে আমভাবে জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছিল। যেমন-
১. ইসলামের প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারী ছাহাবীদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাদেরকে জান্নাতের প্রবেশ করানোর
প্রতিশ্রুতি আল্লাহ দিয়েছেন। উক্কাশা বিন মিহছান (রা.) তাদের অন্যতম ছিলেন। যেমন
আল্লাহ বলেন,
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ
وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ
وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ
فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ،
‘মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে যারা অগ্রবর্তী ও
প্রথম দিককার এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে নিষ্ঠার সাথে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি
সন্তুষ্ট। তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন জান্নাত, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহা সফলতা’ (তওবা ৯/১০০)। অন্যত্র আল্লাহ আরো
বলেন,لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِينَ
الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ
اللهِ وَرِضْوَانًا وَيَنْصُرُونَ اللهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ هُمُ
الصَّادِقُونَ، ‘(ফাই-এর সম্পদ) অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য।
যারা তাদের ঘর-বাড়ি ও মাল-সম্পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও
সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। এরাই হ’ল সত্যবাদী’ (হাশর ৫৯/৮)।
২. উক্কাশা বিন মিহছান (রা.) ছিলেন ঐসব
ছাহাবীগণের অন্তর্ভুক্ত যারা হুদায়বিয়ায় বাবলা গাছের নীচে বায়‘আতে রিযওয়ানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ বলেন, لَقَدْ رَضِيَ اللهُ عَنِ
الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي
قُلُوبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন মুমিনদের প্রতি, যখন তারা বৃক্ষের নীচে তোমার নিকট বায়‘আত করেছে। এর মাধ্যমে তিনি তাদের অন্তরে যা ছিল তা জেনে
নিলেন। ফলে তিনি তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে পুরস্কার দিলেন
আসন্ন বিজয়’ (ফাতহ ৪৮/১৮)।
৩. উক্কাশা বিন মিহছান (রা.) বদরী ছাহাবীগণের
অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বদরী ছাহাবীগণের সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন,لَعَلَّ اللهَ اطَّلَعَ إِلَى
أَهْلِ بَدْرٍ فَقَالَ اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ فَقَدْ وَجَبَتْ لَكُمُ الْجَنَّةُ،
أَوْ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ. ‘তুমি কি জানো না, আল্লাহ অবশ্যই বদরে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি লক্ষ্য করে
বলেছেন,
‘তোমাদের যা ইচ্ছা কর, তোমাদের জন্য জান্নাত অবধারিত অথবা (বর্ণনাকারীর সন্দেহ)
আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি’।[14] অন্যত্র তিনি বলেন,جَاءَ جِبْرِيلُ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ مَا
تَعُدُّونَ أَهْلَ بَدْرٍ فِيكُمْ قَالَ مِنْ أَفْضَلِ الْمُسْلِمِينَ أَوْ
كَلِمَةً نَحْوَهَا قَالَ وَكَذَلِكَ مَنْ شَهِدَ بَدْرًا مِنَ الْمَلاَئِكَةِ. ‘একদা জিবরীল (আঃ) নবী করীম (সা.)-এর নিকটে এসে বললেন, আপনারা বদর যুদ্ধে যোগদানকারী মুসলিমদেরকে কিরূপ গণ্য করেন? তিনি বললেন, তারা সর্বোত্তম মুসলিম অথবা (বর্ণনাকারীর সন্দেহ) এরূপ কোন শব্দ তিনি
বলেছিলেন। জিবরীল (আ.) বললেন, ফেরেশতাদের মধ্যে
বদর যুদ্ধে যোগদানকারীগণও তেমনি মর্যাদার অধিকারী’।[15]
৪. উক্কাশা বিন মিহছান (রা.) ছিলেন ঐসব
ছাহাবীগণের অন্তর্ভুক্ত যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। যেমন হাদীছে
এসেছে,
عَنِ ابْنِ
عَبَّاسٍ رضى الله عنهما قَالَ خَرَجَ عَلَيْنَا النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم
يَوْمًا فَقَالَ عُرِضَتْ عَلَىَّ الأُمَمُ فَجَعَلَ يَمُرُّ النَّبِىُّ مَعَهُ
الرَّجُلُ وَالنَّبِىُّ مَعَهُ الرَّجُلاَنِ، وَالنَّبِىُّ مَعَهُ الرَّهْطُ،
وَالنَّبِىُّ لَيْسَ مَعَهُ أَحَدٌ، وَرَأَيْتُ سَوَادًا كَثِيرًا سَدَّ الأُفُقَ
فَرَجَوْتُ أَنْ يَكُونَ أُمَّتِى، فَقِيلَ هَذَا مُوسَى وَقَوْمُهُ. ثُمَّ قِيلَ
لِى انْظُرْ. فَرَأَيْتُ سَوَادًا كَثِيرًا سَدَّ الأُفُقَ فَقِيلَ لِى انْظُرْ
هَكَذَا وَهَكَذَا. فَرَأَيْتُ سَوَادًا كَثِيرًا سَدَّ الأُفُقَ فَقِيلَ
هَؤُلاَءِ أُمَّتُكَ، وَمَعَ هَؤُلاَءِ سَبْعُونَ أَلْفًا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ
بِغَيْرِ حِسَابٍ. فَتَفَرَّقَ النَّاسُ وَلَمْ يُبَيَّنْ لَهُمْ، فَتَذَاكَرَ
أَصْحَابُ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالُوا أَمَّا نَحْنُ فَوُلِدْنَا فِى
الشِّرْكِ، وَلَكِنَّا آمَنَّا بِاللهِ وَرَسُولِهِ، وَلَكِنْ هَؤُلاَءِ هُمْ
أَبْنَاؤُنَا، فَبَلَغَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ هُمُ الَّذِينَ لاَ
يَتَطَيَّرُونَ، وَلاَ يَسْتَرْقُونَ، وَلاَ يَكْتَوُونَ، وَعَلَى رَبِّهِمْ
يَتَوَكَّلُونَ. فَقَامَ عُكَّاشَةُ بْنُ مِحْصَنٍ فَقَالَ أَمِنْهُمْ أَنَا يَا
رَسُولَ اللهِ قَالَ نَعَمْ. فَقَامَ آخَرُ فَقَالَ أَمِنْهُمْ أَنَا فَقَالَ
سَبَقَكَ بِهَا عُكَّاشَةُ.
ইবনু আববাস (রা.) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন নবী করীম (সা.) আমাদের নিকট এসে বললেন, আমার সামনে (পূর্ববর্তী নবীগণের) উম্মাতদের পেশ করা হ’ল। (আমি দেখলাম) একজন নবী যাচ্ছেন, তাঁর সাথে আছে মাত্র একজন লোক এবং আরেকজন নবী, যাঁর সঙ্গে আছে দু’জন লোক।
অন্য এক নবীকে দেখলাম, তাঁর সঙ্গে আছে একটি দল, আরেকজন নবী, তাঁর সাথে কেউ নেই। আবার দেখলাম, একটি বিরাট দল যা দিগন্ত জুড়ে আছে। আমি আকাঙ্ক্ষা করলাম যে, এ বিরাট দলটি যদি আমার উম্মাত হ’ত। বলা হ’ল, এটা মূসা (আঃ) ও তাঁর কওম। এরপর আমাকে বলা হ’ল দেখুন। দেখলাম, একটি বিশাল জামা‘আত দিগন্ত জুড়ে আছে। আবার বলা হ’ল, এদিকে দেখুন, ওদিকে দেখুন। দেখলাম, বিরাট বিরাট দল দিগন্ত জুড়ে ছেয়ে আছে। বলা হ’ল, ঐসবই আপনার উম্মাত এবং ওদের সাথে সত্তর হাযার
লোক এমন আছে যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এরপর লোকজন এদিক ওদিক চলে
গেল। নবী করীম (সা.) আর তাদের (সত্তর হাযারের) ব্যাখ্যা করে বলেননি। নবী করীম (সা.)-এর
ছাহাবীগণ এ নিয়ে নানান কথা শুরু করে দিলেন। তাঁরা বলাবলি করলেন, আমরা তো শিরকের মাঝে জন্মেছি, পরে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান এনেছি। বরং এরা আমাদের সন্তানরাই হবে। নবী
করীম (সা.)-এর কাছে এ কথা পৌঁছলে তিনি বলেন, তারা (হবে) ঐসব লোক যারা অবৈধভাবে মঙ্গল অমঙ্গল নির্ণয় করে না, ঝাড়-ফুঁক করে না এবং আগুনে পোড়ানো লোহার দাগ লাগায় না, আর তারা কেবল তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা রাখে। তখন
উক্কাশাহ বিন মিহছান দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল!
আমি কি তাদের মধ্যে আছি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন আর একজন দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি তাদের মধ্যে আছি? তিনি বললেন, এ বিষয়ে উক্কাশাহ তোমার অগ্রগামী হয়ে গেছে’।[16] ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, উক্কাশা ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ছাহাবী। তাঁকে হত্যাকারী তুলায়হা ‘মুরতাদ’ ছিল। পরে সে ইসলামে
ফিরে আসে।[17]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবূ হুরায়রাহ (রা.) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে
বলতে শুনেছি,يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مِنْ أُمَّتِى زُمْرَةٌ هِىَ سَبْعُونَ
أَلْفًا، تُضِىءُ وُجُوهُهُمْ إِضَاءَةَ الْقَمَرِ. فَقَامَ عُكَاشَةُ بْنُ
مِحْصَنٍ الأَسَدِىُّ يَرْفَعُ نَمِرَةً عَلَيْهِ قَالَ ادْعُ اللهَ لِى يَا
رَسُولَ اللهِ أَنْ يَجْعَلَنِى مِنْهُمْ. فَقَالَ اللَّهُمَّ اجْعَلْهُ مِنْهُمْ.
ثُمَّ قَامَ رَجُلٌ مِنَ الأَنْصَارِ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ ادْعُ اللهَ أَنْ
يَجْعَلَنِى مِنْهُمْ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ سَبَقَكَ عُكَاشَةُ. ‘আমার উম্মাতের মধ্য থেকে সত্তর হাযারের একটি দল (বিনা
হিসাবে) জান্নাতে প্রবেশ করবে। তখন তাদের মুখমন্ডল চাঁদের ন্যায় উজ্জ্বল হবে।
উক্কাশা ইবনু মিহ্ছান তাঁর পরিহিত রঙিন ডোরাওয়ালা চাদর উপরে তুলে ধরে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আপনি আল্লাহর নিকট আমার জন্য দো‘আ করুন, যেন তিনি আমাকে
তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি দো‘আ করলেন, হে আল্লাহ! একে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। তারপর আনছারদের
মধ্য থেকে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আপনি আল্লাহর নিকট দো‘আ করুন, তিনি যেন আমাকে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করেন। নবী
করীম (সা.) বললেন, উক্কাশা তোমার অগ্রগামী হয়ে গেছে’।[18]
ইলমে হাদীছে অবদান : তাঁর নিকট থেকে আবু হুরায়রাহ (রা.) ও ইবনে আববাস (রা.) হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[19]
মৃত্যু ও দাফন : রাসূল (ছা.)-এর মৃত্যুর ১ বছর পরে হিজরী ১২ সনে প্রথম খলীফা আবুবকর (রা.)
খালিদ ইবনুল ওয়ালীদকে ভন্ডনবী তুলায়হা আসাদীর বিদ্রোহ নির্মূলের নির্দেশ দেন।
উক্কাশা ও ছাবিত ইবনু আরকাম ছিলেন খালিদের বাহিনীর দু’জন অগ্রসৈনিক। তারা বাহিনীর আগে আগে চলছিলেন। হঠাৎ শত্রু
সৈন্যর সাথে তাদের সংঘর্ষ ঘটে। এই শত্রু সৈনিকদের মধ্যে তুলায়হা নিজে ও তাঁর ভাই
সালামাও ছিল। তুলায়হা আক্রমণ করে উক্কাশাকে আর সালামা ঝাপিয়ে পড়ে ছাবিতের ওপর। ছাবিত শাহাদত বরণ
করেন। এমন সময় তুলায়হা চিৎকার করে ওঠে সালামা শিগগির আমাকে সাহায্য কর। আমাকে মেরে
ফেলল। সালামার কাজ তখন শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে তুলায়হার সাহায্যে এগিয়ে যায় এবং দুই
ভাই এক সাথে উক্কাশাকে আক্রমণ করে ধরাশায়ী করে ফেলে। এভাবে উক্কাশা শহীদ হন।[20] উল্লেখ্য, বুযাখা নামক স্থানে উক্কাশা (রা.) শাহাদত বরণ
করেন।[21] বুযাখা হচ্ছে বনু আসাদের পানির কুয়া, যেখানে তুলায়হা বিন খুওয়াইলিদ আসদীর সাথে আবুবকর (রা.)-এর খিলাফতকালে বৃহৎ
যুদ্ধ সংঘটিত হয়।[22]
ইসলামী ফৌজ এই দুই শহীদের লাশের কাছে পৌঁছে
ভীষণ শোকাতুর হয়ে পড়েন। উক্কাশার দেহে মারাত্মক যখমের চিহ্ন ছিল। তার সারা দেহ
ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। বাহিনী প্রধান খালিদ ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে বাহিনীর যাত্রা
বিরতির নির্দেশ দেন। অতঃপর শহীদদ্বয়ের রক্তভেজা কাপড়েই সেই মরুভূমির বালুতে দাফন
করেন।[23] মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে তিনি নেতৃস্থানীয় ছাহাবীদের মধ্যে শামিল
ছিলেন।
পরিশেষে বলব, উক্কাশা বিন মিহছান ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য জীবন বাজি রেখে আমৃত্যু কাফের ও
কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। কেননা তার লক্ষ্য ছিল জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং
গন্তব্য ছিল জান্নাত। তাই কোন কিছুকে পরওয়া না করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়
দ্বীনের পথে তিনি নিরন্তর চেষ্টা করে গেছেন। এই মহান ছাহাবীর জীবনীতে আমাদের জন্য
বহু শিক্ষা রয়েছে। সুতরাং তার জীবনচরিত থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন গঠন করতে পারলে
পরকালে নাজাত লাভ করা আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদেরকে ছাহাবীগণের ন্যায়
হকের পথে চলে পরকালে মুক্তি লাভের তাওফীক দান করুন-আমীন!
[1]. ইবনু আব্দিল বার্র ‘কাছীর’-এর স্থলে কাবীর
বলেছেন। দ্র. আল-ইস্তি‘আব, ৩/১০৮০পৃ.।
[2]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৪০৭হি./১৯৮৬
খ্রি.), ৬/৩৩৮ পৃ.।
[3]. আবুল ফিদা হাফেয ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৩য় খন্ড, ৬ষ্ঠ জুয (কায়রো : দারুর রাইয়ান, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৮খৃ.), পৃ. ৩৪৩।
[4]. হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১ম খন্ড (বৈরূত : মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২য় প্রকাশ, ১৪০৫ হি./১৯৮৫ খৃ.), পৃ. ৩০৭।
[5]. বুখারী হা/১৩৮৭।
[6]. আবু আব্দুল্লাহ হাকেম আন-নাইসাপুরী, আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০খৃ. /১৪১১হি.), ৩য় খন্ড, পৃ. ২৫৩।
[7]. মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব, মুখতাছার সীরাতুর রাসূল, ১/২৬৮ পৃ.।
[8]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৩য় খন্ড, ৬ষ্ঠ জুয, পৃ. ৩৪৩।
[9]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃঃ ২২৪; ইবনু হিশাম ১/৬৩৭
পৃ.।
[10]. তালীক্ব, আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃঃ ১৩২; মা শা-‘আ, পৃ. ১১৬।
[11]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৩য় খন্ড, ৬ষ্ঠ জুয, পৃ. ৩৪৩।
[12]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (সা.), (রাজশাহী: হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৩য় প্রকাশ, ১৪৪৪হি./২০২৩ খৃ.), পৃ. ২৭৯-৮০।
[13]. ওয়াক্বেদী, মাগাযী ২/৫৫০; যাদুল মা‘আদ ৩/২৫০; আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ৩২২।
[14]. বুখারী হা/৩৯৮৩; মুসলিম হা/২৪৯৪; মিশকাত
হা/৬২১৬।
[15]. বুখারী হা/৩৯৯২, ৩৯৯৪; মিশকাত হা/৬২১৭; ছহীহাহ হা/২৫২৮।
[16]. বুখারী হা/৫৭৫২, ৬৫৪১; মুসলিম হা/২২০; মিশকাত হা/৫২৯৬।
[17]. আল-ইছাবাহ, ক্রমিক ৫৬৪৮।
[18]. বুখারী হা/৫৮১১, ৬৫৪২; মুসলিম হা/২১৬; আহমাদ ৮০২২, ৮৬২২।
[19]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১ম খন্ড, পৃ. ৩০৮।
[20]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৩য় খন্ড, ৬ষ্ঠ জুয, পৃ. ৩৪৩; আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৩য় খন্ড, পৃ. ২৫৩।
[21]. ঐ; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১ম খন্ড, পৃ. ৩০৮।
[22]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১ম খন্ড, পৃ. ৩০৭, ২নং টীকা দ্র.।
[23]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৩য় খন্ড, ৬ষ্ঠ জুয, পৃ. ৩৪৩; আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৩য় খন্ড, পৃ. ২৫৩।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(০৮)
উম্মু হাবীবা বিনতু আবী সুফিয়ান (রা.)
মানব সৃষ্টির আদি
থেকেই এমন কিছু লোক ছিলেন যারা জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করে, সকল প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে আল্লাহ প্রদত্ত অহি-র বিধানকে
জীবনের সর্বক্ষেত্রে মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। প্রয়োজনে নিজের অমূল্য জীবন
কুরবানী করেছেন। যেমন প্রতাপান্বিত কাফির সম্রাট ফেরাঊনের অধীনে থেকেও তার স্ত্রী
আসিয়া ছিলেন ইসলামের শাশ্বত আদর্শে উজ্জীবিত। এ আদর্শের জন্য তিনি নিজের জীবন
বিলিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুনিয়াবী জৌলুস ও শান-শওকত তাকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি।
অতীব নিষ্কলুষ ও নির্মল চরিত্রের অধিকারী অতি সুদর্শনা উম্মু হাবীবা (রা.)ও ছিলেন
ইসলামী আদর্শের জন্য নিবেদিত প্রাণ এক মহিয়সী মহিলা। মক্কার কুরাইশ বংশের তৎকালীন
প্রভাবশালী নেতা আবু সুফিয়ানের বিত্ত-বৈভব ও সামাজিক উচ্চ মর্যাদা, প্রতিপত্তি উম্মু হাবীবাকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারেনি।
বরং ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে দ্বীন-ঈমান রক্ষার খাতিরে দেশ ত্যাগের সীমাহীন কষ্ট অকাতরে সহ্য করেন তিনি। বিদেশ-বিভূঁইয়ে গিয়ে
জীবনের সর্বাধিক প্রিয় মানুষ, জীবনের একমাত্র
অবলম্বন প্রথম স্বামী দ্বীন ত্যাগ করে খৃষ্টান হয়ে গেলেও উম্মু হাবীবা (রা.) ছিলেন
ইসলামের উপর অটল ও অবিচল। জীবনের এই কঠিনতম মুহূর্তেও তিনি আদর্শচ্যুত হননি, বিচ্যুত হননি ইসলামের আলোকময় পথ থেকে। তাঁকে বিভ্রান্ত করতে
পারেনি পার্থিব কোন আকর্ষণ, কোন মায়াজাল। এই মহিয়সী রমণী উম্মুল মুমিনীন
উম্মু হাবীবা (রা.)-এর জীবনী আমরা এখানে আলোচনার প্রয়াস পাব।
নাম ও বংশ পরিচয় :
তাঁর প্রকৃত নাম রামলাহ মতান্তরে হিন্দ। তবে
প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ মতে তাঁর নাম রামলাহ। কুনিয়াত বা উপনাম উম্মু হাবীবা।[1] পূর্ণ বংশ পরিচিতি হচ্ছে রামলাহ বিনতু আবী সুফিয়ান ছাখার ইবনে হারব ইবনে
উমাইয়াহ ইবনে আব্দে শাম্স ইবনে আব্দে মানাফ ইবনে কুছাই।[2] তাঁর মাতার নাম ছাফিয়াহ বিনতু আবীল ‘আছ ইবনে
উমাইয়াহ ইবনে আব্দে শাম্স। যিনি ওছমান ইবনু আফফান (রা.)-এর ফুফু ছিলেন।[3] কারো মতে উম্মু হাবীবা (রা.)-এর মাতার নাম আমিনা বিনতু আব্দিল উযযা ইবনে
হিরবান ইবনে আওফ ইবনে ওবায়দ ইবনে ‘আবীজ ইবনে
আদী ইবনে কা‘ব।[4]
জন্ম ও শৈশব :
উম্মু হাবীবা (রা.) নবুওয়াতের ১৭ বছর পূর্বে
মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন।[5] তাঁর শৈশবকাল সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না।
বিবাহ ও ইসলাম গ্রহণ :
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ফুফাত ভাই ওবায়দুল্লাহ
ইবনু জাহাশ এর সাথে উম্মু হাবীবার প্রথম বিবাহ হয়।[6] ওবায়দুল্লাহ ইবনু জাহাশ ছিলেন হারব ইবনু উমাইয়ার মিত্র। বিবাহের পরে ইসলামের
প্রাথমিক দিকে উম্মু হাবীবা ও ওবায়দুল্লাহ দ্বীনের দাওয়াত পেয়ে একই সাথে ইসলাম
গ্রহণ করেন।[7] ওবায়দুল্লাহ বিন জাহাশের ঔরসে ও রামলার গর্ভে মক্কায় হাবীবা নামক এক কন্যা
জন্মগ্রহণ করে । এ মেয়ের নামানুসারে রামলার উপনাম হয় উম্মু হাবীবাহ।[8]
হিজরত ও প্রথম স্বামীর ইন্তিকাল
:
মক্কার সার যমীনে মুসলমানদের বসবাস কঠিন হয়ে
পড়লে উম্মু হাবীবা ও তাঁর স্বামী ওবায়দুল্লাহ অন্যান্য মুসলমানদের সাথে জন্মভূমি
মক্কা ছেড়ে সুদূর হাবাশায় (আবিসিনিয়ায়) বর্তমান ইথিওপিয়ায় হিজরত করেন। কিন্তু এ
হিজরত উম্মু হাবীবা (রা.)-এর জন্য মোটেই সুখকর ছিল না। দ্বীনের খাতিরে স্বজন ও
জন্মভূমি ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে তাঁর জীবনে দুর্দশা নেমে আসে। হিজরত তাঁর জন্য
বয়ে নিয়ে আসল দুঃখ-বেদনার অথৈ পাথার। হিজরতের ফলে আবু জাহলের নির্মম অত্যাচার থেকে
মুক্তি পেলেও দাম্পত্য জীবনে নেমে এল এক অসহনীয় বিপর্যয়। দুর্বল চিত্তের লোক
স্বামী ওবায়দুল্লাহ বিন জাহাশ দ্বীনের জন্য এত তাকলীফ স্বীকার করতে অপ্রস্ত্তত হয়ে
খৃষ্টান ধর্মে ফিরে যেতে উদ্ধত হন। যেজন জীবনের সবচেয়ে আপন, সার্বক্ষণিক সঙ্গী সে স্বামী দ্বীন-ধর্ম ত্যাগ করে পূর্বের
ধর্মে ফিরে যায়। উম্মু হাবীবা (রা.) বলেন, একদা স্বপ্নে আমি আমার স্বামী ওবায়দুল্লাহকে বিকৃত চেহারায় বিভৎস অবস্থায় দেখে
ভয় পেয়ে গেলাম এবং বললাম, আল্লাহর কসম তার অবস্থা পরিবর্তন হয়ে গেছে।
সকালে সে আমাকে বলল, আমি বিভিন্ন ধর্মের প্রতি লক্ষ্য করেছি।
কিন্তু খৃষ্টান ধর্মের চেয়ে উত্তম কোন ধর্ম পাইনি। আমি ঐ ধর্মে ছিলাম। অতঃপর
মুহাম্মাদের ধর্মে প্রবেশ করি। আমি পুনরায় পূর্বের ধর্মে প্রত্যাবর্তন করছি। উম্মু
হাবীবা (রা.) তখন তার স্বপ্নের কথা স্বামীকে বললেন। তিনি স্বামীকে বুঝানোর
যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। কিন্তু সে শুনল না। মদ্যপানের দিকে ঝুঁকে পড়ল। আকণ্ঠ
নিমজ্জিত করে মদ্যপান করতে লাগল।[9]
ওবায়দুল্লাহ ধর্মান্তরিত হওয়ার পর স্ত্রী
উম্মু হাবীবাকেও তার পদাঙ্ক অনুসরণের জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু উম্মু হাবীবার
পর্বতসম ঈমানের কাছে তার সকল কোশেশ ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়। আল্লাহর পথে দ্বীনে
হক্বের উপরে দৃঢ়ভাবে অবিচল থাকেন। স্ত্রীর কাছে নিজের আদর্শিক ব্যর্থতা ও পরাজয়ের
আঘাত ওবায়দুল্লাহর মনে বিশেষভাবে নাড়া দিচ্ছিল। সে কল্পনাও করেনি যে বিদেশ
বিভূঁইয়ে একজন সাধারণ মহিলা স্বামীর আদেশ উপেক্ষা করতে সাহস করবে। কিন্তু আল্লাহর
সন্তুষ্টির জন্য পাগলপরা ও দ্বীনে হক্বের জন্য নিবেদিতা উম্মু হাবীবা (রা.) সে
সাহস প্রদর্শন করলেন। স্বামীর জন্য ইসলামের শাশ্বত আদর্শ ত্যাগ করতে রাযী হ’লেন না। ওবায়দুল্লাহ এর প্রতিশোধ হিসাবে স্ত্রীর নিকট থেকে
দূরে সরে গেলেন। প্রিয়জনের বিচ্ছেদ যন্ত্রণা উম্মু হাবীবা (রা.) অনুভব করলেও মুষড়ে
পড়লেন না। আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও দ্বীনে হক্বের প্রতি অবিচলতা, ইসলামের শাশ্বত আদর্শের জন্য নিবেদিতা উম্মু হাবীবা (রা.)
তাই স্বামীর প্রেম-ভালবাসা উপেক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ভালবাসা তাকে ইসলামের
সার্বজনীন আদর্শ থেকে, সত্যপথ থেকে একটুও সরাতে পারেনি, টলাতে পারেনি। উম্মু হাবীবা (রা.) কর্মের মাধ্যমে প্রমাণ
করলেন যে, প্রয়োজন বোধে দ্বীনে হক্বের জন্য স্বামীর
ভালবাসা ও স্বজনের সুতীব্র আকর্ষণও কুরবানী দিতে হয়।
উল্লেখ্য, উম্মু হাবীবার ১ম স্বামী ওবায়দুল্লাহ বিন জাহাশ আবিসিনিয়ায় খৃষ্টান অবস্থায়
মৃত্যুবরণ করে।[10]
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে
বিবাহ :
উম্মু হাবীবা (রা.) ৬ষ্ঠ মতান্তরে ৭ম হিজরীতে
আবিসিনিয়ায় অবস্থান কালে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।[11] উম্মু হাবীবা (রা.) বলেন, ওবায়দুল্লাহ বিন
জাহাশের মৃত্যুর পর একদা আমি স্বপ্নে দেখলাম, জনৈক আগন্তুক এসে আমাকে বলছে, হে উম্মুল মুমিনীন!
এতে আমি শঙ্কিত হ’লাম। আর আমি মনে মনে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করলাম
যে,
রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বিবাহ করবেন। অতঃপর
আমার ইদ্দতকাল সমাপ্ত হওয়ার অব্যবহিত পরেই আমি দেখলাম, বাদশাহ নাজ্জাশীর দূত আমার দরজায় দন্ডায়মান। সে আমার গৃহে
প্রবেশের জন্য আমার অনুমতি চাচ্ছে। দূত হিসাবে আবরাহা নাম্নী এক দাসী স্বীয়
পরিচ্ছদে আমার নিকটে এসেছে। সে আমাকে বলল, বাদশাহ আমাকে একথা বলে পাঠিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) আপনাকে বিবাহ করার জন্য পত্র পাঠিয়েছেন। অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমর ইবনু উমাইয়াকে নাজ্জাশীর নিকট পাঠান
উম্মু হাবীবাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে।[12] তখন আমি বললাম, আল্লাহ তোমাকে উত্তম জিনিস দ্বারা সুসংবাদ
দান করুন। আবরাহা বলল, বাদশাহ আপনাকে বিবাহের অলী (অভিভাবক) নিযুক্ত
করে পাঠাতে বলেছেন। তখন আমি খালিদ ইবনু সাঈদ ইবনিল আছকে অলী নিযুক্ত করে পাঠালাম।
এই সুসংবাদ প্রদানের জন্য তিনি বাদী আবরাহাকে রৌপ্যের দু’টি চুরি এবং একটি আংটি উপহার দেন।[13] উল্লেখ্য, খালিদ ইবনু সাঈদ ছিলেন উম্মু হাবীবার পিতা
আবু সুফিয়ানের চাচাত ভাই।[14]
সন্ধ্যায় বাদশাহ নাজ্জাশী জা‘ফর ইবনু আবী তালেব ও অন্যান্য মুসলমানদের ডেকে রাসূলুল্লাহ
(সা.)-এর সাথে উম্মু হাবীবা (রা.)-এর বিবাহ পড়িয়ে দেন। তিনি রাসূলে করীম (সা.)-এর
পক্ষ থেকে উম্মু হাবীবাকে ৪০০ দীনার মতান্তরে ৪ হাযার দেরহাম মহর প্রদান করেন।
তিনি উপস্থিত সবাইকে খানার (ওলীমার) দাওয়াত দেন এবং খাদ্য খাওয়ান।[15]
উম্মু হাবীবার নিকট মহরের সম্পদ আসলে তা থেকে
৫০ মিছকাল তিনি আবরাহা নাম্নী বাদীকে প্রদান করেন, যে তাঁকে বিবাহের সুসংবাদ প্রদান করেছিল। বাদী তা নিতে অস্বীকার করলে উম্মু
হাবীবা (রা.) বলেন, আমার কাছে কোন সম্পদ নেই, আমাকে যা দেওয়া হয়েছে, তা থেকে তুমি এটা গ্রহণ করো। তখন আবরাহা বলল, বাদশাহ এ থেকে কোন কিছু গ্রহণ করতে কঠোরভাবে বারণ করেছেন। আর আমি তাঁর
অন্ন-বস্ত্রে জীবন যাপন করছি। তাছাড়া আমি মুহাম্মাদ (সা.)-এর দ্বীনের অনুসরণ করছি
এবং আমি আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করেছি। সুতরাং আপনার নিকট আমার অনুরোধ আপনি
রাসূলের নিকট পৌঁছে আমার সালাম দিবেন এবং তাঁকে অবহিত করবেন যে, আমি তাঁর দ্বীনের অনুসরণ করছি। এ কথা বলে সে ঐ মাল ফেরৎ
দিল।[16] অতঃপর সে আমার প্রতি আরো বন্ধুভাবাপন্ন হ’ল। সে-ই
আমাকে সফরের জন্য প্রস্ত্তত করে দিল। এরপর সে যখনই আমার নিকট আসতো, তখন বলতো, আপনার নিকট আমার
প্রয়োজন ভুলে যাবেন না। উম্মু হাবীবা বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকটে এসে আবরাহার কথা বললে তিনি মুচকি হাসলেন এবং সালামের
উত্তরে বললেন, ‘ওয়া আলাইহাস সালাম ওয়া
রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’।[17] বাদশাহ নাজ্জাশী বিবাহের পর উম্মু হাবীবাকে প্রস্ত্তত করার জন্য স্বীয়
স্ত্রীদের নির্দেশ দেন। তারা কনের প্রয়োজনীয় সাজ-সজ্জা, সুগন্ধি ও অনেক মাখন নিয়ে আসে। উম্মু হাবীবা সেসব
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য মদীনায় নিয়ে আসেন।[18]
বাদশাহ নাজ্জাশী নিজেই উম্মু হাবীবা (রা.)-কে
মদীনায় প্রেরণের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেন এবং তাঁকে শুরাহবিল ইবনু হাসনার সাথে
প্রেরণ করেন।[19] উম্মু হাবীবা (রা.) যখন মদীনায় আসেন তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৩০ বছরের কিছু বেশী।[20]
তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচাত বোন।
রাসূলের স্ত্রীদের মধ্যে তিনি ছিলেন রাসূলের বংশের অতি নিকটবর্তী। রাসূল (সা.)-এর
স্ত্রীদের মধ্য উম্মু হাবীবা (রা.)-কে সর্বাধিক মহর প্রদান করা হয়েছে। আর তাঁকে
রাসূল বিবাহ করেছেন যখন তিনি রাসূলের নিকট থেকে অনেক দূরে ছিলেন।[21]
আবিসিনিয়ায় উম্মু হাবীবা (রা.)-এর স্বামী
ধর্মান্তরিত হওয়ার পর মৃত্যুবরণ করলে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তাঁর পিতা আবূ
সুফিয়ান মক্কার প্রভাবশালী কুরাইশ নেতা এবং সে তখন কাফির। সে ছিল চরম ইসলাম
বিদ্বেষী এবং ইসলাম ও মুসলমানদের কঠিনতম শত্রু। আর উম্মু হাবীবা (রা.) মুসলিম।
এমতাবস্থায় মক্কায় তাঁর পরিবারের নিকটে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না। আবার ওবায়দুল্লাহ
বিন জাহাশের চেয়ে ভাল ও উম্মু হাবীবার জন্য উপযুক্ত কাউকে না পাওয়ায় রাসূলুল্লাহ (সা.)
তাকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান ও বিবাহ করেন।[22]
চেহারা ও চরিত্র মাধুর্য :
উম্মু হাবীবা (রা.) অতি সুদর্শনা ছিলেন। ছহীহ
মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, আবু সুফিয়ান (রা.) স্বীয় কন্যার রূপের গৌরব
করতেন। আবু সুফিয়ান বলতেন, عندى أحسن العرب وأجمله أم حبيبة بنت ابى سفيان، ‘আমার নিকটে আরবের উত্তম ও সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা হচ্ছে উম্মু
হাবীবা বিনতু আবী সুফিয়ান’।[23] উম্মু হাবীবা (রা.) যেমন সুশ্রী ছিলেন, তেমনি ছিলেন নির্মল ও নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী এবং খুব নম্র-ভদ্র স্বভাবের
মহিলা। সরলতা ও কোমলতা ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।[24]
ইবাদত-বন্দেগী ও সুন্নাতের
অনুসরণ :
উম্মু হাবীবা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর
বাণী অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করতেন এবং সাধ্যানুযায়ী নিজের জীবনে সেগুলো পালন
করতেন। তাঁর পিতা আবু সুফিয়ান পরবর্তীতে মুসলমান হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পিতার
ইন্তিকালের তিন দিন পরে উম্মু হাবীবা (রা.) খশবু চেয়ে নিয়ে স্বীয় গন্ডদেশ ও বাহুতে
লাগালেন এবং বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশ মুমিন মহিলার
জন্য তিন দিনের বেশী কারো জন্য শোক পালন করা জায়েয নয়। শুধু স্বামীর জন্য ৪ মাস ১০
দিন শোক পালন করবে।[25]
উম্মু হাবীবা (রা.) অতি ইবাদতগুযার ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতি দিন ১২ রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করবে, জান্নাতে তার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করা হবে’।[26] উম্মু হাবীবা একথা শুনেছিলেন। এরপর সারাজীবন নিয়মিত প্রতিদিন তিনি ১২ রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করতেন।[27]
ইলমী খেদমত :
ইলমে হাদীছে উম্মু হাবীবা (রা.) অসামান্য
অবদান রেখে গেছেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) ও উম্মুল মুমিনীন যয়নাব বিনতু জাহাশ (রা.)-এর
নিকট থেকে হাদীছ শ্রবণ করেন। তাঁর নিকট থেকে স্বীয় কন্যা হাবীবা, ভ্রাতা মু‘আবিয়া, উৎবাহ, ভ্রাতুষ্পুত্র
আব্দুল্লাহ ইবনু উৎবাহ ইবনে আবী সুফিয়ান, ভাগ্নে আবু সুফিয়ান ইবনু সাঈদ ইবনিল মুগীরাহ ইবনিল আখনাস আছ-ছাক্বাফী, তাঁর গোলাম সালিম ইবনু শাওয়াল, ইবনুল জাররাহ, ছাফিয়া বিনতু শায়বাহ, যয়নাব বিনতু উম্মে সালমা, উরওয়াহ ইবনে যুবাইর, আবু ছালেহ আস-সিমান, শুতাইর ইবনু শাকাল, আবুল মালীহ ‘আমীর
আল-হুযালী প্রমুখ হাদীছ বর্ণনা করেন।[28] তাঁর নিকট থেকে বর্ণিত হাদীছ সংখ্যা ৬৫টি।[29]
ইন্তিকাল :
উম্মু হাবীবা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর
ইন্তিকালের পরে অনেক দিন বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে উম্মু হাবীবা (রা.) আয়েশা (রা.)-কে
ডেকে বললেন, আমাদের মাঝে সতীনের সম্পর্ক ছিল। আমাদের কোন
ভুল-ত্রুটি হ’লে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করে দিন। অর্থাৎ
আপনিও আমাকে ক্ষমা করে দিন। তখন আয়েশা বললেন, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আপনাকে মুক্ত করে দিয়েছেন। উম্মু হাবীবা
বললেন,
আপনি আমাকে খুশি করেছেন। আল্লাহ আপনাকে খুশি
করুন। তিনি উম্মু
সালমার নিকটও অনুরূপ বলে পাঠান। উম্মু সালমাও ঐরূপ অভিন্ন কথা বলেন।[30] তিনি স্বীয় ভ্রাতা মু‘আবিয়া ইবনু আবী সুফিয়ানের খিলাফতকালে ৪২
মতান্তরে ৪৪ হিজরীতে ৭৩ বছর বয়সে মদীনায় ইন্তিকাল করেন।[31] মদীনার ‘মাকবারাহ বাবুছ ছাগীর’ নামক কবর স্থানে উম্মু সালমা আসমা বিনতু ইয়াযীদ
আল-আনছারিয়ার কবরের পার্শ্বে তাঁকে সমাহিত করা হয়।৩২
উপসংহার :
উম্মুল মুমিনীন উম্মু হাবীবা (রা.) ছিলেন
মুসলিম কন্যা-জায়া-জননীদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। ইসলামের জন্য তিনি যে ত্যাগ-তিতিক্ষা
ও অবিচলতার অনুপম আদর্শ রেখে গেছেন তা সকলের জন্য অনুসরণীয়। এই মহিয়সী মহিলার
জীবনী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমাদের মাতা-ভগ্নিগণ নিজেদেরকে আদর্শ রমনী হিসাবে
তৈরী করলে সমাজে দেড় হাযার বছর পূর্বের সেই সোনালী যুগের শান্তি-সুখ ফিরে আসবে।
কোন মেয়ে হবে না ধর্ষিতা, হবে না এসিড সন্ত্রাসের নির্মম শিকার। এ
নিপীড়িত সমাজে যৌতুকের বলি হবে না কোন মেয়ে, পিতা-মাতাও হবেন না বিবাহযোগ্য কন্যা ঘরে থাকার কারণে চিন্তিত-বিমর্ষ। অতএব
আসুন! আমরা উম্মু হাবীবার ঘটনাবহুল জীবনী থেকে ইবরাত হাছিল করি এবং আমাদের জীবনকে
ইসলামের আলোকে ঢেলে সাজাই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
[1]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, আল-ইছাবাহ ফী তাময়ীযিছ ছাহাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, তা.বি.), পৃঃ ৮৪।
[2]. হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড (বৈরুত :
মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ৩য় প্রকাশ, ১৪০৫ হিঃ/১৯৮৫ খৃঃ), পৃঃ ২১৮-১৯।
[3]. মুহাম্মাদ ইবনু সা‘দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০ খৃঃ/১৪১০ হিঃ), পৃঃ ৭৬; অলীউদ্দীন মুহাম্মাদ আল-খাতীব আত-তাবরিযী, আল-ইকমাল ফী আসমা-ইর রিজাল (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী, তা.বি.), পৃঃ ৫৯২।
[4]. আবু আবদুল্লাহ আল-হাকিম আন-নাইসাপুরী, আল-মুসতাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৪র্থ খন্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৪১১ হিঃ/১৯৯০ খৃঃ) পৃঃ ২২।
[5]. আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ৮৪।
[6]. মাহমূদ শাকির, আত-তারীখুল ইসলামী, ১ম ও ২য়
খন্ড (বৈরুত: আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৪১১হিঃ/১৯৯১খৃঃ), পৃঃ ৩৬০।
[7]. আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৭৬।
[8]. আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২২।
[9]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২২১; আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৭৭।
[10]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২২০; আল-বিদায়াহ ওয়ান
নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয, পৃঃ ১৪৫।
[11]. আবুল ফিদা ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয (কায়রো : দারুর রাইয়ান, ১ম প্রকাশ, ১৪০৮ হিঃ/১৯৮৮ খৃঃ), পৃঃ ১৪৬।
[12]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২২০।
[13]. আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২২-২৩; আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৭৮-৭৯; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, ২২০-২১।
[14]. সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ জরদানী, ফাতহুল আল্লাম বিশারহি মুরশিদিল আনাম, ১ম খন্ড (কায়রো : ৪র্থ প্রকাশ, ১৪১০ হিঃ/১৯৯৯খৃঃ), পৃঃ ২৩২।
[15]. আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ৮৪; আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২৩।
[16]. আত-তাবাকাতুল কুবরা ৮ম খন্ড, পৃঃ ৭৮; আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২৩; আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ৮৪।
[17]. আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২৩; আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড পৃঃ ৭৮।
[18]. আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২৩; আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড পৃঃ ৭৮।
[19]. আবূদাঊদ হা/২১০৭, ‘বিবাহ’ অধ্যায়, ‘মহর’ অনুচ্ছেদ; নাসাঈ, ‘বিবাহ’ অধ্যায় ‘মহরে ন্যায়নীতি’ অনুচ্ছেদ; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২২১।
[20]. আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড পৃঃ ৭৮।
[21]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২১৯।
[22]. আত-তরীখুল ইসলামী, ১ম ও ২য় খন্ড, পৃঃ ৩৬০।
[23]. ছহীহ মুসলিম হা/৬৩৫৯ ‘কিতাবুল ফাযায়িল’ ‘আবু সুফিয়ানের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ।
[24]. তালিবুল হাশেমী, মহিলা সাহাবী, অনুবাদ : আবদুল
কাদের (ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী, ২য় প্রকাশ, ১৯৯০), পৃঃ ৬৯।
[25]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত
হা/৩৩৩০, ৩৩৩১ ‘বিবাহ’ অধ্যায়, ‘ইদ্দত’ অনুচ্ছেদ।
[26]. মুসলিম, তিরমিযী, মিশকাত হা/১১৫৯।
[27]. মহিলা সাহাবী, পৃঃ ৭০।
[28].আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ৮৫; সিরারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২১৯।
[29]. সিয়ারু অ‘ালামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২১৯।
[30]. আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২৪; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালাহ, ২য় খন্ড, পৃঃ ২২২।
[31]. আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৮; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালাহ, ২য় খন্ড, পৃঃ ২২২।
৩২. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২২০।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(০৯)
উম্মুল মুমিনীন জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারিছ
(রা.)
ভূমিকা :
জুওয়াইরিয়া (রা.) ছিলেন বনু মুছতালিক-এর
সরদারের কন্যা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ইবাদতগুযার ও আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত এক
সম্ভ্রান্ত মহিলা। তিনি তাঁর বংশের জন্য খোশনসীবের কারণ ছিলেন। তাঁর জন্যই তাঁর
বংশের যুদ্ধবন্দীরা মুক্তি লাভ করেছিল। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় লাভের পর
তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করে চলেছেন জীবনের পরতে পরতে।
যখনই তিনি সময় পেয়েছেন নফল ইবাদতে সে সময় ব্যয় করার নিরন্তর চেষ্টা করেছেন।
রাসূলপত্নী উম্মুল মুমিনীন জুওয়াইরিয়া (রা.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী আমরা এখানে আলোচনা
করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
নাম ও বংশ পরিচিতি :
তাঁর নাম জুওয়াইরিয়া, পিতার নাম আল-হারিছ।[1] তাঁর পূর্ব নাম ছিল ‘বাররাহ’। রাসূলুল্লাহ (সা.) সে নাম পরিবর্তন করে জুওয়াইরিয়া রাখেন।[2] তিনি খুযা‘আহ গোত্রের বনু মুছতালিকের সাথে সম্পর্কযুক্ত
ছিলেন। তাঁর পূর্ণ বংশ পরিচয় হচ্ছে জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারিছ ইবনে আবী যিরার ইবনে
হাবীব ইবনে আয়েয ইবনে মালিক ইবনে জুয়াইমা ইবনিল মুছতালিক।[3]
জন্ম ও শৈশব :
জুওয়াইরিয়া (রা.)-এর সঠিক জন্ম তারিখ ও সাল
জানা যায় না। তবে ৫৬ হিজরী সালে ৬৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন।[4] সে হিসাবে তাঁর জন্ম ৬২৩ খৃষ্টাব্দে বলে ধরে নেয়া যায়। মুরাইসী‘ এলাকার বনু মুছতালিক গোত্রে তাঁর শৈশব কেটেছে। কিন্তু তাঁর
শৈশবকাল সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না।
প্রথম বিবাহ :
জুওয়াইরিয়া (রা.)-এর চাচাত ভাই মুসাফা‘ ইবনু ছাফওয়ান ইবনে আবিশ শুফারের সাথে তাঁর প্রথম বিবাহ
সম্পন্ন হয়। বনু মুছতালিকের যুদ্ধে তিনি নিহত হন।[5]
রাসূলের সাথে বিবাহপূর্ব ঘটনা :
যয়নাব বিনতু জাহাশকে বিবাহের পরে রাসূলুল্লাহ
(সা.) বহু বড় বড় ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়েন। হিজরী ৫ম বছরের অধিকাংশ সময় কেটে যায় এসব
ঘটনায় ব্যস্ত থেকে। শাওয়ালের শেষ দিকে এবং যুলকা‘দাহ মাসের প্রথমে খন্দকের যু্দ্ধ সংঘটিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) তিন হাযার
মুসলিম সৈন্য নিয়ে খন্দকের অপর প্রান্তে থেকে ইহুদী ও মুশরিকদের সম্মিলিত বাহিনীর
১০ হাযার সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। বনু কিনানাহ, তাহামাহ অধিবাসী, গাত্বফান গোত্র ও নজদবাসীও ঐ দলে শামিল ছিল। এ সম্মিলিত বাহিনী চতুর্দিক থেকে
মুসলমানদের আক্রমণ করে। মদীনার ইহুদীরা চুক্তি ভঙ্গ করে। যেসব মুনাফিক কেবল গনীমত
লাভের আশায় যুদ্ধে যোগদান করেছিল, তারা সম্ভাব্য
আক্রমণের তীব্রতা অনুমান করে দলত্যাগ করে বাড়ী ফিরে যায়। ২৭ দিন মুসলিম বাহিনী
মুশরিকদের দ্বারা অবরুদ্ধ থাকে। অতঃপর আল্লাহ মুসলমানদের সাহায্য করেন। তারা বিজয়ী
বেশে বাড়ী এসে অস্ত্র খুলে রাখার পূর্বেই নির্দেশ আসে ইহুদী বনু কুরাইযা গোত্র
আক্রমণের। যুলকা‘দার শেষে ও যুলহিজ্জার প্রথমে ২৫ দিন মুসলিম
বাহিনী ঐ গোত্র অবরোধ করে রাখেন। এরপর বনু লিহয়ান, যী কারদ, প্রভৃতি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অতঃপর মুসলমানরা
মদীনায় ফিরে আসার পরে এক মাসও অতিক্রান্ত হয়নি, এমতাবস্থায় খবর আসল যে, খুযা‘আহ গোত্রের
একটি কবীলা বনু মুছতালিক আল-হারিছ ইবনু আবী যিরারের নেতৃত্বে যুদ্ধের জন্য তৈরী
হচ্ছে।[6] রাসূলুল্লাহ (সা.) এ খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বুরাইদা আল-আসলামীকে প্রেরণ
করলেন। তিনি এসে সংবাদ দিলেন যে, বনু মুছতালিক
অস্ত্র-শস্ত্র ক্রয় করে রাসূলের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য প্রস্ত্তত হয়েছে এবং তাদের
অগ্রবর্তী বাহিনী সামনে অগ্রসর হয়েছে।[7]
রাসূলুল্লাহ (সা.) এ খবর পেয়ে যায়েদ বিন
হারিছাকে মদীনার দেখা-শুনার জন্য ভারপ্রাপ্ত গভর্নর নিযুক্ত করে ৪র্থ মতান্তরে ৫ম
হিজরীর ২রা শা‘বান সোমবার ৭০০ জন মুজাহিদ নিয়ে বনু
মুছতালিককে প্রতিহত করতে বের হন। মদীনা থেকে ৯ মাইল দূরে বনু মুছতালিকের ‘মুরাইসী’ নামক কুয়ার কাছে পৌঁছে
রাসূলুল্লাহ অবস্থান নেন। সেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য একটি চামড়ার তাবু
টানানো হয়। এ সফরে তাঁর সাথে আয়েশা ও উম্মু সালমা (রা.) ছিলেন। মুজাহিদগণ কুয়ার
নিকটে সমবেত হ’লেন, তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত হ’লেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে সারিবদ্ধ করলেন। মুহাজিরদের পতাকা আবু বকর (রা.) বা
আম্মার ইবনু ইয়াসার-এর নিকট এবং আনছারদের পতাকা সা‘দ ইবনু উবাদাহর নিকট অর্পণ করলেন। বনু মুছতালিকের পতাকাবাহী ছিল ছাফওয়ান ইবনু
যীশ শুফরাহ। রাসূলুল্লাহ (সা.) ওমর (রা.)-কে নির্দেশ দিলেন, একথা প্রচারের জন্য যে, ‘তোমরা বল, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তাহ’লে তোমাদের জান-মাল নিরাপদে থাকবে’। ওমর (রা.) ঘোষণা
করলে বনু মুছতালিকের লোকেরা এই স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানাল। ফলে যুদ্ধ শুরু হ’ল। এ যুদ্ধে একজন মুজাহিদ শহীদ হন। পক্ষান্তরে বনু
মুছতালিকের ১০জন নিহত হয় এবং বাকী সবাই বন্দী হয়।[8] এই বন্দীদের মধ্যে জুওয়াইরিয়া (রা.)ও ছিলেন।[9]
রাসূলের সাথে বিবাহ :
বনু মুছতালিক যুদ্ধে প্রাপ্ত গনীমতের মালের এক-পঞ্চমাংশ
আল্লাহ ও রাসূলের জন্য পৃথক করার পর অবশিষ্ট সম্পদ নবী করীম (সা.) যোদ্ধাদের মধ্যে
বণ্টন করলেন। অশ্বারোহীকে দু’ভাগ এবং পদাতিককে
একভাগ করে দিলেন। জুওয়াইরিয়া বিনতু হারিছ পড়লেন ছাবিত ইবনু কায়েস আশ-শাম্মাস
আল-আনছারীর ভাগে। গোত্র প্রধানের মেয়ে হওয়ার কারণে দাসী হয়ে থাকা তাঁর জন্য অসম্ভব
ছিল। তিনি এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই তিনি ছাবিত ইবনু কায়েসের সাথে ৯ উকিয়া
স্বর্ণের বিনিময়ে মুক্ত হওয়ার চুক্তি করেন। অতঃপর তিনি সাহায্যের জন্য রাসূলুল্লাহ
(সা.)-এর খিদমতে উপস্থিত হন। তিনি রাসূলের দরবারে এসে বলেন,
يا رسول الله أنا جويرية بنت الحارث بن أبي ضرار سيد قومه، وقد
أصابني من البلاء ما لم يخف عليك فوقعت في السهم لثابت بن قيس بن الشماس أو لإبن
عم له، فكاتبته على نفسي فجئتك أستعينك على كتابتي.
‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি জুওয়াইরিয়া বিনতুল
হারিছ ইবনে আবী যিরার যিনি তার কওমের সর্দার। আমার প্রতি যে বিপদ আপতিত হয়েছে, তা আপনার কাছে গোপনীয় নয়। আমি ছাবিত ইবনু কায়েস ইবনে
শাম্মাস বা তার চাচাত ভাইয়ের অংশে পড়েছি। আমি তার সাথে অর্থের বিনিময়ে মুক্তির
চুক্তি করেছি। তাই আমার চুক্তির ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য আপনার নিকট এসেছি’।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি কি তোমার জন্য এর চেয়ে উত্তম কিছু করব না? জুওয়াইরিয়া বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেটা কি? তিনি বললেন, আমি তোমার পক্ষ থেকে তোমার চুক্তির অর্থ পরিশোধ করে দেব এবং
তোমাকে বিবাহ করব। জুওয়াইরিয়া বললেন, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করলেন। এ খবর শুনে
ছাহাবায়ে কেরাম বনু মুছতালিকের ১০০ জন বন্দীর সবাইকে মুক্ত করে দিলেন।[10] আয়েশা (রা.) বলেন, فما أعلم امرأة كانت أعظم بركة على قومها منها- ‘আমি জানি না তাঁর বংশের জন্য তাঁর চেয়ে অধিক কল্যাণময়ী কোন
মহিলা ছিল কি-না’।[11] বনু মুছতালিকের যুদ্ধবন্দী মুক্তিই ছিল তাঁর বিবাহের মোহর।[12]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, জুওয়াইরিয়া (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলেন, ان أزواجك يفخرن علي يقلن لم
يزوجك رسول الله صلى الله عليه وسلم إنما أنت ملك يمين، فقال رسول الله صلى الله
عليه وسلم ألم أعظم صداقك ألم أعتق أربعين رقبة من قومك- ‘নিশ্চয়ই আপনার স্ত্রীগণ আমার উপর গর্ব করে। তারা বলে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) তোমাকে বিবাহ করেননি, বরং ডান হাতের (বিজিত) সম্পদ। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি কি তোমাকে সবচেয়ে অধিক মোহর প্রদান করিনি? আমি কি তোমার কওমের ৪০ জন দাসকে মুক্ত করিনি’? [13]
জুওয়াইরিয়া (রা.)-কে তাঁর পিতার
ফিরিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা:
জুওয়াইরিয়া (রা.)-এর পিতা হারেছ নবী করীম (সা.)-এর
নিকটে এসে বললেন, আমার মেয়ে বন্দী হয়ে এসেছে। কিন্তু সে
অন্যান্য মহিলার মত দাসী হ’তে পারে না। কেননা আমি ঐ কওমের সম্মানিত
ব্যক্তিদের অন্যতম। সুতরাং আপনি তাকে ছেড়ে দিন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমরা যদি তাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার প্রদান করি তাহ’লে সেটা কি উত্তম হয় না? তখন হারিছ বললেন, হ্যাঁ, আর আমি তার মুক্তিপন প্রদান করছি। অতঃপর তিনি জুওয়াইরিয়া (রা.)-এর নিকটে এসে
বললেন,
ঐ লোকটি তোমাকে যে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার
এখতিয়ার দিয়েছে। সুতরাং তুমি আমাদেরকে লাঞ্ছিত কর না। জুওয়াইরিয়া (রা.) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কেই এখতিয়ার করছি। তখন হারিছ বললেন, আল্লাহর কসম! তুমি আমাদেরকে অপমানিত করলে।[14] উল্লেখ্য যে, পরবর্তীতে তাঁর পিতা আল-হারিছ ইসলাম গ্রহণ
করেন।[15]
[চলবে]
[1]. মাহমূদ শাকির, আত-তারীখুল ইসলামী, ১ম ও ২য় খন্ড (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৯৯১ খ্রীঃ/১৪১১ হিঃ), পৃঃ ৩৬০।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২১৪০।
[3]. মুহাম্মাদ ইবনু সা‘দ, আত-ত্বাবাকাতুল কুবরা, তাহক্বীক্ব : মুহাম্মাদ আব্দুল কাদের আত্বা, ৮ম খন্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০খ্রীঃ/১৪১০হিঃ), পৃঃ ৯২।
[4]. আল-হাকিম নাইসাপুরী, আল-মুস্তাদরাক
আলাছ ছাহীহাইন. তাহক্বীক্ব : মুছতফা আব্দুল কাদের আত্বা, ৪র্থ খন্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০খ্রীঃ/১৪১১হিঃ), পৃঃ ২৮-২৯।
[5]. হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড (বৈরুত : মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ৩য় প্রকাশ, ১৪০৫হিঃ/১৯৮৫ খ্রীঃ), পৃঃ ২৬২; আত-ত্বাবাকাতুল
কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯২।
[6]. ড. আয়েশা আব্দুর রহমান বিনতুশ শাত্বী, তারাজিমু সাইয়্যেদাতি বায়তিন নবুওয়াত (বৈরুত : দারুর রাইয়্যান লিত তুরাছ, তা.বি.), পৃঃ ৩৫৬-৫৭।
[7]. আবু বকর আহমাদ ইবনুল হুসাইন আল-বায়হাক্বী, দালাইলুন নবুওয়াত, তাহক্বীক্ব : ড. আব্দুল মু‘তী কালা‘জী, ৪র্থ খন্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৯৮৫খ্রীঃ/১৪০৫হিঃ), পৃঃ ৪৭।
[8]. দালাইলুন নবুওয়াত, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৪৪-৪৭।
[9]. তারাজিমু সাইয়্যেদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩৫৭।
[10]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৬৫।
[11]. ঐ, পৃঃ ২৬৩।
[12]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৬২; মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২৮; আত-ত্বাবাকাত, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯২-৯৩।
[13]. মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২৭।
[14]. আত-ত্বাবাকাত, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯৩; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৬৩, সনদ ছহীহ; হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব, ১২শ খন্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৪খ্রীঃ/ ১৪১৫হিঃ), পৃঃ ৩৫৮।
[15]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৬৪।
জুওয়াইরিয়া (রা.)-এর স্বপ্ন :
জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ
(সা.)-এর মুরাইসী‘ অভিযানের তিন দিন পূর্বে
আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, চাঁদ মদীনা হ’তে
কিছুটা সরে এসেছে, এমনকি আমার কক্ষে পতিত
হয়েছে। এ ঘটনা আমি কাউকে জানাতে অপসন্দ করলাম। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.) অভিযান
উপলক্ষে আসলেন। অতঃপর আমরা যখন বন্দী হয়ে মদীনায় নীত হ’লাম, তখন
আমি স্বপ্নে দেখা ঘটনা বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার প্রত্যাশা করলাম। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.)
আমাকে মুক্ত করে বিবাহ করলেও আমি আমার কওমের কাউকে উক্ত স্বপ্নের কথা বলিনি। আমি
কাউকে বলেছি এরূপ আমার স্মরণেও ছিল না। কিন্তু মুসলমানরা যখন আমার কওমের সবাইকে
মুক্ত করে দিল, তখন আমার জনৈক চাচাত বোন
আমাকে উক্ত খবর বললে, আমি আল্লাহ্র প্রশংসা
করলাম।১
এ
স্বপ্নের পরে রাসূলের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ছিল তার হৃদয়ে লালিত বাসনা ও
কামনা। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন তখন তিনি আনন্দে
আপ্লুত হন। তখনকার অবস্থা ড. আয়েশা আশ-শাত্বী এভাবে বর্ণনা করেন, فةألق وجهها الجميل بفرحة
غامرة‘তখন তার সুন্দর মুখমন্ডল সীমাহীন খুশির
বন্যায় চমৎকৃত হয়ে ওঠে’।২
বিবাহের
সন-তারিখ :
রাসূলুল্লাহ
(সা.) জুওয়াইরিয়া (রা.)-কে ৫ম হিজরীতে বিবাহ করেন।৩ এ সময় তার বয়স হয়েছিল ২০ বছর। এ সম্পর্কে
তিনি নিজেই বলেন, تزوجني رسول الله صلى الله عليه وسلم وأنا
بنة عشرين سنة-‘রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বিবাহ করেন, তখন
আমি ছিলাম ২০ বছরের মেয়ে’।৪
বিবাহের
কারণ :
জুওয়ারিয়া
(রা.)-কে বিবাহ করার পিছনে দ্বীনী কারণই ছিল প্রধান। নবী করীম (সা.) বুঝতে
পেরেছিলেন যে, গোত্রপ্রধানের কন্যার সাথে
আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হ’লে মুসলমানদের সাথে বনু
মুছতালিকের শত্রুতার চির অবসান ঘটবে। সেটাই ঘটেছিল। এরপর বনু মুছতালিক গোত্রের কেউ
কোন দিন রাসূল (সা.)-এর বিরোধিতা করেনি;
বরং
ক্রমান্বয়ে তারা ইসলামে দীক্ষিত হয়।৫ এছাড়া জুওয়াইরিয়া (রা.)-কে বিবাহের আরেকটি
কারণ হচ্ছে সর্দার কন্যা হিসাবে তাঁকে অপমান,
লাঞ্ছনার
হাত থেকে রক্ষা করা, তাঁকে যোগ্যস্থানে রেখে
তাঁর সম্মান বজায় রাখা এবং দাসত্বের কবল থেকে মুক্ত রেখে তাঁকেও অন্যান্য স্বাধীনা
মহিলাদের সমপর্যায়ভুক্ত করা।৬
চেহারা
ও চারিত্রিক গুণাবলী :
জুওয়াইরিয়া
(রা.) অত্যন্ত আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারিণী ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে আয়েশা (রা.) বলেন, وكانت حلوة ملاحة لا يراها أحد
إلا أخذت بنفسه، فأتت رسول الله صلى الله عليه وسلم تستعينه فكرهتها- يعني لحسنها،‘তিনি এতই কমনীয়া ও মিষ্টভাষিণী ছিলেন যে, তাকে
যে দেখতো সে তাকে হৃদয়ে স্থান না দিয়ে পারতো না। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকটে
সাহায্যের জন্য আসলেন। আমি তার সুন্দর চেহারার কারণে তাকে অপসন্দ করলাম’।৭ হাফিয যাহাবী বলেন, وكانت من أجمل النساء‘তিনি ছিলেন অত্যধিক সুন্দরী মহিলা’।৮
তাঁর
চেহারা ও গুণাবলীর বর্ণনা অন্যত্র এভাবে এসেছে,
একদা
রাসূলুল্লাহ (সা.) আয়েশার কক্ষে উপবিষ্ট ছিলেন। এমতাবস্থায় আয়েশা শুনতে পেলেন যে, কোন
এক মহিলা রাসূলের সাথে সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করছে। আয়েশা (রা.) দরজার দিকে
গিয়ে দেখেন, ‘সেখানে কমনীয়া এক যুবতী
দন্ডায়মান, অসম্ভব মিষ্টি-মধুর তার
চেহারা। যে তাকে দেখবে সে তাকে হৃদয়ে স্থান না দিয়ে পারবে না। তার বয়স ২০ বছরের
কাছাকাছি। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা ও ভয়ে সে
কাঁপছে। আর তার এ আপ্লুতভাব তার প্রাণবন্ততা ও মোহনীয়তাকে আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছে।৯
জুওয়াইরিয়া
(রা.) ছিলেন অত্যন্ত আত্মসম্মানবোধ সম্পন্না ও বিনয়ী মহিলা। যেমন ড. আয়েশা
আশ-শাত্বী বলেন, ودخلت الشبابة المليحة فقالت فى ضراعة تمازجها عزة، ‘আর লাবণ্যময়ী যুবতী গৃহে
প্রবেশ করে (তার বক্তব্য) বলল। যাতে ছিল বিনয়-নম্রতা ও ইয্যত-সম্মানের সংমিশ্রণ।১০ এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বিবাহের
প্রস্তাব দিলে তিনি বললেন, وهى لاتكاد تصدق انها قد نجت من الضياع والهوان،‘আর এটা হয়তো ছাদাক্বা হবে না, এটা
নীচতা, হীনতা ও অপমান-লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি দেবে’।১১
ইবাদত-বন্দেগী
:
জুওয়াইরিয়া
(রা.) অত্যন্ত ইবাদতগুযার ছিলেন। ইবাদতের প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তিনি দিনের অধিকাংশ
সময় ইবাদতে মশগূল থাকতেন। তিনি বলেন,
একদা
সকালে রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার নিকটে আসলেন,
আমি
তখন তাসবীহ-তাহলীল করছিলাম। অতঃপর কোন এক প্রয়োজনে তিনি চলে গেলেন। দ্বিপ্রহরে
তিনি আবার ফিরে এসে বললেন, এখনও তুমি বসে আছ? আমি
বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন,
আমি
কি তোমাকে এমন কিছু বাক্য শিক্ষা দেব না,
যেগুলি
তুমি যা বলছ, তার সাথে তুলনা করা যেতে
পারে কিংবা তুমি এ যাবৎ যা বলছ তার সাথে এটা ওযন করা যেতে পারে? এরপর
তিনি আমাকে নিম্নের দো‘আটি শিখালেন, سُبْحَانَ اللهِ بِحَمْدِهِ عَدَدَ
خَلْقِهِ، سُبْحَانَ اللهِ زِنَةَ عَرْشِهِ، سُبْحَانَ اللهِ رِضَا نَفْسِهِ،
سُبْحَانَ اللهِ مِدَادَ كَلِمَاتِهِ-‘আল্লাহ্র পবিত্রতা বর্ণনা করছি তাঁর প্রশংসা
সহকারে তাঁর সৃষ্টি সংখ্যার সমপরিমাণ,
আল্লাহ্র
পবিত্রতা বর্ণনা করছি তাঁর আরশের ওযন পরিমাণ,
আল্লাহ্র
পবিত্রতা বর্ণনা করছি তাঁর ইচ্ছার সংখ্যানুপাতে ও আল্লাহ্র পবিত্রতা বর্ণনা করছি
তাঁর বাক্য সমূহের সংখ্যা পরিমাণ’। শব্দগুলি তিনবার বলতে বললেন।১২
অপর
একটি বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (ছ্ঃ)
জুওয়াইরিয়া (রা.)-এর নিকটে আসলেন, তিনি ছায়েম ছিলেন। নবী
করীম (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি গতকাল ছিয়াম
রেখেছিলে? তিনি বললেন, না।
নবী করীম (সা.) বললেন, আগামীকাল কি ছিয়াম পালন
করার ইচ্ছা কর? তিনি বললেন, না।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তাহ’লে
ইফতার কর (ছিয়াম ভেঙ্গে ফেল)’।১৩
সম্পদের
অংশ দান :
রাসূলুল্লাহ
(সা.) তাঁর অন্যান্য স্ত্রীর মত জুওয়াইরিয়া (রা.)-এর উপর পর্দা পালনের বিধান আরোপ
করেন এবং অন্যদের মত তার জন্য সম্পদের অংশ নির্ধারণ করেন।১৪ রাসূলুল্লাহ (সা.) খায়বার যুদ্ধে প্রাপ্ত
গনীমতের সম্পদ থেকে ৮০ অসাক১৫ খেজুর ও ২০ অসাক যব বা গম প্রদান করেন।১৬
ইলমে
হাদীছে অবদান :
জুওয়াইরিয়া
(রা.)-এর নিকট থেকে ৭টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে ১টি ছহীহ বুখারীতে এবং ২টি
ছহীহ মুসলিমে উল্লিখিত হয়েছে।১৭ তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট থেকে হাদীছ
শ্রবণ করেন ও বর্ণনা করেন।১৮ তাঁর নিকট থেকে আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (মৃঃ
৬৮হিঃ/৬৮৭খ্রীঃ), আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (মৃঃ ৭৩/৬৯২), ওবায়দ
ইবনুস সিবাক, তুফায়ল, আবু
আইউব মুরাগী (৮০ হিঃ/৬৯৯খ্রীঃ), কুলছূম ইবনু মুছতালিক, আব্দুল্লাহ
ইবনু শাদ্দাদ ইবনিল হাদ (মৃঃ ৮১হিঃ/৭০০খ্রীঃ),
কুরায়ব, মজাহিদ
(রহঃ) প্রমুখ হাদীছ বর্ণনা করেছেন।১৯
মৃত্যু
:
জুওয়াইরিয়ার
গর্ভে রাসূল (সা.)-এর কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর
ইনতিকালের পরে অনেকদিন জীবিত ছিলেন।২০ জুওয়াইরিয়া (রা.)-এর মৃত্যুকাল নিয়ে মতভেদ
রয়েছে। তিনি ৫০ মতান্তরে ৫৬ হিজরী সালে ইনতিকাল করেন।২১ তাঁর মৃত্যুসাল ইবনুল জাওযী ৫০ হিজরী, অন্যরা
৫৫ হিজরী এবং ওয়াকেদী ৫৬ হিজরী বলে উল্লেখ করেছেন।২২ তবে বিশুদ্ধ মতে তিনি ৫৬ হিজরীর রবীউল আউয়াল
মাসে মু‘আবিয়া ইবনু আবী সুফিয়ানের খিলাফতকালে ৬৫ বছর
মতান্তরে ৭০ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন।২৩ মদীনার তৎকালীন গভর্ণর মারওয়ান ইবনুল হাকাম
তাঁর জানাযা ছালাত পড়ান।২৪
উপসংহার
:
জুওয়াইরিয়া
বিনতুল হারিছ (রা.) সর্দারকন্যা হ’লেও তিনি ছিলেন অতীব বিনয়ী
ও নম্র স্বভাবের লজ্জাশীলা মহিলা। আত্মসম্মানবোধ তাঁর মাঝে ছিল কিন্তু গর্ব-অহংকার
তাঁর মাঝে ছিল না। কোন দোষ-ত্রুটি তাঁর নির্মল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে ম্লান করতে
পারেনি। তিনি তাঁর অবসরকে ইবাদতেই কাটাতেন। রাসূলের সকল আদেশকে শিরোধার্য করে তাঁর
যথাসাধ্য অনুসরণ করতেন। এক কথায় তিনি ছিলেন রাসূলের জন্য নিবেদিতা। তাই তাঁর
জীবনীতে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। আমাদের কন্যা-জায়া-জননীরা তাঁর
আদর্শকে উপজীব্য করে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে পারলে জগৎসংসারে তাদের পারিবারিক জীবন
হবে সুখ-শান্তিময় এবং পরকালে লাভ করবে নাজাত। আল্লাহ আমাদেরকে এই মহিয়ষী মহিলার
জীবনী থেকে ইবরাত হাছিলের তাওফীক্ব দিন- আমীন!
১. মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড,
পৃঃ
২৯; দালাইলুন নবুওয়াত, ৪র্থ খন্ড,
পৃঃ
৫০।
২. তারাজিমু সাইয়্যেদাতি
বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩৫৮।
৩. সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ
আব্দুল্লাহ আল-জরদানী, ফাতহুল আল্লাম বিশারহি
মুরশিদিল আনাম, ১ম খন্ড, (কায়রো : দারুস সালাম, ৪র্থ প্রকাশ,
১৪১০হিঃ/
১৯৯০ খ্রীঃ), পৃঃ ২৩৮।
৪. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা,
২য়
খন্ড, পৃঃ ২৬৩; মুস্তাদরাক,
৪র্থ
খন্ড, পৃঃ ২৮-২৯।
৫. মনসুর আহমাদ, বহু বিবাহ ইসলাম ও মুহাম্মদ (সা) (ঢাকা : তাসনিম
পাবলিকেসন্স, ১৯৯৫), পৃঃ ২৪৮-৪৯।
৬. ছালাহুদ্দীন মকবুল আহমাদ, আল-মারআতু বায়না হিদায়াতিল ইসলাম ওয়া গাওয়াতিল ই‘লাম (কুয়েত : দারু ইলাফ, ১ম প্রকাশ,
১৯৯৭
খ্রীঃ/১৪১৮হিঃ), পৃঃ ২৬৮।
৭. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা,
২য়
খন্ড, পৃঃ ২৬৫।
৮. তদেব, পৃঃ ২৬১।
৯. তারাজিম, পৃঃ ৩৫৭।
১০. ঐ, পৃঃ ৩৫৮।
১১. ঐ, পৃঃ ৩৫৮।
১২. মুসলিম হা/২৭২৬, ‘যিকর ও দো‘আ’ অধ্যায়;
মিশকাত
হা/২৩০১।
১৩. বুখারী, ৪/২০৩,
‘ছাওম’ অধ্যায়,
‘জুম‘আর দিন ছিয়াম পালন’ অনুচ্ছেদ;
আবূদাউদ, হা/২৪২২,
‘ছাওম’ অধ্যায়।
১৪. মুস্তাদরাক ৪/২৯; ত্বাবাকাত,
৮/৯৪
পৃঃ।
১৫. ৬০ ছা‘তে এক অসাক। আর এক ছা‘র পরিমাণ হচ্ছে আড়াই কেজি।
১৬. ত্বাবাকাত, ৮/৯৫ পৃঃ।
১৭. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা,
২য়
খন্ড, পৃঃ ২৬৩।
১৮. তাহযীবুত তাহযীব, ১২শ খন্ড,
পৃঃ
৩৫৮।
১৯. হাফেয ইবনু হাজার
আসক্বালানী, আল-ইছাবাহ, ৮ম খন্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তা. বি.),
পৃঃ
৪৪; তাহযীবুত তাহযীব, ১২শ খন্ড,
পৃঃ
৩৫৮।
২০. আত-তারীখুল ইসলামী, ১ম ও ২য় খন্ড,
পৃঃ
৩৬০।
২১. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা,
২য়
খন্ড, পৃঃ ২৬৩, তাহযীবুত তাহযীব,
১২শ
খন্ড, পৃঃ ৩৫৮।
২২. হাফেয ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৪র্থ খন্ড,
৫ম
জুয (কায়রো : দারুর রাইয়ান ১ম প্রকাশ,
১৪০৮হিঃ/১৯৮৮খ্রীঃ), পৃঃ ৫১;
তাহযীবুত
তাহযীব, ১২শ খন্ড, পৃঃ ৩৫৮।
২৩. তারাজিম, পৃঃ ৩৬২।
২৪. আত-ত্বাবাকাত, ৮ম খন্ড,
পৃঃ
৯৫; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা,
২য়খন্ড, পৃঃ ২৬৩;
তাহযীবুত
তাহযীব, ১২শ খন্ড, পৃঃ ৩৫৮।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(১০)
উম্মুল মুমিনীন ছাফিয়া (রা.)
নবীপত্নী ও সর্দার
দুহিতা ছাফিয়া (রা.) ছিলেন অতীব জ্ঞানী ও বিদুষী মহিলা। ইসলাম গ্রহণের পরে দ্বীনের
অনুসরণ ছিল তাঁর একমাত্র ব্রত। অতুলনীয় স্বভাব-চরিত্র ও অনুপম আচার-ব্যবহারের
অধিকারী ছিলেন তিনি। বিনয় ও নম্রতা ছিল তাঁর চরিত্রের ভূষণ। রাসূলের প্রতি তার
অকৃত্রিম ভালবাসা, তাঁর পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ ও দ্বীনের প্রতি
সীমাহীন অনুরাগ ছিল অনুকরণীয়। বংশ কৌলিন্যে, আভিজাত্যে, ধন-সম্পদে যেমন তিনি ছিলেন শীর্ষস্থানীয়া, তেমনি ছিলেন ইবাদতগুযার, দানশীলা ও দায়িত্ব সচেতন। রাসূলপত্নী উম্মুল মুমিনীন এই মহিলা ছাহাবীর জীবন
চরিত এখানে আমরা সংক্ষেপে আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
নাম ও বংশ পরিচয় : তাঁর প্রকৃত নাম যয়নাব। কিন্তু ৭ম হিজরীতে খায়বার যুদ্ধে গনীমত বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হিসাবে তিনি মুসলমানদের নিকট নীত
হন এবং বণ্টনে রাসূলের ভাগে পড়েন। সেকালে আরবে নেতা বা বাদশার অংশের যুদ্ধলব্ধ
সম্পদকে ‘ছাফিয়া’ বলা হ’ত। এ থেকেই ‘ছাফিয়া’ নামে তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন।[1]
তাঁর পূর্ণ বংশ পরিচয় হচ্ছে- ছাফিয়া বিনতু
হুয়াই ইবনে আখতাব ইবনে সা‘ঈদ ইবনে ছা‘লাবা ইবনে ওবায়দ ইবনিল খাযরাজ ইবনে আবী হাবীব ইবনিন নাযর ইবনে নাহহাম ইবনে
ইয়ানহূম।[2] আল্লামা ইবনু হাজার আসক্বালানী ও হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী ‘আখতাব ইবনে সা‘ঈদ’-এর স্থলে ‘আখতাব ইবনে সা‘ইয়াহ’[3] এবং ইবনু সা‘দ ‘সা‘ঈদ ইবনে ছা‘লাবা’-এর স্থলে ‘সা‘ইয়াহ ইবনে ‘আমের’ উল্লেখ করেছেন।[4] তাঁর পিতা ছিলেন মূসা (আঃ)-এর ভাই হারূণ বিন ইমরান (রা.)-এর অধস্তন পুরুষ।[5] তাঁর বংশধারা ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত পৌঁছেছে। যেমন হাফেয শামসুদ্দীন উল্লেখ
করেন যে, তিনি লাভী ইবনে ইসরাঈল (ইয়াকূব) ইবনে ইসহাক
ইবনে ইবরাহীমের বংশধর।[6] তাঁর মাতার নাম বাররা বিনতু সামওয়াল।[7] তিনি ছিলেন মদীনার ইহুদীগোত্র বনু নাযীরের মিত্র গোত্র বনু কুরায়যার রিফা‘আহ ইবনু সামওয়ালের বোন।[8]
ছাফিয়া (রা.)-এর পিতৃ ও মাতৃবংশ যথাক্রমে বনু
নাযীর ও বনু কুরায়যা অন্যান্য আরবীয় ইহুদী বংশের চেয়ে অধিক সম্মান ও মর্যাদার
অধিকারী ছিল। তারা প্রাচীনকাল থেকেই আরবের উত্তরাঞ্চলে বসবাস করত। ছাফিয়া (রা.)-এর
পিতা হুয়াই ইবনু আখতাব ছিলেন গোত্রের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব এবং সর্বজন সম্মানিত
ও মান্যবর। অপরদিকে তাঁর নানা সামওয়ালও সমগ্র আরব উপদ্বীপে বীরত্ব ও সাহসিকতায়
প্রসিদ্ধ ছিলেন। ফলে ছাফিয়া (রা.) পিতৃ ও মাতৃ উভয় দিক দিয়েই ছিলেন বিশেষ কৌলিন্য
ও আভিজাত্যের অধিকারিণী।
জন্ম ও শৈশব : সীরাত গ্রন্থাবলীতে ছাফিয়া (রা.)-এর জন্মকাল ও তারিখ সম্বন্ধে কিছু জানা যায়
না। তবে ৭ম হিজরীতে খায়বার বিজয়ের পর রাসূলের সাথে বিবাহের সময় তার বয়স হয়েছিল ১৭
বছর।[9] সেই হিসাবে তাঁর জন্ম ৬১২ খৃষ্টাব্দে হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। তাঁর শৈশবকাল
সম্পর্কেও তেমন কিছু জনা যায় না। তবে খায়বারের ইহুদী কবীলা বনু নাযীর গোত্রেই তাঁর
বাল্যকাল কেটেছে।
বিবাহ : মদীনার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত অতি সমৃদ্ধ স্থান খায়বারের প্রসিদ্ধ কবি ও
সর্দার সাল্লাম ইবনু মাশকাম আল-কারাযীর সাথে ছাফিয়ার প্রথম বিবাহ সম্পন্ন হয় মাত্র
১৪ বছর বয়সে।[10] হাফিয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী বলেন, তাঁর প্রথম বিবাহ সম্পন্ন হয় সালাম ইবনু আবুল হুকাইকের সাথে।[11] কিন্তু তাদের মধ্যে মন-মানসিকতায় ব্যবধান থাকায় বনিবনা হয়নি। ফলে বিবাহ
বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর হিজাযের খ্যাতিমান সওদাগর ও খায়বারের বিখ্যাত নেতা আবু রাফে‘র ভাতিজা কিনানা ইবনু আবিল হুকায়েকের সাথে ছাফিয়া (রা.)-এর
দ্বিতীয় বিবাহ সম্পন্ন হয়।[12] কিনানা ছিল ছাফিয়ার চাচাত ভাই।[13] সে ছিল প্রসিদ্ধ কবি ও খায়বারের অন্যতম শক্তিশালী ও বিখ্যাত ‘আল-কামূস’ দুর্গের প্রশাসক।[14]
যুদ্ধবন্দী ছাফিয়া (রা.) : মদীনার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ইহুদী অধ্যুষিত একটি সমৃদ্ধ ও বর্ধিষ্ণু জনপদ
খায়বার। কয়েকটি মজবুত দুর্গবেষ্টিত খায়বারে বসে ইহুদীরা মদীনা আক্রমণ করার
ষড়যন্ত্র করে। মদীনা দখল করে ইসলামকে উৎখাত করতে তারা ছিল সংকল্পবদ্ধ। এজন্য তারা
দীর্ঘ দিন ধরে অস্ত্র-শস্ত্র ও সৈন্য সংগ্রহ করতে থাকে। মদীনার অর্ধেক খেজুর বাগান
প্রদানের শর্তে বনু গাতফান ও বনু আসাদ নামক গোত্রকেও তাদের দলভুক্ত করে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এ সংবাদ পেয়ে ইহুদীদের অপকর্মের মূলোচ্ছেদ করার জন্য খায়বার
অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
৭ম হিজরীর প্রথম দিকে সাবা বিন আরফাতা
গিফারীকে মদীনার দায়িত্বশীল নিয়োগ করে রাসূলুল্লাহ (সা.) ১৪শ’ ছাহাবী সাথে নিয়ে খায়বার অভিযানে বের হন। মুসলিম বাহিনী
খায়বারে পৌঁছলে ইহুদীরা খোলা ময়দানে যুদ্ধ করা সমীচীন মনে না করে দুর্গের
অভ্যন্তরে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করতে মনস্থ করে। তুমুল যুদ্ধে ইহুদীরা পরাজিত হয়।
ইহুদীদের ৯৩ জন মৃত্যুবরণ করে। অপরদিকে ১৫ জন মুসলিম মুজাহিদ শাহাদত বরণ করেন।
ইহুদীদের জন্য অতীব ক্ষতিকর এ যুদ্ধে ছাফিয়া (রা.)-এর বংশের নামকরা বীর ও নেতারা
নিহত হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে তার পিতা, ভাই ও অনেক স্বজন ছিল। আর যুদ্ধ বন্দীদের মধ্যে তিনি নিজে ও তার অনেক আত্মীয়
ছিল।[15]
হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) ছাফিয়ার স্বামী
কিনানার নিহত হওয়া সম্পর্কে বলেন, বনু নাযীরের গুপ্ত
ধনভান্ডার কিনানার তত্ত্বাবধানে ছিল। তাকে নবী করীম (সা.)-এর নিকটে আনা হ’লে তিনি ঐ ধনভান্ডার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। কিনানা সেই
স্থান চিনিয়ে দিতে অস্বীকার করে। তখন জনৈক ইহুদী রাসূলের নিকট এসে বলল, আমি কিনানাকে প্রতিদিন প্রত্যুষে এ গর্তের নিকটে ঘুরতে
দেখেছি। এ সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) কিনানাকে বললেন, আমরা যদি তোমার নিকটে ঐ ধনভান্ডার পাই তাহ’লে কি
তোমাকে হত্যা করব? সে উত্তরে বলল, হ্যাঁ। রাসূল ঐ গর্ত খোঁড়ার নির্দেশ দিলেন। সেখান থেকে কিছু গুপ্তসম্পদ বের হ’ল। এরপর কিনানাকে অবশিষ্ট গুপ্তধন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে
বলতে অস্বীকার করে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) যুবায়ের ইবনুল আওয়ামকে বললেন, ওকে শাস্তি দিয়ে তথ্য উদ্ধারের চেষ্টা কর। যুবায়ের (রা.)
আগুনের শলাকা দিয়ে শাস্তি দিয়ে তার বুকে গর্ত করে ফেললেন। সে মৃত্যুর উপক্রম হ’লেও গুপ্তধন সম্পর্কে কোন তথ্য দিল না। কিছু বলল না। অতঃপর
রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে মুহাম্মাদ ইবনু মাসালামার নিকট সোপর্দ করলেন। তিনি কিনানার
গর্দান কেটে ফেললেন। কেননা যুদ্ধের ময়দানে সে মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামার ভাই মাহমূদ
ইবনু মাসলামাকে হত্যা করছিল।[16]
যুদ্ধের পরে গনীমতের মাল ও বন্দীদের এক
স্থানে জমা করা হয়। বেলাল (রা.) ছাফিয়া ও তার চাচাত বোনকে ধরে নিয়ে আসেন। নিহত
ইহুদীদের রক্তাক্ত লাশ যে রাস্তায় পড়েছিল, বেলাল (রা.) তাদেরকে নিয়ে ঐ রাস্তায় আসেন। নিহতদের মাঝে ছাফিয়ার পিতা, ভাই ও আত্মীদের লাশ ছিল। বংশের সম্ভ্রান্ত লোক ও স্বজনদের
কর্তিত লাশ দেখে ছাফিয়ার চাচাত বোন নিজের মুখে চপেটাঘাত করে, মাথায় মাটি ছিটিয়ে দিয়ে, বুক চাপড়িয়ে, পরণের বস্ত্র ছিড়ে, চিৎকার করে বিলাপ করতে থাকে। কিন্তু ছাফিয়া থাকলেন নীরব
নির্বাক। বেলাল (রা.) তাদেরকে নিয়ে নবী করীম (সা.)-এর খেদমতে পৌঁছলে মহিলার
চিৎকার-চেচামেচি দেখে বললেন, এই শয়তান মহিলাকে
আমার নিকট থেকে দূরে সরাও। হে বেলাল! তোমার হৃদয়ে কি কোন দয়া নেই? এ মহিলাদেরকে এমন রাস্তা দিয়ে এনেছ, যে রাস্তায় তাদের পিতা, ভাইদের রক্তরঞ্জিত লাশ পড়ে আছে।[17]
রাসূলের সাথে বিবাহ : খায়বার যুদ্ধে ছাফিয়া বন্দী হন। গনীমত বণ্টনে তিনি দাহিয়া কালবীর অংশে পড়েন।
তখন নবী করীম (সা.)-কে বলা হ’ল ছাফিয়া আপনার
জন্য ছাড়া অন্যের জন্য মানায় না। তখন তিনি দাহিয়ার নিকট থেকে ৭ আরুসের বিনিময়ে
ছাফিয়াকে নিয়ে নেন।[18] অন্য বর্ণনায় ৭ জন বন্দীর বিনিময়ে দাহিয়ার নিকট থেকে ছাফিয়াকে খরিদ করেন।[19]
ছহীহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় আছে, খায়বারের যুদ্ধবন্দীদের একত্রিত করার পর দাহিয়া কালবী এসে
রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল!
বন্দীদের মধ্য হ’তে আমাকে একটি মেয়ে দিন। রাসূল বললেন, তুমি যাও, সেখান থেকে একটি
মেয়ে নিয়ে নাও। দাহিয়া (রা.) ছাফিয়া বিনতু হুয়াইকে গ্রহণ করলেন। তখন জনৈক ছাহাবী
এসে রাসূলকে বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি বনু নাযীর ও বনু
কুরায়যার নেতা হুয়াই বিন আখতাবের কন্যা ছাফিয়াকে দাহিয়া কালবীকে প্রদান করেছেন।
সর্দার দুহিতা ছাফিয়া আপনি ব্যতীত অন্য কারো জন্য উপযুক্ত নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)
বললেন,
ছাফিয়া সহ দাহিয়াকে ডাক। তখন দাহিয়া আসলেন।
আল্লাহর রাসূল (সা.) ছাফিয়ার দিকে তাকালেন এবং দাহিয়াকে বললেন, তুমি অন্য একটি মেয়েকে গ্রহণ কর। বর্ণনাকারী আনাস (রা.)
বলেন,
রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে মুক্ত করে দেন ও
বিবাহ করেন।[20] মূলতঃ ছাফিয়া (রা.) হায়েয থেকে পবিত্র হওয়ার পর রাসূল (সা.) তাকে বিবাহ করেন
এবং তার মুক্তিকেই তার বিবাহের মহর নির্ধারণ করেন।[21]
ওয়ালীমা ও বাসর : রাসূলুল্লাহ (সা.) ছাফিয়ার হায়েয শেষ হওয়া পর্যন্ত খায়বারে অবস্থান করেন। তিনি
পবিত্র হ’লে রাসূলুল্লাহ (সা.) খায়বার থেকে বের হন।
রওয়ানা হওয়ার জন্য উটের নিকটবর্তী হয়ে ছাফিয়ার জন্য রাসূল (সা.) নিজের পা নিচু করে
রাখলেন,
যাতে তাঁর হাটুর উপরে পা রেখে ছাফিয়া (রা.)
সহজইে উঠের পিঠে উঠতে পারে। কিন্তু রাসূলের পায়ের উপর পা দেওয়া চরম বেয়াদবী মনে
করে ছাফিয়া পা দিতে অস্বীকার করেন। অতঃপর তিনি রাসূলের উরুর উপরে হাঁটু দিয়ে ভর
করে উটের পিঠে চড়েন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে স্বীয় সওয়ারীর পিছনে রাখেন, তার উপর চাদর দিয়ে তার পৃষ্ঠদেশ ও মুখমন্ডল ঢেকে দেন। তাকে
স্বীয় স্ত্রীদের অন্তর্ভুক্ত করেন। অতঃপর খায়বার থেকে ৬ মাইল দূরে ‘তাবার’ মনযিলে পৌঁছে
রাসূলুল্লাহ (সা.) বাসর যাপনের ইচ্ছা ব্যক্ত করলে ছাফিয়া (রা.) অমত পোষণ করেন। এতে
রাসূল মনে কষ্ট পান। অতঃপর খায়বার থেকে দূরবর্তী মনযিল ‘ছাহবা’-এ পৌঁছে
রাসূলুল্লাহ (সা.) যাত্রা বিরতি করেন। তখন আনাস ইবনু মালিক (রা.)-এর মাতা উম্মু
সুলাইম বিনতু মিলহান[22] ছাফিয়াকে চুল অাঁচড়িয়ে পরিপাটি করে সাজিয়ে, সুগন্ধি মাখিয়ে রাসূলের জন্য প্রস্ত্তত করেন। অন্য বর্ণনায় আছে, উম্মু সিনান আল-আসলামিয়া ছাফিয়াকে সাজিয়ে সুগন্ধি মাখিয়ে
দেন।[23]
উম্মু সুলাইম বলেন, তাঁবু বা সামিয়ানার অভাবে আমরা দু’টি আবা (পোষাক বিশেষ) বা দু’টি কাপড় গাছের সাথে টাঙিয়ে পর্দা করে দিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) ছাফিয়ার
নিকটবর্তী হ’লে তিনি এগিয়ে আসেন। এরূপ করতে তাকে বলে
দেওয়া হয়েছিল। রাসূল সেখানে বাসর যাপন করেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, প্রথম মনযিলে আমি বাসর যাপনের ইচ্ছা করলে, তুমি অমত করলে কেন? ছাফিয়া বললেন, আমি আপনার জন্য ইহুদীদের অনিষ্টের আশংকা
করছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) ছাফিয়া (রা.)-এর সাথে কথা-বার্তা বলে সারা রাত্রি
নির্ঘুম অতিবাহিত করেন। প্রত্যুষে উম্মু সুলাইম জিজ্ঞেস করলেন, রাসূলকে কেমন দেখলে? তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে পেয়ে খুশি হয়েছেন।
সকালে রাসূলুল্লাহ (সা.) খেজুর, পনির ও ঘি দ্বারা
বিশেষভাবে তৈরী ‘হীস’ নামক এক প্রকার খাদ্য দ্বারা ওয়ালীমা করেন।[24] হাকিমের বর্ণনায় আছে রাসূলুল্লাহ (সা.) রুটি ও গোশত দ্বারা ছাফিয়ার বিবাহোত্তর
ওয়ালীমা করেন।[25]
রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় ‘আল-আযবা’ নামক উটনীর পিছনে
ছাফিয়া (রা.)-কে নিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে উটনী হোঁচট খেয়ে পড়ে
গেলে নবী করীম (সা.) ও ছাফিয়া (রা.) দু’জনেই পড়ে
যান। কিন্তু তাঁরা কোন আঘাত পাননি। আল্লাহ তাদের নিরাপদে রাখেন। কিন্তু নবী করীম (সা.)
ও ছাফিয়া (রা.) হঠাৎ পড়ে যাওয়ায় চিৎকার করে ওঠেন। তখন আবু তালহা স্বীয় সওয়ারী থেকে
ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং রাসূলের নিকটে এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার কোন ক্ষতি হয়নি তো? তিনি বললেন, না, তুমি মহিলার প্রতি খেয়াল কর। তখন আবু তালহা স্বীয় চোখের সামনে কাপড় টানিয়ে
দিয়ে ছাফিয়ার দিকে একটি কাপড় ছুড়ে দিলেন। তিনি তা ধরে উঠে দাঁড়ালেন। অতঃপর তিনি
সওয়ারীতে উঠলেন এবং নবী করীম (সা.)ও আরোহন করলেন।[26] অতঃপর খায়বার থেকে ১৬ মাইল দূরে ‘কুছাইবাহ’ নামক স্থানে রাসূলুল্লাহ (সা.) যাত্রা বিরতি করেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন ছাফিয়া (রা.)-এর সাথে বাসর যাপন করেন, সে সময় তার বয়স হয়েছিল ১৭ বছর।[27]
রাসূলকে পাহারা দান: রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন ছাফিয়া (রা.)-এর তাঁবুতে প্রবেশ করেন তখন আবু আইয়ুব (রা.)
তাঁবুর সামনে খোলা তরবারি নিয়ে রাসূলের নিরাপত্তার জন্য সারা রাত্রি জেগে পাহারা
দিতে থাকেন। সকালে রাসূল তাকে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ছাফিয়া (রা.) একজন অল্প বয়সী তরুণী, যার পিতা, ভাই ও স্বামী আপনার
সাথে যুদ্ধে নিহত হয়েছে। তাই তাকে আপনার জন্য নিরাপদ মনে করিনি। তখন রাসূল হাসলেন
এবং তার জন্য দো‘আ করলেন।[28]
ছাফিয়া (রা.)-এর স্বপ্ন : ছাফিয়া (রা.) একদা স্বপ্নে দেখেন যে, চন্দ্র ছুটে এসে তাঁর ক্রোড়ে পতিত হয়েছে। এ স্বপ্নের কথা তার মায়ের নিকটে
প্রকাশ করলে সে সজোরে ছাফিয়ার মুখে চপেটাঘাত করে এবং বলে, তুই কি এ আশা করিস যে, আরবের বাদশার রাণী হবি?[29] অন্য বর্ণনায় এসেছে, বাসর রাতে রাসূলুল্লাহ ছাফিয়ার চোখের
পার্শ্বে সবুজ দাগ দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কিসের দাগ? তখন তিনি বললেন, আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম যে, ইয়াছরিবের দিক থেকে চন্দ্র ছুটে এসে আমার ক্রোড়ে পতিত হয়েছে। অন্য বর্ণনায় আছে, সূর্য পতিত হয়েছে। আমি এই স্বপ্নের কথা আমার স্বামী কিনানার
নিকট ব্যক্ত করলাম। তখন সে বলল, মদীনা থেকে আগত ঐ
বাদশার অধীনস্ত তুমি হও এটা কি তুমি ভালবাস? একথা বলে সে সজোরে আমার মুখে চপেটাঘাত করে।[30]
রাসূলের সাথে বিবাহের আকাঙ্খা : খায়বার যুদ্ধ বিজয়ের পর ছাফিয়া (রা.) বন্দী হয়ে আসলে এক সময় তাকে রাসূল
জিজ্ঞেস করলেন, আমার ব্যাপারে তোমার কোন আগ্রহ আছে কি? তিনি উত্তরে বললেন, শিরকের মধ্যে নিমজ্জিত থাকার সময় আমি এই আশা পোষণ করতাম। সুতরাং ইসলাম গ্রহণের
দ্বারা আল্লাহ আমাকে আপনার সাহচর্য লাভের যে সুযোগ দিয়েছেন, সে সুযোগ আমি কিভাবে হারাতে পারি?[31] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ছাফিয়া (রা.) যখন রাসূলের নিকট আসলেন, তখন তিনি বললেন, তোমার পিতা ইহুদী ছিলেন, যে আমার প্রতি
শত্রুতা পোষণ করত। অবশেষে আল্লাহ তাকে নিহত করলেন। তখন ছাফিয়া বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তাঁর কিতাবে বলেছেন, وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ
أُخْرَى ‘একজনের (পাপের) বোঝা অন্যের উপর চাপানো হবে
না’ (আন‘আম ১৬৪; ইসরা ১৫; ফাতির ১৮; যুমার ৭; নাজম ৩৮)। তখন রাসূল (সা.) বললেন, তুমি যা পসন্দ কর, বেছে নেও। যদি তুমি ইসলামকে পসন্দ কর, তাহ’লে আমি তোমাকে আমার জন্য রেখে দিব। আর যদি
তুমি ইহুদী ধর্মমতকে পসন্দ কর, তাহ’লে আমি তোমাকে মুক্ত করে দেব, যাতে তুমি তোমার কওমের সাথে মিলিত হ’তে পার।
তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি ইসলামকে ভালবেসেছি, আপনি আমাকে দাওয়াত দেওয়ার পূর্বেই আমি আপনাকে সত্য বলে
স্বীকার করেছি, এমনকি আমি আপনার সওয়ারীতে চড়েছি। ইহুদী ধর্মের
প্রতি আমার কোন আকর্ষণ বা অনুরাগ নেই। আর সেখানে আমার পিতা, ভাই, কেউ নেই। আপনি কুফরী বা ইসলাম যেকোনটি
গ্রহণের এখতিয়ার দিয়েছেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই আমার নিকট অধিক প্রিয় স্বাধীন
হওয়ার চেয়ে এবং আমার কওমের নিকট ফিরে যাওয়ার চেয়ে। তখন তাকে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের
জন্য রেখে দিলেন।[32]
ছাফিয়াকে বিবাহের কারণ : বিভিন্ন কারণে রাসূলুল্লাহ (সা.) ছাফিয়াকে বিবাহ করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য
কয়েকটি নিম্নরূপ :
(১) আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী নিহত এবং নিজেও স্বীয় ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ
হওয়ায় ছাফিয়া শোক বিহবল ছিলেন। তার শোকাহত হৃদয়কে শান্ত করা ও তাকে দ্বীন ইসলামের
দিকে আকৃষ্ট করার জন্য তাকে রাসূলুল্লাহ (সা.) বিবাহ করেন।
(২) এ বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে ইসলাম ও
মুসলমানদের সাথে বনু নাযীর ও বনু কুরায়যার বিরোধিতা ও শত্রুতা হ্রাসকরণ এবং
প্রশমনের অভিপ্রায়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) ছাফিয়াকে বিবাহ করেন। যা পরবর্তীতে
বাস্তবায়িত হয়েছিল।[33]
(৩) সরদার দুহিতা ছাফিয়ার যথাযথ সম্মান বজায়
রাখা এবং এই নযীরবিহীন ইহসানের প্রতি লক্ষ্য করে ইহুদী সম্প্রদায় যাতে
আল্লাহদ্রোহিতা থেকে ফিরে এসে ইসলাম কবুল করতে অনুপ্রাণিত হয়, এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) ছাফিয়াকে বিবাহ করেন।[34]
ছাফিয়া (রা.)-এর রূপ ও সৌন্দর্য
: রাসূলুল্লাহ (সা.) ‘ছাহবা’-এ তিন দিন অবস্থান করার পর মদীনায় ফিরে আসেন।[35] মদীনায় পৌঁছে তিনি নব বিবাহিতা স্ত্রী ছাফিয়াকে নিয়ে হারিছ বিন নু‘মানের বাড়ীতে ওঠেন। রাসূলের প্রিয় এ ছাহাবী ছিলেন বিত্তশালী
এবং রাসূলের প্রয়োজনের প্রতি অত্যন্ত সজাগ। নবী করীম (সা.)-এর সহযোগিতায় তিনি সদা
প্রস্ত্তত থাকতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তার বাড়ীতে উঠলে ছাফিয়া (রা.)-এর রূপের কথা
শুনে আনছার মহিলাদের সাথে উম্মুল মুমিনীন যয়নাব বিনতু জাহাশ, হাফছা, জুওয়াইরিয়া ও আয়েশা
(রা.) হারিছের বাড়ীতে আসেন। আয়েশা (রা.) ছিলেন মুখে নেকাব পরিহিতা। রাসূলুল্লাহ (সা.)
তাকে চিনে ফেলেন। চলে যাবার সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) আয়েশার পিছনে পিছেনে এসে
জিজ্ঞেস করলেন, হে আয়েশা! কেমন দেখলে? তিনি বললেন, সে তো ইহুদী নারী। নবী করীম (সা.) বললেন, ওকথা বল না। সে ইসলাম কবুল করেছে এবং উত্তম মুসলিম হয়েছে।[36] অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) আয়েশার নিকট গিয়ে তার কাপড়
টেনে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, كيف رأيت يا شقيراء ‘কেমন দেখলে হে শাকীরা (আয়েশা)! তিনি বললেন, আমি দেখলাম, সে একজন ইহুদী মহিলা।[37]
ছাফিয়া (রা.) যে অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন তা
উম্মু সিনান আল-আসলামিয়া (রা.)-এর উক্তিতে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, وكانت من أضواء ما يكون من
النساء ‘তিনি ছিলেন সৌম্যকান্তি, যা মহিলাদের মধ্যে বিরল’।[38] আব্দুল্লাহ জরদানী বলেন, وكانت جميلة رضى الله تعالى عنها ‘তিনি ছিলেন সুন্দরী’।[39]
স্বভাব-চরিত্র : তিনি ছিলেন অত্যন্ত উন্নত চরিত্র ও উত্তম বৈশিষ্ট্যের অধিকারিণী। তিনি অতি
নম্র স্বভাবের ও ধৈর্যশীলা মহিলা ছিলেন। ইবনু আব্দুল বার্র বলেন, كانة صفية حليمة عاقلة فاضلة ‘ছাফিয়া (রা.) ছিলেন ধৈর্যশীলা, বুদ্ধিমতী ও গুণবতী’।[40] হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী বলেন, وكانت شريفة عاقلة ذا حسب وجمال ودين رضى الله عنها ‘তিনি ছিলেন ভদ্র, বুদ্ধিমতী, উঁচু বংশীয়া, রূপবতী ও দ্বীনদার মহিলা’।[41]
ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পরও ইহুদী হওয়ার
ভৎর্সনা বা ঠাট্টা-বিদ্রূপ তাঁর জন্য অতি পীড়াদায়ক ও বড় অন্তর জ্বালার ব্যাপার
ছিল। তথাপি এসব বিদ্রূপও তিনি অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে সহ্য করতেন। তিনি কাউকে কখনও
কোন কটু কথা বলেননি এবং কারো তিরস্কারের কঠিন জবাব দেননি। আনাস (রা.) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা ছাফিয়া (রা.)-এর নিকটে এ খবর পৌঁছল যে, হাফছা বিনতু ওমর তাকে ইহুদী বলে। তখন তিনি কাঁদতে লাগলেন। এমতাবস্থায় নবী করীম
(সা.) তার নিকটে প্রবেশ করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, কাঁদছ কেন? তিনি বললেন, হাফছা আমাকে ইহুদীর মেয়ে বলে। নবী করীম (সা.) বললেন, ‘তুমি নবীর কন্যা, তোমার চাচা নবী এবং তুমিও নবীর অধীনে আছ। সুতরাং তোমার উপর কে গর্ব করতে পারে? অতঃপর তিনি হাফছাকে বললেন, হে হাফছা! আল্লাহকে ভয় কর’।[42]
দানশীলতা : তিনি ছিলেন অল্পে তুষ্ট ও দানশীলা মহিলা। তিনি রাসূলের সাথে মদীনায় আগমন করলে
ফাতিমাতুয যাহরা তাকে দেখতে আসলেন। তখন তিনি নিজের কানের মূল্যবান ঝুমকা বা দুল
খুলে ফাতিমাকে দিলেন এবং তাঁর সাথে আগত অন্যান্য মহিলাকেও কোন না কোন গহনা প্রদান
করলেন।[43] ছাফিয়া (রা.) স্বীয় ব্যক্তিগত গৃহখানা জীবদ্দশায়ই ছাদাক্বা করে দেন।[44] তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে জমি ও আসবাবপত্রের মূল্য বাবদ একলক্ষ দিরহাম
পেয়েছিলেন। এর এক-তৃতীয়াংশ স্বীয় ভাগ্নার জন্য অছিয়ত করে যান। যার পরিমাণ ছিল ৩০
হাযার দেরহাম।[45] এ ব্যক্তি ছাফিয়া (রা.)-এর মৃত্যুর পর ইসলাম কবুল করেন।[46] অপর এক বর্ণনায় আছে যে, লোকেরা ছাফিয়া (রা.)-এর ভাগ্নাকে অর্থ প্রদানে গড়িমসি করে। তখন আয়েশা (রা.)
বললেন,
তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং ছাফিয়ার অছিয়ত পূর্ণ
কর। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী অছিয়ত পূরণ করা হয়।[47]
রাসূলের প্রতি ভালবাসা : রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ছাফিয়া (রা.)-এর ছিল সীমাহীন ভালবাসা, অকৃত্রিম প্রেম, অশেষ মুহাববাত। এটা রাসূলের সাক্ষ্যদানে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়েছে। নবী
করীম (সা.) অন্তিম শয্যায় শায়িত, মৃত্যু যন্ত্রণায়
তিনি ছটফট করছেন। তাঁর চতুর্দিকে এসে সমবেত হয়েছেন তাঁর সহধর্মিনীগণ। তখন রাসূলের
অস্থিরতা দেখে ছাফিয়া (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার এ যন্ত্রণা যদি আমার হ’ত! একথা শুনে রাসূলের অন্যান্য স্ত্রীগণ তাঁর দিকে তাকালেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)
অন্যান্য স্ত্রীদের দিকে তাকালেন এবং বললেন, তোমরা কি অনর্থক ভাবলে? তারা বললেন, কোন জিনিসকে, হে আল্লাহর নবী! তিনি বললেন, যে বিষয়ে তোমরা তোমাদের সাথীর প্রতি কটাক্ষের দৃষ্টিতে
তাকালে?
আল্লাহর কসম! সে সত্যই বলেছে’।[48] অর্থাৎ এটা নিছক কথার কথা নয়, প্রদর্শনী মূলকও নয়। সে অন্তর থেকেই একথা বলেছে।
রাসূলের ভালবাসার পাত্রী : ছাফিয়া (রা.) যেমন রাসূলকে ভালবাসতেন, তেমনি রাসূলুল্লাহ (সা.)ও ছাফিয়াকে মুহাববাত করতেন। ছাফিয়ার সঙ্গ পসন্দ করতেন
এবং তার প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় পত্নীগণ সহ হজ্জে
গমনকালে ছাফিয়ার উট (দুর্বল হয়ে) বসে পড়লে তিনি কেঁদে ফেললেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এসে
নিজ হাতে তার অশ্রু মুছিয়ে দেন ও কাঁদতে নিষেধ করেন। তিনি লোকদের নিয়ে যাত্রা
বিরতি করেন। অতঃপর ‘রাওয়াহ’ নামক স্থানের নিকটবর্তী হয়ে যয়নাব বিনতু জাহাশকে বললেন, তোমার বোনকে একটি উট দাও। তার কাছে সবার চেয়ে বেশি বাহন
ছিল। যয়নাব বললেন, আমি এই ইহুদীকে উট দিব? এতে রাসূলুল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হ’লেন। মদীনায় ফিরে আসা অবধি তার সাথে কথা বলেননি। দু’তিন মাস (যুলহিজ্জাহ থেকে মুহাররম বা ছফর পর্যন্ত) তার
নিকটে যাননি। যয়নাব বলেন, রাসূলের উষ্মা আমাকে প্রায় নিরাশ করে
ফেলেছিল। রবী‘উল আউয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ যয়নাবের নিকটে
গেলে রাসূলকে দেখে যয়নাব এগিয়ে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এরূপ আমি কখনও বলব না। যয়নাবের একটি দাসী ছিল, সেটা তিনি রাসূলকে দান করেন। নবী করীম (সা.) যয়নাবের
ঊর্ধ্বে ওঠানো খাট নিজ হাতে নামিয়ে তাতে বসলেন এবং যয়নাবের প্রতি সন্তুষ্ট হ’লেন।[49]
সত্যবাদিনী ও স্পষ্টভাষিণী : ওমর ফারূক (রা.)-এর খিলাফতকালে ছাফিয়া (রা.)-এর জনৈক দাসী খলীফার নিকট অভিযোগ
করল যে,
উম্মুল মুমিনীন ছাফিয়ার নিকট থেকে এখনও
ইহুদীবাদের গন্ধ আসে। কেননা তিনি শনিবারকে উত্তম জ্ঞান করেন এবং ইহুদীদের সঙ্গে আন্তরিক
সম্পর্ক রাখেন। ওমর (রা.) একথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য নিজেই ছাফিয়া (রা.)-এর গৃহে
গমন করেন। তিনি আগমনের কারণ বর্ণনা করলে ছাফিয়া (রা.) বললেন, যখন থেকে আল্লাহ আমাকে শনিবারের পরিবর্তে শুক্রবার দিয়েছেন, তখন থেকেই শনিবারের প্রতি ভালবাসার প্রয়োজন থাকেনি। আর
ইহুদীদের মাঝে আমার আত্মীয়-স্বজন থাকার কারণে তাদের সাথে আমার কেবল আত্মীয়তার
সম্পর্ক রাখতে হয়। তাঁর সত্যবাদিতা ও সুস্পষ্ট বক্তব্যে খলীফা খুশি হয়ে ফিরে এলেন।
এরপর উম্মুল মুমিনীন দাসীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার বিরুদ্ধে খলীফার কাছে অভিযোগ করতে কোন জিনিস তোমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে? সে বলল, শয়তান আমাকে
প্ররোচনা দিয়েছে। তখন তিনি বললেন, যাও, তোমাকে আযাদ করে দিলাম।[50]
ছাফিয়া (রা.) স্বীয় পিতা হুয়াই বিন আখত্বাব
সম্পর্কে বলেন, আমি আমার বাপ-চাচাদের নিকটে তাদের সকল
সন্তানের মধ্যে অধিক প্রিয় ছিলাম এবং সকলের আগেই আমাকে কোলে তুলে নিয়ে তারা আদর
করতেন। যেদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রথম ইয়াছরিবে আগমন করেন ও কুবায় বনু আমর বিন
আওফের গোত্রে অবতরণ করেন, সেদিন অতি প্রত্যুষে আমার পিতা ও চাচা
রাসূলের দরবারে উপস্থিত হন। অতঃপর সন্ধ্যার দিকে তারা ক্লান্ত ও অবসন্নচিত্তে গৃহে
প্রত্যাবর্তন করেন। আমি ছুটে তাদের কাছে গেলাম। কিন্তু আল্লাহর কসম! তারা এত
চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন যে, আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। এ সময় আমি আমার
চাচাকে বলতে শুনলাম, তিনি আমার আববাকে বলছেন, أهو هو؟ ‘ইনিই কি তিনি? আববা বললেন, نعم والله ‘আল্লাহর কসম! ইনিই তিনি’। চাচা বললেন, فما فى نفسك منه ‘এখন তাঁর সম্পর্কে আপনার চিন্তা কী’? আববা বললেন, عداوتُه والله ما بقيتُ ‘তার শত্রুতা, আল্লাহর কসম! যতদিন আমি বেঁচে থাকব’।[51]
সহানুভূতি ও কর্তব্য সচেতনতা : ছাফিয়া (রা.) অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি তাঁর কর্তব্য ও দায়িত্বের
প্রতিও সচেতন ছিলেন। ৩৫ হিজরীতে ওছমান (রা.) বিদ্রোহীদের দ্বারা নিজ গৃহে বন্দী
হয়ে পড়লে বাইরের সকল যোগাযোগ তাঁর সাথে বন্ধ হয়ে যায়। ছাফিয়া (রা.) একজন খাদেমকে
নিয়ে খচ্চরে আরোহণ করে তাঁর গৃহাভিমুখে রওয়ানা হন। আশতার নাখঈ দেখতে পেয়ে তাঁকে
ফিরাতে খচ্চরের মুখে আঘাত করে। তখন ছাফিয় (রা.) বললেন, আমাকে ছেড়ে দাও, এখানে আমাকে অপদস্ত কর না। তিনি ফিরে আসেন। তারপর তিনি স্বীয় বাড়ী থেকে ওছমান
(রা.)-এর বাড়ীতে হাসান (রা.)-এর মাধ্যমে খাদ্য পানীয় পৌঁছে দেন।[52]
ইলমী খিদমত : ছাফিয়া (রা.) অন্যান্য উম্মুল মুমিনীনের ন্যায় ইসলামী জ্ঞানের কেন্দ্রভূমি
ছিলেন। লোকেরা তাঁর কাছে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে সন্তোষজনক জবাব পেত। হাদীছ, ফিকহ সহ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল। ইবনুল
আছীর বলেন, كانت عاقلة من عقلاء النساء ‘বুদ্ধিমতী-জ্ঞানী মহিলাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অতিশয় জ্ঞানী’।[53] আবু ওমর বলেন, كانة صفية عاقلة فاضلة ‘ছাফিয়া ছিলেন জ্ঞানী গুণবতী মহিলা’।[54] শামসুদ্দীন আয-যাহাবী বলেন, كانت صفية ذات حلم ووقار ‘ছাফিয়া ছিলেন বুদ্ধিমতী ও মর্যাদাশীলা’।[55] মূলতঃ তিনি নবী করীম (সা.)-এর সাহচর্যে থাকায় হাদীছ সহ
ইসলামী শরী‘আতের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। মুহায়রা
বিনতু হায়কাল নাম্নী এক মহিলা হজ্জ সমাপন করে ছাফিয়া (রা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে
মদীনায় আসেন। তিনি গৃহে প্রবেশ করে দেখেন কূফার বহু মহিলা বসে আছেন এবং ছাফিয়া (রা.)-কে
নানা বিষয়ে প্রশ্ন করছেন। আর তিনি বিচক্ষণতার সাথে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।
তিনি মহিলাদের মাধ্যমে নাবীয (খেজুর ভিজানো শরবত) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি
বললেন,
রাসূলুল্লাহ (সা.) তা হারাম করেছেন।[56]
তাঁর থেকে মোট ১০টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।
তন্মধ্যে ১টি বুখারী ও মুসলিম যৌথভাবে নিজ নিজ গ্রন্থে সংকলন করেছেন।[57] তবে আমাদের পরিসংখ্যানে তাঁর বর্ণিত হাদীছগুলোর মধ্যে
পুনরুল্লেখ সহ বুখারীতে ৭টি, মুসলিমে ১টি, তিরমিযীতে ৩টি, সুনান আবু দাঊদে ৪টি এবং ইবনু মাজাহতে ২টি হাদীছ সংকলিত হয়েছে। তিনি মূলতঃ
রাসূলুল্লাহ (সা.) হ’তে হাদীছ বর্ণনা করেন। তাঁর নিকট থেকে তাঁর
ভাই,
তাঁর গোলাম কিনানা, আলী ইবনু হুসাইন ইবনে আলী, যয়নুল আবেদীন ইবনু আলী ইবনে হাসান, ইসহাক ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনে হারিছ, মুসলিম ইবনু ছাফওয়ান, ইয়াযীদ ইবনু মু‘আত্তাব প্রমুখ হাদীছ বর্ণনা করেন।[58]
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত
সম্পদ : রাসূলুল্লাহ (সা.) খায়বার থেকে প্রাপ্ত ফসল হ’তে ছাফিয়াকে ৮০ ওয়াসাক খেজুর এবং ২০ ওয়াসাক যব বা গম
দিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি তাঁর পিতৃ-মাতৃ সূত্রে প্রাপ্ত জমি ও আসবাবপত্রের মূল্য
বাবদ এক লক্ষ দেরহাম পেয়েছিলেন।[59]
ইন্তিকাল : ওয়াকেদী বলেন, ছাফিয়া (রা.) মু‘আবিয়া (রা.)-এর শাসনামলে ৫০ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। ইবনু
হিববান ও ইবনু মান্দা বলেন, তিনি ৩৬ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। কেউ বলেন, তিনি ৫২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। কারো মতে, তিনি ৫০ হিজরীর রামাযান মাসে ৬০ বছর বয়সে মদীনায় ইন্তিকাল
করেন।[60] ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, মু‘আবিয়ার শাসনামলে তিনি ইন্তিকাল করেছেন বলে ইবনু হিববান যা
উল্লেখ করেছেন, তা সঠিক নয়। কেননা আলী ইবনু হাসান ছাফিয়া (সা.)
থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন, এটা ছহীহাইনে রয়েছে। আর অকাট্যভাবে প্রমাণিত
যে,
আলী ইবনু হাসান ৩৬ হিজরীর পরে জন্মগ্রহণ
করেছেন।[61] সুতরাং ছাফিয়া (রা.) ৫০ বা ৫২ হিজরীতে ইন্তিাকল করেছেন।
এটাই বিশুদ্ধ মত। আমর ইবনুল আছ মতান্তরে মু‘আবিয়া (রা.)
তাঁর জানাযা ছালাত পড়ান। মদীনার বাকীউল গারক্বাদ নামক গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা
হয়।[62]
পরিশেষে বলব, বিদুষী ছাহাবিয়া, পতীপরায়না ও রাসূলের একান্ত অনুগতা ছাফিয়া (রা.)-এর
ঘটনাবহুল জীবনী থেকে আমাদের কন্যা-জায়া-জননীদের জন্য অনেক শিক্ষা রয়েছে। তাঁর
জীবনী থেকে ইবরাত হাছিল করে জীবন রাঙাতে পারলে সকলের জীবন, সংসার ও সমাজ হবে সুন্দর ও সুখময়। আল্লাহ আমাদেরকে উম্মুল
মুমিনীন ছাফিয়া (রা.)-এর জবীনী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
[1]. দায়িরায়ে মা‘আরিফে ইসলামিয়্যাহ, ১ম খন্ড
(করাচী: মাদানী কুতুবখানা, তা.বি), পৃঃ ৯৯২।
[2]. আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ আল-হাকিম
আন-নাইসাপুরী, আল-মুস্তাদরাক আলাছ
ছহীহাইন, ৪র্থ খন্ড (বৈরুত:
দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ ১৯৯০ খৃঃ/১৪১১ হিঃ), পৃঃ ৩০।
[3]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, আল-ইছাবাহ ফী তাময়ীযিছ ছাহাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলামিয়্যাহ, তা.বি.), পৃঃ ১২৬; হাফেয শামসুদ্দীন
আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড (বৈরুত: মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ৩য় প্রকাশ, ১৯৮৫ খৃঃ/১৪০৫ হিঃ), পৃঃ ২৩১।
[4]. মুহাম্মাদ ইবনু সা‘দ, আত-তাবাক্বাতুল
কুবরা, ৮ম খন্ড (বৈরুত:
দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০ খৃঃ/১৪১০ হিঃ), পৃঃ ৯৫।
[5]. আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৬; আত-তাবাক্বাত, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯৫।
[6]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩১।
[7]. আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩০।
[8]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯৫।
[9]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৭; আল-ইছাবাহ ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৭।
[10]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯৫; আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৬।
[11]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩১।
[12]. আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৭; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩১।
[13]. হাফেয ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয (কায়রো:
দারুর রাইয়ান লিত-তুরাছ, ১ম প্রকাশ
১৪০৮ হিঃ/১৯৮৮ খৃঃ), পৃঃ ১৯৭।
[14]. ড. আয়েশা আব্দুর রহমান, তারাজিমু সায়্যেদাতি বায়তিন নবুওয়াত (বৈরুত: দারুর রাইয়্যান, তাবি), পৃঃ ৩৬৪-৬৫।
[15]. তালিবুল হাশেমী, মহিলা সাহাবী, অনুবাদ: আব্দুল
কাদের (ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী, ১৪১৪ হিঃ/১৯৯৪ খৃঃ), পৃঃ ৭১-৭৩; মুহাম্মাদ নূরুযযামান, সংগ্রামী নারী, (ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী, ১৪১১ হিঃ/১৯৯০ খৃঃ), পৃঃ ৯২-৯৩।
[16]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয, পৃঃ ১৯৮-৯৯।
[17]. আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৬; তারাজিমু সায়্যেদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩৬৫-৬৬।
[18]. আহমাদ, ৩য় খন্ড, পৃঃ ১২৩, ২৪৬; আবু দাঊদ হা/২৯৯৭; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩১-৩২।
[19]. ছহীহ মুসলিম, ‘কিতাবুন নিকাহ’, হা/১৩৬৫।
[20]. মুসলিম, হা/১৩৬৫ (৮৪); বুখারী, ‘মাগাযী’ অধ্যায়, ‘খায়বার যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ।
[21]. বুখারী, ‘মাগাযী’ অধ্যায়, ‘খায়বার যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ, ‘বিবাহ’ অধ্যায়, ‘দাসী মুক্তিই মহর’ অনুচ্ছেদ ও ‘ওয়ালীমা’ অনুচ্ছেদ; মুসলিম, হা/১৩৬৫ (৮৫), ‘বিবাহ’ অধ্যায়; আবু দাঊদ, হা/২০৫৪; তিরমিযী, হা/১১১৫; নাসাঈ, মুছান্নাফ আব্দুর
রাযযাক; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩২।
[22]. উম্মু সুলাইমের আসল নাম ‘সাহলাহ’। যিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দুধ সম্পর্কের
খালা ছিলেন। দ্রঃ সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ জরদানী, ফাতহুল আল্লাম বিশারহি মুরশিদিল আনাম, ১ম খন্ড (কায়রো: দারুস সালাম, ৪র্থ প্রকাশ, ১৯৯০/১৪১০ হিঃ), পৃঃ ২৩৯।
[23]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯৬।
[24]. আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৬-২৭; আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯৬-৯৭; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয, পৃঃ ১৯৭।
[25]. আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩০।
[26]. বুখারী, মুসলিম হা/১৩৬৫ (৮৭); সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৩।
[27]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯৬-৯৭।
[28]. আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩০; তারাজিমু
সায়্যেদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩৬৯।
[29]. আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৬।
[30]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯৬; আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৬; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয, পৃঃ ১৯৮; তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩৬৮।
[31]. ফাতহুল আল্লাম বিশারহি মুরশিদিল আনাম, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৩৯।
[32]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯৭, তারাজিমু
সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩৬৬।
[33]. ছালাহুদ্দীন মাকবুল আহমাদ, আল-মারআতু বায়না হিদায়াতিল ইসলাম ওয়া গাওয়াতিল ই‘লাম (কুয়েত: দারুল ইলাফ আদ-দাওলিয়া, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৭/১৪১৮ হিঃ), পৃঃ ২৬৯।
[34]. মাহমূদ শাকির, আত-তারীখুল ইসলামী, ১ম ও ২য়
খন্ড (বৈরুত: আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৪১১হিঃ/১৯৯১), পৃঃ ৩৬১।
[35]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয, পৃঃ ১৯৮।
[36]. আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৭; আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০০; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৬-৩৭।
[37]. আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৭; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ১৩৭।
[38]. আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৬।
[39]. ফাতহুল আল্লাম, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৩৮।
[40]. আবু ওমর ইউসুফ ইবনু আব্দুল বার্র, আল-ইস্তি‘আব ফী মা‘রিফাতিল আছহাব
(কায়রো: দারুন নাহযাতিল মিছরিয়া, তাবি), ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ১৮৭২।
[41]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৬-৩৭।
[42]. তিরমিযী, হা/৩৮৯৪, সনদ ছহীহ।
[43]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০০; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৭; আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৭।
[44]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০২।
[45]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৮।
[46]. আত-তাবক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০১।
[47]. ঐ, পৃঃ ১০২।
[48]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০১; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৫; আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৭।
[49]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৩-৩৪; মুসনাদে আহমাদ
৬/৩৩৭-৩৮; আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৬; আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০০।
[50]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩২-৩৩।
[51]. তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াতে, পৃঃ ৩৬৮-৬৯।
[52]. ঐ, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ১৩৭; তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০১।
[53]. আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনিল আছীর, উসুদুল গাবা ফী মা‘রিফাতিছ
ছাহাবা ৫ম খন্ড (বৈরুত: দারুল ইহইয়া আত-তুরাছিল আরাবী, তা.বি.), পৃঃ ৪৯০।
[54]. আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৭।
[55]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৫।
[56]. মুসনাদ আহমাদ, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ ৩৭০।
[57]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৮।
[58]. হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব, ১২শ খন্ড
(বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৪/১৪১৫হিঃ), পৃঃ ৩৮০; আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৭।
[59]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০১-১০২।
[60]. আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১২৭।
৬১. তাহযীবুত তাহযীব, ১২শ খন্ড পৃঃ ৩৮০।
[62]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৮।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(১১)
ইসলামের প্রথম দাঈ, ওহোদের ঝান্ডাবাহী শহীদ ছাহাবী মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রা.)
ভূমিকা :
নবী-রাসূলগণের পরে আল্লাহর নিকটে ছাহাবীদের
মর্যাদা সর্বাধিক। বিশেষ করে ইসলামের প্রথম যুগের আনছার ও মুহাজির ছাহাবীগণ, যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাদের জান্নাতের
সুসংবাদ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘মুহাজির ও
আনছারগণের মধ্যে যারা অগ্রবর্তী ও প্রথম দিককার এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে
নিষ্ঠার সাথে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং
তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল
থাকবে। আর এটিই হ’ল মহা সফলতা’ (তওবা ৯/১০০)। ছাহাবীদের মর্যাদা প্রসঙ্গে রাসূল (সা.)-এর বলেন,فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ
أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلاَ نَصِيفَهُ- ‘যদি তোমাদের কেউ ওহোদ পাহাড়ের সমপরিমাণ স্বর্ণ দান করে, তথাপি তা ছাহাবীদের কোন একজনের (সৎকর্মের) সিকি ছা‘ সমপরিমাণ দানের বা তার অর্ধেকেরও সমতুল্য হবে না’।[1] রাসূল (সা.)-এর পরে ছাহাবীগণই আমাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব, আমাদের যাবতীয় সৎকর্মের প্রেরণা ও জান্নাতের পথে নিরন্তর
এগিয়ে যাওয়ার অনুভূতি। সেকারণ ছাহাবীদের জীবনী জানা ও সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে
নিজেদের জীবনকে সে মোতাবেক গড়ে তোলা জান্নাতপিয়াসী সকল মুমিনের জন্য আবশ্যক।
আলোচ্য নিবন্ধে ইসলামের প্রথম দাঈ ও ওহোদ যুদ্ধের ঝান্ডাবাহী তরুণ মুহাজির ছাহাবী
মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রা.)-এর জীবনী আলোচনা করা হ’ল।-
নাম ও বংশ পরিচয় : তার নাম মুছ‘আব। পিতার নাম উমায়ের। দাদার নাম হাশিম।
মাতার নাম খুনাস বিনতে মালেক। তার বংশ ধারা হচ্ছে- মুছ‘আব বিন ওমায়ের বিন হাশিম বিন আব্দে মানাফ বিন আব্দুদ দার
বিন কুছাই বিন কিলাব। তার কুনিয়াত হচ্ছে আবূ মুহাম্মাদ।[2]
ইসলামপূর্ব জীবন : মুছ‘আব মক্কার এক সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য পরিবারে
জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতা খুনাস বিনতে মালেক ছিলেন অঢেল সম্পদের মালিক। মুছ‘আব ছিলেন এক সুদর্শন যুবক। ছিলেন মায়ের অতি আদরের।
অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট তাকে কখনো স্পর্শ করেনি। দামী
পোষাক ও দামী আতর ব্যবহার ছিল তার নিত্য স্বভাব। তিনি মক্কার সকল দামী ব্রান্ডের
আতর ব্যবহার করতেন এবং দামী দামী পোষাক পরিধান করতেন।[3] ধনীর দুলাল হিসাবে তার চলাফেরাও ছিল ভিন্নতর। চলার পথে সহপাঠীরা ঘিরে রাখত
তাকে।[4] ইসলাম গ্রহণের পূর্বে পুরোদস্ত্তর এক বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি।
দ্বীনের আলো গ্রহণ : হেদায়াতের চাবি একমাত্র আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে ইচ্ছা হেদায়াতের আলো দান করেন (বাক্বারাহ ২/১৪২)। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান মুছ‘আবকে মহান আল্লাহ তাঁর দ্বীনের জন্য কবুল করলেন। ইসলামের একেবারে প্রারম্ভিক
সময়েই ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি। ছিলেন অগ্রবর্তী ছাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত। প্রচলিত
জাহেলী সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে তাওহীদের আলোকোজ্জ্বল রাজপথের সন্ধান পান তিনি।
জানতে পারেন ছাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী আরক্বাম বিন আবুল আরক্বামের গৃহে মুহাম্মাদ (সা.)
দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছেন। তাই কালক্ষেপণ না করে সংগোপনে সেখানে গিয়ে হাযির হন।
অতঃপর তাওহীদের অমিয় সুধা পান করে নিজেকে ধন্য করেন। বাপ-দাদার আচরিত ধর্ম ও সমাজ
ব্যবস্থা দু’পায়ে দলে চির শান্তির ধর্ম ইসলাম কবুল করেন।[5]
গৃহবন্দী মুছ‘আব : মুছ‘আব বিন ওমায়েরের ধনাঢ্য মা খুনাস ছিলেন অত্যন্ত রাগী মহিলা।
ছেলের প্রতি যেমন ছিলেন স্নেহশীল তেমনি শাসনেও ছিলেন কঠোর। মুছ‘আব তার মাকে ব্যতীত সমাজের অন্য কাউকে ভয় করতেন না।
মাতৃভীতির কারণে তিনি তার ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি আপাতত গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হ’লে জানাবেন। একারণে
তিনি দারুল আরক্বামে গোপনে যাতায়াত করতেন। কিন্তু ওছমান বিন তালহা তাঁর দারুল
আরক্বামে যাতায়াতের বিষয়টি দেখে ফেলেন এবং খবরটি তৎক্ষণাৎ তার মাকে জানিয়ে দেন।
ফলে তার মা সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সহায়তায় মুছ‘আবকে প্রথমে বুঝানোর চেষ্টা করে, অতঃপর শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। এমনকি তাঁকে
গৃহবন্দী করা হয়। দিন-রাত পাহারার মধ্যে রাখা হয় তাকে। যেন কোনভাবেই ঘর থেকে বের
হয়ে দারুল আরক্বামে যেতে না পারেন। এভাবে দিনের পর দিন বন্দীত্ব বরণ করেন তরুণ
ছাহাবী মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রা.)।[6]
হিজরত : গৃহবন্দী থাকাবস্থায় তিনি জানতে পারেন যে, নতুন মুসলমানদের একটি কাফেলা হাবশায় হিজরত করছেন। তিনিও মনস্থির করলেন
যেকোনভাবে এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি লাভ করে হাবশায় হিজরত করবেন। সে লক্ষ্যে সুযোগ
খুঁজতে থাকেন। একদিন কৌশলে তিনি বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং মুসলিম কাফেলার সাথে
হাবশায় হিজরত করেন। হাবশায় কিছুদিন থাকার পর তিনি পুনরায় মক্কায় ফিরে আসেন। এবারে
তিনি ইয়াছরিব তথা মদীনায় হিজরত করেন। রাসূল (সা.) তাকে দাঈ হিসাবে ইয়াছরিবে প্রেরণ
করেন। মুহাজিরদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম মদীনায় গমন করেন। বারা ইবনে ‘আযেব (রা.) বলেন,أَوَّلُ مَنْ قَدِمَ عَلَيْنَا مُصْعَبُ بْنُ
عُمَيْرٍ وَابْنُ أُمِّ مَكْتُومٍ، ثُمَّ قَدِمَ عَلَيْنَا عَمَّارُ بْنُ يَاسِرٍ
وَبِلاَلٌ رضى الله عنهم. ‘সর্বপ্রথম আমাদের মধ্যে (মদীনায়) আগমন করেন
মুছ‘আব বিন ওমায়ের ও ইবনু উম্মে মাকতূম (রা.)। তারপর আমাদের কাছে
আসেন আম্মার ইবনু ইয়াসির ও বিলাল (রা.)’।[7] একই মর্মে অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ قَالَ سَمِعْتُ الْبَرَاءَ بْنَ عَازِبٍ رضى
الله عنهما قَالَ أَوَّلُ مَنْ قَدِمَ عَلَيْنَا مُصْعَبُ بْنُ عُمَيْرٍ وَابْنُ
أُمِّ مَكْتُومٍ، وَكَانَا يُقْرِئَانِ النَّاسَ، فَقَدِمَ بِلاَلٌ وَسَعْدٌ
وَعَمَّارُ بْنُ يَاسِرٍ، ثُمَّ قَدِمَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ فِي عِشْرِينَ
مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ قَدِمَ النَّبِيُّ صلى الله
عليه وسلم، فَمَا رَأَيْتُ أَهْلَ الْمَدِينَةِ فَرِحُوا بِشَىْءٍ فَرَحَهُمْ
بِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم، حَتَّى جَعَلَ الإِمَاءُ يَقُلْنَ قَدِمَ
رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَمَا قَدِمَ حَتَّى قَرَأْتُ (سَبِّحِ
اسْمَ رَبِّكَ الأَعْلَى) فِي سُوَرٍ مِنَ الْمُفَصَّلِ-
‘আবূ ইসহাক হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বারা ইবনু ‘আযেব (রা.)-কে বলতে শুনেছি যে, সর্বপ্রথম আমাদের মধ্যে (মদীনায়) আগমন করেন মুছ‘আব বিন ওমায়ের ও ইবনু উম্মে মাকতূম (রা.)। তারা লোকদের কুরআন
পড়াতেন। তারপর আসেন বিলাল, সা‘দ ও আম্মার
ইবনু ইয়াসির (রা.)। এরপর ওমর
ইবনুল খাত্ত্বাব (রা.) রাসূল (সা.)-এর বিশজন ছাহাবীসহ মদীনায় আসেন। অতঃপর রাসূল (সা.)
স্বয়ং আগমন করেন। তাঁর আগমনে মদীনাবাসী যে পরিমাণ আনন্দিত হয়েছিল সে পরিমাণ
আনন্দিত হ’তে আমি কখনো দেখিনি। এমনকি দাসীরাও বলছিল, রাসূল (সা.) শুভাগমন করেছেন। বারা (রা.) বলেন, তাঁর আগমনের পূর্বেই আমি سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الأَعْلَى
পর্যন্ত কয়েকটি সূরা পড়েছিলাম’।[8]
এতে প্রমাণিত হয় যে, মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রা.) সর্বপ্রথম মদীনায় গমন
করেন। তিনি সেখানে দাওয়াতী কাজের পাশাপাশি লোকেদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন। যার ফলে রাবী নিজেই
কুরআনের বেশ কিছু সূরা শিখতে সক্ষম হয়েছিলেন। অন্য বর্ণনায় আছে, রাবী বলেন, فَمَا رَأَيْتُ أَهْلَ الْمَدِينَةِ فَرِحُوا بِشَىْءٍ فَرَحَهُمْ
بِهِ، حَتَّى رَأَيْتُ الْوَلاَئِدَ وَالصِّبْيَانَ يَقُولُونَ هَذَا رَسُولُ
اللَّهِ قَدْ جَاءَ ‘রাসূল (সা.)-এর আগমনে মদীনাবাসীকে এত বেশি
আনন্দিত হ’তে দেখেছি যে, অন্য কোন বিষয়ে তাদেরকে কখনো এতটা আনন্দিত হ’তে দেখিনি। এমনকি আমি দেখেছি যে, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা পর্যন্ত বলছিল, ইনিই তো আল্লাহর সেই রাসূল, যিনি আমাদের মাঝে
আগমন করেছেন’।[9]
ইসলামের প্রথম দাঈ মুছ‘আব : ইসলামের ইতিহাসে প্রথম দাঈ
ছিলেন মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রা.)। ১১ নববী বর্ষে হজ্জের মওসুমে ইয়াছরিব থেকে
মক্কায় আগত ৬ জন তরুণ ইসলাম কবূল করে মদীনায় ফিরে গিয়ে দাওয়াতী কাজ করলে পরের বছর
নতুন ৭জন সহ মোট ১২জন মক্কায় আগমন করেন। তাদের মধ্যে বয়োকনিষ্ঠ আস‘আদ বিন যুরারাহ (রা.) ছিলেন দলনেতা। আগের বছরের ন্যায় এবারও
তারা আক্বাবা নামক পাহাড়ী সুড়ঙ্গে রাসূল (সা.)-এর হাতে বায়‘আত করেন। এ সময় তারা তাদের সাথে মদীনায় একজন দাঈ প্রেরণের
জন্য রাসূল (সা.)-এর নিকটে অনুরোধ জানান। যিনি মদীনার সর্বত্র তাওহীদের বাণী পেঁŠছে দিবেন।
রাসূল (সা.) তখন মিষ্টভাষী, তীক্ষণধী সম্পন্ন তরুণ ছাহাবী মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রা.)-কে এ মহতী কাজের জন্য মনোনীত করেন। ফলে
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম দাঈ হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রা.)। মদীনায় গিয়ে তিনি আস‘আদ বিন
যুরারাহর বাড়ীতে অবস্থান করেন। অতঃপর তরুণ দুই ছাহাবী মুছ‘আব ও আস‘আদ (রা.) মিলে
ইয়াছরিবের ঘরে ঘরে তাওহীদের দাওয়াত পেঁŠছাতে শুরু করেন।[10]
মদীনায় দাওয়াতের সুফল : অল্পদিনের মধ্যেই তাদের দাওয়াতের সুফল দৃশ্যমান হ’তে লাগল। তিনি এতটাই নম্রভাষী ছিলেন যে, যে কেউ তার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মত শ্রবণ করত। চরম বিদ্বেষী
ব্যক্তিও মুহূর্তে পরম বন্ধুতে পরিণত হয়ে যেত। একদিন আস‘আদ বিন যুরারাহ তাঁকে সাথে নিয়ে ‘বনু আব্দিল আশহাল’ ও ‘বনু যাফরে’র মহল্লায় গমন করেন
ও সেখানে একটি কূয়ার পাশে কয়েকজন মুসলমানকে নিয়ে বসে দাওয়াতী কাজ করছেন। তখনো
পর্যন্ত বনু আব্দিল আশহাল গোত্রের দুই নেতা সা‘দ বিন মু‘আয ও উসায়েদ বিন হুযায়ের ইসলাম কবুল করেননি। মুবাল্লিগদের
আগমনের খবর জানতে পেরে সা‘দ উসায়েদকে বললেন, আপনি গিয়ে ওদের নিষেধ করুন যেন আমাদের সরল-সিধা মানুষগুলিকে
বোকা না বানায়। আস‘আদ আমার খালাতো ভাই না হ’লে আমি নিজেই যেতাম’।
অতঃপর উসায়েদ বর্শা উঁচিয়ে সদর্পে সেখানে
গিয়ে বললেন, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, তবে এখুনি পালাও। তোমরা আমাদের বোকা লোকগুলিকে মুসলমান
বানাচ্ছ’। মুছ‘আব তখন শান্তভাবে বললেন, আপনি কিছুক্ষণের জন্য বসুন ও কথা শুনুন। যদি পসন্দ না হয়, তখন দেখা যাবে’। উসায়েদ তখন মাটিতে বর্শা গেড়ে বসে পড়লেন। অতঃপর মুছ‘আব তাকে কুরআন থেকে কিছু অংশ পাঠ করে শুনালেন। তারপর তিনি
আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ত্ব ও তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যের গুরুত্ব
সম্পর্কে কিছু কথা বললেন। ইতিমধ্যে উসায়েদ চমকিত হয়ে বলে উঠলেন,مَا أَحْسَنَ هَذَا الْكَلاَمَ
وَأَجْمَلَهُ ‘কতই না সুন্দর কথা এগুলি ও কতই না মনোহর’। এরপর তিনি সেখানেই
ইসলাম কবুল করলেন। অতঃপর তিনি সা‘দ বিন মু‘আয-এর নিকটে এসে বললেন, فَواللهِ مَا رَأَيْتُ بِهِمَا بَأْسًا ‘আল্লাহর কসম! আমি তাদের মধ্যে দোষের কিছু দেখিনি’।
পরক্ষণে সা‘দ বিন মু‘আযও ইসলাম কবুল করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি
নিজ গোত্রে ফিরে এসে সবাইকে ডেকে বললেন, ‘হে বনু আব্দিল আশহাল! তোমরা আমাকে তোমাদের মধ্যে কেমন মনে কর?’ তারা বলল, ‘আপনি আমাদের নেতা, সর্বোত্তম সিদ্ধান্তের অধিকারী ও আমাদের নিশ্চিন্ততম
কান্ডারী’। তখন তিনি
বললেন,
فَإِنَّ كَلاَمَ
رِجَالِكُمْ وَنِسَائِكُمْ عَلَيَّ حَرَامٌ حَتّى تُؤْمِنُوا بِاللهِ
وَبِرَسُولِهِ ‘তোমাদের নারী ও পুরুষ সকলের সঙ্গে আমার কথা
বলা হারাম, যে পর্যন্ত না তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের
উপরে ঈমান আনবে’। এ কথার
প্রতিক্রিয়া এমন হ’ল যে, সন্ধ্যার মধ্যেই সকলে ইসলাম কবুল করল’।[11]
এভাবে মুছ‘আব (রা.)-এর দাওয়াতী মেহনতের ফলে পরবর্তী হজ্জ মৌসুম আসার আগেই ইয়াছরিবের ঘরে
ঘরে ইসলামের শাশ্বত বাণী পৌঁছে গিয়েছিল এবং ৭৫ জনের এক বিশাল কাফেলা মক্কায় গিয়ে
আক্বাবা নামক পাহাড়ী সুড়ঙ্গে রাসূল (সা.)-এর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করে ধন্য হয়েছিলেন। যাকে ‘বায়‘আতে কুবরা’ বলা হয়। সেই সাথে রাসূল (সা.)-এর মদীনায় হিজরতের পথও সুগম ও সুপ্রশস্ত হয়েছিল।
ওহোদ যুদ্ধে ঝান্ডাবহন ও
শাহাদতবরণ : তিনি বদর ও ওহোদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে কাফেরদের বিরুদ্ধে বীর
বিক্রমে যুদ্ধ করেছেন। ওহোদের যুদ্ধে রাসূল (সা.) তাঁর হাতে ইসলামের ঝান্ডা অর্পণ
করেন। ৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সকালে যুদ্ধ শুরু হয়। তৎকালীন রীতি অনুযায়ী
প্রথমে দ্বৈত যুদ্ধ, অতঃপর সম্মিলিত যুদ্ধে কাফের বাহিনীর বহু
সৈন্য হতাহত হয় ও তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে থাকে। কিন্তু গনীমত সংগ্রহকে কেন্দ্র
করে গিরিপথের পাহারাদার মুসলিম তীরন্দায সেনাদের সাময়িক ভুল সিদ্ধান্তের ফলে
শত্রুপক্ষের অশ্বারোহী দলের চৌকস সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ তার বাহিনী নিয়ে উক্ত
গিরিপথ দিয়ে ঝড়ের বেগে মুসলিম বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে মুসলিম বাহিনীর উপর
মহা পরীক্ষা নেমে আসে। নিশ্চিত বিজয় যেন পরাজয়ের রূপ লাভ করে। অনেক ছাহাবী হাতাহত
হন। রাসূল (সা.) মারাত্মকভাবে আহত হন। তাঁর দান্দান মুবারক শহীদ হয়। এই কঠিন
মুহূর্তে যে কয়জন ছাহাবী রাসূল (সা.)-এর নিকটে ছুটে এসে তাকে বাঁচানোর জন্য নিজের
জীবন বাজি রেখে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন মুছ‘আব বিন
ওমায়ের (রা.)। =সীরাতুর রাসূল, পৃ: ৩৭৩। এক হাতে তরবারী ধারণ করে অপর
হাতে তিনি শত্রুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র চালাতে থাকেন। জান্নাত লাভের উদগ্র নেশায়
বীরত্বের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ইতিমধ্যে শত্রুদের টার্গেট হয়ে যান তিনি।
শত্রুপক্ষের অশ্বারোহী ইবনে ক্বামিয়াহ ধেয়ে আসে তাঁর দিকে। ঘোড়ার উপর থেকে অস্ত্র
চালনা করে সে। মুছ‘আবও সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করেন। অতঃপর
ইবনে ক্বামিয়াহ তাঁর ডান হাতে আঘাত করলে হাতটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি
তখন বলে ওঠেন, وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ
الرُّسُلُ ‘মুহাম্মাদ একজন রাসূল ছাড়া কিছুই নন। তাঁর
পূর্বে আরো বহু রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন’। এবারে মুছ‘আব স্বীয় বাম হাত
দ্বারা ইসলামের ঝান্ডাকে উড্ডীন করেন। ইবনে ক্বামিয়াহ দ্বিতীয়বার আঘাত করে তাঁর
বাম হাতটিও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আবারও তিনি পূর্বের ন্যায় বলতে থাকেন, وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا
رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ ‘মুহাম্মাদ একজন রাসূল ছাড়া কিছুই নন। তাঁর পূর্বে আরো বহু
রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন’। মুছ‘আবের দুই হাতই দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই কঠিন
মুহূর্তে জীবনের অন্তিম সায়াহ্নেও তিনি ইসলামের ঝান্ডাকে পদানত হ’তে দেননি। যন্ত্রণায় কাতর রক্তাক্ত মুছ‘আব এবারে দুই হাতের বাহু দ্বারা ইসলামের ঝান্ডাকে উঁচু করে
ধরেন। কিন্তু না শেষ রক্ষা হ’ল না। তৃতীয় দফায়
বর্শা নিক্ষেপ করা হ’ল তাঁর দিকে। অবশেষে বর্শা বিদ্ধ হয়ে ইসলামের
পতাকা নিয়েই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। এভাবেই সংক্ষিপ্ত ও মর্যাদামন্ডিত জীবনের
অবসান ঘটিয়ে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাক্বামে পৌঁছে যান ইসলামের প্রথম দাঈ
দুনিয়াত্যাগী ছাহাবী মুছ‘আব বিন ওয়ায়ের (রা.)।[12]
এদিকে মুছ‘আব বিন ওমায়ের শহীদ হবার পর তাঁকে আঘাতকারী আব্দুল্লাহ বিন ক্বাতিমাহ ফিরে
গিয়ে ঘোষণা করে যে, إِنَّ مُحَمَّدًا قَدْ قُتِلَ ‘মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে’। কেননা রাসূল (সা.)-এর চেহারার সাথে মুছ‘আবের চেহারার অনেকটা মিল ছিল। এই খবর উভয় শিবিরে দারুণ
প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মুসলমানগণ ক্ষণিকের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তখন
আল্লাহ তা‘আলা মুছ‘আবের
মুখনিঃসৃত উক্ত বাণীই অহী হিসাবে নাযিল করেন, وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ
قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ
وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي
اللَّهُ الشَّاكِرِينَ ‘আর মুহাম্মাদ একজন রাসূল বৈ কিছু নন। তাঁর
পূর্বে বহু রাসূল বিগত হয়েছেন। এক্ষণে যদি তিনি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তাহ’লে তোমরা কি পশ্চাদপসরণ করবে? বস্ত্ততঃ যদি কেউ পশ্চাদপসরণ করে, সে আল্লাহর কোনই ক্ষতি করতে পারে না। আর আল্লাহ সত্বর তাঁর
কৃতজ্ঞ বান্দাদের পুরস্কৃত করবেন’ (আলে ইমরান ৩/১৪৪)।[13]
কাফন-দাফন : যুদ্ধ শেষ হ’লে রাসূল (সা.) মুছ‘আব বিন ওমায়েরের নিকট যান এবং সূরা আহযাবের ২৩নং আয়াত তিলাওয়াত
করেন। যেখানে আল্লাহ বলেন, مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّهَ
عَلَيْهِ فَمِنْهُمْ مَنْ قَضَى نَحْبَهُ وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْتَظِرُ وَمَا
بَدَّلُوا تَبْدِيلًا ‘মুমিনদের মধ্যে অনেকে আল্লাহর সাথে তাদের কৃত
অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। আর
তারা তাদের অঙ্গীকার আদৌ পরিবর্তন করেনি’ (আহযাব ৩৩/২৩)।
এ সময়ে রাসূল (সা.) তার কাফনের চাদরটির দিকে
তাকিয়ে বলেন, ‘আমি তোমাকে মক্কায় দেখেছি।
সেখানে তোমার চেয়ে কোমল চাদর এবং সুন্দর যুলফী আর কারো ছিল না। আর আজ তুমি এখানে
এই চাদরে ধুলিমলিন অবস্থায় পড়ে আছ’। তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, ক্বিয়ামতের দিন তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে সাক্ষ্যদানকারী হবে’।[14] উল্লেখ্য যে, তাঁর কাফনের জন্য একখন্ড চাদর ব্যতীত কোন
কিছু পাওয়া যায়নি। যা দিয়ে তার মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে যেত, পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে যেত। অবশেষে রাসূল (সা.)-এর নির্দেশে
চাদরটি দিয়ে মাথা ঢেকে ‘ইযখির’ ঘাস দিয়ে পা ঢেকে তাকে দাফন করা হয়।
ছাহাবী আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.)-কে একদিন
খাবার দেওয়া হ’লে তিনি আক্ষেপ করে বললেন,قُتِلَ مُصْعَبُ بْنُ عُمَيْرٍ
وَكَانَ خَيْرًا مِنِّى فَلَمْ يُوجَدْ لَهُ مَا يُكَفَّنُ فِيهِ إِلاَّ بُرْدَةٌ ‘মুছ‘আব বিন উমায়র (রা.) শহীদ হয়েছেন। তিনি ছিলেন
আমার চাইতে শ্রেষ্ঠ, অথচ তাঁর কাফনের জন্য এক ফালি চাঁদর ছাড়া কিছুই
পাওয়া যায়নি’।[15]
অন্য বর্ণনায় আছে, আব্দুর রহমান বিন আওফ ছিয়াম অবস্থায় ছিলেন। তাকে খাদ্য
পরিবেশন করা হ’লে তিনি বলেন, قُتِلَ ‘মুছ‘আব বিন উমায়র (রা.) শহীদ হয়েছেন। তিনি ছিলেন
আমার চাইতে শ্রেষ্ঠ। অথচ তাঁকে এমন একখানা চাদর দিয়ে কাফন দেয়া হ’ল যে, তাঁর মাথা ঢাকলে দু’পা বের হয়ে যায়। আর দু’পা ঢাকলে
মাথা বের হয়ে যায়। (রাবী বলেন) আমার মনে পড়ে, তিনি আরও বলেছিলেন, হামযাহ (রা.) শহীদ হয়েছেন। তিনিও ছিলেন আমার
চাইতে শ্রেষ্ঠ। অতঃপর আমাদেরকে পৃথিবীতে অনেক প্রাচুর্য দেওয়া হয়েছে। আমার আশংকা
হয় যে,
আমাদের নেক আমল গুলোর বিনিময় আমাদেরকে আগেই
দিয়ে দেওয়া হ’ল কি-না। এরপর তিনি কাঁদতে লাগলেন, এমনকি খাদ্যও পরিহার করলেন।[16] একই মর্মে খাববাব (রা.) হ’তে বর্ণিত আছে, খাববাব (রা.) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলল্লাহ (সা.)-এর
সাথে হিজরত করেছি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার
সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য। আমাদের প্রতিদান আল্লাহর নিকটেই নির্ধারিত আছে। আমাদের
মধ্যে অনেকে তাঁদের ত্যাগ ও কুরবানীর ফল ভোগ না করেই আখেরাতে চলে গেছেন। তাদের
মধ্যে মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রা.) অন্যতম। তিনি ওহোদ
যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তাঁকে কাফন দেয়ার জন্য আমরা তার একটি চাদর ব্যতীত আর কিছুই
পাইনি। চাদরটি দিয়ে তাঁর মাথা ঢাকলে পা বের হয়ে যায়, পা ঢাকলে মাথা বের হয়ে যায়। তখন রাসূল (সা.) বললেন, চাদরটি দিয়ে তাঁর মাথা ঢেকে দাও, আর পা দু’টির উপর ইয্খির
ঘাস রেখে দাও। অর্থাৎ ইযখির ঘাস দিয়ে পা ঢেকে দাও। আর আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন, যাদের ফল পেকে গেছে এবং তাঁরা তা আহরণ করছেন’।[17]
উপসংহার : দুনিয়া ত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন ছাহাবী মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রা.)। চিরশান্তির অনন্ত নিবাস জান্নাত লাভের প্রত্যাশায় তিনি
বিলাসী জীবন ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করে বেছে নিয়েছিলেন সমাজ সংস্কারের কাঁটাযুক্ত পথ।
বাহারী পোষাক ও দামী আতর ত্যাগ করে পরেছিলেন অতি সাধারণ পোষাক। ইসলামের সূচনালগ্নে
ইয়াছরিবের জনপদে তাঁর প্রজ্ঞাপূর্ণ দাওয়াত, সদাচরণ, মিষ্টভাষিতা ও ধৈর্যশীলতা এবং সর্বোপরি
জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ইসলামের ঝান্ডাকে উড্ডীন রাখার প্রাণান্ত কোশেশ
আল্লাহর পথের দাঈদের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর
তাক্বওয়াপূর্ণ আপোষহীন জিহাদী যিন্দেগী থেকে ইবরত হাছিলের তাওফীক দান করুন-আমীন!
[1]. বুখারী হা/৩৬৭৩; মুসলিম
হা/২৫৪০; মিশকাত হা/৫৯৯৮।
[2]. ইবনুল জাওযী, আল-মুনতাযাম ফী
তারীখিল মুলূক ওয়াল উমাম (বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ, তাবি), ৩/১৯৩; খালেদ মুহাম্মাদ
খালেদ, রিজালুন হাওলার
রাসূল (বৈরুত: দারুল ফিকর ১৪২১হি:), পৃ. ২৫।
[3]. রিজালুন হাওলার রাসূল, পৃ. ২৪।
[4]. সীরাতুর রাসূল (সা.) (রাজশাহী: হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৩য় মুদ্রণ ২০১৬), পৃ. ২০৫।
[5]. আল-মুনতাযাম ফী তারীখিল মুলূক ওয়াল উমাম, ৩/১৯৩; রিজালুন হাওলার রাসূল, পৃ.২৪-২৫।
[6]. রিজালুন হাওলার রাসূল, পৃ. ২৫।
[7]. বুখারী হা/৩৯২৪; ঐ, ই.ফা.বা. হা/৩৬৪০।
[8]. বুখারী হা/৩৯২৫; ঐ, ই.ফা.বা. হা/৩৬৪১।
[9]. বুখারী হা/৪৯৪১; ঐ, ই.ফা.বা. হা/৪৫৭৭ ‘তাফসীর’ অধ্যায় নং-৫২; মিশকাত হা/৫৯৫৬।
[10]. রিজালুন হাওলার রাসূল, পৃ. ২৭।
[11]. সীরাতুর রাসূল, পৃ.
২০৫-২০৬।
[12]. আল-মুনতাযাম ফী তারীখিল মুলূক ওয়াল উমাম, ৩/১৯৪; রিজালুন হাওলার রাসূল, পৃ. ২৯।
[13]. মুনতাযাম ৩/১৯৫; রিজালুন
হাওলার রাসূল, পৃ. ২৯; সীরাতুর রাসূল, পৃ. ৩৭০।
[14]. মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, হা/২৯৭৭; রিজালুন হাওলার
রাসূল, পৃ. ৩০।
[15]. বুখারী হা/১২৭৪; ঐ, ই.ফা.বা. হা/১২০০ ‘জানাযা’ অধ্যায়।
[16]. বুখারী হা/১২৭৫; ৪০৪৫; ঐ, ই.ফা.বা. হা/১২০১; মিশকাত
হা/১৬৪৪।
[17]. বুখারী হা/৩৯১৪, ৪০৪৭; ঐ, ই.ফা.বা. হা/৩৬৩২; মুসলিম
হা/৯৪০; তিরমিযী হা/৩৮৫৩; মিশকাত হা/৬১৯৬।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(১২)
যয়নাব বিনতু খুযাইমা (রা.)
ভূমিকা :
উম্মুল মুমিনীন যয়নাব বিনতু খুযাইমা (রা.)
ছিলেন অতীব দানশীলা মহিলা। তিনি গরীব-দুঃখী ও দুস্থদের উদার হস্তে দান করতেন। তিনি
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণকারী উম্মুল মুমিনীনদের অন্যতম ছিলেন।
তাঁর সৌভাগ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং তার জানাযার ছালাত
পড়িয়েছিলেন। দানশীলতার পাশাপাশি ইবাদত-বন্দেগীতেও তিনি ছিলেন অন্যান্য নবী
পত্নীগণের ন্যায় অগ্রবর্তী সারিতে। উত্তম চরিত্র মাধুর্যের অধিকারিণী মহিলা ছাহাবী
যয়নাব (রা.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী এ নিবন্ধে আলোচনার প্রয়াস পাব।
নাম ও বংশ পরিচয় :
তাঁর নাম যয়নাব, উপাধি ‘উম্মুল মাসাকীন’ বা দীন-দুঃখীদের জননী। জাহেলী যুগেও তাঁকে এ নামে ডাকা হ’ত। কারণ তিনি দরিদ্রদের বেশী বেশী খাদ্য দান করতেন।[1] তাঁর পিতার নাম খুযাইমা। তাঁর পূর্ণ বংশ পরিচয় হচ্ছে- যয়নাব বিনতু খুযাইমা
ইবনিল হারেছ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আবদে মানাফ ইবনে হেলাল ইবনে আমের ইবনে
ছা‘ছা‘আহ।[2] তাঁর মায়ের নাম হিন্দ বিনতু আওফ ইবনিল হারেছ ইবনে হিমাতাহ আল-হুমায়রিয়া।[3] তিনি ছিলেন উম্মুল মুমিনীন মায়মূনা (রা.)-এর বৈপিত্রীয় বোন।[4]
জন্ম ও শৈশব :
যয়নাব (রা.)-এর জন্মকাল সম্পর্কে কিছু জানা
যায় না। তবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে বিবাহের সময় তার বয়স হয়েছিল ৩০ বছর।[5] সে হিসাবে তাঁর জন্ম ৫৯৫ খৃষ্টাব্দে হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। তাঁর
শৈশব-কৈশোর সম্পর্কেও কিছুই জানা যায় না।
প্রথম বিবাহ :
প্রথমে কার সাথে যয়নাব (রা.)-এর বিবাহ হয়েছিল
এ ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। এ ব্যাপারে যে মতগুলি পাওয়া যায় তা হচ্ছে- (১) তুফায়েল
ইবনুল হারেছ ইবনিল মুত্তালিব ইবনে আবদে মানাফের সাথে যয়নাব (রা.)-এর প্রথম বিবাহ
হয়।[6] অতঃপর তুফায়েলের ভাই ওবায়দাহ ইবনুল হারেছ যয়নাবকে বিবাহ করেন। ওবায়দাহ বদর
যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন।[7] (২) তাঁর প্রথম স্বামী ছিলেন আব্দুল্লাহ বিন জাহাশ। তিনি ওহোদ যুদ্ধে নিহত হন।[8] (৩) তিনি তুফায়েল ইবনিল হারেছের অধীনে ছিলেন। তুফায়েল যয়নাব (রা.)-কে তালাক
দিলে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বিবাহ করেন। (৪) সীরাতে ইবনে হিশামে আছে, তিনি প্রথমে জাহম ইবনু আমর ইবনিল হারেছ আল-হিলালীর নিকটে
ছিলেন। তারপরে ওবায়দা ইবনিল হারেছ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব তাঁকে বিবাহ করেন।[9] (৫) ছালাহুদ্দীন মকবূল আহমাদ বলেন, রাসূলুল্লাহর পূর্বে তাঁর চাচাদের বংশের দু’জনের সাথে যয়নাব (রা.)-এর বিবাহ হয়েছিল। প্রথমতঃ তুফায়েল ইবনুল হারেছ তাঁকে
বিবাহ করেন এবং পরে তিনি তাঁকে তালাক দেন। অতঃপর তার ভাই ওবায়দাহ ইবনুল হারেছ
তাঁকে বিবাহ করেন। তিনি বদর যুদ্ধে নিহত হন।[10]
মোদ্দাকথা তুফায়েল যয়নাব (রা.)-কে প্রথম
বিবাহ করেন। তার সাথে বিচ্ছেদ ঘটলে তার ভাই ওবায়দার সাথে যয়নাব (রা.)-এর দ্বিতীয়
বিবাহ সম্পন্ন হয়। তিনি বদর যুদ্ধে শহীদ হ’লে
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে যয়নাব (রা.)-এর বিবাহ হয়। এটাই প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য
মত।[11]
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে
বিবাহ :
যয়নাব (রা.)-এর পূর্বের স্বামীর মৃত্যুর পরে
হিজরতের ৩১ মাসের মাথায় তথা ৩য় হিজরীর রামাযান মাসে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বিবাহ
করেন। রাসূলে কারীম (সা.) তাকে ১২ উকিয়া[12] ও ১ নশ[13] মোহর দিয়েছিলেন।[14] অন্য বর্ণনায় আছে, যয়নাব (রা.)-এর চাচা কাবীছাহ ইবনু আমর
আল-হিলালী তাঁকে রাসূলের সাথে বিবাহ দেন। আর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে ৪০০ দেরহাম
মোহর দিয়েছিলেন।[15] মাহমূদ শাকের বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন যয়নাব (রা.)-কে বিবাহ
করেন,
তখন তার বয়স ছিল ৬০ বছর। আর এই অধিক বয়সের
কারণেই তাকে কেউ বিবাহ করতে চাচ্ছিল না।[16] একথা ঠিক নয়। কেননা সর্বাধিক বিশুদ্ধ মতে, তিনি ৩০ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।[17] সুতরাং ৬০ বছর বয়সে বিবাহ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
যয়নাব (রা.)-কে বিবাহের কারণ :
যয়নাব (রা.)-কে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিবাহের
পিছনে কতিপয় সামাজিক ও ধর্মীয় কারণ বিদ্যমান ছিল। স্রেফ উপভোগের জন্য হ’লে রাসূল (সা.) তাকে বিবাহ করতেন না। কেননা তিনি একদিকে
ছিলেন বিধবা এবং অপরদিকে মধ্যম বয়সী।[18] এছাড়া তিনি অতীব সুন্দরী বা অধিক জ্ঞানবতী বিদুষী মহিলাও ছিলেন না।[19] তাকে বিবাহ করার অন্য কারণ ছিল। তন্মধ্যে কতিপয় কারণ নিম্নে উদ্ধৃত হ’ল।- (১) যয়নাব (রা.)-এর স্বামীর ইন্তিকালের পরে তিনি
আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। তাঁকে বিবাহ করতে তেমন কেউ রাযী ছিল না। তেমনি তাঁর পরিবারের
কেউ তাঁর দায়িত্বভার গ্রহণ করেনি। কারণ তখনও তাঁর পরিবারের কেউ ইসলাম গ্রহণ করেনি।
এমতাবস্থায় যয়নাব (রা.) নিদারুণ আর্থিক সংকটে নিপতিত হন। তাঁর ভরণ-পোষণে সমস্যা
দেখা দেয়। ফলে অসহায় যয়নাব (রা.)-কে আশ্রয় দিতে এবং তাঁর অসহায়ত্ব দূর করতে
রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বিবাহ করেন।[20] (২) যয়নাব (রা.)-এর প্রতি দয়াপরবশ হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বিবাহ করেছিলেন।
কেননা তার পূর্ব স্বামী ছিল রাসূলের চাচাত ভাই।[21] (৩) বদর যুদ্ধে তার নির্ভীক বীর স্বামী শহীদ হওয়ায় তার অন্তরে যে ব্যথা সৃষ্টি
হয়,
তা দূরীভূত করে তার হৃদয়কে প্রশান্ত করা ও
তার প্রতি সহানুভূতি স্বরূপ রাসূল (সা.) তাকে বিবাহ করেন।[22] (৪) যয়নাব (রা.)-এর পিতৃবংশ হাওয়াযেন-এর বনু আমির শাখার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের
মানসে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে স্ত্রীত্বে বরণ করেন।[23]
রাসূলের নিকটে অবস্থান :
রাসূল (সা.)-এর নিকটে তিনি কতদিন অবস্থান
করেছিলেন এ ব্যাপারে কয়েকটি মতামত পাওয়া যায়। (১) মাহমূদ শাকের বলেন, وعاشت عنده عامين ثم توفيت فى
حياته، ‘তিনি রাসূলের নিকটে দু’বছর জীবন যাপন করেন। অতঃপর রাসূলের জীবদ্দশায়ই তিনি
ইন্তিকাল করেন’।[24] (২) হাকিম নাইসাপুরী বলেন, ولم تلبث عنده إلا يسيرًا، ‘তিনি রাসূলের নিকটে অল্প দিন অবস্থান করেন’।[25] (৩) হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী বলেন, لم تمكث عنده إلا شهرين أو أكثر، ‘তিনি রাসূলের নিকট কেবল দু’মাস বা তার চেয়ে কিছু বেশী দিন অবস্থান করেন’।[26] (৪) সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ জরদানী বলেন, ولم تلبث عنده إلا شهرين أوثلاثة ثم مات، ‘তিনি রাসূলের নিকটে শুধু দু’মাস বা তিন মাস অবস্থান করেন। অতঃপর মৃত্যুবরণ করেন’।[27] (৫) ইবনু সা‘দ ও ইবনুল কালবী বলেন, فمكث عنده ثمانية أشهر، ‘অতঃপর তিনি রাসূলের নিকটে ৮ মাস অবস্থান করেন’।[28] (৬) হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী ও ইবনুল ইমাদ আল-হাম্বলী বলেছেন, যয়নাব (রা.) রাসূলের নিকটে তিন মাস অবস্থান করেন।[29] মোটকথা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকটে যয়নাব (রা.) অল্পকাল ছিলেন এবং রাসূলের
জীবদ্দশাতেই ইন্তিকাল করেন।[30] তাঁর থেকে কোন হাদীছ বর্ণিত হয়নি।[31]
দানশীলতা :
যয়নাব (রা.)-এর দানশীলতা ছিল সুপরিজ্ঞাত।
ইসলাম গ্রহণের পূর্বেই তিনি স্বীয় কবীলার নিকট দানশীলা হিসাবে পরিচিতা ছিলেন। কোন
দীন-দুঃখী তাঁর নিকটে এসে খালি হাতে ফিরে যেত না। তিনি গরীব-দুঃখীদের এমনভাবে
সেবা-যত্ন করতেন যে, তাঁকে ‘উম্মুল
মাসাকীন’ বা ‘গরীবদের
জননী’
উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল।[32] ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর মধ্যে দান-খয়রাত করার ঐ প্রবণতা অব্যাহত ছিল।
দরিদ্র-অভাবী মানুষের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। তাঁর এ
অনুপম গুণাবলীর দ্বারা তিনি পৃথিবীতে অমর হয়ে আছেন। তাঁর দানশীলতা সম্পর্কে ড.
আয়েশা আব্দুর রহমান বলেন, ঐতিহাসিক ও চরিতকারগণ যয়নাব বিনতু খুযাইমার
বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য করলেও গরীব-দুঃখীদের প্রতি তাঁর দয়া-দাক্ষিণ্য, সহানুভূতি-সহমর্মিতার এই উত্তম বিশেষণের ব্যাপারে সকলেই
ঐকমত্য হয়েছেন। যত গ্রন্থে যয়নাব বিনতু খুযাইমার নাম উল্লেখিত হয়েছে সেখানেই তাঁর
উপাধি ‘উম্মুল মাসাকীন’ তথা ‘দরিদ্রদের জননী’ উল্লেখ করা হয়েছে।[33] রাসূলের স্ত্রী হিসাবে বরিত হওয়ার পরও রাসূলের সেবা ও অন্তঃপুরের ব্যস্ততা
গরীব-দুঃখীদের সেবা-যত্ন থেকে তাঁকে দূরে সরাতে পারেনি। এ গুণ আমৃত্যু তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল।[34]
রাসূলের আনুগত্য ও অল্পে তুষ্টি
:
ইসলাম গ্রহণের পর থেকে রাসূল (সা.)-এর প্রতি
তাঁর আনুগত্য ছিল অকৃত্রিম ও অতুলনীয়। রাসূলের স্ত্রী হওয়ার মর্যাদা তিনি লাভ
করেছিলেন, এজন্য তার মনে কোন অহংকার ছিল না। তিনি রাসূল
(সা.)-এর নিকট থেকে যা পেতেন তার প্রতিই সন্তুষ্ট থাকতেন। অল্পে তুষ্টির এ উত্তম
গুণ তাঁর মধ্য ছিল সদা অমলিন। কোন উচ্চাভিলাষ ও কোন আত্মঅহংকার তাঁর ঐ উত্তম
বিশেষণ থেকে তাঁকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বরং সরল-সহজ, অনাড়ম্বর ও নির্ঝঞ্ঝাট জীবন-যাপনে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন।[35]
ইন্তিকাল ও দাফন :
যয়নাব (রা.)-এর মৃত্যু সন নিয়েও কিছুটা
মতবিরোধ রয়েছে। ইবনুল কালবী বলেন, وماتت فى ربيع الآخر سنة أربع ‘তিনি ৪র্থ হিজরীর রবীউল আখির মাসে ইন্তিকাল করেন’।[36] ইবনু সা‘দ বলেন, وتوفيت فى آخر شهر ربيع الآخر على رأس تسعة وثلاثين
شهرًا- ‘তিনি হিজরতের ৩৯ মাসের মাথায়
রবীউল আখির মাসের শেষে মৃত্যুবরণ করেন’।[37] মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৩০ বছর।[38] ড. আয়েশা আব্দুর রহমান বলেন, والراحج انها ماتت فى الثلاثين من عمرها- ‘অগ্রাধিকারযোগ্য কথা হচ্ছে যে, তিনি ৩০ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন’।[39]
উম্মুল মুমিনীনদের মধ্যে খাদীজা (রা.) প্রথম
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় ইন্তিকাল করেন, যাকে মক্কার ‘জিহুন’ নামক স্থানে দাফন করা হয়। অতঃপর যয়নাব বিনতু খুযাইমা (রা.) রাসূলের জীবদ্দশায়
মদীনায় ইন্তিকাল করেন।[40] রাসূলুল্লাহ (সা.) তার জানাযা ছালাত পড়ান। তাঁকে ‘বাক্বীউল গারক্বাদে’ দাফন করা হয়।[41] যয়নাব (রা.)-এর তিন ভাই তাঁর কবরে নেমেছিলেন।[42] উম্মুল মুমিনীনের মধ্যে যয়নাব বিনতু খুযাইমাই (রা.) ছিলেন ভাগ্যবতী মহিলা, যাকে প্রথম ‘বাক্বীউল
গারক্বাদে’ দাফন করা হয়।[43]
উপসংহার :
ইসলামপূর্ব জাহেলীযুগ থেকেই যয়নাব (রা.)
দুস্থ মানবতার সেবায় ছিলেন নিবেদিতা প্রাণ। ইসলামে দাখিল হওয়ার পর নিবিষ্টমনে মহান
আল্লাহর ইবাদত করার পাশাপাশি তিনি গরীব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। আর
তাঁর এ সৎকাজের সুমহান পুরস্কার আল্লাহ তাকে পার্থিব জীবনে দান করেছেন। তাঁর
অসহায়ত্বের সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) তার পাশে এসে দাঁড়ান এবং তাকে স্ত্রী হিসাবে বরণ
করেন। তিনি উম্মুল মুমিনীন হওয়ার বিরল সম্মানে ভূষিতা হন। যদিও রাসূলের সাথে তার
দাম্পত্য জীবন ছিল অতি অল্প সময়ের; কিন্তু তাঁর সৌভাগ্য হ’ল রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং তার জানাযা ছালাত
পড়িয়েছেন। পরিশেষে বলব, যয়নাব (রা.) তাঁর সংগ্রামী জীবনে সদা
দীন-দুঃখীদের পাশে ছিলেন। তাদের প্রয়োজন পূরণই ছিল তাঁর সতত সাধনা। এই অনুপম গুণই
তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। আল্লাহ আমাদেরকেও তাঁর মত গুণাবলী অর্জনের তাওফীক্ব দিন-
আমীন!
[1]. সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ জরদানী, ফাতহুল আল্লাম বিশারহি মুরশিদিল আনাম, ১ম খন্ড (কায়রো : দারুস সালাম, ৪র্থ প্রকাশ, ১৪১০ হিঃ/১৯৯০ খৃঃ), পৃঃ ২৩৭।
[2]. আবু আব্দুল্লাহ আল-হাকিম আন-নাইসাপুরী, আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৪র্থ খন্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০খৃঃ/১৪১১ হিঃ), পৃঃ ৩৬।
[3]. ড. আয়েশা আব্দুর রহমান, তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত (বৈরুত : দারুর
রাইয়্যান, তা.বি.), পৃঃ ৩১৪।
[4]. শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড (বৈরুত :
মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ৩য় প্রকাশ, ১৪০৫ হিঃ/১৯৮৫ খৃঃ), পৃঃ ২১৮।
[5]. ফাতহুল আল্লাম, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৩৭।
[6]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২১৮; তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩১৫।
[7]. সাঈদ আইয়ূব, যাওজাতুন নবী (সা.) (বৈরুত : দারুল হাদী, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৭/১৪১৭-১৮ হিঃ), পৃঃ ৬০; মুহাম্মাদ ইবনু সা‘দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০খৃঃ/১৪১০ হিঃ), পৃঃ ৯১।
[8]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২১৮; আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩৬।
[9]. তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩১৫।
[10]. ছালাহুদ্দীন মকবূল আহমাদ, আল-মারআতু বায়না হিদায়াতিল ইসলাম ওয়া গাওয়াতিল ই‘লাম (কুয়োত : দারু ইলাফ আদ-দাওলিয়া, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৭খৃঃ/১৪১৮হিঃ), পৃঃ ২৬৫।
[11]. তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩১৫।
[12]. ৪০ দেরহামে এক উকিয়া। দ্রঃ মিশকাত হা/৩২০৩; এক দেরহাম সমান তিন মাসা 1 রতি। দ্রঃ নূর মুহাম্মাদ আজমী, বঙ্গানুবাদ মিশকাত ৬/১৯৭ পৃঃ।
[13]. এক নশ হচ্ছে অর্ধ উকিয়া বা ২০ দেরহাম। দ্রঃ মিশকাত হা/৩২০৩।
[14]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯১; যাওজাতুন নবী (সা.), পৃঃ ৬০-৬১; ১২ উকিয়া ১ নশ-এর পরিমাণ হচ্ছে ৫০০ দেরহাম। দ্রঃ মিশকাত হা/৩২০৩।
[15]. তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩১৬।
[16]. মাহমূদ শাকের, আত-তারীখুল ইসলামী, ১ম-২য় খন্ড
(বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৪১১ হিঃ/১৯৯১ খৃঃ), পৃঃ ৩৫৮।
[17]. তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩১৮।
[18]. আল-মারআতু বায়না হিদায়াতিল ইসলাম ওয়া গাওয়াতিল ই‘লাম, পৃঃ ২৬৫।
[19]. তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩১৬।
[20]. আত-তারীখুল ইসলামী, ১ম-২য় খন্ড, পৃঃ ৩৫৮।
[21]. তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩১৭।
[22]. আল-মারআতু বায়না হিদায়াতিল ইসলাম ওয়া গাওয়াতিল ই‘লাম, পৃঃ ২৬৫।
[23]. তদেব।
[24]. আত-তারীখুল ইসলামী, ১ম-২য় খন্ড, পৃঃ ৩৫৮।
[25]. মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩৬।
[26]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২১৮।
[27]. ফাতহুল আল্লাম, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৩৭; আবু ওমর আব্দুল বার্রও একই মত পোষণ করেন। দ্রঃ আল-ইস্তি‘আব, ৪/৪৫৪।
[28]. তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩১৬; আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯১।
[29]. তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩১৬।
[30]. আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩৬।
[31]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২১৮।
[32]. তদেব; ফাতহুল আল্লাম, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৩৭।
[33]. তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩১৭।
[34]. ঐ, পৃঃ ৩১৮।
[35]. তদেব।
[36]. তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩১৬।
[37]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯১-৯২, যাওজাতুন নবী (সা.), পৃঃ ৬১।
[38]. ফাতহুল আল্লাম, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৩৭; আত-তাবাক্বতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯২।
[39]. তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩১৮।
[40]. তদেব, পৃঃ ৩১৮।
[41]. আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯২; যাওজাতুন নবী (সা.), পৃঃ ৬১; ফাতহুল আল্লাম, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৩৭।
[42]. আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৯২।
[43]. তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৩১৮।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(১৩)
মায়মূনা বিনতুল হারেছ (রা.)
ভূমিকা :
নবীপত্নী উম্মুল মুমিনীন মায়মূনা বিনতুল
হারেছ (রা.) ছিলেন বহু দুর্লভ গুণের অধিকারিণী এক বিদুষী মহিলা। ছাহাবায়ে কেরামের
বিভিন্ন সমস্যায় তিনি অতি বিচক্ষণতার সাথে সমাধান দিতেন। উত্তম চারিত্রিক
বৈশিষ্ট্য, আল্লাহভীতি, দানশীলতা, ইবাদত-বন্দেগী, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য প্রভৃতি গুণাবলীর জন্য তিনি ছিলেন সবার প্রিয়
পাত্রী। অহি-র নির্মল আলোতে তাঁর জীবন ছিল উদ্ভাসিত। রিসালাতে মুহাম্মাদীর
সংস্পর্শে এসে দ্বীন সম্পর্কে তিনি সম্যক জ্ঞান লাভ করেছিলেন। দ্বীনের জন্য জীবন
উৎসর্গকারিণী এই বিদুষী মহিলার সংক্ষিপ্ত জীবনাদর্শ আমরা এখানে আলোচনার প্রয়াস
পাব।
নাম ও বংশপরিচয় :
তাঁর প্রকৃত নাম ছিল বাররা। রাসূলুল্লাহ (সা.)
তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন মায়মূনা।[1] তাঁর পিতার নাম হারেছ। মাতার নাম হিন্দ বিনতু আওফ। মায়মূনা (রা.)-এর পূর্ণ
বংশধারা হচ্ছে- মায়মূনা বিনতুল হারেছ ইবনু হাযান ইবনে বুজায়র ইবনিল হাযম ইবনে
রুওয়ায়বা ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হেলাল ইবনে ‘আমির ইবনে
ছা‘ছা‘আহ[2] ইবনে মু‘আবিয়াহ ইবনে বকর ইবনে হাওয়াযিন ইবনে মানছূর
ইবনে ইতরামা ইবনে খাফসা ইবনে কায়স ইবনে আয়লান ইবনে মুযার।[3] হাকিম নাইসাপুরী বুজায়র ইবনিল হাযম-এর স্থলে বুজায়র ইবনিল হুরম (بجير ابن الهرم) উল্লেখ করেছেন।[4] মায়মূনা (রা.)-এর মায়ের বংশধারা হচ্ছে- হিন্দ বিনতু আওফ ইবনে যুহায়র ইবনিল
হারিছ ইবনে হাতামা ইবনে জারাশ মতান্তরে জারীশ।[5] তিনি হুমায়র[6] মতান্তরে কিনানা গোত্রের মহিলা ছিলেন।[7]
মায়মূনা (রা.) ছিলেন আববাস ইবনু আব্দুল
মুত্তালিবের স্ত্রী উম্মুল ফযল লুবাবা আল-কুবরা বিনতুল হারিছ, ওয়ালীদ ইবনুল মুগীরার স্ত্রী লুবাবা আছ-ছুগরা বিনতুল হারিছ
ও আসমা বিনতুল হারিছের বোন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে الأخوات مؤمنات
(মুমিনা বোনগণ) বলে অভিহিত করেছেন।[8] তিনি প্রখ্যাত ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস ও সাইফুল্লাহ খ্যাত খালিদ বিন
ওয়ালীদের খালা ছিলেন।[9]
জন্ম ও শৈশব :
মায়মূনা (রা.)-এর জন্ম ও শৈশব সম্পর্কে
ঐতিহাসিকগণ কিছু বলেননি। ফলে তাঁর জন্ম ও শৈশব সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। তবে ৭ম
হিজরী সনে ৩৭ বছর বয়সে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।[10] সে হিসাবে তাঁর জন্ম ৫৯২ হিজরীতে হয়েছিল বলে ধরে নেয়া যায়।
প্রথম বিবাহ :
জাহেলী যুগে তাঁর প্রথম বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল
মাসঊদ ইবনু আমর ইবনে ওমাইর আছ-ছাক্বাফীর সাথে। কোন কারণে তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটলে
আবু রুহম ইবনু আব্দুল ওয্যা ইবনে আবী কায়েস-এর সাথে তাঁর বিবাহ হয়। তিনি বানু
মালেক ইবনে হাসাল ইবনে আমের ইবনে লুই-এর লোক ছিলেন। ৭ম হিজরীতে তিনি মারা যান।[11]
রাসূল (সা.)-এর সাথে বিবাহ :
খায়বার যুদ্ধের পরে ৭ম হিজরীর শাওয়াল
মতান্তরে যুলক্বাদাহ মাসে কাযা ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমনের পথে
রাসূলুল্লাহ (সা.) মায়মূনা (রা.)-কে বিবাহ করেন।[12] এ সময় মায়মূনা (রা.)-এর বয়স হয়েছিল ২৬ বছর[13] মতান্তরে ৩৭ বছর।[14] রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক মায়মূনা (রা.)-কে বিবাহের প্রস্তাব দেওয়ার ব্যাপারে
কয়েকটি মতামত পাওয়া যায়। ১. রাসূলুল্লাহ (সা.) কাযা ওমরা আদায়ের বছর মক্কার
উদ্দেশ্য রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে আওস ইবনু খাওলী ও আবু রাফে‘কে আববাস (রা.)-এর নিকটে পাঠান। কিন্তু তারা পথ হারিয়ে ফেলে
‘রাবেগ’ উপত্যকায় কয়েকদিন
অবস্থান করেন। অবশেষে ‘কুদাইদ’ নামক স্থানে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে পেয়ে তাঁর কাফেলার সাথে যুক্ত হয়ে মক্কায়
গমন করেন। রাসূল মক্কায় পৌঁছে আববাস (রা.)-এর নিকট দূত পাঠান। দূত উক্ত বিষয়টি
আববাসের নিকটে উল্লেখ করে। অন্য বর্ণনায় আছে, মায়মূনা তার বিষয়টি রাসূলের নিকটে পেশ করে। তখন রাসূল (সা.) আববাসের বাড়ীতে
গিয়ে মায়মূনাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে আববাস (রা.) তাকে রাসূলের সাথে বিবাহ দেন।[15]
(২) রাসূলুল্লাহ (সা.) জা‘ফর ইবনু আবু তালেবের মাধ্যমে মায়মূনার নিকটে প্রস্তাব
পাঠালে তিনি বিষয়টি আববাস (রা.)-এর নিকটে উপস্থাপন করেন। তখন আববাস (রা.) তাকে
রাসূলের সাথে বিবাহ দেন।[16]
(৩) মায়মূনা (রা.) রাসূলের প্রতি তার মনের
আকর্ষণের কথা স্বীয় সহোদর বোন উম্মুল ফযল-এর নিকট ব্যক্ত করেন। তখন উম্মুল ফযল তার
স্বামী আববাস (রা.)-এর সাথে এ বিষয়ে আলাপ করেন। আববাস (রা.) একথা রাসূলের নিকটে
পেশ করেন। এমনকি তিনি রাসূলের নিকট মায়মূনাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)
এ প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে মায়মূনা (রা.)-কে বিবাহ করেন।[17]
(৪) রাসূলুল্লাহ (সা.) আবু রাফে‘ ও অন্য একজন আনছার লোককে মায়মূনার নিকটে পাঠান। তারা
মায়মূনাকে রাসূলের সাথে বিবাহ দেন তিনি মদীনা থেকে (মক্কার উদ্দেশ্যে) বের হওয়ার
পূর্বে।[18]
(৫) বাররা বিনতুল হারিছ ওরফে মায়মূনা (রা.)
নিজেকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য দান করেছিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ নিম্নোক্ত আয়াত
নাযিল করেন, وَامْرَأَةً مُّؤْمِنَةً إِنْ وَهَبَتْ نَفْسَهَا لِلنَّبِيِّ إِنْ
أَرَادَ النَّبِيُّ أَنْ يَّسْتَنْكِحَهَا خَالِصَةً لَّكَ مِنْ دُوْنِ
الْمُؤْمِنِيْنَ- ‘কোন মুমিনা নারী যদি নিজেকে
নবীর কাছে সমর্পণ করে, নবী তাকে বিবাহ করতে চাইলে সেও হালাল। এটা
বিশেষ করে আপনারই জন্য, অন্য কোন মুমিনের জন্য নয়’ (আহযাব ৫০)।[19]
রাসূলুল্লাহ (সা.) মায়মূনা (রা.)-কে যখন
বিবাহের প্রস্তাব পাঠান তখন মায়মূনা (রা.) একটি উটে চড়েছিলেন। রাসূলের প্রস্তাবে
তিনি খুশি হয়ে বলেন, اَلْجَمَلُ وَمَا عَلَيْهِ لِرَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم- ‘এ উট এবং এর উপর যা আছে সব রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য’।[20] রাসূলুল্লাহ (সা.) মায়মূনা (রা.)-কে ৪০০ দিরহাম মতান্তরে ৫০০ দিরহাম মহর
দিয়েছিলেন।[21] তিনি ছিলেন নবী করীম (সা.)-এর সর্বশেষ বিবাহিতা স্ত্রী।[22]
বাসর যাপন :
৭ম হিজরীর শাওয়াল মাসে কাযা ওমরা সম্পন্নের
পর মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পথে ‘তানঈম’-এর নিকটবর্তী মক্কা থেকে ১০ বা ১২ মাইল দূরে ‘সারিফ’ নামক স্থানে
রাসূলুল্লাহ (সা.) মায়মূনা (রা.)-এর সাথে বাসর যাপন করেন।[23]
নবী করীম (সা.) মক্কায় তিন দিন অবস্থান করেন।
তৃতীয় দিনে হুয়াইতাব ইবনু আব্দুল ওয্যা আরো কয়েক জন কুরাইশ লোক নিয়ে এসে
রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে বলে, তোমার (মক্কায় অবস্থানের) সময় শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং তুমি আমাদের এখান থেকে চলে
যাও। তিনি বললেন, ‘তোমাদের কি হ’ল, তোমরা আমাকে পরিত্যাগ করেছ, আর আমি তোমাদের সামনে বাসরের আয়োজন করেছি এবং তোমাদের জন্য
খাদ্য প্রস্ত্তত করেছি! ইতিমধ্যে তোমরা হাযিরও হয়েছ’। তারা বলল, তোমার খাদ্যের আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। তুমি আমাদের এখান থেকে চলে যাও। তখন
রাসূলুল্লাহ (সা.) মায়মূনা (রা.)-কে নিয়ে বের হ’লেন এবং ‘সারিফ’ নামক স্থানে এসে যাত্রা বিরতি করেন। এখানেই তিনি বাসর যাপন করেন।[24]
রাসূলুল্লাহ (সা.) কি মুহরিম
অবস্থায় মায়মূনা (রা.)-কে বিবাহ করেছিলেন?
রাসূলুল্লাহ (সা.) মায়মূনা (রা.)-কে হালাল
অবস্থায় না মুহরিম অবস্থায় বিবাহ করেছিলেন এ সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থে দু’ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। মুহাম্মাদ ইবনু সা‘দ ‘আত-তাবাক্বাতুল কুবরা’ গ্রন্থে ১১টি বর্ণনা পেশ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) মায়মূনা (রা.)-কে হালাল অবস্থায় বিবাহ
করেছেন। পক্ষান্তরে তিনি বিভিন্ন সূত্রে ১৭টি বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন যে, তাঁদের বিবাহ মুহরিম অবস্থায় সম্পন্ন হয়েছিল।[25] অনুরূপভাবে হাকিম নাইসাপুরী (রহঃ)ও পক্ষে-বিপক্ষে কয়েকটি বর্ণনা পেশ করেছেন।[26] হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী পক্ষে-বিপক্ষে কতিপয় বর্ণনা উল্লেখ করে মুহরিম
অবস্থায় বিবাহ সংক্রান্ত বর্ণনাকে মুতাওয়াতির বলেছেন।[27] উক্ত বর্ণনাগুলোর মধ্যে দু’একটি নিম্নে উল্লেখ
করা হ’ল-
عَنْ يَزِيْدَ بْنِ الْأَصَمِّ حَدَّثَتْنِيْ مَيْمُوْنَةُ بِنْتُ
الْحَارِثِ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَزَوَّجَهَا
وَهُوَ حَلاَلٌ قَالَ وَكَانَتْ خَالَتِيْ وَخَالَةَ ابْنِ عَبَّاسٍ-
ইয়াযীদ ইবনুল আছাম হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, মায়মূনা বিনতুল হারিছ (রা.) আমাকে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে হালাল অবস্থায় বিবাহ করেছেন। রাবী বলেন, তিনি আমার ও ইবনু আববাসের খালা ছিলেন।[28] অন্য বর্ণনায় আছে,
عَنْ يَزِيْدَ بْنِ الْأَصَمِّ ابْنِ أَخِيْ مَيْمُوْنَةَ عَنْ
مَيْمُوْنَةَ قَالَتْ تَزَوَّجَنِيْ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ وَنَحْنُ حَلاَلاَنِ بِسَرِفَ-
ইয়াযীদ ইবনুল আছাম (মায়মূনার ভাগ্না) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, মায়মূনা (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ‘সারিফ’ নামক স্থানে আমাকে
বিবাহ করেন এবং আমরা হালাল অবস্থায় ছিলাম’।[29]
অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ عِكْرِمَةَ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى
اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَزَوَّجَ مَيْمُوْنَةَ وَهُوَ مُحْرِمٌ-
ইকরিমা ইবনু আববাস (রা.) হ’তে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) মায়মূনা (রা.)-কে মুহরিম অবস্থায় বিবাহ করেছেন।[30] আবুশ শা‘ছা থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে।[31]
সমন্বয় :
উপরোক্ত দুই ধরনের বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় করতে
গিয়ে মনীষীগণ বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যথা- ১. রাসূলুল্লাহ (সা.) মুহরিম অবস্থায়
বিবাহ করেছেন এবং হালাল অবস্থায় বাসর যাপন করেছেন। ২. ঐ সময় পর্যন্ত মুহরিম
অবস্থায় বিবাহ করা হারাম হয়নি।[32] ৩. কারো মতে, তিনি তখন হারামের সীমানার মধ্যে ছিলেন। এজন্য
তাকে মুহরিম বলা হয়েছে। কিন্তু মূলতঃ তিনি হালাল ছিলেন। ৪. রাসূলুল্লাহ (সা.)
হালাল অবস্থায় বিবাহ করেছিলেন ও বাসর যাপন করেছিলেন এবং বিবাহের কথা প্রকাশ
করেছিলেন মুহরিম অবস্থায়।[33] যেরূপ ইমাম মুহিউস সুন্নাহ বাগাভী (রহঃ) বলেন, وَالْاَكْثَرُوْنَ عَلٰى أَنَّهُ تَزَوَّجَهَا
حَلاَلاً وَظَهَرَ أَمْرَ تَزْوِيْجِهَا وَهُوَ مُحْرِمٌ ثُمَّ بَنَى بِهَا وَهُوَ
حَلاَلٌ بِسَرِفَ فِىْ طَرِيْقِ مَكَّةَ. ‘অধিকাংশ বিদ্বান এ মতে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) হালাল অবস্থায় তাকে (মায়মূনাকে) বিবাহ করেছেন এবং বিবাহের
বিষয়টি মুহরিম অবস্থায় প্রকাশ করেছেন। আর মক্কার পথে ‘সারিফ’ নামক স্থানে তার
সাথে বাসর যাপন করেন হালাল অবস্থায়।[34]
বিবাহের কারণ :
তৎকালীন আরব সমাজে বিভিন্ন গোত্রের সাথে
বৈবাহিক সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। এ সম্পর্কের কারণেই ছোট ছোট
গোত্রগুলো বিশালাকার ধারণ করে। এই বৈবাহিক সম্পর্ক ও পরিচিতির সূত্র ধরে মরুর পথে
মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে বহু দূর দূরান্ত থেকে নিজ নিজ গন্তব্যে যাতায়াত
করত। এ সম্পর্কের ফলে নির্ভয়ে তারা এক শহর থেকে অন্য শহরে ব্যবসা-বাণিজ্যের
উদ্দেশ্যে সফর করত। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপ্লব সাধিত হয়। অনুরূপভাবে বৈবাহিক সম্পর্কের
কারণে ইসলামী দাওয়াত সুদীর্ঘ কাল থেকে ব্যাপকতা লাভ করে আসছে। সেই দিক থেকে এ
বিবাহ ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক মায়মূনা (রা.)-কে
বিবাহ করার উল্লেখযোগ্য কতিপয় কারণ হচ্ছে- (১) আববাস (রা.)-এর পরিবার-পরিজনের সাথে
সুসম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করা। কেননা তারা এ বিবাহ বন্ধনকে মনে-প্রাণে কামনা করছিলেন।
(২) মায়মূনা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করে তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। এতে তিনি বিভিন্ন
সমস্যায় পতিত হন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তার মানসিক অবস্থা ঠিক করার জন্য এবং বিভিন্ন
সমস্যা থেকে হেফাযত করার জন্য তাকে বিবাহ করেন। (৩) মক্কার মুশরিকদের অন্তরকে
প্রভাবিত করার জন্য, বিশেষতঃ মায়মূনা (রা.)-এর গোত্র বনু হেলালের
উপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য রাসূল (সা.) মায়মূনা (রা.)-কে বিবাহ করেন। কেননা
আরবরা এ বৈবাহিক সম্পর্ককে মহৎ মানবিকতা, আশ্রয় দান ও সহায়তা হিসাবে গণ্য করত। এ বিবাহের ফলে দেখা যায়, ঐ গোত্রের লোক দলে দলে ইসলাম কবুল করছে।[35]
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য :
উম্মুল মুমিনীন মায়মূনা (রা.) বহু দুর্লভ গুণ
ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারিণী ছিলেন। নিম্নে তাঁর কতিপয় উত্তম গুণাবলী
উপস্থাপন করা হ’ল।-
ক. তাকওয়া বা আল্লাহভীতি : বিশ্ব জাহানের মালিক মহান আল্লাহকে তিনি সবচেয়ে বেশী ভয় করতেন। জীবনের প্রতিটি
কাজে তা প্রতিফলিত হ’ত এবং তাঁর সাথে যারা ওঠা-বসা করতেন তারা
তাঁর এ বৈশিষ্ট্যকে সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারতেন। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা ছিদ্দীকা (রা.)
মায়মূনা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে তাঁর এ অনুপম গুণ প্রতিভাত হয়েছে। তিনি বলেন, أَمَا اَنَّهَا كَانَتْ مِنْ
أَتْقَانَا لِلَّهِ، وَأَوْصَلَنَا لِلرِّحْمِ، ‘জেনে রেখো, নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী
আল্লাহভীরু এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারীণী।[36]
খ. দানশীলতা : মায়মূনা (রা.) অতীব দানশীলা মহিলা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তার এগুণটি পসন্দ
করতেন। মায়মূনা (রা.)-এর একজন দাসী ছিল। তিনি তাকে আল্লাহর নামে আযাদ করে দেন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট একথা বর্ণনা করলে তিনি বললেন, তুমি যদি ঐ অর্থ তোমার ভাই ইবনুল হারিছকে দিতে তবে অধিক
ছওয়াব পেতে।[37]
(গ) ইবাদত-বন্দেগী : মায়মূনা (রা.) অতি ইবাদতগুযার মহিলা ছিলেন। তিনি ছালাত আদায়ের সময়ে তনুত্রাণ
পরিধান করে তথা আপাদমস্তক বস্ত্রাবৃত করে ছালাত আদায় করতেন।[38] তিনি হজ্জ করতে গিয়ে ইহরাম অবস্থায় মাথা কামিয়ে ফেলেন। এ অবস্থায়ই তিনি
ইন্তিকাল করেন। তাঁর মাথায় তখন নতুন চুলে ভরা ছিল।[39] মায়মূনা (রা.)-এর সম্ভবতঃ জানা ছিল না যে, হজ্জ বা ওমরায় মহিলাদের মাথা কামানো নিষেধ, বরং চুল ছোট করতে হয়। কেননা হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَلِيٍّ رضي الله عنه قَالَ نَهَى رَسُوْلُ اللهِ صلى الله
عليه وسلم أَنْ تَحْلِقَ الْمَرْأةُ رَأسَهَا-
আলী (রা.) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) মহিলাদের মাথা কামাতে নিষেধ করেছেন।[40] অন্য বর্ণনায় এসেছে, لَيْسَ عَلَى النِّسَاءِ الْحَلْقُ إِنَّمَا عَلَى النِّسَاءِ
التَّقْصِيْرُ
‘মহিলাদের উপর মাথা কামানো নেই, তাদের জন্য আবশ্যক চুল খাটো করা’।[41]
(ঘ) দ্বীনের বিধানের
প্রতি কঠোরতা : আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ-নিষেধের প্রতি তিনি খুবই মনোযোগী
ছিলেন। আল্লাহর হুকুমের বিপরীত কোন কাজ হ’তে দেখলে, তিনি তা বরদাশত করতেন না। একদা তাঁর এক নিকটাত্মীয় তাঁর
গৃহে আসল। তখন লোকটির মুখ থেকে শরাবের গন্ধ আসছিল। তিনি বললেন, যদি তুমি মুসলমানদের নিকটে যাও, তাহ’লে তারা তোমাকে বেত্রাঘাত করবে কিংবা তোমাকে
পবিত্র করে ছাড়বে। তুমি আমার নিকটে আর কখনো আসবে না।[42]
(ঙ) বুদ্ধিমত্তা : তাঁর বর্ণিত অনেক হাদীছ থেকে তাঁর ফিক্বহী সূক্ষ্মতার পরিচয় মেলে। উদাহরণ
স্বরূপ একটি হাদীছ উল্লেখ করা হ’ল- একবার ইবনু
আববাস (রা.) মলিন মুখে বসে আছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে বৎস! তোমার কি হয়েছে? তিনি বললেন, উম্মু আম্মার (তাঁর স্ত্রী) আমার চুলে চিরুণী
করে দিত। কিন্তু সে মাসিক স্রাবে রয়েছে। তিনি বললেন, কী চমৎকার! আমার ঐ রকম দিনে নবী করীম (সা.) আমার কোলে মাথা রেখে শয়ন করতেন ও
কুরআন মাজীদ পড়তেন। আমি ঐ অবস্থায় মসজিদে বিছানা (চাটাই) রেখে আসতাম। বৎস! হাতেও
কি এসব হয় কখনও?[43]
ইলমী খিদমত :
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তিকালের পরও দীর্ঘ
দিন মায়মূনা (রা.) জীবিত ছিলেন। মহানবী (সা.)-এর অনেক হাদীছই উম্মুল মুমিনীনদের
মাধ্যমে পরবর্তীদের কাছে সম্প্রসারিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মায়মূনা (রা.)-এর অবদান
অনস্বীকার্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) হ’তে তিনি
হাদীছ শিক্ষা লাভ করেছেন এবং তা বর্ণনাও করেছেন। ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, মায়মূনা (রা.) হ’তে ৭৬টি
হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[44] হাফেয যাহাবী বলেন, তাঁর থেকে মোট ১৩টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। ইমাম
বুখারী ও মুসলিম যৌথভাবে ৭টি, ইমাম বুখারী
এককভাবে ১টি এবং ইমাম মুসলিম (রহঃ) এককভাবে ৫টি হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[45] তবে আমাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তাঁর থেকে বর্ণিত পুনরুক্তিসহ ছহীহ বুখারীতে
২১টি,
ছহীহ মুসলিমে ১৮টি, জামি আত-তিরমিযীতে ৪টি, সুনান আবু দাঊদে ১৫টি, সুনান নাসাঈতে ২৬টি এবং সুনান ইবনু মাজাহতে
১১টি হাদীছ সংকলিত হয়েছে।
তাঁর থেকে যারা হাদীছ বর্ণনা
করেছেন :
তাঁর থেকে যারা হাদীছ বর্ণনা করেছেন তন্মধ্যে
উল্লেখ্যযোগ্য হ’লেন- ইবনু আববাস (মৃঃ ৮৬/৭০৫), আব্দুল্লাহ ইবনু শাদ্দাদ ইবনুল হাদ (মৃঃ ৮১/৭০০), আব্দুর রহমান ইবনুস সায়েব আল-হিলালী, ইয়াযীদ ইবনু আছাম, (এরা সকলেই তাঁর ভাগ্নে), তাঁর পূর্ব স্বামীর
ছেলে ওবায়দুল্লাহ আল-খাওলানী, নদবা (দাসী), আতা ইবনু ইয়াসার, সুলায়মান ইবনু ইয়াসার (মৃঃ ১০০/৭১৮), ইবরাহীম ইবনু আব্দুললাহ (মৃঃ ৪১/৬৬১), কুরায়ব (ইবনু আববাসের দাস) (মৃঃ ৯৮/৭১৬), ওবায়দা ইবনু সাববাক, ওবায়দুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনে উতবা (মৃঃ
৯৪/৭১২), আলিয়া বিনতু সাবী (রা.) প্রমুখ।[46]
খাদ্যশস্য দান :
রাসূলুল্লাহ (সা.) খায়বারের উৎপাদিত ফসল থেকে
মায়মূনা (রা.)-কে ৮০ ওয়াসাক্ব খেজুর এবং ২০ ওয়াসাক্ব যব বা গম প্রদান করেন।[47]
ইন্তিকাল :
মায়মূনা (রা.) ৫১হিঃ/৬৭১খৃঃ ‘সারিফ’ নামক স্থানে
ইন্তিকাল করেন। সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।[48] মুহাম্মাদ ইবনু ওমর আল-ওয়াকেদী বলেন, তিনি ইয়াযীদ ইবনু মু‘আবিয়ার খিলাফতকালে ৬১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ
করেন।[49] হাফেয ইবনু কাছীর বলেন, তিনি ৬৩ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।[50] মায়মূনা (রা.) রাসূল (সা.)-এর স্ত্রীগণের মধ্যে সর্বশেষে ইন্তিকাল করেন।[51] অথচ ইয়াযীদ ইবনুল আছামের বর্ণনা হ’তে জানা যায়
যে,
আয়েশা (রা.) মায়মূনা (রা.)-এর পরেও জীবিত
ছিলেন। আর আয়েশা (রা.) সর্বসম্মতিক্রমে ৬০ হিজরীর পূর্বে ইন্তিকাল করেন। মায়মূনা (রা.)-এর
মৃত্যু সন নিয়ে আরো কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন ৪৯ হিঃ, ৬৩ হিঃ ও ৬৬ হিঃ। তবে এ বর্ণনাগুলো সঠিক নয়। বরং প্রথম
বর্ণনাটিই অধিক বিশুদ্ধ।[52] মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর মতান্তরে ৮১ বছর।[53]
জানাযা ও দাফন :
তিনি ‘সারিফে’ মৃত্যুবরণ করেন। কারো মতে, তিনি মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন এবং সারিফে নীত হন।[54] যখন তাঁর লাশ কাঁধে উঠানো হয়, তখন ইবনু আববাস (রা.)
বলেন,
তিনি রাসূল (সা.)-এর স্ত্রী। সুতরাং বেশী
নাড়াচাড়া করো না। আদবের সাথে আস্তে নিয়ে চলো।[55] ইবনু আববাস (রা.) তাঁর জানাযা পড়ান। ‘সারিফ’ নামক স্থানে যেখানে তাঁর বাসর উদ্যাপিত হয়েছিল, সেখানে তাঁকে দাফন করা হয়। ইবনু আববাস (রা.), ইয়াযীদ ইবনুল আছাম, আব্দুল্লাহ ইবনু শাদ্দাদ ইবনুল হাদী এবং ওবায়দুল্লাহ আল-খাওলানী (রা.) তাঁকে
কবরে নামান।[56] ইয়াযীদ ইবনু আছাম বলেন, যখন আমরা মায়মূনা (রা.)-এর মৃতদেহ কবরে
রাখলাম,
তখন তাঁর মাথাটা একদিকে ঝুকে গেল। তখন আমি
চাদর খুলে তাঁর মাথার নীচে দিলে ইবনু আববাস তা উঠিয়ে ফেলেন এবং তাঁর মাথার নীচে
কিছু নুড়ি পাথর দিয়ে দেন।৫৭ [57]
সমাপনী :
উম্মুল মুমিনীন মায়মূনা (রা.) ছিলেন
সম্ভ্রান্ত বংশীয় ও অভিজাত পরিবারের এক বিদুষী মহিলা এবং বহু অনুপম গুণের
অধিকারিণী। তিনি চরিত্র-মাধুর্যে যেমন অনুসরণীয় ছিলেন, তেমনি ইলমী খিদমতে তাঁর জীবনের অনেক সময় ব্যয় করেছেন।
নবীপত্নী এই মহিয়সী ছাহাবীর জীবনী থেকে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রয়েছে। তাঁর
ঘটনাবহুল জীবনী থেকে ইবরাত হাছিল করতে পারলে আমাদের ইহকালীন ও পরকালীন জীবন হবে
সুন্দর ও সুখময়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা গ্রহণের তাওফীক্ব
দান করুন-আমীন!
[1]. হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড (বৈরুত :
মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ৩য় প্রকাশ, ১৯৮৫ খৃঃ/১৪০৫ হিঃ), পৃঃ ২৪৩; হাফেয ইবনু হাজার
আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব, ১২শ খন্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৪ খৃঃ/১৪১৫ হিঃ), পৃঃ ৪২৮।
[2]. মুহাম্মাদ ইবনু সা‘দ, আত-ত্বাবাক্বাতুল
কুরবা, ৮ম খন্ড (বৈরুত :
দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০ খৃঃ/১৪১০ হিঃ), পৃঃ ১০৪; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৮।
[3]. আবু ওমর ইবনু আব্দুল বার্র, আল-ইস্তি‘আব, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ১৯১৫।
[4]. হাকিম নাইসাপুরী, আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৪র্থ খন্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০/১৪১১ হিঃ), পৃঃ ৩১।
[5]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০৪।
[6]. আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩১।
[7]. আল-ইস্তি‘আব, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ১৯১৫।
[8]. আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩৫।
[9]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৮; সাঈদ আইয়ূব, যাওজাতুন নবী (সা.), (বৈরুত : দারুল হাদী, ১ম প্রকাশ, ১৪১৭/১৯৯৭), পৃঃ ৮০।
[10]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৯; মাহমূদ শাকির, আত-তারীখুল ইসলামী, ১ম ও ২য় খন্ড (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৪১১/১৯৯১), পৃঃ ৩৬১।
[11]. আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩২; আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০৪; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৯।
[12]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০৪-১০৫; আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩২; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৯।
[13]. ড. আয়েশা আব্দুর রহমান, তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত (কায়রো : দারুর রাইয়ান, তা.বি.), পৃঃ ৪১৫।
[14]. আত-তারীখুল ইসলামী, ১ম-২য় খন্ড, পৃঃ ৩৬১।
[15]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৯; আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০৫।
[16]. তদেব; হাফেয ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ
ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয (কায়রো : দারুর রাইয়ান, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৮/১৪০৮), পৃঃ ২৩৩; আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩৩।
[17]. তারাজিমু সাইয়্যেদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৪১৫।
[18]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০৫।
[19]. তারাজিমু সাইয়্যেদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৪১৫-১৬; আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ১৯২; ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৩য় খন্ড (কুয়েত : আল-ইরফান, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৬)/১৪১৭ হিঃ), পৃঃ ৬৫৪।
[20]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয, পৃঃ ২৩৩।
[21]. তদেব; ফাতহুল আল্লাম, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৩৬।
[22]. তদেব; আত-তারীখুল ইসলামী, ১ম ও ২য়
খন্ড, পৃঃ ৩৬১; আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩২; আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০৮।
[23]. আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩২-৩৩; তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়তিন নবুওয়াত, পৃঃ ৪১৭।
[24]. আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩৩।
[25]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০৫-১০৮।
[26]. আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩৩-৩৪।
[27]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৪০-৪১।
[28]. ছহীহ মুসলিম হা/১৪১১ ‘মুহরিমকে বিবাহ করা হারাম ও প্রস্তাব দেওয়া অপসন্দনীয়’ অনুচ্ছেদ; ইবনু মাজাহ, হা/১৯৬৪।
[29]. আবু দাঊদ হা/১৮৪৩; তিরমিযী হা/৮৪৫; আহমাদ ৬/৩৩৩, ৩৩৫।
[30]. মুসলিম হা/২৫২৭; আহমাদ হা/২২০০; আবু দাঊদ
হা/১৮৪৩; তিরমিযী হা/৮৪৩।
[31]. বুখারী; মুসলিম হা/১৪১০; তিরমিযী
হা/৮৪৪; ইবনু মাজাহ
হা/১৯৬৫।
[32]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪ জুয, পৃঃ ২৩৩; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৪২।
[33]. মিরক্বাত, ৯ম খন্ড, পৃঃ ১৬৩।
[34]. মিশকাত, তাহক্বীক্ব : আলবানী, ২য় খন্ড (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৩য় প্রকাশ, ১৯৮৫/১৪০৫ হিঃ), পৃঃ ৮২২, ২৬৮৩ নং হাদীছের আলোচনা দ্রঃ।
[35]. ছালাহুদ্দীন মকবূল আহমাদ, আল-মার‘আতু বায়না হিদয়াতিল ইসলাম ওয়া গাওয়াতুল ই‘লাম, পৃঃ ২৭১।
[36]. আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩৪; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৪৪, সনদ হাসান।
[37]. বুখারী হা/২৪০৩; মুসলিম হা/১৬৬৬।
[38]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১১০; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৪৩, সনদ ছহীহ।
[39]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০৯; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৪৩, সনদ ছহীহ।
[40]. নাসাঈ, তিরমিযী, হা/৯১৩।
[41]. আবু দাঊদ হা/১৯৪৮, সনদ হাসান।
[42]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১১০; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৪৩, সনদ ছহীহ।
[43]. মুসনাদ ইমাম আহমাদ, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ ৩৩১।
[44]. সাইয়েদ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আল-জরদানী, ফাতহুল আল্লাম বিশারহি মুরশিদিল আনাম, ১ম খন্ড (কায়রো : দারুস সালাম, ৪র্থ প্রকাশ, ১৪১০/১৯৯০), পৃঃ ২৩৬; অবশ্য তাঁর থেকে বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ‘মাতালিউল আনোয়ার’ গ্রন্থে ৭৭টি এবং ‘আল-কামাল ফী
মা‘রিফাতির রিজাল’ গ্রন্থে ৪৬টি হাদীছের কথা এসেছে। দ্রঃ আসমাউছ ছাহাবা
আর-রুয়াত, ৪৪নং টীকা, পৃঃ ৬৮।
[45]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৪৫।
[46]. তদেব, পৃঃ ২৩৯; আসমাউছ ছাহাবা
আর-রুয়াত, পৃঃ ৬৮।
[47]. আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১১১।
[48]. আল-ইছাবা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১৯৩; তাহযীবুত তাহযীব, ১২শ খন্ড, পৃঃ ৪৮১।
[49]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৪৫।
[50]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয, পৃঃ ২৩৪।
[51]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১৪০।
[52]. আল-ইছাবা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১৯৩; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৪৫।
[53]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১১১; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৪৫।
[54]. তদেব; আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১১১।
[55]. বুখারী, ২য় খন্ড, পৃঃ ৭৫৮।
[56]. আল-ইস্তি‘আব, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ১৯১৮।
[57]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১১১।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(১৪)
রায়হানা বিনতু শামঊন (রা.)
ভূমিকা :
রায়হানা বিনতু শামঊন (রা.) বানু নাযীর বা
বানু কুরাইযা গোত্রের মহিলা ছিলেন। যুদ্ধবন্দী হিসাবে তিনি রাসূলের নিকটে নীত হন।
অতঃপর ইসলাম কবুল করার মাধ্যমে রাসূলের স্ত্রীদের মত মর্যাদা লাভের ঈর্ষণীয়
সম্মানে ভূষিতা হন। এই মহিয়সী রমণীর সংক্ষিপ্ত জীবনী আমরা আলোচ্য নিবন্ধে
উপস্থাপনের প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।-
নাম ও বংশপরিচয় :
তাঁর নাম রায়হানা। তাঁর পিতার নাম শামঊন
মতান্তরে যায়েদ। তাঁর পিতার নাম ও বংশপরিচয় নিয়ে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) তাঁর বংশপরিচয় এভাবে উল্লেখ করেছেন- রায়হানা বিনতু শামঊন
বিন যায়েদ। কেউ বলেছেন, রায়হানা বিনতু যায়েদ বিন আমর বিন ক্বানাফা
মতান্তরে খানাফাহ।[1] ইবনু সা‘দ তাঁর বংশধারা এভাবে বলেছেন, রায়হানা বিনতু যায়েদ বিন আমর বিন খানাফাহ বিন শামঊন বিন
যায়েদ।[2] ইবনু আব্দিল বার্র তাঁর বংশ পরম্পরা এভাবে উল্লেখ করেছেন, রায়হানা বিনতু শামঊন ইবনে যায়েদ ইবনে খানাফাহ।[3] ইবনু ইসহাক বলেছেন এভাবে, রায়হানা বিনতু আমর
ইবনে খানাফাহ।[4] অন্যত্র আছে- রায়হানা ইবনাতু আমর ইবনে হুযাফাহ।[5] তাঁর বংশ-গোত্র নিয়েও মতভেদ রয়েছে। ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) ও ইবনু সা‘দ তাকে বনু নাযীর গোত্রের বলে উল্লেখ করেছেন।[6] ইবনু ইসহাক, ইবনু আব্দিল বার্র ও হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ)
তাঁকে বনু কুরাইযা কবীলার বলে উল্লেখ করেছেন। ইবনু আব্দিল বার্র বলেন যে, অধিকাংশের মত হচ্ছে- তিনি বনু কুরাইযা গোত্রের ছিলেন।[7] কিন্তু ঐতিহাসিক ইবনু সা‘দ বলেন, তিনি বনু কুরাইযার হাকাম নামক জনৈক ব্যক্তির সাথে বিবাহ
বন্ধনে আবদ্ধ হন। এজন্য কোন কোন বর্ণনাকারী তাঁকে বনু কুরাইযার অন্তর্ভুক্ত বলে
গণ্য করেছেন।[8]
জন্ম ও শৈশব :
উম্মুল মুমিনীন রায়হানা (রা.)-এর জন্ম সাল
সম্পর্কে যেমন কিছু জানা যায় না, তেমনি তাঁর
শৈশব-কৈশোরের অবস্থাও অজ্ঞাত। কেননা এ বিষয়ে চরিত্রকার ও ঐতিহাসিকগণ কিছুই বর্ণনা
করেননি।
প্রথম বিবাহ :
বনু কুরাইযার আল-হাকাম নামক জনৈক ব্যক্তির
সাথে তাঁর প্রথম বিবাহ হয়। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, বনু কুরাইযার হাকীম নামক এক ব্যক্তির সাথে রায়হানা (রা.)-এর প্রথম বিবাহ
সম্পন্ন হয়।[9]
ইসলাম গ্রহণ ও রাসূলের সাথে
বিবাহ :
৫ম হিজরীর যুলকা‘দাহ ও যুলহিজ্জাহ মাসে বনু কুরাইযার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ
যুদ্ধে তার স্বামী নিহত হয় এবং তিনি যুদ্ধবন্দী হিসাবে রাসূলের নিকটে নীত হন।
গনীমত বণ্টনে তিনি রাসূলের অংশে পড়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) গনীমত বণ্টন শেষ করে
রায়হানা (রা.)-কে উম্মুল মুনযির সালমা বিনতু ক্বায়সের গৃহে পাঠান। সেখানে তিনি
কয়েকদিন অবস্থান করেন। ইতিমধ্যে বনু কুরাইযার যুদ্ধ অপরাধীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর
করা এবং বন্দীদের বণ্টন সম্পন্ন হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) উম্মুল মুনযিরের
বাড়ীতে গিয়ে রায়হানাকে ডেকে বললেন, ان اخترت الله ورسوله واختارك رسول الله لنسفه ‘যদি তুমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে এখতিয়ার কর, তাহ’লে আল্লাহর রাসূল তোমাকে নিজের জন্য পসন্দ
করবেন’। তখন তিনি বললেন, إنى اختار الله ورسوله ‘আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে পসন্দ করি’। অপর একটি বর্ণনায়
আছে,
রায়হানা যুদ্ধ বন্দীনী হিসাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর
নিকটে নীত হ’লে তিনি তাকে বললেন, তুমি ইচ্ছা করলে ইসলাম কবুল করতে পার, ইচ্ছা করলে স্বধর্মের (ইহুদী) উপর কায়েম থাকতে পার। তিনি
বললেন,
أنا على دين قومى ‘আমি আমার জাতির ধর্মের উপরে আছি’। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.)
বললেন,
إن اسلمت اختارك
رسول الله لنفسه- ‘তুমি মুসলিম হ’লে আল্লাহর রাসূল নিজের জন্য তোমাকে এখতিয়ার করবেন’। তিনি প্রত্যাখ্যান
করলেন ও নিজ কথার উপর অটল থাকলেন। এতে রাসূল (সা.) মনে খুব কষ্ট পেলেন এবং
রায়হানাকে নিজের অবস্থার উপর ছেড়ে দিলেন। একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) ছাহাবায়ে কেরামের
সাথে বসেছিলেন এমন সময় জনৈক ব্যক্তির পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। তিনি বললেন, এই ব্যক্তি হচ্ছে ছা‘লাবা ইবনু
সা‘ইয়াহ, সে রায়হানার ইসলাম
গ্রহণের সুসংবাদ নিয়ে এসেছে। সে এসে রাসূলকে বললেন, রায়হানা ইসলাম কবুল করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) রায়হানাকে (দাসী হিসাবে) গ্রহণ
করলেন। তার ইসলাম গ্রহণে রাসূলুল্লাহ (সা.) খুশী হন। তিনি আমৃত্যু রাসূলের নিকটে
ছিলেন।[10] ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে আযাদ করে দেন এবং তাকে সাড়ে বার
উকিয়া বা ৫০০ দেরহাম মহর প্রদান করে বিবাহ করেন।[11] এটা ছিল ৬ষ্ঠ হিজরীর মুহাররম মাসে।[12] রাসূলুল্লাহ (সা.) তার উপর পর্দার বিধান আরোপ করেন এবং অন্যান্য স্ত্রীদের
যেরূপ খাদ্যদ্রব্য দান করেছিলেন, তদ্রূপ রায়হানাকেও
দিয়েছিলেন।[13] অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) রায়হানাকে দাসী হিসাবে
স্বীয় মালিকানায় রেখেছিলেন, তাকে আযাদ করেননি এবং তাকে বিবাহও করেননি।
কিন্তু ইবনু সা‘দ বলেন, ما روى لنا فى عتقها وتزويجها وهو أثبت الأقاويل
عندنا وهو الأمر عند أهل العلم، ‘তাঁর আযাদ হওয়া ও বিবাহের ব্যাপারে যা আমাদের
নিকটে বর্ণিত হয়েছে, তা আমাদের নিকটে অধিক প্রতিষ্ঠিত কথা এবং
বিদ্বানগণের নিকটে এটি অধিক শক্তিশালী’।[14] ইবনু ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) রায়হানাকে নিজের জন্য
মনোনীত করেন। মৃত্যু অবধি দাসী হিসাবে তিনি রাসূলের মালিকানায় ছিলেন। কালবী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) রায়হানাকে আযাদ করে বিবাহ করেন।[15]
অন্য বর্ণনায় আছে, রায়হানা (রা.) উম্মুল মুনযিরের গৃহে অবস্থান করছিলেন।
সেখানে তাঁর একটি ঋতু অতিবাহিত হয়। তিনি পবিত্র হ’লে উম্মুল মুনযির (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকটে এসে রায়হানার পবিত্রতার
খবর দিলেন। তখন তিনি উম্মুল মুনযিরের বাড়ীতে গেলেন।[16] অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) রায়হানকে
ডেকে বললেন, যদি তুমি পসন্দ কর যে, আমি তোমাকে আযাদ করে দেই এবং বিবাহ করি তাহ’লে তাই করব। কিংবা যদি তুমি আমার মালিকানায় থাকা পসন্দ কর
(তবে তাই হবে)। তিনি বললেন, يا رسول الله اكون فى ملكك أخف على وعليك، ‘হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমি আপনার মালিকানায় থাকব, যা আমার জন্য ও আপনার জন্য হালকা হবে’। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.)
তাকে (দাসী হিসাবে) নিজ মালিকানায় রাখলেন। আমৃত্যু তিনি রাসূলের মালিকানায় ছিলেন।
উম্মুল মুনযিরের বাড়ীতেই রাসূলুল্লাহ (সা.) রায়হানার সাথে বাসর যাপন করেন।[17] আয-যুহরী বলেন, كانت امة رسول الله فأعتقها وتزوجها، তিনি রাসূলের দাসী ছিলেন। অতঃপর রাসূল তাকে আযাদ করে বিবাহ করেন।[18]
চেহারা ও স্বভাব-চরিত্র :
রায়হানা অতি সুন্দরী মহিলা ছিলেন। তাঁর
সম্পর্কে মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব বলেন, فكانة امرأة جميلة وسيمة ‘আর তিনি ছিলেন রূপসী, কমনীয়া মহিলা’।[19] ওয়াক্বেদী বলেন, وكانت ذات جمال ‘তিনি সুন্দরী ছিলেন’।[20] তিনি অতীব লাজুক ছিলেন। তিনি নিজেই বলেন, উম্মুল মুনযিরের বাড়ীতে অবস্থানকালে রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার নিকটে আসলেন।
আমাকে ডেকে তাঁর সামনে বসালেন। আমি তখন লজ্জায় জড়সড় হয়ে যাচ্ছিলাম।[21]
তালাক ও রাজা‘আত :
রায়হানা (রা.) অত্যন্ত আত্মসম্মানবোধ
সম্পন্না মহিলা ছিলেন। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে এক তালাক প্রদান করেন। এটা
তার জন্য এত কষ্টদায়ক ছিল যে, তিনি কষ্টে স্বীয়
স্থান থেকে সরতে পারলেন না। সেখানে বসেই তিনি অত্যধিক কাঁদতে লাগলেন। অবশেষে
রাসূলুল্লাহ (সা.) তার নিকটে আসলেন এবং তাকে ফিরিয়ে নিলেন (রাজা‘আত করলেন)।[22] যুহরীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে তালাক দেন, তখন তিনি তার পরিবারের সাথে ছিলেন। তিনি বলেন, এরপর আমাকে কেউ দেখতে পায়নি। ওয়াক্বেদী বলেন, এটা ঠিক নয়। কেননা তিনি রাসূলের নিকটে থাকতেই ইন্তিকাল করেন।[23]
ইন্তিকাল ও দাফন :
রায়হানা (রা.) রাসূলের ওফাতের ১৬ মাস পূর্বে
মতান্তরে ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ইন্তিকাল করেন। তাঁকে ‘বাক্বীউল গারক্বাদ’ নামক কবরস্থানে দাফন করা হয়।[24]
সমাপনী :
রায়হানা (রা.) রাসূলের সান্নিধ্যে আসার পর
থেকে আমৃত্যু তাঁর অধীনে ছিলেন। মহানবী (সা.)-এর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা ও তাঁর
একনিষ্ঠ আনুগত্য ছিল তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক। রাসূলুল্লাহ (সা.)ও
তাকে মুহাববত করতেন। রিসালাতে মুহাম্মাদীর সংস্পর্শে এসে রায়হানা (রা.) নিজের
জীবনকে রাঙিয়ে ছিলেন ইসলামের কালজয়ী আদর্শের সমুজ্জ্বল আলোকমালায়। এরপর ইসলামের
উপর আজীবন তিনি অটল ও অবিচল ছিলেন। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর মত ইসলামের আদর্শে জীবন
গড়ার তাওফীক্ব দিন- আমীন!
[1]. হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী, আল-ইছাবাহ ফী তাময়িযিছ ছাহাবাহ,র্ ৮ম খন্ড, (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, তা.বি.), পৃঃ ৮৮; আনসাবুল আশরাফ, পৃঃ ১৯৫।
[2]. ইবনু সা‘দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০/১৪১০ হিঃ), পৃঃ ১০২।
[3]. ইবনু আবদিল বার্র, আল-ইস্তি‘আব ২/৯৭।
[4]. ইবনু কাছীর, আস-সীরাহ আন-নবাবিয়্যাহ, ৩য় খন্ড, পৃঃ ২৪২।
[5]. ইবনু ইসহাক, আস-সীরাহ আন-নবাবিয়াহ, ১ম খন্ড, পৃঃ ৯৩।
[6]. ইছাবাহ, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৮৮।
[7]. আল-ইস্তি‘আব ২/৯৭।
[8]. আত-তাবাক্বাত ৮/১০২।
[9]. আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১০২, ১০৩।
[10]. আল-ইছাবাহ ৮/৮৮; আত-তাবাক্বাত ৮/১০৪।
[11]. আত-তাবাক্বাত ৮/১০৩।
[12]. সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ জরদানী, ফাতহুল আল্লাম বিশারহি মুবশিদিল আনাম, ১ম খন্ড (কায়রো : দারুস সালাম, ৪র্থ প্রকাশ, ১৯৯০/১৪১০ হিঃ), পৃঃ ২৩৯; আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৮/১০৩।
[13]. আল-ইছাবাহ, ৮/৮৮ পৃঃ।
[14]. আত-তাবাক্বাত ৮/১০৩।
[15]. ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রহীকুল মাখতূম (কুয়েত : আল-ইরফান, ২য় প্রকাশ, ১৯৯৬/১৪১৬ হিঃ), পৃঃ ৩১৭।
[16]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৫/৩২৭।
[17]. আল-ইছাবাহ, ৮/৮৮; আত-তাবাক্বাত ৮/১০৪; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৪/১৪৫।
[18]. আল-বিদায়াহ ৫/৩২৭।
[19]. আত-তাবাক্বাত ৮/১০৩।
[20]. ইছাবাহ ৮/৮৮।
[21]. আত-তাবাক্বাত ৮/১০৩।
[22]. তদেব; ফাতহুল আল্লাম, ১/২৩৯; আল-ইছাবাহ ৮/৮৮।
[23]. ইছাবাহ ৮/৮৮।
[24]. আত-তাবাক্বাত ৮/১০৩; আল-ইছাবাহ, ৮/৮৮।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(১৫)
আনাস ইবনু মালেক (রা.)
ছাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে
সরাসরি অনেক কল্যাণকর বিষয় শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কোন বিষয়ে তাঁদের ভুল-ত্রুটি
হয়ে গেলে রাসূল (সা.) তাদের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে দিয়ে সঠিক পথ নির্দেশ করতেন, তাদের নিকটে বর্ণনা করতেন আমলের যথার্থ পদ্ধতি। আল্লাহর
ভালবাসা অর্জনের মাধ্যমে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশের পথ দেখাতেন। সে যুগে
ছাহাবায়ে কেরাম রাসূলের মুখ থেকে সরাসরি অহি-র বাণী শুনতে পেতেন।
বর্তমান যুগে আমরা মসির অাঁচড়ে কালো হরফে
লিখিত গ্রন্থ অধ্যয়ন করে ছাহাবায়ে কেরামের জ্ঞানের কথা জানতে পারছি। অথচ তাঁদের
সবাই রাসূলের নিকটে সার্বক্ষণিক অবস্থান করতেন না। কিন্তু যিনি রাসূলের সান্নিধ্যে
অবস্থান করে তাঁর দশটি বছর খেদমতে অতিবাহিত করেছেন, তিনি কতটা জ্ঞান অর্জন করেছেন! জীবনের একটা দীর্ঘ সময় তিনি রাসূলের সাহচর্যে
কাটিয়েছেন। ফলে তাঁর কর্মকান্ড নিকট থেকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁর থেকে জ্ঞান, শিষ্টাচার ও উপদেশমালা সরাসরি লাভ করেছেন জীবনের পরতে পরতে। দশটি বছর যিনি
রাসূলের সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন তিনি হ’লেন প্রখ্যাত
ছাহাবী আনাস বিন মালিক (রা.)। এ নিবন্ধে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত আলোচনা করা হলো।-
নাম ও বংশ পরিচয় :
তাঁর প্রকৃত নাম আনাস, কুনিয়াত বা উপনাম আবু হামযাহ মতান্তরে আবু ছুমামাহ। উপাধি
হচ্ছে ‘খাদেমুর রাসূল’ (রাসূলের সেবক), ইমাম, মুফতী, ক্বারী, মুহাদ্দিছ প্রভৃতি।[1] তাঁর পিতার নাম মালেক ইবনুন নাযর এবং মাতার নাম উম্মু সুলাইম আল-গুমাইছা বিনতু
মিলহান।[2] হাফেয ইবনু কাছীর তাঁর মাতার নাম বলেছেন, উম্মু হারাম মুলাইকা বিনতু মিলহান।[3] তিনি মদীনার প্রসিদ্ধ খাযরাজ গোত্রের নাজ্জার শাখায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্ণ
বংশ পরিচয় হচ্ছে আনাস ইবনু মালেক ইবনিন নাযর ইবনে যামযাম ইবনে যায়েদ ইবনে হারাম
ইবনে জুনদুব ইবনে আমের ইবনে গানাম ইবনে আদী ইবনিন নাজ্জার।[4]
জন্ম ও শৈশব :
আনাস (রা.)-এর নির্দিষ্ট জন্ম তারিখ জানা যায়
না। তবে তিনি বলেন, قَدِمَ النَّبِىُّ صـ الْمَدِينَةَ وَأَنَا ابْنُ عَشْرٍ ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় আগমন করলেন তখন আমি দশ বছরের বালক’।[5] অন্য বর্ণনায় এসেছে, قَدِمَ رَسُوْلُ اللهِ صـ الْمَدِينَةَ وَأَنَا ابْنُ ثَمَانِ سِنِيْنَ- ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় আগমনকালে আমি ছিলাম ৮ বছরের বালক’।[6] এ হিসাবে তিনি ৩ নববী বর্ষ মুতাবিক ৬১২ খ্রীষ্টাব্দে মতান্তরে ৫ নববী বর্ষ
মুতাবিক ৬১৪ খ্রীষ্টাব্দে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমোক্ত মতটিই অধিক প্রসিদ্ধ।
অর্থাৎ রাসূলের মদীনা আগমনকালে আনাস (রা.)-এর বয়স ছিল ১০ বছর।[7]
শৈশবেই তাঁর পিতা মালেক শত্রুর অতর্কিত
আক্রমণে নিহত হন। ফলে আনাস (রা.) ইয়াতীম হয়ে যান।[8] অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মদীনায় আসেন, তখন তিনি রাসূল (সা.)-এর দরবারে নীত হন। এরপর থেকে রাসূলের সান্নিধ্যে ও তাঁর
সরাসরি তত্ত্বাবধানে আনাসের শৈশব অতিবাহিত হয়। তিনি রাসূলের দৃষ্টির সামনেই বেড়ে
ওঠেন।
ইসলাম গ্রহণ :
ইসলাম আগমনের প্রাথমিক দিকেই আনাস (রা.)-এর
মাতা উম্মু সুলাইম ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু তার স্বামী মালেক ছিলেন স্বীয়
বাপ-দাদার ধর্মে। সে উম্মু সুলাইমের পূর্বের ধর্মে ফিরে আসা কামনা করত। উম্মু
সুলাইম সচেতন ও জ্ঞানী মহিলা ছিলেন। তিনি ইসলামের উপরই অটল থাকেন এবং স্বীয় ইয়াতীম
পুত্র আনাসকে ইসলামের শিক্ষা দেন। তাওহীদের দীক্ষা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের
প্রতি অপরিসীম ভালবাসার বীজ আনাসের হৃদয়ে প্রোথিত করেন। ফলে তিনি রাসূলকে দেখার
পূর্বেই তাঁর প্রতি অসীম মহববত পোষণ করতেন। ভাবতেন বড় হ’লে রাসূলের সাথে সাক্ষাতের জন্য মক্কায় গমন করবেন এবং তাঁর
নিকটেই অবস্থান করবেন।[9]
রাসূলের খাদেম হিসাবে আনাস (রা.)
:
রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় আগমন করলে আনাসের
মাতা উম্মু সুলাইম মতান্তরে তার চাচা ও উম্মু সুলাইমের (২য়) স্বামী আবু ত্বালহা
তাকে নিয়ে এসে বলেন, يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ أَنَسًا غُلاَمٌ كَيِّسٌ، فَلْيَخْدُمْكَ ‘হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আনাস চালাক-চতুর, বুদ্ধিমান ছেলে। সে আপনার খেদমত করবে’।[10] আনাস (রা.) বলেন, فَخَدَمْتُهُ فِى السَّفَرِ وَالْحَضَرِ ‘অতঃপর বাড়ীতে ও সফরে আমি তাঁর খেদমত করেছি’। আনাস (রা.)-কে তাঁর
মা-খালাগণ রাসূলের খেদমত করার জন্য উৎসাহিত করতেন। যেমন তিনি বলেন, وَكُنَّ أُمَّهَاتِىْ
يَحْثُثْنَنِى عَلَى خِدْمَتِهِ ‘আমার মা-খালাগণ আমাকে তাঁর সেবা করার জন্য
প্রেরণা দিতেন’।[11] অন্য বর্ণনায় এসেছে, فَكَانَ أُمَّهَاتِى يُوَاظِبْنَنِى عَلَى خِدْمَةِ النَّبِىِّ صـ ‘আমার মা-খালাগণ অবিরতভাবে আমাকে নবী করীম (সা.)-এর খেদমত
করার নির্দেশ দিতেন’।[12] রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় আগমনের পর থেকে মৃত্যু অবধি আনাস (রা.) তাঁর খেদমত
করেন। তিনি পূর্ণাঙ্গরূপে রাসূলের সাহচর্য ও সান্নিধ্য লাভ করেছেন।[13]
শিক্ষা-দীক্ষা :
আনাস (রা.) ১০ বছর বয়স থেকে ২০ বছর পর্যন্ত
অর্থাৎ তাঁর জীবনের কৈশোর থেকে যৌবনেরও একটি অংশ রাসূলের সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন।
ফলে তিনি রাসূলের নিকট থেকে অশেষ জ্ঞানার্জন করেন।[14] তিনি রাসূলের নিকট থেকে হাদীছ শুনে তা লিখে রাখতেন এবং তাঁকে পুনরায় শুনাতেন।[15]
আনাসের জন্য রাসূলের দো‘আ :
মদীনায় হিজরত করার পর আনাস (রা.) মহানবী (সা.)-এর
নিকটে নীত হ’লেন। রাসূল (সা.) তার জন্য দো‘আ করেন, اللَّهُمَّ أَكْثِرْ مَالَهُ وَوَلَدَهُ وَأَطِلْ حَيَاتَهُ ‘হে আল্লাহ! তুমি তার সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি করে দাও
এবং তার হায়াত বাড়িয়ে দাও’।[16]
অন্য বর্ণনায় আছে, اللَّهُمَّ أَكْثِرْ مَالَهُ
وَوَلَدَهُ ‘হে আল্লাহ! তুমি তার সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি
বৃদ্ধি করে দাও’।[17] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা.) আনাসের জন্য এ দো‘আ করেন, اللَّهُمَّ ارْزُقْهُ مَالاً وَوَلَدًا وَبَارِكْ لَهُ ‘হে আল্লাহ! তুমি তাকে সম্পদ ও সন্তান দান কর এবং তাতে বরকত
দান কর’।[18] অন্য হাদীছে এসেছে,اللَّهُمَّ أَكْثِرْ مَالَهُ وَوَلَدَهُ، وَبَارِكْ لَهُ فِيْمَا
أَعْطَيْتَهُ ‘হে আল্লাহ! তুমি তার ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি
বৃদ্ধি করে দাও এবং তুমি তাকে যা দান করেছ তাতে বরকত দাও’।[19]
রাসূলের দো‘আর বরকত :
রাসূলের দো‘আ আনাস (রা.)-এর জীবনে প্রতিফলিত হয়েছিল। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার জন্য তিনটি দো‘আ করেছেন। এর মধ্যে দু’টির ফলাফল
আমি দুনিয়াতেই পেয়েছি এবং আখিরাতে তৃতীয়টি পাওয়ার দৃঢ় প্রত্যাশা করি।[20]
অন্যত্র আনাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের নিকটে আসতেন। একদা তিনি আমাদের
ঘরে আসলেন এবং আমাদের পরিবারের সকলের জন্য দো‘আ করলেন।
তখন (আমার মা) উম্মু সুলাইম বললেন, আপনার এই ছোট্ট খাদেমটির জন্য দো‘আ করছেন না
কেন?
তখন তিনি এভাবে দো‘আ করলেন, اللَّهُمَّ أَكْثِرْ مَالَهُ وَوَلَدَهُ وَأَطِلْ حَيَاتَهُ
وَاغْفِرْ لَهُ ‘হে আল্লাহ! তুমি তার সম্পদ ও সন্তান বৃদ্ধি
করে দাও, তার হায়াত বাড়িয়ে দাও এবং তাকে ক্ষমা করে দাও’। তাঁর তিনটি দো‘আর ফল এভাবে প্রত্যক্ষ করেছি যে, একশত তিনটি সন্তানকে নিজ হাতে দাফন করেছি। আমার বাগানের ফসল
বছরে দু’বার উঠানো হয় এবং আমার আয়ু এতই দীর্ঘ হয়েছে
যে,
অধিক বয়সের কারণে আমি রীতিমত লজ্জাবোধ করি।
এখন (চতুর্থটি) মাগফিরাত আশা করছি’।[21]
অপর একটি হাদীছে এসেছে,আনাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের নিকটে আসলেন। এ সময় আমি, আমার মা ও আমার খালা উম্মু হারাম ব্যতীত কেউ ছিল না। আমার
মা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আপনার ছোট খাদেমের
জন্য দো‘আ করুন। তখন রাসূল (সা.) আমার জন্য সব ধরনের
রকতের দো‘আ করলেন। তিনি আমার জন্য যে দো‘আ করেছিলেন, তার শেষে ছিল, اللَّهُمَّ أَكْثِرْ مَالَهُ وَوَلَدَهُ وَبَارِكْ لَهُ فِيْهِ ‘হে আল্লাহ! তার সম্পদ ও সন্তানাদি বৃদ্ধি করে দিন এবং তাতে
বরকত দান করুন’।[22] আনাস (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ! সে যুগে আমার সম্পদ ছিল প্রচুর
এবং সন্তান ও নাতী-পোতার সংখ্যা ছিল একশ’র মত।[23]
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আনাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার দুনিয়া ও আখিরাতের সকল প্রকার কল্যাণের জন্য দো‘আ করলেন। তিনি বলেন, فَإِنِّىْ لَمِنْ أَكْثَرِ الأَنْصَارِ مَالاً ‘ফলে আমি আনছারদের মধ্যে ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলাম’।[24]
আনাস (রা.) বলেন, আল্লাহ আমার সম্পদ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি আমার আঙ্গুর
গাছে বছরে দু’বার ফল আসত এবং আমার ঔরসজাত সন্তান হয়েছিল
১০৬ জন’।[25] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আনাস (রা.)-এর একটি বাগান ছিল যাতে বছরে দু’বার ফল আসত। আর তাঁর বাগানে এমন ফুল ছিল যা থেকে মিশক
আম্বরের সুগন্ধি ছড়াত।[26]
ইস্তি‘আব গ্রন্থে
উল্লিখিত হয়েছে যে, আনাস (রা.)-এর ৮০ জন সন্তান ছিল। তন্মধ্যে ৭৮
জন ছেলে এবং হাফছাহ ও উম্মু আমর নামক ২ জন মেয়ে।[27] আবুল ইয়াকযান বলেন, প্লেগে আনাস (রা.)-এর ৮০ জন মতান্তরে ৭০ জন
সন্তান মারা গিয়েছিল।[28] রাসূলের দো‘আর বরকতে আনাস (রা.) দীর্ঘ বয়স পেয়েছিলেন।
তিনি ৯৬/৯৭ মতান্তরে ১০৩ বা ১০৭ বছরের দীর্ঘ জীবন লাভ করেন।[29]
রাসূল (সা.)-এর গোপনীয় বিষয়ের
হেফাযত :
মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) কোন গোপনীয় কথা আনাস
(রা.)-কে বললে তিনি তা প্রকাশ করতেন না; বরং গোপনই রাখতেন। যেমন তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার নিকটে আসলেন। আমি তখন বালকদের সাথে খেলায় লিপ্ত ছিলাম।
তিনি আমাদেরকে সালাম দিলেন। অতঃপর আমাকে একটি বিশেষ প্রয়োজনে পাঠালেন। আমি আমার
মায়ের নিকটে বিলম্বে ফিরে আসলাম। আমি মায়ের নিকটে গেলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে কিসে আটকে রেখেছিল? আমি বললাম, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে একটি প্রয়োজনে
পাঠিয়েছিলেন। তিনি বললেন, প্রয়োজনটি কি? আমি বললাম, সেটা গোপনীয়। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গোপনীয় বিষয় কখনও কাউকে বলবে না। আনাস
বলেন,
হে ছাবিত! সে গোপনীয় ব্যাপার কারও নিকট বললে
তা তোমাকে অবশ্যই বলতাম।[30] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আনাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে আমার নিকট
বলেছিলেন। তারপর আমি কারো নিকটে তা প্রকাশ করিনি। এমনকি (আমার মা) উম্মু সুলাইম (রা.)
সে ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু আমি তাঁকেও তা জানাইনি।[31]
জিহাদে অংশগ্রহণ :
আনাস (রা.) অনেক জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন।
তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে ৮টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।[32] তন্মধ্যে হুদায়বিয়ার সন্ধি, মক্কা বিজয়, হুনায়েন ও তায়েফ উল্লেখযোগ্য।[33] তিনি রাসূলের সাথে বিদায় হজ্জ, ওমরা ও বায়‘আতে রিযওয়ানে শরীক হন।[34] তিনি বদর যুদ্ধে রাসূলের খাদেম হিসাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ইরানের প্রসিদ্ধ
শহর তুসতার বিজয়ে অংশগ্রহণ করেন।[35] তখন তিনি হুরমুযানকে নিয়ে ওমর (রা.)-এর নিকটে আসেন। অতঃপর সে ইসলাম গ্রহণ করে।[36]
পোশাক-পরিচ্ছদ :
আনাস (রা.) স্বাভাবিক পোশাক পরিধান করতেন।
তিনি জুববা ও নকশা করা চাদর ব্যবহার করতেন।[37] তিনি মাথায় কালো পাগড়ি ও হাতে আংটি পরতেন। পাগড়ির প্রান্ত পিছনের দিকে ঝুলিয়ে
দিতেন।[38] তাঁর আংটিতে ‘মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ’ খোদাই করা ছিল। যখন তিনি পেশাব-পায়খানায় যেতেন, তখন তা খুলে রাখতেন।[39]
আনাস (রা.)-এর বর্ণনায় রাসূল (সা.)-এর
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও দৈহিক গুণাবলী :
ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে আনাস (রা.) ছিলেন
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একান্ত কাছের মানুষ। তিনি নিকট থেকে রাসূল (সা.)-এর
কার্যাবলী প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর বর্ণনায় রাসূলের অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে
উঠেছে। যেমন তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন, সর্বাপেক্ষা উত্তম চরিত্রের মানুষ। একদা কোন এক কাজে আমাকে
পাঠাতে চাইলেন। তখন আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি
যাব না। কিন্তু আমার মনের মধ্যে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) যে কাজের জন্য আমাকে আদেশ করেছেন, আমি সে কাজে অবশ্যই যাব। অতঃপর আমি বের হ’লাম এবং এমন কতিপয় বালকের নিকট এসে পৌঁছলাম যারা বাজারের
মধ্যে খেলাধুলা করছিল। এমন সময় হঠাৎ রাসূলুল্লাহ (সা.) পিছন হ’তে আমার ঘাড় চেপে ধরলেন। আনাস (রা.) বলেন, আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তিনি হাসছেন। তখন তিনি স্নেহের সুরে বললেন, হে উনাইস! আমি তোমাকে যে কাজের জন্য আদেশ করেছিলাম সেখানে কি তুমি গিয়েছিলে? আমি বললাম, ইয়া রাসূল্লাল্লাহ
(সা.)! এইতো আমি এক্ষণি যাচ্ছি।[40]
আনাস (রা.) বলেন, আমি একাধারে দশ বছর নবী করীম (সা.)-এর খেদমত করেছি। কিন্তু
তিনি কোন দিন ‘উফ’ শব্দটি পর্যন্ত আমাকে বলেননি। এমনকি একাজটি কেন করেছ এবং তা কেন করনি- এমন
কথাও কোন দিন বলেননি।[41]
তিনি আরো বলেন, আমার বয়স যখন আট বছর তখন রাসূল (সা.)-এর খেদমতে যোগ দেই এবং দশ বছর যাবৎ তাঁর
খেদমত করেছি। কোন সময় কোন জিনিস নষ্ট হয়ে গেলেও তিনি আমাকে কখনো তিরস্কার করেননি।
যদি পরিবারবর্গের কেউ আমাকে তিরস্কার করতেন, তখন তিনি বলতেন, তাকে ছেড়ে দাও। কেননা যা হওয়ার ছিল তা তো
হবেই।[42]
রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন অসীম ধৈর্যের
অধিকারী। যেমন আনাস (রা.) বলেন, একদা নবী করীম (সা.)
একটি নাজরানী চাদর গায়ে জড়িয়ে পথ চলছিলেন। পথিমধ্যে এক বেদুইন তার চাদর ধরে হেঁচকা
টান দেয় ফলে তাঁর গলায় চাদরের টানের দাগ পড়ে যায়। এরপর ঐ বেদুইন বলল, হে মুহাম্মাদ (সা.)! আল্লাহ তা‘আলার যে সকল সম্পদ আপনার হাতে আছে, তা হ’তে আমাকে কিছু
দেওয়ার নির্দেশ দিন। তখন নবী করীম (সা.) তার দিকে ফিরে তাকালেন এবং হেসে ফেললেন।
অতঃপর তাকে কিছু দেয়ার নির্দেশ দিলেন।[43]
রাসূলের চলাফেরা, শারীরিক বৈশিষ্ট্যও আনাস (রা.)-এর বর্ণনায় উঠে এসেছে। তিনি
বলেন,
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর (দেহের) চেয়ে অধিক
সুগন্ধময় কোন মিসক আম্বর বা ভিন্ন কোন বস্ত্তর ঘ্রাণ আমি গ্রহণ করিনি এবং তাঁর
(দেহের চেয়ে কোমল রেশম বা নরম বস্ত্র আমি স্পর্শ করিনি।[44] অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন শুভ্র উজ্জ্বল বর্ণের। তাঁর ঘাম যেন মুক্তার ন্যায়।
তিনি চলার সময় সম্মুখপানে ঝুঁকে চলতেন। আমি নরম কাপড় বা রেশমকেও তাঁর হাতের তালুর
মত নরম পাইনি এবং মিসক আম্বরের মাঝেও তাঁর শরীরের চেয়ে অধিক সুগন্ধি পাইনি।[45]
আনাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের গৃহে আসলেন এবং আরাম করলেন। তিনি
ঘর্মাক্ত হ’লেন, আর আমার মা একটি ছোট বোতল নিয়ে রাসূলের ঘাম মুছে তাতে ভরতে লাগলেন। নবী করীম (সা.)
জাগ্রত হ’লেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, হে উম্মু সুলাইম! একি করছ? আমার মা বললেন, এ হচ্ছে আপনার ঘাম, যা আমরা সুগন্ধির সঙ্গে মেশাই, আর এতো সব সুগন্ধির সেরা সুগিন্ধ।[46]
অন্যত্র তিনি বলেন, নবী করীম (সা.) উম্মু সুলাইমের গৃহে যেতেন এবং তার বিছানায়
আরাম করতেন। আর উম্মু সুলাইমকে বলা হ’ল, নবী করীম (সা.) তোমার গৃহে তোমার বিছানায় ঘুমিয়ে গেছেন।
আনাস (রা.) বলেন, উম্মু সুলাইম গৃহে প্রবেশ করলেন, নবী করীম (সা.) তখন ঘর্মাক্ত হয়েছেন, আর তাঁর ঘাম চামড়ার বিছানার উপর জমে গেছে, উম্মু সুলাইম তার কৌটা খুললেন এবং সে ঘাম মুছে মুছে ছোট
একটি বোতলে ভরতে লাগলেন। নবী করীম (সা.) হঠাৎ উঠে গেলেন এবং বললেন, হে উম্মু সুলাইম! তুমি কি করছ? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের শিশুদের জন্য তার বরকত নিচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (সা.)
বললেন,
ভাল করেছ।[47]
রাসূল (সা.) হাসি-ঠাট্টাও করতেন। যেমন আনাস (রা.)
হতে বর্ণিত যে, নবী করীম (সা.) সবচেয়ে অধিক সদাচারী ছিলেন।
আমার এক ভাই ছিল; তাকে আবূ ‘উমায়ের’ বলে ডাকা হ’ত। আমার ধারণা যে, সে তখন মায়ের দুধ খেতো না। যখনই সে তাঁর নিকট
আসতো,
তিনি বলতেন, হে আবূ ‘উমায়ের! কী করছে তোমার নুগায়ের? সে নুগায়র পাখিটা নিয়ে খেলতো। আর প্রায়ই যখন ছালাতের সময় হ’ত এবং তিনি আমার ঘরে থাকতেন, তখন তাঁর নীচে যে বিছানা থাকতো, একটু পানি ছিটিয়ে ঝেড়ে দেয়ার জন্য আমাদের আদেশ করতেন। তারপর তিনি ছালাতের জন্য
দাঁড়াতেন এবং আমরাও তাঁর পেছনে দাঁড়াতাম। আর তিনি আমাদের নিয়ে ছালাত আদায় করতেন।[48]
ছোট বড় কোন মানুষের সাথে মিশতে তিনি কুণ্ঠিত
হ’তেন না। আনাস ইবনু মালিক (রা.) বলেন, মদীনাবাসীদের কোন এক দাসীও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাত ধরে
যেখানে চাইত নিয়ে যেত। আর তিনিও তার সাথে চলে যেতেন।[49]
ইবাদত-বন্দেগী :
আনাস (রা.) ইবাদত-বন্দেগীতে রাসূলের
পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ما رأيت أحدا أشبه بصلاة رسول الله صـ من ابن أم سليم
يعني أنسًا ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ছালাতের সাথে
সাদৃশ্যপূর্ণ ছালাত ইবনু উম্মে সুলাইম তথা আনাস ব্যতীত অন্য কাউকে দেখিনি’।[50] আনাস ইবনু সীরীন বলেন, كان أنس بن مالك أحسن الناس صلاة في الحضر والسفر ‘আনাস ইবনু মালেক (রা.) ছিলেন মুক্বীম (বাড়ীতে থাকা) অবস্থায়
ও সফরে সর্বোত্তম ছালাত আদায়কারী ব্যক্তি’।[51]
তিনি ইবাদতের প্রতি সজাগ ও সচেতন থাকতেন।
ছালেহ ইবনু ইবরাহীম বলেন, আমরা জুম‘আর দিনে
রাসূলের কোন এক স্ত্রীর বাড়ীতে বসে কথা-বার্তা বলছিলাম। তখন আনাস (রা.) এসে বললেন, তোমরা থাম। এরপর ছালাতের আযান হ’লে তিনি বললেন, আমি আশংকা করছি যে, তোমাদের সাথে কথা বলতে থাকলে আমার জুম‘আর ছালাত ছুটে যাবে বা বাতিল হয়ে যাবে।[52]
আনাস (রা.) ধীর-স্থিরভাবে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে
রাতের নফল ছালাত আদায় করতেন। আর এই দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করার কারণে তাঁর
দু’পায়ের গোড়ালী ফেটে রক্ত বের হয়ে যেত।[53]
তিনি বৃদ্ধ বয়সে অতি দুর্বল হয়ে যান। ফলে
ছিয়াম পালনে অক্ষম হয়ে পড়েন। তখন তিনি প্রতি দিনের ছিয়ামের জন্য একজন মিসকীনকে
রুটি-গোশত খাওয়াতেন এবং নিজে ছিয়াম ভঙ্গ করতেন। দু’বছর তিনি এরূপ করেছেন।[54] অন্য বর্ণনায় আছে, মৃত্যুর বছর আনাস (রা.) ছিয়াম পালনে অপারগ
হয়ে পড়লেন। যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাঁর পক্ষে কাযা আদায় করা সম্ভব নয়, তখন তিনি এক গামলা রুটি ও গোশত রান্না করে কয়েকজনকে খাওয়ালেন।[55] অপর বর্ণনায় আছে, তিনি এক গামলা ছারীদ (খাদ্য বিশেষ) তৈরী করে
৩০ জন মিসকীনকে খাওয়ালেন।[56]
তিনি কুরআন খতম করলে পরিবার-পরিজন সকলের জন্য
দো‘আ করতেন।[57] তিনি ইহরাম বাঁধলে (হজ্জ ও ওমরা শেষে) ইহরাম থেকে হালাল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত
তাঁর সাথে কোন কথা বলা যেত না। এ সময় তিনি কেবল আল্লাহর যিকর করতেন। যিকর ব্যতীত
অন্য কোন কথা বলতেন না।[58] তিনি উভয় ক্বিবলার দিকেই ছালাত আদায় করেছেন। তিনি বলেন, لَمْ يَبْقَ مِمَّنْ صَلَّى
الْقِبْلَتَيْنِ غَيْرِىْ ‘দুই ক্বিবলার দিকে ফিরে ছালাত আদায়কারী আমি ব্যতীত
আর কেউ নেই’।[59]
রাসূলের প্রতি আনাসের ভালবাসা :
তিনি রাসূল (সা.)-কে মনে-প্রাণে ভালবাসতেন।
রাসূলের কথা-কর্মের অনুসরণের প্রতি তিনি ছিলেন সদা উদগ্রীব। রাসূল (সা.) যা
ভালবাসতেন আনাস (রা.)ও তাই ভালবাসতেন; যা তিনি অপসন্দ করতেন আনাস (রা.)ও তা অপসন্দ করতেন। তিনি রাসূলের সাথে প্রথম
সাক্ষাতের মুহূর্ত এবং বিদায়ের সময়কে অধিক স্মরণ করতেন। রাসূলের প্রতি তার
অকৃত্রিম ভালবাসার কথা সুস্পষ্ট হয় তার এ উক্তিতে, ما من ليلة إلا وأنا أرى فيها حبيبي ثم يبكي ‘এমন কোন রাত নেই যে, আমি আমার প্রিয় বন্ধুকে (স্বপ্নে) দেখিনি। অতঃপর তিনি কাঁদলেন’।[60] রাসূলের প্রতি তার মহববতের বিষয়টি আরো প্রতিভাত হয়েছে নিম্নোক্ত হাদীছে। আনাস
(রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল
ক্বিয়ামত কখন হবে? তিনি বললেন, তার জন্য তুমি কি প্রস্ত্তত করেছ? লোকটি বলল, আমি তার জন্য অধিক ছালাত, ছিয়াম ও দান-ছাদাক্বা করতে পারিনি। তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর
রাসূলকে ভালবাসি। রাসূল (সা.) وَأَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ ‘তুমি তার সাথে থাকবে, যাকে তুমি ভালবাস’। আনাস (রা.)
বলেন,
কোন কিছুতে আমি কখনও এত খুশি হইনি, যত খুশি হয়েছি রাসূলের একথা وَأَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ
শুনে। কেননা আমি নবী করীম (সা.), আবূবকর ও ওমরকে
ভালবাসি। আর আমি আশা করি তাঁদের ভালবাসার কারণে আমি তাঁদের সাথেই জান্নাতে থাকব।
যদিও আমি তাঁদের ন্যায় আমল করতে পারিনি’।[61]
ইলমে হাদীছে অবদান :
রাসূল (সা.)-এর সান্নিধ্যে থেকে আনাস (রা.)
অহি-র অফুরন্ত জ্ঞান লাভে ধন্য হয়েছিলেন। রাসূলের নিকট থেকে লাভ করেছিলেন ইলমের
সঠিক বুঝ, প্রজ্ঞা ও প্রয়োগপদ্ধতি। তিনি তা ছাহাবী, তাবেঈ ও অন্যান্য মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি
রাসূলুল্লাহ (সা.), আবূবকর, ওমর, ওছমান, আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা, মু‘আয ইবনু জাবাল, উসাইদ ইবনুল হুযাইর, আবু ত্বালহা, ছাবেত ইবনু কায়েস, আব্দুর রহমান ইবনু আওফ, ইবনু মাসঊদ, মালেক ইবনু ছা‘ছা‘আহ, আবু যর, উবাদাহ ইবনুছ ছামেত, আবু হুরায়রাহ, উম্মু সুলাইম বিনতু মিলহান (তাঁর মাতা), তাঁর খালা উম্মু হারাম, উম্মুল ফাযল (আববাসের স্ত্রী), ফাতেমাতুয যাহরা প্রমুখ থেকে হাদীছ শ্রবণ ও বর্ণনা করেন।
তাঁর থেকে হাসান, সুলাইমান আত-তাইমী, আবু ক্বিলাবাহ, ইবনু সীরীন, শা‘বী, আবু মিজলায, মাকহূল, ওমর ইবনু আব্দুল আযীয, ছাবিত আল-বুনানী, আবূবকর ইবনু আব্দুল্লাহ আল-মুযনী, ইবনু শিহাব আয-যুহরী, ক্বাতাদাহ, ইবনুল মুনকাদির, ইসহাক ইবনু আব্দুল্লাহ আবু ত্বালহা, আব্দুল আযীয ইবনু ছুহাইব, শু‘আইব আল-হাবহাব, আমর ইবনু আমের আল-কূফী, হুমায়েদ আত-ত্বাবীল, ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আল-আনছারী, কাছীর ইবনু সুলাইম, ঈসা ইবনু তাহমান, ওমর ইবনু শাকির, ছুমামাহ, আল-জা‘দ আবু ওছমান, আনাস ইবনু সীরীন, আবু উমামা ইবনু সাহল ইবনু হুনাইফ, ইবরাহীম ইবনু মায়সারা, বুরাইদ ইবনু আবী মারিয়াম, বয়ান ইবনু বিশর, রবী‘আহ ইবনু আবু আব্দুর রহমান, সাঈদ ইবনু জুবাইর, সালমা ইবনু ওয়ারদান প্রমুখ হাদীছ শুনেছেন ও বর্ণনা করেছেন।[62]
১৫০ হিজরী পর্যন্ত তাঁর নির্ভরযোগ্য
শিষ্য-সাথীগণ এবং ১৯০ হিজরী পর্যন্ত দুর্বল শিষ্যগণ বেঁচেছিলেন। তাঁর ছাত্রদের
নিকট থেকে যারা হাদীছ শুনেছেন তন্মধ্যে নির্ভরযোগ্য অনেকে ২০০ হিজরীর পরেও জীবিত
ছিলেন।[63]
তাঁর নিকট থেকে প্রায় ২০০ জন রাবী হাদীছ
বর্ণনা করেছেন।[64] তাঁর থেকে বর্ণিত হাদীছ সংখ্যা ২২৮৬টি। তন্মধ্যে বুখারী ও
মুসলিম ঐক্যমতে ১৮০টি, বুখারী এককভাবে ৮০টি এবং মুসলিম এককভাবে ৯০টি
হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[65] কেউ বলেন, মুসলিম এককভাবে
৭০টি হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[66]
আনাস (রা.) হাদীছ বর্ণনায় সতর্ক ও সচেতন
ছিলেন। মুহাম্মাদ বলেন, আনাস (রা.) রাসূল (সা.) থেকে হাদীছ বর্ণনার
সময় সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তেন এবং বলতেন, او كما قال رسول الله صـ ‘অথবা রাসূল (সা.) এরূপ বলেছেন’।[67] তিনি বলতেন,خُذْ مِنِّى فَأَنَا أَخَذْتُ مِنْ رَسُولِ اللهِ صـ
عَنِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَلَسْتَ تَجِدُ أَوْثَقَ مِنِّيْ ‘আমার নিকট থেকে (ইলম) গ্রহণ কর। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর
নিকট থেকে গ্রহণ করেছি, তিনি আল্লাহ থেকে। আর তুমি আমার চেয়ে
নির্ভরযোগ্য কাউকে পাবে না’।[68]
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন :
আবূবকর (রা.) খলীফা হওয়ার পর আনাস (রা.)-কে
বাহরাইনে যাকাত আদায়কারী নিযুক্ত করেন। তাঁর মৃত্যু হ’লে তিনি ওমরের নিকটে আসেন। তখন ওমর বলেন, কি নিয়ে এসেছেন, দিন। আনাস বললেন, আগে বায়‘আত নিন। তখন
ওমর (রা.) হাত বাড়িয়ে দিলেন। অতঃপর আনাস বললেন, এই যে, সব সম্পদ, আমরা যা নিয়ে এসেছি। তখন ওমর বললেন, এসব আপনার। যার পরিমাণ ছিল ৪ হাযার।[69]
ওমর (রা.)ও তাকে বাহরাইনে যাকাত আদায়ের
দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন।[70] ইয়াযীদের মৃত্যুর পর ইবনু যুবায়ের আনাস (রা.)-এর নিকট পত্র
লেখেন। তখন তিনি ৪০ দিন বছরার মসজিদে ইমামতি করেন।[71]
রাসূলের মৃত্যুতে আনাসের শোক :
রাসূল (সা.)-এর সাথে সাক্ষাতের প্রথম দিনে
আনাসের চেহারা ছিল দীপ্তিময় এবং রাসূলের বিচ্ছেদের দিনে তার চেহারা ছিল বিষাদময়, চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত। রাসূলের কথা তিনি বার বার উল্লেখ
করতেন। তিনি জীবনের ১০টি বছর রাসূলের সন্নিধ্যে কাটানোতে তাঁর প্রতি ছিল অপরিসীম
ভালবাসা। যখন রাসূল (সা.) ইন্তেকাল করেন, তখন আনাস শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। তিনি অনুভব করলেন তাঁর চারিদিক যেন
পরিবর্তিত হয়ে গেল; দুনিয়া যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল। এর
প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর বক্তব্যে, তিনি বলেন, যেদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরত করে মদীনায় প্রবেশ করেন
সেদিন সেখানকার প্রতিটি জিনিস জ্যোতির্ময় হয়ে যায়। অতঃপর যেদিন তিনি ইন্তিকাল করেন
সেদিন আবার তথাকার প্রতিটি জিনিস অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। আমরা তাঁর দাফনকার্য শেষ
করে হাত থেকে ধুলা না ঝাড়তেই আমাদের অন্তরে পরিবর্তন এসে গেল (ঈমানের জোর কমে
গেল)।[72]
ইবনু রজব বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্যুবরণ করলে মুসলমানদের মধ্যে বিশৃংখলা দেখা দিল। কেউ
কেউ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল, কি করবে তা বুঝতে
পারল না; কেউ বসে পড়ল উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পেল না, কারো বাকরুদ্ধ হয়ে গেল, কথা বলার শক্তি পেল না। কেউ তাঁর মৃত্যুকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করল। অথচ রাসূল (সা.)
বলেছেন যে, তিনি প্রেরিত হয়েছেন।[73] ছাহাবীগণের অনেকেরই এ অবস্থা হয়েছিল, যার প্রমাণ নিম্নোক্ত হাদীছ। আনাস (রা.) বলেন, যখন নবী করীম (সা.)-এর রোগ প্রকটরূপ ধারণ করে তখন তিনি
বেহুঁশ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ফাতেমা (রা.) বললেন, ওহ! আমার পিতার উপর কত কষ্ট! তখন নবী করীম (সা.) বললেন, আজকের পরে তোমার পিতার উপর আর কোন কষ্ট নেই। যখন তিনি
ইন্তিকাল করলেন, তখন ফাতেমা (রা.) বললেন, হায় আমার পিতা! আমার পিতা, রবের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। হায় আমার পিতা! জান্নাতুল ফিরদাউসে তাঁর বাসস্থান।
হায় আমার পিতা! জিবরীল (আঃ)-কে তাঁর ইন্তিকালের খবর শুনাই। যখন নবী করীম (সা.)-কে
সমাহিত করা হ’ল, তখন ফাতিমা (রা.) বললেন, হে আনাস!
রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে মাটি চাপা দিয়ে আসা তোমরা কিভাবে বরদাশত করলে?[74]
হাজ্জাজ কর্তৃক আনাস (রা.)-কে
অপমান :
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বহু ছাহাবী ও তাবেঈর উপরে
নির্যাতন করেছিল। তার হাত থেকে আনাস (রা.)ও রেহাই পাননি। আলী ইবনু যায়েদ বলেন, আমি গভর্নরের প্রাসাদে ছিলাম। ইবনুল আশ‘আছের (বিদ্রোহের) রাত্রে হাজ্জাজ লোকদেরকে ঠিক করছিল। তখন
আনাস (রা.) আসলেন। এ সময় হাজ্জাজ বলল, হে খবীছ! ফেতনার মধ্যে ঘোরাফিরা করা লোক! একবার আলীর সাথে, একবার ইবনুয যুবায়েরের সাথে, আবার ইবনুল আশ-আছের সাথে থাকছ। যার হাতে আমার প্রাণ, সে সত্তার কসম করে বলছি, আমি তোমার মূল উচ্ছেদ করে দেব, যেমন আঠা তুলে ফেলা হয়। আমি তোমার চামড়া তুলে ফেলব, যেভাবে যবের (গুই সাপের) চামড়া ছাড়ানো হয়। তখন আনাস (রা.)
বললেন,
আমীরকে (গভর্ণরকে) কে সাহায্য করবে? হাজ্জাজ বলল, তুমি একাই কি তাকে সাহায্য কর? আল্লাহ তোমার কানকে বধির করে দিন। তখন আনাস (রা.) ইন্নালিল্লাহ পড়লেন। এরপর
হাজ্জাজ অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে আনাস (রা.) বের হয়ে আসলেন। আমরাও তাঁর পিছনে
পিছনে খোলা জায়গায় আসলাম। তখন তিনি বললেন, আমার পরে যদি আমার সন্তানদের উপর এর অনিষ্টের আশংকা না করতাম, তাহ’লে আমি তাকে এমন কথা বলতাম যে, এরপরে আর কখনও সে আমাকে লজ্জিত করত না।[75]
আ‘মাশ বলেন, হাজ্জাজ যখন আনাস (রা.)-কে কষ্ট দেয় তখন তিনি খলীফা আব্দুল
মালেক ইবনে মারওয়ানের কাছে পত্র লিখলেন, আমি ৯/১০ বছর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমত করেছি। আল্লাহর কসম! যদি নাছারারা
এমন কোন লোককে পেত যে তাদের নবীর সেবা করেছে, তাহ’লে অবশ্যই তারা তাকে সম্মান করত।[76] তখন তিনি বললেন, হে বৎস! তুমি হাজ্জাজের নিকটে লেখ, ‘তোমার ধ্বংস হোক! আমি আশংকা করছি যে, তোমার হাতে কেউ কল্যাণ লাভ করবে না। আমার পত্র তোমার কাছে পেঁŠছলে, তুমি আনাস (রা.)-এর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে’। আনাসের নিকটে লিখলেন, আমি ব্যতীত আপনার উপরে কারো কোন কর্তৃত্ব নেই।
অতঃপর হাজ্জাজের নিকটে যখন পত্র আসল, সে আমীরুল মুমিনীনের দূতকে বলল, পত্রে যা আছে, এটা কি তিনি লিখেছেন? দূত বলল, হ্যাঁ, অবশ্যই। এতে তার মুখাবয়ব কঠিন হয়ে গেল। সে
বলল,
আমি নির্দেশ শুনলাম ও মেনে নিলাম। আর সে উঠে
দাঁড়ানোর ইচ্ছা করল। আমি বললাম, আপনি চাইলে আমি
তাঁকে খবর দেই। এরপর আমি আনাস ইবনে মালিকের নিকটে এসে বললাম, আপনি কি লক্ষ্য করেছেন যে, সে (হাজ্জাজ) আপনাকে ভয় করছে? সে আপনার নিকটে
আসতে চেয়েছিল। কিন্তু আপনিই চলুন তার নিকটে। তখন আনাস (রা.) তার নিকটে আসলেন। এ সময়
হাজ্জাজ বলল, হে আবু হামযাহ! আপনি কি রাগ করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ? তুমি বছরার কেন্দ্রস্থলে জনসমক্ষে আমাকে
লাঞ্ছিত করেছ। সে বলল, আপনার ও আমার দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঐ লোকের মত যে
বলে,
হে প্রতিবেশী! তুমিই আমাকে সাহায্য কর এবং
আমার কথা শ্রবণ কর। আমি আশা করি যে, আমার (বলা ঐ) কথা কাউকে বলবেন না।[77]
আনাস (রা.)-এর কারামাত :
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কিছু অলৌকিক
ক্ষমতা দান করেন, যেগুলোকে কারামত বলে। আনাস (রা.)-এর জীবনে
এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল। যেমন ছাবেত আল-বুনানী বলেন, আনাস (রা.)-এর জমির তত্ত্বাবধায়ক এসে বললেন, আপনার জমিগুলো শুকিয়ে গেছে সেচ দেওয়া প্রয়োজন। তখন আনাস (রা.) চাদর পরলেন এবং
উন্মুক্ত মাঠে বেরিয়ে এসে দু’রাক‘আত ছালাত পড়ে দো‘আ করলেন।
এতে আকাশে মেঘ দেখা গেল এবং আকাশ ছেয়ে গেল ও বৃষ্টি হ’ল। এমনকি শুষ্কভূমি সিক্ত হয়ে গেল। এটা ছিল গ্রীষ্মকাল। তখন
তিনি পরিবারের কাউকে পাঠালেন, পানি কতদূর পৌঁছেছে, তা দেখার জন্য। সে দেখল যে, তাঁর সব জমিই সিক্ত হয়েছে, সামান্য অংশ
ব্যতীত।[78]
আনাস (রা.) বলেন, রুবায়ি‘ নামক তাঁর এক বোন
জনৈক মহিলার সামনের দাঁত ভেঙ্গে দিলে আল্লাহর রাসূল (সা.) তার কিছাছের নির্দেশ
দিলেন। আনাস (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য পাঠিয়েছেন, তার দাঁত ভাঙ্গা হবে না। পরবর্তীতে বাদীপক্ষ কিছাছের পরিবর্তে ক্ষতিপূরণ নিতে
রাযী হ’লে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছে, যে আল্লাহর নামে শপথ করলে তিনি তার শপথ রক্ষা করেন। সে কারণ
তাকে আর শপথ ভঙ্গ করতে হয় না’।[79]
ইন্তেকাল :
ছাহাবীগণের মধ্যে আনাস (রা.) সর্বশেষে
মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বলেন, قَدْ بَقِيَ قَوْمٌ مِنَ الْأَعْرَابِ، فَأَمَّا مِنْ أَصْحَابِهِ
فَأَنَا آخِرُ مَنْ بَقِيَ ‘আরবের অনেকেই বেঁচে আছে। আর রাসূলের
ছাহাবীগণের মধ্যে আমিই সর্বশেষ যে বেঁচে আছি’। তাঁর অসুস্থতায় ডাক্তার ডাকার কথা বললে, তিনি বলেন, ডাক্তার আমাকে
অসুস্থ করে দেবে। বরং তোমরা আমাকে ‘লা ইলাহা
ইল্লাল্লাহু’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ
ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’- এ বাক্যের তালক্বীন দাও। মৃত্যু
অবধি তিনি একথাই বলছিলেন।[80]
আনাস (রা.)-এর মৃত্যুকাল নিয়ে ঐতিহাসিকগণের
মাঝে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। হুমায়েদ, কাতাদাহ, হায়ছাম ইবনু আদী, সাঈদ ইবনু উফাইর ও আবু উবাইদ বলেন, তিনি ৯১ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। মা‘ন ইবনু ঈসা ও ওয়াকেদী বলেন, তিনি ৯২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ইবনু উলাইয়্যাহ, সাঈদ ইবনু আমের, আল-মাদায়েনী, আবু নু‘আইম, খলীফা, আল-ফাল্লাস বলেন, তিনি ৯৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। এটাই বিশুদ্ধ মত।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর, মতান্তরে ১০৭ বছর।[81] তিনি বছরায় ইন্তিকাল করেন।[82]
আনাস ইবনু মালেক (রা.) মৃত্যুবরণ করলে
মুরেক্ব আল-‘আজলী বললেন, আজ অর্ধেক ইলম চলে গেল। তাকে বলা হ’ল, হে আবুল মু‘তামার সেটা
কিভাবে?
তিনি বললেন, প্রবৃত্তির অনুসারী কোন লোক রাসূলের হাদীছ বর্ণনার ক্ষেত্রে আমাদের বিরোধিতা
করলে আমরা বলতাম, ঐ ব্যক্তির কাছে চল যিনি রাসূল (সা.)-এর নিকট
থেকে শুনেছেন।[83]
উপসংহার :
আনাস (রা.) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর
সার্বক্ষণিক সহচর। তিনি রাসূলের নিকট থেকে অহি-র জ্ঞান লাভ করে নিজে সে অনুযায়ী
আমল করে ধন্য হয়েছিলেন। আর তাঁর জ্ঞানের আলোকছটায় মুসলিম জাহান আলোকিত করে গেছেন।
রাসূলের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করে তিনি ইত্তেবায়ে সুন্নাতের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন
মুসলিম উম্মাহর জন্য। সুতরাং রাসূলের এই ছাহাবীর জীবনীতে আমাদের জন্য শিক্ষণীয়
বিষয় রয়েছে। তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে সে অনুযায়ী আমল করার তাওফীক্ব দিন।-আমীন!
[1]. শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৩য় খন্ড (বৈরূত : মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪০২ হি./১৯৮২ খ্রী.), পৃঃ ৩৯৫-৯৬।
[2]. মাহমূদ আল-মিছরী, আছহাবুর রাসূল (সা.), (কায়রো : মাকতাবা আবুবকর ছিদ্দীক্ব, ২য় প্রকাশ, ১৪২৩হিঃ/২০০২খ্রী.), পৃঃ ২১৭।
[3]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৫ম খন্ড, ৯ম জুয (কায়রো :
দারুর রাইয়্যান, ১ম প্রকাশ, ১৪০৮ হি./১৯৮৮ খৃ.), পৃঃ ৯৪।
[4]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৩/৩৯৫ পৃঃ।
[5]. মুসলিম হা/২০২৯।
[6]. তিরমিযী হা/৫৮৯, ২৬৭৮, ২৬৯৮; মিশকাত হা/৫৮১৯, সনদ ছহীহ।
[7]. বুখারী হা/৬৪০০, ২৫৬১।
[8]. আছহাবুর রাসূল (সা.), পৃঃ ২১৭।
[9]. তদেব।
[10]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৫ম খন্ড, ৯ম জুয, পৃঃ ৯৪।
[11]. মুসলিম হা/৫১৮৫ (১২৫), ২০২৯।
[12]. বুখারী হা/৫৭৬৯, ৪৭৬৮।
[13]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৩/৩৯৭।
[14]. তদেব, ৩/৩৯৬; আল-বিদায়া ওয়ান
নিহায়াহ, ৫ খন্ড, ৯ম জুন, পৃঃ ৯৪।
[15]. মুস্তাদরাক ৩/৬৬৪।
[16]. বুখারী, আদাবুল মুফরাদ
হা/৬৫৩।
[17]. মুসলিম হা/(১৪৩) ২৪৮১।
[18]. বুখারী, ‘ছাওম’ অধ্যায় হা/১৯৮২।
[19]. মুসলিম হা/(১৪১)২৪৮০; মিশকাত হা/৬১৯৯; তিরমিযী
হা/৩৮২৯।
[20]. মুসলিম হা/(১৪৪) ৬২৭১।
[21]. বুখারী, আদাবুল মুফরাদ হা/৬৫৪, সনদ ছহীহ।
[22]. মুসলিম হা/(১৪২) ৬২৬৯।
[23]. মুসলিম হা/(১৪৩) ৬২৭০।
[24]. বুখারী, হা/১৯৮২ ‘ছাওম’ অধ্যায়।
[25]. বুখারী ‘দাওয়াত’ অধ্যায়; মুসলিম হা/২৪৮০।
[26]. তিরমিযী হা/৩৮৩৩।
[27]. ইবনু আবদিল বার্র, আল-ইস্তি‘আব।
[28]. সিয়ার ৩/৪০৫।
[29]. তদেব ৩/৪০৬।
[30]. মুসলিম হা/(১৪৫)২৪৮২।
[31]. মুসলিম হা/৬২৭৩ (১৪৬/৬২৭৩)।
[32]. সিয়ার ৩/৩৯৭; আবু আব্দুল্লাহ আল-হাকিম, আল-মুস্তাদরাক, ৩য় খন্ড
(বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪১১ হি.; ১৯৯৮ খৃ.), পৃঃ ৬৬৫।
[33]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, আত-তাহযীবুত তাহযীব, (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ ১৪১৫ হি./ ১৯৯৪ খৃ.), পৃঃ ৩৪৩।
[34]. তদেব, সিয়ার ৩/৩৯৭।
[35]. তদেব ৩/৩৯৭।
[36]. তদেব পৃঃ ৩/৪০২।
[37]. সিয়ার ৩/৪০৪।
[38]. সিয়ার ৩/৪০৩।
[39]. তদেব ৩/৪০৪।
[40]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮০২।
[41]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮০১।
[42]. বায়হাক্বী শু‘আবুল ঈমান হা/১৪২৯; মিশকাত
হা/৫৮১৯, সনদ ছহীহ।
[43]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮০৩।
[44]. মুসলিম হা/২৩৩০।
[45]. মুসলিম হা/২৩৩০, ৫৯৪৮।
[46]. মুসলিম হা/৫৯৪৯।
[47]. মুসলিম হা/৫৯৫০।
[48]. বুখারী হা/৬২০৩; মুসলিম ৩৮/৫ হা/২১৫০।
[49]. বুখারী হা/৬০৭২; মিশকাত হা/৫৮০৯।
[50]. সিয়ার, ৩/৪০০; আল-বিদায়াহ, ৫ম খন্ড, ৯ম জুয, পৃঃ ৯৫; তাহযীবুত তাহযীব ১/৩৪৩।
[51]. আল-বিদায়াহ ৫ম খন্ড, ৯ম জুয, পৃঃ ৯৫।
[52]. আল-বিদায়াহ ৫ম খন্ড, ৯ম জুয, পৃঃ ৯৫।
[53]. সিয়ার ৩/৪০০।
[54]. বুখারী, তরজমাতুল বাব-২৫, তাফসীর
অধ্যায়।
[55]. সিয়ার ৩/৪০৫, ৫নং টীকা দ্র.।
[56]. তদেব ৩/৪০৫।
[57]. ছিফাতুছ ছাফওয়াহ ১/৩০৪।
[58]. সিয়ার ৩/৪০১ ও টীকা নং ২ দ্র.।
[59]. বুখারী ‘তাফসীর’ অধ্যায় হা/৪৪৮৯।
[60]. তদেব ৩/৪০৩; আছহাবুর রাসূল (সা.), পৃঃ ৩২৫।
[61]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, বুখারী
হা/৩৬৮৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৬৮৯।
[62]. সিয়ার ৩/৩৯৬; তাহযীব ১/৩৪২।
[63]. সিয়ার ৩/৩৯৬-৯৭।
[64]. তদেব ৩/৩৯৭।
[65]. তদেব ৩/৪০৬।
[66]. যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফায, ১ম খন্ড (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৩৭৪ হি.), পৃঃ ৪৫।
[67]. আল-বিদায়াহ, ৫ম খন্ড, ৯ম জুয, পৃঃ ৯৬।
[68]. তদেব, পৃঃ ৯৫।
[69]. সিয়ার ৩/৪০১।
[70]. তাহযীব ১/৩৪৩; আল-বিদায়াহ, ৫ম খন্ড, ৯ম জুয, পৃঃ ৯৪।
[71]. সিয়ার ৩/৪০১।
[72]. তিরমিযী হা/৩৬১৮; ইবনু মাজাহ
হা/১৬৩১; মিশকাত হা/৫৯৬২, সনদ ছহীহ।
[73]. আছহাবুর রাসূল (সা.), পৃঃ ৩২২।
[74]. বুখারী হা/৪৪৬২; মিশকাত
হা/৫৯৬১।
[75]. সিয়ার ৩/৪০২।
[76]. তদেব ৩/৪০২।
[77]. সিয়ার ৩/৪০৪; আল-মুস্তাদরাক, ৩/৬৬৪।
[78]. তদেব ৩/৪০০; আল-বিদায়াহ, ৫ম খন্ড, ৯ম জুয, পৃঃ ৯৬।
[79]. বুখারী হা/২৮০৬; মুসলিম
হা/১৯০৩।
[80]. আল-বিদায়াহ, ৫ম খন্ড, ৯ম জুয, পৃঃ ৯৭।
[81]. সিয়ার ৩/৪০৬; তাহযীব ১/৩৪৩, আল-বিদায়াহ, ৫ম খন্ড, ৯ম জুয, পৃঃ ৯৭।
[82]. তাহযীব ১/৩৪৩। [83]. তাহযীব ১/৩৪৩-৪৪; বিদায়াহ ৫ম
খন্ড, ৯ম জুয, পৃঃ ৯৭।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(১৬)
সা‘দ ইবনু মু‘আয (রা.)
প্রাথমিক কথা : সা‘দ ইবনু মু‘আয (রা.) ছিলেন
অন্যতম বদরী ছাহাবী। বনু কুরায়যার ব্যাপারে ফায়ছালা দানকারী এই আনছার ছাহাবীর
জানাযায় ৭০ হাযার ফেরেশতা অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে
ও আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হয়। এই জলীলুল কদর ছাহাবীর জীবন চরিত এ নিবন্ধে আলোচিত
হবে ইনশাআল্লাহ।
নাম ও বংশ পরিচয় : তাঁর নাম সা‘দ, কুনিয়াত আবু আমর, উপাধি সাইয়্যেদুল আওস। তাঁর পিতার নাম মু‘আয এবং মাতার নাম কাবশা বিনতু রাফে‘।[1] তাঁর পূর্ণ বংশ পরিচয় হচ্ছে, সা‘দ ইবনু মু‘আয ইবনে নু‘মান ইবনে ইমরাউল কায়েস ইবনে যায়েদ ইবনে আব্দুল আশহাল ইবনে
জুশম ইবনে হারেছ ইবনে খাযরাজ ইবনে নাবীত ইবনে মালেক ইবনে আওস আল-আশহালী আল-খাযরাজী
আল-আনছারী।[2]
জন্ম ও শৈশব : তাঁর জন্মকাল সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তবে তিনি ৫ম হিজরীতে ৩৭ বছর বয়সে
ইন্তিকাল করেন।[3] সে হিসাবে তিনি ৫৯০ খৃষ্টাব্দে নবুওয়াতের ২০ বছর পূর্বে মদীনার খাযরাজ গোত্রের
বনু আব্দুল আশহাল শাখায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও চরিতকারগণ
কিছু বলেননি। তাই এ সম্পর্কেও কিছু জানা যায় না।
ইসলাম গ্রহণ : সা‘দ (রা.) মুছ‘আব ইবনু
উমায়ের (রা.)-এর হাতে ইসলাম কবুল করেন। ইসলাম গ্রহণের পরে তিনি স্বীয় কওমের
সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললেন, হে বনু আব্দুল আশহাল! তোমাদের সাথে আমার
ব্যবহার কেমন পেয়েছ? তারা বলল, হে আমাদের নেতা! উত্তম পেয়েছি এবং আমাদের সঠিক দিক নির্দেশক হিসাবে পেয়েছি।
তিনি বললেন, আমার ব্যপারে তোমাদের একথা বলা হারাম হবে, যতক্ষণ না তোমাদের পুরুষ-মহিলারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের
প্রতি ঈমান আনবে। ফলে বনু আব্দুল আশহালের প্রতিটি পুরুষ-মহিলা ইসলাম কবুল করল।[4]
দেহসৌষ্ঠব ও চেহারা : সা‘দ (রা.) ছিলেন দীর্ঘকায়, ফর্সা, সুন্দর, সৌম্য-কান্তি চেহারা, ডাগর চোখ বিশিষ্ট ও সুন্দর শ্মশ্রুশোভিত
মানুষ।[5] তিনি দীর্ঘদেহী, স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ ছিলেন।[6]
ওমরা পালন ও আবু জাহলের সাথে
বিতর্ক : সা‘দ ইবনু মু‘আয (রা.) ওমরা করতে মক্কায় যান এবং বায়তুল্লাহর তওয়াফ করার সময় আবু জাহল তাঁর
সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়। আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রা.)
বলেন,
সা‘দ ইবনু মু‘আয (রা.) ওমরা আদায় করার জন্য গেলেন এবং ছাফওয়ানের পিতা
উমাইয়াহ ইবনু খালাফের বাড়িতে অতিথি হ’লেন।
উমাইয়াহও সিরিয়ায় গমনকালে (মাদীনায়) সা‘দ (রা.)-এর
বাড়িতে অবস্থান করত। উমাইয়াহ সা‘দ (রা.)-কে বলল, অপেক্ষা করুন, যখন দুপুর হবে এবং যখন চলাফেরা কমে যাবে, তখন আপনি গিয়ে তাওয়াফ করবেন। সা‘দ (রা.)
তাওয়াফ করছিলেন। এমতাবস্থায় আবু জাহল এসে হাযির হ’ল। সা‘দ (রা.)-কে দেখে জিজ্ঞেস করল, এ ব্যক্তি কে যে কা‘বার তাওয়াফ
করছে?
সা‘দ (রা.)
বললেন,
আমি সা‘দ। আবু জাহল
বলল,
তুমি নির্বিঘ্নে কা‘বার তাওয়াফ করছ? অথচ তোমরাই মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীদেরকে আশ্রয় দিয়েছ? সা‘দ (রা.) বললেন, হ্যাঁ। এভাবে দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হ’ল। তখন উমাইয়াহ সা‘দ (রা.)-কে
বলল,
আবুল হাকামের সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে কথা বল না, কারণ সে মক্কাবাসীদের নেতা। অতঃপর সা‘দ (রা.) বললেন, আল্লাহর কসম! তুমি যদি আমাকে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করতে বাধা প্রদান কর, তবে আমিও তোমার সিরিয়ার সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের রাস্তা বন্ধ
করে দিব। উমাইয়া সা‘দ (রা.)-কে তখন বলতে লাগল, তোমার স্বর উঁচু কর না এবং সে তাঁকে বিরত করতে চেষ্টা করতে
লাগল। তখন সা‘দ (রা.) ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি মুহাম্মাদ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তারা তোমাকে হত্যা করবে। উমাইয়া বলল, আমাকেই? তিনি বললেন, হ্যাঁ। উমাইয়া বলল, আল্লাহর কসম মুহাম্মাদ (সা.) কখনও মিথ্যা কথা বলেন না। অতঃপর উমাইয়া তার
স্ত্রীর নিকট ফিরে এসে বলল, তুমি কি জান, আমার ইয়াছরিবী ভাই আমাকে কি বলেছে? স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, কি বলেছে? উমাইয়া বলল, সে মুহাম্মাদ (সা.)-কে বলতে শুনেছে যে, তারা আমাকে হত্যা করবে। তার স্ত্রী বলল, আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ (সা.) মিথ্যা বলেন না। যখন মক্কার
মুশরিকরা বদরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’ল এবং
আহবানকারী আহবান জানাল। তখন উমাইয়ার স্ত্রী তাকে স্মরণ করে দিল, তোমার ইয়াছরিবী ভাই তোমাকে যে কথা বলছিল, সে কথা তোমার মনে নেই? তখন উমাইয়া না যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিল। আবু জাহল তাকে বলল, তুমি এ অঞ্চলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। আমাদের সঙ্গে দুই একদিনের পথ চল।
উমাইয়াহ তাদের সঙ্গে চলল। আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায়
সে নিহত হ’ল।[7]
ভ্রাতৃস্থাপন : রাসূলুল্লাহ (সা.) আনছার ছাহাবী সা‘দ ইবনু মু‘আয ও মুহাজির ছাহাবী আবু উবায়দাহ ইবনুল জাররাহ মতান্তরে সা‘দ ইবনু মু‘আয ও সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছের মাঝে ভ্রাতৃসম্পর্ক স্থাপন করে দেন।[8]
যুদ্ধে অংশগ্রহণ : তিনি ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদর, ওহোদ ও খন্দক বা আহযাব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।[9] খন্দক যুদ্ধে সা‘দ (রা.) আহত হয়েছিলেন। কুরাইশ গোত্রের হিববান
ইবনু আরিকা নামক এক ব্যক্তি তাঁর উভয় বাহুর মধ্যবর্তী রগে তীর বিদ্ধ করেছিল। ফলে
নিকট থেকে সেবা করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) মসজিদে নববীতে (সা‘দের জন্য) একটি তাঁবু তৈরী করেছিলেন।[10] হাকিম নাইসাপুরী (রহঃ) বলেন, কুরাইশের বনু আমের
ইবনে লুআই গোত্রের হিববান ইবনু কায়স ইবনে আরিকা নামক জনৈক লোকের নিক্ষিপ্ত তীরে সা‘দ (রা.) আহত হন। এরপর বনু কুরায়যার ফায়ছালা প্রদান পর্যন্ত
প্রায় ১ মাস জীবিত ছিলেন।[11]
বিচার-ফায়ছালা : আহযাব যুদ্ধের সময় বনু কুরায়যার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে
নির্দেশ দেওয়া হয় বনু কুরায়যার দিকে অভিযান পরিচালনার জন্য। আয়েশা (রা.) বলেন, নবী করীম (সা.) খন্দক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে অস্ত্র রেখে গোসল
করছিলেন। এমন সময় তাঁর কাছে জিবরীল (আঃ) এসে বললেন, আপনি অস্ত্র রেখে দিয়েছেন? আল্লাহর কসম আমরা
তা খুলিনি। তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে চলুন। নবী করীম (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যেতে হবে? তিনি বনু কুরায়যার প্রতি ইশারা করে বললেন, ঐ দিকে। তখন নবী করীম (সা.) তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন।[12] আর ছাহাবীদের নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘বনু কুরায়যায় না পৌঁছে কেউ আছর ছালাত আদায় করবে না’।[13]
রাসূলুল্লাহ (সা.) বনু কুরায়যাকে ২৫ দিন যাবৎ
অবরুদ্ধ করে রাখেন। যখন তাদের রসদ ফুরিয়ে গেল এবং জীবন ধারণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল
তখন তারা আওসের বনু আশহাল গোত্রের নেতা ও তাদের মিত্র সা‘দ বিন মু‘আযের ফায়ছালা মেনে
নিতে সম্মত হ’ল। রাসূলুল্লাহ (সা.) সা‘দকে আনার জন্য লোক পাঠালেন।[14] বুখারী-মুসলিমে এভাবে বর্ণিত হয়েছে, যখন বনু কুরায়যার ইহুদীরা সা‘দ ইবনু মু‘আয (রা.)-এর ফয়ছালা মুতাবিক দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসে, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) সা‘দ (রা.)-কে ডেকে পাঠন। তিনি ঘটনাস্থলের কাছেই ছিলেন। তখন সা‘দ (রা.) একটি গাধার পিঠে আরোহণ করে আসলেন। তিনি রাসূলের
নিকটবর্তী হ’লে রাসূল (সা.) বললেন, ‘তোমরা তোমাদের নেতার দিকে দন্ডায়মানহও’।[15] তিনি এসে আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর নিকটে বসলেন। তখন তাঁকে বললেন, এগিয়ে যাও এরা তোমার ফায়ছালায় রাযী হয়েছে। সা‘দ (রা.) বললেন, আমি এই রায় ঘোষণা করছি যে, তাদের যোদ্ধাদের
হত্যা করা হবে, নারী ও সন্তানদের বন্দী করা হবে।[16] আর তাদের ধন-সম্পদ বণ্টন করা হবে।[17] সা‘দ (রা.)-এর ফায়ছালা মেনে নিয়ে বনু কুরায়যার লোকেরা দুর্গ
থেকে নেমে আসে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, حَكَمْتَ بِحُكْمِ اللهِ، أَوْ بِحُكْمِ الْمَلِكِ ‘তুমি আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে ফায়ছালা দিয়েছ। অথবা তিনি
বললেন,
‘তুমি রাজাধিরাজের নির্দেশ মুতাবেক ফায়ছালা
দিয়েছ’।[18]
সা‘দ (রা.)-এর দো‘আ : সা‘দ (রা.) আল্লাহর কাছে দো‘আ করেছিলেন, হে আল্লাহ! আপনি তো জানেন, আপনার সন্তুষ্টির জন্য তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার চেয়ে কোন
কিছুই আমার কাছে অধিক প্রিয় নয়। যে সম্প্রদায় আপনার রাসূল (সা.)-কে মিথ্যাচারী
বলেছে এবং দেশ থেকে বের করে দিয়েছে হে আল্লাহ! আমি মনে করি (খন্দক যুদ্ধের পর)
আপনি তো আমাদের ও তাদের মধ্যে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন। যদি এখনো কুরায়শদের
বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধ বাকী থেকে থাকে তাহ’লে আমকে
বাঁচিয়ে রাখুন, যাতে আমি আপনার রাস্তায় তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ
করতে পারি। আর যদি যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়ে থাকেন তাহ’লে ক্ষত হ’তে রক্ত প্রবাহিত করুন এবং তাতেই আমার মৃত্যু
দিন। এরপর তাঁর ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হয়ে তা প্রবাহিত হ’তে লাগল। মসজিদে বনু গিফার গোত্রের একটি তাঁবু ছিল। তাদের
দিকে রক্ত প্রবাহিত হ’তে দেখে তারা বললেন, হে তাঁবুবাসীগণ! আপনাদের দিক থেকে এসব কি আমাদের দিকে আসছে? পরে তাঁরা জানলেন যে, সা‘দ (রা.)-এর ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ জখমের কারণেই
তিনি মারা যান, আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট থাকুন।[19]
মৃত্যু ও দাফন : তিনি ৫ম হিজরীতে আহযাব যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের ২৫ দিন পরে এবং বনু কুরায়যার
ব্যাপারে ফায়ছালা প্রদান শেষে যুলকা‘দাহ মাসের
শেষের দিকে কিংবা যুলহিজ্জা মাসের প্রথম দিকে ৩৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[20] তাঁর জানাযা ছালাত রাসূলুল্লাহ (সা.) পড়ান এবং তাকে বাকীউল গারক্বাদে দাফন করা
হয়।[21]
আবু সাঈদ খুদরী (রা.) সা‘দ (রা.)-এর কবর খনন করেন। তিনি বলেন, যখন আমরা কবর খনন করছিলাম, তখন মিসক আম্বারের সুগন্ধি আসছিল।[22] আমরা তাঁর জন্য লাহদ কবর খনন করলাম।[23] যে চার জন ব্যক্তি সা‘দ (রা.)-এর কবরে নামেন, তারা হ’লেন হারেছ ইবনু আওস, উসাইদ ইবনুল হুযাইর, আবু নায়েলাহ সিলকান, সালমা ইবনু সালামাহ ইবনে ওকাশ। এ সময় রাসূল (সা.)
পার্শ্বে দাঁড়িয়ে ছিলেন।[24]
সন্তান-সন্ততি : সা‘দ (রা.)-এর দু’টি ছেলে ছিল, তারা হচ্ছেন আব্দুল্লাহ ও আমর। আর আমরের ৯টি সন্তান হয়েছিল।[25]
বৈশিষ্ট্য বা বিশেষত্ব : সা‘দ (রা.) অনন্য বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। তিনি
নিজেই বলেন,
فأنا رجل من الناس ما سمعت من رسول الله صلى الله عليه و سلم حديثا
قط إلا علمت أنه حق من الله ولا كنت في صلاة قط فشغلت نفسي بغيرها حتى أقضيها ولا
كنت في جنازة قط فحدثت نفسي بغير ما تقول ويقال لها حتى أنصرف عنها-
‘আমি এমন একজন লোক যে, রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে যে হাদীছই শুনি তাকে আল্লাহর পক্ষ
থেকে হক হিসাবে জানি। আমি যখনই ছালাতে রত হই, ছালাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার অন্তরকে ছালাত ব্যতীত অন্য দিকে ব্যস্ত করি
না। আমি যে কোন জানাযায় অংশগ্রহণ করি না কেন সেখানে মৃতব্যক্তির জন্য যা তুমি বল
এবং তার জন্য যা বলা হয় তা ব্যতীত আমার অন্তরে অন্য কোন চিন্তার উদয় হয় না, যতক্ষণ না আমি সেখান থেকে ফিরে আসি।[26]
সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যেব (রহঃ) বলেন, فهذه الخصال ما كنت أحسبها إلا
في نبي ‘আমি মনে করি এই বৈশিষ্ট্য কেবল নবীদের মাঝেই
থাকে’।[27] আয়েশা (রা.) বলেন, كان في بني عبد الأشهل ثلاثة لم يكن بعد النبي صلى الله عليه و سلم
أفضل منهم سعد بن معاذ وأسيد بن حضير وعباد بن بشر ‘বনু আব্দুল আশহাল গোত্রে তিনজন লোক ছিল। নবী করীম (সা.)-এর
পরে তাদের চেয়ে উত্তম কেউ নেই। তারা হ’লেন, সা‘দ বিন মু‘আয, উসাইদ ইবনু হুযাইর ও আববাদ ইবনু বিশর।[28]
অন্যত্র তিনি বলেন, ما كان أحد اشد فقدا على
المسلمين بعد النبي صلى الله عليه وسلم وصاحبيه أو أحدهما من سعد بن معاذ، ‘নবী করীম (সা.) ও তাঁর দুই সাথী বা তাদের একজনের পরে কোন
মানুষই এত বিচ্ছেদ ব্যথা অনুভব করেনি, যা করেছে সা‘দ ইবনু মু‘আয (রা.)-এর জন্য।[29]
মানাকিব বা মর্যাদা : সা‘দ (রা.) ছিলেন বিশেষ মর্যাদার অধিকারী একজন জলীলুল কদর
ছাহাবী। তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা.) পরোক্ষভাবে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। নিম্নে
এই খ্যাতিমান আনছার ছাহাবীর মর্যাদা ও ফযীলতের কতিপয় দিক উল্লেখ করা হ’ল।-
১. তাঁর জানাযায় সত্তর হাযার ফিরিশতা
অংশগ্রহণ করেছিলেন।
২. তাঁর মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ কেঁপেছিল এবং
আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, هَذَا الَّذِيْ تَحَرَّكَ لَهُ
الْعَرْشُ وَفُتِحَتْ لَهُ اَبْوَابُ السَّمَاءِ وَشَهِدَهُ سَبْعُوْنَ اَلْفًا
مِّنَ الْمَلاَئِكَةِ لَقَدْ ضَمَّ ضُمَّةً ثُمَّ فُرِجَ عَنْهُ. ‘সা‘দ এমন ব্যক্তি যার মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ
কেঁপেছিল, যার জন্য আকাশের দরজা খুলে দেয়া হয়েছিল এবং
যার জানাযাতে সত্তর হাযার ফেরেশতা উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু এমন ব্যক্তির কবরও
সংকীর্ণ করা হয়েছিল। অবশ্য পরে তা প্রশস্ত করা হয়েছিল’।[30]
৩. তাঁকে দাফন করার পরে তাঁর কবর আযাব মাফ
করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) দো‘আ করেছিলেন। যেমন
হাদীছে এসেছে,
عَن جَابر بن عبد الله قَالَ خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى
اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى سَعْدِ بْنِ مُعَاذٍ حِيْنَ تُوُفِّيَ قَالَ
فَلَمَّا صَلَّى عَلَيْهِ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
وَوُضِعَ فِيْ قَبْرِهِ وَسُوِّيَ عَلَيْهِ سَبَّحَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَسَبَّحْنَا طَوِيْلاً ثُمَّ كَبَّرَ فَكَبَّرْنَا فَقِيْلَ
يَا رَسُوْلَ اللهِ لِمَ سَبَّحَتْ ثُمَّ كَبَّرْتَ قَالَ: لَقَدْ تَضَايَقَ عَلَى
هَذَا العَبْدِ الصَّالِحِ قَبْرُهُ حَتَّى فَرَّجَهُ اللهُ عَنْهُ.
জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রা.) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, সা‘দ ইবনু মু‘আয যখন মৃত্যুবরণ
করেন,
আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে তার জানাযায়
হাযির হ’লাম। জানাযা পড়ার পর তাকে (সা‘দকে) যখন কবরে রাখা হ’ল ও মাটি
সমান করে দেওয়া হ’ল, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) সেখানে (দীর্ঘ সময়) আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করলেন, আমরাও দীর্ঘ সময় তাঁর সাথে তাসবীহ পাঠ করলাম। অতঃপর তিনি
তাকবীর বললেন। আমরাও (তাঁর সাথে) তাকবীর বললাম। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে
জিজ্ঞেস করা হল, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! কেন আপনি এরূপ
তাসবীহ ও তাকবীর বললেন? তিনি বললেন, এ নেক ব্যক্তির পক্ষে তার কবর অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। (অতএব আমি এরূপ
করলাম,)
এতে আল্লাহ তার কবরকে প্রশস্ত করে দিলেন’।[31] অর্থাৎ প্রথম যখন তিনি কবরে প্রবেশ করেন, তখন তাকে চাপ দেওয়া হয়। অতঃপর তার জন্য কবর প্রশস্ত করে দেওয়া হয়।
৪. তাঁর কবর প্রশস্ত করে দেওয়া হয়।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, لَوْ نَجَا أَحَدٌ مِنْ ضُمَّةِ الْقَبْرِ لَنَجَا سَعْدُ بْنُ
مُعَاذٍ وَلَقَدْ ضَمَّ ضُمَّةً ثُمَّ رُوْخَي عَنْهُ. ‘যদি কেউ কবরের নিষ্পেষণ হ’তে পরিত্রাণ পেত, তাহলে সা‘দ ইবনু মু‘আয অবশ্যই পরিত্রাণ পেত। তাকে এক বার চাপ দেওয়া হয়, অতঃপর তা তার জন্য প্রশস্ত করা হয়’।[32]
৫. হাফেয যাহাবী (রহঃ) বলেন, فسعد ممن نعلم أنه من أهل
الجنة، وأنه من أرفع الشهداء ‘অতএব আমাদের জানা মতে, সা‘দ জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত এবং তিনি
শীর্ষস্থানীয় শহীদদের অন্তর্ভুক্ত।[33] যেমন হাদীছে ইঙ্গিত এসেছে। বারা ইবনে আযেব (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে এক জোড়া রেশমী পোশাক উপহার দেওয়া হ’ল। তখন ছাহাবায়ে কেরাম তার কোমলতায় বিস্ময় বোধ করতে লাগলেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন,أَتَعْجَبُونَ مِنْ لِينِ هَذِهِ لَمَنَادِيلُ سَعْدِ بْنِ مُعَاذٍ
خَيْرٌ مِنْهَا أَوْ أَلْيَنُ ‘তোমরা এর কোমলতায় অবাক হচ্ছ? জান্নাতের মাঝে সা‘দ ইবনু মু‘আযের রুমালগুলো হবে এর তুলনায় অধিক উত্তম ও নরম’।[34]
অপর একটি হাদীছে এসেছে, আনাস ইবনু মালেক (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে চিকন রেশমের একটি জুববা উপহার দেয়া হ’ল। অথচ নবী করীম (সা.) রেশম পরিধান করতে নিষেধ করতেন। তখন
লোকেরা তাতে বিস্ময় বোধ করলো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ঐ সত্তার কসম! যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ রয়েছে।
নিঃসন্দেহে জান্নাতে সা‘দ ইবনু মু‘আযের রুমালগুলো এর তুলনায় অধিক উত্তম’।[35]
৫. ফিরিশতাগণ তার লাশ বহন করেন। আনাস (রা.)
বলেন,
যখন সা‘দ ইবনু মু‘আযের জানাযা (লাশ) বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তখন মোনাফিকরা বলে, কতই না হালকা এ মৃতদেহটি! তাদের এরূপ মন্তব্যের কারণ ছিল
বনু কুরায়যা সম্পর্কে তাঁর প্রদত্ত ফায়ছালা। নবী করীম (সা.)-এর কাছে এ সংবাদ
পৌঁছলে তিনি বললেন, إِنَّ الْمَلاَئِكَةَ كَانَتْ تَحْمِلُهُ ‘নিশ্চয়ই ফেরেশতাগণ তার জানাযা (লাশ) বহন করেছিলেন (তাই
হালকা অনুভূত হয়)।[36]
হাদীছ বর্ণনা : সা‘দ (রা.) থেকে দু’টি হাদীছ
বর্ণিত হয়েছে। একটি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা.)-এর সূত্রে এবং একটি আনাস (রা.)
তাঁর থেকে বর্ণনা করেন সা‘দ ইবনুর রবী-এর হত্যার ঘটনা সম্পর্কিত।[37]
উপসংহার : সা‘দ ইবনু মু‘আয (রা.) ছিলেন
ইসলামের একনিষ্ঠ খাদেম এবং রাসূল (সা.)-এর একান্ত অনুসারী। তাঁর জীবনের প্রতিটি
মুহূর্ত ব্যয় করেছেন ইসলাম রক্ষার স্বার্থে। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি
ইসলামের জন্য ছিলেন নিবেদিত ও উৎসর্গিত। মৃত্যুর স্বল্প সময় পূর্বে বনু কুরায়যার
ব্যাপারে ফায়ছালা দিয়ে তা তিনি প্রমাণ করে গেছেন। যার ফলে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে
জান্নাতী বলে ইঙ্গিত করেছেন। এ ছাহাবীর জীবনী থেকে তাই আমাদের জন্য বহু শিক্ষণীয়
বিষয় রয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদেরকে সেভাবে গড়ে
তোলার তাওফীক দিন-আমীন!
[1]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব, ৩য় খন্ড (বৈরুতঃ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৪ খ্রী.), ১৪১৫ হি.), পৃঃ ৪২০।
[2]. তদেব; আবু আব্দুল্লাহ আল-হাকিম নিসাপুরী, আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৪র্থ খন্ড (বৈরুতঃ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০ খ্রী./১৪১১ হি.), পৃঃ ২২৬।
[3]. হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১ম খন্ড (বৈরুত :
মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ৩য় সংস্করণ, ১৯৮৫/১৪০৫), পৃঃ ২৯০।
[4]. সিয়ার ১/২৮০।
[5]. সিয়ার ১/২৮৯, ২৯৬।
[6]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয, (কায়রো : দারুর রাইয়ান, ১ম প্রকাশ, ১৪০৮ হিঃ/১৯৮৮ খ্রী.), পৃঃ ১৩১।
[7]. বুখারী হা/৩৬৩২।
[8]. সিয়ার ১/২৯২।
[9]. তাহযীবুত তাহযীব, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৪২০।
[10]. বুখারী হা/৪১২২, ‘মাগাযী’ অধ্যায়; মুসলিম হা/১৭৬৯, ‘জিহাদ ও সফর’ অধ্যায়।
[11]. মুস্তাদরাকে হাকেম, ৪/২২৭; তাহযীব ৩/৪২০।
[12]. বুখারী হা/৪১১৭, ‘মাগাযী’ অধ্যায়।
[13]. বুখারী হা/৪১১৯, ঐ।
[14]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয, পৃঃ ১৩২, ১২৯।
[15]. বুখারী হা/৪১১৭; মুসলিম হা/১৭৬৯।
[16]. বুখারী হা/৩০৪৩।
[17]. বুখারী হা/৪১২১, ৪১২২।
[18]. বুখারী হা/৪১২১; মুসলিম হা/১৭৬৮, ১৭৬৯, ‘জিহাদ ও সফর’ অধ্যায়।
[19]. বুখারী হা/৪১২২; মুসলিম হা/১৭৬৯।
[20]. বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয, পৃঃ ১৩২; সিয়ার ১/২৯০।
[21]. তদেব।
[22]. তদেব, পৃঃ ২৯৫।
[23]. তদেব, পৃঃ ২৮৯।
[24]. তদেব, পৃঃ ২৯০।
[25]. তদেব, পৃঃ ২৯৭।
[26]. তাহযীবুত তাহযীব ৩/৪২০।
[27]. তদেব।
[28]. তদেব।
[29]. সিয়ার ১/২৯৬।
[30]. নাসাঈ, মিশকাত হা/১৩৬।
[31]. আহমাদ, মিশকাত হা/১৩৫; সনদ ছহীহ।
দ্র. ইরওয়াউল গালীল ৩/১৬৬ পৃঃ।
[32]. ছহীহুল জামে‘ হা/৫৩০৬, হাদীছ ছহীহ।
[33]. তদেব, পৃঃ ২৯০।
[34]. বুখারী হা/৩২৪৯, ৩৮০২; মুসলিম হা/১২৬।
[35]. বুখারী হা/২৬১৫, ৩২৪৮; মুসলিম হা/১২৭/২৪৬৯।
[36]. তিরমিযী হা/৩৮৪৯ ‘ফাযাইল’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৬২২৮, সনদ ছহীহ।
[37]. তদেব।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(১৭)
হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা.)
ভূমিকা :
হুযায়ফা (রা.) ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছাহাবী।
ফিক্বহ ও হাদীছ ছাড়াও ক্বিয়ামত পর্যন্ত যে সকল ফিৎনা নাযিল হবে সে সম্পর্কে তিনি
বিশেষজ্ঞ ছিলেন। মুনাফিকদের সম্পর্কেও তাঁর জানা ছিল। এ কারণে তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর
গোপন জ্ঞানের অধিকারী বা ‘ছাহিবুস সির্র’ বলা হ’ত। হুযায়ফা বলেন, অতীতে পৃথিবীতে যা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা
ঘটবে তা সবই রাসূল (সা.) আমাকে বলেছেন।[1] এই জলীলুল কদর ছাহাবীর জীবন চরিত নিম্নে আলোচিত হ’ল।-
নাম ও বংশ পরিচয় :
তাঁর আসল নাম হুযায়ফা, ডাক নাম আবু আব্দিল্লাহ।[2] লকব বা উপাধি হচ্ছে ‘ছাহিবুস সির্র’।[3] তার পিতার নাম হুসাইল মতান্তরে হিসল ইবনু জাবির। পিতার উপাধি হচ্ছে আল-ইয়ামান।
তাঁর পূর্ণ বংশ পরিচয় হচ্ছে- হুযায়ফা ইবনু হিসল বা হুসাইল ইবনে জাবের ইবনে আমর
ইবনে রবী‘আ ইবনে জারওয়াহ ইবনিল হারেছ ইবনে মাযেন ইবনে
ক্বাতী‘আহ ইবনে আবস ইবনে বাগীয ইবনে রীছ ইবনে গাতফান ইবনে সা‘দ ইবনে ক্বায়েস আইলান ইবনে মুযার ইবনে নাযর ইবনে মা‘আদ ইবনে আদনান আল-আবসী।[4] তিনি গাতফান গোত্রের আবস শাখার সন্তান। এজন্য তাঁকে আল-আবসীও বলা হয়। তাঁর
মাতার নাম রিবাব বিনতু কা‘ব ইবনে আদী ইবনে আব্দিল আশহাল। তিনি মদীনার
আনছার গোত্র আউসের আব্দুল আশহাল শাখার কন্যা।[5] ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, হুযায়ফা একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছাহাবী।[6]
হুযায়ফার পিতা হুসাইল ছিলেন মূলতঃ মক্কার বনী
আবস গোত্রের লোক। ইসলামপূর্ব যুগে তিনি নিজ গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে মক্কা
থেকে পালিয়ে ইয়াছরিবে আশ্রয় নেন। সেখানে বনী আব্দুল আশহাল গোত্রের সাথে প্রথমে
মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন এবং পরে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে বসবাস করতে থাকেন।
মদীনার আনছার গোত্রসমূহের আদি সম্পর্ক মূলতঃ ইয়ামানের সাথে। হুসাইল তাদের মেয়ে
বিয়ে করায় তাঁর গোত্রের লোকেরা তাঁর পরিচয় দিত ‘আল-ইয়ামান’ বলে। এজন্য হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান বলা হয়।[7] এ ইয়ামান আব্দুল আশহাল গোত্রে বিয়ে করেন। সেখানে তাঁর
নিম্নোল্লেখিত সন্তানগণ জন্মগ্রহণ করেন- ১. হুযায়ফা, ২. সা‘দ, ৩. ছাফওয়ান, ৪. মুদলিজ ও ৫. লায়লা। তারা ইতিহাসে ইয়ামানের
বংশধর নামে খ্যাত।
আল-ইয়ামানের মক্কায় প্রবেশে যে বাধা ও ভয় ছিল
ধীরে ধীরে তা দূর হয়ে যায়। তিনি মাঝে-মধ্যে মক্কা ও ইয়াছরিবের মধ্যে যাতায়াত
করতেন। তবে তিনি বেশী থাকতেন ইয়াছরিবে। এদিকে রাসূল (সা.) মক্কায় ইসলামের দাওয়াত
দিতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে হুযায়ফার পিতা আল-ইয়ামান বনী আবসের এগারো ব্যক্তিকে
সংগে করে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল (সা.)
তখনও মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেননি। সুতরাং হুযায়ফা মূলের দিক থেকে মক্কার। তবে
মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই বড় হন।[8]
ইসলাম গ্রহণ :
হুযায়ফা (রা.)-এর পিতা আল-ইয়ামান মক্কায়
ইসলামের প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বনু আবস গোত্রের দশম ব্যক্তি।[9] হুযায়ফা (রা.)-এর মাও প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে
হুযায়ফা মুসলিম পিতা-মাতার কোলে বেড়ে ওঠেন এবং প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।
ইসলাম গ্রহণের পর একদা তিনি রাসূলুললাহ (সা.)-এর দরবারে হাযির হন। তাকে রাসূল (সা.)
হিজরত ও নুছরাতের যে কোন একটি বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দান করেন। হুযায়ফা (রা.)
নুছরাতকে বেছে নেন।[10]
ভ্রাতৃ সম্পর্ক :
রাসূল (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় আসার পর
মুওয়াখাত বা দ্বীনী ভ্রাতৃ-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার রীতি চালু করেন। রাসূল (সা.)
হুযায়ফা ও আম্মার বিন ইয়াসার (রা.)-এর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে দেন।[11]
রাসূল (সা.)-এর সাহচর্য :
হুযায়ফা (রা.) ছিলেন ঐসকল ছাহাবীগণের
অন্তর্ভুক্ত যারা রাসূল (সা.)-এর সাহচর্যকে আবশ্যিক করে নিয়েছিলেন। তিনি রাসূলের
সান্নিধ্যে থেকে দ্বীনের বহু গুরুত্বপূর্ণ ইলম হাছিল করেন। হুযায়ফা (রা.)-এর মা
তাকে রাসূল (সা.)-এর সান্নিধ্যে থাকতে উৎসাহিত করতেন। এমর্মে তিনি বলেন, আমার মা আমাকে প্রশ্ন করেন, নবী করীম (সা.)-এর নিকট তুমি কখন যাবে? আমি বললাম, আমি এতদিন যাবত তাঁর নিকট উপস্থিত হওয়া
পরিত্যাগ করেছি। এতে তিনি আমার উপর রাগান্বিত হন। আমি তাকে বললাম, নবী করীম (সা.)-এর সঙ্গে আমাকে মাগরিবের ছালাত আদায় করতে
ছেড়ে দিন। তাহ’লে আমি তার কাছে আমার ও আপনার জন্য ক্ষমা
প্রার্থনার আবেদন করব। অতএব নবী করীম (সা.)-এর নিকট আমি হাযির হয়ে তাঁর সাথে
মাগরিবের ছালাত আদায় করলাম। তারপর তিনি নফল ছালাত আদায় করতে থাকলেন। অবশেষে তিনি
এশার ছালাত আদায় করলেন। তারপর তিনি বাড়ির দিকে যাত্রা করলেন এবং আমি তাঁর পিছু
পিছু গেলাম। তিনি আমার আওয়াজ শুনতে পেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে, হুযায়ফা? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তোমার কি দরকার, আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে ও তোমার মাকে ক্ষমা করুন’।[12]
যুদ্ধে অংশগ্রহণ :
ক. বদর যুদ্ধ : হুযায়ফা (রা.) বদর যুদ্ধে যোগদান করেননি। এ যুদ্ধে হুযায়ফা ও তাঁর পিতার
যোগদান না করার কারণ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, আমার বদরে যোগদানে কোন বাধা ছিল না। তবে আমার আববার সাথে আমি তখন মদীনার বাইরে
ছিলাম। আমাদের মদীনায় ফেরার পথে কুরাইশ কাফিররা পথরোধ করে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কোথায় যাচ্ছ? বললাম, মদীনায়। তারা বলল, তাহ’লে নিশ্চয়ই তোমরা মুহাম্মাদের কাছেই যাচ্ছে? আমরা বললাম, আমরা শুধু মদীনায় যাচ্ছি। তাছাড়া আমাদের আর কোন উদ্দেশ্য নেই। অবশেষে তারা
আমাদের পথ ছেড়ে দিল এই অঙ্গীকারের ভিত্তিতে যে, আমরা মদীনায় গিয়ে কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুহাম্মাদ (সা.)-কে কোনভাবে
সাহায্য করব না। তাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা মদীনায় পৌঁছলাম এবং রাসূলুল্লাহ
(সা.)-কে কুরাইশদের নিকট কৃত অঙ্গীকারের কথা বলে জিজ্ঞেস করলাম, এখন আমরা কি করব? তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার পূরণ কর। আর আমরা
তাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের জন্য আল্লাহর সাহায্য চাইব।[13]
খ. ওহোদ যুদ্ধ : হুযায়ফা (রা.) ওহোদ যুদ্ধে তাঁর পিতার সাথে যোগদান করেন। এ যুদ্ধে তাঁর বৃদ্ধ
পিতা মুসলিম সৈনিকদের হাতে শাহাদত বরণ করেন। ঘটনাটি নিম্নরূপ-
ওহোদ যুদ্ধের সময় তাঁর পিতা আল-ইয়ামান ও
ছাবিত ইবনু ওয়াক্শ বার্ধক্যে উপনীত হয়েছিলেন। যুদ্ধের আগে নারী ও শিশুদের একটি
নিরাপদ দুর্গে রাখা হয়। আর এই দুই বৃদ্ধকে রাখা হয় ঐ দুর্গের তত্ত্বাবধানে। যুদ্ধ
যখন তীব্র আকার ধারণ করে তখন আল-ইয়ামান সঙ্গী ছাবিতকে বললেন, তোমার বাপ নিপাত যাক! আমরা কিসের অপেক্ষায় বসে আছি? পিপাসিত গাধার স্বল্পায়ুর মত আমাদের সবার আয়ুও শেষ হয়ে
এসেছে। আমরা খুব বেশী হ’লে আজ অথবা কাল পর্যন্ত বেঁচে আছি। আমাদের কি
উচিত নয়, তরবারি হাতে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকটে
চলে যাওয়া? হ’তে পারে, আল্লাহ তাঁর নবী (সা.)-এর সাথে আমাদের শাহাদত
দান করবেন।
তাঁরা দু’জন তরবারি
হাতে নিয়ে দুর্গ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন।
এদিকে যুদ্ধের এক পর্যায়ে পৌত্তলিক বাহিনী
পরাজয় বরণ করে পালাচ্ছিল। তখন শয়তান চেচিয়ে বলে ওঠে, মুসলমানরা এসে পড়েছে। একথা শুনে পৌত্তলিক বাহিনীর একটি দল ফিরে দাঁড়ায় এবং
মুসলমানদের একটি দলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আল-ইয়ামান ও ছাবিত দু’দলের তুমুল সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান। পৌত্তলিক বাহিনীর হাতে
ছাবিত শাহাদত বরণ করেন। কিন্তু হুযায়ফার পিতা আল-ইয়ামান শহীদ হন মুসলমানদের হাতে।
মুসলমানরা তাকে চিনতে না পারায় এবং যুদ্ধের ঘোরে এমনটি ঘটে যায়। হুযায়ফা কিছু দূর
থেকে পিতার মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে চিৎকার করে ওঠেন, ‘আমার আববা, আমার আববা’ বলে। কিন্তু সে চিৎকার কারো কানে পৌঁছেনি। যুদ্ধের শোরগোলে তা অদৃশ্যে মিলিয়ে
যায়। ইতিমধ্যে নিজ সঙ্গীদের তরবারির আঘাতে ঢলে পড়েন তিনি। হুযায়ফা (রা.) পিতার
মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে শুধু একটি কথা উচ্চারণ করেন, ‘আল্লাহ আমাদের সকলকে ক্ষমা করুন। তিনিই সর্বাধিক দয়ালু’।[14]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা (রা.) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওহোদ যুদ্ধে
মুশরিকগণ যখন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পড়ল, তখন ইবলীস চীৎকার করে (মুসলমানগণকে) বলল, হে আল্লাহর বান্দাগণ! পিছনের দিকে লক্ষ্য কর। তখন অগ্রগামী দল পিছন দিকে ফিরে (শত্রুদল মনে
করে) নিজদলের উপর আক্রমণ করে বসল এবং একে অন্যকে হত্যা করতে লাগল। এমন সময় হুযায়ফা
(রা.) পিছনের দলে তাঁর পিতাকে দেখতে পেয়ে চীৎকার করে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহর বান্দাগণ! আমার পিতা, আমার পিতা। আয়েশা (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! কিন্তু তারা কেউই বিরত হয়নি। অবশেষে তাঁকে হত্যা করে ফেলল।
হুযায়ফা (রা.) বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিন। (রাবী হিশাম
বলেন,)
আমার পিতা উরওয়াহ (রহঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! এ কথার কারণে হুযায়ফা (রা.)-এর মধ্যে তাঁর
জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কল্যাণের চিহ্ন বিদ্যমান ছিল’।[15]
রাসূল (সা.) হুযায়ফাকে তাঁর পিতার ‘দিয়াত’ বা রক্তমূল্য দিতে
চাইলে তিনি বললেন, আমার আববা তো শাহাদতেরই প্রত্যাশী ছিলেন, আর তিনি তা লাভ করেছেন। হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক, আমি তাঁর দিয়াত বা রক্তমূল্য মুসলমানদের জন্য দান করে
দিলাম। এতে রাসূল (সা.) দারুণ খুশী হ’লেন।[16]
গ. আহযাব বা খন্দক যুদ্ধ : হুযায়ফা (রা.) খন্দক যুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কুরাইশরা এমন
তোড়জোড় করে ধেয়ে আসে যে, মদীনায় ভীতি ও ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। মদীনার
চতুর্দিকে বহুদূর পর্যন্ত কুরাইশরা ছড়িয়ে পড়ে। রাসূল (সা.) আল্লাহর কাছে দো‘আ করেন এবং মদীনার প্রতিরক্ষার জন্য খন্দক খনন করেন। এক
রাতে এক অভিনব ঘটনা ঘটে গেল। আর তা মুসলমানদের জন্য এক অদৃশ্য সাহায্য ছাড়া আর
কিছুই ছিল না। কুরাইশরা মদীনার আশ-পাশের বাগানগুলিতে শিবির স্থাপন করে আছে। হঠাৎ
এমন প্রচন্ড বাতাস বইতে শুরু করল যে, রশি ছিড়ে তাঁবু ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। হাঁড়ি-পাতিল উল্টে-পাল্টে গেল এবং হাড়
কাঁপানো শীত আরম্ভ হ’ল। আবু সুফিয়ান বলল, আর উপায় নেই, এখনই স্থান ত্যাগ করতে হবে।[17]
রাসূল (সা.) কুরাইশ বাহিনী নিয়ে দারুণ
দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তিনি কোন রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে রাতের অন্ধকারে কাউকে
কুরাইশ বাহিনীর অভ্যন্তরে পাঠিয়ে তাদের খবর সংগ্রহের ইচ্ছা করলেন। আর এ দুঃসাহসী
অভিযানের জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত হুযায়ফাকে নির্বাচন করেন। একটি বর্ণনা মতে, রাসূল (সা.) সঙ্গীদের বললেন, ‘যদি কেউ মুশরিকদের খবর নিয়ে আসতে পারে, তাকে আমি ক্বিয়ামতের দিন আমার সাহচর্যের খোশখবর দিচ্ছি’। একে তো দারুণ শীত, তার উপর প্রবল বাতাস। কেউ সাহস পেল না। রাসূল (সা.) তিনবার
কথাটি উচ্চারণ করলেন। কিন্তু কোন দিক থেকে কোন রকম সাড়া পেলেন না। চতুর্থবার তিনি
হুযায়ফা (রা.)-এর নাম ধরে ডেকে বললেন, ‘তুমি যাও, খবর নিয়ে এসো।’ যেহেতু নাম ধরে ডেকেছেন। সুতরাং আদেশ পালন ছাড়া উপায় ছিল না।
অন্য একটি বর্ণনা মতে হুযায়ফা (রা.) বলেন, ‘আমরা সে রাতে কাতারবন্দী হয়ে বসেছিলাম। আবু সুফিয়ান ও
মক্কার মুশরিক বাহিনী ছিল আমাদের উপরের দিকে। আর নীচে ছিল বনী কুরাইযার ইহুদী
গোত্র। আমাদের নারী ও শিশুদের নিয়ে আমরা ছিলাম শঙ্কিত। আর সেই সাথে ছিল প্রবল
ঝড়-ঝঞ্ঝা ও ঘোর অন্ধকার। এমন দুযোর্গপূর্ণ রাত আমাদের জীবনে আর কখনো আসেনি।
বাতাসের শব্দ ছিল বাজ পড়ার শব্দের মত। আর এমন ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার ছিল যে, আমরা আমাদের নিজের আঙ্গুল পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম না।
এদিকে মুনাফিক শ্রেণীর লোকেরা একজন একজন করে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকটে এসে বলতে
লাগল,
আমাদের ঘর-দরজা শত্রুর সামনে একেবারেই খোলা।
তাই একটু ঘরে ফেরার অনুমতি চাই। মূলতঃ অবস্থা সে রকম ছিল না। কেউ যাওয়ার জন্য
অনুমতি চাইলেই তিনি অনুমতি দিচ্ছিলেন। এভাবে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত আমরা তিন শত বা
তার কাছাকাছি সংখ্যক লোক থাকলাম।
এমন সময় রাসূল (সা.) উঠে এক এক করে আমাদের
সবার কাছে আসতে লাগলেন। এক সময় আমার কাছেও আসলেন। শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমার
গায়ে একটি চাদর ছাড়া আর কিছু ছিল না। চাদরটি ছিল আমার স্ত্রীর। আর তা খুব টেনেটুনে
হাঁটু পর্যন্ত পড়ছিল। তিনি আমার একেবারে কাছে আসলেন। আমি মাটিতে বসেছিলাম। জিজ্ঞেস
করলেন,
তুমি কে? বললাম, হুযায়ফা। হুযায়ফা? এই বলে মাটির দিকে একটু ঝুঁকলেন, যাতে আমি তীব্র ক্ষুধা ও শীতের মধ্যে উঠে না দাঁড়াই। আমি
বললাম,
হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, কুরাইশদের মধ্যে
একটি খবর হচ্ছে। তুমি তাদের শিবিরে গিয়ে আমাকে তাদের খবর এনে দিবে।
আমি বের হ’লাম। অথচ আমি ছিলাম সবার চেয়ে ভীতু ও শীতকাতর। রাসূল (সা.) দো‘আ করলেন, ‘হে আল্লাহ!
সামনে-পিছনে, ডানে-বামে, উপরে-নীচে, সব দিক থেকে তুমি তাকে হিফাযত কর।’ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দো‘আ শেষ হ’তে না হ’তে আমার সব
ভীতি দূর হ’ল এবং শীতের জড়তাও কেটে গেল। আমি যখন পিছন
ফিরে চলতে শুরু করলাম। তখন তিনি আমাকে আবার ডেকে বললেন, হুযায়ফা! আমার কাছে ফিরে না আসা পর্যন্ত আক্রমণ করবে না।
বললাম,
ঠিক আছে। আমি রাতের ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে চলতে
লাগলাম। এক সময় চুপিসারে কুরাইশদের শিবিরে প্রবেশ করে তাদের সাথে এমনভাবে মিশে
গেলাম যেন আমি তাদেরই একজন। আমার পৌঁছার কিছুক্ষণ পর আবু সুফিয়ান কুরাইশ বাহিনীর
সামনে ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন। বললেন, ওহে কুরাইশ
সম্প্রদায়! আমি তোমাদেরকে একটি কথা বলতে চাই। তবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে তা
মুহাম্মাদের কাছে পৌঁছে যায় কি-না। তোমরা প্রত্যেকেই নিজের পাশের লোকটির প্রতি
লক্ষ্য রাখ। একথা শোনার সাথে সাথে আমার পাশের লোকটির হাত মুঠ করে ধরে জিজ্ঞেস
করলাম,
কে তুমি? সে জবাব দিল অমুকের ছেলে অমুক।
আবু সুফিয়ান বললেন, ‘ওহে কুরাইশ সম্প্রদায়! আল্লাহর কসম! তোমরা কোন নিরাপদ গৃহে
নও। আমাদের ঘোড়াগুলি মরে গেছে, উটগুলি কমে গেছে
এবং মদীনার ইহুদী গোত্র বনু কুরাইযাও আমাদের ছেড়ে গেছে। তাদের যে খবর আমাদের কাছে
এসেছে তা সুখকর নয়। আর কেমন প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যে পড়েছি, তাও তোমরা দেখছ। আমাদের হাঁড়িও আর নিরাপদ নয়। আগুনও জ্বলছে
না। সুতরাং ফিরে চল। আমি চলছি’। একথা বলে তিনি উটের রশি খুললেন এবং পিঠে চড়ে তার গায়ে আঘাত
করলেন। উট চলতে শুরু করল। কোন কিছু ঘটাতে রাসূল (সা.) যদি নিষেধ না করতেন, তাহ’লে একটি মাত্র তীর ছুড়ে তাকে হত্যা করতে
পারতাম।
আমি ফিরে আসলাম। এসে দেখলাম, রাসূল (সা.) তাঁর এক স্ত্রীর চাদর গায়ে জড়িয়ে ছালাতে
দাঁড়িয়ে আছেন। ছালাত শেষ করে তিনি আমাকে তাঁর দু’পায়ের কাছে টেনে নিয়ে চাদরের এক কোনা আমার গায়ে জড়িয়ে দিলেন। আমি সব খবর তাঁকে
জানালাম। তিনি দারুণ খুশী হ’লেন এবং আল্লাহর
হামদ ও ছানা পেশ করলেন। হুযায়ফা সেদিন বাকী রাতটুকু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সেই চাদর
গায়ে জড়িয়ে সেখানেই কাটিয়ে দেন। প্রত্যুষে রাসূল (সা.) তাঁকে ডাকলেন, ইয়া নাওমান- ওহে ঘুমন্ত ব্যক্তি ওঠো।[18]
অপর বর্ণনায় এসেছে, যুহায়র ইবনু হারব ও ইসহাক ইবনু ইবরাহীম, ইবরাহীম তায়মীর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন যে, আমরা হুযায়ফা (রা.)-এর কাছে ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি বলে উঠল, হায়, আমি যদি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে পেতাম, তবে তাঁর সঙ্গে মিলে একত্রে যুদ্ধ করতাম এবং তাতে যথাসাধ্য
করতাম (কোনরূপ পিছপা হ’তাম না)। হুযায়ফা (রা.) বললেন, তুমি তাই করতে? কিন্তু আমি তো আহযাবের রাতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। (সে রাতে)
প্রচন্ড বায়ু ও তীব্র শীত আমাদের কাবু করে ফেলেছিল। এমনি সময় রাসূলুল্লাহ (সা.)
ঘোষণা করলেন, ওহে! এমন কেউ আছে কি, যে আমাকে শত্রুর খবর এনে দিবে? আল্লাহ তা‘আলা তাকে
ক্বিয়ামতের দিন আমার সঙ্গে রাখবেন।
আমরা তখন চুপ করে রইলাম এবং আমাদের মধ্যে কেউ
তার সে আহবানে সাড়া দেয়নি। তিনি আবার বললেন, ওহে! এমন কোন ব্যক্তি আছে কি যে আমাকে শত্রুপক্ষের খবর এনে দিবে? আল্লাহ তা‘আলা তাকে
ক্বিয়ামতের দিন আমার সঙ্গে রাখবেন। এবারও আমরা চুপ রইলাম আর আমাদের মধ্যে কেউ তাঁর
আহবানে সাড়া দিল না। তিনি আবার ঘোষণা করলেন, ওহে! এমন কেউ আছে কি যে আমাকে শত্রুপক্ষের খবর এনে দিবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে
ক্বিয়ামতের দিন তাকে আমার সঙ্গে রাখবেন। এবারও আমরা চুপ করে রইলাম এবং আমাদের কেউ
তাঁর আহবানে সাড়া দিল না। এবার তিনি
বললেন,
হে হুযায়ফা! ওঠো, তুমি শত্রুপক্ষের খবর আমাদের এনে দাও। রাসূলুল্লাহ (সা.)
এবার যখন আমার নাম ধরেই ডাক দিলেন, তখন উঠা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। তিনি বললেন, শত্রুপক্ষের খবর আমাকে এনে দাও। কিন্তু সাবধান! তাদেরকে
আমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত কর না।
তারপর আমি যখন তাঁর নিকট থেকে প্রস্থান করলাম, তখন মনে হচ্ছিল আমি যেন হাম্মামের (উষ্ণ আবহাওয়ার) মধ্য
দিয়ে চলেছি। এভাবে আমি তাদের (শত্রুপক্ষের) নিকটে পেঁŠছে গেলাম।
তখন আমি লক্ষ্য করলাম আবূ সুফিয়ান আগুন দ্বারা তাঁর পিঠে ছেক দিচ্ছেন। আমি তখন
একটি তীর ধনুকে সংযোগ করলাম এবং তা নিক্ষেপ করতে মনস্থ করলাম। তৎক্ষণাৎ আমার মনে
পড়ে গেল যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলে দিয়েছেন, তাদেরকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুল না। আমি যদি তখন তীর
নিক্ষেপ করতাম, তবে তীর নির্ঘাত লক্ষ্যভেদ করত।
অগত্যা আমি ফিরে আসলাম এবং ফিরে আসার সময়ও
উষ্ণ হাম্মামের মধ্য দিয়ে অতিক্রমের মতো উষ্ণতা অনুভব করলাম। তারপর ফিরে এসে
প্রতিপক্ষের খবর রাসূল (সা.)-কে প্রদান করলাম। আমার দায়িত্ব পালন করে অবসর হ’তেই আবার আমি শীতের তীব্রতা অনুভব করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.)
তাঁর খোলা অতিরিক্ত জুববার অংশ দিয়ে আমাকে আবৃত করে দিলেন। যা তিনি ছালাত আদায়ের
সময় গায়ে দিতেন। তারপর আমি ভোর পর্যন্ত একটানা নিদ্রায় আচ্ছন্ন রইলাম। যখন ভোর হ’ল তখন তিনি বললেন,
হে ঘুমকাতুরে! এখন উঠে পড়’।[19]
ঘ. তাবূক যুদ্ধ : হুযায়ফা (রা.) তাবূক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করেন।[20] তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর
জীবদ্দশায় এবং তাঁর পরে সংঘটিত সকল অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।
আকার-আকৃতি :
দৈহিক আকৃতিক দিক দিয়ে হুযায়ফা (রা.)-কে
হিজাযী বলে চেনা যেত। মধ্যমাকৃতির একহারা গড়ন এবং সামনের দাঁতগুলি ছিল অতি সুন্দর।
দৃষ্টিশক্তি এতই প্রখর ছিল যে, ভোরের আবছা
অন্ধকারেও তীরের নিশানা (লক্ষ্যস্থল) নির্ভুলভাবে দেখতে পেতেন (হুযায়ফাহ ইবনুল ইয়ামান, পৃঃ ২৭)।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য :
হুযায়ফা (রা.) উত্তম চরিত্রের মূর্তপ্রতিক
ছিলেন। রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত হওয়ায় তার মধ্যেও রাসূল (সা.)-এর
অনুপম গুণাবলীর প্রতিফলন ঘটেছিল। আদব-কায়দা ও আচার-ব্যবহারে তিনি অনন্য ছিলেন।[21]
সুন্নাতের পাবন্দ :
সুন্নাতের অনুসরণের ব্যাপারে তিনি অতি সজাগ ও
সচেতন ছিলেন। কেউ সুন্নাতের পরিপন্থী কাজ করলে তিনি ভীষণভাবে রেগে যেতেন। একটি
হাদীছে এসেছে, ইবনু আবূ লায়লাহ (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযাইফা (রা.)
মাদায়েনে ছিলেন। তিনি পানি চাইলেন। তখন এক মহাজন একটি রূপার পাত্রে তার জন্য পানি
আনলে তিনি পানি ফেলে দিয়ে বললেন, আমি এটা ফেলতাম না।
ফেলেছি এজন্য যে, তাকে এ পাত্রে পানি পরিবেশন করতে নিষেধ
করেছি। তবুও সে বিরত হয়নি। রাসূলুল্লাহ (সা.) রেশমী কাপড় পরতে এবং সোনা-রূপার
পাত্রে পান করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ঐগুলো দুনিয়াতে কাফেরদের জন্য এবং আখিরাতে তোমাদের জন্য।[22]
ইবাদত-বন্দেগী :
তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর
সন্তুষ্টির জন্যই সাধ্যমত ইবাদত করার চেষ্টা করতেন এবং এ ব্যাপারে রাসূল (সা.)-এর
মত করার চেষ্টা করতেন।
ক. ছালাত : ছালাত আদায়ের ক্ষেত্রে তিনি রাসূল (সা.)-এর মত আদায় করতেন। মাঝে-মধ্যে তিনি
নবী করীম (সা.)-এর সাথে দীর্ঘ ক্বিরাআত ও দীর্ঘ রুকূ-সিজদা সহকারে রাতের ছালাত
আদায় করতেন।[23]
খ. ছিয়াম : তিনি নফল ছিয়ামে অভ্যস্ত ছিলেন। ছালাতের ন্যায় ছিয়াম পালনের ক্ষেত্রেও
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণ করতেন।[24]
গ. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের
নিষেধ : সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের ব্যাপারে তিনি ছিলেন
অত্যন্ত সচেষ্ট। কেননা সৎকাজের আদেশ দানের ফযীলত এবং অসৎকাজের নিষেধের ব্যাপারে
অনেক হাদীছ রাসূল (সা.) থেকে তিনি বর্ণনা করেছেন।[25]
ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা :
হুযায়ফা (রা.) যে অসীম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার
অধিকারী ছিলেন, তা ওহোদ যুদ্ধে মুসলিম মুজাহিদদের হাতে তাঁর
পিতার শাহাদত বরণ করা এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকটে তাঁর ক্ষমা প্রার্থনা করা থেকে
স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এছাড়া রাসূল (সা.) দিয়াত বা রক্তমূল্য দিতে চাইলে হুযায়ফা (রা.)
তা মুসলমানদের জন্য দান করে দেন।[26] এতে তাঁর সীমাহীন ধৈর্য ও
সহিষ্ণুতার পরিচয় মেলে।
বুদ্ধিমত্তা :
তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী
ছিলেন। খন্দকের যুদ্ধের সময় কুরাইশ বাহিনীর সংবাদ জানতে গিয়ে আবু সুফিয়ান যখন
বললেন,
তোমরা প্রত্যেকেই নিজের পাশের লোকটির প্রতি
লক্ষ্য রাখ- একথা শোনার সাথে সাথে হুযায়ফা (রা.) পাশের লোকটির হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস
করলেন,
কে তুমি?[27] নিজেকে আড়াল করার জন্য তাঁর এই উপস্থিহত বুদ্ধির মধ্য দিয়ে তাঁর বুদ্ধিমত্তার
পরিচয় মেলে।
স্পষ্টবাদিতা :
হুযায়ফা (রা.) অত্যন্ত স্পষ্টবাদী ছিলেন। হক
কথা বলতে তিনি কখনো দ্বিধা-সংকোচ করতেন না। তার মত স্পষ্টবাদী লোক সে যুগে ছিল
বিরল। তাঁর স্পষ্টবাদিতার অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন ওমর (রা.) ফিৎনা সম্পর্কে জানতে
চাইলে তিনি বলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! সে ব্যাপারে আপনার ভয়ের
কোন কারণ নেই। কেননা আপনার ও সে ফিৎনার মাঝখানে একটি বন্ধ দরজা রয়েছে। ওমর (রা.)
জিজ্ঞেস করলেন, সে দরজাটি ভেঙ্গে ফেলা হবে, না খুলে দেয়া হবে? হুযায়ফা (রা.) বললেন, ভেঙ্গে ফেলা হবে। ওমর (রা.) বললেন, তাহ’লে তো আর কোন দিন তা বন্ধ করা যাবে না। ঐ
দরজা দ্বারা তিনি ওমর (রা.)-কে বুঝিয়েছিলেন।[28]
অনুরূপভাবে তিনি তার নিজ গোত্র আবস সম্পর্কেও
দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন। রিবঈ বিন হিরাশ বলেন, যে রাতে লোকেরা ওছমান বিন আফফান (রা.)-এর নিকটে গেল, সে রাতে আমি মাদায়েনে হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামানের কাছে গেলাম।
তিনি আমাকে বললেন, তোমার সম্প্রদায়ের ব্যাপার কী? আমি বললাম, আপনি তাদের কোন্
ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন? তিনি বললেন, তাদের মধ্যে কে কে ঐ ব্যক্তির (ওছমানের) নিকট (বিদ্রোহীরূপে) গেছে? আমি যারা গেছে তাদের মধ্যে কিছু লোকের নাম করলাম। তিনি
বললেন,
আমি আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে
বিচ্ছিন্ন হবে এবং আমীরকে অপমান করবে, আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময় তাঁর নিকট সে
ব্যক্তির কোন মুখ থাকবে না’।[29]
দুনিয়া বিমুখতা :
তিনি পার্থিব ভোগ-বিলাসের প্রতি ছিলেন দারুণ
উদাসীন। এ ব্যাপারে তাঁর অবস্থা এমন ছিল যে, মাদায়েনের ওয়ালী থাকাকালেও তাঁর জীবন যাপনে কোনরূপ পরিবর্তন হয়নি। অনারব
পরিবেশ এবং সেই সাথে ইমারতের পদে অধিষ্ঠিত থাকা- এত কিছু সত্ত্বেও তাঁর কোন
সাজ-সরঞ্জাম ছিল না। বাহনের জন্য সব সময় একটি গাধা ব্যবহার করতেন। এমন কি জীবন
ধারণের জন্য ন্যূনতম খাবার ছাড়া কাছে আর কিছুই রাখতেন না। তবে তিনি দুনিয়া ও
আখিরাত সমানভাবে গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বলতেন, তোমাদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম নয় যারা আখিরাতের জন্য
দুনিয়া ত্যাগ করেছে, আবার তারাও নয় যারা দুনিয়ার জন্য আখিরাত ছেড়ে
দিয়েছে। বরং যারা এখান থেকে কিছু এবং ওখান থেকে কিছু গ্রহণ করে তারাই মূলতঃ সবচেয়ে
উত্তম।[30]
খলীফা ওমর (রা.) তাকে মাদায়েনের গভর্ণর নিয়োগ
করেন। নতুন গভর্ণর আসছেন- এ খবর মাদায়েনবাসীদের কাছে পৌঁছে গেল। নতুন আমীরকে
স্বাগত জানানোর জন্য তারা দলে দলে শহরের বাইরে সমবেত হ’ল। তারা দেখতে পেল কিছু দূরে গাধার ওপর সওয়ার হয়ে দীপ্ত
চেহারার এক ব্যক্তি তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। গাধার পিঠে অতি পুরনো একটি জিন। তার
ওপর বসে বাহনের পিঠের দু’পাশে পা ছেড়ে দিয়ে এক হাতে রুটি ও অন্য হাতে
লবণ ধরে মুখে ঢুকিয়ে চিবাচ্ছেন। আরোহী ধীরে ধীরে জনতার মাঝখানে এসে পড়লেন।
তিনি আবাসস্থলে পৌঁছে উপস্থিত জনতাকে তাদের
প্রতি লেখা খলীফার ফরমান পাঠ করে শোনালেন। খলীফা ওমর (রা.)-এর নিয়ম ছিল, নতুন ওয়ালী বা শাসক নিয়োগের সময় সেই এলাকার অধিবাসীদের প্রতি
বিভিন্ন নির্দেশ ও ওয়ালীর দায়িত্ব ও কর্তব্য স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া। কিন্তু হুযায়ফা
(রা.)-এর নিয়োগপত্রে মাদায়েনবাসীর প্রতি শুধু একটি নির্দেশ ছিল, ‘তোমরা তাঁর কথা শুনবে ও আনুগত্য করবে।’ তিনি যখন তাদের সামনে খলীফার এ ফরমান পাঠ করে শোনালেন, তখন চারদিক থেকে আওয়ায উঠল, বলুন, আপনার কী প্রয়োজন? হুযায়ফা বললেন, ‘আমার নিজের জন্য শুধু কিছু খাবার আর আমার গাধাটির জন্য কিছু ঘাস-খড় প্রয়োজন।
যতদিন এখানে থাকব, আপনাদের কাছে শুধু এতটুকুই চাইব’। এ পদে কিছুদিন
থাকার পর কোন এক কারণে খলীফা ওমর (রা.) তাঁকে রাজধানী মদীনায় তলব করেন। খলীফার
ডাকে সাড়া দিয়ে হুযায়ফা (রা.) যে অবস্থায় একদিন মাদায়েন গিয়েছিলেন ঠিক ঐ অবস্থায়
মদীনার দিকে যাত্রা করেন। হুযায়ফা আসছেন, এ খবর পেয়ে খলীফা মদীনার কাছাকাছি পথের পাশে এক জায়গায় লুকিয়ে থাকেন। হুযায়ফা
(রা.) নিকটে আসতেই ওমর (রা.) সামনে এসে দাঁড়ান এবং তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘হুযায়ফা! তুমি আমার ভাই, আর আমিও তোমার ভাই।’ তারপর সেই পদেই তাঁকে বহাল রাখেন।[31] এ ঘটনা তার দুনিয়া বিমুখতার উজ্জ্বল উদাহরণ।
তাক্বওয়া :
তিনি জীবন যাপনে হারাম-হালাল বেছে চলতেন।
কথা-কর্ম, ইবাদত-বন্দেগী, মানুষের সাথে চলাফেরা ও জীবন ধারণের ক্ষেত্রে সন্দেহজনক বিষয়ও পরিহার করতেন।
শরী‘আতে নির্দেশ পালন ও সুন্নাতের একনিষ্ঠ অনুসরণের মধ্যেই তাঁর
তাক্বওয়াশীলতা ফুটে ওঠে। নিম্নোক্ত দু’টি ঘটনার
মধ্যেই তার আল্লাহভীতির পরিচয় পাওয়া যায়।
১. হুযায়ফা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) আমাদের দু’টি হাদীছ
বর্ণনা করেছিলেন, যার একটি আমি দেখেছি (সত্যে পরিণত হয়েছে)। আর
অপরটির অপেক্ষায় আছি। তিনি আমাদের বলেন, আমানত মানুষের অন্তর্মূলে প্রবিষ্ট হয়। এরপর তারা কুরআন শিখে, তারপর তারা সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করে। তিনি আমাদের আমানত
বিলুপ্তি সম্পর্কেও বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ এক সময় ঘুমাবে। তার অন্তর থেকে আমানত উঠিয়ে নেয়া হবে। তখন একটি বিন্দুর
মত চিহ্ন অবশিষ্ট থাকবে। এরপর সে আবার ঘুমাবে। তারপর আবার তুলে নেয়া হবে, তখন ফোসকার মত তার চিহ্ন অবশিষ্ট থাকবে। যেমন একটা জ্বলন্ত
অঙ্গারকে যদি তুমি পায়ের উপর রেখে দাও এতে পায়ে ফোস্কা পড়ে, তখন তুমি সেটাকে ফোলা দেখবে। অথচ তার মধ্যে কিছুই নেই। (এ
সময়) মানুষ বেচাকেনা করবে বটে কিন্তু কেউ আমানত রক্ষা করবে না।
তখন বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন আমানতদার ব্যক্তি আছেন। কোন কোন লোক সম্পর্কে বলা হবে যে, লোকটি কতই না বুদ্ধিমান, কতই না বিচক্ষণ, কতই না বীর, অথচ তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান নেই। [এরপর হুযায়ফা (রা.) বললেন] আমার
উপর দিয়ে এমন একটি যুগ অতিবাহিত হয়েছে তখন আমি তোমাদের কার সঙ্গে লেনদেন করছি
এ-সম্পর্কে মোটেও চিন্তা-ভাবনা করতাম না। কেননা সে যদি মুসলিম হয় তাহ’লে তার দ্বীনই (হক আদায়ের জন্য) তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে
আনবে। আর যদি সে খ্রিস্টান হয়, তাহ’লে তার অভিভাবকরাই (হক আদায়ের জন্য) তাকে আমার কাছে ফিরে
আসতে বাধ্য করবে। কিন্তু বর্তমানে আমি অমুক অমুককে ব্যতীত কারো সঙ্গে বেচাকেনা করি
না।[32]
২. হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ইসলাম পুরাতন হয়ে যাবে, যেমন কাপড়ের উপরের কারুকার্য পুরাতন হয়ে যায়।
শেষে এমন অবস্থা হবে যে, কেউ জানবে না, ছিয়াম কি, ছালাত কি, কুরবানী কি, যাকাত কি? এক রাতে পৃথিবী থেকে মহান আল্লাহর কিতাব বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং একটি আয়াতও
অবশিষ্ট থাকবে না। মানুষের (মুসলমানদের) কতক দল অবশিষ্ট থাকবে। তাদের বৃদ্ধ ও
বৃদ্ধারা বলবে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ (আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই)-এর অনুসারী দেখতে পেয়েছি।
সুতরাং আমরাও সেই বাক্য বলতে থাকব। (তাবিঈ)
সিলা (রা.) হুযায়ফা (রা.)-কে বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলায় তাদের কি উপকার হবে? অথচ তারা জানে না ছালাত কি, ছিয়াম কি, হজ্জ কি, কুরবানী কি এবং যাকাত কি? সিলা ইবনে যুফার (রা.)
তিনবার কথাটির পুনরাবৃত্তি করলে তিনি প্রতিবার তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেন। তৃতীয়
বারের পর তিনি তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, হে সিলা! এই কালেমা তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবে, কথাটি তিনি তিনবার বলেন।[33]
[1]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব ২/১৯৩।
[2]. খায়রুদ্দীন যিরিকলী, আল-আ‘লাম ২/১৭১।
[3]. বুখারী হা/৩৭৪৩, ৬২৭৮; আল-আ‘লাম ২/১৭১।
[4]. আল-ইছাবাহ ১/৩১৭; ইবনু আব্দিল
বার্র, আল-ইসতি‘আব, ১/৯৮।
[5]. আবু বকর আল-ইছফাহানী, রিজালু ছহীহ মুসলিম, ১/১৪৫; আল-ইসতি‘আব, ১/৯৮।
[6]. আল-ইছাবাহ ১/৩১৭; আল-ইসতি‘আব, ১/২৭৭।
[7]. শাযারাতুয যাহাব ১/৪৪; আল-ইছাবাহ ১/৩১৭; তাহযীবুত
তাহযীব ২/১৯৩।
[8]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবাহ ৪/১২২।
[9]. ইবরাহীম মুহাম্মাদ আল-আলী, হুযায়ফাহ ইবনুল ইয়ামান আমীনু সির্রে রাসূলিল্লাহি, (দিমাশক : দারুল কলাম, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৬ খ্রীঃ/১৪১৭ হিঃ), পৃঃ ২৯।
[10]. তাহযীবুত তাহযীব ২/১৯৩; আল-ইছাবাহ ২/৪৪; আল-ইসতি‘আব ১/৯৯।
[11]. হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২/৩৬২; সীরাতু ইবনে হিশাম ১/৫০৬।
[12]. তিরমিযী হা/৩৭৮১; নাসাঈ
হা/১৯৩; মিশকাত হা/৬১৭১; তা’লীকুর রাগীব হা/৭০৮২, সনদ ছহীহ।
[13]. মুসলিম হা/১৭৮৭; যাহাবী, তারীখুল ইসলাম, ২/১৫৩; তাহযীবুত তাহযীব
২/১৯৩; আল-ইছাবাহ ২/৪৪।
[14]. হাকেম হা/৪৯০৯, সনদ ছহীহ; সীরাতু ইবনে হিশাম ২/৮৭; হায়াতুছ ছাহাবা ১/৫১৯; ছুওয়ারুন মিন হায়াতিছ ছাহাবা ৪/১২৫-১২৭।
[15]. বুখারী হা/৩২৯০, ৩৮২৪, ৪০৬৫, ৬৬৬৮, ৬৮৮৩, ৬৮৯০।
[16]. মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৪৯০৯; সীরাতু ইবন হিশাম ২/৮৭; হায়াতুছ ছাহাবাহ ১/৫১৯; ছুওয়ারুন মিন হায়াতিছ ছাহাবা ৪/১২৫-১২৭।
[17]. তাবাকাত ২/৫০।
[18]. মুসনাদ আহমাদ ৫/৩৯২-৯৩; সীরাতু ইবনে হিশাম ৩/২৩১-৩২, সনদ হাসান; মুস্তাদরাকে হাকেম
৩/৩১, সনদ ছহীহ।
[19]. মুসলিম হা/১৭৮৮, ‘আহযাবের
(খন্দক ও পরীখার) যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ।
[20]. হুযায়ফাহ ইবনুল ইয়ামান আমীনু সির্রে রাসূলিল্লাহি, পৃঃ ৫২।
[21]. ঐ, পৃঃ ১০৩-৪।
[22]. বুখারী হা/৫৬৩৪; মুসলিম
হা/২০৬৫; আবূদাউদ হা/৩৭২৩; তিরমিযী হা/১৮৭৮।
[23]. মুসলিম হা/৭৭২; আবূদাঊদ
হা/৮৭১, ৮৭৪; তিরমিযী হা/২৬২।
[24]. মুসনাদে আহমাদ হা/২৩৩৬১; ইবনু মাজাহ হা/১৬৯৫, সনদ হাসান।
[25]. হুযায়ফাহ ইবনুল ইয়ামান, পৃঃ ১৩৩।
[26]. মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৪৯০৯; সীরাতু ইবনে হিশাম ২/৮৭; হায়াতুছ ছাহাবাহ ১/৫১৯; ছুওয়ারুন মিন হায়াতিছ ছাহাবা ৪/১২৫-১২৭।
[27]. মুসনাদ আহমাদ ৫/৩৯২-৯৩; সীরাতু ইবনে হিশাম ৩/২৩১-৩২, সনদ হাসান; মুস্তাদরাকে হাকেম
৩/৩১, সনদ ছহীহ।
[28]. বুখারী হা/৫২৫; মুসলিম
হা/১৪৪; তিরমিযী হা/২২৮৫; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৫৫।
[29]. আহমাদ হা/২৩২৮৩-৮৪; হাকেম
হা/৪০৯, হাদীছ হাসান।
[30]. রিজালুন হাওলার রাসূল, পৃঃ ২০০; তাহযীবুল কামাল
৫/৫০৮; হায়াতুছ ছাহাবাহ
৩/৫১৭।
[31]. আল-আ’লাম ২/১৭১; তাহযীবুত তাহযীব ২/১৯৩; হায়াতুছ ছাহাবাহ ৩/২৬৬, ২/৭৩।
[32]. বুখারী হা/৭০৮৬; মুসলিম
হা/১৪৩।
[33]. ইবনু মাজাহ হা/৪০৪৯; ছহীহাহ
হা/৮৭।
খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে
হুযায়ফা (রা.)
ক. আবুবকর (রা.)-এর আমলে
হুযায়ফা :
নবী করীম (সা.)-এর মৃত্যুর পরে আবুবকর (রা.)
খেলাফতে অধিষ্ঠিত হ’লে হুযায়ফা (রা.) তাঁর নিকটে বায়‘আত করেন। আবুবকর (রা.) ২ বছর ৩ মাস ১০ দিন খেলাফতে অধিষ্ঠিত
থাকেন। তিনি এ সময় মুরতাদদের দমন এবং পারস্য ও সিরিয়া বিজয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ফলে সে
সময়ে আবুবকর (রা.)-এর পক্ষে হুযায়ফা (রা.)-কে কোন দায়িত্বে নিযুক্ত করা সম্ভব
হয়নি।[1]
খ. ওমর (রা.)-এর আমলে হুযায়ফার দায়িত্ব পালন :
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রা.) খেলাফতে আসীন হয়ে
হুযায়ফা (রা.)-কে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত করেন। ওমর (রা.)-এর নিকটে
হুযায়ফা (রা.)-এর মার্যাদার স্তরও ছিল অতি উচ্চে। খলীফা ওমর (রা.)-এর সময় তিনি
কূফা শহরের গোঁড়া পত্তনের জন্য স্থান নির্ধারণ করেন।[2] তিনি মাদায়েন ও দাজলার তীরবর্তী এলাকায় তত্ত্বাবধায়কের
দায়িত্ব পালন করেন।[3]
একজন নতুন ওয়ালী আসছেন- এ খবর মাদায়েনবাসীদের
কাছে পৌঁছে গেল। ফলে নতুন আমীরকে স্বাগত জানানোর জন্য তারা দলে দলে শহরের বাইরে
সমবেত হ’ল। তারা এ মহান ছাহাবীর তাক্বওয়া, আল্লাহভীতি, সরলতা ও ইরাক বিজয়ের অনেক কথা শুনেছিল। সেকারণ একটি জাঁকজমকপূর্ণ কাফেলার সাথে
তাঁর আগমনের প্রতীক্ষায় ছিল। কিন্তু না, কোন কাফেলার সাথে নয়। তারা দেখতে পেল কিছু দূরে গাধার উপরে সওয়ার হয়ে দীপ্ত
চেহারার এক ব্যক্তি তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। গাধার পিঠে অতি পুরনো একটি জিন। তার
ওপর বসে বাহনের পিঠের দু’পাশের পা ছেড়ে দিয়ে এক হাতে রুটি ও অন্য হাতে
লবণ ধরে মুখে ঢুকিয়ে চিবোচ্ছেন। আরোহী ধীরে ধীরে জনতার মাঝখানে এসে পড়লেন। তারা
ভাল করে তাকিয়ে দেখে বুঝল, ইনিই সেই ওয়ালী, যার প্রতীক্ষায় তারা দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথমবারের মত তাদের
কল্পনা হোঁচট খেল। পারস্যের কিসরা বা তাঁর পূর্ব থেকে তাদের দেশে এমন ওয়ালীর আগমণ
আর কখনো ঘটেনি।
তিনি চললেন এবং লোকেরাও তাঁকে ঘিরে পাশাপাশি
চলল। তিনি আবাস স্থলে পৌঁছে উপস্থিত জনতাকে তাদের প্রতি লেখা খলীফার ফরমান পাঠ করে
শোনালেন। খলীফা ওমর (রা.)-এর নিয়ম ছিল, নতুন ওয়ালী বা শাসক নিয়োগের সময় সেই এলাকার অধিবাসীদের প্রতি বিভিন্ন নির্দেশ
ও ওয়ালীর দায়িত্ব ও কর্তব্য স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া। কিন্তু হুযায়ফা (রা.)-এর
নিয়োগপত্রে মাদায়েনবাসীর প্রতি শুধু একটি নির্দেশ ছিল- ‘তোমরা তাঁর কথা শুনবে ও আনুগত্য করবে।’ তিনি যখন তাদের সামনে খলীফার এ ফরমান পাঠ করে শোনালেন, তখন চারদিক থেকে আওয়ায উঠল, বলুন, আপনার কী প্রয়োজন। আমরা সবই দিতে প্রস্তুত।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ছাহাবী ও খুলাফায়ে রাশেদার পদাঙ্ক অনুসরণকারী হযায়ফা (রা.)
বললেন,
‘আমার নিজের পেটের জন্য শুধু কিছু খাবার, আর আমার গাধাটির জন্য কিছু ঘাস-খড় প্রয়োজন। যতদিন এখানে
থাকব,
আপনাদের কাছে শুধু এতটুকুই চাইব।’ তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে আরো বললেন, ‘তোমরা ফিৎনার স্থানগুলি থেকে দূরে থাকবে। লোকেরা জানতে চাইল, ফিৎনার স্থানগুলি কি? তিনি বললেন, আমীর বা শাসকদের বাড়ীর দরজাসমূহ। তোমাদের কেউ
আমীর বা শাসকের কাছে এসে মিথ্যা দ্বারা তাকে সত্যায়িত করবে এবং তার মধ্যে যা নেই
তাই বলে তার প্রশংসা করবে- এটাই মূলতঃ ফিৎনা’।
উক্ত পদে কিছু দিন থাকার পর কোন এক কারণে
খলীফা ওমর (রা.) তাঁকে রাজধানী মদীনায় তলব করেন। খলীফার ডাকে সাড়া দিয়ে হুযায়ফা (রা.)
যে অবস্থায় একদিন মাদায়েন গিয়েছিলেন ঠিক একই অবস্থায় মদীনার দিকে যাত্রা করেন।
হুযায়ফা আসছেন, এ খবর পেয়ে খলীফা মদীনার কাছাকাছি পথের পাশে
এক স্থানে লুকিয়ে থাকেন। নিকটে আসতেই হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ান এবং তাঁকে জড়িয়ে ধরে
বলেন,
‘হুযায়ফা, তুমি আমার ভাই, আর আমিও তোমার ভাই’। তারপর সেই পদেই
তাঁকে বহাল রাখেন।[4]
মাদায়েনে ওয়ালী থাকাকালে একবার জনতার
উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, ‘হে জনমন্ডলী! তোমরা তোমাদের দাসদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখ। দেখ, তারা কোথা থেকে কিভাবে উপার্জন করে তোমাদের নির্ধারিত মজুরী
পরিশোধ করছে। কারণ হারাম উপার্জন খেয়ে দেহে যে গোশত তৈরী হয় তা কখনও জান্নাতে
প্রবেশ করবে না। আর এটাও জেনে রাখ, মদ বিক্রেতা, ক্রেতা ও তাঁর প্রস্তুতকারক, সকলেই তা পানকারীর সমান’।[5]
ওমর (রা.)-এর নিকটে হুযায়ফার স্থান :
১. হুযায়ফা (রা.) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা ওমর (রা.)-এর নিকটে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন তিনি
বললেন,
ফিৎনা-ফাসাদ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর
বক্তব্য তোমাদের মধ্যে কে মনে রেখেছ? হুযায়ফা (রা.) বললেন, যেমনভাবে তিনি বলেছিলেন হুবহু তেমনিই আমি মনে
রেখেছি। ওমর (রা.) বললেন, আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর বাণী মনে রাখার
ব্যাপারে তুমি খুব দৃঢ়তার পরিচয় দিচ্ছ। আমি বললাম, (রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন) মানুষ নিজের পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, পাড়া-প্রতিবেশীদের ব্যাপারে যে ফিৎনায় পতিত হয়- ছালাত, ছিয়াম, ছাদাক্বাহ, (ন্যায়ের) আদেশ ও (অন্যায়ের) নিষেধ তা দূরীভূত করে দেয়। ওমর
(রা.) বললেন, আমার উদ্দেশ্য তা নয়। বরং আমি সেই ফিৎনার কথা
বলছি,
যা সমুদ্র তরঙ্গের ন্যায় ভয়াল হবে। হুযায়ফা (রা.)
বললেন,
হে আমীরুল মুমিনীন! সে ব্যাপারে আপনার ভয়ের
কোন কারণ নেই। কেননা আপনার ও সে ফিৎনার মাঝখানে একটি বন্ধ দরজা রয়েছে। ওমর (রা.)
জিজ্ঞেস করলেন, সে দরজাটি ভেঙ্গে ফেলা হবে, না খুলে দেয়া হবে? হুযায়ফা (রা.) বললেন, ভেঙ্গে ফেলা হবে। ওমর (রা.) বললেন, তাহ’লে তো আর কোন দিন তা বন্ধ করা যাবে না।
[হুযায়ফা (রা.)-এর ছাত্র শাক্বীক (রহ.) বলেন], আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ওমর (রা.) কি সে দরজাটি সম্বন্ধে জানতেন? হুযায়ফা (রা.) বললেন, হ্যাঁ, দিনের পূরে রাতের আগমন যেমন সুনিশ্চিত, তেমনি নিশ্চিতভাবে তিনি জানতেন। কেননা আমি তাঁর কাছে এমন
একটি হাদীছ বর্ণনা করেছি, যা মোটেও ক্রুটিযুক্ত নয়। (দরজাটি কী) এ
বিষয়ে হুযায়ফা (রা.)-এর নিকট জানতে আমরা ভয় পাচ্ছিলাম। তাই আমরা মাসরূক (রহ.)-কে
বললাম এবং তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, দরজাটি ওমর (রা.) নিজেই।[6]
২. ওমর (রা.) হুযায়ফাকে খুব সম্মান করতেন।
কোন মুসলমান মারা গেলে ওমর (রা.) জিজ্ঞেস করতেন যে, হুযায়ফা কি এর জানাযায় শরীক হয়েছে? যদি বলা হ’ত হ্যাঁ তাহ’লে তিনিও জানাযায় শরীক হ’তেন। আর যদি বলা হ’ত না তাহ’লে তিনি তার জানাযা
পড়তেন না।[7]
৩. হুযায়ফা (রা.) বলেন, আমি একদিন মসজিদে বসে আছি। ওমর (রা.) আমার পাশ দিয়ে যেতে
যেতে বললেন, হুযায়ফা, অমুক মারা গেছে, তার জানাযায় চল। একথা বলে তিনি চলে গেলেন।
মসজিদ থেকে বের হ’তে যাবেন, এমন সময় পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখেন, আমি নিজ স্থানে বসে আছি। তিনি বুঝতে পেরে আমার কাছে ফিরে এসে বললেন, হুযায়ফা, আমি তোমাকে আল্লাহর
কসম দিয়ে বলছি, সত্যি করে বল তো আমিও কি তাদের (মুনাফিকদের)
একজন?
আমি বললাম, নিশ্চয়ই না। আপনার পরে আর কাউকে কখনও আমি এমন সনদ দেব না।[8]
৪. একবার খলীফা ওমর (রা.) তাঁকে জিজ্ঞেস
করলেন,
আচ্ছা আমার কর্মকর্তাদের মধ্যে কি কোন
মুনাফিক আছে? হুযায়ফা বললেন, একজন আছে। খলীফা বললেন, আমাকে তার একটু পরিচয় দাও না। বললেন, আমি তা দেব না। হুযায়ফা বলেন, তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ওমর তাকে বরখাস্ত করেন। সম্ভবতঃ তিনি সঠিক হিদায়াত
পেয়েছিলেন।[9]
৫. একবার খলীফা ওমর (রা.) তাঁর পাশে বসা ছাহাবীদের
বললেন,
আচ্ছা আপনারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ
ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার কথা একটু বলুন তো! প্রায় সকলেই বললেন, আমাদের একান্ত ইচ্ছা এই যে, আমরা যদি ধন-রত্নে ভরা একটি ঘর পেতাম, আর তার সবই আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিতে পারতাম। সবার শেষে ওমর (রা.) বললেন, আমার বাসনা এই যে, আমি যদি আবু উবায়দাহদাহ, মু‘আজ ও হুযায়ফা (রা.) মত মানুষ বেশী বেশী পেতাম, আর তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অর্পণ করতে পারতাম। একথা
বলে তিনি দীনার ভর্তি একটি থলে একজন লোকের হাতে দিয়ে বলেন, এগুলি হুযায়ফার নিকট নিয়ে যাও, আর তাকে বল, খলীফা এগুলি আপনার প্রয়োজনে খরচের জন্য পাঠিয়েছেন। তাকে আরো বলে দেন, তুমি একটু অপেক্ষা করে দেখে আসবে, সে দীনারগুলি কি করে। লোকটি থলেটি নিয়ে হুযায়ফা (রা.)-এর
নিকট গেল। আর হুযায়ফা (রা.) সাথে সাথে তা গরীব-মিসকীনের মধ্যে বন্টন করে দিলেন।[10]
গ. ওছমান (রা.)-এর আমলে হুযায়ফার
দায়িত্ব পালন :
ওছমান (রা.)-এর খেলাফতকালের পুরো সময় এবং আলী
(রা.)-এর খেলাফতের কিছু দিন, একটানা এ দীর্ঘ সময়
তিনি মাদায়েনের ওয়ালী পদে আসীন ছিলেন।[11]
ওছমান (রা.)-এর খেলাফতকালে হিজরী ৩০ সনে সাঈদ
ইবনু ‘আছের সাথে কূফা থেকে খুরাসানের উদ্দেশ্যে বের হন। তুমাইস
নামক বন্দরে শত্রু বাহিনীর সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। এখানে সাঈদ ইবনু আছ ‘ছালাতুল খাওফ’ (ভীতিকালীন ছালাত) আদায় করেন। তিনি ছালাত পড়ানোর পূর্বে হুযায়ফার নিকট থেকে তার
পদ্ধতি জেনে নেন।[12] এরপর তিনি ‘রায়’-এ যান এবং সেখান থেকে সালমান ইবনু রাবী‘আ ও হাবীব ইবনু মাসলামার সাথে আরমেনিয়ার দিকে অগ্রসর হন। এ
অভিযানে তিনি কূফা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন।[13]
হিজরী ৩১ সনে ‘খাকানে খাযার’-এর বাহিনীর সাথে বড় ধরনের একটি সংঘর্ষ হয়।
এতে সালমানসহ প্রায় চার হাযার মুসলিম শহীদ হন। সালমানের শাহাদাতের পর হুযায়ফা গোটা
বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পর তাঁকে অন্যত্র বদলী করা হয় এবং
তাঁর স্থলে মুগীরা ইবনু শু‘বাকে নিয়োগ করা হয়। হুযায়ফা (রা.) ‘বাব’-এর ওপর তিনবার অভিযান চালান।[14] তৃতীয় হামলাটি ছিল হিজরী ৩৪ সনে।[15] এ অভিযান ছিল ওছমান (রা.)-এর খিলাফতের শেষ দিকে। এ সকল
অভিযান শেষ করে তিনি মাদায়েনে নিজ পদে ফিরে আসেন।
খলীফা ওছমান (রা.) পবিত্র কুরআনের যে মূল কপি
তৈরী করেন এবং খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠান, তার প্রধান ভূমিকা পালন করেন মূলতঃ হুযায়ফা (রা.)। এ সম্পর্কে ইমাম বুখারী (রহঃ) আনাস (রা.)-এর
একটি বর্ণনা নকল করেছেন। আনাস (রা.) বলেন, ‘হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান সিরিয়াবাসীদের সাথে ইরাক, আরমেনিয়া ও আজারবাইজান অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। তিনি এ সকল এলাকার নবদীক্ষিত
অনারব মুসলিমদের কুরআন পাঠে তারতম্য লক্ষ্য করে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। সেখান থেকে
মদীনায় ফিরে খলীফাকে বললেন, ‘আমি আরমেনিয়া ও আজারবাইজানের
লোকদের দেখেছি, তারা সঠিকভাবে কুরআন পড়তে জানে না। তাদের
কাছে কুরআনের আসল কপি পৌঁছাতে না পারলে ইহুদী ও নাছারার হাতে তাওরাত ও ইনজীলের যে
অবস্থা হয়েছে, এ উম্মতের হাতে কুরআনের অবস্থাও অনুরূপ হওয়ার
আশঙ্কা রয়েছে’। তখন খলীফা
বিশিষ্ট ছাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রা.) কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ‘মাছহাফ’ এনে তার হুবহু নকল
করে বিভিন্ন এলাকায় প্রচার করেন। এভাবে পবিত্র কুরআনের হিফাযতের ব্যাপারে হুযায়ফা
(রা.) পরোক্ষভাবে বিরাট অবদান রাখেন। তিনি গোটা ইরাক ও পারস্যবাসীকে কুরআনের এক
পঠনের ওপর সমবেত করেন।[16]
ঘ. আলী (রা.)-এর আমলে হুযায়ফা :
ইসলামের চতুর্থ খলীফা আলী ইবনু আবী তালিব (রা.)-এর
খেলাফতকালে হুযায়ফা (রা.) তেমন কোন ভূমিকা পালন করতে পারেননি। কেননা এ সময় আলী (রা.)
ওছমান (রা.)-এর শাহাদত পরবর্তী ফিৎনা প্রশমনে ব্যস্ত ছিলেন। এছাড়া হুযায়ফা (রা.)
আলী (রা.)-এর খেলাফতকালে ৪০ দিনের মত জীবিত ছিলেন। তবে এ সময়ে তিনি দু’টি কাজ করেছিলেন- ১. নতুন খলীফার নামে বায়‘আত করেন। ২. তাঁর দুই ছেলে ছাফওয়ান ও সাঈদকে আলী (রা.)-এর
বায়‘আত করার এবং তাঁকে সাহায্য করার অছিয়ত করেন। তারা পিতার
অছিয়ত পালন করেন এবং ছিফফীনের যুদ্ধে আলী (রা.)-এর পক্ষে শাহাদত বরণ করেন।[17]
খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে
হুযায়ফা (রা.)-এর যুদ্ধে অংশগ্রহণ : হুযায়ফা (রা.) পারস্যের
নিহাওয়ান্দ, দিনাওয়ার, হামযান, মাহ্, রায়, আযারবাইজান, নাছীবীন, ক্বাদেসিয়া, আরমেনিয়া প্রভৃতি অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং ঐসব অঞ্চল জয় করেন।[18]
(চলবে)
[1]. ইবরাহীম মুহাম্মাদ আল-আলী, হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান, (দিমাশক : দারুল কলম, ১ম প্রকাশ, ১৪১৭হিঃ/১৯৯৬ খ্রিঃ), পৃঃ ৫৯-৬০।
[2]. তারীখুত তাবারী ৪/১৮৯; হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান, পৃঃ ৬৩-৬৪।
[3]. তারীখুত তাবারী ৪/১৮৯, ৪/২৪৭; তাবাক্বাতে ইবনে
সাদ ৬/৭-৮; হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান, পৃঃ ৬৪।
[4]. আল-আ‘লাম ২/১৭১ পৃঃ; হায়াতুছ ছাহাবাহ ৩/২৬৬, ২/৭৩ পৃঃ; তাহযীবুত তাহযীব ২/১৯৩ পৃঃ।
[5]. হায়াতুছ ছাহাবাহ ৩/৪৮২ পৃঃ।
[6]. বুখারী হা/৫২৫, ১৪৩৫, ১৮৯৫, ৩৫৮৬, ৭০৯৬; মুসলিম হা/১৪৪।
[7]. শাজারাতুয যাহাব ১/৪৪ পৃঃ; আল-ইস্তিআব ১/৩২৫ পৃঃ।
[8]. তারীখু ইবন আসাকির ১/৯৭; যাহাবী, তারীখ ২/১৫৩।
[9]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবাহ ৪/১৩৬-১৩৭; আল-ইস্তিআব ১/৩২৫ পৃঃ।
[10]. আত-তারীখুছ ছগীর ১/৫৪; তারীখু ইবনু আসাকির ১/৯৯, ১০০; হায়াতুছ ছাহাবাহ
২/২৩৩।
[11]. আল-ইছাবাহ ১/৩১৭ পৃঃ।
[12]. মুসনাদ ৫/৩৮৫ পৃঃ; রাবীআ
৫/৩৮৩৬-৩ পৃঃ।
[13]. তারীখুত তাবারী ৫/২৮৯ পৃঃ।
[14]. তারীখুত তাবারী ৫/২৮৯ পৃঃ।
[15]. তারীখুত তাবারী ৫/২৯৩ পৃঃ।
[16]. বুখারী, ‘জামউল কুরআন’ অধ্যায়; আত-তিব ইয়ান ফী উলূমিল কুরআন, পৃঃ ৫৭।
[17]. আল-ইস্তিআব, ১/৩৩৪ পৃঃ; হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান, পৃঃ৮৯-৯০।
[18]. আল-ইসতিআব; আল-ইছাবার টীকা
১/২৭৮ পৃঃ; তাহযীবুত তাহযীব
২/১৯৩ পৃঃ।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(১৮)
আস‘আদ বিন যুরারাহ (রা.)
উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য অনুসরণীয় হচ্ছেন
স্বয়ং রাসূল (সা.)। অতঃপর তাঁর
ছাহাবীগণ। এ কারণেই তিনি মুক্তিপ্রাপ্ত দলের পরিচয় দিতে গিয়ে ما أنا عليه وأصحابي ‘আমি এবং আমার ছাহাবীগণ যে পথে আছি’ উল্লেখ করেছেন (তিরমিযী, মিশকাহ হা/১৭১-১৭২)। ছাহাবায়ে কেরামের জীবনেতিহাস মুমিনদেরকে সত্য
ও ন্যায়ের পথে অনুপ্রেরণা যুগায়। তাই তাঁদের ঘটনাবহুল জীবনী জানা প্রয়োজন। আলোচ্য
নিবন্ধে অত্যন্ত মশহূর ছাহাবী আস‘আদ বিন যুরারাহ (রা.)-এর
সংক্ষিপ্ত জীবনী বিধৃত হ’ল।-
নাম ও বংশ পরিচয় : তাঁর নাম ‘আস‘আদ’। কুনিয়াত ‘আবূ উমামা’। পিতার নাম যুরারাহ বিন ‘উদাস। মাতার
নাম সা‘আদ বিনতে রাফে‘। তার পূর্ণ নসবনাম হচ্ছে- আবূ উমামা আস‘আদ বিন যুরারাহ বিন ‘উদাস বিন ‘উবায়দ বিন ছা‘লাবাহ বিন গানাম বিন মালেক বিন নাজ্জার।[1] তিনি আস‘আদ আল-খায়র নামেও
পরিচিত। কেউ কেউ তার নাম ‘আসাদ বিন যুরারাহ’ (أَسَدُ بْنِ زُرَارَةَ)ও বলেছেন। তিনি মদীনার খাযরাজ গোত্রের নাজ্জার শাখার
সন্তান। এজন্য তাঁকে খাযরাজী ও নাজ্জারীও বলা হয়।[2] তাঁর জন্মতারিখ সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।
ইসলাম গ্রহণ : তাঁর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে দুই ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। ইবনুল আছীর ওয়াকেবদীর
সূত্রে বলেন, আস‘আদ বিন
যুরারাহ ও যাকওয়ান বিন আব্দিল ক্বায়স নিজেদের একটি বিষয় নিষ্পত্তির জন্য মক্কার
কুরায়শ নেতা উতবা বিন রাবী‘আহর নিকট গমন করেন। এ সময়ে উতবাহর নিকট তারা
রাসূল (সা.) সম্পর্কে কিছু কথা শুনতে পান। অতঃপর সেখান থেকে গোপনে রাসূল (সা.)-এর
সাথে সাক্ষাৎ করেন। রাসূল (সা.) তাঁদের নিকটে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন এবং কুরআন
মাজীদের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করে শুনান। ফলে সেখানেই তারা দু’জন ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর সেখান থেকে আর উতবাহর নিকট না
গিয়ে সরাসরি তারা মদীনায় ফিরে আসেন।[3]
ইবনু ইসহাক বলেন, আস‘আদ বিন যুরারাহ একাদশ নববী বর্ষে অনুষ্ঠিত
আক্বাবার ১ম বায়‘আতে অংশগ্রহণ করে ইসলাম কবুল করেন।[4] নববী ১১তম বর্ষের হজ্জের মওসুমে একরাতে রাসূলুল্লাহ (সা.)
আবুবকর ও আলীকে সাথে নিয়ে মক্কায় আগত বিভিন্ন হজ্জ কাফেলার লোকদেরকে তাদের তাঁবুতে
গিয়ে দাওয়াত দিতে থাকেন। এমন সময় তাঁরা মিনার আক্বাবাহ গিরিসংকটের আলো-অাঁধারীর
মধ্যে কিছু লোকের কথাবার্তা শুনে তাদের দিকে এগিয়ে যান। জিজ্ঞাসায় জানতে পারলেন যে, তারা ইয়াছরিব থেকে হজ্জে এসেছেন এবং তারা ইহূদীদের মিত্র
খাযরাজ গোত্রের লোক। তারা ছিলেন সংখ্যায় ছয়জন এবং সকলেই ছিলেন বয়সে তরুণ।
রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআনের কিছু আয়াত তেলাওয়াত
করে শুনালেন। অতঃপর সেখানেই তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনেন এবং
পিতৃধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম কবুল করেন। সৌভাগ্যবান এই ৬ তরুণের নেতা ছিলেন তাদের
মধ্যে সর্বকনিষ্ট বনু নাজ্জার গোত্রের আস‘আদ বিন
যুরারাহ। অন্যান্যরা হ’লেন (২) একই গোত্রের ‘আওফ বিন হারেছ বিন রিফা‘আহ (৩) বনু
যুরায়েক্ব গোত্রের রাফে‘ বিন মালেক বিন আজলান (৪) বনু সালামাহ গোত্রের
কুৎবা বিন ‘আমের বিন হাদীদাহ (৫) বনু হারাম গোত্রের
ওক্ববা বিন ‘আমের বিন নাবী (৬) বনু ওবায়েদ বিন গানাম
গোত্রের জাবির বিন আব্দুল্লাহ বিন রিআব (রা.)।[5]
মদীনায় দ্বীনের দাওয়াত ও
আক্বাবার ২য় বায়‘আত : ইসলাম গ্রহণের পর মদীনায় ফিরে আস‘আদ বিন যুরারাহ (রা.) রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ মত দ্বীনের
দাওয়াত শুরু করেন। যে মহাসত্যের সন্ধান তিনি পেয়েছেন তা জনগণের সামনে তুলে ধরার
জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। মদীনায় পৌঁছেই সর্বপ্রথম আবুল হায়ছামের সাথে দেখা করেন এবং
তার কাছে তার নতুন বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করেন। আবুল হায়ছাম সাথে সাথে বলে ওঠেন, ‘তোমার সাথে আমিও তাঁর রিসালাতের উপর ঈমান আনলাম’।[6]
এভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকটে তিনি দ্বীনের
দাওয়াত তুলে ধরেন। তার এই নিরন্তর দাওয়াতের ফলেই পরের বছর দ্বাদশ নববী বর্ষে
হজ্জের মৌসুমে নতুন আরো ৭জন সহ মোট ১২জন মক্কায় গিয়ে রাসূল (সা.)-এর নিকটে বায়‘আত করেন। এই বায়‘আতে গত বছরের
পাঁচজন ছাড়াও এ বছর নতুন যে সাতজন উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা হ’লেনঃ (১) বনু নাজ্জার গোত্রের মু‘আয বিন হারেছ বিন রিফা‘আহ (২) বনু
যুরায়েক্ব গোত্রের যাকওয়ান ইবনু ‘আব্দে ক্বায়েস (৩)
বনু গানাম গোত্রের ‘উবাদাহ বিন ছামেত (৪) বনু গানামের মিত্র
গোত্রের ইয়াযীদ বিন ছা‘লাবাহ (৫) বনু সালেম গোত্রের আববাস বিন
ওবাদাহ বিন নাযালাহ (৬) বনু ‘আব্দিল আশহাল
গোত্রের আবুল হায়ছাম মালেক ইবনুত তাইয়েহান (৭) বনু ‘আমর বিন ‘আওফ গোত্রের ‘ওয়ায়েম বিন সা‘এদাহ। গত বছরের জাবের বিন আব্দুল্লাহ এ বছর
আসেননি।[7] এসময়ে তারা মদীনায় দ্বীন
শিক্ষাদান ও ব্যাপকভিত্তিক দাওয়াতের জন্য মক্কা থেকে একজন দাঈকে মদীনায় প্রেরণের
আবেদন জানান। রাসূল (ছঃ) তাদের দাবীর প্রেক্ষিতে উদ্যমী ও ধীশক্তিসম্পন্ন যুবক মুছ‘আব বিন ‘উমায়রকে ইয়াছরিবে
প্রেরণ করেন। তিনিই হচ্ছেন মদীনার প্রথম দাঈ।
আস‘আদ ও মুছ‘আবের ব্যাপকভিত্তিক দাওয়াত এবং আক্বাবার ৩য় বায়‘আত : মুছ‘আব বিন ‘উমায়র মদীনায় পৌঁছে
আস‘আদ বিন যুরারাহর মেহমান হন। অতঃপর মুছ‘আব ও আস‘আদ দু’জনে নতুন উদ্যমে ব্যাপকভাবে দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করেন।
তারা মদীনার বিভিন্ন ব্যক্তি, পরিবার ও গোত্রের
নিকট গিয়ে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেন। তাদের দাওয়াত এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে নববী ত্রয়োদশ বর্ষে ২জন মহিলাসহ
মোট ৭৫জন ইয়াছরিববাসী মক্কার পূর্বোক্ত আক্বাবা নামক পাহাড়ী সুড়ঙ্গ পথে রাসূল (সা.)-এর
হাতে বায়‘আত করেন। এটিই ইসলামের ইতিহাসে ‘বায়‘আতে কুবরা’ বা বড় বায়‘আত নামে খ্যাত। যা ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর
মাদানী জীবনের ভিত্তি স্বরূপ। মূলতঃ আক্বাবাহর বায়‘আত তিন বছরে তিনবার অনুষ্ঠিত হয়। ১১ নববী বর্ষে আস‘আদ বিন যুরারাহর নেতৃত্বে ৬ জন ইয়াছরিববাসীর প্রথম ইসলাম
কবুলের বায়‘আত। ১২ নববী বর্ষে ১২ জনের দ্বিতীয় বায়‘আত এবং ১৩ নববী বর্ষে ৭৩+২=৭৫ জনের তৃতীয় ও সর্ববৃহৎ বায়‘আত- যার মাত্র ৭৫ দিনের মাথায় ১৪ নববী বর্ষের ২৭শে ছফর
বৃহস্পতিবার মক্কা হ’তে ইয়াছরিবের উদ্দেশ্যে রাসূল (সা.)-এর
হিজরতের সূচনা হয়।[8] ইবনু ইসহাক বলেন, আস‘আদ বিন যুরারাহ উক্ত তিনটি বায়‘আতেই অংশগ্রহণ করেন।[9]
তাঁদের দাওয়াতের প্রভাব সম্পর্কে নিম্নোক্ত
ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। একদিন আস‘আদ বিন যুরারাহ মুছ‘আব বিন উমায়েরকে সাথে নিয়ে বনু আব্দিল আশহাল ও বনু যাফারের
(بنو ظَفَر) মহল্লায় গমন করেন ও সেখানে একটি কূয়ার পাশে কয়েকজন মুসলমানকে
নিয়ে বসেন। তখনো পর্যন্ত বনু আব্দিল আশহাল গোত্রের দুই নেতা সা‘দ বিন মু‘আয ও উসায়েদ বিন
হুযায়ের ইসলাম কবুল করেননি। মুবাল্লিগদের আগমনের খবর জানতে পেরে সা‘দ উসায়েদকে বললেন, আপনি যেয়ে ওদের নিষেধ করুন যেন আমাদের সরল-সিধা মানুষগুলিকে বোকা না বানায়। আস‘আদ আমার খালাতো ভাই না হ’লে আমি নিজেই যেতাম’।
উসায়েদ বর্শা উঁচিয়ে সদর্পে সেখানে গিয়ে
বললেন,
যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, তবে এখনি পালাও। তোমরা আমাদের বোকা লোকগুলিকে মুসলমান
বানাচ্ছ’। মুছ‘আব শান্তভাবে বললেন, আপনি কিছুক্ষণের জন্য বসুন ও কথা শুনুন। যদি পসন্দ না হয়, তখন দেখা যাবে’। উসায়েদ তখন মাটিতে বর্শা গেড়ে বসে পড়লেন। অতঃপর মুছ‘আব তাকে কুরআন থেকে কিছু অংশ পাঠ করে শুনালেন। তারপর তিনি
আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ত্ব ও তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যের গুরুত্ব
সম্পর্কে কিছু কথা বললেন। ইতিমধ্যে উসায়েদ চমকিত হয়ে বলে উঠলেন,مَا أَحْسَنَ هَذَا الْكَلاَمَ
وَأَجْمَلَهُ ‘কতই না সুন্দর কথা এগুলি ও কতই না মনোহর’। এরপর তিনি সেখানেই
ইসলাম কবুল করলেন।
অতঃপর তিনি সা‘দ বিন মু‘আয-এর নিকটে এসে বললেন, فَواللهِ مَا رَأَيْتُ بِهِمَا
بَأْسًا، ‘আল্লাহর কসম! আমি তাদের মধ্যে দোষের কিছু
দেখিনি’। তবে আমি তাদের
নিষেধ করে দিয়েছি এবং তারাও বলেছে, আপনারা যা চান তাই করা হবে’। এ সময় উসায়েদ চাচ্ছিলেন যে, সা‘দ সেখানে যান। তাই তাকে রাগানোর জন্যে বললেন, আমি জানতে পারলাম যে, বনু হারেছাহর লোকজন আস‘আদ বিন যুরারাহকে হত্যা করার জন্য বের হয়েছে
এজন্য যে, সে আপনার খালাতো ভাই। সা‘দ ক্রুদ্ধ হয়ে তখনই বর্শা হাতে ছুটে গেলেন। যেয়ে দেখেন যে, আস‘আদ ও মুছ‘আব
নিশ্চিন্তে বসে আছে। বনু হারেছাহর হামলাকারীদের কোন খবর নেই। তখন তিনি বুঝলেন যে, উসায়েদ তার সঙ্গে চালাকি করেছে তাকে এদের কাছে পাঠানোর
জন্য। তখন সা‘দ ক্রুদ্ধস্বরে উভয়কে ধমকাতে থাকলেন এবং আস‘আদকে বললেন, তুমি আমার আত্মীয় না হ’লে তোমাদের কোনই ক্ষমতা ছিল না আমার মহল্লায়
এসে লোকদের বাজে কথা শুনাবার’। আস‘আদ পূর্বেই সা‘দ ও উসায়েদ-এর বিষয়ে মুছ‘আবকে অবহিত
করেছিলেন যে, এরা দু’জন মুসলমান
হ’লে এদের গোত্রের সবাই মুসলমান হয়ে যাবে। আস‘আদের ইঙ্গিতে মুছ‘আব অত্যন্ত
ধীর ও নম্র ভাষায় সা‘দকে বললেন, আপনি বসুন এবং আমাদের কথা শুনুন! অতঃপর পসন্দ হ’লে কবুল করবেন, নইলে প্রত্যাখ্যান করবেন’। অতঃপর তিনি বসলেন
এবং মুছ‘আব তাকে কুরআন থেকে শুনালেন ও তাওহীদের মর্ম
বুঝালেন। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সা‘দ বিন মু‘আয ইসলাম কবুল করে ধন্য হ’লেন। অতঃপর সেখানেই দু’রাক‘আত নফল
ছালাত আদায় করে নিজ গোত্রে ফিরে আসলেন। পরবর্তীতে তার গোত্রের সকলেই ইসলাম কবুল
করেন।[10]
তাঁর মর্যাদা ও বৈশষ্ট্য :
মদীনায় জামা‘আতে ছালাত ও জুম‘আ চালু করা : আস‘আদ বিন যুরারাহ (রা.) বয়সে তরুণ হ’লেও তার ঈমানী জাযবা ও দৃঢ়তা ছিল অত্যন্ত প্রবল। তিনি
মদীনার নতুন মুসলমানদের নিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত জামা‘আতে শুরু করেন এবং মদীনায় তিনিই সর্বপ্রথম জুম‘আর ছালাত চালু করেন। মদীনার বনু বায়াযাহ গোত্রের নাক্বী‘উল খাযেমাত (نَقِيعُ الْخَضِمَاتِ) নামক স্থানের ‘নাবীত’ (هَزْمُ النَّبِيْتِ) সমতল ভূমিতে সর্বপ্রথম জুম‘আর ছালাত শুরু হয়। যেখানে চল্লিশ জন মুছল্লী উপস্থিত ছিলেন।[11] তার এই যুগান্তকারী উদ্যোগকে স্মরণ করে সমকালীন ছাহাবীগণের
অনেকেই সারা জীবন তার জন্য খাছ দো‘আ করেছেন।
যেমন- আবদুর রহমান ইবনে কা‘ব বিন মালেক (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার পিতা অন্ধ হয়ে গেলে আমি ছিলাম তার পরিচালক। আমি তাকে
নিয়ে যখন জুম‘আর ছালাত আদায় করতে বের হ’তাম, তখন তিনি আযান শুনলেই আবূ উমামাহ আস‘আদ বিন যুরারাহ (রা.)-এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন এবং দো‘আ করতেন। আমি তাকে ক্ষমা প্রার্থনা ও দো‘আ করতে শুনে কিছুক্ষণ থামলাম, অতঃপর মনে মনে বললাম, আল্লাহর শপথ! কি বোকামী! জুম‘আর আযান শুনামাত্রই আমি তাকে আবূ উমামাহ-এর জন্য ক্ষমা
প্রার্থনা ও দো‘আ করতে শুনি, অথচ আমি তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করিনি? অতঃপর আমি তাকে নিয়ে একদিন জুম‘আর
উদ্দেশ্যে বের হ’লাম। তিনি যখন আযান শুনলেন তখন অভ্যাস মাফিক
আস‘আদ বিন যুরারাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তখন আমি তাকে
জিজ্ঞেস করলাম, হে পিতা! জুম‘আর আযান শুনলেই আপনি আস‘আদ বিন যুরারাহর
জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন, এটি কেন করেন? তিনি বললেন, বৎস! রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদীনায়
আসার পূর্বে তিনিই সর্বপ্রথম বনূ বায়যাহ গোত্রের প্রস্তরময় সমতল ভূমিতে অবস্থিত ‘নাক্বী‘উল খাযামাত’-এ আমাদের নিয়ে জুম‘আর ছালাত
পড়েন। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা তখন কতজন ছিলেন? তিনি বলেন, চল্লিশজন পুরুষ’।[12]
বনু নাজ্জার-এর নক্বীব : আক্বাবায়ে কুবরায় অংশগ্রহণকারী ৭৫ জনের মধ্য হ’তে ১২ জনকে রাসূল (সা.) তাদের জন্য ‘নক্বীব’ (প্রতিনিধি) বা নেতা নির্বাচন করে দেন। তন্মধ্যে ৯ জন খাযরাজ
ও ৩ জন আউস গোত্র হ’তে। আস‘আদ বিন
যুরারাহ ছিলেন খাযরাজ গোত্রের বনু নাজ্জার শাখার নক্বীব। তিনি শুধু নক্বীবই ছিলেন
না,
বরং তিনি ছিলেন তাদের প্রধান।[13] তার মৃত্যুর পরে বনু নাজ্জারের লোকেরা রাসূল (সা.)-এর নিকট
উপস্থিত হয়ে আবেদন করেন যে, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আস‘আদ মৃত্যুবরণ করেছেন, তিনি ছিলেন আমাদের নক্বীব। এক্ষণে আপনি আমাদের জন্য অন্য একজন নক্বীব নিযুক্ত
করে দিন। রাসূল (সা.) বললেন, তোমরা আমার মাতুল
গোত্র। আমিই তোমাদের নক্বীব। আর এটি ছিল তাদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাকর।[14]
সাহল ও সোহাইল এর তত্ত্বাবধায়ক
: রাসূল (সা.)-এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে আসার পর যে
স্থানে তাঁর উটনি বসে পড়ে এবং যে স্থানটিকে তিনি মসজিদ ও বাসস্থানের জন্য নির্ধারণ
করেন,
সে জায়গাটির মালিক ছিল সাহল ও সোহাইল নামক
দুই ইয়াতীম বালক। আর আস‘আদ বিন যুরারাহ (রা.) ছিলেন তাদের
তত্ত্বাবধায়ক। রাসূল (সা.) বালক দু’টির
তত্ত্বাবধায়ক আস‘আদের নিকট জমির মূল্য জানতে চাইলে বালকদ্বয়
বলে ওঠে, আমরা আল্লাহর কাছে এর মূল্য চাই। অতঃপর রাসূল
(সা.) বিনা মূল্যে নিতে রাযী না হওয়ায় আবু বকর (রা.) জমির মূল্য পরিশোধ করেন।
অবশ্য অন্য বর্ণনা মতে, আস‘আদ তার বনী
বায়যায় অবস্থিত একটি বাগান মসজিদের এই জমির বিনিময়ে ইয়াতীমদ্বয়কে প্রদান করেন।[15]
রাসূল (সা.)-এর জন্য খাদ্য
প্রেরণ : রাসূল (সা.) হিজরতের পর আবু আইয়ূব আনছারীর বাড়ীতে অবস্থানকালে
এক রাত পর পর পালাক্রমে তাঁর জন্য খাবার পাঠাতেন। আস‘আদের বাড়ী থেকে খাবার আসার পালার রাতে তিনি জিজ্ঞেস করতেন, আস‘আদের পাত্রটি কি এসেছ? বলা হ’ত, হ্যাঁ। তিনি বলতেন, সে পাত্রটি নিয়ে এসো। বর্ণনাকারী বলেন, এর দ্বারা বুঝা যেত যে, আস‘আদের বাড়ীর
খাবারটি তার নিকট পসন্দনীয় ছিল।[16]
মৃত্যু ও দাফন : এই মহান ছাহাবী অল্প বয়সে রাসূল (সা.)-এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের ১ম বছর
শাওয়াল মাসে, যখন মসজিদ নববীর নির্মাণ কাজ চলছিল তখন ‘জাবহা’ নামক কণ্ঠনালীর এক
প্রকার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ফারী‘আ, কাবশা ও হাবীবা নামে তিন কন্যা রাসূল (সা.)-এর
যিম্মায় রেখে যান।[17] রাসূল (সা.) আজীবন তাদের
দেখাশুনা করেন। এক মেয়েক সাহল বিন হুনাইফের সাথে বিবাহ দেন, যাদের ঔরসে আবূ উমামা বিন সাহল জন্মগ্রহণ করেন।[18] রাসূল (সা.) তার জানাযার ছালাত পড়ান এবং ‘বাক্বীউল গারক্বাদে’ তাকে দাফন করা হয়। উল্লেখ্য যে, আনছারদের মতে তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যাকে ‘বাক্বীউল গারক্বাদে’ দাফন করা হয়। তবে মুহাজিরদের মতে ‘বাক্বী’তে প্রথম দাফন করা
হয় ওছমান বিন মায‘উনকে। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।[19]
উপসংহার : আস‘আদ বিন যুরারাহ (রা.) ছিলেন তরুণ, উদ্যমী ও সাহসী ছাহাবী। তিনি ছিলেন আল্লাহর পথের নিঃস্বার্থ
দাঈ। ইসলাম কবুলের পর মাত্র কয়েক বছর বেঁচে থাকলেও ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল
উম্মাতের জন্য তিনি রেখে গেছেন দাওয়াতী কাজের গভীর প্রেরণা। মদীনায় ইসলামের বীজ
বপিত হয়েছে তাঁর মাধ্যমেই। তাঁর নিরন্তর দাওয়াতের ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে মদীনা
রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়। সেকারণ প্রত্যেক দাঈর জন্য তার সংক্ষিপ্ত জীবনী থেকে
ব্যাপক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর দ্বীনের নিঃস্বার্থ দাঈ হিসাবে
কবুল করুন-আমীন!!
[1]. শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা (বৈরূত: মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ ৩য় প্রকাশ ১৯৮৫), ১ম খন্ড, পৃ: ২৯৯; আল-ইছাবাহ ফী
তাময়ীযিছ ছাহাবাহ, ১ম খন্ড, পৃ: ৩৪।
[2]. উসদুল গাবাহ, ১ম খন্ড, পৃ: ৭১।
[3]. ইবনুল জাওযী, আল-মুনতাযাম ফী তারীখিল মুলূক ওয়াল উমাম (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, তাবি), ৩য় খন্ড, পৃ: ৮২; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১ম খন্ড, পৃ: ৩০২। উলেলখ্য, অধিকাংশ তারীখের কিতাবে এই বিবরণটি উদ্ধৃত হ’লেও এর বিশুদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা এটি ওয়াক্বেদীর সূত্রে
বর্ণিত হয়েছে। আর ওয়াক্বেদী সম্পর্কে অনেকের মন্তব্য হচ্ছে ‘ওয়াক্বেদী মাতরূক’। -দ্রঃ সিয়ার, পৃ: ৩০২, টীকা ১-২।
[4]. ইছাবাহ ১/৩২ পৃ: জীবনী নং ১১১।
[5]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (সা.), (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ, নভেম্বর ২০১৫), পৃ: ২০০-২০১।
[6]. মুহাম্মদ আবদুল মা‘বুদ, আসহাবে রাসূলের
জীবনকথা (ঢাকা: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, পঞ্চম প্রকাশ ২০০৭), ৩য় খন্ড, পৃ: ১৪; গৃহীত: তাবাকাত ১/১৪৬ পৃ:।
[7]. সীরাতুর রাসূল (সা.), পৃ: ২০১-২০২।
[8]. ঐ, পৃ: ২১২।
[9]. আল-ইছাবাহ, ১/৩২ পৃ:, জীবনী নং ১১১।
[10]. সীরাতুর রাসূল (সা.), পৃ: ২০৫-২০৬।
[11]. ছালাতুর রাসূল (সা.), পৃ: ১৮৯; গৃহীত: ইবনু মাজাহ হা/১০৮২; আবুদাঊদ হা/১০৬৯ সনদ ‘হাসান’; সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৪৩৫; যা-দুল মা‘আ-দ ১/৩৬১; নায়ল ৪/১৫৭-৫৮; মির‘আত ৪/৪২০।
[12]. ইবনু মাজাহ হা/১০৮২, সনদ হাসান।
[13]. সিয়ার ১/৩০২ পৃ:।
[14]. ঐ, ১/৩০৩ পৃ:; মুনতাযাম ৩/৮৩ পৃ:।
[15]. আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, ৩য় খন্ড, পৃ: ১৬।
[16]. ঐ।
[17]. সিয়ার ১/৩০৩ পৃ:।
[18]. আসহাবে রাসূলের জীবন কথা ৩/১৭ পৃ:।
[19]. সিয়ার ১/৩০৩ পৃ:; মুনতাযাম ৩/৮২ পৃ:।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(১৯)
খুবায়েব বিন আদী (রা.)
ভূমিকা : ছাহাবায়ে কেরামের সীমাহীন ত্যাগ ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে সার্বজনীন ও
শাশ্বত জীবনাদর্শ ইসলাম পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তাঁরা নির্দ্বিধায় নিজেদের
জান-মাল কুরবানী করে দ্বীন প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখে গেছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা জীবন
বাজি রেখে বা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। সাক্ষাৎ মৃত্যুর কথা জেনেও তাঁরা কখনও
পিছপা হননি। দ্বীনের খেদমত ও সহায়তায় জীবনোৎসর্গ করেছেন হাসিমুখে। এজন্য তাঁরা
ইসলামের ইতিহাসে সোনালী মানুষ হিসাবে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। যাঁরা নিজেদের
জীবনকে আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়ে শাহাদতের অমিয় সুধা পান করেছেন, খুবায়েব বিন আদী (রা.) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। এ নিবন্ধে তাঁর
সংক্ষিপ্ত জীবনী আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
নাম ও বংশ পরিচয় : তাঁর নাম খুবায়েব, পিতার নাম আদী। তাঁর পূর্ণ বংশ পরিক্রমা
হচ্ছে খুবায়েব বিন আদী বিন বানী জাহজাবী বিন আওফ বিন কিফলাহ বিন আওফ বিন আমর বিন আওফ
আল-আনছারী।[1] কেউ তাঁর বংশ পরিচয় এভাবে
উল্লেখ করেছেন, খুবায়েব বিন আদী বিন আমের বিন মুজদা‘আহ বিন জাহজাব আল-আনছারী।[2] কারো মতে, তাঁর বংশক্রম হ’ল- খুবায়েব বিন আদী বিন বানী আমর বিন আওফ আল-আনছারী আল-আওসী।[3] তার জন্ম ও শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।
জিহাদে অংশগ্রহণ : তিনি বদর ও ওহোদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।[4] অতঃপর ৪র্থ হিজরীতে সারিয়া রাজী‘তে অংশগ্রহণ
করেন ও শাহাদত বরণ করেন।
শাহাদত বরণের ঘটনা : ৪র্থ হিজরীর ছফর মাসে কুরায়েশরা ষড়যন্ত্র করে ‘আযাল ও ক্বাররাহ (عَضَلٌ وَالْقَارَّةُ) গোত্রের সাতজন
লোককে রাসূল (সা.)-এর দরবারে পাঠায়। তারা গিয়ে আরয করে যে, আমাদের গোত্রের মধ্যে ইসলামের কিছু চর্চা রয়েছে। এক্ষণে
তাদেরকে দ্বীন শিক্ষাদানের জন্য ও কুরআন পড়ানোর জন্য কয়েকজন উঁচু মর্যাদা সম্পন্ন
ছাহাবীকে পাঠালে আমরা উপকৃত হ’তাম। রাসূলুল্লাহ (সা.)
সরল বিশ্বাসে তাদের গোত্রে ‘আছেম বিন ছাবিত (রা.)-এর
নেতৃত্বে ৬ জন মুহাজির ও ৪জন আনছারসহ ১০ জনের একটি মুবাল্লিগ দল প্রেরণ করেন।[5] তবে ইমাম বুখারী উল্লেখ করেন যে, আল্লাহর রাসূল (সা.) দশ ব্যক্তিকে গোয়েন্দা হিসাবে সংবাদ
সংগ্রহের জন্য পাঠান।[6] ঐ দলের নেতা ‘আছেম ছিলেন ওমরের শ্বশুর এবং ‘আছেম বিন ওমরের নানা। তারা রাবেগ ও জেদ্দার মধ্যবর্তী রাজী‘ নামক ঝর্ণার নিকটে পৌঁছলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হুযায়েল
গোত্রের শাখা বনু লেহিয়ানের ১০০ তীরন্দায তাদের উপর হামলা করে। এতে ‘আছেম সহ ৮জন শহীদ হন এবং খুবায়েব বিন ‘আদী ও যায়েদ বিন দাছেনাহকে তারা মক্কায় নিয়ে বিক্রি করে
দেয়।[7]
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তাঁরা উসফান ও মক্কার মধ্যবর্তী হাদাআত নামক স্থানে পৌঁছলে
হুযায়েল গোত্রের লেহইয়ান শাখার প্রায় দু’শত
তীরন্দাযকে তাঁদের পিছু ধাওয়া করার জন্য পাঠায়। এরা তাঁদের চিহ্ন দেখে চলতে থাকে।
ছাহাবীগণ মদীনা হ’তে সঙ্গে নিয়ে আসা খেজুর যেখানে বসে
খেয়েছিলেন। অবশেষে এরা সে স্থানের সন্ধান পেয়ে যায়। তখন তারা বলল, ইয়াছরিবের খেজুর। অতঃপর এরা তাঁদের পদচিহ্ন দেখে চলতে থাকে।
‘আছেম ও তাঁর সাথীগণ এদের দেখে একটি উঁচু স্থানে আশ্রয় গ্রহণ
করলেন। তখন কাফিররা তাঁদের ঘিরে ফেলল এবং তাঁদেরকে বলতে লাগল, তোমরা অবতরণ কর ও স্বেচ্ছায় বন্দীত্ব বরণ কর। আমরা তোমাদের
অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, তোমাদের মধ্য হ’তে কাউকে আমরা হত্যা করব না। তখন দলনেতা ‘আছেম ইবনু ছাবিত (রা.) বললেন, أَمَّا أَنَا فَوَاللهِ لاَ أَنْزِلُ الْيَوْمَ فِى ذِمَّةِ
كَافِرٍ، اللَّهُمَّ أَخْبِرْ عَنَّا نَبِيَّكَ. ‘আল্লাহর কসম! আমি তো আজ কাফিরদের নিরাপত্তায় অবতরণ করব না।
হে আল্লাহ! আমাদের পক্ষ থেকে আপনার নবীকে সংবাদ পৌঁছে দিন’। অবশেষে কাফিররা তীর
নিক্ষেপ করতে শুরু করল। আর তারা ‘আছেম (রা.) সহ সাত
জনকে শহীদ করল। অতঃপর অবশিষ্ট তিনজন খুবায়েব আনছারী, যায়েদ ইবনু দাছিনা (রা.) ও অপর একজন তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের উপর
নির্ভর করে তাদের নিকট অবতরণ করলেন। কাফিররা তাঁদেরকে আয়ত্তে নিয়ে তাদের ধনুকের
রশি খুলে ফেলে তাঁদের বেঁধে ফেলল। এ সময়ে তৃতীয় ব্যক্তি বলে উঠলেন,هَذَا أَوَّلُ الْغَدْرِ،
وَاللهِ لاَ أَصْحَبُكُمْ، إِنَّ لِى بِهَؤُلاَءِ أُسْوَةً. ‘এযে গোড়াতেই বিশ্বাসঘাতকতা! আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের সঙ্গে
যাব না। যারা শহীদ হয়েছেন আমি তাঁদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করব’। কাফিররা তাঁকে শহীদ
করে ফেলে এবং খুবায়েব ও ইবনু দাছিনাকে নিয়ে চলে যায়। অবশেষে তাঁদের উভয়কে মক্কায়
বিক্রি করে দেয়।[8]
খুবায়েবকে ক্রয়কারী : খুবায়েবকে হত্যার জন্য ৮০ মিছক্বাল স্বর্ণ মতান্তরে ৫০টি উটের বিনিময়ে খরীদ
করেন হুজায়ের বিন আবু ইহাব তামীমী, যিনি বদর যুদ্ধে নিহত হারেছ বিন ‘আমের-এর
সহোদর ভাই ছিলেন।[9] কারো মতে, হারেছ বিন আমের বিন নওফেলের মেয়ে ১০০ উটের বিনিময়ে
খুবায়েবকে ক্রয় করে।[10] মা‘মার ইবনু শিহাব সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হারেছ ইবনু আমের ইবনে নওফেলের বংশধররা খুবায়েবকে ক্রয় করে
নেয়।[11]
ইমাম বুখারী উল্লেখ করেন যে, হারেছ বিন আমেরের পুত্ররা খুবায়েবকে ক্রয় করে নেয়। কারণ বদর
যুদ্ধের দিন খুবায়েব (রা.) হারিছ ইবনু আমিরকে হত্যা করেছিলেন। খুবায়েব (রা.) কিছু
দিন তাদের নিকট বন্দী থাকেন।[12]
শূলে বিদ্ধ করার স্থান ও
হত্যাকারী : হারাম এলাকা থেকে বের করে ৬ কি. মি. উত্তরে ‘তানঈম’ নামক স্থানে
ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার গোলাম নিসতাস ইবনুদ দাছিনাকে হত্যা করে। অতঃপর একই দিনে
খুবায়েবকে সেখানে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয়।[13] ইমাম বুখারী উল্লেখ করেন যে, তারা খুবাইবকে শহীদ
করার উদ্দেশ্যে হারাম-এর নিকট হতে হিলের দিকে নিয়ে বের হয়ে পড়ল।[14] ওক্ববা বিন হারেছ বিন ‘আমের
খুবায়েবকে এবং ছাফওয়ান বিন উমাইয়া বিন খালাফ যায়েদকে হত্যা করে বদর যুদ্ধে তাদের
স্ব স্ব পিতৃহত্যার বদলা নেয়।[15] কিন্তু আববাদ ইবনু
আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের স্বীয় পিতার সূত্রে উক্ববা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি খুবায়েবকে
হত্যা করিনি। কেননা তখন আমি ছোট ছিলাম। তবে বনু আব্দুদ দারের মিত্র আবু মায়সারা
একটি ছোট বর্শা নিয়ে আমার হাতে ঢুকিয়ে দেয়। অতঃপর সে বর্শা সহ আমার হাত ধরে
খুবায়েবকে আঘাত করে তাকে হত্যা করে’।[16]
শূলে চড়ার আগে খুবায়েব দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করেন এবং বলেন, আমি ভীত হয়েছি, এই অপবাদ তোমরা না দিলে আমি দীর্ঘক্ষণ ছালাত আদায় করতাম। তিনিই প্রথম এই
সুন্নাতের সূচনা করেন। অতঃপর কাফেরদের জন্য বদ দো‘আ করেন এবং মর্মন্তুদ কবিতা বলেন, যা ছহীহ বুখারী সহ বিভিন্ন হাদীছ ও জীবনী গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে। খুবায়েবের
সেই বিখ্যাত দো‘আটি ছিল নিম্নরূপ-اللَّهُمَّ أَحْصِهِمْ عَدَدًا وَاقْتُلْهُمْ بَدَدًا
وَلاَ تُبْقِ مِنْهُمْ أَحَدًا- ‘হে আল্লাহ! তুমি এদেরকে এক এক করে গুণে রাখ। তাদেরকে এক এক
করে হত্যা কর এবং এদের একজনকেও অবশিষ্ট রেখো না’। অতঃপর তাঁর পঠিত সাত বা দশ লাইন কবিতার বিশেষ
দু’টি লাইন ছিল নিম্নরূপ-
وَلَسْتُ أُبَالِي حِينَ أُقْتَلُ مُسْلِمًا* عَلَى أَيِّ جَنْبٍ
كَانَ فِي اللهِ مَصْرَعِي
وَذَلِكَ فِي ذَاتِ الإِلَهِ وَإِنْ يَشَأْ * يُبَارِكْ عَلَى
أَوْصَالِ شِلْوٍ مُمَزَّعِ
‘আমি যখন মুসলিম হিসাবে নিহত হই তখন আমি কোন
পরোয়া করি না যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাকে কোন্ পার্শ্বে
শোয়ানো হচ্ছে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমার মৃত্যু হচ্ছে। তিনি ইচ্ছা করলে আমার
খন্ডিত টুকরা সমূহে বরকত দান করতে পারেন’।[17]
খুবায়েবের সাথী যায়েদ বিন দাছেনাকে হত্যার
পূর্বে আবু সুফিয়ান তাকে বললেন, তুমি কি এটাতে খুশী
হবে যে,
তোমার স্থলে আমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করি এবং
তুমি তোমার পরিবার সহ বেঁচে থাক? তিনি বলেন,لاَ وَاللهِ الْعَظِيمِ مَا
أُحِبُّ أَنْ يَفْدِيَنِي بِشَوْكَةٍ يُشَاكَهَا فِي قَدَمِهِ ‘কখনোই না। মহান আল্লাহর কসম! আমি চাই না যে, আমার স্থলে তাঁর পায়ে একটি কাঁটারও আঘাত লাগুক’। একথা শুনে বিস্মিত
আবু সুফিয়ান বললেন,مَا رَأَيْتُ مِنَ النَّاسِ أَحَدًا يُحِبُّ أَحَدًا كَحُبِّ
أَصْحَابِ مُحَمَّدٍ مُحَمَّدًا ‘মুহাম্মাদের সাথীরা মুহাম্মাদকে যেরূপ
ভালোবাসে সেরূপ কাউকে আমি দেখিনি’।[18]
মৃত্যুর পূর্বে খুবায়েবের শেষ বাক্য ছিল- اللَّهمَّ إنَّا قَدْ
بَلَّغْنَا رِسَالَةَ رَسُولِكَ، فَبَلِّغْهُ الْغَدَاةَ مَا يُصْنَعُ بِنَا ‘হে আল্লাহ, আমরা তোমার রাসূলের
রিসালাত পৌঁছে দিয়েছি। এক্ষণে তুমি তাঁকে আমাদের সাথে যা করা হচ্ছে, সে খবরটি পৌঁছে দাও’।[19]
ওমর (রা.)-এর গভর্ণর সাঈদ বিন ‘আমের (রা.) যিনি খোবায়েবের হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী
ছিলেন,
তিনি উক্ত মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণ করে
মাঝে-মধ্যে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতেন। তিনি বলতেন, খোবায়েবের নিহত হবার দৃশ্য স্মরণ হ’লে আমি
নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। আল্লাহর পথে কতবড় ধৈর্যশীল তিনি ছিলেন যে, একবার উহ্ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। বন্দী অবস্থায় তাঁকে
থোকা থোকা আঙ্গুর খেতে দেখা গেছে। অথচ ঐসময় মক্কায় কোন আঙ্গুর ছিল না’।[20]
দাফন : বীরে মা‘উনার মর্মান্তিক হত্যাকান্ডে বেঁচে যাওয়া
একমাত্র ছাহাবী ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী প্রহরীদের লুকিয়ে অতীব
চতুরতার সাথে খুবায়েবের লাশ এনে সসম্মানে দাফন করেন।[21]
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) উল্লেখ করেন যে, নবী করীম (সা.) মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ ও যুবায়ের ইবনুল
আওয়ামকে প্রেরণ করেন খুবায়েব (রা.)-কে শূলের কাষ্ঠ থেকে নামানোর জন্য। তাঁরা দু’জন তানঈমে পৌঁছে ৪০ জন নেশাগ্রস্ত মাতাল লোক দেখতে পান।
তাঁরা খুবায়েবকে নামান এবং যুবায়ের তাকে স্বীয় ঘোড়ায় উঠিয়ে নেন। তাঁর দেহ তখনও
সজীব ছিল, কিছুমাত্র পরিবর্তিত হয়নি। এ সময় মুশরিকরা
এসে তাঁদেরকে ধমক দিল ও সতর্ক করল। তারা সন্নিকটে চলে আসল, তখন যুবায়ের (রা.) খুবায়েবের লাশ ফেলে দিলেন। যমীন লাশকে
গিলে ফেলল। ফলে তার নামকরণ হ’ল بليع الأرض ‘যমীন কর্তৃক গ্রাসকৃত’।[22]
খুবায়েবের অনুপম ব্যবহার : খুবায়েব যুলকা‘দা মাসে বন্দী হন। এটা ছিল হারাম মাস। এজন্য
তাকে বনু আব্দে মানাফের দাসী মু‘আবিয়ার বাড়ীতে
বন্দী রাখা হয়।[23] অন্য বর্ণনায় আছে, হুজায়েরের দাসী, যিনি পরে মুসলমান হন, তার বাড়ীতে খুবায়েবকে বন্দী রাখা হয়। তিনি
বলেন যে, খোবায়েব আমার বাড়ীতে আটক ছিল। একদিন আমি তাকে
বড় এক থোকা আঙ্গুর খেতে দেখি। অথচ তখন মক্কায় কোন আঙ্গুর ছিল না। তিনি বলেন, হত্যার সময় উপস্থিত হ’লে তিনি
আমাকে বলেন, আমার জন্য একটা ক্ষুর পাঠিয়ে দিন, যাতে হত্যার পূর্বে আমি ক্ষৌরকর্ম করে পবিত্রতা অর্জন করতে
পারি। তখন আমি আমার বাচ্চাকে দিয়ে তাঁকে একটা ক্ষুর পাঠিয়ে দিলাম। পরক্ষণে আমি বলে
উঠলাম,
হায়! আমি এটা কি করলাম? আল্লাহর কসম! লোকটি নিজের হত্যার বদলে আমার বাচ্চাকে হত্যা
করবে। অতঃপর সে বাচ্চার হাত থেকে ক্ষুরটি নিয়ে বলল, তোমার জীবনের কসম! তোমার মা যেন আমার বিশ্বাসঘাতকতার ভয় না করেন, যখন তিনি তোমাকে এই ক্ষুরসহ আমার কাছে পাঠিয়েছেন। অতঃপর সে
বাচ্চাকে ছেড়ে দিল’।[24]
ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন, আমাকে ওবায়দুল্লাহ ইবনু আয়ায অবহিত করেছেন, তাঁকে হারিছের কন্যা জানিয়েছে যে, যখন হারিছের পুত্রগণ খুবায়েব (রা.)-কে শহীদ করার সর্বসম্মত
সিদ্ধান্ত নিল, তখন তিনি তার কাছ থেকে ক্ষৌর কাজ সম্পন্ন
করার উদ্দেশ্যে একটা ক্ষুর ধার চাইলেন। তখন হারিছের কন্যা তাকে একখানা ক্ষুর ধার
দিল। সে সময় ঘটনাক্রমে আমার ছেলে আমার অজ্ঞাতে খুবায়েবের নিকট চলে যায় এবং আমি
দেখলাম যে, আমার ছেলে খুবায়েবের উরুর উপর বসে আছে এবং
খুবায়েবের হাতে রয়েছে ক্ষুর। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। খুবায়েব আমার চেহারা দেখে
বুঝতে পারলেন যে, আমি ভয় পাচ্ছি। তখন তিনি বললেন, তুমি কি এ ভয় কর যে, আমি শিশুটিকে হত্যা করব? কখনও আমি তা করব
না। আল্লাহর কসম! আমি খুবায়েবের মত উত্তম বন্দী কখনো দেখিনি। আল্লাহর শপথ! আমি একদা
দেখলাম,
তিনি লোহার শিকলে আবদ্ধ অবস্থায় ছড়া হ’তে আঙ্গুর খাচ্ছেন, যা তাঁর হাতেই ছিল। অথচ এ সময় মক্কায় কোন ফলই পাওয়া যাচ্ছিল না। হারিছের কন্যা
বলতো,
এ তো ছিল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হ’তে প্রদত্ত
জীবিকা,
যা তিনি খুবায়েবকে দান করেছেন।[25]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, কুরায়েশরা খোবায়েবকে হারেছ বিন ‘আমেরের বাড়ীতে কয়েকদিন বন্দী রাখে। এ সময় তাকে কোন খাদ্য বা
পানীয় দেওয়া হয়নি। একদিন হঠাৎ হারেছ-এর ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটি ধারালো ছুরি নিয়ে
খেলতে খেলতে তার কাছে চলে আসে। তিনি তাকে আদর করে কোলে বসান। এ দৃশ্য দেখে বাচ্চার
মা চিৎকার করে ওঠেন। তখন খোবায়েব বলেন, মুসলমান কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না।
ইবাদত-বন্দেগী : তিনি ছিলেন আল্লাহভীরু, ধার্মিক, আবেদ ও তাপস। তিনি রাত্রে দীর্ঘ ক্বিরাতে তাহাজ্জুদ ছালাত আদায় করতেন।[26] সুন্নাত পালনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অতি আন্তরিক ও সদা
সচেতন। যেমন তিনি ক্ষৌরকর্মের জন্য মৃত্যুর পূর্বে হারেছের কন্যার নিকটে ক্ষুর
চেয়ে নেন। এছাড়া তিনি হারাম-হালালের ব্যাপারে অতি সজাগ ও হুঁশিয়ার ছিলেন। যেমন
হুজায়েরের দাসী যখন জিজ্ঞেস করে তোমার কোন প্রয়োজন আছে কি? তখন তিনি বলেন, আমি তোমার নিকটে ৩টি বিষয় কামনা করি। ১. তুমি আমাকে মদ পান করাবে না, ২. দেব-দেবীর নামে উৎসর্গিত বা যবেহকৃত জিনিস আমার থেকে
দূরে রাখবে, ৩. তারা যখন আমাকে হত্যা করতে চাইবে, তখন তুমি আমাকে অবহিত করবে।[27]
মানাকিব ও কারামাত : খুবায়েবের মর্যাদা সম্পর্কে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, তিনি শাহাদতের অমিয় সুধা পান করেছেন। আর তাঁর কারামাত হ’ল মক্কায় যখন কোন ফল পাওয়া যেত না, তখন তিনি আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক হিসাবে আঙ্গুরের থোকা থেকে
ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছেন।[28]
খুবায়েব (রা.)-এর জীবনীতে উপদেশ
ও শিক্ষা : খুবায়েব (রা.)-এর শাহাদতের ঘটনায় অনেক উপদেশ রয়েছে। এসব
উপদেশ মুসলিম মিল্লাতের জন্য অনুসরণীয়। তার মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
১. নবী করীম (সা.)-এর ছাহাবীগণ আল্লাহর দ্বীন
ও রাসূলের সহযোগিতার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
২. বন্দীত্ব বরণে কল্যাণ মনে করলে মুসলিম
ব্যক্তি তাৎক্ষণিক হত্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য কাফির-মুশরিকের নিকটে বন্দীত্ব বরণ
করতে পারে।
৩. মুশরিকদের শিশু সন্তান ও মুশরিক শিশুদের
হত্যা করা থেকে বিরত থাকা।
৪. এ ঘটনায় কারামাতে আওলিয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট
হয়েছে। যেমন (ক) বিনা মওসুমে খুবায়েরের আঙ্গুর ফল খাওয়া (খ) আছেম বিন ছাবিতের
লাশকে হেফাযত করা। যখন কুরাইশ কাফিরদেরকে এ সংবাদ পৌঁছানো হয় যে, ‘আছেম (রা.)-কে শহীদ করা হয়েছে, তখন তারা তাঁর কাছে এক লোককে পাঠায়, যাতে সে ব্যক্তি তাঁর লাশ হ’তে কিছু অংশ কেটে নিয়ে আসে, যাতে তারা তা দেখে
চিনতে পারে। কারণ বদর যুদ্ধের দিন ‘আছেম (রা.)
কুরাইশদের এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন। ‘আছেমের লাশের (রক্ষার জন্য) মৌমাছির ঝাঁক প্রেরিত হল, যারা তাঁর দেহ আবৃত করে রেখে তাদের ষড়যন্ত্র হ’তে হিফাযত করল। ফলে তারা তাঁর শরীর হ’তে এক খন্ড গোশতও কেটে নিতে পারেনি’।[29]
(গ) তাদের দো‘আয় রাসূলের নিকটে গোয়েন্দা দলের সংবাদ পৌঁছানো। যেমন ‘আছেম (রা.) দো‘আ করেন, اللَّهُمَّ أَخْبِرْ عَنَّا
نَبِيَّكَ. ‘হে আল্লাহ! আমাদের পক্ষ থেকে
আপনার নবীকে সংবাদ পৌঁছে দিন’। খুবায়েব (রা.) দো‘আ করেন, اللَّهمَّ إنَّا قَدْ
بَلَّغْنَا رِسَالَةَ رَسُولِكَ، فَبَلِّغْهُ الْغَدَاةَ مَا يُصْنَعُ بِنَا ‘হে আল্লাহ! আমরা তোমার রাসূলের রিসালাত পৌঁছে দিয়েছি।
এক্ষণে তুমি তাঁকে আমাদের সাথে যা করা হচ্ছে, সে খবরটি পৌঁছে দাও’।[30]
৫. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে যে কোনভাবে পরীক্ষা করতে পারেন। এর মাধ্যমে ঐসব
মুসলিমদের সম্মানিত করতে ও তাদেরকে পুরস্কৃত করতে চান। কেননা মুমিনদের জন্য
আল্লাহর নিকটে প্রত্যাবর্তনই উত্তম, দুনিয়ায় বেঁচে থাকার চেয়ে।
৬. স্বভাবগত সুন্নাতের প্রতি লক্ষ্য রাখা
যরূরী,
সেটা যেকোন প্রতিকূল অবস্থায়ই হোকনা কেন।
৭. যুদ্ধক্ষেত্রে অনুসন্ধানকারী দল থাকা
যরূরী। এ বিষয়ে রাসূল (সা.) বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
৮. শত্রুদের জন্য নিজেদের পরিচয় প্রকাশক কোন
জিনিস ছেড়ে যাওয়া থেকে মুসলিম বাহিনীকে সতর্ক ও সাবধান হ’তে হবে। যেমন ‘আছেম বিন
ছাবিতের দলের ফেলে যাওয়া খেজুরের অাঁটি দেখে মুশরিকরা তাদের গতিপথ জেনে যায়।
৯. তীরন্দাযী যে যুদ্ধক্ষেত্রে অনন্য শক্তি, এ ঘটনা তার প্রমাণ। এতে কাফেররা ৭ জন মুসলিম মুজাহিদকে তীর
নিক্ষেপে শহীদ করে। এজন্য রাসূল (সা.) বলেন,أَلاَ إِنَّ الْقُوَّةَ الرَّمْىُ
‘নিশ্চয়ই শক্তি হচ্ছে তীরন্দাযীতে’।[31]
১০. মুসলিমের সুন্দর আচরণ ও উত্তম চারিত্রিক
বৈশিষ্ট্য প্রকাশের মাধ্যমে ইসলামের অনুপম আদর্শের প্রকাশ ঘটে। যেমন খুবায়েব (রা.)
বনু হারেছের জনৈক মহিলার বাড়ীতে বন্দী থাকাবস্থায় তার ছেলেকে হাতের কাছে পেয়েও
অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দেন। তিনি নিহত হবেন এটা জানার পরও তিনি প্রতিশোধ নেননি। যে
কারণে মহিলা অকপটে স্বীকার করেন,وَاللهِ مَا رَأَيْتُ أَسِيْرًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ خُبَيْبٍ ‘আল্লাহর কসম! আমি খুবায়েবের চেয়ে উত্তম কোন বন্দি কখনও
দেখিনি’।[32]
১১. আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান
করেন। যেমন আল্লাহ খুবায়েবকে রিযক দান করেছিলেন।
১২. কুরাইশরা ‘হারামকে’ সম্মান করত। তারা মুশরিক হওয়া হারামের মধ্যে
বন্দীদেরকেও হত্যা করতো না, বরং তারা তাদেরকে হারাম এলাকার বাইরে নিয়ে যেত।
তারা হারাম মাসেও কাউকে হত্যা করতো না।
১৩. মুসলিম ব্যক্তির নিহত হওয়ার পূর্বে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করা শরী‘আত সম্মত। খুবায়েব (রা.)ই প্রথম এ সুন্নাত চালু করেন।
১৪. মুসলমানদের জন্য কাফিরদের বিরুদ্ধে দো‘আ করা বৈধ। যেমন খুবায়েব (রা.) দো‘আ করেন
اللَّهُمَّ أَحْصِهِمْ عَدَدًا وَاقْتُلْهُمْ بَدَدًا وَلاَ تُبْقِ
مِنْهُمْ أَحَدًا-
১৫. কোন কোন কাফের তাদের বিরুদ্ধে কৃত
মুসলমানদের দো‘আকে ভয় করে। এজন্য দেখা যায়, খুবায়েব (রা.)-এর হত্যা কান্ডের সময় উপস্থিত অনেকেই মূর্ছিত
হয়ে পড়ে। তাদের উপরে খুবায়েবের দো‘আ বিরাট
প্রভাব বিস্তার করে। এমনকি এটা ছিল তাদের কারো কারো ইসলাম গ্রহণের প্রাথমিক কারণ।
১৬. হত্যার সময় কবিতা রচনা ও আবৃত্তি করা
যায়। যেমন খুবায়েব (রা.) করেছিলেন। যা খুবায়েবের ঈমানী শক্তি ও দ্বীনের উপরে
দৃঢ়তার প্রমাণ বহন করে।
১৭. এতে মুসলমানের দো‘আ কবুল হওয়া এবং জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর তাদের সম্মানিত
হওয়ার প্রমাণ মেলে। যেমন- ‘আছেম-এর লাশ আনার জন্য কুরায়েশ নেতারা লোক
পাঠান। কিন্তু আল্লাহ তার লাশের হেফাযতের জন্য এক ঝাঁক ভীমরুল প্রেরণ করেন। ফলে
মুশরিকরা তার লাশের নিকটে যেতে পারেনি। কেননা ‘আছেম
আল্লাহর নিকটে অঙ্গীকার দিয়েছিলেন,لاَ يَمَسَّهُ مُشْرِكٌ، وَلاَ يَمَسَّ مُشْرِكًا
أَبَدًا فِي حَيَاتِهِ ‘যেন কোন মুশরিক তাকে স্পর্শ না করে এবং তিনিও
কোন মুশরিককে তাঁর জীবদ্দশায় কখনো স্পর্শ না করেন’। পরে ওমর (রা.) বলেন,مَنَعَهُ اللهُ بَعْدَ
وَفَاتِهِ، كَمَا امْتَنَعَ مِنْهُ فِي حَيَاتِهِ ‘আল্লাহ তাঁকে মুশরিকের স্পর্শ থেকে মৃত্যুর পরেও হেফাযত
করেছেন,
যেমন তাকে জীবিত অবস্থায় হেফাযত করেছিলেন’।[33]
আর আল্লাহ মুসলমানদের হত্যা করা থেকে
কাফেরদের বাধা দেন না। কেননা তিনি শাহাদতের মাধ্যমে মুসলমানদের সম্মানিত করতে চান।
১৮. এ ঘটনায় আরো প্রমাণিত হয় যে, খিয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতা কাফেরদের বৈশিষ্ট্য। যেমন তারা
আব্দুল্লাহ বিন তারেককে হত্যা করে এবং খুবায়েব ও যায়েদকে কুরাইশদের নিকটে বিক্রি
করে দেয়।[34]
উপসংহার : খুবায়েব (রা.)-এর শাহাদতের ঘটনা মুসলিম উম্মাহর জন্য স্মরণীয় এক অনন্য ঘটনা।
আত্মত্যাগের এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। অসীম সাহসী, ইবাদত গুযার, সুন্নাতের পাবন্দ ও ইসলামের উপর দৃঢ়পদ এ ছাহাবীই মৃত্যুকালে নফল ছালাত আদায়ের
সুন্নাত চালু করেন। তিনিই প্রথম মুসলিম, যাকে শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। তাঁর জীবনী থেকে মুসলিম জাতির জন্য অনেক
শিক্ষা ও উপদেশ রয়েছে। এগুলি আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা ইহকালীন ও
পরকালীন জীবনে সফলতার সোনালী সোপানে আরোহণ করতে পারব; সফলতা লাভ করতে পারব জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ পেয়ে; কামিয়াবী হাছিল করতে পারব জান্নাতে দাখিল হয়ে। আল্লাহ
আমাদের সকলকে উভয় জীবনে সফলতা দান করুন-আমীন!
[1]. ইবনু আবদিল বার্র, আল-ইস্তি‘আব ১/১৩০ পৃঃ।
[2]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৩/১৫৩।
[3]. ছালাহুদ্দীন আছ-ছাফাদী, আল-ওয়াফী বিল ওয়াফিয়াত, (বৈরূত : দারু ইইয়াইত তুরাছ ১৪২০/২০০১ খ্রিঃ), ১৩/১৭৮ পৃঃ।
[4]. সীরাতে ইবনে হিশাম, ১/৩০০, টীকা নং ২; আল-ইছাবাহ ১/৪১৪; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৩/১৫৩।
[5]. অন্য বর্ণনায় এসেছে, মারছাদ বিন
আবী মারছাদ আল-গানাভী-র নেতৃত্বে। দ্রঃ ইবনু হিশাম ২/১৬৯।
[6]. বুখারী হা/৩০৪৫, ৩৯৮৯।
[7]. ইবনু হিশাম ২/১৭৬।
[8]. বুখারী হা/৩০৪৫, ৩৯৮৯।
[9]. আল-ইস্তি‘আব ১/১৩০; তাকীউদ্দীন আল-মাকরীযী, ইবনু হিশাম ২/১৭২; ইমতাউল আসমা‘ (বৈরূত : দারুল
কুতুবিল ইলমিয়া, ১৪২০হিঃ/১৯৯৯খ্রিঃ), ১/১৮৬।
[10]. ইমতাউল আসমা‘, ১/১৮৬।
[11]. আল-ইস্তি‘আব ১/১৩০।
[12]. বুখারী হা/৩০৪৫, ৩৯৮৯।
[13]. আল-বিদায়াহ ৪/৬৫-৬৬।
[14]. বুখারী হা/৩০৪৫।
[15]. ইবনু হিশাম ২/১৭৬।
[16]. আল-বিদায়াহ ৪/৬৬; সীরাতে ইবনে কাছীর
৩/১৩০; রওযুল উনফ, ৬/১৩২।
[17]. ইবনু হিশাম ২/১৭৬; বুখারী
হা/৩০৪৫, ৩৯৮৯।
[18]. সীরাতে ইবনে হিশাম, ২/১৭২; সীরাতুল হালাবিয়া, ৩/১৬৪; সীরাতু ইবনে কাছীর
৩/১২৫।
[19]. ইবনু হিশাম ২/১৭২।
[20]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (সা.), পৃঃ ৩৯৪।
[21]. আর-রহীকুল মাখতূম, ১/২৬৬; আল-বিদায়াহ ৪/৬৬।
[22]. আল-ইছাবাহ, ২/২২৬ পৃঃ; আয-যুরকানী, শারহুয যুরকানী আলাল মাওয়াহিব, ২/৪৯৩।
[23]. ইমতাউল আসমা‘, ১/১৮৬।
[24]. ইবনু হিশাম ২/১৭২।
[25]. বুখারী হা/৩০৪৫, ৩৯৮৯।
[26]. ইমতাউল আসমা‘, ১৩/২৭৬; সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৬/৪৩।
[27]. ফৎহুল বারী ৭/৩৮২; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১/২৪৯।
[28]. বুখারী হা/৩০৪৫।
[29]. বুখারী হা/৩০৪৫, ৩৯৮৯।
[30]. ইবনু হিশাম ২/১৭২।
[31]. মুসলিম হা/১৯১৭; আবু দাউদ
হা/২৫১৪; মিশকাত হা/৩৮৬১।
[32]. বুখারী হা/৩০৪৫, ৩৯৮৯, ৪০৮৬।
[33]. ইবনু হিশাম ২/১৭১।
[34]. ফাতহুল বারী ৭/৩৮৩-৮৪; মুহাম্মাদ আলী আছ-ছাল্লাবী, আস-সীরাতুন নাবাবিয়াহ, ১/৫৩৫-৩৭।
আসহাবে রাসূলের জীবন কাহিনী
-এম এ রাজ্জাক হাওলাদার
জীবন কাহিনী-(২০)
জাবের ইবনু আব্দিল্লাহ (রা.)-এর উটের
ঘটনা
প্রখ্যাত ছাহাবী
জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা.)-এর দুর্বল উটকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর
মু‘জেযা এবং জাবের (রা.)-কে রাসূল (সা.) কর্তৃক সহযোগিতার এক
অনন্য দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছে নিম্নোক্ত হাদীছে।
জাবের বিন
আব্দুল্লাহ হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে যাতুর রিকা‘ অভিযানে বের হই। আমার একটি দুর্বল উটের পিঠে চড়ে আমি বের
হয়েছিলাম। অভিযান শেষে ফেরার পথে আমার সাথী-সঙ্গীরা দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। আর আমি
দুর্বল উটের কারণে বার বার পিছিয়ে পড়ছিলাম। এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) পেছনে
থেকে অগ্রসর হয়ে আমার নিকট পৌঁছে গেলেন। তিনি আমাকে বললেন, জাবের! ব্যাপার কী? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমার এই উট আমাকে
পেছনে ফেলে রেখেছে। তিনি বললেন, উটটিকে বসাও। জাবের
(রা.) বললেন, আমি আমার উটটিকে বসালাম এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)
ও তাঁর বাহন থামালেন।
তিনি আমাকে বললেন, তোমার হাতের ছড়িটি আমাকে দাও অথবা একটি গাছের ডাল ভেঙ্গে
এনে আমাকে দাও। আমি তাই করলাম। তিনি সেটি দ্বারা উটকে কয়েকটি খোঁচা মারলেন। তারপর
আমাকে বললেন, এবার তুমি উটের পিঠে বস। আমি উটের পিঠে
উঠলাম। উটটি চলতে শুরু করল। যে মহান সত্তা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সত্য সহকারে
পাঠিয়েছেন, তাঁর কসম করে বলছি, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উটের সাথে তখন আমার উটটিও চলতে থাকে।
আমি চলতে চলতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে আলাপ করছিলাম। তিনি বললেন, হে জাবের! তুমি কি এই উটটি আমার কাছে বিক্রি করবে? আমি বললাম, জ্বী না, বিক্রি করব না; বরং সেটি আপনাকে উপঢৌকন স্বরূপ দিয়ে দেব। তিনি বললেন, না, দান নয়; বরং সেটি আমার নিকট বিক্রি করে দাও।
এবার আমি বললাম, তবে মূল্য নির্ধারণ করুন। তিনি বললেন, ঠিক আছে এক দিরহামের বিনিময়ে আমি উটটি গ্রহণ করলাম। আমি
বললাম,
না ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! তাহ’লে আমি ঠকে যাব। তিনি বললেন, তবে দু’দিরহামে? আমি বললাম, না তাও নয়। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) অনবরত দাম
বৃদ্ধি করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত বললেন, এক উকিয়া তথা চল্লিশ দিরহামের বিনিময়ে। আমি বললাম, তাতে কি আপনি খুশি? তিনি বললেন, হ্যাঁ আমি খুশি। আমি বললাম, তাহ’লে আপনি এই উটের মালিক হ’লেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি তা গ্রহণ করলাম। এরপর তিনি বললেন, হে জাবের! তুমি কি বিয়ে করেছ? আমি বললাম, জ্বী হ্যাঁ ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! তিনি
জিজ্ঞেস করলেন, কুমারী না কি বিবাহিতা? আমি বললাম, বিবাহিতা। তিনি
বললেন,
কুমারী বিয়ে করলে না কেন? তাহ’লে তুমি তার সাথে আনন্দ করতে সেও তোমাকে নিয়ে
আনন্দ করত। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা.)! আমার আববা ওহোদ
যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তিনি ৭টি কন্যা সন্তান রেখে গেছেন। তাই আমি একজন বয়স্কা মহিলা
বিয়ে করেছি, যাতে সে ওদেরকে দেখাশোনা ও তত্ত্বাবধান করতে
পারে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি ঠিক কাজটিই
করেছ ইনশাআল্লাহ। আমরা যখন ‘সিরার’ নামক স্থানে পৌঁছব, তখন আমি উট যবেহ করার নির্দেশ দেব। সেখানে উট যবেহ হবে এবং সেখানে আমরা একদিন
থাকব। ঐ দিন আমরা ওখানে থাকব। তোমার স্ত্রী আমাদের আগমন সংবাদ শুনলে তার গদিগুলো
ঝেড়ে নেবে।
আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! আমাদের তো কোন গদি নেই। তিনি বলেন, এখন না থাকলেও তখন থাকবে। আর তুমি যখন স্ত্রীর নিকট যাবে
তখন বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) সহ আমরা ‘সিরার’ নামক স্থানে
পৌঁছালাম। তিনি উট যবেহ করার নির্দেশ দিলেন। উট যবেহ করা হ’ল। আমরা সেদিন ওখানে থাকলাম। সন্ধ্যায় রাসূলুল্লাহ (সা.) ও
আমরা সকলে মদীনায় প্রবেশ করলাম। বাড়ি গিয়ে আমার স্ত্রীকে আমি সব খুলে বলি। সে বলল, ঠিক আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর
নির্দেশ শিরোধার্য। সকালে আমি উটটি নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা
করি। তাঁর দরজায় গিয়ে আমি উটটিকে বসিয়ে দিই। তারপর নিজে মসজিদে গিয়ে তাঁর কাছেই
বসি। রাসূলুল্লাহ (সা.) কক্ষ থেকে বের হয়ে উটটি দেখতে পান। তিনি বললেন, এটি কার উট? ব্যাপার কি? লোকজন বলল, এটি জাবেরের উট। তিনি নিয়ে এসেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, জাবের কোথায়? আমাকে ডাকা হ’ল। তারপর তিনি আমাকে বললেন, ভাতিজা! তুমি তোমার উটটি ধর এবং নিয়ে যাও। এটি তোমারই থাকবে।
এরপর তিনি বিলাল (রা.)-কে ডেকে বললেন, যাও, জাবিরকে এক উকিয়া (৪০ দিরহাম) দিয়ে দাও।
জাবের (রা.) বলেন, আমি বিলালের সাথে গেলাম। তিনি আমাকে এক উকিয়া
দিলেন,
বরং কিছুটা বেশী দিলেন। আল্লাহর কসম! সেটি
আমার নিকট ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আমার পরিবারের মধ্যে মুদ্রাটির একটি আলাদা
মর্যাদা ছিল। অবশেষে ‘হাররা’ দিবসের বিশৃঙ্খলায় সেটি হারিয়ে যায়’ (মুসনাদে আহমাদ
হা/১৫০৬৮, সনদ হাসান; বুখারী হা/২০৯৭; মুসলিম হা/৭১৫; আল-বিদায়াহ
ওয়ান নিহায়াহ, ৪/৯৯-১০০ পৃঃ)।
শিক্ষা :
১. পণ্য
ক্রয়-বিক্রয়ে দাম-দর করা যায় এবং দাম বৃদ্ধি করা যায়।
২. নির্দিষ্ট দামে
পণ্য ক্রয় করার পর বিক্রেতাকে কিছু বেশী দেওয়া যায়।
৩. কর্মীর খোঁজ-খবর
নেওয়া এবং তার অবস্থা পরিবর্তনের জন্য দান করা যায়।
৪. নিজের প্রয়োজন
থাকা সত্ত্বেও অন্য ভাইয়ের জন্য দান করা। যেমন জাবের (রা.) স্বীয় উটটি রাসূল (সা.)-কে
দিতে চেয়েছিলেন।
৫. স্বামীর সন্তান
ও পরিবার-পরিজনের সেবাযত্ন করা স্ত্রীর কর্তব্য।
৬. কুমারী মহিলা
বিবাহ করা মুস্তাহাব। বিধবা মহিলাকে বিবাহ করা গুরুত্ববহ।
আল্লাহ আমাদের
সবাইকে উক্ত হাদীছ থেকে শিক্ষা গ্রহণের তাওফীক্ব দিন-আমীন!
No comments:
Post a Comment
razzakhowlader59@gmil.com